মেঘের_পালক,০৮,০৯

0
695

#মেঘের_পালক,০৮,০৯
সুমাইয়া আমান নিতু
পর্ব- ৮

অরিন,
তুমি আমাকে মিথ্যেবাদী ভাবলেও সত্যিটা হলো আমি সত্যবাদী। সেদিনের ঘটনাটা ভুল করে হলেও ভুলের সংশোধন হয়েছে সত্যের প্রতিস্থাপনে। তুমি যদি বিশ্বাস করো পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে…

একটু লিখে কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলল প্লাবন৷ গার্বেজ লিখছে! জীবনে কাউকে চিঠি লেখেনি সে। প্রেমপত্র তার হাতে উঠবে না। কী করা যায়?

অনেক ভেবে সে ঠিক করল বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করা এক কবি বন্ধুর থেকে সাহায্য নেবে। আর কোনো উপায় নেই। অরিন কথা না বললে তার খাওয়া,ঘুম, বাথরুম কোনোটাই বোধহয় ঠিকমতো হবে না।

উদাসকে পাওয়া গেল টিএসসিতে। সে এই গরমেও বড় বড় কাঁধ সমান চুল এলোমেলো ঝাঁকিয়ে মাঝে মাঝে গান গেয়ে উঠছে। হাতে কবিতার খাতা৷ সেটা ভর্তি অজস্র হাবিজাবি কবিতা।

প্লাবন পাশে গিয়ে বসতেই উদাস একগাল হেসে বলল, “সিগারেট দে।”

প্লাবনের মেজাজ বিগড়ে যেতে চাইলেও সে সেটা হতে দিল না৷ একটু তেলতেল স্বরে বলল, “আমি তো সিগারেট খাই না। টাকা নে, দোকানে গিয়ে কিনে আন৷ তারপর তোর সাথে কথা আছে।”

উদাস সিগারেট কিনে সেটা দোকান থেকেই ধরিয়ে এনেছে। এসে প্লাবনের পাশে বসে একগাদা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “বল কী সমস্যা। প্রেম বিষয়ক?”

“তুই জানলি কিভাবে?”

“আমারে মানুষের মনে পড়ে প্রেমে পড়লে।”

“তাই নাকি?”

“হু।”

“ভালো।”

“কী লাগব? প্রেমপত্র? প্রস্তাব দিবি? নাকি রাগ ভাঙাবি? নাকি জন্মদিনের শুভেচ্ছা? নাকি প্রেমবার্ষিকী উদযাপন? নাকি…”

“থাম থাম। আমার রাগ ভাঙানো লাগবে।”

উদাস তার কাঁধের ঝুলি থেকে একটা বড় পুরানো খাতা বের করে সূচিপত্র দেখল। রাগ ভাঙানোর চিঠি আছে ৩৪ নাম্বার পৃষ্ঠায়। সেটা বের করে প্লাবনকে দেখিয়ে বলল, “এইটা কপি কইরা নিলেই হবে।”

“দে।”

“উহু, পার চিঠি পাঁচশ টাকা।”

“কিহ! মগের মুল্লুক নাকি?”

উদাস তার মুখটা ভয়াবহ রকমের উদাস করে বলল, “দামাদামি নাই। নিলে পাঁচশোয় নে, না নিলে ফোট!”

প্লাবন উঠবে কি বসবে সেই চিন্তা কিছুক্ষণ করার পর আপনাআপনি তার হাত পকেটের দিকে চলে গেল। পাঁচশত টাকা বের করে সেটা উদাসের হাতে ধরিয়ে দিয়ে খাতাটা টেনে নিল।”

উদাস বলল, “এইখানে বইসাই কপি কইরা ফেল। খাতা অন্য কোথাও নেওয়া যাইব না।”

প্লাবন তিক্ত গলায় বলল, “মোবাইলে ছবি তোলা যাবে?”

