মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
| শেষ পর্ব |
তরুর পড়ার টেবিলের উপর যে সফেদ রঙা যন্ত্রটা পড়ে আছে তার নাম হেয়ার ড্রায়ার। হেয়ার ড্রায়ারটা দুইদিন যাবৎ টেবিলের উপর বড়ো অবহেলা নিয়ে পড়ে আছে, তরু যন্ত্রটা ব্যবহার করেনি। জিনিসটা কী করে ব্যবহার করতে হয় সেটাও অবশ্য জানে না। আজকালকার যুগে ‘জানি না’ বলে কোনো ব্যাপার নেই। ইউটিউব ঘাটলেই সব ‘জানি না’ ‘জানি হ্যাঁ’ হয়ে যায়। তরুর মধ্যে ‘জানি না’-কে ‘জানি হ্যাঁ’ করার কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। রাতের আঁধারের মতো বিশাল কেশ ভার এই বৈদ্যুতিক যন্ত্র দিয়ে শুকাতে বসা অত্যন্ত ধৈর্যের কাজ। এতো ধৈর্য তরুর প্রাণে সইবে না। মাহবুব আশেপাশে থাকলে অবশ্য এই ভীষণ পরিশ্রমের কাজটা খুব আগ্রহ নিয়ে করানো যেতো। পিঠের উপর কেশরাশি মেলে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলতো,
‘ এই যে ভদ্রলোক? চুল শুকিয়ে দাও দেখি। হেয়ার ড্রায়ার কিনে দিয়ে তো মনে হচ্ছে একদম ওলি-আউলিয়া পর্যায়ে চলে গিয়েছো। বউয়ের ভেজা চুল যে শুকাতে হবে সে খেয়ালও থাকে না, আশ্চর্য!’
মাহবুব তখন কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাতো? সেকি সত্যি সত্যিই আয়োজন করে চুল শুকাতে বসতো? তরুর হঠাৎ করেই চুল ভিজিয়ে মাহবুবের সামনে গিয়ে বসতে ইচ্ছে হলো। ‘ ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়’ — প্রবাদটা বড়ো ভ্রান্ত বলেই হয়তো তরুর ইচ্ছেটা পূরণ হলো না। তরু দুইদিন হলো শ্বশুরবাড়ি থেকে হলে এসেছে। হলে এসেছে অত্যন্ত টেকনিক খাটিয়ে। মাহবুবকে জানতে দেওয়া হয়নি। গোটা ব্যাপারটাতে মাহবুবের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছে তরু জানে না। সে বউয়ের জন্য ছুটি নিয়েছে অথচ বউ তাকে ফাঁকি দিয়ে উড়ে গিয়েছে। বিরক্ত হওয়ার কথা। মাহবুব উড়ে যাওয়া পাখিকে ফোন করে গম্ভীর কণ্ঠে শুধিয়েছে,
‘ তোমার এখন হলে থাকাটা কী খুব জরুরি তরু?’
তরু জানিয়েছে,
‘ অবশ্যই জরুরি। ওখানে আমার পড়াশোনা কিছু হচ্ছে না।’
‘ তুমি হলে যেতে চাও সেটা আমাকে বললে হতো না?’
তরু হেসে বললো,
‘ আমি তো ওখানে যাওয়ার সময়ও তোমাকে বলিনি মাহবুব।’
মাহবুব কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন কেটেছে। অর্থাৎ, তরুর সাথে কথা বলার সকল ইচ্ছে তার বাষ্পীভূত হয়েছে। তার পরের দুইদিন মাহবুব তার সাথে কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। এমন একটা অবস্থায় মাহবুবের সামনে চুল ভিজিয়ে বসে যাওয়া অসম্ভব। কেবল ইচ্ছে নয় মহা-ইচ্ছে থাকলেও অসম্ভব। তরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মাহবুবের সাথে ঝামেলাটা সে ইচ্ছে করেই করেছে। মাহবুব আশেপাশে থাকলে তার ভেতরে যে আশ্চর্য পরিবর্তন হয়, সেই পরিবর্তনটা তরুকে খুব বিরক্ত করছে। তরু খেয়াল করেছে, মাহবুবের প্রতি তার অভিমানগুলোও আপনা-আপনিই কমে যাচ্ছে। কেন কমছে, সেটা অবশ্য রহস্য। তরু বুঝতে পারছে না, নারী মনের অভিমান এতো ঠুনকো হবে কেন? যে পুরুষ তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না তাকেই উজার করে দিতে চাইবে কেন?
কেন? কেন? কেন?
