মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-২২,২৩

0
452

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-২২,২৩
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
২২

রাহনাফকে নিয়ে সোজা নিজের বাসায় চলে আসে মেহের। যদিও এতে রাহনাফের আপত্তি ছিলো বেশ। মেহের জোর করেই তার সাথে করে বাড়িতে নিয়ে আসে রাহনাফকে। আশ্রমে তার দাদিকে দেখা মাত্রই মেহেরের গা জ্বলে উঠার মতো অনুভব হয়। তার দিকে কটাক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে আসতে নিলে রাহনাফ ওকে আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু মেহের রাহনাফের কোন কথাই শুনে না। সে চলে আসে। পিছন থেকে তার দাদীও অনেকবার ডেকেছে কিন্তু পিছনে ফিরে তাকায়নি মেহের। সে প্রস্হান করে। রাহনাফের আর কি করার, সেও বৃদ্ধাকে বিদায় জানিয়ে মেহেরকে পিছু করতে থাকে। আশ্রমের গেটের বাহিরে আসতেই সে একটা বড় গাড়ি দেখতে পায়। গাড়িটা আশ্রমের ভিতরে প্রবেশ করছে। এত বড় গাড়ি নিয়ে এই আশ্রমে আবার কে আসবে সেটা দেখার জন্যেই গাড়িটাকে ভালো করে পরখ করে রাহনাফ। কেন জানি তার মনে হলো এই গাড়িটা সে আগেও দেখেছে, বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে গাড়িটাকে। থমকে দাঁড়িয়ে যায় রাহনাফ। দূর থেকে মেহের রাহনাফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের ইশারায় কয়েকবার ডাক দেয় কিন্তু সে খেয়াল নেই রাহনাফের, সে গাড়িটাকে দেখতে ব্যাস্ত। তাই মেহের নিজে রাহনাফের কাছে এসে দাঁড়ায় আর মৃদু সূরে রাহনাফকে ডাক দেয় রাহনাফকে। রাহনাফ এখনো কোন রিসপন্স করে না তার দৃষ্টি দূরের গতিশীল গাড়ির দিকে। রাহনাফের দৃষ্টি অনুসরণ করে মেহের তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিন্তু দেখার মতো কোন কিছুই তার চোখের সামনে পরে না। তাই সে রাহনাফ হাতে নাড়া দিয়ে বলে,

– ওদিকে কি এত দেখছেন! কখন থেকে ডাকছি আপনার কোন রিসপন্সই নাই।

নিজের হাতে শীতল স্পর্শ পেতেই সামনে তাকায় রাহনাফ। মেহেরকে দেখে ভ্রু দ্বয়ে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে জিগ্যেস করে,

– কিছু বলছেন লেখিকা সাহেবা?

– আপনি কি ভাবছেন বলুন তো?

মেহেরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার সেই গাড়ির দিকে তাকায় রাহনাফ। গাড়িটা ততক্ষণ ওদের দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছে। রাহনাফ তড়িৎগতিতে মেহেরের হাত চেপে ধরে বলে চলুন, তারপর ওকে নিয়ে সেই গাড়ির পিছু করতে থাকে। এত তাড়াহুড়া করে কোথায় যাচ্ছে রাহনাফ সেটা কয়েকবার জিগ্যেস করে মেহের, কিন্তু কোন জবাব দেয়না রাহনাফ। সে মেহেরের হাত শক্তকরে চেপে ধরে শুধু সামনের দিকে এগোতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর সেই বড় গাড়িটা দেখতে পায় রাহনাফ। গাড়ির ভেতর থেকে একটা যুবক কোট প্যান্ট করে বের হয়ে পিছনের দরজা খুলে দিলো। সেখান থেকে একজনক অর্ধবয়স্ক মহিলা বের হলো যার গায়ে জড়ানো সাদা থান আর কাধে একটা কালো শাল। অর্ধবয়স্ক মহিলাটিকে দেখে যেন রাহনাফের পুরো দুনিয়া থমকে যায়। আলগা হয়ে আসে তার হাত। থো মেরে দাঁড়িয়ে থেকে স্থির দৃষ্টিতে সে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেহের তার হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে রাহনাফের মুখের দিকে তাকায়। রাহনাফের মলিন মুখ দেখে মেহের তার বুকের বা পাশটায় চিনচিন ব্যাথা অনুভব করে। শ্বাস আটকে আসে তার। আচ্ছা রাহনাফের এমন বিষন্নমাখা মুখ দেখে মেহেরের কেন খারাপ লাগছে! তবে কি মেহের রাহনাফকে ভালোবেসে ফেলেছে। প্রিয় মানুষের বিষণ্ণতায় যদি আমি এক পৃথিবী সমান ব্যাথা অনুভব করি তবে এর নাম বুঝি ভালোবাসা। বুকের উপর হাত রেখে রাহনাফের মুখের দিকে দৃষ্টি রাখে মেহের। রাহনাফের দৃষ্টি তখনো স্থির সামনে থাকা সেই অর্ধবয়স্ক মহিলার দিকে। মহিলাটি যখনি পিছনের দিকে ঘুরে তাকায় রাহনাফ খপ করে মেহেরের হাত ধরে পিছনের দিকে ঘুরে যায়। রাহনাফ এতটাই শক্তকরে মেহেরের হাত ধরেছে সে মেহের তার হাতে ব্যাথা অনুভব করছে আর তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই রাহনাফের, সে নিজের মুখ লুকাতে ব্যাস্ত।

অর্ধবয়স্ক মহিলাটি রাহনাফকে ছাড়িয়ে চলে যায় আশ্রমের ভিতরে। সে চলে যেতেই বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে রাহনাফ। পিছনের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় সেই গাড়ির পিছনে একটা ছোট ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। দুজন হেল্পার ট্রাকের ভিতরে থেকে বড় বড় খাবারের পাত্র বের করছে। রাহনাফ সে দিকে তোয়াক্কা না করে সেই অর্ধবয়স্ক মহিলাটিকে ফলো করার জন্যে তার পিছু ছুটে। মেহের অবাক চোখে রাহনাফের কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে শুধু।

অর্ধবয়স্ক মহিলা আশ্রমের সকল বৃদ্ধা ও বাচ্চাদের মাঝে খাবার আর বস্র বিতরণ করেন এবং তার ছেলের জন্যে সকলের নিকট দোয়া চায়। এক কৈশোর তার কাছে তার ছেলে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি মৃদু হেসে বলেন,

– আমি অনেক আগেই তাকে হাড়িয়ে ফেলেছি। মন খারাপ হয়ে যায় মহিলার। থানের আচল দিয়ে চোখ মুছে নেয় সে। এই দৃশ্য দূর থেকে রাহনাফ। তার চোখের কোটর বেদ করে পানি গড়িয়ে পরে। মেহেরের মুখ হা হয়ে যায়। রাহনাফ কাঁদছে! কে এই মহিলা? রাহনাফ কেন তাকে লুকিয়ে দেখছে! আর তাকে দেখে রাহনাফ কেনই বা কাঁদছে। তবে কি এনিই রাহনাফের মা। চোখ বড় বড় হয়ে যায় মেহেরের। রসোগোল্লার মতো চোখ নিয়ে একপলক রাহনাফের দিকে তাকিয়ে আবার সে মহিলার দিকে তাকায়। দুইজনেই কাঁদছে, দুজনের চোখেই রয়েছে আপনজনকে হাড়ানোর তীব্র যন্ত্রনা। মেহের আলতো করে রাহনাফের এক হাত ধরে বলে উঠে,