“উহু, ওটিও হচ্ছে না৷ আমার ব্যবসায় ভাগ বসানোর কোনো সিস্টেম নাই।”

প্লাবন অগত্যা কাগজ কলম এনে চিঠি কপি করতে বসল। লিখতে লিখতে বুঝল জিনিসটার দাম বেশি ঠিকই, তবে কাজ করার সম্ভাবনাও আছে। চিঠির শেষে নিজের সেদিনকার অনুভূতি লিখতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু ভাবল সেটা রাগ কমার পর ধীরেসুস্থে বলবে। নইলে অরিনের কাছে ওসব বাজে কথা মনে হবে।

চিঠিটা কেমন করে অরিনকে দেয়া যায় সে আরেক চিন্তা। পরে ভাবল অর্নবের সাহায্যই নিতে হবে। সে ফোন করল অর্নবকে। অর্নব ফোন ধরল না।

কিন্তু মায়ের মেসেজ এলো, “কিরে, তোর প্রেমকাহিনীর কী অবস্থা?”

প্লাবন ছোট্ট করে উত্তর দিল, “It’s complicated”

***

অর্নব সেদিন ফোনে প্লাবনকে বলেছিল সে সব ফিক্স করে দেবে৷ সেই চেষ্টায় সে লেগে গেল একেবারে আদা-জল খেয়ে। প্রথমেই ক্লাসে ঢুকে বসে পড়ল অরিনের পাশে। অরিন বিরক্ত মুখে তাকাতেই অর্নব হাসি হাসি মুখ করে বলল, “অরিন তোকে তো ফাটাফাটি লাগছে আজকে! তুই দেখি দিনদিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস।”

অরিন ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল, “তোর কী সমস্যা? আমাকে এইসব বলিস কেন?”

“আরে আমি ফ্লার্ট করছি না তো। আমি সত্যি কথা বললাম।”

“কেন বললি? উদ্দেশ্য কী তোর? আগেরদিন অপমান করে আজকি বলিস সুন্দর? এইটা কি তোর ফ্যামিলিগত সমস্যা? তোর কাজিনও আমার সাথে ধোঁকাবাজি করল আর তুই এইসব ঘোড়ার ডিম বকতেছিস!”

অর্নব এবার সামলে নিয়ে বলল, “আরে শোন! আমি তোকে বোঝাতে এলাম যে প্লাবন খুবই ভালো ছেলে।”

“হুম। তারপর?”

“ওর মতো ভালো ছেলে এই দেশে আর একটাও পাওয়া যাবে না।”

“তারপর?”

“ও অনেক বুদ্ধিমান। ট্যালেন্ট পুরা! চাইলে হাভার্ডে পড়তে পারে। কিন্তু বাংলাদেশেই পড়ছে।”

“তারপর?”

“ওর বাপের অত টাকা নাই, কিন্তু ওর হয়ে যাবে কয়দিন পরেই।”

“তারপর?”

“ওর মতো সচ্চরিত্রবান পুরা মহাকাশেও নাই।”

অরিন অর্নবের মুখে একটা চুইংগাম ঠেসে দিয়ে বলল, “এইটা চাবা। তারপর গিয়ে তোর ভাইয়ের গলা ধরে বসে থাক। আমার সাথে আর জীবনে কথা বলতে আসলে রাম খামচি খাবি।”

অর্নব ঢোক গিলল। অরিনের নখ ভীষণ ধারালো। এটা ক্লাসের সবাই জানে, কারন ফার্স্ট ইয়ারে ওদের ক্যাম্পাসেরই এক ছেলে ওদের ক্লাসের শারমিনকে হ্যারাস করার পর অরিন রেগেমেগে সেই ছেলের হাতে আর গালে খামচি দিয়ে এসেছে। সেই দাগগুলো এখনো স্পষ্ট বোঝা যায়। আর অরিন শুধু শুধু হুমকি দেয় না। হুমকি সত্যি করে ছাড়ে। অতএব, খামচির ভয়ে অর্নব পুরোপুরি চুপ হয়ে গেল।

ক্লাস শেষে বের হয়ে অরিন দেখল প্লাবন দাঁড়িয়ে আছে। যদিও তার প্লাবনকে দেখে মনে মনে প্রচন্ড আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু মুখটা সে শক্ত করে এগিয়ে গেল।

বলল, “আপনার ভাই তো আপনার নামে প্রশংসা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে। তো ওসব কি আপনারই শিখিয়ে দেয়া?”

“আমি শিখিয়ে দেব কেন?”

“তো কি সে নিজে থেকে ওসব বলবে? থাক, এই ফালতু টপিকে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আপনি কেন এসেছেন?”