চৈত্রের আকাশে সফেদ রঙা মেঘ উড়ছে। পর্দাহীন খোলা জানালায় বয়ে যাচ্ছে চৈত্রের গরম হাওয়া। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। রুগ্ন নিষ্প্রভ বধূর মতোই ম্লান তার আলো। সেই আলো-আঁধারির খেলায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা তরুকে দেখায় গাছের মতোই রহস্যময়। স্থির, শান্ত, বিষণ্ণ। মনের ভেতর ছুটে চলে সংসার জীবনের দ্বন্দ্ব। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে তরু। কিছু একটা খোয়া গিয়েছে তার। অথচ সেই হারিয়ে যাওয়া জিনিসের প্রতি তরুর কী বৈরাগ্য। আনন্দ। মনের কোথাও যেন চাপা উচ্ছ্বাস। কীসের সেই উচ্ছ্বাস? নিজেকে বুঝতে না পেরে পাথরের প্রতিমার মতো শীতল হয়ে আসে তরুর চোখ। নিজের মনে শুধায়,
‘ প্রিয় মেঘ? বলো দেখি, কেন আমার এই লুকোনো উচ্ছ্বাস? কেন আমি এতো বিষণ্ণ?’
মেঘেরা রহস্য করে হাসে। তাদের ঝংকার তোলা হাসিতে ঝিম ধরে যায় কান। তরুর খেয়াল হয়। মেঘ নয়, তরুর বেয়ারা মোবাইলটা বড়ো জ্বালাতন করছে। তরু ফোন তুললো। ওপাশ থেকে সজলের উচ্ছল কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে,
‘ তো, শ্বশুরবাড়ি কেমন লাগছে, শ্যালিকা?’
‘ শ্বশুর বাড়ি কেমন লাগছে বলতে হলে শ্বশুর বাড়ি থাকতে হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো আমি শ্বশুর বাড়িতে নেই, তাই বলতে পারছি না।’
সজল অবাক হয়ে বললো,
‘ সেকি! তুমি তাহলে কোথায়?’
তরু নির্বিকার কণ্ঠে বললো,
‘ রাস্তায়। রাস্তা ধরে হাঁটছি। ঘুম থেকে উঠেই শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। ভাবছি আপনার কাছে যাবো। ঘুমাবেন না, জেগে থাকুন।’
সজল দিশেহারা কণ্ঠে বললো,
‘ বলছো কী! পালিয়ে এসেছো মানে কী? শ্বশুর বাড়ি কী পালিয়ে আসার জায়গা? তুমি একজেক্টলি আছোটা কোথায়? যেখানেই থাকো ভুলেও আমার বাসায় আসবে না। আমি বাসায় একা, তোমার আপা গিয়েছে বাপের বাড়ি। আমি তোমার আপাকে এক্ষুনি ফোন করছি। তুমি যেখানে আছো সেখানে থাকো। আমি কোনো একটা ব্যবস্থা করছি।’
তরু গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ কোনো ব্যবস্থা করার দরকার নেই। আমি আপনার বাসাতেই উঠবো। কাল সকালে আমার সাথে থানায় যাবেন। সম্মানিত এএসপি মাহবুবুর হাসান নীরবের নামে নারী নির্যাতনের অভিযোগে একটা মামলা করা হবে।’
সজল এবার ঘামতে লাগলো। হতভম্ব কণ্ঠ বললো,
‘ নারী নির্যাতনের মামলা মানে কী? আমাকে বিশ্বাস করতে বলো না যে, মাহবুবের মতো মানুষ তোমাকে নির্যাতন করেছে?’
‘ মাহবুবের মতো মানুষ বলে তো আপনি তাকে সাধু সন্ন্যাসী লেভেলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। শুনুন সজল ভাই, আপনারা তাকে সাধু সন্ন্যাসী লেভেলের মানুষ ভাবলেও সে আসলে তা নয়। সে হলো মাংসাশী প্রাণী। পাশের বাড়ির কচি মেয়ের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক আছে। আমার মতো বুড়ো মেয়ে তার পছন্দ নয়। এইযে আমাকে ধোঁকা দিলো, এটা নির্যাতন নয়?’
সজলের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। একের পর এক ভয়াবহ খবরে তার বুক ধরফর করছে,
‘ তুমি বুড়ো মেয়ে?’
তরু নির্বিকার কণ্ঠে বললো,
‘ বুড়োই তো। যার ষোল-সতের বছরের মেয়ে পছন্দ। তার কাছে একুশ বছরের মেয়ে বুড়ো হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
সজল অবিশ্বাসের কণ্ঠে বললো,
‘ অসম্ভব! মাহবুবের মতো মানুষ এমন একটা জঘন্য কাজ করতেই পারে না।’
‘ আপনি নিজেই তো প্রেম করে বিয়ে করেছেন। আপনি নিজে প্রেম করে, মাহবুবের প্রেমকে জঘন্য বলছেন। আপনি তো দারুণ হিপোক্রেট! আপনার নামেও মামলা করা উচিত।’
সজল মিনমিন করে বললো,
‘ বিয়ের আগে প্রেম আর বিয়ের পর বউ রেখে প্রেম কী এক হলো?’
