#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-০৬,০৭
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
০৬
১১,
স্কুল থেকে ফিরার সময় বাজারে যায় সৈয়দা মাহবুবা। অনেকদিন বাসায় ভালোকিছু রান্না হয়না। এতদিন মেয়েদুটো কোন রকমে সিদ্ধ ভাত আর নুডলুস সিদ্ধ খেয়েই দিন পার করেছে। এই মেয়েদুটোকে নিয়ে না পারা গেল না। কতবার বলেছি রান্নটা অন্ততপক্ষে শিখে নাও। আমার কথা কেও কানেই তুলে না। একজন আছে সারাক্ষণ খাতা কলম নিয়ে আর অন্যজনের কথা নাই বললাম। গায়ে জড়ানো শালটা একটু টেনে নিয়ে কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করে নিলেন। কাচা বাজারের কাছে আসতেই তার চোখ পড়লো এক জোড়া কবুতরের বাচ্চার উপর। মেহেরের খুব পছন্দ কবুতরের মাংস। তবে মৌ-টা কবুতরের মাংস একদমই খেতে পারেনা। মৌয়ের জন্যে অন্যকিছুর ব্যাবস্থা করতে হবে। দুইশত চল্লিশ টাকা দিয়ে কবুতরের বাচ্চাদুটো নিয়ে নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। এবার আলু নিতে হবে। মাংতে আলু না দিলে জমে নাকি। আলু দেওয়ার কারন শুধু খাবারকে সুস্বাদু করার জন্যে না। এতে খাবারের পরিমাণও বেড়ে যায়। মৌ-য়ের জন্যে আলাদা করে মুরগীর মাংস কিনে নিলেন তিনি। তারপর কিছু টুকটাক কেনাকাটা করে বাজার থেকে চলেই যাচ্ছিলেন তখন তার চোখ আটকে যায় একটা ফার্মেসির দোকানে। সেখানে সৈয়দ নওশাদ ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে ডক্টরের সাথে কথা বলছে। প্রাক্তন স্বামিকে দেখে কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন সৈয়দা মাহবুবা। নওশাদ দোকানে কেন? কার কি হয়েছে? আচ্ছা ওর মায়ের তো বয়স হয়েছে হয়তো তার জন্যে ঔষুদ কিনতে এনেছে। অধোর কামড়িয়ে সামনে তাকালেন সৈয়দা মাহবুবা।
বিয়ের তিনমাস পর হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পরেন সৈয়দা মাহবুবা। শরীরে জ্বরের পরিমানটা একটু বেশীই ছিলো। কিছু খেতে পারতোনা মাথা ঘুরাতো। কিছু খেলেই বমি বমি ভাব হতো। সবাই ভেবেই নিয়েছিলো মাহবুবা মা হতে চলেছে। তাই জ্বর কমানোর জন্যে কোন রকমের ঔষুদ খেতে দিতো না তাকে। কিন্তু সৈয়দা মাহবুবা তো জানতো সে মা হচ্ছে না। কেননা বিয়ের পর এই তিনমাসে সৈয়দ নওশাদ কখনোও তার সংস্পর্শে আসেন নি। বেশীর ভাগ রাতই তিনি বাড়ির বাহিরে কাটিয়েছেন। বাবার ভয়ে কখনো কখনো বাড়িতে থেকেছেন তিনি কিন্তু মাহবুবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে।কারন এমন কয়লার মতো কালো বউ নিয়ে তিনি সংসার করতে চাননা। সৈয়দ নওশাদ ঠিক করেই নিয়েছেন, এবার তার বাবাকে সবটা বলা উচিৎ। সেদিন রাতে প্রচণ্ড জ্বর ছিলো সৈয়দা মাহবুবার গায়ে। তাই সারাদিন নওশাদ আহমেদকে বাড়িতে থাকতে হয়েছে। সৈয়দ নওশাদের বাবা সেদিন তাকে ডেকে বলেন, বৌমার জ্বর তো কমার বদলে বাড়ছে, ওকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যায়। ডক্টরের পরামর্শ মোতাবেক ঔষুদ খেলে মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ থাকবে। বাবার কথা শুনে সৈয়দ নওশা মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। কারন তিনি তার বাবার সম্মুখে বলতে পারছিলেন না, যে