মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-২০,২১

0
536

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-২০,২১
মাহফুজা_মাহফুজা_শিখা
২০

– তোর জিবনে এমন একজন আসবে যে তোকে তোর চেয়ে বেশী ভালোবাসবে। তোর খেয়াল রাখবে যত্ন নিবে।আলিহানের কথা শুনে অধোর চেপে হাসে রাহি। আড় চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। রাহি কি আর কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারবে যতটা সে রাহনাফকে ভালোবাসে। হয়তো না, আবার হয়তো হতেও পারে। একজন মানুষের জিবনে অন্য একটা মানুষের জায়গা কখনো শূন্য পরে থাকে না, কেউ না কেউ এসে সেই শূন্য জায়গাটা পূর্ন করে দেয়। রাহনাফকে পেয়ে গেলে হয়তো একাকিত্বের স্বাধ নেওয়া হতো না। তাই পছন্দের কিছু জিনিস না পাওয়াই শ্রেয়। সবসময় যে পছন্দের সব জিনিস পেতেই হবে সেটা কোন সংবিদানে লেখা নেই। মাঝে মাঝে প্রিয় কিছু মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের পছন্দের জিনিস হাসি মুখে বিসর্জন দিতে হয়। তাতেও একটা সুখ আছে, যে সুখ সবাই বুঝে না। রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে রাহি। আলিহান রাহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

– অনেকক্ষণ এসেছিস, এবার বাসায় চলে যা। আমিও যাই দেখি ওদিকে মৌ অপেক্ষা করছে। বউ আমার অপেক্ষা করতে করতে বুড়ি হয়ে গেলো।

– শালা বউয়ের কাছে যাবি সেটা আগে বললেই পারতিস। রাহনাফের কথা শুনে বাকা চোখে ওর দিকে তাকায় আলিহান। তারপর বলে উঠে,

– তুইও চল না আমার সাথে। তোর লেখিকা সাহেবার সাথে দেখা হয়ে যাবে।

আলিহানের কথা শুনে কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে রাহনাফ। মৌনতা ভেঙে সে বলে উঠে,

– এখন না পরে এক সময় দেখা করে নিবো। লেখিকা ম্যাম এখন তার ডিবেট নিয়ে ব্যাস্ত। আমি তাকে ডিস্টার্ব করতে চাইনা।

– তুই তাকে ডিস্টার্ব করতে চাস না নাকি সে ডিস্টার্ব হয় না, কোনটা? প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আলিহান। সে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের দিকে। রাহনাফের জবাব কি হয় সেটা জানার জন্যে। রাহনাফ আলিহানের কথার প্রতিউত্তরে বলে,

– দুটোই। আমার লেখিকা সাহেবা আমাকে পাত্তা দেয় না। আমি যে তার প্রেমানলে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি সেটা কি সে দেখতে পাচ্ছে না। আর কত পুড়াবে সে আমায়। ভাই তোর শালীটাকে একটু বুঝা। আর কত পুড়াবে সে আমাকে। শুধু আমাকে লাগবে তার, এমন একটা চুক্তি হোক আমি খুব করে চাই।

৩১,
হে বসন্ত, খনিকের মায়ায় যাসনে তুই চলে, যদিও যাবি, যাস তুই আমায় একটু বলে। যাবার সময় দিস আমায় তোর রঙের একটু খানি ছোয়া। দিবি কি আমায়?? আমি এই অল্প খানি চাই, সারাজীবন থাকবো আমি তোরই অপেক্ষায়। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো রাহনাফ। রাত এখন বারোটা ছুঁইছুঁই, কিছুক্ষণ পর বারোটা বাজবে। ঘড়ির কাটা যখন বারোটার মাঝামাঝি পৌঁছাবে তখনি রাহনাফ তার জিবনের আরো একটা বছর পিছনে ফেলে চলে যাবে। হাড়িয়ে যাবে আরো একটা বছর তার জিবন থেকে। মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ সে। আকাশের মতোই তার জিবনটা মুক্ত। না আছে কারো শাসন আর না আছে বারন। যে দিকে খুশি যাও বলার কেউ নেই। শাসন করারও কেউ নেই। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে মেহেরের নাম্বারে ডায়াল করলো সে। প্রথম কল কেটে গেলে আবার ও কল করে সে। দ্বিতীয়বার রিং হতেই কল রিসিভ করে মেহের। ঘুৃম ঘুম চোখে নেশালো কন্ঠে বলে উঠে,

– আপনি এত রাতে!

