#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-১০,১১
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
১০
মেহেরের চলে যাওয়ার পানে রাহনাফ তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অধরে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলতে থাকে,
– জীবনটা অনেক সুন্দর হয় লেখিকা সাহেবা। যদি ভালোবাসায় এ জীবন পূর্ণতা পায়। যদি কেউ তোমার কষ্টটা ভাগ করে নিতে চায়, তাহলে তোমার জিবন সুন্দর লেখিকা । আর আমি তোমার কষ্ট গুলো নিতে চাই। আমার সকল আনন্দ তোমার মাঝে বিলিয়ে দিতে চাই লেখিকা সাহেবা।
বুকের উপর হাত ভাজ করে তাকিয়ে থাকিয়ে থাকে আকাশ পানে। শীতের শেষ প্রখর তাপ দিচ্ছে সূর্যিমামা। এতদিন যেন আকাশ মেঘে ঢাকা ছিলো আর আজ মেঘ কাটিয়ে উকি দিয়ে সূর্য। ঠিক যেন #মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর।
মোবাইলের রিংটোন এর শব্দে ঘোর কাটে রাহনাফের। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাম্বার দেখে নেয় রাহনাফ। মোবাইলের স্কিনে রাহি নামটা জ্বলজ্বল করছে। রাহনাফ কল রিসিভ করে বলল,
– আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব। রাহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে মোবাইল পকেটে পুরে রাখে। তারপর সে হাটতে থাকে সামনের দিকে।
১৭,
আজ সকাল থেকেই মেহেরের মনটা বিষণ খারাপ। সময়ানুক্রমে মন খারাপটা আরো দৃঢ় হচ্ছে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে সে ছাদে চলে আসে। যদি ছাদের এই মনোরমা পরিবেশ দেখে তার মন খারাপটা দূর হয়ে যায়। সৈয়দ মাহবুবা ছোট্টথেকে বাগান পছন্দ করতেন। আগে বাড়ির আশেপাশে উঠোনে অনেক গাছ রোপন করেছেন তিনি। এই ভাড়া বাড়িতে আসার পর ছাদে গাছ লাগান তিনি। সকাল সন্ধা দুই বেলা গাছের পরিচর্যা করেন সে।
তার ছাদ বাগানে রয়েছে আপেল, আমলকী, লেবু বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। ছাদের কোনো অংশে আবার লাগিয়েছেন পাথরকুচি, কালোমেঘা, তুলসী গাছসহ বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গাছ। সবজি ফল আর ফুলে ভরে গেছে পুরো ছাদ। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটি ছাদ নাকি সবুজ ফসলের মাঠ। মেহের গিয়ে লেবু গাছের পাশে দাঁড়ায়। কচি লেবুর পাতার গন্ধ শুকে নেয় সে। না ভালো লাগছে না। আচ্ছা এই ঔষুদি গাছগুলা কি মেহেরের মন ভালো করে দিতে পারবে। হয়তো পারবে না। মেহের তো শরীরে কোন আঘাত পায়নি তাহলে ঔষুদ লাগিয়ে কি হবে। কাল রাত থেকে মেহেরের মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরেন। যার কারনে আজ মেহের ডিবেট প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারে না মেহের এতেও মন খারাপ হয়নি মেহেরের। সব আগে তার মায়ের সুস্থতা বলে দাবি জানায় সে। সৈয়দ মাহবুবা মেহেরকে অনেকবার বলছে, সে যেন আঞ্চলিক ভাষার এই ডিবেট মিছ না করে। কিন্তু মেহের, সে তার অসুস্থ মা কে ছেড়ে কোথাও যাবে না। মায়ের সেবা আর মৌ-য়ের সাথে দুষ্টুমিতে ভালো কাটছিলো মেহেরের দুপুর।তার মধ্যে সৈয়দা মাহবুবা মেহের আর মৌ-কে ডেকে বলেন,
– মা-রে তোদের একটা কথা বলি শুন। আমার তো বয়স দিনদিন বেড়েই চলেছে। আজকাল শরীরটাও বেশী ভালো থাকে না। আজ ভালো থাকলে কালই মন্দ। কবে জানি পরপারে যাওয়ার ডাক এসে যায়।
