#মেঘের_ছায়া ( ৭)
উনার উষ্ণ বুকের হৃৎস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আমি। চোখ বন্ধ করে পুনরায় তাকিয়ে বুঝতে পারলাম এইবার সত্যি সত্যি উনি এসেছেন।উনার ধুকপুক বুক থেকে দ্রুত সরে দাঁড়ালাম। লজ্জিত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে ভীষণ অবাক হলাম। উসকো খুসকো চুল, চোখ মুখ শুকনো হয়ে কেমন পা*গল পা*গল দেখাচ্ছে উনাকে। অজানা এক আ*তঙ্ক ভর করলো মনে। ফারা আসফাকের দু-হাত নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কি হয়েছে আপনার? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তাছাড়া আপনি একা কেন, লিজ কোথায়? সে কি নিচে দাঁড়িয়ে আছে? আসুন তাকে এগিয়ে নিয়ে আসি। ‘
এই বলে ফারা যেই যেতে লাগলো লিজের কাছে আসফাক তার হাত শক্ত করে ধরল; টলমলে অশ্রুসজল চোখে ফারার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ লিজ আসেনি ফারু এই বলে উনি হঠাৎ ফারাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল এবং বলতে লাগলো, ‘ লিজ আমাকে ঠকিয়েছে সে আমাকে রেখে অন্য একজনকে গ্রহণ করেছে এ আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি তো তাকে সত্যিই ভালবেসেছিলাম আমি হেরে গেছি ফারু আমি সত্যি হেরে গেলাম।’
ফারা মনে মনে বলল, ‘ আপনি যেটাকে ভালোবাসা বলছেন সেটা আসলেই ভালোবাসা নয় সেটা হচ্ছে একটা মোহ। বিয়ের আগে ভালোবাসা বলতে কিছুই হয় না আসফাক ভাই যেটা হয় সেটার নাম যিনা। যিনা শুধু একসাথে মেলা*মে*শা করাকে বুঝায় না, চোখ দিয়ে পরনারী বা পরপুরুষকে দেখাকেও বুঝায়, চোখের যি*না যাকে বর্তমানে আমরা ক্রাশ বলি।’
এসব মনে হতেই ফারার মন খারাপ হয়ে গেল। সে ভাবলো এখন সে এসব কিছু আসফাককে বলবেনা কেননা মন খারাপের সময় তাকে এখন এসব বলে লাভ হবে না। ফারা ভেবে ঠিক করল আসফাক শান্ত হলেই বুঝিয়ে বলবে সে। আসফাকের দাড়িতে ফারা কোমল হাত দু’টো রেখে চোখের পানি পরম যত্নে মুছিয়ে দিল। দুহাত শক্ত করে ধরে বলল,
‘ আপনি তো পুরুষ মানুষ, পুরুষ মানুষের কি কাঁদতে আছে। পুরুষ মানুষের কর্মই হলো সবকিছুকে তুচ্ছ করে পরাজয়কে জয় করা, অ*শুদ্ধকে শুদ্ধ করা। পেছনের দিকে না ফিরে সামনের দিকে এগিয়ে চলা।পুরুষদেরকে আল্লাহ আলাদা নিয়মত দান করেছেন আর তা হলো সহ্য শক্তি। তারা সহ্য শক্তি দিয়ে পুরো পৃথিবী জয় করবার ক্ষমতা রাখে।’
ফারার কথা শুনে আসফাক ছোট বাচ্চাদের মতো চুপসে গেল। যেনো ধরণীর বুকে উজ্জ্বল আলোকরেখা সে দেখতে পাচ্ছে এই মুহুর্তে। সে যেনো মনে কিছুটা ভরসা পেল।
বাসায় ফিনফিনে নিরবতা বিরাজ করছে। আসফাকের বাবা-মা এ নিয়ে কোনো কথা বাড়ায়নি। একটিবারও তারা ছেলেকে জো*র*জবর*দস্তি করেনি। কেননা তারা জানে তাদের ছেলে যথেষ্ট ম্যাচিউরড। তাছাড়া তাদের ঘরে তো একজন বউমা রয়েছেন, সেই পারবে তাদের ছেলেকে পুনরায় হাসিখুশিময় জীবনে ফিরিয়ে আনতে।তাদের পূর্ণ ভরসা আছে ফারার উপর।
আসফাক সারাক্ষণ মন খা*রা*প করে বসে বা শুয়ে থাকে। ব্যবসায়ের কোনো কিছুতে তার মন নেই আর , ব্যবসা আপাতত আসফাকের বাবাই দেখছেন। তিনিও চান ছেলে একটু সময় নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসুক।
মাগরিবের সালাত আদায় করে ফারা চা নিয়ে গেল আসফাকের জন্যে। গিয়ে দেখলো আসফাক মাথা নিচু করে নিজের চুলগুলো মুঠো করে করে টানছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছু একটা ভাবছে।