“তোমাকে অনেক কিছু বলতে চাই অরিন।”

“আমার সময় নাই। সময় থাকলেও শুনতাম না। আপনার সাথে আমার কোনো কথা নাই।”

কথাটা শুনে প্লাবনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপের ছায়া পড়ল মুখে। মায়া হলো অরিনের। সে চট করে সামনে থেকে সরে যেতে পারল না। বলল, “গেলাম। আশা করি আর আসবেন না এদিকে।”

প্লাবন বলল, “এটা নিয়ে যাও অরিন। প্লিজ পড়বে।”

অরিন কাগজটা নিল। লাভ লেটার? তার কেন যেন খুব মজা লাগতে লাগল। অথচ হওয়া উচিত ছিল প্রচন্ড বিরক্ত। ছেলেটাকে দেখলেই সে আইসক্রিমের মতো গলে পানি হয়ে যায়।

***

বাড়ি ফিরেই চিঠি পড়তে বসল অরিন।

প্রিয় অরিন,

চিঠি পেয়ে তোমার হয়তো মনে হয়েছে আমি ভীষণ অনুতপ্ত হয়ে কোনো কবিতা লিখে বসেছি৷ কিন্তু আমি যে কবি নই! আমি সাধারণ মানুষ মাত্র। যে জানে না কোনটা তার ভুল, কোনটা ঠিক। আমার মতো ভুলে ভরা মানুষটিকে তুমি বেছে নিয়েছ নিজের প্রিয়তম হিসেবে, এ আমার কাছে কম সৌভাগ্যের নয়। আমি এসব জাগতিক ঠিক ভুলের হিসেব নিয়ে বসে থাকতে চাই না। আমি চাই তোমার কপালের টিপের দিকে চেয়ে একটা যুগ পার করে দিতে। চাই তোমার মেঘের মতো চুলের গহীনে হারিয়ে যেতে। চাই তোমার চোখের সাগরে ভেসে যেতে।—

এই পর্যন্ত পড়ে অরিন ভুরু কুঁচকে বসে রইল। ঠিক এই লেখা সে কোথায় যেন পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। কোনো গল্প উপন্যাসে? এত ক্রিঞ্জ গল্পে থাকবে বলে তো মনে হয় না। তাহলে? কোথায়..কোথায়…হুট করে মনে পড়ে গেল তার। ফোনটা টেনে নিয়ে মৌটুসীকে ফোন করল তাড়াতাড়ি।

“হ্যালো টুসী, শোন না একটা কথা।”

“বল।”

“ফার্স্ট ইয়ারে তোর যখন অর্নবের সাথে রিলেশন ছিল..”

“অ..রি..ন!” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল মৌটুসী, “অনেক আগেই এটা ঠিক হয়েছিল যে ওই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা কেউ কোনোদিন কথা বলব না।”

“হ্যাঁ কিন্তু একটা দরকারে..”

“কোনো কথা না। না মানে না।”

“তুই শোন না একটু!”

“আমি শুনতে চাই না।”

“প্লাবনের সাথে রিলেটেড।”

“কিহ!”

“হ্যাঁ। আমি একটা জিনিস পড়ছি, তুই শুনতে থাক।”

“কী পড়বি ফোনে?”

“আহা শোন না! চিঠি পেয়ে তোমার হয়তো মনে হয়েছে আমি ভীষণ অনুতপ্ত হয়ে কোনো কবিতা লিখে বসেছি৷ কিন্তু আমি যে কবি নই! আমি সাধারণ মানুষ মাত্র। যে জানে না কোনটা তার ভুল, কোনটা ঠিক। আমার মতো ভুলে ভরা মানুষটিকে তুমি বেছে নিয়েছ নিজের প্রিয়তম হিসেবে, এ আমার কাছে কম সৌভাগ্যের নয়। আমি এসব জাগতিক ঠিক ভুলের….”

“অ্যাই চুপ চুপ! তুই…তুই এই চিঠিটা কোথায়…”

বলতে বলতে কোথায় যেন চলে গেল মৌটুসী। বেশ কিছুক্ষণ অরিন একা একাই হ্যালো হ্যালো করে গেল।

খানিকক্ষণ পর মৌটুসী ফিরে বলল, “চিঠিটা তো আমার কাছেই আছে। তুই পড়ছিস কোথা থেকে?”

