মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-০৮,০৯

0
714

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-০৮,০৯
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
০৮
১৫,
পাশাপাশি বসে আছে মৌ আর আলিহান। মেহের মৌ এর পাশে বসে মোবাইলে গেইম খেলছে। রাহনাফ চলে গেছে পার্কের বাহিরে বাদামের দোকানে। দুইজন প্রেমিক প্রেমিকা যখন পার্কে বসে কথা বলে তখন তাদের মুহূর্তটা আরো বেশী মেমোরিবল করার জন্যে নাকি বাদাম চাই। তাই মৌ এর কথামতো রাহনাফ বাদাম কিনতে গেছে। এদিকে মৌ এর পাশে মেহের বসে থাকার কারনে আলিহান পরছে বিভ্রান্তিতে। সে মৌ-য়ের সাথে মন খুলে কথাও বলতে পারছে না। মৌ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও সে মেহেরকে কিছু বলতেও পারছে না। কিছুক্ষণ পর দুটো কাগজে করে বাদাম নিয়ে আসে রাহনাফ। একটা সে মৌ-য়ের হাতে দেয় অন্যটা নিজের কাছে রাখে। রাহনাফ আলিহানের বিষন্নমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। যে মৌ-য়ের সাথে দেখা করার জন্যে সে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তাকে কাছে পেয়েও এমন মুখ ভার করে বসে আছে কেন? আলিহান তার হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সামনে তাকালো। তখনি রাহনাফের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয় আর রাহনাফ চোখের ইশারায় জানতে চায় আলিহানের মন খারাপের কারন। তখন আলিহান তার চোখের ইশারায় মেহেরকে দেখিয়ে দেয়। রাহনাফ মৃদু হেসে আলিহানকে শান্ত হতে বলে মৌ-য়ের পাশে গিয়ে বসে তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে,

– আপনাকে না সত্যিই নভেল দেওয়া দরকার। নভেল দিলেও বোধহয় কম হবে, আপনাকে তো Alfred Nobel কেই দিয়ে দেওয়া উচিৎ।

রাহনাফের কথা শুনে ভ্রুযুগলে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহের। মোবাইলটা ব্যাগে পুরে রেখে শান্ত গলায় বলে,

– ঠিক কি কারনে আমাকে নভেল দেওয়া হবে শুনি?

– কেন আবার! এখনে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা বসে আছে একটু গল্প করবে বলে, আর আপনি ওদের মাঝে এলাচি হয়ে বসে আছে। আপনার কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নাই।ওদের তো একটু স্পেস দেওয়া দরকার তাইনা। পারসোনালিটি বলে কিছু আছে না-কি?

– এক সেকেন্ড, এদের আবার কিসের পারসোনালিটি, বিয়ে হয়েছে নাকি, এরা কি স্বামি স্ত্রী যে পারসোনাল কথা থাকবে। দৃঢ় কন্ঠে জবাব দেয় মেহের।

– আপনার মতো ঘাড়ত্যারা ত্যজি ইঁদুরকে বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।

রাহনাফের বলা শেষ বাক্যশুনে মেহেরের রাগ সপ্তম আকাশে পৌঁছে যায়। সে রাগে দাত কটমট করতে থাকে। তারপর বলে,

– কি বললেন আপনি? সাহস থাকে তো আবার বলে দেখুন। উঠে দাড়িয়ে যায় মেহের। মৌ মেহেরের হাত ধরে ওকে থামাতে যায় কিন্তু তার আগেই রাহনাফ বলে উঠে,

– ঘাড়ত্যারা ত্যাজি ইদুর। মেহের মৌ-য়ের থেকে নিজের হাত ছুটিয়ে নিয়ে তাড়া করতে থাকে রাহনাফকে। রাহনাফ দৌড়ে ওদের থেকে অনেকটা দূরে চলে যায় আর মেহের রাহনাফের পিছনে ছুটতে থাকে। আলিহান ওদের কান্ড দেখে না হেসে পারে না। ফিক করে হেসে দেয় সে। মৌ আলিহানের হাসির দিকে তাকিয়েই থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর আলিহান মৌ-য়ের সামনে তুরি বাজিয়ে বলে,

– কোথায় হারালেন ম্যাডাম?