-‘নিন আপনার চা।’
-‘খাব না।’
-‘আজ আর পানসে নয় আমার মতো, অনেক চিনি দিয়েছি, যেনো সবার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারেন।
খেয়ে দেখুন।’
ফারার হাত থেকে চা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে চা টা রেখে আসফাক বললো, ‘ তোর চা খেতে বেশ ফারু। মজা করবার জন্য তোকে রাগাতাম আমি।’
আসফাকের মুখে আদরের ডাক ফারু শুনে ফারার হৃদয়টা যেনো জুড়িয়ে গেল।ফারার ইচ্ছে করছে আসফাকের গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে আসফাকের বুকে লুকিয়ে যেতে।আসফাক আগের মতো দুষ্টমি করে না বলে ফারার ভীষণ খারাপ লাগে।বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
ফারা আসফাকের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আপনাকে কিছু বলবো যদি অনুমতি দেন।’
-‘ অনুমতি নিতে হবে না বল তুই।’
-‘আচ্ছা আপনি বলছেন লিজকে আপনি ভীষণ ভালোবেসেছিলেন। যদি বিয়ের আগে ভালোলাগাকে আপনি ভালোবাসা বলেন তাহলে বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনকে তাহলে কি বলবেন! তাছাড়া ভালোবাসা তাকেই বলে যেখানে দু’জন একে অপরকে ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে মহান রবের কাছে; আর তা একমাত্র স্বামী স্ত্রীর মাঝেই সম্ভব। লিজকে আপনার ভালো লাগতো সেইটা ভালোবাসা নয়, সেটা ছিলো কিছু সময়ের জন্য আবেগ, কিছুটা মোহ। যা একটা সময় কেটে যাবে। এতোক্ষণ আমি আপনাকে লজিক দিয়ে বুঝালাম যে লিজ পশ্চিমা সংস্কৃতি নিয়ে বড় হওয়া একজন মেয়ে। তার কাছে ভালোবাসার পবিত্র কোন সংজ্ঞা পাওয়া যাবে না কোনদিনও। তাই সে আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে। এবার চলুন ইসলামে আপনার করা কাজকে কি বলে,
দুই চোখের ব্যভি*চার হল বে*গা*না নারীর দিকে তাকানো কানের ব্যভি*চার যৌ*ন উ*দ্দী*প্ত কথা শোনা মুখের ব্যভি*চার আবেগ উ*দ্দি*প্ত কথা বলা হাতের ব্যভি*চার বে*গানা নারীকে খা*রা*প উদ্দেশ্যে স্পর্শ করা আর পায়ের যি*না ব্য*ভি*চারের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়া এবং মনের ব্য*ভিচার হল চাওয়া ও প্রত্যাশা করা। (মেশকাত হাদিস- ৮৬)
তাছাড়া আপনি চারপাশের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন বেশিরভাগ প্রেমের শেষ পরিণতিই হয় বি*চ্ছে*দ ধোঁ*কা এটি শয়*তা*নের মরী*চিকা এই বলে ফারা থামল।
আসফাক হতবম্ভ হয়ে গেল ফারার কথা শুনে। ফারার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাকে অফিসে যেতে হবে এ বলে উনি রেডি হতে চলল।’
বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আকাশ যেনো আজ সকল দুঃখ বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ঝরিয়ে দিতে চাইছে। আসফাকেরও ইচ্ছে হচ্ছে ভেতরের গুমোট বাঁধা সব দুঃখ কষ্ট ধুয়ে মুছে ফেলতে।
ফারা আজ নিজ হাতে আসফাকের জন্য রান্না করছে। আসফাকের পছন্দের সব আইটেম একে একে রান্না শেষ করে গোসল শেষে কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পরে নিল। আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল গুলো মুছে নিল। বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়ালো। বাহিরের ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দ নুপুরের ধ্বনির মতো শোনাচ্ছে তার কানে। প্রেমহীন মনও যেন আজ প্রেমের পরশ পেতে বড্ড ক্লান্ত। আবেগময়ী মন যেন আজ বড্ড অবুঝ হয়ে উঠেছে।