– ঘুমচ্ছিলেন নাকি?

– হ্যাঁ।
রাহনাফের খুব খারাপ লাগলো মেহেরের ঘুমটা ভাঙিয়ে দেওয়ার কারনে। কেন যে সে এত রাতে কল করতে গেলো। তবে মন্দ হয়নি। এত রাতে কল না করলে মেহেরের এমন আফিম মেশানো কন্ঠ সে শুনতেই পেত না।

– কিছু বলবেন আপনি? ওপাশ থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মেহের।

– কালকের দিনটা আমার নামে করে দিন লেখিকা সাহেবা। শান্ত কন্ঠে বলে উঠে রাহনাফ।

– কাল কি কোন বিশেষ দিন নাকি?

– একটু স্পেশাল।

– কি স্পেশাল শুনি। উৎসাহ নিয়ে বলে মেহের।

– কাল সকালে আমি আপনার অপেক্ষা করবো লেখিকা সাহেবা। কল কেটে দেয় রাহনাফ। বুকপকেটে মোবাইল রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বাকরে শ্বাস ফেলে।

চারিদিক থেকে আযানের সুমিষ্ট সূর ভেসে আসছে মেহেরের কানে। আযানের সূর শুনে ঘুম কেটে যায় মেহেরের। আড়মোড়া হয়ে উঠে বসে বড় করে হাই তুলে ওয়াশরুমে চলে যায়। তারপর ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজ আদায় করে নেয় সে। নামায শেষে মনে হলো আর একটু ঘুমিয়ে নেই। একরাশ ঘুৃম এসে ভীড় জামালো মেহেরের দু-চোখের পাতায়। কিন্তু এখন তো ঘুমালে চলবে না। দুদিন পর ডিবেট। ভালো করে প্রিপারেশ নিতে হবে। এবারের ডিবেটটা যে করেই হোক তাকে জিততেই হবে। কিন্তু তার দু-চোখ সেটা মানছে না। তারা বারবার করে বলছে, আর একটু ঘুমিয়ে নে। ঘুমালে ক্ষতি কিসের। ঘুম মানুষের শরীর মন দুটোকেই সুস্থ রাখে। সু্স্বাস্থ্যের জন্যে ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্কের নিউরোন বিশ্রাম পায়। প্রতিটি নিউরোনের বিপরীতে ১০ টি করে গ্লিয়াল সেল রয়েছে যা ঘুমের মধ্যে তৎপর হয়ে ওঠে। তেমনি এই গ্লিয়াল সেলগুলো নিউরোনের ভেতরে যে টক্সিন থাকে তা ধুয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন করে এবং পরবর্তী দিনের কাজের জন্যে প্রস্তুত করে। অর্থাৎ তখন ব্রেনের টিস্যুগুলো রিপেয়ার হয়। ঘুম ব্রেন সেলকে সতেজ রাখে। ভালো ঘুমালে স্মৃতিশক্তি এবং ব্রেনের কার্যকারিতা বাড়ে। ফলে মস্তিষ্ক ব্যবহারের সক্ষমতা, তার মানসিক অবস্থা ও স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। ফলে তিনি পূর্ণ একাগ্রতা ও সর্তকতার সাথে প্রতিটি কাজ করতে পারেন। সারাদিনে ঘটে যাওয়া মাসেল, সেল ও হাড়ের ক্ষয়ক্ষতির মেরামত হয় ঘুমের মধ্যে। অবশেষে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পরে মেহের। কিছুক্ষণের মধ্যে সে হাড়িয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। দেখতে থাকে নানা রং বেরঙ্গেস স্বপ্ন। ঘুমের মধ্যে হেসে উঠে সে। হঠাৎ মোবাইলের বিকট শব্দের ঘুম কেটে যায় মেহেরের। রিংটোনে গাড়ির হর্নের শব্দ! মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায় তার। এটা নিশ্চয় আলিহানের কাজ। সে ছাড়া আর কেউই এই কাজ করতে পারে। তাড়াতাড়ি করে বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে মেহের। স্কিনে রাহনাফের নামটা জ্বলজ্বল করছে। অটোমেটিক তার কপালে কয়েটা ভাজ পরে যায়। রাহনাফ সাতসকালে কেন কল করেছে! অবাকে চেয়ে বেশী চিন্তিত মেহের। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো বাহিরে এখন আবছা অন্ধকার। আচ্ছা রাহনাফের কিছু হয়নি তো, ও ঠিক আছে তো! নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহেরের ছোট্ট মাথায়। চটজলদি কল রিসিভ করতে গিয়ে কেটে যায়। নিমিষেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে যায় তার। ততক্ষণাৎ আবারও কল করে রাহনাফ। মেহের তাড়াতাড়ি করে কল রিসিভ করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওপাশ থেকে রাহনাফ বলে উঠে,