– মা তুমি চুপ করবে। কেন এসব অলক্ষনে কথা বার্তা বলছো। এখন কোন কথা বলবে না তুমি। এতক্ষণ তো কোন কথাই বের হচ্ছিলো না মুখ দিয়ে। যেই জ্বরটা একটু কমেছে ওমনি শুরু করে দিয়েছো। মেহেরের কড়া শাসনে মৃদু হাসে সৈয়দা মাহবুবা। অতঃপর বলে,
– আমি তোদের দুজনের বিয়ে দিতে চাই। মেহু, মৌ তোদের যদি পছন্দের কেউ থাকে তবে সেটা আমাকে বলতে পারিস। আমি তাদের পরিবারের সাথে কথা বলবো।
সৈয়দা মাহবুবার মুখে বিয়ের কথা শুনে রেগে যায় মেহের। মেহের তো আগেই ঠিক করেছে সে বিয়ে করবে না। তাহলে তার মা বিয়ে দেওয়ার কথা কেন বলছে। মেহের চায়না তার মা বিয়ের পর যতটা কষ্ট পেয়েছে সেও কষ্টটা সে পাক। দুজন মানুষের পথ চলা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাক। মাঝপথ থেকে চলে যাক সে। তবে যে মেহের নিজেকে সামলাতে পারবে না। তার চেয়ে ভালো সে একাই সবটা পথ হাটবে। চায়না কারো সঙ্গ।
সৈয়দা মাহবুবা তার দুই মেয়ের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে তারা কি জবাব দেয় সেটা জানার জন্যে। মৌ চুপ করে থাকে কোন কথা বলে না। তবে মেহের সে চুপটি করে থাকার মেয়েই নয়। সে বলে উঠে,
– মা তুমিতো অসুস্থ তাহলে এখন এসব কথাবার্তা কেন বলছো বলতো। আর আমি তোামকে আগেও বলেছি মা, আমি বিয়ে করতে চাইনা। আমি বিয়ে করবো না। আমি তো তোমাকে দেখেছি নিজের জিবনের সাথে কতটা সংগ্রাম করেছো তুমি। পরিবার সমাজের সাথে লড়াই করে বাঁচছো তুমি। মা, তোমার মতো আমার এত ধৈর্য নাই। আমি পারবো না তোমার মতো জিবনের সাথে লড়াই করে বাচতে।
– তুই কেন আমার মতো লড়াই করবি বলতো মা। দেখবি তোর বর তোকে অনেক ভালোবাসবে।
সৈয়দা মাহবুবার এই কথাটা শুনে মেহেরের মন আরো বেশী খারাপ হয়ে যায়। হ্যাঁ তার বর তাকে ভালোবাসবে। এটাই স্বাভাবিক, কেননা তার গায়ে তো সাদা চামড়া। আর সুন্দর বউকে তো ভালোবাসবেই। মেহের সৈয়দা মাহবুবার দিকে করুন চোখে তাকায় অতঃপর বলে,
– সুন্দর বৌকে সবাই ভালোবাসে তাই না মা। কথাটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল মেহের।
মেহেরের কথার গভীরতা বুঝতে বাকি রইলো না সৈয়দা মাহবুবার। সে বড় করে শ্বাস ফেলে মেহেরের হাতদুটি ধরলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন,
– না মেহু। তোর ধারনাটা সঠিক নয়। সবাই বর্ণবাদী হয় না। একেক জন একেক রকমের হয়। আমার ভাগ্যে স্বামি শ্বাশুড় বাড়ির ভালোবাসা নেই তাই হয়তো আজ আমি একজন সিঙ্গেল মাদার। আমাদের দেশে এখন অনেক মানুষ আছে যাদের গায়ের রং কালো আর তারা স্বামি সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছে। কালো মেয়েদের সবাই অপছন্দ করে না। জানিস মেহু আমার দাদা কি বলতো, আমার দাদা বলতো, নদীর পানি ঘোলা ভালো আর জাতের মেয়ে কালো ভালো। ছোট বেলায় আমার গায়ের রং নিয়ে আমার প্রতিবেশী আত্নীয় স্বজনরা অনেক কটু কথা বলতো আর তাদের সকলের কথার প্রতিবাদ জানাতো আমার দাদা। কই আমার দাদা তো আমাকে অপছন্দ করেন নি। মেহু, সবার মন মানসিকতা এক হয় না।
সৈয়দা বেগমের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া করে না মেহু। নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করে সে। তারপর সোজা চলে আসে ছাদে। বাগানের প্রতিটা গাছকে ছুঁইয়ে দেখছে সে। তখন তার চোখ যায় ওদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানের সামনে। যেখানে কিছু বাচ্চা ছেলেরে সাথে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে রাহনাফ। রাহনাফের এই দিকটা খুব ভালো লাগে মেহেরের। রাহনাফ বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে তাই হয়তো রোজ বিকালে স্কুলের মাঠে ওদের সাথে ক্রিকেট খেলে। আনমনে হেসে ফেলল মেহের। এতক্ষণের মন খারাপটা এবার বোধহয় চলেই গেলো।
