মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-১৪,১৫

0
851

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-১৪,১৫
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
১৪

– রাহনাফ, আপনি ঠিক কার কথা বলছেন! কাকে বিয়ে করার কথা বলছেন আপনি?

কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে রাহনাফকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো মেহের। মেহেরের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নে রাহনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে মৌনতা অবলম্বন করে কিছুক্ষণ। ছোট্ট করে একটা শ্বাস ত্যাগ করে মেহেরের দিকে তাকিয়ে মৌনতা ভেঙে রাহনাফ বলে উঠে,

– রাহির কথা বলছি আমি। রাহির সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার কথা চলছে। আপনি প্লিজ একবার হ্যাঁ বলে দিন লেখিকা সাহেবা। আমি শুধু আপনাকে চাই, আপনার হাত ধরে পাশাপাশি চলতে চাই বাকিটা জিবন। হুড খোলা রিক্সায় পাশাপাশি বসে গল্পের ফোয়ারা চালিয়ে অনেক দূর যেতে চাই। আপনার শীতল হাতে আমার উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেতেই কেপে উঠবেন আপনি আর আমি আদুরে আপনাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিবো। প্লিজ লেখিকা সাহেবা আমায় ফিরিয়ে দিবেন না।

রাহনাফের কথাশুনে আপনাআপনি মেহেরের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। অবাক চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই ছেলেটা তো প্রেমের রচনা বলছে। এটা শুধু মাত্র স্বপ্ন তাছাড়া বাস্তবে এসব হয় নাকি। অধোর কামড়িয়ে লম্বা শ্বাস টেনে মেহের বলে উঠে,

– আপনি রাহিকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় রাহনাফ। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।

– কেন পারবেন না আপনি। প্লিজ লেখিকা সাহেবা আমায় ফিরিয়ে দিবেন না তাহলে আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো। আপনাকে দেখলে আমার হাজার বছর বাচার ইচ্ছে জাগে। আমার মুখের হাসি দেখলে আমি লড়াই করার সাহস পাই। আপনার পাশাপাশি যখন থাকি তখন মনে হয় আমি পৃথীবির সবচেয়ে সুখী মানব।

– আপনি ভুল পথে হাটছেন মিস্টার রাহনাফ। এখনো সময় আছে সঠিক পথে পা বাড়ান। কথাটা বলেই মেহের রাহনাফকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। অমনি রাহনাফ মেহেরের হাত ধরে আবার আগের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়। অতঃপর বলে,

– কি সমস্যা আপনার। আমাকে মেনে নিতে আপনার প্রবলেম কোথায়??

– প্রবলেম। মৃদু হাসে মেহের। আপনি নিজেই মস্ত বড় একটা প্রবলেম। রাহি আপনাকে ভালোবাসে আর সৈয়দ নওশাদ রাহির সাথে আপনাকে বিয়ে দেওয়ার জন্যে আপনার পিছনে লাক্ষাদিক টাকা ইনভেস্টমেন্ট করতে চাইছেন। আর আপনি কিনা রাহিকে বিয়ে করবে না। আপনাকে আমি কোনদিনও বিয়ে করবো না। হাত ছাড়ুন আমার। শেষ কথাটা চেঁচিয়ে বলে মেহের।

মেহেরের কথা মনে হয় রাহনাফের কর্ণপাত হলো না। সে করুন চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

-চলুন লেখিকা আমরা বিয়ে করে নেই। পরে আন্টিকে আমি বুঝিয়ে বলবো।

রাহনাফের কথা শুনে মেহেরের প্রচণ্ড রাগ হয়। সে রাগে কটমট করে রাহনাফের থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত রাহনাফের শক্তির সাথে পেরে উঠেনা। তাই সে রাহনাফের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। এতেও রাহনাফ কোন প্রতিক্রিয়া করে না। সে আগের চেয়ে আরো শক্ত মুঠি করে নেয়। মেহেরে চোখের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলে উঠে,

– একবার শুধু এই হাত ধরে রাখার অনুমতি দেন লেখিকা দেখবেন শত ঝড় আসলেও এই হাত ছাড়বো না আমি। একবার বিশ্বাস করেই দেখুন আমায় লেখিকা, আপনার বিশ্বাস আজিবন অটুট রাখার দায়িত্ব আমার।