– একটু জানালার কাছে আসবেন লেখিকা সাহেবা। দু-চোখ আমার বড্ড তৃষ্ণার্থ আপনাকে দেখার জন্যে। প্লিজ লেখুকা সাহেবা আমার চোখের তৃষ্ণাটা মিটিয়ে দিন।

রাহনাফের কথা শুনে আপবাআপনি চোখ বড় বড় হয়ে যায় মেহের। ভ্রু কুচকিয়ে মোবাইলের নাম্বরটা একবার দেখে নেয়। নাম্বার তো ঠিকই আছে তাহলে জানালার কাছে আসতে বলল কেন? বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে উকি দেয় মেহের।

– ডান পাশে তাকান লেখিকা সাহেবা রাহনাফের কথামতো ডানের দিকে তাকাতেই আবছা আলোয় দেখতে পায়, বাসার সামনে বাইকের উপর বসে আছে কেউ।

– ওটা আপনি! প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মেহের।

– নিচে আসুন।

– পাগল হয়ে গেছেন আপনি? এত সকালে আমার বাসার সামনে কি করছেন আপনি?

– উঃহ আপনি এত প্রশ্ন করেন কেন? তাড়াতাড়ি নিচে আসুন। মশায় কামড়িয়ে আমার অর্ধেক রক্ত শেষ করে দিয়েছে বাকি অর্ধেকটা শেষ করার আগে চলে আসুন।

– কোথায় যাব আমি?

– বলেছিলাম না লেখিকা সাহেবা আজ সারাদিন আমার নামে করে দিবেন।

– তাই বলে এত সকালে!

– হ্যাঁ। চলে আসুন আমি অপেক্ষা করছি। কল কেটে দেয় রাহনাফ। মেহের রুমে এসে বিছানার উপর মোবাইল রেখে গলায় উড়না পেচিয়ে চলে যায় বাহিরের দিকে।

চলবে,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২১]

মৃদু আলোয় মেহেরকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে রাহনাফ। মাথায় এলোমেলো চুল, গাল নাক চোখ ঘুৃমের কারনে কিছুটা ফুলে আছে তার।সদ্য ঘুম থেকে উঠলে যা হয় আর কি। মেহেরের চোখে প্রচুর পরিমান ঘুম এসে ভর করেছে সেটা তার আধো খোলা চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। দু-হাতে চোখ ঢলে কিছুক্ষণ পর পর হাই তুলে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে মেহের। রাহনাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে মেহেরের মুখ পানে। মেহের রাহনাফ কাছে এসে দাঁড়াতেই রাহনাফ বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়। তারপর সে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– বাইকে বসুন লেখিকা সাহেবা।

রাহনাফের কথা শুনে মেহের তার চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে বলে উঠে,

– বাইকে বসবো মানে কি? কোথায় যাব?

– সেটা গেলেই দেখতে পাবেন, এখন বসুন।

– আমি কোথাও যাচ্ছি না আপনার সাথে। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় মেহের। পিছন থেকে রাহনাফ বলে উঠে,

– আজকের দিনটা আমার নামে করে দিবেন বলছিলেন।তাহলে এখন কেন চলে যাচ্ছেন!

– তাই বলে সূর্য উঠার আগে চলে আসবেন! দাঁড়িয়ে বলে মেহের।

– যেহেতু পুরো দিনটাই আমার তাই সূর্য উঠার আগ থেকে ডুবার পর পর্যন্ত সবটাই আমার করে নিতে চাই।

বাইকে উঠে বসে রাহনাফ। মেহের তাকিয়ে থাকে রাহনাফের দিকে। কি হলো লেখিকা সাহেবা বাইকে বসুন। বলে উঠে রাহনাফ। রাহনাফের কথার কোন প্রতিক্রিয়া করে না মেহের। সে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের মুখ পানে। রাহনাফ হয়তো মেহেরের এমন চাহনি বুঝতে পারছে তাই সে মেহেরের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে বলে উঠে,