তরু বললো,
‘ এখানেও আপনাদের দোষ। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো না চাইতেই আচমকা ধরে বেঁধে বিয়ে দিলে এমনই হবে। আমার উচিত আপনাদের সবার নামে মামলা দেওয়া। কাল সকালে আমার সাথে থানায় যাবেন। আপনি না মেজিস্ট্রেট? কানেকশন তো থাকার কথা। কঠিন একটা মামলা সাজাবেন। এক মামলাতেই এএসপি কাইত।’
সজল দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
‘ আমি মেজিস্ট্রেট হলে তোমার বর এএসপি। তিন চার বছরের বেশি হলো চাকরি করছে। গ্রোথ ভালো। প্রমোশন হয়ে যাবে। থানায় আমার থেকেও ওর কানেকশন বেশি। তুমি পুলিশের ঘরে যাবে পুলিশের নামে মামলা করতে? মাহবুব তোমাকে মার্ডার কেসে ফাঁসিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিবে।’
‘ তারমানে আপনি বলছেন, মাহবুব ফাঁসাফাঁসি ধরনের ছেলে?’
সজল বিপদগ্রস্ত কণ্ঠে বললো,
‘ না, না। তা কেন? মাহবুব অত্যন্ত ভালো ছেলে।’
‘ ভালো ছেলে হলে ফাঁসাবে কেন? ভালো ছেলেরা কাউকে ফাঁসায়? ভালো ছেলেরা অভিযোগ মাথা পেতে নেয়। লজ্জিত হয়। আপনি দরজা খুলে অপেক্ষা করুন। ভালো ছেলের ভালোগিরি ছুটানোর ব্যবস্থা আমি করছি।’
তরু ফোন কেটে দিলো। মাহবুবের সাথে বিয়ে হওয়ার পর তার কতিপয় অধঃপতনের মাঝে একটি উল্লেখযোগ্য অধঃপতন হলো সে এখন পানির মতো গলগল করে মিথ্যা বলতে পারছে। তরু ফোনটা পাশে ফেলে বিছানায় টান টান হয়ে শুলো। তরুর ধারণা ঠিক থাকলে সজল এখন চারুর ফোনে লাগাতার ফোন দিচ্ছে। টেনশনে তার হাত-পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তরুর দুঃখ, সমুদয় সমস্যা এই পৃথিবীর যেসকল পুরুষকে একটু অন্যরকমভাবে স্পর্শ করে তাদের মধ্যে সজলের নাম বেশ উল্লেখযোগ্য জায়গায় আছে। সজল বাস্তবিকই তরুকে ভীষণ স্নেহ করে। বিষয়টা তরু জানে, বুঝে এবং জ্বালাতন করে।
কান থেকে মোবাইল টেলিফোন নামানোর মিনিটখানেক পরই আবারও ঝনঝন করে বেজে উঠলো সেই বেয়ারা যন্ত্র। তরু অনুভূতিশূন্য হাতে কল তুললো। ওপাশ থেকে সরব ফিসফিস করে বললো,
‘ ভাবী? ভাইয়া আর তোমার প্রেমের ব্যাপারটা কতটুকু এগুলো? তোমাদের প্রেমটা হলো নাকি এখনও ঝুলছে?’
তরু বললো,
‘ ঝুলছে।’
‘ এই ঝুলাঝুলির ব্যাপারটা আর কতদিন চলতে হবে?’
তরু গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ বলা যাচ্ছে না। প্রেম তো কোনো হিসেব- নিকেশের বিষয় না। সারাজীবনও ঝুলাঝুলি অব্যহত থাকতে পারে। তাছাড়া গরু টাইপের মানুষের প্রেম হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। এদিকে তোমার ভাই হলো উন্নতমানের গরু।’
সরব উত্তরে কিছু বললো না৷ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো,
‘ তুমি কী ভাইয়ার সাথে রাগ করে চলে গিয়েছো ভাবী? আর আসবে না?’
তরু ম্লান হেসে বললো,
‘ তোমার তাই মনে হচ্ছে?’
‘ হ্যাঁ। ভাইয়া তোমার প্রেমে পড়েনি বলে মন খারাপ?’
