#মেঘের_ছায়া( ৬)
লিজকে বিয়ের কথা বাসার সবাইকে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে বাড়িতে ঝড় বয়ে গেছে।ফারা সবকিছু সামলে নিয়ে সবাইকে মোটামুটি রাজি করিয়েছি এবং সবাইকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তার স্বামীর যাতে গুনাহ না হয় সেজন্যই সে আশফাকের এই বিয়েতে পুরোপুরি সায় দিয়েছে। যেখানে আসফাকের স্ত্রী ফারা রাজি সেখানে অন্য কারো আপত্তি থাকা অবাঞ্ছনীয় বিষয় ।
এক আকাশ মন খারাপ নিয়ে ফারা হাসিমুখে সবকিছু সামলাচ্ছে দেখে মনে হচ্ছে তার সাথে কিছুই হয়নি।
ফারার শাশুড়ি ফারাকে নিজের কাছে বসালো পরম মমতায় ফারার হাত ধরে বলল, ‘ তোকে আমি আমার ভাইয়ের মেয়ে হিশেবে পক্ষ নিয়ে বলছি না, আমি আমার বউমা হিসেবে বলছি, স্বামীর ভাগ কি মানুষ অন্য কাউকে দিতে চায়, তাহলে তুই দিচ্ছিস কেন?’
ফারা নিজেকে সামলে কাঁদো কাঁদো কন্ঠ আড়াল করে শান্ত সুরে বলল, ‘মা তোমার ছেলে ওই লিজকে ভালোবাসে, আমি চাইনা লিজের সাথে অবৈধ সম্পর্ক করে তোমার আসফাক যি*নায় লিপ্ত থাকুক। তাই আমি তার স্ত্রী হিশেবে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার দায়িত্বটা না হয় নিজেই গ্রহণ করলাম।’
আসফাকের মা কেঁদে ফেললেন ফারার মুগ্ধময় কথা শুনে। জড়িয়ে ধরে তিনি ফারার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘তোর মত মানুষ হয় না ফারা তুই সত্যি খুব ভাল একজন মেয়ে যে কিনা স্বামীর জন্য এতটা সেক্রিফাইস করতে পারে। তুই হচ্ছিস আমার এ সংসারের আলো। নিজের যত্ন নিস সব সময়। আল্লাহ যেন খুব তাড়াতাড়ি তোর দুঃখগুলো দূর করবার ব্যবস্থা করেন এ আমার ফরিয়াদ রইলো। ‘
ফারা খুব যত্ন করে আসফাকের যাওয়া লাগেজ গুছিয়ে দিচ্ছে যেন আসফাক ফারার জন্য কোন শুভ কাজ করতে যাচ্ছে। ফারার ভাব ভঙ্গি দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে। আসফাক নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফারার দিকে। সে ভাবছে ফারা একজন মেয়ে মানুষ হয়েও কিভাবে নিজের স*তীন আনতে রাজি হয়েছে। আসফাক ফারার হাত ধরে কোমল সুরে বলল, ‘লিজকে বিয়ে করলে তুই চলে যাবি না তো ফারু?’
আসফাকের মুখে এই প্রথম আদরের ডাক ফারু শুনে ফারার কলিজায় যেনো মোচড় মারলো। ফারু একমাত্র তার বাবা ও দাদু আদর করে ডাকে।
মলিন মনে ফারা বলল, ‘আমি আপনাকে ছাড়া কোথাও যাবো না আসফাক, মনের অজান্তে কখন যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি নিজেরও তা জানা নেই।’
ফারা মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে যাবে না বুঝালো।
আসফাক হাসলো ফারার চোখে তাকিয়ে। যাবে না জেনে সে যেন ভীষণ খুশি হল। আসফাক ফারাকে বলল, ‘জানিস তো ফারু লিজ না নারকেলের নাড়ু অনেক পছন্দ করে, তুই কি বানিয়ে দিতে পারবি?’
ফারা মনে মনে হাসলো লিজের জন্য আসফাকের এমন কেয়ারিং দেখে, বুকটা তার দা*উদা*উ করে জ্ব*লছিল।
মনে মনে সে বলল, ‘আমি বৈধ পন্থায় আপনার জন্য সব করতে রাজি।’
মিনিট দু এক পর ফারা মুখ ফুটে জবাবে বলল, ‘ পারবো ইনশাআল্লাহ। ‘
লিজকে মা-বাবা মেনে নিবে তো ফারু?’