– আমার উপর কি একটু ভরসা করা যায় না লেখিকা সাহেবা। একবার বিশ্বাস করেই দেখুন, আসুন পাশে বসুন। বিন্দু পরিমাণও যদি বিশ্বাস করে থাকুন তাহলে বসুন আমি আপনার কোন ক্ষতিই হতে দিবো না। সামনের দিকে তাকিয়ে মেহেরের উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকে রাহনাফ।

রাহনাফের কথা শুনে মেহেরের মুখে মলিন হাসির রেখা ফুটে উঠে। সে স্মিত হাসে তারপর রাহনাফের পিছনে গিয়ে বসে রাহনাফের কাদে তার হাত রাখে। সামনে থাকা মিররে নিজের আর মেহেরের আধেক প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে রাহনাফ। দু-চোখ বন্ধকরে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে সে। এ যেন এক বড় প্রাপ্তি তার কাছে। মেহের তাকে বিশ্বাস করে তার পাশে বসেছে তার কাছে হাত রেখেছে। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে তার কাছে। চোখ খুলে মিররের দিকে তাকায়, মেহেরের আধেক মুখ দেখা যাচ্ছে তাতে। রাহনাফ মিররটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে ঠিক করে নিলো। এবার মেহেরের পুরো মুখটাই দেখা যাচ্ছে তাতে। হুম এখন ঠিক আছে। হাত দিয়ে মাথায় চুলগুলো পিছনে ঠেলে দেয় রাহনাফ তারপর সে ছুটে চলে তার গন্তব্যের দিকে।

৩২,
রাহনাফ, চাইল্ড এন্ড ওল্ডএজ কেয়ার হোমের ভিতরে নিয়ে আসে তার বাইক। গেটের ভিতর দিয়ে বাইক প্রবেশ করানোর সময় মেহের বেশ অবাক হয়। রাহনাফ সাতসকালে তাকে এখানে কেন নিয়ে আসলো। আর এত সকলে সে আশ্রামেই বা কেন আসলো। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহেরের মাথায়। সে কিছুক্ষণ পর পর রাহনাফের কাঁধ শক্তকরে চেপে ধরছে। রাহনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

– গেলেই বুঝতে পারবেন কেন এসেছি। এখন শান্ত শিষ্ট ভদ্র মেয়ের মতো বসে থাকুন।

রাহনাফের কথা শুনে শুকনো ডুক গিয়ে মেহের। বাকা চোখে বাইকের মিররের দিকে তাকিয়ে রাহনাফের মুখ দর্শনকরে সে, অমনি রাহনাফ তার বাইক থামিয়ে দেয়। ঘটনাক্রমে মেহেরের পুরো শরীরের ভর গিয়ে পরে রাহনাফের উপর। মেহের দ্রুত নিজেকে সামলে বাইক থেকে নেমে যায়। রাহনাফ ও বাইক থেকে নামে তারপর সে মেহেরের হাত ধরে অপর পাশে চাইল্ড হোমের কাছে নিয়ে যেতে থাকে।

চাইল্ড হোমের কাছে আসতেই অনেকগুলা ছেলে মেয়ে রাহনাফে ঘিরে ধরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে থাকে। রাহনাফ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের সামলাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। মেহের তার হাত উচু করে তাকিয়ে আছে রাহনাফের দিকে। রাহনাফ বাচ্চাদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে সেটাই দেখছে সে। তারপর সে তার হাতের উপর হাত বুলিয়ে মৃদু হাসে। কেন হাসে সেই কারনটা অজানা তার। হাতের উপর হাত বুলিয়ে দিয়ে আবারও সে রাহনাফের দিকে তাকায়। এই ছেলেটার হাসি এত কিউট কেন? কেন! সে হাসলে আমার বুকটা ব্যাথা করে উঠে। কেন তার সাথে থাকলে আমার নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়। বুকের উপর হাত রাখে মেহের। তাহলে কি আমিও! মুগ্ধ চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

দুপুরে রাহনাফ নিজে বাচ্চাদের নিয়ে ভুনা খিচুড়ি রান্না করে আশ্রামের সব বাচ্চা ও বয়স্কদের খাওয়ায়। সকলে রাহনাফের উজ্জল ভবিষ্যৎ আর দীর্ঘয়ু কামনা করছে। মেহের সারাক্ষণ রাহনাফের পাশে ঘুরে ঘুরে ওকে দেখেছে। মাঝে মাঝে যখন রাহনাফের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয়েছে তখনি সে তার দৃষ্টি নামিয়ে কোন এক কাজ করার বাহানা খুজে চলেছে। এটা দেখে মৃদু হাসছে রাহনাফ আর মাথা চুলকাচ্ছে। খাওয়া শেষে সবাই যখন বিশ্রাম নিতে ব্যাস্ত রাহনাফ তখন আশ্রামের পাশে বাগানে বসে গাছের সাথে কথা বলে। কিছুক্ষণ পর মেহের ও এসে রাহনাফের পাশে বসে। রাহনাফ মেহেরের উপস্থিতি টের পেলেও কোন প্রতিক্রিয়া না করে গাছের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে তাকিয়ে থাকে। মেহের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

– আজ আপনার জন্মদিন, আগে বলেন নি কেন?