মধ্যে এখনো স্বামি স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠে নি তাহলে বাচ্চা আসবে কোথা থেকেন। বাবার সামনে কিছু না বললেও রুমে এসে সৈয়দা মাহবুবাকে অনেক অপমান করেছেন তিনি। এমন কয়টার মতো বউ নিয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হবেন না। তার মতো এমন ফুটফুটে যুবকের পাশে এমন কয়লার ড্রাম দেখলে সকলে হাসাহাসি করবে। আর তিনি লোক হাসাতে চান না এটাই বলেছিলেন। সৈয়দা মাহবুবা সেদিন নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন। তার গায়ের রং করলো এতে তার দোষটা কোথায়। কেন তাকে গায়ের রং নিয়ে এত কথা শুনতে হয়। আর কেঁদেকেঁদে বলছিলেন তাকেই কেন কালো বানানো হলো। সেদিন রাতে যখন জ্বরে কাপাকাপি করছিলো সৈয়দা মাহবুবা তখন হয়তো সৈয়দ নওশাদের মনে সৈয়দা মাহবুবার জন্যে একটু মায়া জন্মাচ্ছিলো। তাইতো তিনি সৈয়দা মাহবুবার কাছে যান। তিনি সৈয়দা মাহবুবার এতটাই কাছে গিয়েছিলেন যেন নিজের পুরুষত্বটাকে দমিয়ে রাখতে পারেন নি।
শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। হ্যাঁ ভুল ছিলো সব। সব কিছু ভুল ছিলো। তবে তার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিলো না। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। তাইতো আজ তিনি একজন সিঙ্গেল মাদার হলেও সুখী জিবন যাবন করছেন, তবে একটু কঠিন । তার এই জিবন যাপনের পথটা এতটা সহজ ছিলো না। মানুষের লাঞ্ছনা অপমান আর কটু কথা শুনে আজ তিনি এখানে এসেছেন। তবে এটা নিয়ে তার গর্ভ হয়। তারপর লম্বা পা ফেলে সেখান থেকে চলে আসলেন। যে অতীতকে তিনি পিছলে ফেলে এসেছেন তাকে আবার বর্তমানে নিয়ে আসতে চাননা তিনি। কোন পিছুটান নেই। এখন সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। মেয়েদুটোকে মানুষের মানুষ করে একজন বিশ্বাসী মানুষের হাতে তুলে দিতে চান। যারা তার মেয়েদুটোকে সারাজীবন আগলে রাখবে।
১২,
একা মনে বকবক করতে করতে বাড়ি ফিরছে মেহের। রাগ তার এখন সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেছে। কিছুক্ষণ আগে তার দেখা হয়েছিলো সৈয়দ নওশাদ আহমেদের সাথে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও সে মেহেরের সাথে কথা বলতে আসে। কিন্তু মেহের সে এবারও সৈয়দ নওশাদকে উপেক্ষা করে। আর সেখান থেকে চলে আসে। মেহের চলে আসার পর সৈয়দ নওশাদ তার হাতে থাকা মোবাইলের স্কিনে তাকিয়ে মৃদু হাসে। এ যেন প্রাপ্তির হাসি। নিচের দিকে তাকিয়ে বকবক করতে করতে হাটছে মেহের। তখন হঠাৎ করে কারো সাথে ধাক্কা লাগে তার। ঘটনাক্রমে কিছুটা পিছিয়ে যায় মেহের। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই কপাল কুঁচকে ফেলে সে। সাথে রাগও হয় বেশ। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে বুকের উপর হাত ভাজ করে নেয় সে। তার সামনে মূর্তিমানের মতো দাঁড়িয়ে আছে রাহি আর তার মা। মেহেরের এমন চাহনি দেখে রাহি ওর মাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
– আম্মু এই মেয়েটা আমাকে আজ কলেজে অপমান করেছে। সে নাকি আমার অবস্থা খারাপ করে দিবে।
রাহির কথা শুনে ওর মা এগিয়ে আসে মেহেরের দিকে। তারপর বলে,
– আমাকে চিনো?