১৮,
নিজের রুমে বসে অফিসের কাজ করছিলেন সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। অফিসের কাজ তিনি অফিসেই বেশী করেন। আজকাল তিনি বাসায় বেশী আসেন না বলেই চলে। সারাদিন রাত অফিসেই কাটিয়ে দেন। সারাদিন অফিস করে দিন শেষে ঘরে ফিরলে যদি একটু শান্তিই না পাওয়া যায় তাহলে কার ঘরে ফিরতে মন চায়। তাই সৈয়দ নওশাদ এখন বেশী সময় অফিসেই কাটায়। গত কাল দিনটা তার খুব সুন্দর কেটেছে। মায়ের সাথে সময় কাটিয়েছে, এক সাথে বসে দুজনে খাবার খেয়েছে। বসে বসে কালকের কথাই ভাবছিলো সৈয়দ নওশাদ এমনি সময় রাহি এসে তার দরজার লক করে বলে,
– বাবা আসবো??
ঘোর কেটে যায় সৈয়দ নওশাদের। সে ভিতর থেকে জবাব দেয়,
– এসো।
রাহি এসে সৈয়দ নওশাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– বাবা আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।
– হুম বলো।
– বাবা, আমি। আমি রাহনাফকে বিয়ে করতে চাই।
রাহির কথা শুনে মাথা তুলে সামনে তাকায় সে। অতঃপর বলে,
– কি বললে তুমি।
– তুমি ঠিকই শুনেছো বাবা, আমি রাহনাফকে বিয়ে করতে চাই। আমি জানি এতে তোমার কোন আপত্তি নাই। তুমিও তো রাহনাফকে পছন্দ করো তাইনা বাবা।
– হ্যাঁ। কিন্তু সেটা শুধু মাত্র একজন ছেলে হিসাবে, মেয়ের জামাই হিসাবে নয়।
– বাবা প্লিজ, প্লিজ বাবা না করো না। রাহনাফকে বিয়ে করার বয়না শুরু করে দেয় রাহি।
– ঠিক আছে। আমি রাহনাফের সাথে কথা বলবো। সৈয়দ নওশাদের কথা শুনে রাহি খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। সৈয়দ নওশাদ তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
– পাগলী একটা। তোর কোন চাওয়া আমি অপূর্ণ রেখেছি কখনো। এটাও রাখবো না। রাহনাফের সাথে তোর বিয়ে হবে।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১১]
১৯,
আজ সকাল থেকে রান্নার কাজে খুব আছেন সৈয়দা মাহবুবা। স্কুলেও যাওয়া হয়নি তার। সকল থেকে এপর্যন্ত শুধু রান্না করছেন তিনি। মেহের ব্যাস্ত ঘর ঘুছাতে। মৌ- কে আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে। হ্যাঁ আলিহান ওর তার বন্ধুরা দেখতে আসছে মৌ-কে। সৈয়দা মাহবুবার জ্বর কিছুটা কমে এলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মৌ-য়ের বিয়ে আগে দেওয়ার। মেহেরকে পরে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করাবেন তিনি। মৌ-কে ওর পছন্দের কথা জিগ্যেস করতেই মৌ আলিহানের কথা জানায় সৈয়দা মাহবুবাকে। সৈয়দা মাহবুবা তার দুই মেয়ের সাথে বন্ধুসূলভ তাই হয়তো মৌ তার পছন্দের কথা তাকে জানাতে দ্বিধাবোধ করে নি। সৈয়দা মাহবুবা মৌ-য়ের পছন্দকে সামর্থ্য জানিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে চান। মৌ শাওয়ার নিয়ে নিজের রুমে জানালায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তার মনের মধ্যে বয়ে চলেছে অজানা ঝড়। আচ্ছা সৈয়দা মাহবুবার পছন্দ হবে তো আলিহানকে। নাকি সে আলিহানকে রিজেক্ট করে দিবে। যদি সৈয়দা মাহবুবা আলিহানকে অপছন্দ করে তাহলে কি হবে! মৌ-কি পারবে আলিহানকে ছেড়ে অন্যকাউকে বিয়ে করতে। না এটা সম্ভব না কখনো। জানালায় খিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে থাকে দূরের ওই রাস্তায়। এখান দিয়েই আসবে আলিহান।