– এনি কি আপনার,,,,,

– মা। এনিই আমার মা। মেহেরকে থামিয়ে বলে উঠে রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে একটুও অবাক হয়নি মেহের। কারন সে এমনটাই আন্ধাজ করেছিলো। রাহনাফ অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহেরের দিকে। মেহেরের এখন বড্ড অসহায় লাগছে। সে পারছেনা রাহনাফের চোখের পানি মুছে দিতে আর না পারছে ওকে ওর মায়ের সাথে মিলিয়ে দিতে। খুব অসহায় লাগছে মেহেরের। সে করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। তখন দুজনের মাঝে দৃষ্টি সংযোগ হয়। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা হয় চোখে চোখে। দুজন দুজনের চোখের ভাষা বুঝে নেয় কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করে না কেউ। রাহনাফ মেহেরের হাতটা শক্তকরে ধরে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে,

– চলুন লেখিকা সাহেবা ফিরে যাই।

– রাহনাফের কথায় সায় দেয় মেহের। তারপর দুইজনেই সেখান থেকে প্রস্তান করে। আধেক রাস্তা আসার পর রাহনাফ তার বাসায় ফিরে যেতে চাইলে মেহের জোর করে রাহনাফ তার সাথে তার বাসায় নিয়ে আসে।

৩৩,
মৌ আলিহান আর রাহি তিনজন মিলে রাহনাফের জন্যে নানা রকমের খাবার রান্না করে। আলিহান রাহনাফের পছন্দের কেক তৈরী করে। আশ্রমে মেহের রাহনাফের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আলিহান কে কল করে রাহনাফের জন্মদিনের কথা জানায়। আর ওর পছন্দের সব খাবার রান্না করতে বলে। কারন মেহের রাহনাফকে তার সাথে নিয়ে আসবে। আলিহান রাহিকে কল করে বাসায় আসতে বলে। এই সুযোগে যদি মেহের আর রাহির মাঝে একটু ভাব জমে। রাহিও এত ভালো একটা সুযোগ মিছ করতে চায়না। তাইতো আলিহান কল করার সাথে সাথে সে ছুটে চলে আসে মেহেরের বাসায়। মৌ আর আলিহানের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করে রাহি। সৈয়দ মাহবুবা বিকালে বাসায় ফিরে আজ। তিনি ফিরলে সবাই মিলে একসাথে রাহনাফকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় আর কেক কাটে। তারপর সবাই মিলে এক সাথে এক টেবিলে খাওয়া দাওয়া করে করে। এতে করে রাহনাফ আর মেহের আজ অনেক কাছাকাছি চলে আসে। রাহনাফ মেহেরকে খাইয়ে দেয়, মেহের দেয় রাহনাফকে খাইয়ে। এই দৃশ্য দেখে হাতের মুঠি শক্ত করে বসে থাকে রাহি। খাবার প্লেটে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে শুধু কোন খাবার তার মুখ অব্ধি পৌঁছায় না। আড় চোখে রাহনাফ আর মেহেরের হাসিমুখ দেখে রাহি। কারন এখন রাহনাফ আর মেহের যতটা কাছাকাছি চলে আসছে রাহি ঠিক ততটাই দূরে চলে যাচ্ছে। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নেয় রাহি। একপক্ষ ভালোবাসার চেয়ে দূরে চলে যাওয়াটা ভালো মনে করে সে। কারন তাদের দুজের মিল হওয়ার মাঝে সে নিজেকে মস্ত বড় দেয়াল মনে করে। যে দেয়াল টপকে গিয়ে মিলন হতে পারছে না রাহনাফ ও মেহেরের। মৃদু হাসে রাহি। মেহের ও তার জিবনে ভালোবাসা পেয়েছে। তার বোনটা কাউকে ভালোবাসতে পেরেছ এটা যে তার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। অধোর চেপে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে উপরের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রর্থনা করে, তাদের ভালোবাসা যেন সারাজীবন অটুট থাকে। তারা যেন একে অপরকে এভাবেই ভালোবাসে সবমসময়।

– রাহি, কি এত ভাবছিস বলতো? কিছুই তো খাচ্ছিস না।

-আলিহানের কথায় ঘোর কাটে রাহির। সে আলিহানের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে।

– এইতো খাচ্ছি। এক লোকমা ভাত মুখে দেয় রাহি। আলিহান ও রাহি একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৩]