থতমত খেয়ে যায় মৌ। সে যতটা সম্ভব তার দৃষ্টি নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,

– আপনাতেই ডুবে থাকি সারাক্ষণ। আমার সকল ভাবনা জুরে শুধু আপনার বসবাস আলিহান। স্মিত হাসে আলিহান, সে মৌ-য়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

এদিকে অনেক্ষন যাবৎ রাহনাফের পিছনে ছুটে হাপিয়ে উঠেছে মেহের। সে হাটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বড় করে বারকয়েক শ্বাস নেয়। রাহনাফ ওর থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেয়েটা বড্ড বাচ্চা স্বভাবের। যাই হোক তাকে এভাবে কষ্ট দেওয়াটা মোটেও ঠিক না। রাহনাফ স্ব-ইচ্ছায় মেহেরের সামনে এসে দাঁড়ায়। আর তখনি মেহের ঝপিয়ে পরে রাহনাফের উপর।এলোপাথাড়ি রাহনাফকে মারতে থাকে সে। সুযোগ বুঝে রাহনাফ মেহেরের হাত দুটো ধরে পিছনে নিয়ে নেয়। যার ফলে মেহেরের পুরো শরীরের ভর গিয়ে পরে রাহনাফের গায়ের উপর। অনেকটা কাছাকাছি এসে যায় দুজনে। যতটা কাছে আসলে একে অপরের হৃদস্পন্দর শুনতে পায় ততটা কাছাকাছি। দুজন দুজনের অক্ষির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মেহের নিজের হাত ছুটানোর জন্যে ছটফট করতেই রাহনাফ মেহেরের চোখে চোখ রেখে বলে,

– আশেপাশে সবাই আমাদের দেখছে। নিজের রাগকে কন্ট্রোল করুন লেখিকা সাহেবা। রাহনাফের কথা মতো আশেপাশে তাকায় মেহের। সবাই কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। মেহের তার দৃষ্টি নামিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তখন রাহনাফ মেহেরকে ছেড়ে ওকে থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দেয়। অতঃপর বলে,

– চলুন আমরা ওদিকটায় যাই।

– কিন্তু মৌ।

– আলিহান আছে তো। আপনার কোন ধারনাই নেই লেখিকা সাহেবা ওরা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। আমার বন্ধু থাকতে আপনার বোনের কোন ক্ষতি হবো না। চলুন লেখিকা আজ আপনাকে নতুর কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় মেহের। রাহনাফ তার হাতের ইশারায় পার্ক থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত একটা ভবন দেখায়। অতঃপর বলে,

– চলুন লেখিকা আমরা ওইদিকে যাই।

– ওটা তো চাইল্ড এন্ড ওন্ডএজ কেয়ার হোম।

– হ্যাঁ। শুধু কল্পনার জগৎ নিয়ে লেখলে চলবে লেখিকা! বাস্তবতা দেখুন, আমাদের চারিপাশের এই প্রকৃতিকে মন দিয়ে উপভোগ করুন। তবেই আপনি একজন স্বর্থক লেখক।

এই প্রথমবার রাহনাফের কথা ভালো লাগে মেহেরের। মেহের মুগ্ধ দৃষ্টিতে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর তারা দুইজনেই চলে যায় দূরের ওই চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোম।

মায়ের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের সেবামূলক কার্যক্রমের কথা অনেক শুনেছে মেহের। নির্ধারিত সময়ে এখানে পৌঁছে বন্ধুবৎসল সেবাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত আতিথেয়তা দারুণ লাগছে মেহেরের । তাঁরা পেশাদার আর কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। রাহনাফ তো এখানে এসেই কোথাও যেন উধাও হয়ে গেছে। মেহের একা একা ঘুরে ঘুরে দেখছে এই চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ হোম। কিছুক্ষণ পর কয়েকটা বাচ্চাএসে মেহেরকে ঘিরে ধরে। মেহের বাচ্চাগুলো সাথে হেসে খেলে কথা বলে তারপর চলে যাই আশ্রমের অন্যপ্রান্তে। সেই প্রান্তে ছিলো বৃদ্ধাদের বসবাস। প্রথমেই তার চোখ আটকে যায় একটা বেঞ্চের উপর বসে থাকা দুজন বৃদ্ধা নর-নারীর উপর। যারা একে অপরের সাথে খাবার ভাগ করে খাচ্ছে। বয়সের ভারে শরীরে চামড়া কুচকে গেছে, বাড়ি ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে তবুও তাদের ভালোবাসা এক বিন্দুও কমেনি। মেহের তাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উল্টোদিকে হাটা শুরু করে তখনি পিছন থেকে কেও মেহেরের নাম ধরে ডাক দেয়।

– মে-মেহের।

জাড়ানো কাপা কন্ঠে এই আশ্রমে নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যায় মেহের। পিছনের দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পায় একজন বৃদ্ধা মহিলা তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। বৃদ্ধাকে দেখে কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ পরে যায় মেহেরের। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে বলে,

– আপনি আমাকে ডাকছেন?