তরু হাসলো। বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ প্রেম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার সরব। আমরা কারো প্রেমে পড়তে পারি। কিন্তু সে প্রেম দ্বিগুণ হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসছে না বলে মন খারাপ করতে পারি না।’ কিন্তু কী করে বলবে? তার নিজেরই যে মন খারাপ হচ্ছে! সরব ভাবীকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো,
‘ ভাবী? আমরা ভাইয়াকে প্রেমে ফেলার জন্য নতুন কোনো টেকনিক ইউজ করতে পারি। প্রেমে পড়ার বিকল্প কিছু পন্থা বলো দেখি। কঠিন কঠিন পন্থা বলবে। সহজ পন্থা ব্যবহারে ঝুঁকি আছে, ভাইয়া ধরে ফেলবে।’
তরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
‘ তোমার ভাই সব টেকনিকের উর্ধে। এসব টেকনিকে গরু মাহবুব ছাগল মাহবুব হবে না।’
সরব হতাশ কণ্ঠে বললো,
‘ উফ! ভাইয়াকে প্রেমে ফেলা দেখি ম্যাথমেটিকসের থেকেও হার্ড! আচ্ছা, ভাবী? কালো জাদু করে কী প্রেমে ফেলা যায়? ধরো, আড়াইশো টাকা বাজেট, এর মধ্যেই একটা শক্ত জাদু করে ফেললাম? হবে না?’
তরু হেসে ফেললো। কণ্ঠস্বর গম্ভীর করে বললো,
‘ আইডিয়াটা খারাপ না। কিন্তু এভাবে কাউকে জোর করে প্রেমে ফেলা অন্যায় হয়ে যাচ্ছে না?’
‘ অন্যায় হলেও খুব বড়ো অন্যায় হওয়ার কথা না। অযথা তোমার মন খারাপ করিয়ে দেওয়াটাও তো ভাইয়ার অন্যায় হচ্ছে। অন্যায়ে অন্যায়ে কাটাকাটি। তাছাড়া আমি তো খুব ভালো ছেলে না। এটুকু অন্যায়ে মোটামুটির গণ্ডী পেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। ভাইয়া নিশ্চয় তোমার প্রেমে পড়বে, তুমি একদম মন খারাপ করে থেকো না।’
তরুর হঠাৎই মন খারাপ হয়ে গেলো। কী আশ্চর্য, পৃথিবীর সকলে তাকে নিয়ে এতো ভাবে কেবল মাহবুব ভাবে না। কেন ভাবে না? তরু ডানহাত মুখের সামনে এনে হাই তুললো। হাট করে খোলে রাখা জানালা দিয়ে দূরের ওই আকাশের দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ। মুক্তোর মতো একটি দুটো তারা ফুটেছে। হলের পাশের লম্বা মাথার নারকেল গাছটায় চৈত্র মাসের হাওয়া লেগেছে। স্তব্ধ প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাথা দোলাচ্ছে গেরুয়া পরা বাউলের মতো। তরুর আঁধার রঙা চুল শয্যা ছাড়িয়ে গড়াগড়ি খায় মেঝেতে। আঁচল সরে যায়। শুভ্র উদরখানা দেখায় চাঁদের আলোর থেকেও উজ্জ্বল। মোমের মতো পা’জোড়া বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসে ভারী সোনার নূপুর৷ এ নূপুর জোড়া তরুর শাশুড়ীমা দিয়েছিলেন বড়ো ভালোবেসে। তরু নুপুর হাতে নিজেদের শোবার ঘরে এসে নিটোল পা’জোড়া দোলাতে দোলাতে বাঁকা চোখে চেয়ে বলেছিলো,
‘ পুলিশ অফিসার বিয়ে করলে নাকি জীবনের ছোটখাটো সমস্যা সমাধান হয়ে যায় চট করে। তা বলি, নূপুরটা যদি ঝুঁকে ঝুঁকে নিজেরই পরতে হয় তাহলে বাবা আমায় ওমন মিথ্যে লোভ দেখিয়ে বিয়ে দিলেন কেন? আশ্চর্য!’