– অনুমতি ব্যতীত হাত ধরাটা কি ঠিক। আপনার থেকে এটা আশা করিনি আমি। আমার হাত ছাড়ুন আশেপাশে সবাই আমাদের দেখছে।

বিনা বাক্যে মেহেরের হাত ছেড়ে দেয় রাহনাফ। মেহের তার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে রাহনাফ যেখানটায় ধরেছিলো সেখানে লাল দাগ বসে গেছে। হাতের দিকে একপলক তাকিয়ে রাহনাফের দিকে তাকায় মেহের। তাখন খেয়াল করে রাহনাফের চোখে পানি টলমল করছে। মেহের থামকে যায় রাহনাফের চোখের পানি দেখে। সে তাকিয়েই থাকে রাহনাফের অক্ষির দিকে। দু-ফোটা অশ্রু রাহনাফের চোখের কোটর গড়িয়ে গাল বেয়ে মাটিতে পরে যায়। এই দৃশ্য দেখে মেহেরের বুকের বা পাশটায় চিনচিন করে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কি এই ব্যাথার কারন জানা নাই মেহেরের। শুধু বুকের ভিতরের ব্যথাটাই অনুভব করছে সে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না মেহের। মাথা নিচু করে দু-হাতে উড়না খামচে ধরে সে। তারপর নিরবে সেখান থেকে প্রস্তান করে। রাহনাফ অশ্রুসিক্ত নয়নে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ না মেহের তার চোখের আড়াল হয়। মেয়ের চোখের আড়াল হতোই নিজের হাতটা উপরে তুলে নেয় রাহনাফ। মেহের যেখানে কামড় বসিয়ে দিয়েছে সেখানে মেহেরে দাতের দাগ বসে গেছে। স্মিত হাসে রাহনাফ আর দাগের ওই অংশটাতে নিজের অধোরে ছুইয়ে দেয়। দু-চোখের কোনে তার এখনো অশ্রুর ভীড়।

২৪,
বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অন্দকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবা। শাড়ির আচল নিচে পরে ফ্লোরের সাথে লেপ্টে আছে। জানালা দিয়ে বাতাশ এসে তার আধপাকা চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। বহুদিন পর নিজের চুলগুলো খোলা রেখেছেন। এর আগে কবে তিনি নিজের চুলে বাতাশের দোল খাইয়েছেন সেটা তার জানা নেই। আজ আকাশে চাদকে ঘিরে হাজার তারার মেলা বসেনি। চারিদিকে নিকশ কালো অন্দকার। দূর দূরান্তে শুধু বড় বড় দালানে জ্বলে থাকা লাইটের আলোয় জ্বলমল করে শহরটা।তবুও আলো আছে শহরের বুকে। অন্ধকার আকাশের মতোই তার মনটা আজ ভালো নেই। মনের আকাশে মেঘ জমেছ তার। লোকের এত কটু কথায় হাপিয়ে উঠেছেন তিনি। লড়াই করতে করতে ক্লান্ত তিনি। এর মধ্যেই আবার যদি প্রাক্তন স্বমী কল করে তাহলে পুরনো ঘা টা মনে হয় তাজা হয়ে উঠে। মনে ভিতরে পুষে রাখা রাগটা আবার মনে হয় জ্বলে উঠে। এমনটাই হয়েছে সৈয়দা মাহবুবার সাথে। বিকাল বেলা সৈয়দ নওশাদ কল করেছিলো তার নাম্বারে। কলটা রিসিভ করা হয়ে উঠেনি। সৈয়দ নওশাদ তার নাম্বার কোথায় পেলো সেটা ভাবতে ভাবতেই কল কেটে যায়। পরে আর কল করা হয়ে উঠে নি। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নিলেন কয়েকবার। তারপর আনমনে বলে উঠলেন,

– দমকা হাওয়ায় ঘুরপাক খেয়ে,
ঘুটঘুটে অন্ধকারে শূন্যতায় পতিত আমি।
আদুরে মিষ্টি সুরে কেউ সমবেদনা জানায়নি,
ভালোবাসার আঁচলে বাঁধা হইনি তাই হয়তো
ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস আমাকে ছাড়েনি। [শিখা]

– মা, এতরাতে তুমি এখানে! এখনো ঘুমাও নি যে?