– মৌ, তুই এখনো রেডি হোস নি। কিছুক্ষণের মধ্যে পাত্রপক্ষ চলে আসবে। রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল মেহের।
মেহেরের কথার কোন জবাব দিলো না মৌ। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকটায়। মৌ-য়ের থেকে কোন জবাব না পেয়ে মেহের ধীর পায়ে মৌ-য়ের পাশে দাঁড়ায়। মৌ-কে এমন গম্ভীর হয়ে ভাবতে দেখে মেহের মৌ-য়ের কাধে হাত রেখে বলে,
– এত মনযোগ দিয়ে কি ভাবছিস মৌ?
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে দৃষ্টি নামিয়ে সামনে তাকায় মৌ। মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু সূরে বলে,
– মেহু তুই?
– তোর কি হয়েছে বলতো মৌ। সকাল থেকে দেখছি কেমন মন মরা হয়ে বসে আছিস। তোর কি কোন কারনে মন খারাপ।
মেহের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মৌ। বিছানায় এসে বসতে বসতে বলে,
– নারে, ভাল্লাগছেনা।
– সেটাই তো জানতে চাই। কেন ভালো লাগছে না তোর? তোর পছন্দের মানুষটাই তো তোকে দেখতে আসছে তাহলে ভালো লাগছে না কেন? মেহের মৌ-য়ের পাশে বসতে বসতে বলল। মেহের কথা শুনে মৌ ওর দিকে করুন চোখে তাকালো। অতঃপর বলল,
– আন্টি আলিহানকে পছন্দ করবে তো, মেহু। অভিযোগের সূরে কথাটা বলল মৌ। মৌ-য়ের কথা শুনে খিল খিল করে হেসে দেয় মেহের।
– এইজন্য এমন গাল ফুলিয়ে বসে আছিস। মেহের মৌ-কে জড়িয়ে ধরে আর বলে,শান্ত হো। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মৌ মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– আমার খুব ভয় হচ্ছে মেহু। আসলে নিজের পছন্দের মানুষ দেখতে আসছে তো তাই এত টেনশন হচ্ছে। আন্টি যদি আলিহানকে পছন্দ না করে।
মেহের মৌকে ছেড়ে ওর গালে হাত রেখে বলে,
– ধুর পাগলী, কেন এত চিন্তা করছিস। সব ঠিকঠাকই হবে। তুই এখন রেডি হয়ে নে। আমি যাই মা-কে একটু হেল্প করি। মেহেরের কথার সম্মতি স্বরুপ মাথা নাড়ায় মৌ। অতঃপর মেহের চলে যায় আর মৌ রুমে বসে রেডি হতে থাকে
আলিহান ও তার তিন বন্ধু এসেছে মৌ-কে দেখতে। এদের মধ্যে রাহনাফ ও এসেছে। সবাইকে বসার রুমে রেখে মেহের ওর মাকে ডাকতে চলে যায়। সৈয়দা মাহবুবা রান্না সেরে গোসল করতে গিয়েছেন মাত্র। প্রায় দশ মিনিট পর সৈয়দা মাহবুবা বসার রুমে আসেন। সৈয়দা মাহবুবাকে দেখে আলিহান দাঁড়িয়ে যায়। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সৈয়দা মাহবুবার দিকে। সৈয়দা মাহবুবা ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আলিহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– তুমি দাড়িয়ে গেলে কেন বাবা। বসো।
– ছোটমনি। অস্ফুটভাবে বলল আলিহান। তবে এটা সৈয়দা মাহবুবার কান পর্যন্ত ঠিকই পৌছালো। সৈয়দা মাহবুবা তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে বলে উঠলেন,
– কি- কি বললে তুমি।
সৈয়দা মাহবুবার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না আলিহান। সে তার আসন ছেড়ে দ্রুত সৈয়দা মাহবুবার কাছ গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। দু-হাতে শক্তকরে সৈয়দা মাহবুবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