“তুই তো শুনতেই চাইলি না।”

“এবার চাইছি। বল।”

“প্লাবন আমাকে এই চিঠি দিয়েছে। পড়তে পড়তে মনে হলো আগে কোথায় যেন পড়েছি। তারপর মনে পড়েছে তোর সেই চিঠির কথা। তোর ব্যাগেই থাকত চিঠিটা। আমিও কয়েকবার পড়েছি। সেজন্য মনে আছে।”

“তার মানে অর্নব প্লাবনকে চিঠিটা লিখে দিয়েছে?”

“তা দিতে পারে। কিন্তু এতদিন পর হুবহু এক জিনিস কিভাবে লিখবে?”

“তাও তো কথা! তার মানে কী…”

“তার মানে চিঠিটা অর্নব একবারই লিখেছে। সেটা দেখে নকল করে প্রয়োজনে ব্যবহার করে৷ আজ সেটা দিয়েছে প্লাবনকে।”

“কী জঘন্য! কিন্তু এইরকম হাস্যকর ন্যাকা মার্কা জিনিস অর্নব লিখতে পারে বলে তোর মনে হয়?”

“প্লাবন লিখতে পারে তা তো আরও মনে হয় না।”

“যত যাই হোক, আমাকে আবার ঠকালো সেই ছেলে৷ কত খারাপ ভাব!”

“হুম।”

“আর তুই, এই কপি মার্কা চিঠি এখনো রেখে দিছিস! মুখে বলিস কিছু নাই, কিছু নাই, ভিতরে ভিতরে ঠিকই তোমার ফিলিংস আছে তাই না?”

মৌটুসী খুব রাগী গলায় বলল, “এই চিঠি আমি তোর সামনে ড্রেনে ফেলব কালকে দেখিস।”

“লাগবে না। এখনই ফেলে দে। আমিও দিচ্ছি।”

“আচ্ছা।”

ফেলছি বলার পরেও দুই বান্ধবীর কেউই চিঠি ফেলল না। কারন লেখার কথাগুলো যারই হোক, হাতের লেখা আসল মানুষেরই।

অরিনের রাগ অবশ্য এক বিন্দুও পড়েনি। সে ক্লাসের বান্ধবী তাজরিনকে ফোন করে বলল, “তুই কয়েকটা গালি লিখে পাঠাতে পারবি?”

তাজরিন গালি দিতে খুবই ভালোবাসে। ক্লাসের কারো প্রেমিকের সাথে ঝামেলা বা অযাচিত ফোনকল আসলে গালাগালির প্রয়োজন হলে তাজরিন ভরসা। তাজরিন বলল, “একশোবার পারব। কতদিন মনের সুখে গালি দেই না। কিন্তু লিখা লাগবে কেন? ফোন নাম্বার দে, ফোন দিয়ে গালি দেই।”

অরিন দিতে চেয়েও দিল না। থাক! সে বলল, “তুই লিখে পাঠা।”

অবশেষে তাজরিন গালির লম্বা লিস্ট লিখে পাঠাল। অরিন প্লাবনের নাম্বার ব্লকলিস্ট থেকে আনব্লক করল। তারপর না পড়েই শুধু কপি পেস্ট করে গালির লিস্ট প্লাবনের কাছে পাঠিয়ে দিল। সাথে লিখল, “যে চিঠি নিজে না লিখে অন্যের লেখা নকল করে মানুষকে দিতে পারে তার মতো ফ্রড দুনিয়াতে একটাও হয় না।”

প্লাবন মেসেজগুলো পড়ে অনেকক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল। গালিগুলো একটা একটা করে পড়ল। সে নকল করে চিঠি দিয়েছে ঠিক, তাই বলে এভাবে গালি দেবে? এত নোংরা গালি? অরিন এত নোংরা সেটাই জানা ছিল না। একবার ইচ্ছে হলো উত্তরে অরিনকে কিছু গালি নিজেও দেবে। কিন্তু পরে ভাবল লেবু কচলে কী লাভ আর? এমনিতেই বিষয়টা বিশ্রী রকমের তেঁতো হয়ে গেছে। সে এবার নিজেই অরিনকে ব্লক করে দিল।

মায়ের ডাক শুনে বাস্তবে ফেরার পর মা জিজ্ঞেস করলেন, “কী অবস্থা এখন?”

প্লাবন বলল, “ব্রেক আপ!”

“সে কি!”