– না। কাটকাট জবাব মেহেরের।
– ওই যে সেদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিলো।
– এই শহরে থাকি বেশ কয়েকবছর যাবৎ। ভোর হলে বাসা থেকে বের হই আর সন্ধাবেলা ঘরে ফিয়ে যায়। চলার পথে রোজ কত রকমের মানুষের সাথে দেখা হয়। কেও মুখোশের আড়ালে কেও বাহিরে। কেও আবার পাগল সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। আর কিছু বড়লোক যারা সভ্যতার আড়ালে অসভ্য বর্বর লোক। সবাইকে তো আর মনে রাখা সম্ভব নয়।
– এই মেয়ে কি বলতে চাইছো তুমি?
– আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন। আর রাহি বড়লোক হলেই মানুষ কিন্তু বড় মানুষ হয় না। তোমার আচরনে প্রকাশ পায় তুমি কেমন। তুমি কেমন পরিবারে বড় হয়েছো আর কেমন শিক্ষা পেয়েছো। আমি তোমার সিনিয়র তাই তাই যথার্থ সম্মান ডির্জাব করি তোমার থেকে। আমার উপর তোমার কিসের এত রাগ বলো। কেন আমার পিছনে পরে আছো।
– এই মেয়ে তোমার সাহস হয় কি করে এভাবে কথা বলার। জানো কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো তুমি? রাহির মায়ের কথা শুনে মৃদু হাসলো মেহের। অতঃপর বলল,
– আপনি যেই হোননা কেন তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। আমার মা কি বলে জানেন, মানুষকে অপমান করা যেমন পাপ তেমনি নিজের অপমানও সহ্য করাটাও পাপ। তাই আমি নিজের অপমান মুখ বুজে সহ্যকরি না। কারন এটা আমার মায়ের শিক্ষা।
– কোন মহান ব্যাক্তি তোমার মা?
– অবশ্যই আমার মা মহান। নাহলে সিঙ্গেল মাদার হয়ে আমাদের দুইবোনকে মানুষ করতে পারতো না।
মেহেরের কথা শুনে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো রাহি ও তার মা। রাহির মা তো হাসি থামিয়ে বলে উঠলো, তোমার বাবা মায়ের বিয়ে হয়েছিলো তো? কিন্তু এই কথা গায়ে মাখলো না মেহের। এটা তার সয়ে গেছে। অনেক শুনেছে সে এমন কথা। মৃদু হাসলো মেহের। তারপর বলল,
– যে আমাকে পৃথিবীতে এনেছে তার পরিচয়টা না হয় অজানাই থাক। কারন সেটা জানলে আপনাদের পায়ে তলায় মাটি সরে যাবে। আসি এখন, ভালো থাকবেন।আশাকি আর কোন দিন আপনারা আমার সামনে আসবেন না। চলে যায় মেহের। মেহেরের চলে যাওয়ার পর রাহি রেগে বলে,
– দেখলে তো আম্মু এই মেয়েটা কত বড় বেয়াদব। কিভাবে তোমার সাথে কথা বলল। রাহির কথার কোন জবাব দেয়না তার মা। সে ডুব দিয়েছে তার ভাবনায়।
চলতে চলতে মেহের ভাবে একটা নারীর কথা। এমন একটা নারী যে কিনা সমাজের কাছে পরিত্যাজ্য। রাষ্ট্র যাকে মূল্যা দেয় না। হ্যাঁ এরাইলো সিঙ্গেল মাদার। তাদের সিঙ্গেল মাদার হওয়ার পিছনের কাহিনীটা কেও শুনে না সকলে শুধু মজা নিতে জানে। একজন মা যে কতটা ত্যাগ স্বীকার করে সেটা কেও জানে না। সন্তানের জন্য বাবা-মা দুজনের সাহচর্যই প্রয়োজন। কিন্তু দুজনের সেই কাজটাই একজন সিঙ্গেল মাদার একাই করে চলেছেন হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, সাহসে বুক বেঁধে। তিনি একাই সন্তানের কাছে হয়ে উঠেছেন বাবা-মা দুই-ই। কাজটা ঠিক সার্কাসে দেখা সরু দড়ির ওপর দিয়ে চলার মতোই কঠিন। তাকে একাই কখনো বাবার মতো কঠোর হয়ে শাসন করতে