মাহবুব বেরুনোর জন্য তৈরি হচ্ছিলো। তরুর কথার প্রত্যুত্তরে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে চোখ তুলে তরুর দিকে চাইলো। তরু উদাস মুখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মনোযোগী চোখজোড়া স্থির করলো জানালার বাইরে এক চিলতে আকাশের ওপর। মাহবুব এগিয়ে এসে কী যত্ন করেই না নূপুর পরালো তরুর পায়ে! তরু চমকে উঠলো। ফিরে তাকালো। মাহবুবকে গ্রাহ্য না করে হৃদপিণ্ডের সাথে সাথে পা দুলিয়ে দুলিয়ে পায়ে তুললো ঝংকার তোলা সুর। চারপাশে যেন বেজে উঠলো কোনো কিশোরীর বাঁধভাঙা হাসির মোহনিয়া রব। মাহবুব তরুর উদাসীন্যকে পরোয়া না করেই তরুর মুখের কাছে মুখ নুয়ালো। তরুর নিঁখুত নাকের একমাত্র কলঙ্ক হয়ে থাকা ছোট্ট রন্ধ্রে বসিয়ে দিলো সরু, ছোট্ট এক মুক্তো দানা। তরুর নিঁখুত নাকের উপর তা দেখালো আকাশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছিনিয়ে আনা ঝলমলে তারার মতো। তরুর হৃৎস্পন্দন থমকে গেলো। এই বুঝি মাহবুব মুগ্ধতায় বাক্য হারায়। তরুকে বলে,
‘ তরু তোমাকে আকাশের মতো সুন্দর লাগছে। নাকফুলটাকে লাগছে আকাশের বুকে ছোট্ট তারা।’
গরু মাহবুব অবশ্যই ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করেনি। তরুর মন ভেঙে দিয়ে সে করেছে গরুর মতো ব্যবহার। তরুর নাকের দিকে কয়েক পলক ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে নাকফুলের ছোট্ট কুচিখানা তরুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছে,
‘ এটা লাগাবো কীভাবে? লাগিয়ে নাও তো!’
তরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আকাশের মতো তার বুকের মধ্যেখানেও গাঢ় বিষণ্ণতার আঁধার নামে। প্রকৃতি দোয়াত ভাঙা কালি ঢেলে সন্ধ্যা আঁকতেই মাহবুবের জন্য মন কেমন করে। মাহবুবের গন্ধে গন্ধে আচ্ছন্ন থাকা সন্ধ্যাটা শূন্যতায় খা খা করে। খা খা করলেও উপায় নেই। মাহবুব সম্পর্কে তরুর কাছে কিছু অমীমাংসিত রহস্য আছে। সে রহস্যের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এসব খা-খা, ফা-ফা এর দাম দেওয়া হবে না। একদমই না। তরু বুক ভর্তি শূন্যতা নিয়েই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো। এলো শাড়ি, এলোচুলের মেঘকুমারী চোখের পলকে ঘুমকুমারী হলো। জানালা দিয়ে বয়ে গেলো রাত্রিকালের দীর্ঘশ্বাস!
কে যেন বলেছিলো, প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। বিষয়টা বোধহয় সত্য। সেই শূন্যতা পূরণ করতেই তরুর বুক ভরিয়ে দিয়ে স্বপ্নের দুয়ারে মাহবুবের দেখা মিললো। মাহবুব তার ঘরের আরাম কেদারায় বসে বই পড়ছে। কোনো কারণে তার মুখখানা শুকনো, বিষণ্ণ। তরু সবসময়ের মতো বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো। তার পায়ে টকটকে লাল আলতা। পায়ে টিনের চালে পড়া বৃষ্টির মতোই শিঞ্জিনী ধ্বনি। ভারী চুলের বহরও ঝুলছে শয্যা বেয়ে বেশ খানিকটা নিচ পর্যন্ত। পান খেয়ে লাল টুকটুকে ঠোঁট। তরু টকটকে ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসি হাসলো। নুপুর পরা পা জোড়া দোলাতে দোলাতে শুধালো,
‘ তুমি এতো মন খারাপ করে বই পড়ছো কেন মাহবুব? বইয়ের মোলাটটা কী হাসিখুশি! এমন হাসিখুশি বই পড়ে বুঝি মন খারাপ করতে হয়?’
মাহবুব বললো,
‘ আমি তো বই পড়ছি না তরু। তোমাকে পড়ছি।’
তরু বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
‘ আমাকে পড়ছো?’
মাহবুব বিমর্ষ মুখে মাথা নাড়লো। তরু শুধালো,
‘ তোমার চোখগুলো এতো বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন মাহবুব? কী আছে আমার মধ্যে? তুমি কী আমার অভিমানগুলো দেখতে পারছো?’
‘ পারছি।’
‘ এই অভিমান থেকে কী আমার মুক্তি নেই?’
‘ নেই।’
‘ কেন!’
‘ তুমি তো খুব বুদ্ধিমতী। তুমিই বলো, নেই কেন?’
তরু টলমলে চোখে তাকালো। মাথা নেড়ে বললো,
‘ জানি না। আমি তোমাকে বুঝতে পারি না।’
মাহবুব হাত বাড়িয়ে দেয়। ভীষণ স্নেহ নিয়ে ডাকে,
‘ তরু!’