মেহেরের কণ্ঠস্বর শুনে পিছনের দিকে ঘুরে তাকায় সৈয়দা মাহবুবা। মেহেরের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলে উঠেন,

– ঘুম আসছে না রে। তুই এখানে কি করছিস?

মেহের ওর পায়ের পাশে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আদিরে গলায় বলল,

– আমারও ঘুম আসছে না। আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দিবে মা ।

মেয়ের এমন বাচ্চামো দেখে মৃদু হাসলেন সৈয়দা মাহবুবা। তারপর সে তার মেয়েকে নিয়ে বিছানায় চলে গেলেন।

সৈয়দা মাহবুবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে মেহের। সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর কথা বলছেন। মেহের চুপচাপ তার মায়ের কথা শুনে যাচ্ছে। দু-চোখের পাতা মেলানোর সাহস পাচ্ছে না সে। এতক্ষণ নিজের রুমে ঘুমানোর জন্যে যতবার দু-চোখের পাতা এক করেছে তাতবারই রাহনাফের সেই অশ্রুসিক্ত নয়ন ভেসে উঠেছে তার চোখের সামনে। চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেনি মেহের। পরপর কয়েকবার চেষ্টা করার পরেও যখন এমনটা হয়েছে তখন সে বাধ্য হয়েই তার মায়ের রুমে চলে আসে। সৈয়দা মাহবুবা কথা বলার ফাকে যখন দেখলেন মেহের এখনো ঘুৃমায় নি তখনি তিনি মেহেরকে জিগ্যেস করেন,

– এখনো ঘুমাচ্ছিস না কেন? আর তোর চোখমুখ এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন?

– আমি আমার চোখ বন্ধ করতে পারছি না। যতবার আমার দু-চোখের পাতা এক করেছি ততবারি রাহনাফের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মায়ের কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বসে পরলো মেহের।

মেহেরের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবার হাত থেমে যায়। সে তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন তারপর বললোন,

– রাহনাফ কে দেখতে পাস মানে কি?

– হ্যাঁ মা। তারপর রাহনাফের ভালোবাসার কথা আর ওর পাগলামিগুলার কথা বলে তার মাকে। সব শুনে সৈয়দা চুপকরে বসে থাকে কিছুক্ষণ তারেপর সে নিজে রাহনাফের নাম্বারে কল করে বলো,কাল তার সাথে দেখা করতে।

এদিকে রাহনাফ সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি।সন্ধায় রাহি কল করে অনেক কান্নাকাটি করেছে। রাহনাফ মোবাইলে ওকে কিছু বলতেও পারছিলো না। কখন সকাল হবে আর রাহির সাথে কথা বলবে সে। যে করেই হোক রাহিকে বুঝাতে হবে। রাহিকে সে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না। তার মন জুরে শুধু মেহেরের বসবাস। আজ না হয় কাল মেহের তার ভালোবাসা গ্রহণ করবেই এটা নিজের উপর বিশ্বাস রাহনাফের। সত্যি কারের ভালোবাসা কখনো হেরে যেতে পারে। প্রকৃতি এটা কিছুতেই মেনে নিবে না। সকাল হতেই রাহনাফ কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে রাহির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বের হয়।।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১৫]

রাহির হাত থেকে রক্তের স্রোত ছুটছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার রুম। রুমের সব জিনিসপাতি লণ্ডভণ্ড হয়ে পরে আছে। ড্রেসিংটেবিলের আয়নাটা ভেঙে চুড়মার হয়ে পরে আছে। তার সামনে ফুলদানিটা কয়েক টুকরা হয়ে পরে আছে। বিছানার বালিশ চাদর এলোমেলো ভাবে নিচে পরে আছে। রাহি ফ্লোরে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে দু-চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ওর হাতের রক্ত বিছানায় পরে সাদা চাদরটা লাল বর্ণ ধারন করেছে। ওদিকে রাহির মা অনেক্ষন যাবৎ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। সে বিরতিহীনভাবে রাহিকে ডেকে চলেছে।মেয়ের জন্য খুব টেনশন হচ্ছে তার। সকাল হতেই রাহনাফ আসে রাহির সাথে দেখা করতে। রাহি রাহনাফকে নিয়ে সোজা তার রুমে চলে আসে তারপর দুজনে প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎ কথা বলে। দুই ঘন্টা পর রাহনাফ চলে গেলেও রাহি তার রুম থেকে বের হয়নি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল রাহি তবুও তার রুম থেকে বের হলো না। রাহিকে রুমের বাহিরে আসতে না দেখে রাহির মা বুঝে যায় দুজনের মাঝে কিছু প্রবলেম হয়েছে। রাহনাফ রাহিকে উল্টাপাল্টা কিছু বলছে তাই হয়তো রাহি রাগ করে রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছে।বন্ধ রুমে থাকলে কি আর সমস্যায় সমাধান হবে। যে কোন সমস্যা আসলে আগে সমস্যাটির মোকাবিলা করতে হবে। রাহির মা রাহিকে ডাকতে আসে। দরজার ওপাশে দাড়িয়ে অনবরত রাহিকে ডেকে যান তিনি। কিন্তু রাহির কোন রিসপন্স -ই পাচ্ছে না। রাহির তার ডাকের সারা দিচ্ছে না। একটু ভয় পেয়ে যায় রাহির মা। দৌড়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে সৈয়দ নওশাদকে কল করে সব বলে তারপর একটা সার্ভেন্টকে ডেকে নিয়ে যান রাহির রুমের সামনে। সার্ভেন্ট দরজার লক ভেঙে দেয় তারপর রাহির মা রুমে প্রবেশ করে। রুমের ভিতরে প্রবেশ করতেই রুমের অবস্থা দেখে থমকে যায় রাহির মা। নিঃপলক সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর যখন সে বিছানার দিকে তাকায় তখনি চিৎকার করে উঠেন তিনি। লম্বা পা ফেলে রাহির কাছে যেতে চাইলে একটা কাচের টুকরো তার পায়ে ফুটে যায়। আহঃ শব্দ করে নিচে তাকাতেই ভাঙা আয়নায় নিজের মুখ দেখেন তিনি। কেপে উঠে রাহির মা। লোক মুখে শুনেছেন তিনি ভাঙ্গা আয়নার মুখ দেখলে নাকি বিপদ আসে যদিও এই আধুনিক যুগে এই প্রথা মানে না কেউ। তবে আজ কেন জানি মানতে ইচ্ছে করছে। সামনে দিকে তাকিয়ে রাহিকে এক পলক দেখে নেন। তারপর ড্রেসিংটেবিলের দিকে তাকিয়ে বলেন,

– নাহ আমার রাহির কিছু হবে না। আমার রাহির কিছু হলে কাউকে ছাড়বো না আমি, কাউকে না।

নিজের একাধিক প্রতিবিম্ব ভাঙ্গা আয়নাতে দেখে নিলেন তিনি। ততক্ষণ কয়েকজন সার্ভেন্ট রাহির কাছে চলে এসেছে। তাদের মধ্যে একজন রাহির কাছে বসে অন্যজন রাহির হাত ধরে নেয়।

– আপামানি তার হাতের রগ কাইটা ফালাইছে ম্যাডাম।

একজন সার্ভেন্টের কথায় রাহির মা চমকে উঠে। দ্রুত রাহির পাশে বসে কান্না করতে থাকেন তিনি। অপর সার্ভেন্ট বলে,

– আপামনিকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়্যা যাইতে অইবো। না হলে তাকে বাচান যাইবো না। সার্ভেন্ট রাহিকে পাজা কোলে তুলে নেয়। তারপর ড্রাইভার ডেকে রাহিকে নিয়ে চলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

২৫,
করিডোরে নিজের মাকে নিয়ে বসে আছে মেহের। তার পাশেই বসে আছে মৌ। মৌ করিডোরে বসে বসে ঝিমুচ্ছে আর একটু পরপর হাই তুলছে। মৌ-য়ের এমন অবস্থা দেখে মেহের রাগে ফুসছে আর মনে মনে মৌ-কে গালি দিচ্ছে। ঘুমাবি যখন তখন না আসলেই পারতি, দরদ দেখিয়ে হসপিটালে আসার কি দরকার ছিলো শুনি। সৈয়দা মাহবুবা তাকিয়ে আছে মেহেরের রাগিরাগি মুখের দিকে। মেহের যখন রাগ করে তখন সে ঠোট কামড়ায় আর নাক ফুলায়। নাক ফুলানোর সময় মেহেরে নাকে যে তিনটা আছে সেটা বড় হয়ে যায় দেখতে খুব ভালো লাগে। মেহেরের মা মেহেরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,

– এটা আমার মেয়ে অথচ আমিই তার উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারি না। কি দরকার ছিলো এত সুন্দর হওয়ার। সবাই তো আমার মেয়ের দিকে নজর দেয়। আল্লাহ দেখো কারো বদ নজর যেন না পরে আমার মেয়ের উপর। বড় করে শ্বাস নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। সুন্দর হলে একটাই সমস্যা, সকলের নজরে পরতে হয়। আর কালো মেয়েদের জিবনের প্রতিটা পদে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কালো মেয়েরাও সকলের নজরে পরে। কালো মেয়েদের কপালে ভালোবাসা জুটে না। তাদের অনেক কষ্ট। যেটা সৈয়দা মাহবুবা তার জিবন থেকে জানতে পারেছে। সে কালো বলেই তো তার স্বামি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে কারন তার সুন্দর বউ লাগবে।

মৌ নিজের ঘুম তাড়ানোর জন্যে হাটার সিদ্ধান্ত নেয়। বসে থাকে ঘুমপরিরা বেকে বসে। এবার সে হাটবে তাহলে যদি ঘুৃম দূর হয়। তবে এত বড় হসপিটালে একা হাটতে গিয়ে যদি হাড়িয়ে যায় তাহলে! আচ্ছা মৌ হাড়িয়ে গেলে কি আলিহান আবার বিয়ে করে নিবে। ওকে ভুলে যাবে আলিহান। সে নতুন বউ নিয়ে সুখে সংসার করবে তাকে আদর করবে ভালোবাসবে। নো নো এটা হতে পারে না। আলিহান শুধু মৌ-কে ভালোবাসবে। মাথা নাড়িয়ে সব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দেয়। মেহেরের দিকে তাকাতেই দেখে মেহের নিচের দিকে তাকিয়ে হাত কচলাচ্ছে। মৌ ততক্ষণাৎ মেহেরের পাশে গিয়ে বসে মেহেরের এত হাত নিজের হাতের মুঠিতে আবদ্ধ করে নেয়। মেহের তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে প্রশ্নের দৃষ্টিতে মৌ-য়ের দিকে তাকাতেই মৌ বলে উঠে

– চলনা ওদিকে একটু হেটে আসি।

অনেকক্ষণ বসে থেকে মেহেরের ও বোরিং লাগছে তাই সে আর আপত্তি করে না। সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলে,

– মা তুমি একটু বসো আমরা আসি।

– কোথায় যাবি তোরা?

– সামনের দিকটায়। তুমি বসো ভাইয়াও হয়তো এখনি চলে আসে।

অতঃপর মেহের আর মৌ হাটতে হাটতে চলে যায় অন্য একটা ওয়ার্ডে। পাশেই পরপর দুটো ওটি রাখা। যার একটাতে এখনো লাইট জ্বলছে। এদিকে ওদিক থেকে ডক্টর নার্সের ছুটাছুটি। মেহের আর মৌ হেটে হেটে সবটা দেখছে। হঠাৎ একটা নার্সের কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যায় দুজনে।

– পেসেন্টের হাত থেকে প্রচুর পরিমানে রক্ত ঝড়ছে। ইমিডিএটলি এ প্রজেটিভ রক্ত লাগবে।

– আপনারা যে করেই হোক রক্তের ব্যাবস্থা করে দিন। আমাদের আপামনিকে বাচান। যত টাকা লাগে সব দিবো শুধু আপামনিকে বাচিয়ে দিন কালো টিশার্ট পরিহিতা লোকটা বলল।

– টাকা থাকলেই সব হয় না। আপনারা রক্তের ব্যাবস্থা করুন। আমাদের ব্লাড ব্যাংকে এ প্রজেটিভ রক্ত শেষ হয়েছে। আপনারা যেখান থেকেই হোক রক্তের ব্যাবস্থা করে দিন। কথাগুলো বলে নার্স চলে যেতে চাইকে পিছন থেকে মেহের তাকে ডাক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে,

– রক্ত আমি দিবো। আমার ব্লাডগ্রুপ এ প্রজেটিভ।

মেহেরের কথা শুনে মৌ-য়ের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে অবাক চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,

– তুই রক্ত দিবি মানে! কিছুদিন আগেই তো ব্লাড ডোনেট করছি, আজ আবার দিবি। এরকম চলতে থাকলে তো তুই অসুস্থ হয়ে যাবি।

– আমার একটু রক্তের বিনিময়ে যদি একটা মানুষের প্রন বেচে যায় তাহলে ক্ষতি কি। মেহের নার্সের দিকে তাকিয়ো বলে,

– আপনারা আমার কি কি টেষ্ট করাবেন করে নিন। অতঃপর নার্স মেহেরকে নিয়ে চলে যায়। মৌ মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

রক্ত দেওয়া শেষে যখন চলে আসছিলো মেহের তখন একটা নার্স মেহেরকে বলে,

– আপনার আর পেসেন্টের রক্তের সব দিকটাই ম্যাচ করেছে। আশ্চর্য! এটা মিরাক্কেল। তা নাহলে দুজন অপরিচিত মানুষের মাঝে এতটা মিল থাকতে পারে না।
নার্সের কথাশুনে মৃদু হাসে মেহের তারপর সেখান থেকে চলে আসে।

দুহাতে মাথা চেপে ধরে করিডোরে বসে আছে মেহের। ওর পাশেই বসে আছে মৌ আর আলিহান। রাহনাফ মেহেরের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেরের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না রাহনাফ। দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার প্রিয়সীর দিকে। সৈয়দা মাহবুবা গেছেন ডাক্তারের চেম্বারে। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ ধীর পায়ে মেহেরের পাশে এসে দাঁড়ায়। আলিহান ওকে বসতে বললে, রাহনাফ চোখের ইশারায় বলে দেয় ঠিক আছে। মেহেরের পাশে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে রাহনাফ। রাহনাফের বড্ড ইচ্ছে করছে মেহেরকে দু-হাতে তার বুকে জড়িয়ে নিতে। মেহের মাথার গভীর চুলে বিলি কেটে দিতে ইচ্ছে করছে তার। আচ্ছা মেহেরে কি কোন দিনও তাকে সেই সুযোগ দিবো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানা কথা ভাবতে থাকে রাহনাফ। এর মধ্যে একজন ডক্টর আসে মেহেরের কাছে। ডক্টরকে দেখে মেহের দাঁড়াতে গেলে মাথা ঘুরে নিচে পরে যেতে নেয় আর তখনি রাহনাফ দু-হাতে মেহেরকে আগলে নেয়। তবে কিছু সময়ের জন্যে সেন্সলেস হয়ে যায় মেহের। রাহনাফ মেহেরকে পাজা কোলে নিয়ে একটা কেবিনে নিয়ে যায়। আলিহান আর মৌ ওদের পিছনে যায়। আলিহান যাওয়ার সময় ডক্টরকে ওদের সাথে নিয়ে যায়। মেহেরের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নেওয়া হয়েছে যার ফলে ওর শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। ডক্টর ওকে রেস্ট নিতে বলে। আর একটা লোককে ওদের কেবিনে ডাকে। লোকটাকে দেখে সকলে অবাক হয়ে যায়। মেহের বেড থেকে নামতে চাইলে মৌ ওকে আটকিয়ে দেয়। রাহনাফ তার চক্ষুদ্বয় সংকোচিত করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। আলিহান তাকে দেখা মাত্রই তার দৃষ্টি ঘুড়িয়ে অন্যদিকে তাকায়। কারন তাদের সামনে কোটসুট পরে দাড়িয়ে আছে সৈয়দ নওশাদ। ডক্টরের কথায় শুনে সকলের সকলে আরো বেশী অবাক হয়।

– স্যার এই সেই মেয়ে, যে আপনার মেয়েকো রক্ত দান করেছে।

অবাক হয়ে যায় মেহের। অজান্তেই কাকে রক্ত দিয়েছে সে। তাছাড়া কি হয়েছে রাহির। রাহনাফের চোখদুটো বড় বড় হয়ে যায়, সকালে তো রাহি ভালোই ছিলো। এইটুকু সময়ে কি হলো তার। সৈয়দ নওশাদ ডক্টরের কথা উপেক্ষা করে বলেন,

– মেহের।

তারপর সে পুরো কেবিনে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। আলিহানকে দেখে তার অধরে হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু আলিহান তার দিকে থেকে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here