হয়, আবার মায়ের মতো স্নেহ দিয়ে সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিতে হয়। বাবার মতো সন্তানকে চেনাতে হয় বাইরের দুনিয়া। আবার মায়ের মতো পরিবারের ভেতরকার প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হয়, যাতে সন্তানের মধ্যে তৈরি হয় দায়িত্ববোধ। সিঙ্গেল মাদারদের পদে পদে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। সিঙ্গেল মাদারদের প্রতিকূল পথচলা * সন্তানের পিতৃপরিচয় বিব্রত করে সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। কেননা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়, সবখানেই সন্তানের পিতৃপরিচয় তুলে ধরতে হয়। যে মানুষটা কোনো দায়-দায়িত্ব নিলো না, সন্তান মরে গেল নাকি বেঁচে রইল সে নিয়ে যার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তবু তার পরিচয়েই মানুষ করতে হবে সন্তানকে- নির্মম বাস্তবতা! জন্মনিবন্ধনে বাবার নাম চাই, স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় বাবার নাম দাও, ভোটার আইডি কার্ডে বাবার নাম লেখো, চাকরির জন্য তৈরি করা বায়োডাটায়, এমনকি সন্তানের বিয়ের কাবিননামায় অপরিহার্য বাবার নামের সেই মানুষটির পরিচয়। এই নামসর্বস্ব বাবার পরিচয় চিরদিন বহন করে চলতে হয় এমন মায়েদের। এতো কিছুর পরেও আইনি স্বীকৃতি নেই সিঙ্গেল মায়ের। কখনোই তিনি সন্তানের লিগ্যাল অভিভাবক হতে পারবেন না, থাকবেন কেবলেই তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে। একা থাকার পথে বাধা একাকী মায়েরা যখন বাসা ভাড়া নিতে যান, তখন বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই ভাড়া দিতে চান না। এমনকি কেউ কেউ অবমাননাকর মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেন না। হ্যাঁ এটাই হলো আমাদের সমাজ।
চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৭]
১৩,
নিজের রুমে বসেই কাজ করছিলো মেহের। কিছুদিন পর একটা ডিবেট প্রতিযোগীতা আসতে চলেছে তার। তবে এবারের ডিবেটটা হবে একটু অন্যরকম, কৌতূহলী। আঞ্চলিক ভাষার ডিবেট প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ নিতে যাচ্ছে মেহের। যার নাম “আমারাই সেরা”। সেটার উপর ভিত্তি করেই লেখালেখি করে যাচ্ছে মেহের। রাত এখন এগারোটায় ছুঁই ছুঁই। সৈয়দা মাহবুবা ঘুৃমিয়ে গেছেন অনেক আগেই। সারাদিন কাজ করে বেশ ক্লান্ত তিনি। মৌ মেহেরের পাশেই বসে আছে। মৌ-য়ের চোখ মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। সে কিছুক্ষণ মেহেরের পাশে বসছে আবার কিছুক্ষণ পায়চারী করে যাচ্ছে।
– এত ছুটাছুটি কেন করছিস মৌ। যা বলার বলে ফেল। ডাইরি আর কলমটা রেখে মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে বলল মেহের।
মেহেরের কথাশুনে মৌ তার অধোরে হাসি ফুটিয়ে মেহেরের পাশে বসলো।তারপর সে মেহেরের হাত ধরে বলে,
– মেহু, আমার তোর সাহায্যের প্রয়োজন।
মৌ-য়ের কথা শুনে ভ্রুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহের।
– তুই নিজেই একের ভিতরে হাজার। আমি তোকে কিসের হেল্প করবো?