– জানতে চেয়েছেন কখনো?

রাহনাফের প্রশ্নের কোন জবাব দেয়না মেহের। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে সে। তারপর বলে উঠে,

– আমাকে এখনে কেন নিয়ে আসলেন? না মানে এই আশ্রম তো আপনি আগে থেকেই চিনেন, আপনি একা আসতে পারতেন তবে আমাকেই কেন নিয়ে আসলেন এখানে।

– আজকের এই দিনটা আমার কাছে খুব স্পেশাল, আর ততটাই আপনি আমার কাছে স্পেশাল। স্পেশাল দিনটা যদি স্পেশাল মানুষের সাথে নাই কাটাই তাহলে কি করে হয় বলুন তো। সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠে রাহনাফ। মেহের ততক্ষণ রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়েই ছিলো। রাহনাফ তার দৃষ্টি নামিয়ে মেহের দিকে তাকাতেই দুজনের সাথে চোখাচোখি হয়। মৃদু হেসে মেহের তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয় আর রাহনাফ সে তাকিয়েই থাকে মেহের মুখপানে। কিছুসময় পর মেহের তার হাত বাড়িয়ে বলে উঠে,

– আপনার মোবাইলটা একটু দেন তো।

দ্বিরোক্তি করে না রাহনাফ। সে তার মোবাইলটা মেহেরের হাতে দিয়ে দেয়। মোবাইল পেয়ে মেহের মৃদু হেসে উঠে চলে যায়। দূর থেকে এক বৃদ্ধা মাহিলা মেহেরকে দেখতে পায় তখন। সে এতক্ষণ বসে বসে একটা সোয়েটার শেলাই করছিলো। মেহেরকে দেখা মাত্রই সে সুই সুতা সোয়েটার রেখে মেহেরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেই কবে সে দেখেছিলো মেহেরকে তারপর তার মেহেরের দেখা পায়নি সে। নওশাদ কে কত করে বলেছে মেহেরকে দেখবে, কিন্তু সৈদয় নওশাদ তো পৃথিবী সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাবা, সে বাবার অধীকার নিয়ে মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পরে না। মেয়ের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পারে না সে। বৃদ্ধা তার নাতনী মেহেরকে দেখতে পারে না। আজ কত দিন পর সে আবার মেহেরের মুখ দেখতে পেরেছে তাকে ছুয়ে না দেখলে কি করে হয়। বৃদ্ধা মেহেরকে ছুঁয়ে দেখবে বলে মেহেরের কাছে আসতে থাকে। এদিকে মেহের ফোনে কথা বলে শেষ করে আবার গিয়ে রাহনাফের পাশে বসে ওকে ওর মোবাইলটা ফিরতে দিয়ে দেয়। তারপর দুজনে মিলে তাকিয়ে থাকে গাছের দিকে।

– মে-মেহের।

ফাটানো জড়ানো কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায় মেহের আর রাহনাফ। পিছনে থাকা লোকটা দেখে রাহনাফের মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠলেও মেহের মুখখানা বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। তিক্ততায় ভরে উঠে তার মন। চোখ ছেয়ে যায় বিরক্ততায়। মুহূর্তেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আসে তার। উড়নাটা নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে শক্তচোখে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকে মেহের।রাহনাফ অধোরে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,

– আরে আমার কিউট দাদি যে আসুন আসুন।

বৃদ্ধার রাহনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে মলিন হাসি উপহার দিকে মেহেরের দিকে তাকায় সে। মেহের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে রাহনাফের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধা ওদের পাশে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়ায় মেহের। ঘৃনাভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বৃদ্ধার দিকে। আর বৃদ্ধার দৃষ্টি স্থির মেহেরের মুখের দিকে। তার চাহনিতে ছিলো শুধু অনুতাপ মাত্র।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_মাহফুজা_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here