তরু তাকায়। মাহবুব চোখ ভরা প্রশ্রয় নিয়ে বলে,
‘ কাছে এসো তরু।’
তরু ঠাঁই বসে থাকে। তার ভীষণ অভিমানী মুখটির দিকে চেয়ে হাতটা আরও প্রসারিত করে মাহবুব। তরুর হাত টেনে নিজের কোলের উপর বসায়। মাঝরাতের মিহি হাওয়ার মতোই ফিসফিস করে বলে,
‘ তরু! এমন কে আছে যে তোমাকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসতে পারে? এমন কে আছে যে আমার থেকেও ভালো বন্ধু হতে পারে? চেয়ে দেখো, আমি তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়েছি। তোমার মাঝের সকল আয়না আমি ভেঙে ফেলেছি। যেই মুহূর্তে তুমি আমায় ভালোবেসে ডেকেছো, আমি ঠিক সেই মুহূর্তেই তোমার হয়েছি। পুরো পৃথিবী তোমায় রূপবতী ইন্দ্রাণী রূপে দেখেছে। আমার মতো সাধারণ পুরুষের কী ইন্দ্রাণীকে ছোঁয়ার সাধ্য আছে? এই রূপ যে আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতো রূপের উত্তাপে পুড়তে থাকা তুমি বড়ো অপরিচিত। আমার কী দোষ, সাধারণ পুরুষ আমি, আমি তোমায় ইন্দ্রণী নয় কেবল আমার তরু রূপে দেখেছি। তোমাকে যত কাছে টেনেছি তত তোমার রূপের ছটা খসে অভিমান দেখেছি। ওই অভিমান তুমি শুধু আমায় দিয়েছো। ধন্যবাদ তরু। সেই অভিমানে আমি আমার তরুকে পেয়েছি।’
মাহবুবের অবাধ্য হাত কত বাস্তব হয়ে বিচরণ করছে তরুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে৷ মেঘমন্দ্র কণ্ঠটা যেন ঝনঝন করে বাজছে কানের কাছে। তরুর আচমকা ঘুম ছুটে গেলো। স্বপ্ন না বাস্তব তার প্রভেদ করার চেষ্টা না করে দুইহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বহু বহু বছর পর তরু হাউমাউ করে কাঁদলো। এই মুহূর্তে মাহবুবের গা ঘেঁষে বসার জন্য বুক হাহাকার করে উঠলো। ঘড়ির কাটার খেয়াল হলো না। অভিমান খেয়াল হলো না। অদৃশ্য দেওয়াল খেয়াল হলো না। তরু সব ভুলে মাহবুবের মোবাইলে ফোন লাগালো। মাহবুব বোধহয় জেগেই ছিলো। ফোনটা রিং হতেই রিসিভ হলো। তরু তখনও ফুঁপাচ্ছে। মাহবুব ফোন ধরতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আহ্লাদে। বললো,
‘ কোথায় তুমি? আমি তোমার কাছে যাবো।’
মাহবুব বিস্মিত হলো না। তবে কণ্ঠে প্রকাশ পেলো অপ্রতিরোধ্য স্নেহ। বললো,
‘ এতোরাতে তুমি হল থেকে বেরুতে পারবে তরু?’
মাহবুবের কণ্ঠ শুনে বুকের ভেতর টলমল করে উঠলো আবেগের সমুদ্দুর। রুদ্ধ কণ্ঠেই ধমক দিলো,
‘ সব যদি আমাকেই জানতে হয় তাহলে বাবা আমায় পুলিশের কাছে বিয়ে দিলো কেন? তুমি জানতে না তোমার বউ হলে থাকে? বিয়ে করার সময় মনে ছিলো না? বিয়ে করেছো কেন?’
মাহবুব উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তরুর ঝাঁঝ শুনলো। কণ্ঠে চাপা কৌতুক নিয়ে বললো,
‘ ও হ্যাঁ, পুলিশের তো এগুলোই কাজ। তোমার স্বামীর অন্যায় হয়েছে, তরু।’
মাহবুবের কথায় ফোন কেটে, কান্না থামিয়ে, চোখ-মুখ গম্ভীর করে বসে রইলো তরু। মাহবুব ঘন্টাখানেক বাদে আবারও টেলিফোন করলো। তরুকে গেটের কাছে আসতে বলে ফোন কাটলো। তরু চোখে-মুখে ভীষণ বিরক্তভাব ধরে রেখে নিচে নামলো। মাহবুব কীভাবে ব্যবস্থা করেছে বুঝা না গেলেও হলের দারোয়ানের ফুলেফেঁপে থাকা পকেটে কিছুটা আঁচ করা গেলো। দারোয়ান নিস্পৃহ মুখে গেট খুলে দিলো। মাহবুব গেট থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে মেটে রঙের পাঞ্জাবি আর রাস্তা বাতির আলো-আঁধারিতে মাহবুবকে দেখাচ্ছে বিষণ্ণ সুন্দর। তরু হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলো, এই মানুষটার মতো ভালো বন্ধু সে আর কক্ষনো পাবে না। মাহবুবের মতো নীরব প্রশ্রয়ে সকল দাবী মেনে নেওয়ার মতো মানুষ তরু আর কক্ষনো পায়নি। প্রথমদিন থেকে মাহবুব তাকে অবাধ প্রশ্রয় দিয়েছে বলেই সে মাহবুবের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়েছে কেবল তরু হয়ে। পাছে তরুর মন ও মুখের কথার প্রভেদ বুঝতে পারবে না বলে