– কাল আমি আমার ড্রিম বয়ের সাথে দেখা করতে যাব। তোকেও আমার সাথে যেতে হবে।
পাগল নাকি। তুই যা-না, এর মধ্যে আমার কেন জড়াচ্ছিস। মৌ-য়ের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো মেহের। আমি এসব কিছুই করতে পারবো না। উঠে দাঁড়ায় মেহের। বিছানায় ফেলেরাখা শালটা নিয়ে চলে যায় বারান্দায়। দু-হাত দুইদিকে প্রসারিত করে উপভোগ করতে থাকে প্রকৃতিকে। মাঘের কুয়াশাচ্ছন্ন চন্দ্রালােকিত গভীর রাত্রি । সমগ্র বিশ্ব দ্রিামগ্ন । কোথাও কোনাে সাড়া নেই। দূর-দিগ্বলয় পানে তাকালে মনে হয় রুপালি জ্যোৎস্নায় কুয়াশার সাদা বসন পরে বৈধব্যবেশী কোনাে নারী দাঁড়িয়ে আছে! রাত্রির নিস্তব্ধতা চৌচির করে দূরে দু’একটি কুকুরের চিৎকার । পূর্ণ চাদের নিথর রাত্রির বুকে মেহের জেগে । একেবারে একা নিঃসঙ্গ অনিকেত । রজতধারায় ঝরনার মতাে চাঁদের রূপ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে। মেহেরের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে । মেহের ক্রমাগত গভীর উপলব্ধির অতলে ডুবে যাচ্ছে। মহাকালের অসীম কালচক্রে এই রাত, এই দুর্লভ সুন্দর মুহূর্ত আর তাে ফিরে আসবে না । আসবে অন্য চাদনি রাত কিন্তু এই রাত তাে চিরতরেই বিগত হবে। বাহিরের শীতল হাওয়া মেহেরের মনটাকেও শীতল করে দিয়েছে। শালটা টেনে ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলো মেহের। মৌ-য়ের কথা মনে পড়তেই রুমে চলে আসে সে। মৌ তখন বিছানায় বসে মোবাইলে স্কলিং করছিলো। মেহেরকে রুমে দেখে মৌ মোবাইলটা রেখে বলে উঠলো,
– এই তুই আমার বোন। বোনের দরকারে যদি নাই এগিয়ে আসিস তাহলে তুই আমার কিসের বোন।
– ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল বন্ধ কর। কখন যেতে হবে সেটা বল আগে।
– তারমানে কাল তুই আমার সাথে যাচ্ছিস?
– না গিয়ে উপায় আছে। সারাদিন তোর ওই গাল ফুলানো দেখার চেয়ে তোর সাথে যাওয়াটাই ভালো।
মেহেরের কথা শুনে মৌ খুশিতে মেহেরকে জড়িয়ে ধরে।
পরেরদিন সকালে মেহের মৌ আর তাদের মা একইসাথে বাসা থেকে বের হয়। সৈয়দা মাহবুবা ওদের সাথে আছেন বলে বেশ বিপত্তিতে পরেছে মৌ। মৌ ভালো করেই জানে সে ওদের কলেজে পৌঁছে দিয়ে তবেই তার স্কুলে যাবে।আর একবার কলেজে ডুকলে বের হওয়াটা মুশকিল। তবে যে করেই হোক মুশকিল আসান করতেই হবে। মৌ-কে আজ যে করেই হোক ওর ড্রিম বয়ের সাথে দেখা করতেই হবে। মৌ- য়ের ভাবনা জুরে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে সে কিকরে তার ড্রিম বয়ের সাথে দেখা করতে যাবে। মেহের হাত শক্তকরে ধরে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পরে মৌ। মেহের মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়। মৌ চোখের ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বলে। সৈয়দা মাহবুবা ওদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
– রাস্তায় মধ্যে দাঁড়িয়ে পরলি কেন?