রুমে ফারা পা রাখতেই দেখল আসফাক কাক ভেজা হয়ে ঘরে ফিরেছে। ফারা দ্রুত গিয়ে খুব যত্ন করে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে আসফাকের মাথাটা মুছতে লাগলো।
-‘এই ফারু এতো জোরে জোরে চুল মুছে দিচ্ছিস যেনো সব চুল উঠিয়ে ফেলবি! বৃষ্টির দোষ নেই যেন সব দোষ আমার চুলের।’
ফারা মুচকি হেসে বলল, ‘দোষ বৃষ্টির নয়, দোষ এই চুলের মালিকের।সে কেন এই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে গেল। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি।’
আসফাক খেতে গিয়ে আবিষ্কার করল আজ খাবারের স্বাদে নতুন অনুভূতি জিভে দিলেই যেনো অমৃতের স্বাদ। আসফাক বলেই ফেলল, ‘ মা আজ খাবারটার টেস্ট এতটাই মজা ইচ্ছে করছে রান্নার হাতটা সহ খেয়ে ফেলি।’
মা হাসতে হাসতে বলল, ‘ আজ রান্না সব ফারা করেছে। সত্যি ভীষণ মজা হয়েছে। আমার ফারু সব দিক দিয়ে বেস্ট। রূপে রূপবতী গুণে গুণবতী।’
ফারা এত প্রশংসা শুনে নিজেই ভীষণ লজ্জা পেল।
ফারা তার মায়ের মুখে শুনেছে শশুর বাড়ি একজন মেয়ে মানুষ রান্না দিয়েও সবার মন জয় করতে পারে। এটা যে কোন একটা মেয়ের অসাধারণ গুন বটে।
ফারা নিজের জন্য ফ্লোরে বিছানা করতে গেলে আসফাক তাকে আঁটকায়।
-‘কি ব্যাপার! নিচে বিছানা করছিস কেন আমি কি বা*ঘ না ভা*ল্লু*ক আমার সাথে ঘুমালে কি তোকে আমি খেয়ে ফেলবো! কটমট চোখে তাকিয়ে বললো, ‘চল দু’জনের মাঝখানে কোলবালিশ থাকবে। ‘
ফারা লজ্জা পাচ্ছে আর কোন উপায় না পেয়ে নিজেকে ঠিকঠাক গুছিয়ে শুয়ে পড়লো।
জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তেজস্ক্রিয় উত্তাপ ফারার চোখে এসে পড়ল। পাশে তাকিয়ে দেখলো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আসফাক। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সবে সাতটা বাজে,তাই সে ভাবলো আসফাক আর কিছুক্ষণ ঘুমাক একটু পরে ডেকে দিবে। কিচেনে গিয়ে সবার জন্য নাস্তা বানাতে লাগলো। রুমে এসো দেখলো, আসফাক ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে মিটমিট করে হাসছে। ফারার কাছে এসে আসফাক চুল মুছতে মুছতে বলল,
‘ ছিঃ ফারা তুই এমন ভাবে ঘুমাস কেন লজ্জায় আমার মাথায় কা*টা যাচ্ছে।’
ফারা ভয় পেল সে এমন কি করল যার জন্য আসফাকের লজ্জা লাগছে। সে ভাবতে লাগলো রাতে তো ঠিকঠাকভাবে ঘুমিয়েছে, কোলবালিশ তো মাঝখানেই ছিল। কিছু একটা ভেবে ফারার গলা শুকিয়ে আসছে, ভয়ে দরদরিয়ে ঘামছে। মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না ফারার। তার মানে কি……
ফারা আমতা আমতা করে বলল, ‘ মা.. মানে কী! কি করেছি আমি!’
-‘কি করিসনি তাই বল তুই এত শব্দ করে নাক ডেকেছিস যে আরেকটু হলেই এ বিল্ডিং টা ভেঙ্গে পড়তো।’
এই বলে তিনি হা হা করে হাসতে লাগলো।
আসফাকের কথা শুনে ফারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কি ভয়টাই না পেয়েছে সে মনে মনে ভাবতে লাগলো, আসফাক ভাইয়ের কথায় আজ আর ফারা রাগ করবে না বরং আজ তার ভীষণ খুশি লাগছে। ফারা তো তার এই আসফাককেই দেখতে চায়।
ফারাও আসফাকের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো।
চলবে–
( আফরিন ইভা)