– ছোটমনি, তুমি আমাকে চিনতে পারছো না। আমি তোমার গুড্ডু। তুমি আমাকে চিনতে পারছো না। কোথায় হাড়িয়ে গেছিলো তুমি। জানো কত খুজেছি তোমাকে আমি। আলিহান সৈয়দা মাহবুবাকে ছেড়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলিহানের পরিচয় শুনে সৈয়দা মাহবুবা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখদুটো তার অশ্রুতে ভরে গেছে। ছলছল করছে পানিতে। তিনি তার হাতদুটি আলিহানের গালে রেখে কান্নামিশ্রত সুরে বললেন,
– গুড্ডু। আমার গুড্ডু, কত বড় হয়েগেছিস তুই। ছোট মনির কথা মনে আছে তোর। সৈয়দা মাহবুবা আলিহানকে তার বুকে জড়িয়ে নিলেন।
পাশাপাশি বসে আছে আলিহান আর সৈয়দা মাহবুবা। ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে মেহের। এখানে কি হচ্ছে কিছুই ডুকছে না তার ছোট্ট মাথায়। আর এই আলিহানই বা কে? তার মায়ের সাথে আলিহানের কি সম্পর্ক। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহেরের মাথায়। আলিহান তার মা-কে এভাবে জড়িয়ে রেখেছে কেন? নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে মেহের ওর মাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
– মা, আলিহান ভাইকে তুমি কি করে চিনো। কই আগে তো কখনো তার সম্পর্কে আমাদের বলো নি।
মেহেরের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন কর্নোপাত হতেই আলিহান সৈয়দা মাহবুবার দিকে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকায়। আলিহানের প্রশ্নের জবাব স্বরুপ সৈয়দা মাহবুবা মৃদু হেসল মাথা নাড়ায়। তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে ডাকে। মেহের গিয়ে সৈয়দা মাহবুবার পাশে বসে তখন পাশ থেকে আলিহান মেহেরের চুল টেনে বলে,
– এটাতো পুরাই পিচ্চি। মেহের বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আলিহানের প্রতি। তারপর সে সৈয়দা মাহবুবার দিকে জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা লম্বা করে শ্বাস টেনে বলে,
– গুড্ডু তোর ভাই মেহু। তোর চাচাতো ভাই সে।
সৈয়দা মাহবুবার কথা শুনে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহের। অতঃপর সৈয়দা মাহবুবা আবার বলে,
– গুড্ডু হচ্ছে তোর বড় চাচার ছেলে। তোর বড় চাচা আর চাচি গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায় তারপর থেকে আমি যতদিন ছিলাম ওকে দেখাশোনা করেছি।
সৈয়দ মাহবুবার কথা শুনে উঠে দাঁড়ায় মেহের। দু-হাতে শক্ত করে উড়নাটা চেপে ধরে নিজেকে কঠিন পজিশনে নিয়ে যায়। অতঃপর বলে,
– আমার কোনদিন বাবাই ছিলো না তাহলে চাচা আসবে কোথা থেকে।
মেহেরের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবা কিছু না বললেও আলিহানের বন্ধুরা বেশ অবাক হয়। আলিহানও অবাক হয়েছে। তবে রাহনাফ একটু বেশীই অবাক হয়েছে, এইতো কিছুদিন আগে মেহের বলেছিল ওর বাবা মারা গেছে তাহলে আজ কেন বলছে ওর কোন দিন বাবা ছিলোই না। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেহেরের মুখ পানে তাকিয়ে থাকে রাহনাফ। সে তার লেখিকা সাহেবাকে মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারে না। তার মাথায় যে কখন কি চলে কে জানে। রাহনাফ নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে বলে উঠলো,
– এ আপনি কি বলছেন লেখিকা সাহেবা। আপনার বাবা ছিলো না মানে?