– আমি একটু লেডিশ শপে যাবো। তুমি যাও তোমার স্কুলে।তোমার তো লেট হয়ে যাচ্ছে।
– এখন আবার লেডিশ শপে যাবি কি করতে? কলেজ থেকে ফেরার সময় না হয় যাস।
– আমার এখনি দরকার আন্টি তুমি যাও আমরা আসছি। সৈয়দা মাহবুবা আর কোন কথা বাড়ায় না সে চলে যায় তার গন্তব্যে। সৈয়দা মাহবুবার চলে যাওয়ার পর মৌ তার বুকের উপর হাত রেখে বড়বড় করে শ্বাস নয়ে বার কয়েক। তারপর মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– বাঁচালাম। এবার চল।
– কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায় সেটা তো বল?
– সোর্ল পার্ক। সেখানেই আমার ড্রিম বয় আমার সাথে দেখা করবে।
১৪,
সোর্ল পার্কের পূর্ব দিগন্তে যে বড় গাছটা আছে সেই গাছের নিচে বসে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে রাহনাফ। মাথার উপরে থাকা বিশাল গাছটায় বসে আছে নানা রংয়ের পাখি। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে তার খুব একটা ভালো লাগছে না। তিক্ত মনে বসে বসে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে সে। তাতে যদি মনটা একটু ভালো হয়। তার জিবনটাই যে বিষাক্ত। এই বিষাক্ত জিবনে এক টুকরো সুখের আলো হলো মেহের। যাকে দেখলে হাজার বছর বাচতে ইচ্ছে করে রাহনাফের। যার সাথে কথা বলার সময় মনে হয় সময়টা যদি এখানেই থেমে যেতো। সিগারেটটা দুই ঠোঁটের মাঝ বরাবর নিয়ে তাতে দিলো এক টান। এখন একটু শান্তি লাগছে। ধুমপান যে শুধু শরীরের ক্ষতি করে সেটাও কিন্তু নয় অনেক সময় ধুমপান শরীরের অনেক উপকারও করে। বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা তাঁদের মতে, বেশ কিছু রোগে উপকারী ভূমিকা পালন করে ধূমপান। প্রথমেই বিজ্ঞানীরা বলেছেন আলসরেটিভ কোলাইটিসের কথা। এটা পেটের একটি রোগ, মূলত এই রোগে বৃহদন্ত্রে ক্ষত সৃষ্টি হয়। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি যে এই রোগে ধূমপানের রয়েছে ইতিবাচক ভূমিকা। ধুমপানের আরেকটি উপকারী দিক হলো এটা আলঝেইমারস প্রতিরোধক।
মৌ আর মেহের সোর্ল পার্কে প্রবেশ করেই সরাসরি পূর্ব দিগন্তের সেই গাছটার কাছে চলে আসে। গাছের নিচে রাহনাফকে বসা দেখে অবাক হয়ে যায় মেহের। সে রাহনাফকে পা থেকে মাথা অব্ধি অবলোকন করে নিয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৌ-য়ের দিকে। তারপর বলে,
– এটা তোর ড্রিম বয়।
মেহেরের কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই সামনে তাকায় রাহনাফ। তার সামনে মেহেরকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠে রাহনাফ। তৎক্ষণাৎ হাতে থাকে সিগারেট টা ফেলে সেটা পায়ের চাপা দিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ আগেই যেটা মুখে ছিলো এখন সেটাই পায়ের নিচে।
– মেহের আপনি এখানে?