মেহেরের কথার কোন জবাব দেয়না বৃদ্ধা। সে একপা দু-পা করে এগিয়ে আসতে থাকে। বৃদ্ধাটি মেহের নিকটবর্তী আসলে মেহের খেয়াল করে তার চোখ পানিতে জ্বলজ্বল করছে। বৃদ্ধার চোখের নোনাজল দেখেই মেহের তার বুকের বা পাশে হালকা ব্যাথা অনুভব করে। বৃদ্ধাটি মেহেরের কাছে চলে আসে তার তখন তার দু-চোখ থেকে কয়েকফোটা অশ্রু গাল বেয়ে পরে। মেহের বৃদ্ধার চোখে জল দেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধাটি মেহেরের গালে হাত রেখে মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বৃদ্ধার হাতের ছোঁয়া মেহেরের ভালো লাগে। কেন জানি তাকে নিজের বলে মনে হচ্ছে তার। মেহের বৃদ্ধার হাতের উপর হাত রেখে বলে,

– কে আপনি? আপনি আমার নাম জানেন কি করে??

মেহেরের প্রশ্ন উপেক্ষা করে বৃদ্ধা বলে উঠে,

– কি মিষ্টি দেখতে হয়েছিস তুই। যেন শরীরে টুকা দিলেই রক্ত বের হবে। বলতো আমি তোকে কি করে চিনলাম, বলতে পারলি না তো। বেশ তাহলে আমিই বলছি, আমি তোকে চিনতে পেরেছি তোর চোখদুটো দেখে।

বৃদ্ধার কথা শুনে মেহের তার গাল থেকে বৃদ্ধার হাত সরিয়ে দেয়। কেউ তার গায়ের রং নিয়ে কথা বললে তিক্ত লাগে মেহেরের। সে যে তার গায়ের এমন দুধ সাদা রংকে অপছন্দ করে এটা কি কেউ জানেনা নাকি। তারপরেই কেন সবাই তার গায়ের রংয়ের এত প্রশংসা করে বৃদ্ধাকে রেখে চলে আসে সেখান থেকে। পিছন সে অনেক ডেকেছে কিন্তু ফিরে তাকায়নি মেহের।

এদিকে মেহের রাহনাফকে খুজে যাচ্ছে। এই ছেলেটা সেই এসে কোথায় উধাও হয়ে গেল এখনো তার দেখা মেলে নি। বেশ রাগ লাগছে এখন মেহেরের। কতটা সময় কেটেগেল এখানে। এখন কলেজ ছুটি হওয়ার সময়, বাসায় ফিরে যেতে হবে। ওদিকে মৌ কি করছে কে জানে? এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মেহের।

– কাকে খুঁজছেন লেখিকা সাহেবা!!

চেনা এই কণ্ঠস্বর শুনে পাশে তাকায় মেহের। পাশে তাকাতেই দেখতে পায়, কৈশোর বয়সের কয়েকজন ছেলেমেয়ের সাথে বসে বসে গল্প করছে রাহনাফ। মেহেরের খুব রাগ হয়। এই স্টুপিড ছেলেটাকে সে কখন থেকে খুঁজে যাচ্ছে। আর সে সময় ভুলে, এখানে বসে গল্প করছে। মেহের দ্রুত পায়ে রাহনাফের কাছে যায়। গলার স্বর শক্ত করে বলে,

– আপনি এখানে, আর আমি আপনাকে কোথায় কোথায় খুঁজে যাচ্ছি।

– এত খুজার কি প্রয়োজন কাউকে জিগ্যেস করলেই পারতেন।

– কাউকে জিগ্যেস করতেন। রাহনাফকে ব্যাঙ্গ করে বলে মেহের। কাকে জিগ্যেস করবো আমি। না কেউ আমাকে চিনে আর না আপনাকে। তাহলে জিগ্যেস করে লাভটা কি??