“হ্যাঁ মা। শোনো, আমি বিয়ে করব৷ তুমি পছন্দ করে মেয়ে দেখে আমার বিয়ে দিয়ে দাও। জীবনে একবার পছন্দ করলাম, তাও বাজে মেয়ে!”

“কিন্তু তোর তো পড়াশুনাই শেষ হয় নাই। বিয়ে করে বউকে খাওয়াবি কী?”

প্লাবন মায়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল মা মজা করছে নাকি সিরিয়াস। কিন্তু কিছু বুঝল না। বলল, “আমার তো এই বছরেই পড়াশুনা শেষ হয়ে যাবে। তারপর চাকরি পেলেই বিয়ে করে নেব।”

“আচ্ছা!”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#মেঘের_পালক
পর্ব-৯

এক বছর পর…

বিয়েবাড়িতে এসে খাওয়ার সময়ে অরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। জায়গার তুলনায় অতিথি অনেক। এক ব্যাচ খেয়ে ওঠার আগেই অন্যরা সেই টেবিলের চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ বসার বৃথা চেষ্টা করে সে চলে গেল সেখান থেকে। ভিড় কমলে নাহয় খাবে।

হাঁটতে হাঁটতে করিডোরে এসে দাঁড়াল সে। মা জোর করে এসব অপরিচিত লোকের বিয়েতে নিয়ে আসে। মায়ের বান্ধবীর মেয়ের বিয়ে। দাওয়াত সবাইকে করলেও বাবা আর ভাই সুযোগ পায়নি আসার। তাকে বাগে পেয়ে ধরে এনেছে। মা আবার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। খাবারের লাইনে সুবিধা করতে না পেরে বান্ধবীর সাথে গল্প জুড়ে দিয়ে হেঁটে কোনদিকে গেল ঠিক বুঝতে পারেনি অরিন। সে একাই ঘুরে বেড়াতে শুরু করল।

বিয়ের কনে ভারি সুন্দর দেখতে! লাল টুকটুকে বউ একেই বলে। তার ওপর ভীষণ লাজুক। চোখই তুলছে না। আজকালকার বউ আবার এমন হয়?

করিডোরে দাঁড়িয়ে সে আজকের মেঘলা আকাশ দেখল। তার জীবনটা এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে! সবকিছু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। সে ফাইনাল ইয়ারে উঠে গেছে। বাসা থেকে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলের সাথে কথাও হয়৷ কিন্তু কেন যেন কিছুই ভালো লাগে না!

সেই যে প্লাবনের সাথে তীব্র ঝগড়া আর প্রেম মিলে তিনদিনের ছোট্ট সম্পর্ক হয়েছিল, সেটার রেশ এতদিন রয়ে যাবে কে জানত! এখনও সে সেই মানুষটাকে মিস করে যার সাথে তার কখনো কথা বলার অভ্যাসটাও গড়ে ওঠেনি!

ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে উঠেছিল সে৷ ফোনের শব্দে ঘোর ভাঙল। সাজ্জাদের ফোন। ধরল না অরিন। কেন যেন লোকটাকে উটকো ঝামেলা মনে হয়। অথচ ভালো লোক। অরিনের মনে এখনো সেই বড় বড় চোখের লম্বা ছেলেটার অবয়ব ভাসে যাকে দেখলে এক অপূর্ব আনন্দে মন পূর্ণ হয়ে যেত! আহা!

আবারও সেই স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে যেতে থাকল অরিন৷ দেখল পাগড়ি মাথায় দাঁড়িয়ে প্লাবন। হাসিমুখে বিয়ে করতে আসছে! এমন স্বপ্ন বহুবার দেখেছে অরিন।

হঠাৎ মনে হলো স্বপ্ন কোথায়? সে যা দেখছে তা তো সত্যি! এটা কি প্লাবন? হ্যাঁ প্লাবনই তো! কিন্তু কী করে সম্ভব? এই বিয়ের বর সে? অরিনের কেমন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে বরের গাড়ি থেকে পাগড়ি মাথায় শেরওয়ানি পরা মানুষটাকে। প্লাবন!