ভয় হয়নি। মন গুটিয়ে আসেনি। তরু যেন নিজের মনেই চমকে উঠলো। চিন্তার সুতোয় সুতোয় টান লেগে মস্তিষ্কে নতুন এক চিন্তার উদয় হলো। উপলব্ধি হলো, এই একুশ বছরের জীবনে মাহবুবের মতো অতো মনোযোগ দিয়ে তরুকে কেউ শুনেনি। তরুর অদ্ভুত কথার বাণে অনেকেই ভেসেছে। তরুর উদাসীনতা দেখেছে। তরুর কথার সাথে তাল মিলিয়ে তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে। চোখ ভর্তি কপটতা নিয়ে বাহ্যিক তরুকে জানতে চেয়েছে। অবাক হয়েও, বিরক্ত হয়েও তরুর রূপ চাঞ্চল্যে চুপ থেকেছে। কিন্তু কেউ তাকে শুনেনি। মনোযোগ দিয়ে শুনেনি। যার কাছে নির্ভয় হয়ে কথা জমা রাখা যায় তরুর তেমন কোনো বন্ধু হয়নি। তার চারপাশ ঝাঁক ঝাঁক বন্ধুদের হুল্লোড়। অথচ তরু দেখেছে কেবল দেওয়াল। আর সেই দেওয়াল ভাঙার অপেক্ষা।
তরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নাসারন্ধ্রে মাহবুবের নিজস্ব সেই গন্ধটা ধাক্কা দিতেই চেতনা ফিরলো। মাহবুব ততক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। গুছিয়ে না রাখা চুল আর একদিনের না কামানো দাড়িতে তাকে বড়ো অন্যরকম দেখাচ্ছে। তরু মুগ্ধ চোখে তাকায়। এই পুরুষকে সে যত দেখে ততই মুগ্ধ হয়। ভালো লাগে। ভালোবাসাতে ইচ্ছে হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় হাউমাউ করে কাঁদতে। কিন্তু তরু তো কাঁদে না। বাবা বলে, তরু কান্না বিবর্জিত রমণী। কান্না বিবর্জিত রমণীদের চোখে কান্না থাকে না। বুক জুড়ে থাকে বিষণ্ণতা। তবে তরু আজ কী করে ওমন হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো? সকল বিষণ্ণতা উড়ে গিয়ে কেন মনটা আচমকা এমন হালকা হয়ে উঠলো? মাহবুব নিঃসংকোচে তরুর হাত ধরলো। সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
‘ চলো।’
হাতে টান পড়তেই তরুর ভারী খোঁপা সর্বানাশা নদী তীরের মতোই ভেঙে পড়লো। এলিয়ে পড়লো পুরো পিঠজুড়ে। তরু শুধালো,
‘ মোটরসাইকেল আনোনি? কী করে এলে?’
‘ পরিচিত এক বন্ধুর মোটরসাইকেলে এসেছি। এতোরাতে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরুলে মা দুশ্চিন্তা করবে না?’
তরু বাঁকা চোখে চাইলো,
‘ তো? তোমার বউকে তুমি হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে এতো রাতে?’
মাহবুব স্বাভাবিক স্বরে বললো,
‘ কেন? কোলে করে নিয়ে যাবো। তোমার স্বামী পুলিশ বলে কথা। তুমি তো আর হেঁটে যাওয়ার জন্য পুলিশ বিয়ে করোনি। বউকে মাঝরাতে কোলে করে হেঁটে বেড়ানোও পুলিশদের কর্মকাণ্ড হওয়া উচিত।’
স্পষ্ট তরুকে খোঁচা মারার চেষ্টা! তরু প্রত্যুত্তর না করে আড়চোখে চাইলো। কৃষ্ণপক্ষের ম্লান চাঁদও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তরুর চোখে। কোথা থেকে ভেসে এলো হাসনাহেনার গন্ধ। ঘড়ির কাটা বোধ করি মহানির্বাণ লাভ করলো। মহানির্বাণ লাভ করলো সময়-জ্ঞান, গন্তব্য। বিচ্ছিরি গরম ছাপিয়ে শীতল হাওয়া এসে লাগলো গায়ে। মাহবুব পরিষ্কার আকাশের দিকে চেয়ে চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
‘ বৃষ্টি হবে।’
কিছুক্ষণের মাঝেই হাওয়ার তেজ বাড়লো। সেই হাওয়ায় দোল খেয়ে গেলো তরুর এলোচুল। মোলায়েম আঁচল। তরুর মুখে এখন আর প্রতিমা ভাব নেই। চাঁদের ম্লান আলোয় তাকে দেখাচ্ছে উচ্ছল কিশোরীদের মতো। মাহবুব এখনও শক্ত করে ধরে আছে তার হাত। সময় গড়াচ্ছে। তারা হাঁটছে গন্তব্যহীন। তরুর কাছে এই রাত, এই জ্যোৎস্না, এই শীতল হাওয়া সকলই যেন লাগছে মেঘের মতো। এ যেন এক মেঘের দেশ। মাহবুব সেখানে আস্ত একটা প্রেম। প্রেমের বাড়ি। যে প্রেম মেঘের মতো উড়ে বেড়ায়। ঝাপটা দিয়ে ভিজিয়ে দেয় আচমকা কিন্তু মুঠোয় করে ধরে ফেলা যায় না। সে কেবল ধরা দেয় মনে মনে। তরু হাঁটতে হাঁটতেই আকাশের দিকে চাইলো। শুধালো,
‘ মাহবুব? বলো দেখি, হোয়াট ইজ লাভ? ভালোবাসা মানে কী?’