– কেন? এই পার্কের কোথাও কি লেখা আছে “এখানে মেহেরের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
মেহেরের কথায় থতমত খেয়ে যায় রাহনাফ। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটা সব সময়ই রাগ নাকের ডগায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তবে যাই বলিনা না কেন, মেহেরের এই উল্টা স্বভাবের জন্যে রাহনাফের কাছে সে এত প্রিয়। রাহনাফ নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। তারপর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
– আমি সেটা কখন বললাম।
মেহের কিছু বলবে তার আগেই মৌ বলে,
– দোহাই লাগি মেহু এখান কোন ঝামেলা করিস না।
– হ্যাঁ আপনার বোনকে বুঝান। সবসময় এত ঝগড়া করা ভালো না। একটু মিষ্টি করে কথা বললে কি এমন ক্ষতি হয় শুনি। মিষ্টি করে কথা বলতে পারেন না আপনি। মেহেরকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে মেহের ব্যাঙ্কত্বক হাসি দিয়ে বলল,
– ক্ষতি তো অবশ্যই হবে। আমার মিষ্টি কথা যে শুনবে তারই ডায়াবেটিস হয়ে যাবে।
মেহেরের কথা শুনে চক্ষুদ্বয় বড় বড় রসগোল্লার মতো হয়ে যায় রাহনাফের। রাহনাফের এমন চাহনি দেখে মৃদু হাসে মেহের। তখন ওদের কাছে আসে একজন সুদর্শন যুবক। বয়সতার ছাব্বিশ সাতাইশ হবে। মিষ্টি কালারের শার্টের উপর মেরুন কালারের কোট গায়ে। লম্বামুখ আকৃতির এই সুদর্শন ছেলেকে দেখে মৌ-য়ের মুখ আপনা আপনিই হা হয়ে যায়। ভ্রুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে তাকিয়ে থাকে এই সুদর্শন যুবকের দিকে। মেহের ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকিয়ে থাকে মৌ-য়ের দিকে। কিছুক্ষণ পর সে মৌ-কে একটু নাড়া দিয়ে বলে,
– মুখটা বন্ধকর মৌ। নাহলে শুধু মশা নয় মাছিও ডুকে পরবে।
মৌ তার মুখটা বন্ধকরে মেহেরের দিকে তাকায় একপলক। তারপর আবার সেই যুবকটার দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা হাসি হাসে। যা দেখে যুবকটা তার অধরোষ্ঠ চেপে মলিন হাসি দেয়। এদিকে মেহের আর রাহনাফ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। মেহের বুঝতে পারছেনা এই ছেলেটা কে? আর রাহনাফ বুঝতে পারছে এই ত্যাজি বিড়ালের বোনের সাথে তার বন্ধুর সম্পর্ক কি? কিছুসময় পর রাহনাফ গিয়ে সেই যুবকটার সামনে দাঁড়ায় আর বলে,
– আলিহান তুই ওদের চিনিস?
রাহনাফের কথা শুনে যুবকটা রাহনাফকে জড়িয়ে ধরে। কুশল বিনিময় শেষ হলে সে রাহনাফকে বলে,
– তোকে একটা মেয়ের কথা বলছিলাম মনে আছে। এই মৌ-ই হলো সেই মেয়েটা।
– দোস্ত দুনিয়াতে আর কোন মেয়ে পেলি না। শেষে এই ত্যাজি ইদুরের বোনকেই ভালোবাসতে হলো তোর।
রাহনাফের কথা কানে আসতেই মেহের তেরে আসে ওর দিকে কিন্তু তখনি মৌ মেহেরকে আটকে দেয়। যুবকটা রাহনাফের কাঁধে হাত রেখে মৃদু হাসে তারপর সে মেহেরের দিকে ঘুরে,
– তুমি নিশ্চয় মেহের। হাই আমি আলিহান। মৃদু হাসলো মেহের। তারপর যখন রাহনাফের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয় তখনি নিজের দৃষ্টি শক্ত করে ফেলে মেহের।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
[ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আসসালামু আলাইকুম[