-‘সেটা নিয়ে ভাবছেন কেন আমি আছি তো। ‘
আসফাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘তোর জন্যই তো আমি লিজকে বিয়ে করার মত দুঃসাহস করছি।’
রাত দশটা বাজতে চলল আসফাক লাগেজ হাতে নিয়ে একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। ফারাকে শুধু এটুকুই বলে গেল ভালো থাকিস নিজের যত্ন নিস।
এই মুহূর্তে ফারার ইচ্ছে করছে আসফাকের গলা জড়িয়ে কাঁদতে এবং বলতে, ‘ আপনি ছাড়া আমি ভালো থাকবো কি করে আপনি বিহীন নিজের যত্ন নিয়ে কি হবে! ‘
মনকে ফারা শক্ত করে কান্না আটকালো। এই ভেবে মেয়েদের যে ভেঙ্গে পড়লে চলে না তারা গড়তে জানে ভাঙতে নয়।
দু’দিন পর আসফাক ফোন দিল বাড়িতে। সে জানালো সে খুব ভালোভাবে পৌঁছেছে আমেরিকায়। ফারার শাশুড়ি ফোনটা এনে ফারাকে দিল। ফারা সালাম দিয়ে আসফাক কে ভালো জিজ্ঞাসা করল, আর কিছু বলতে পারলো না, যেনো এখুনি কেঁদে ফেলবে।
আসফাক বলতে শুরু করলো,
‘জানিস তো ফারু আমার না অনেক খুশি খুশি লাগছে আজ অনেকদিন পর লিজের সাথে দেখা হবে। ভাবছি ওকে আজ ফাইনালি বিয়ের প্রস্তাব দেব। জানি সে অনেক খুশি হবে। সে জানে আমি তাকে কতটা ভালবাসি এবং আমিও জানি সে আমায় কতটা ভালোবাসে।’
আপনি সবার ভালোবাসা বুঝলেন আসফাক ভাই কিন্তু আমার ভালোবাসাটুকু বুঝতে পারলেন না। হয়তো এ আমার ব্যর্থতা নয়তো আপনার ব্যর্থতা। ফারা মনে মনে যা বললো আসফাক কিছুই শুনতে পেল না। শুধু একটা না পাওয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফারা। দু ফোটা চোখের জল মুছে নিল। আসফাককে ভরসা দিয়ে সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করলো।’
‘আল্লাহুম্মা আহয়িনি মা কানাতিল হায়াতু খাইরান লি, ওয়া তাওয়াফফানি ইজা কানাতিল ওয়াফাতু খাইরান লি।’
‘হে আল্লাহ! যতদিন বেঁচে থাকা আমার জন্য কল্যাণকর হয়, ততদিন আমাকে জীবিত রাখুন আর যখন আমার জন্য মৃত্যুই কল্যাণকর হয় তখন আমার মৃত্যুদান করুন।’ (বুখারি : ৫৬৭১; মুসলিম : ২৬৮০)
ফারা অস্থিরতা কাটাতে বাংলা অনুবাদ সহ কোরআন পড়তে বসলো সেখানে সে নিজেকে শক্ত করার মত অনেকগুলো কোরআনের আয়াত খুঁজে পেল। কুরআনে চুমু খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ অশান্ত বুকে চেপে রাখলো নিমিষেই যেন তার সকল দুঃখগুলো গুছিয়ে শীতলতার ছোঁয়া এনে দিল।ফারা মনে মনে বললো, ‘ আসলে কোরআন এমন একটি গ্রন্থ যা পুরো জীবনের পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করে।’
ফারার মা ফোন দিয়ে কেঁদে ফেললো অবুঝ শিশুর মতো। ফারা নিজের মা’কে স্বস্তি দিয়ে বললো, ‘ কাঁদছো কেন মা! দুনিয়াটা তো আমাদের জন্য পরীক্ষা মাত্র। এখানে ভালোভাবে পরীক্ষা দিলেই পরকালে আমরা সার্টিফিকেট পাব আর সার্টিফিকেট নিয়েই জান্নাতে যেতে পারবো। হতে পারে উনার জন্য আমার এই সিদ্ধান্ত জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করবে। তুমি চিন্তা করো না আমি আগামীকাল থেকে আবার ভার্সিটি যাব, মন দিয়ে পড়াশোনা করব এবং আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে মনোযোগ বাড়াবো। আর ওনাকে তো আমি ছেড়ে যাচ্ছি না আমি তো ওনার স্ত্রী হিসেবেই আছি। ‘