– রাইট। আপনাকে এখানে কেউ চিনে কিন্তু আমাকে তো চিনে।

– আপনি এমন ভাবে বলছেন মনে হচ্ছে আপনিও এই চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোমে থেকেছেন।

– আপনার ধারনা ভুল নয় লেখিকা সাহেবা। সামনে তাকিয়ে সবার সাথে গল্প করায় মনোযোগ দেয় রাহনাফ। মেহের অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের পানে।

চলবে,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৯]

– আমার ধারণা ভুল নয় বলতে কি বুঝাতে চাইছেন আপনি, মিস্টার রাহনাফ।

– আমার বেড়ে হয়ে উঠাটা এই আশ্রমেই।

– মানে!!

মেহেরের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে রাহনাফ ওর দিকে ঘুরে বসে। অতঃপর বলতে থাকে,

– আমি অনাথ। হ্যাঁ লেখিকা সাহেবা এটাই সত্যি। আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন ব্রেন স্টোকে আমার বাবা মারা যায়। বাবার মৃত্যর পর দাদার বাড়িতে ঠায় হয়নি আমার আর আমার মায়ের। তারপর একবছর আমি আর আমার মা দুইজনেই নানার বাড়িতে থাকতাম। একবছর যেতে না যেতেই মামা মামিদের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন চলে আসলো। আমাকে আর আমার মাকে তারা বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে না। নানাটাও ছিলো বৃদ্ধ। কামাই রোজগার কিছুই ছিলোনা তার। তাই ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথার কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। তারপর নানা সিদ্ধান্ত নেয় তারা আমার মায়ের আবার বিয়ে দিবে। মা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে সেটা মেনে নেয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো আমাকে নিয়ে। কারন আমার মায়ের যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে আমাকে মেনে নিবে না। আর নানার ও সামর্থ্য নেই যে সে আমার ভরণ পোষনের দায়িত্ব নিবে। একরকম বাধ্য হয়েই আমার মা আমাকে এই আশ্রামে রেখে যায়। সেই সাত বছর বয়স থেকে আমি এই আশ্রমে থাকি। এই আশ্রমে আমার কৈশোরকাল কেটেছে। আশ্রমের প্রতিটা ঘর আমার চেনা। এই আশ্রমের বৃদ্ধাদের আমি দাদা দাদি তাকি। বাচ্চাগুলো আমার ভাই বোন। হ্যাঁ এখানে সবাই আমার পরিবার। এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সে আমাকে পড়াশুনা করার সুযোগ করে দেয়। এসএসসি পরিক্ষার পর আমাকে আশ্রম ছেড়ে চলে যেতে হয়। তবে এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠিতার সাহায্যে আমি পলিটেকনিক্যালে ভর্তি হতে পারি। তারপর থেকেই নিজের খরচ নিজেই বহন করি। সকালে টিউশন আর রাতে টিউশন এই ভাবেই নিজের পড়াশুনো চালিয়ে যাই। পলিটেকনিক্যালে পড়ার সময় আলিহানের সাথে পরিচয় আমার। তারপর বন্ধুত্ব। আলিহান ও অনেক সাহায্য করেছে আমায়।

– এখন কি করছেন? দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলো মেহের।

– আগের মতোই চলছে। তবে সাথে কোচিংটা যুক্ত হয়েছে। মৃদু হেসে জবাব দেয় রাহনাফ।

– আপনার পড়াশুনা কি শেষ? মেহের প্রশ্নে শুনে কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে রাহনাফ। অতঃপর বলো,

– নাহ। শুধুমাত্র ডিপ্লোমা শেষ। অর্থের অভবে এখনো বিএসসি করা হয়নি।

– ওহ। ছোট্টকরে শ্বাস ত্যাগ করে মেহের। তারপর সে রাহনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে আসে। পিছনে পরে থাকে রাহনাফ। আচমকা মেহেরের মুখে বিষন্মতার ছাপ কেন? আর মেহের এভাবে চলেই বা গেল কেন? আচ্ছা রাহনাফের কোন কথায় কি কষ্ট পেয়েছে মেহের, ভাবতে থাকে রাহনাফ।