মাহবুব বললো,
‘ ঘর।’
তরু চোখ ফিরিয়ে তাকালো,
‘ ঘর! আর ঘর মানে?’
‘ শান্তি।’
তরু আবারও নজর ফিরিয়ে আকাশে চাইলো। উদাস কণ্ঠে শুধালো,
‘ আর শান্তি মানে?’
মাহবুব তরুর দিকে চাইলো। চোখে চোখ পড়লো। তরুর হৃদস্পন্দন থমকে গেলো। নিঃশ্বাস আটকে এলো। মাহবুব বললো,
‘ তুমি।’
তরুর থমকে যাওয়া স্পন্দন আবারও ছুটতে লাগলো লাঘামহীন। মাহবুব আগের মতোই ভাবলেশহীন পথ চলছে। তরু বিড়বিড় করলো,
‘ আমি?’
পথের ধারে প্রাচীর ঘেরা এক বাড়ির প্রাচীর ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে এক সাদা জবার গাছ। ফুলের ভারে নুইয়ে এসেছে কাণ্ড। মাহবুব হাত বাড়িয়ে একটা ফুল ছিঁড়লো। হাঁটতে হাঁটতেই হাত ছেড়ে রুক্ষ হাতে জড়িয়ে ধরলো তরুর পাতলা কোমর। কানের কাছে সাদা জবা গুঁজে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ মেঘের দেশের রাজকন্যা? আমি আপনার প্রেমের ঘরে কড়া নাড়ছি। এক জবা প্রেমের বিনিময়ে চাইছি রাশি রাশি অভিমান।’
তরু ততক্ষণে থমকে দাঁড়িয়েছে। রাশি রাশি মেঘেরা যেন তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তরু টলমলে চোখ লুকাতে মাথা নুয়ালো। অভিমানী কণ্ঠে বললো,
‘ তোমাকে বিয়ে করাটা আমার উচিত হয়নি। তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে কী রকম ন্যাকা হয়ে যাচ্ছি আমি! কথায় কথায় কান্না পেয়ে যাচ্ছে, আশ্চর্য!’
মাহবুবকে এই প্রথমবারের মতো হাসতে দেখলো তরু। মাহবুব মৃদু হেসে তরুকে টেনে নিলো নিজের কাছে। তরুর মুখটা নিজের বুকে নিয়ে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ কাঁদলে তোমায় আমার আমার লাগে। আমি চাই তুমি আরও কাঁদো। তোমার অভিমানের সাথে সাথে সমুদ্দুর সমান কান্না শুধু আমার হোক।’
সমাপ্ত….
[ শেষ। তিনদিন ধরে লিখছি-কাটছি। লিখছি-কাটছি করে অবশেষে শেষ হলো। অনেকে বোধহয় মাহবুবকে জানার জন্য আগ্রহী হয়ে ছিলেন। সেজন্য দুঃখিত। কেননা, গল্পটা তরুর। আর গল্পটা নিতান্তই ছোট গল্প। তবুও অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে। সবিস্তার আলোচনা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় কথা, ব্যক্তিগত কারণ ও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে খুব দেরী দেরী করে লেখা দিয়েছি। গুছিয়েও লিখতে পারিনি। যারা ধৈর্য ধরে পড়েছেন, পাশে থেকেছেন তাদের কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। আশা করি, নিজেদের কথাগুলো মন্তব্যে জানাবেন। আপনাদের কথায় হয়তো আবার লিখতে উৎসাহ পাবো, মনোবল পাবো, নতুন কিছু শিখতে পারবো… ❤️]