– হ্যাঁ আমার বাবা কখনো ছিলো না, না এখন আছে আর না ভবিষ্যৎ এ কোন দিন থাকবে। আমার মা একজন সিঙ্গেল মাদার।
নিজেই একদমে কথা গুলো বলে চলে যায় মেহের। মৌ-য়ের সাথে তার কথা বলতে হবে। এই বিয়েটা যে করেই হোক ভাংতে হবে। কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না এই বিয়ে। না হলে যে পুরো অতীতটা ওদের সামনে চলে আসবে। মেহের ওর মাকে ভেঙে পরতে দেখতে পারবে না কখনো না। মেহের চলে যেতেই আলিহানের এক বন্ধু বলে উঠে,
– আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো পত্রীকে কউ নিয়ে এসো।
মেহের চলেই যাচ্ছিলো তখন সৈয়দা মাহবুবা পিছন থেকে ওকে ডাক দিয়ে বলেন,
– মৌ-কে নিয়ে এসো।
মেহের করুন চখে সৈয়দা মাহবুবার মুখের দিকে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা তার মেয়ের চাওনি উপেক্ষা করেন। বাধ্যে মেহের মৌ-কে পাত্র পক্ষের সামনে নিয়ে আসে। দেখুক যত খুশি দেখে নিক। দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। এই বিয়ে মেহের হতে দিবে না। সে তার মা আর মৌ কে নিয়ে এই শহর ছেড়ে চলে যাবে।
বাঙালীর একটা রীতি আছে, পাত্রী দেখার সময় পাত্রীকে সম্মান স্বরুপ কিছু টাকা উপহার দেওয়া হয়। সেই রীতিটাই পালন করতে মেহের আলিহানের কাছে টাকা দাবি করে। প্রতিউত্তরে রাহনাফ বলে উঠে,
– আসলে আসার সময় আমরা কেও টাকা নিয়ে আসে নি। বিশ্বাস না হলে আপনি আমাদের পকেট চেক করতে পারেন লেখিকা সাহেবা।তবে আমার বিকাশে কিছু টাকা আছে! আপনি যদি আপনার বিকাশ নাম্বার দিতেন তাহলে আমি এখুনি সেন্ড মানি করে দিতাম।
রাহনাফের কথা শুনে মেহের সহ উপস্থিত সকলের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মেহের ড্যাবড্যাবিয়ে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে ভাবে,
– পাত্রী দেখতে এসে সেন্ড মানি করতে চায়, এটা কি মজা করছে নাকি সত্যিই ওনাদের কাছে টাকা নাই। বেপারটা ওর কাছে কেমন লাগছে। মেহের কোন কথা না বাড়িয়ে বলে,
– ঠিক আছে, টাকাটা আপনি পরে দিয়ে দিয়েন। সেন্ড মানি করার কোন প্রয়োজন নেই। তারপর সে মৌ-কে নিয়ে তার রুমে চলে যায়। মেহেরের এমন কান্ডে রাহনাফের মনটা ছোট হয়ে যায়। কত আশা নিয়ে নাম্বারটা চেয়েছিলো সে। ভাবছিলো এই সুযোগে সে মেহেরের নাম্বারা জেনে যাবে। কিন্তু সেটাও হলো না। মেহের তার সব আশায় পানি ঢেলে চলে গেলো। মেহের মৌ কে রুমে নিয়ে দরজাটা লক করে দেয়। মৌ শাড়ির ক্লিপ খুলতে খুলতে বলে,
– কি হয়েছে মেহু, একরম করছিস কেন?
– তুই এই বিয়ে করবি না মৌ।
মেহেরের কথা শুনে মৌ-য়ের হাত থেমে যায়। সে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহেরের দিকে। আর ভাবতে থাকে সবই তো ঠিক আছে তাহলে এই মেহুর আনার হলোটা কি??
চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা