মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-১৬,১৭

0
695

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-১৬,১৭
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
১৬

সৈয়দ নওশাদ আবেগ প্রবণ হয়ে মেহেরের মাথায় হাত রাখতে গেলে মেহের তার হাত সড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে,

– ছুঁবেন না আমাকে। আপনি আমাকে স্পর্শ করলে আমি নিজেও নোংরা হয়ে যাবো।

মেহেরের কথা শুনে সৈয়দ নওশাদ তার চোখ বন্ধকরে হাত শক্তমুঠি করে নেয়। পাশ থেকে রাহনাফ বাকা চোখে ওদের দিকে তাকায়। স্যার মেহেরকে আগে থেকে চিনতো, ওরা এভাবে কথা বলছে কেন? কই মেহের কিংবা স্যার তো আগে কখনো বলেনি তারা একে অপরের পরিচিত। রাহনাফের ভাবনার ছেদ ঘটে সৈয়দ নওশাদের কথায়।

– একবার বাবা বলে ডাক মা।

– আমার কোন বাবা নেই। প্লিজ আপনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যায়। আলিহান ভাই এই লোকটাকে আমার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বলো। চিৎকার করে বলে মেহের।

– চাচা আপনি কি করছেন, চলে যান এখান থেকে। কেন শুধু শুধু মেহুর শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা আবার তাজা করে তুলছেন। কি সুখ পান বলুনতো এই পিচ্চিটাকে কষ্ট দিয়ে। এগিয়ে এসে বলে আলিহান। আলিহানের কথা শুনে সৈয়দ নওশাদ ছলছল চোখে তার দিকে তাকায়।

– গুড্ডু, তোরও এত অভিমান।

– কি করবো বলুন, আপনি তো মানুষটাই এরকম। কাউকে আপন করে নিতে জানেন না, কারো কষ্ট বুঝেন না শুধু নিজেরটা ছাড়া। তাইতো দাদি আজ বৃদ্ধা আশ্রমে। আপনি কি পারতেন না দাদিকে বৃদ্ধাশ্রম যাওয়া থেকে আটকাতে। সুন্দরী বউয়ে এতটাই মোহ যে তার কথায় উঠছেন বসছেন। তার কথা শুনে নিজের মাকে পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে রাখলেন। ছোটমনি একা নিজের সাথে লড়াই করে মেহেরকে বড় করছে। আর মেহু বাবা থাকতেও বাবার পরিচয়হীন ভাবে বাঁচতে হচ্চে ওকে। চোখের সামনে বাবা থাকতে তাকে বাবা বলে ডাকতে না পারার কষ্টটা আপনি জানেন স্যার। জানেন না, কারন আপনার সব আছে। সুন্দরী বউ সুন্দরী কন্যা বাড়ি গাড়ি সব আছে।

রাহনাফের কথা শুনে ছলছল চোখে মেহেরের দিকে তাকায় সৈয়দ নওশাদ। মেহের তারদিকে ঘৃনা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে । রাহনাফ এগিয়ে এসে আলিহানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

– এসব তুই কি বলছিস আলিহান! মেহের স্যারের মেয়ে?

– হ্যাঁ। মেহু শুধু আমার শলিকা নয়, সে আমার ছোট বোন। এই নওশাদ আহমেদের প্রথম সন্তান মেহু।

আলিহানের কথা শুনে রাহনাফের মাথা ঘুরে যায় সে করুন দৃষ্টিতে মেহেরের দিকে তাকায়। মেহেরের দৃষ্টি তখন ছিলো নিচের দিকে।

সৈয়দ নওশাদ আহমেদ আবার বলে উঠে,
– মেহের তুই কি আমাকে কোন দিনও ক্ষমা করবি না মা।

– ক্ষমা, কিসের জন্যে ক্ষমা করবো আপনাকে বলতে পারেন। গর্ভাবস্থায় আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করার জন্যে, আপনার আরেকটা বিয়ে করার জন্যে নাকি জন্মের আগে আমাকে পিতার পরিচয় থেকে বঞ্চিত করার জন্যে। কোনটার জন্যে ক্ষমা করবো আপনাকে। যেখানে সব শিশুর বেড়ে উঠা হয় তার বাবার হাত ধরে, তাকে হাটিহাটি পায়ে হাটা শিখানো, মা বকলে সন্তান যখন গাল ফুলিয়ে বসে থাকে তখন বাবা তার সন্তানকে চুপিচুপি আদর করে সেই রাগ ভাঙিয়ে, সেই বয়সে আমি জানতামই না আমার বাবা কে? কি আমার বাবার পরিচয়। লোক মুখে কটু কথা শুনে বড় হয়ে উঠেছি। আমার মাকে দেখেছি সে কি করে আমাকে বাবা আর মা দুটোর আদর দিয়েছে তাই এই বয়সে এসে আমার বাবাব কোন প্রয়োজন নেই। তাহলে আমার মায়ের আদরকে অসম্মান করা হবে। আপনি চলে যায় সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। আর কোন দিন বাবার অধীকার নিয়ে আমার সামনে আসবেন না। আমি কোন দিন আপনাকে বাবা বলে মানতে পারবো না। আমার কোন বাবা নেই আমার মা একজন সিঙ্গেল মাদার।

মেহেরের কথা শুনে সৈয়দ নওশাদের চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। সে করুন চোখে তাকিয়ে রইলো মেহেরের দিকে। মেহের তার দৃষ্টি নামিয়ে মৌ-য়ের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরে। রাহনাফ এখনো তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। এই মেহেরকে দেখে বুঝাই যায় না তার মনের ভিতরে এতটা কষ্টা লুকিয়ে রাখা আছে। কতটা হাসিখুশি ভাবে সকলের সাথে সহজে মিশে যায় সে। মেহের মাথা তুলে সামনে তাকাতেই রাহনাফের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয়। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তখনি কথা বলতে বলতে কেবিনে প্রবেশ করে সৈয়দা মাহবুবা,

– মেহু কোথায় কি হয়েছে ওর!

সৈয়দা মাহবুবার কণ্ঠস্বর শুনে সবাই দরজার দিকে তাকায়। সৈয়দ নওশাদ মাথা ঘুড়িয়ে দরজার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়। কিন্তু এই কালো মহিলাকে দেখে অবাক হওয়ার কারনটা তিনি জানেন না। আচ্ছা মাহবুবা কি আগের থেকে আরো বেশী কালো হয়েছে দেখতে আরো খারাপ দেখায়? সৈয়দা মাহবুবার দৃষ্টি স্থির কেবিনের বেডের উপর। যেখনে আধো শোয়া হয়ে বসে আছে মেহের। তিনি সেদিকে এগিয়ে যায়। তখন মেহের বলে,

– আমার কিছু হয়নি মা। মাথাটা ব্যাথা করছে। তবে চিন্তার কোন কারন নাই। রক্ত দেয়ার পর কিছুটা মাথা ঘোরাবে এটাই স্বাভাবিক। তুমি বসো এখানে। তোমার কি অবস্থা ডক্টর কি বলল!

মেহেরের প্রশ্ন শুনে সৈয়দা মাহবুবা বড় করে শ্বাস ত্যাগ করলেন। এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না। তিনি মেহেরের পাশে বসতে বসতে বললেন,

– কিছু হয়নি আমার। আমি একদম সুস্থ। তোদের আগেই বলছিলাম, ডক্টরের কাছে যেতে হবে না কিন্তু তোরা তো কেউই আমার কথা শুনিস না। এই দেখ আমার রিপোর্ট।

মেহের তার মায়ের হাত থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে দেখতে লাগলো। সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,

– এমন অনিয়মিতভাবে রক্তদিলে চলবে। নিজের দিকটা দেখেছিস একবার।

– আমি ঠিক আছি মা। রক্তের অভাবের কারণে প্রতিবছর বহু রোগীর প্রাণ সংকটের মুখ পড়ে। এক ব্যাগ রক্ত দিতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট। এই অল্প সময়ে চাইলেই একজনের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। আমার সামর্থ্য থাকা সত্তেও কেন একজনের প্রাণ বাঁচাবো না বলো।

মেহেরের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবার চোখ অশ্রুতে ভরে গেলো। তবে এটা সুখের অশ্রু। তিনি পেড়েছে তার মেয়েকে মানুষ করতে। পাশেই দাঁড়িয়ে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করছেন। হাত দুটো শক্ত মুঠি করা তার। কত সুন্দর মা মেয়ের সম্পর্ক। তিনি চাইলে আজ এদের সুখের কারন হতে পরতো। মেহের তার মাকে বাহুডোরে আগলে রাখতে পারতেন তিনি। সৈয়দা মাহবুবা কথা বলার ফাঁকে লক্ষ করলেন কেবিনের ভিতরে সৈয়দ নওশাদ আহমেদের উপস্থিতি। তাকে দেখা মাত্রই থমকে যায় সৈয়দা মাহবুবা। চোখ-মুখ শক্তকরে বলে উঠেন,

– এই লোকটা এখানে কি করছে? কি হলো কেউ কথা বলছো না কেন? বলো এই লোকটা কি করছে এখানে?

– মাহবুবা আমি,,, আবেগী কন্ঠে কিছু বলতে চায় সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। তার কিছু বলার আগেই সৈয়দা মাহবুবা তার হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,

– আমি তোমাদের কাছে জানতে চাইছি।

– ছোটমনি, মেহু ওনার মেয়েকে রক্ত দিয়েছে তাই উনি এখানে এসেছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। পাশ থেকে বলে আলিহান।

আলিহানের কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবা তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে মেহেরের দিকে তাকালে মেহের হাত দিয়ে তার কান স্পর্শ করে বল মৃদু সুরে বলে, সরি, আমি জানতাম না। সৈয়দা মাহবুবা তার দৃষ্টি শক্তকরে নেয়। তারপর বলে,

– উনাকে এখান থেকে যেতে বলো।

সৈয়দা মাহবুবার কথা শুনে অধোর চেপে মৃদু হাসার চেষ্টা করে নওশাদ আহমেদ। তারপর কেবিনের সবাইকে অবলোকন করে নিয়ে দু পা পিছিয়ে উল্টোদিক ঘুরে চলে যায় কেবিনের বাইরে। নওশাদ আহমেদ যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন তাকে দেখে কেউ কেবিনের দরজার আড়ালে লুকিয়ে যায়। সৈয়দ নওশাদ চলে যেতেই সে দরজাটা খামচে ধরে। এতক্ষণ দরজার আড়ালে তাদের কথা শুনছিলো সে। সে দরজার আড়ালে মুখ লুকিয়ে অস্ফুটভাবে বলে উঠে,

– আমি কিছুতেই আমার অধীকার ছাড়বো না। প্রয়োজনে আরো একজনের প্রান যাবে। তারপর সে লম্বা পা ফেলে সেখান থেকে চলে যায়।

২৬,
মেহের তার মা-কে নিয়ে হসপিটাল থেকে চলে যায়। যাওয়ার আগে ডক্টর মেহেরকে পই পই করে বলে দিয়েছে তার ফুল বেড রেস্ট। সাথে ফলমূল তো আছে। ফলমূল খাওয়া কথা শুনে নাক সিটাকায় মেহের। এটা দেখে ডক্টর মৃদু হাসলেও রেগে যায় সৈয়দা মাহবুবা। রাহনাফ আর আলিহানও ওদের সাথে বের হয়ে যায়। কিছুদূর চলে আসার পর মনে হয় রাহির কথা। আলিহান আর রাহনাফ ওদের তিনজনকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে ওরা আবার ফিরে আসে হসপিটালে। তারা সোজা চলে যায় রাহির কাছে। রাহির মা বাসায় চলে গেছে এখন রাহির পাশে আছে শুধু সৈয়দ নওশাদ । রাহনাফকে দেখে সৈয়দ নওশাদ বলে,

– তুমি এখান থেকে চলে যাও রাহনাফ। রাহি তোমাকে দেখলে আরো কষ্ট পাবে। তুমি চলে যাও রাহিকে আমরা সামলে নিবো।

– কিন্তু স্যার,,

– কোন কিন্তু টিন্তু শুনতে চাচ্ছি না আমি। চলে যাও তুমি। আর কোনদিন যেন তোমাকে রাহির সাথে না দেখি।

সৈয়দ নওশাদের কথা শুনে আলিহান বলে উঠে,

– সৈয়দ নওশাদ আহমেদ ও তাহলে কারো জন্যে কষ্ট পায়। আমি তো ভেবেছিলাম সে শুধু তার নিজের কথা ভাবে।

– তুমি কি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ ভাবো আলিহান। প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সৈয়দ নওশাদ।

– নাহ, স্বরন করিয়ে দিলাম আপনার আরো একটা মেয়ে আছে। আপনার প্রথম সন্তান। তাকেও কি রাহির মতো ভালোবাসেন নাকি সবটাই লোক দেখানে। আপনি তো আবার লোক দেখানো কাজ করতে বেশী পছন্দ করেন। শেষ বাক্যটা বিরবির করে বলে আলিহান। কিন্তু সেটা সৈয়দ নওশাদের কানে পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছালো। সে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে আলিহানের দিকে তাকাতেই আলিহান রাহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– রাহি ঘুমিয়ে আছে। চল পরে আবার আসবো। উল্টোদিকে হাটা শুরু করে আলিহান। রাহনাফ চলে যাওয়ার আগে ঘুমন্ত রাহির দিকে একপলক তাকিয়ে বলে উঠে,

– আমি তোমার সেই ভালোবাসা নেই রাহি, যা তুমি আজিবন চেয়েছো।

রাহনাফ বড় করে শ্বাস নিয়ে চলে যায় কেবিনের বাইরে।

চলবে,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [১৭]

– রাহি, আমি তোমার সেই ভালোবাসা নই, যা তুমি আজিবন চেয়েছো।

কথাটা বলেই কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায় রাহনাফ। রাহনাফ চলে যেতেই পিটপিট করে চোখ খুলে রাহি। দু-চোখের গহব্বর অশ্রুতে ভরে গেছে তার। কেবিনের ভিতরে রাহনাফকে আসতে দেখে ঘুমের ভান করে ছিলো সে। কিন্তু ওদের কাছ থেকে এমন কথা শুনবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারে নি। তাহলে কি সত্যিই তার বাবা ভালো মানুষ নয়। তাহলে কে তার বোন। আলিহান কার কথা বলছিলো, নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। দৃষ্টি ঘুড়িয়ে তার বাবার দিকে তাকাতেই দেখে সৈয়দ নওশাদ বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। রাহি অশ্রুসিক্ত নয়নে সৈয়দ নওশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এটাই কি তার বাবা। আলিহান এতগুলা কথা বলল সে কোন প্রতিবাদ করলো না কেন? তাহলে কি সব সত্যি। তার আরো একটা মেয়ে আছে। তাহলে কে সে! সে কেন তাদের সাথে থাকে না। কোথায় আছে তারা? নানা প্রশ্ন এসে ভীড় জমিয়েছে রাহির মাথায়। পিছন থেকে জড়ালো কন্ঠে ডেকে উঠে রাহি,

– বাবা,

রাহির ডাক শুনে চমকে উঠেন সৈয়দ নওশাদ। ততক্ষণাৎ পিছনে ফিরে রাহির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কখন জেগেছে রাহি! আলিহানের বলা কথাগুলো কি সে শুনে নিয়েছেন। রাহিকে সরাসরি জিগ্যেস ও করতে পারছেন না তিনি। মহামুশকিলে পরেছেন।

– কখন উঠলে! না মানে কিছু বলবে?

– আমি বাড়ি যাব। তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চল বাবা।

সৈয়দ নওশাদ রাহির কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,

– খুব কষ্ট হচ্ছে মামনি! কেন এমনটা করতে গেলে বলতো। তোমার কি আমাদের কথা একবারও মনে পরে নি। যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তাহলে?

– বাবা, রাহনাফ।

– থেমে যায় সৈয়দ নওশাদের হাত। সে রাহির মাথা থেকে হাত সড়িয়ে বলেন,

– তুমি রাহনাফকে ভুলে যাও রাহি। আমি তোমার জন্যে রাহনাফের চেয়ে ভালো পাত্র যোগাড় করে দিবো। আমার রাজকন্যার জন্যে একটা রাজপুত্র ধরে নিয়ে আসবো।

সৈয়দ নওশাদের কথা শুনে রাহির সবটুকু আশা ভেঙে যায়। সে শুধু নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে।

২৭,
দুদিন ধরে বাসায় বসে বসে বোর হচ্ছে মেহের। রক্তদেওয়ার প্রথম দিন জ্বর আসলেও আজ সে সুস্থ তাহলে তাকে কেন বাসায় আটকিয়ে রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে মায়ের উপর খুব অভিমান মেহেরের। তার কলেজ পড়াশুনা লেখালেখি সবটাই অফ করে দিয়েছেন তিনি। এখন শুধু সারাক্ষণ খাওয়া আর ঘুম। এভাবে হাত পা ঘুটিয়ে কতক্ষণ বসে থাকা যায়। সৈয়দা মাহবুবাকে শত বুঝিয়েও বাহিরে যাওয়ার জন্যে রাজি করাতে পারে নি। তার এক কথা, একা সে মেহেরকে কোথাও যেতে দিবেন না। বিকালের দিকে রাহনাফ আসে ওদের বাসায়। রাহনাফ আসলে আলিহান, মৌ আর মেহেরকে নিয়ে বাহিরে যায়।

পিচডালা রাস্তায় পাশাপাশি হেটে চলেছে মেহের আর রাহনাফ। আলিহান আর মৌ সিনেমা হলে গেছে সিনেমা দেখতে। হলে নাকি আজ ভালোবাসার রং ছবি চলছে। ছবিটা নাকি হাউসফুল। মেহের স্ব-ইচ্ছায় যায়নি সেখানে। তাই মেহেরের সঙ্গ দিতে রাহনাফকে মেহেরের কাছে রেখে যায় আলিহান। এটা যেন রাহনাফের কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কিছুদূর হাটতেই মেহেরের জুতা যায় ছিঁড়ে। বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায় মেহেরের মুখ। কি আর করার এক হাতে জুতা নিয়ে পাশাপাশি হাটতে থাকে তারা। পৃথিবীর পারফেক্ট জুটি এই জুতা। একটা ছিঁড়ে গেলে অন্যটা অচল। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ মেহেরের
হাত তার হাতের মুঠিতে আবদ্ধ করে নেয়। মেহের তার হাত ছাড়াতে চাইলে রাহনাফ তার মুঠি আরো শক্ত করে নেয়। মেহের ক্ষিপ্ত হয়ে রাহনাফের দিকে বাকা চোখে তাকালে রাহনাফ ভুবন ভুলানো হাসি উপহার দেয়। থেমে যায় মেহের। হাসলে ছেলেদের গালেও টোল পরে এটা রাহনাফকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। কত সুন্দর তার হাসি শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। মেহের মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মেহেরের এমন চাহনি দেখে রাহনাফ বলে উঠে,

– এভাবে কি দেখছেন লেখিকা সাহেবা!

মেহের নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
– আমি আপনাকে ভালোবাসি না।

– হুম জানি। আপনার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো আমিও কাউকে এত সহজে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আপনাকে ভালোবাসতে হবে না লেখিকা সাহেবা। শুধু আমাকে ভালোবাসা সুযোগ দিন। আমি আপনাকে আমরণ ভালোবেসে যাব।

– সেটা হয় না।

– কেন হয়না লেখিকা সাহেবা। দেখবেন একদিন আপনিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেবেন। হয়তো আমার থেকে বেশী। আমি না হয় সেই দিনটার অপেক্ষাতে রইলাম।

– সেইদিন কি আধো আসবে?

– আসবে। খুব শিগগীর আসবে।

– লেখিকা সাহেবা আমার একটা কথা রাখবেন?

– বলুন।

– আপনার প্রথম অটোগ্রাফটা আমায় দিবেন।

– কোথায় দিতে হবে?

– আমাদের বিয়ের কাবিননামায়। মনে মনে বলল রাহনাফ।

– কি হলো কিছু বলছেন না যে।

মৃদু হাসে রাহনাফ। তারপর দুজনে হাটতে হাটতে অনেকটা দূর চলে আসে। এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধা নামছে পৃথিবীর বুকে। পাখিরা সব নিজনিজ নীড়ে ফিরে যাচ্ছ। হাটতে হাটতে একসময় দাঁড়িয়ে যায় রাহনাফ। হাত উঁচু করে মেহের হাতের পাচ আঙ্গুলের মাঝে তার আঙ্গুলগুলো ডুবিয়ে দিয়ে বলে,

– আমার সঙ্গ আপনার ভালো লাগে।

– সেটা কখন বললাম।

– এতদূর চলে আসলাম অথচ নিজের হাত ছাড়ানোর বিন্দু মাত্র চেষ্টা করলেন না।

রাহনাফের কথা শুনে মেহেরের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে ততক্ষণাৎ নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। এটা দেখে রাহনাফ স্মিত হেসে বলে,

– মজা করছিলাম। চলুন আমরা ও দিকে যাই। হাতের ইশারায় সামনের দিকটা দেখিয়ে বলে। মেহের ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের উপর তারপর সে রাহনাফের আগে আগে হাটতে থাকে। পিছন থেকে রাহনাফ মেহেরকে ডেকে বলে,

– সন্ধা নেমে আসছে বাড়ি ফিরতে হবে তো।

মেহের রাহনাফের কথা কর্ণপাত না করে সামনের দিকে হাটতে থাকে। রাহনাফের আর কি করার সে হেলেদুলে মেহেরের পিছনে হাটতে থাকে।

২৮,
গাড়ি করে বাড়ি ফিরছে রাহি ও তার পরিবার। সৈয়দ নওশাদ ড্রাইভ করছেন তার পাশের সিটে বসা তার স্ত্রী আর পিছনের সিটে জানালায় হেলান দিয়ে বসে বাইরের প্রকৃতি দেখছে রাহি। কোন কিছুতেই মন বসে না তার। সব কিছু তিক্ত লাগে। রাহনাফকে এত ভালোবাসার পরেও সে কেন রাহনাফের ভালোবাসা পেল না। রাহনাফ কেন তাকে মেনে নিতে পারে নি। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে তার। তার থেকেও বড় কথা রাহির বোন কে? সব প্রশ্ন এক সাথে মাথায় এসে ভর করেছে তার। সৈয়দ নওশাদের অতীত না জানা অব্ধি শান্তু হতে পারছে না সে। হঠাৎ ই তার দৃষ্টি পরে গিয়ে রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে। খড় পাতার ছাউনি যুক্ত চায়ের দোকান। পাশেই আছে বড় একটা কেরাম বোর্ড। যেখানে কয়েকজন যুবক কেরাম খেলছে। চায়ের দোকানের সামনে রয়েছে একটা বাশের বেঞ্চ। সেই বেঞ্চের উপর বসে মাটির ভারে চা খাচ্ছে রাহনাফ আর মেহের। মুহুর্তেই মধ্যেই রাহির বুকের বা পাশটায় চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠলো। কত সুন্দর মনোমুগ্ধকর একটা দৃশ্যপট। দুজন প্রেমিক প্রেমিকা পাশাপাশি বসে মাটির ভাড়ে চা খাচ্ছে। মাথার উপর জ্বলছে লাল রংয়ের একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব। লাল লাইটের আলোতে দুজনের মুখ জ্বলজ্বল করছে। দূর থেকে কত সুন্দর ই না লাগছে এই দৃশ্যপট। মনোমুগ্ধকর সিগ্ধ ভালোবাসায় জর্জরিত একটা মোমেন্ট। রাহির চোখের কোটর গড়িয়ে অশ্রু পরলো। ওদের উপর থেকে তার দৃষ্টি সড়াতে চেয়েও পারছে না সে। তার গাড়িটা এখানে থামাতে হলো। স্থীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

সৈদয় নওশাদ ড্রাইভিং করার সময় যখন রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে ওদের দেখতে পান তখনি তিনি গাড়ি ব্রেক করে নেন তার তাকিয়ে থাকেন মেহেরের দিকে। দৃই দৃশ্যটা রাহির মায়ের চোখ এড়ালো না। সে সৈয়দ নওশাদের দৃষ্টি বরাবর লক্ষ করে যখন মেহের আর রাহনাফকে দেখতে পান তখনি রাগে তিনি কপাল কুচকে ফেলেন। শাড়ির আঁচল খামচে ধরে সে দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, অতঃপর রাহির কথা মনে হতেই সে পিছনে ফিরে আর রাহিকেও ওদের দিকে তাকিয়ে কান্না করতে দেখে তিনি সৈয়দ নওশাদকে তাড়া দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করতে বলেন। সৈয়দ নওশাদ রাহির দিকে এক পলক তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেন। চলে যায় রাহি কিন্তু তার মন পরে থাকে খড় পাতার ছাউনিযুক্ত এই চায়ের দোকানে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here