বাসায় ফিরে সেদিন রাতে মেহের একটা গল্প লিখে পত্রিকা পেজে জমা দেয়। পরের দিন ভোরে সেই গল্পটা নবচেতনা পত্রিকাতে প্রকাশ পায়। সেদিন মেহেরের গল্প সারাদেশ লোক পড়ে, পড়েনি শুধু রাহনাফ।

১৬,
তারপর কেটে যায় তিনটা দিন। এই তিন দিনে মাত্র একবার দেখা হয়েছে মেহের আর রাহনাফের। তবুও সেটা মৌ আর আলিহানের দেখা করা নিয়ে। আজ মার্চ মাসের দ্বিতীয় দিন। কাল মেহেরের ডিবেট প্রতিযোগীতা “আমরাই সেরা” অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হবে টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে। মেহের রেডি হচ্ছে আজ সে আবার সেই চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোম যাবে। সেদিনের বৃদ্ধার কথা তার খুব মনে পরে। বৃদ্ধার সেই ছলছল চাওনি ভুলতে পারছে না মেহের। মেহের আজ বোরখা পরেই সেখানে যাবে।সকাল থেকে মৌ-য়ের মাথা ব্যাথা তাই সে আজ কোথাও যাবে না। মেহেরের রেডি হওয়া শেষে সে এবং তার মা সৈয়দা মাহবুবা দুজনে মিলে বেড়িয়ে যায়। কিছুদূর যেতেই তাদের পথ আলাদা হয়ে যায়। সৈয়দা মাহবুবা তার স্কুলের পথে চলে যায় আর মেহের যায় চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোমের দিকে।

রিক্সায় পাশাপাশি বসে কলেজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে রাহি আর রাহনাফ। মেয়েদের সাথে রিক্সায় বসলে এই এক সমস্যায় পরতে হয়। পুরো রাস্তা বকবক করতে করতে মাথা ব্যাথা করিয়ে দেয়। রাহি পাগলের মতো একা একা বকবক করে যাচ্ছে আর রাহনাফ রিক্সার এক পাশে চুপটি করে বসে আছে। বেশ বিরক্ত লাগছে তার। সাথে মাথাটাও ব্যাথা করছে তার। শুধুমাত্র সৈয়দ নওশাদের কথা রাখতে রাহির সাথে আজ ওকে একই রিক্সায় যেতে হচ্ছে। সৈয়দ নওশাদের কথা ফেলতে পারে না রাহনাফ। তারই সুযোগ নিচ্ছে রাহি। হঠাৎ রাহনাফের চোখ যায় একটা অটোর দিকে। যেখানে বসে আছে মেহের। মেহেরকে দেখেই যেন রাহনাফের মাথাব্যথা নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। সে তাকিয়ে থাকে সেই অটোর দিকে। অটোটা যখন ওদের রিক্সা ক্রস করে চলে যায় তখন রাহনাফ বলে উঠে,

– চাচা রিক্সা থামান? রাহনাফের কথামত রিক্সাওয়ালা তার রিক্সা থামিয়ে দেয়। রাহনাফ রিক্সা থেকে নেমে যাবে তখন রাহি রাহনাফের হাত ধরে বলে,

– কোথায় যাচ্ছো তুমি?

– কোথাও যাচ্ছি না। তুমি কলেজে যাও আমি আসছি। রাহির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় রাহনাফ তারপর সে রিক্সা থেকে নেমে যায়। রাহির মন খারাপ হয় যায়। সে বিষন্ন মন নিয়ে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের পানে। কিন্তু রাহনাফ, তার ভাবনাতে বিরাজ করছে মেহের। চলে যায় রিক্সা। রাহনাফ সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে রিক্সার জন্যে। রিক্সা পেলে সে পিছু করবে মেহেরের।

