#মেঘের_পালক
পর্ব-১
সুমাইয়া আমান নিতু
লম্বা টেবিলের অজস্র খাবারদাবারের দিকে তাকিয়ে অরিনের মাথা খানিকটা ঘুরে গেল। বড়লোক হওয়া ভালো, তাই বলে এত বড়লোক? এই বড়লোকখানায় নিজেকে কেমন বেমানান লাগছে তার। অবশ্য লাগার তেমন কোনো কারন নেই। আমন্ত্রিত অতিথির বেশিরভাগই তারই মতো মধ্যবিত্ত গোছের। পার্টিটা মূলত তাদের বন্ধু অর্নবের জন্মদিন উপলক্ষে দেয়া। প্রথমে সবাই একসাথে মজা করতে পারবে বলে খুশি হয়েছিল খুব, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অর্নব বুঝি তাদের ডেকেছে নিজেদের বড়লোকি জাহির করার জন্য। আবার এমনটা নাও হতে পারে। হতেই পারে সে মিডল ক্লাস সংকীর্ণ মন নিয়ে চিন্তা করছে বলে এমন মনে হচ্ছে। সে যাহোক, পার্টি নিয়ে তার যতটা না চিন্তা, তারচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে পার্টিতে আসা একটা ছেলেকে নিয়ে।
ছেলেটা ঠিক সুন্দর কি না সে জানে না, তবে আকর্ষণীয় যে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে সেটা অরিন নিজের চোখে না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারত না।
ছেলেটার নাম প্লাবন। পার্টিতে ঢোকার মুখেই অরিনের সাথে তার কথা হয়েছে। কী কথা সেটা ভেবে অরিন বেশ লজ্জা পাচ্ছে। কারন ঢুকতে গিয়ে সে একটা ওয়েটারের সাথে ধাক্কা খেয়ে জুসের ট্রে উল্টে দিয়েছিল। আর জুসের অনেকটা গিয়ে পড়েছিল প্লাবনের গায়ে।
অরিন খুব বিব্রত আর ব্যস্ত হয়ে বলেছিল, “আল্লাহ! আমি কী করলাম। ইচ্ছে করে করিনি বিশ্বাস করুন…”
অরিন ভাবতেও পারেনি ছেলেটা চটে না গিয়ে উল্টে হেসে ফেলে অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে বলবে, “নো প্রবলেম মিস। এক্সিডেন্ট হতেই পারে। কিন্তু মজাটা এখানেই যে আমি কখনোই সমস্যায় পড়ি না। দেখুন না আমার শার্টে বা প্যান্টে দাগ দেখা যাচ্ছে না।”
অরিন দেখেছিল প্লাবনের শার্টটা গাঢ় নীল আর প্যান্ট কালো। জুসের হালকা সবুজ রঙ লেগে যায়নি। তবে জামাটা চটচটে হয়ে গেছে নিশ্চিয়ই? অরিন কী বলবে ভেবে পায়নি।
প্লাবন নিজের গজদন্ত বের করে হেসে বলেছিল, “আজকে আসার সময় পরার কথা ছিল অফ হোয়াইট শার্ট৷ শেষ মুহূর্তে কেন যেন এটা পরলাম। প্রকৃতি আমাকে সব সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে রাখে। কারণটা অজানা। এরকম বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? প্লিজ এনজয় দ্য পার্টি!”
অরিন মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল আর কথা শুনছিল। এত সুন্দর করে কেউ হাসে? কথা বলে? উফ!
প্লাবনের নামটাই শুধু জানতে পেরেছে সে। ছেলেটার পরিচয় জানা হয়নি। কয়েকবার চেষ্টা করেছে অর্নবকে জিজ্ঞেস করতে, কিন্তু তাকে ছেঁকে ধরে আছে মেয়েরা। ক্লাসের কয়েকটা মেয়ে হ্যাংলার মতো অর্নবের পেছনে ঘোরে। বড়লোকের ছেলে, হাত খুলে খরচ করে। কে স্বার্থের জন্য আশেপাশে আছে অতকিছু ভাবে না। এরা জেনেশুনেই দুধের মাছি পোষে।
অরিন একটা কমলা রঙের পুডিং জাতীয় খাবার প্লেটে তুলে নিল। থকথকে জিনিসটা কী দিয়ে বানিয়েছে কে জানে! ধরলেই নড়ে ওঠে। একটু মুখে দিল সে। মিষ্টি মিষ্টি। পুদিনা পাতার ফ্রেভার পাওয়া যাচ্ছে। সে পুদিনা পাতা সহ্য করতে পারে না। জিনিসটা কোথায় ফেলবে সেরকম জায়গা খুঁজতে লাগল।
মাটিকে দেখা গেল একটা বেগুনী রঙের আইসক্রিম জাতীয় খাবার অতি আগ্রহে খাচ্ছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে স্বর্গীয় খাবার খাচ্ছে।
অন্যদের অবস্থাও কাছাকাছি। অরিনের কেন যেন মনে হচ্ছে সার্কাস চলছে!
হঠাৎ মানুষটাকে হারিয়ে ফেলল সে। সেই দেখা হওয়ার পর থেকে চোখ দিয়ে প্লাবনকে লক করে রেখেছে সে। যেদিকেই যায়, অরিনের চোখ বারবার সেদিকেই চলে যায়। হঠাৎ কোথায় চলে গেল?
অরিন চোখ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ খুঁজল। দেখা গেল না তাকে। জায়গাটায় ভিড় অবশ্য বেশি। সবাই খাবারের আশেপাশে।
অরিন হেঁটে বাড়ির পেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। পেছনে ফুলের বাগান। মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। ভেতরের মিউজকের হালকা সুর দোলা দিয়ে যাচ্ছে যেন মৃদু বাতাসের সাথে।
কে একটা ডাকল যেন তাকে। সে ফিরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না৷
আবারও অন্যমনষ্ক হয়ে গেল, ঘোর ভাঙল কারো ডাকে। এবারও পেছন ফিরে কাউকে দেখতে পেল না সে। ভুলভাল শুনছে নাকি?
ভেতরে গিয়ে দেখল ঘটনা অন্যরকম। সবাই সত্যি তাকে খুঁজছে। কিন্তু কেন খুঁজছে? কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই মিলে তাকে ঠেলে তুলে দিল ছোট্ট স্টেজে। পুরো হলের বড় বড় বাতিগুলো নিভে গেল। শুধু একটুকরো বৃত্তাকার আলো স্টেজটাকে আলোকিত করে রাখল। অরিন মুখ ঢাকল। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
একটা হিন্দি গান বেজে উঠল হঠাৎ। প্রেমের গান।
স্টেজে উঠে এলো প্লাবন। হাতে একটা গোলাপের তোড়া।
সে অরিনের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে গোলাপের তোড়া সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আই লাভ ইউ।”
(চলবে)