ফোনটা কেটে দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে হাতের সকল কাজ শেষ করল। নিজেকে মানিয়ে নিয়ে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে লাগলো নতুন এক ফারা।
ফারা শশুর শাশুড়ির যত্ন নিয়ে সংসারের সব কাজ সামলে সে নতুন করে আবার ভার্সিটি যাওয়া শুরু করেছে। সামনে তার অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষা। ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়ছে সে। তার কাছে ইসলামের ইতিহাস বিষয়টা চমৎকার লাগে। কেননা ইসলামের অনেক সিংহ পুরুষ এবং মহীয়সী নারীদের গল্প পড়ে নিজের জীবনে সে শিক্ষার প্রতিফলন ঘটায় ফারা।এতে সে অনেক সমাধান খুঁজে পায়। ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়ার জীবনীটা তাকে খুব ভালো শিক্ষা দিয়েছে। একজন খা*রাপ লোকের স্ত্রী হয়েও সে কিভাবে মনোযোগ দিয়ে আল্লাহর ইবাদত করে প্রিয় বান্দায় পরিণত হয়েছে এবং তার দোয়ায় আল্লাহর কাছাকাছি জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করা আছে। এইটা তাকে বেশ আনন্দ দেয়। সেদিক থেকে আসফাক তো খুব ভালো মানুষ। সে তো আর ফারার ইবাদতে বাঁধা দিচ্ছে না। বিবি আছিয়ার জীবনী জেনে ফারা এটুকু বুঝতে পেরেছে যে ওই মহীয়সী নারীর কষ্টের চাইতে তো ফারা বহুগুণ ভালো রয়েছে।
আজ ভার্সিটি থেকে ফিরবার পথে ফারা একটা জিনিস খুব ভালো করে খেয়াল করেছে একজন ছেলে তাকে প্রতিদিন ফলো করে। এমন অ*শালীন কাজ ফারাকে খুব করে ভাবাচ্ছে। ফারা মনে মনে ভাবছে আজ মুসলিম সমাজ বি*পাকে আছে, কোথায় তারা ইসলামের পতাকা উড়াবে তা না করে তারা বিভিন্ন ডিভাইস ইউজ করে নিজেদের ইউ*জ*লে*স বানাচ্ছে। তারা প্রতিনিয়ত যি*নায় লিপ্ত হচ্ছে নে*শা করছে প*র্নো*গ্রা*ফিতে আ*সক্ত হচ্ছে। তাছাড়া তারাও উঠতে বসতে মোবাইল ইউজ করে নিজেদেরকে সমাজের দেশের বো*ঝা বানাচ্ছে। ফারা ভাবছে তারা কি পারবে ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে!
ছেলেটার অস*ভ্যতার সমাধান কি করে করবে খুঁজে পাচ্ছে না ফারা। কার কাছে বলবে ছেলেটার কথা ছেলেটা খুব করে জ্বা*লাচ্ছে ফারাকে। ফারা মনে মনে ভাবছে, ‘ ছেলে যদি খুব বেশি বা*ড়া*বা*ড়ি করে তাহলে সে ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিবে।
আয়নায় সে হঠাৎ কারো প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আসফাক। আসফাককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো ফারা।
-‘ আপনি এসেছেন জানেন তো আপনাকে ছাড়া আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, যেন বুক ফেটে আমি যেকোনো সময় মারা যাবো। একটা ছেলে আমাকে খুব করে বি*র*ক্ত করছে। যার সমাধান এখনো খুঁজে পাইনি।’
ফারা টের পেল কিছু একটা , ভাবছে আসফাক কি সত্যি এসেছে?
চলবে__
(আফরিন ইভা)