অরিনের মনটা টুপ করে বিষন্নতার আঁধারে ডুবে গেল। কি হাসিমুখ মানুষটার! অবশ্য যা হয়েছে ভালো হয়েছে। ফ্রড দুই নাম্বার লোকের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে।

কিন্তু প্লাবনের বিয়ের কথা অর্নব কিছু বলল না কেন? সম্ভবত কপি করা চিঠিটা ধরা পড়ার পর অর্নবের সাথে যে বিশাল ঝগড়া হয়েছিল তার আর মৌটুসীর, সেজন্য সেই ব্যাপারে আর কথা বলতে আগ্রহ পায়নি অর্নব নিজেই। যাক, ভালো হয়েছে। আশা করা যেতে পারে প্লাবন তার স্ত্রীকে ভালো রাখবে।

অরিন নিজের নামে ডাক শুনে পেছন ফিরল। মা এসেছেন।

“কখন থেকে ডাকছি! শুনিস না কানে? খাবি না?বরপক্ষ চলে এলো যে!”

“খাব না মা।”

“সেকি!”

“হুম। খিদে চলে গেছে খাবারের গন্ধে।”

“তুই না খেলে চলে যা। আমাকে যেতে দেবে না এখনই।”

“থাকো তুমি। আমি চলে যাব।”

“আচ্ছা।”

মাকে দেখা গেল রীতিমতো ব্যস্ত৷ চলে গেল সেখান থেকে।

অরিন চলে যাবে ভেবেও যেতে পারছে না৷ কেন যেন ইচ্ছে করছে বর বউকে একসাথে দেখতে। সে দাঁড়িয়ে রইল।

মিনিট কয়েক পর কোথা থেকে খুব সুন্দর দেখতে এক স্বাস্থ্যবান এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি শাহিদার মেয়ে না?”

“জি।”

“শাহিদা এসেছে?”

“জি।”

“আমার সাথে চলো তো, তাড়াতাড়ি!”

“কেন?”

“গেট ধরতে হবে। শালির সংখ্যা যত বেশি হবে টাকা তত বেশি উঠবে।” বলতে বলতে মহিলা তাকে একেবারে টেনে নিয়ে গেলেন৷ দাঁড় করিয়ে দিলেন সামনে৷

অরিন জমে শক্ত হয়ে গেল। প্লাবনের একেবারে সামনে এসে পড়েছে সে! প্লাবন দেখলে কী করবে? কিছু বলে বসবে না তো?

কিন্তু অরিনকে অবাক করে দিয়ে প্লাবন তাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না৷ কয়েক পলক নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থেকে এত ঝগড়াঝাঁটির মধ্যেও একবার হাই তুলল। তারপর টাকাপয়সার ঝামেলা মিটিয়ে বিয়ে করতে ঢুকে পড়ল।

একটা বড় সোফায় একগাদা বন্ধুর সাথে বসে আছে প্লাবন। অরিন নিজের মনেই কেন যেন বউয়ের সাথে নিজেকে তুলনা করতে শুরু করল৷ মেয়েটা কিভাবে প্লাবনের সাথে মানায়? প্লাবনের এমন মেয়েই পছন্দ ছিল? সে কি শুধরে গেছে? কে জানে!

অরিন আর গেল না। দাঁড়িয়েই রইল। বিয়ে পড়ানোর সময়ও সে আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে থাকল।

কাবিন নামায় সই করার জন্য যখন কাজি এলো, অরিনের হঠাৎ চোখে পানি চলে এলো। মনে পড়ে গেল তার হাত কেটে যাওয়া আর প্লাবনেই খাইয়ে দেবার দিনটা। আজ সেই মানুষটার বিয়ে দেখতে হচ্ছে চোখের সামনে। কি অদ্ভুত জীবন! প্লাবনকে কি তার প্রাক্তন বলা যায়? নাকি সেটা একতরফা ভালোবাসা ছিল? প্লাবনের দিক থেকে তো কিছু ছিলই না৷

কাজি যখন বিয়ে পড়ানো শুরু করবে, তখন প্লাবন হঠাৎ একটানে পাগড়ি খুলে ফেলল। সেটা নিয়ে পাশের জনের মাথায় পরিয়ে দিয়ে জোরে জোরেই বলল, “তোর জিনিস তুই পর ভাই। অনেকে আবার ভাবছে আমারই বোধহয় বিয়ে।”

বলে অরিনের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিল। অরিনের গা জ্বলে গেল। তবে মনটা বোধহয় জ্বলা অবস্থা থেকে ফের ঠান্ডা পানিতে এসে পড়ল!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here