১৭,
ওল্ডএজ হোমের বাহিরে এসে অপেক্ষা করছেন একজন বৃদ্ধা। বয়সের ভারে শরীর তার নুইয়ে পরেছে। শরীরে চামড়ায় ভাজ পরেছে একাধিক। চোখে স্পষ্ট দেখতে পেলেও কানে একটু কমই শুনে। একটু গুজে হাটেন তিনি। অধিক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন তিনি। প্রতি মাসের শুরুতে তার ছেলে এসে তাকে ফলমূল ঔষুদ আরো নানান দ্রব্যাদি দিয়ে যায়। কাল তার ছেলে আসেনি আজ নিশ্চয় আসবে। ছেলেকে দেখতে পাবে, তাকে দু-হাতে ছুতে পারবে, আনন্দের যেন শেষ নেই আজ তার। বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগে বৃদ্ধাটি। কিছুসময় পর দেখা মেলে তার ছেলের। হাতে একখান ব্যাগ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে বৃদ্ধার ছেলে। ছেলেকে দেখে চোখদুটো পানি ভরে উঠলো তার। পরনে থাকা থানের এক অংশ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলেন তিনি। ছেলেটা তার কাছে চলে আসলো, বৃদ্ধা এবার আর তার চোখে জল আটকে রাখতে পারলেন না। শ্রাবণ ধারার মত করে বইতে শুরু করলো তার চোখের জল। ছেলেটা এসে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। এবার ছেলেটাও কাঁদছে। বাস্তবতা কতটা কঠিন। যে মা তাকে জন্ম দিয়েছে, আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলেছে সে আজ থাকে বৃদ্ধাশ্রমে। ছেলের এত বড় বাড়িতে জায়গা হয়না মায়ের। প্রতিয়া মেয়ে যদি তার শ্বাশুড় শ্বাশুড়িকে নিজের বাবা মায়ের মতো ভালোবাসতো তাহলে বিশ্বে কোন বৃদ্ধাশ্রম থাকতো না।

রিক্সা থেকে নেমে আশ্রামে ভিতরে প্রবেশ করার সময় মেহেরের চোখ আটকে যায় সে বৃদ্ধার দিকে। কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, কিন্তু কে সে। উল্টোদিকে থাকায় লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না মেহের। তাই সে ধীর পা তাদের দিকে এগোতো থাকে। মেহের বৃদ্ধার অনেকটা কাছাকাছি চলে আসছে তখনি লোকটা বৃদ্ধাকে ছেড়ে দু-হাতে আলতো করে তার চোখের পানি মুছে দেয়। লোকটার মুখ দেখা মাত্র মেহের দুপা পিছিয়ে যায়। অস্ফুটভাবে বলে,

– সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। এই বৃ্দ্ধার ছেলে সৈয়দ নওশাদ, তাহলে তো উনি,,,, আর মেহের কিনা এই বৃদ্ধার সাথে দেখা করার জন্যে এখানে এসেছে। নিজের উপর বেশ রাগ লাগছে না। রাগে হাতদুটি মুঠো করে নিলো মেহের। সৈয়দ নওশাদ তার মাকে ছেড়ে দিয়ে বুক পকেট থেকে স্মার্ট ফোন বের করে বলে,

– তুমি মেহের কে দেখতে চেয়েছিলে না মা। দেখো আমি আজ মেহেরের ছবি এনেছি। তারপর সে মোবাইলে মেহেরের ছবি তার মাকে দেখাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। বৃদ্ধা তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে,

– সেদিন মেহের এসেছিলো আমি দেখেছি ওকে। দু হাতে ছুইয়ে দেখেছি। জানিস বাবা এখন আর আমার আফসোস নাই। আমি আমার প্রথম নাতনীকে ছুয়ে দেখতে পারছি। তাদের বলা কথা তিক্ত লাগছিলো মেহেরের তাই সে হাত দিয়ে কান বন্ধকরে নেয়। তারপর সে নিরবে প্রস্থান করে।

চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোমের বাহিরে আসতেই দেখা হয়ে যায় রাহনাফের সাথে। রাহনাফকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো মেহের তখন রাহনাফ গিয়ে মেহেরের সামনে দাঁড়ায়। মেহের তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে রাহনাফের দিকে তাকায়। বিনিময়ে মৃদু হেসে রাহনাফ বলে উঠে,

– না আসলে হয়েছে কি? না মানে আসলে !

– কি মানে মানে করছেন বলুন তো। পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়েছেন কেন? কড়া গলায় বলে মেহের।

– কোথায় যাচ্ছেন?

– পাতালপুরীতে, আপনি যাবেন আমার সাথে।

– শুধু পাতালপুরী কেন, আপনি আমাকে যম রাজ্যে নিয়ে যেতে চাইলেও আমি বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যাব। মনে মনে বলল রাহনাফ।

– এভাবে হা করে কি দেখছে? সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।

– হ্যাঁ হ্যাঁ । রাহনাফ মেহেরের সামনে থেকে সরে যায়। মেহের তার ক্রোধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের উপর তারপর চলে যায়।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here