ছাদে বসে সবাই মিলে গল্প করছে। মৌ আর আলিহান পাশাপাশি বসেছে। আলিহানের একপাশে বসেছে রাহি তারপর রাহনাফ তারপরে মেহের। রাহি কিছুক্ষণ পর পর মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই মেহেরের। মেহের অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। রাহনাফ অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে মেহের অন্যমনস্ক। কি এত ভাবছে মেহের সেটা জানার জন্যে সে তার শীতল হাতটা মেহেরের হাতের উপর রাখে। নিজের হাতে শীতল অনুভব করতেই মাথা নাড়িয়ে হাতের দিকে তাকায়। রাহনাফের হাত বরাবর সে তার মুখের দিকে তাকাতেই রাহনাফ চোখের ইশারায় জিগ্যেস করে,

– এত কি ভাবছেন লেখিকা সাহেবা। কোন সমস্যা হয়েছে কি?

মেহের মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়। তখনি পাশ থেকে মৌ বলে উঠে,

– সিঙ্গারা খাবো। সিঙ্গারা আর পিঁয়াজু ছাড়া আড্ডা ভরপুর হয় নাকি।

মৌ-এর কথায় সম্মতি জানায় তারা সবাই। আলিহান বাসায় সিঙ্গারা বানাতে চায় কিন্তু মৌ-য়ের কারনে সেটাও হয়ে উঠে না। মৌ আলিহানকে তার পাশ থেকে উঠতে দেয় না। মেহের ও পারে না সিঙ্গারা বানাতে। রাহি রাহনাফ ওরা কেউও সিঙ্গারা বানাতে পারে না। কিন্তু মৌ মেহেরকেই দায়িত্ব দেয় সিঙ্গারা বানাতে। কি করবে মেহের সে তো পারেনা। কিন্তু মৌ খেতে চেয়েছে যখন তো তাকে দিতেই হবে। তাই সে উঠে দাঁড়ায় মাঠের পাশে সেই ছোট্ট খড় পাতার ছাউনিযুক্ত দোকানে যেতে। সেখান থেকে গরম গরম সিঙ্গারা আর পিয়াজু কিনে আনবে সে। দোকানের কথা মনে হতেই আড় চোখে রাহনাফের দিকে তাকায় সে। মনে পরে যায় সেদিনের কথা, রাহনাফ কি ভাবে তার সমস্ত পিঁয়াজু খেয়ে ফেলেছে। মৃদু হাসে মেহের। আজ রাগের পরিবর্তে তার মুখে ফুটে উঠেছে হাসির রেখা। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের দিকে। রাহনাফ তার দিকে তাকাতেই দুজনের দৃষ্টি সংযোগ হয় আর মেহের লজ্জামখা হাসি দিয়ে সেখান থেকে প্রস্তান করে। রাহনাফ ওর পিছু চলে আসতে চাইলে রাহি ওকে আটকিয়ে দিয়ে সে চলে আসে মেহেরের পিছুপিছু।

মেহেরের সাথে পা মিলিয়ে হাটছে রাহি। সে মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোট চেপে হাসছে আর হাতছে। মেহের সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে হেটে চলেছে। ওর পাশে রাহি নামের কেউ আছে কি নাই সেদিকে খেয়াল নেই তার। সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে হেটে চলেছে। হঠাৎ পিছনের দিকে তাকাতেই রাহি লক্ষ করলো একটা বড় ট্রাক দ্রুত স্পিডে ওদের দিকে আসছে। ট্রাকটা দেখা মাত্রই কিছু সময়ের জন্যে জ্ঞান শুন্য হয়ে পরে রাহি। সে থ মেরে তাকিয়ে থাকে গাড়ির দিকে। যখন হুস ফিরে রাহির তখন সে দেখতে পায় ট্রকটা অতি নিকটে চলে আসছে। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ট্রাক আর মেহেরের মাঝে সংঘর্ষণ হবে। এক মিনিটও সময় নষ্ট করে না রাহি। দ্রুত মেহেরকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাক্রমে রাস্তার এক পাশে ছিটকে পরে মেহের আর ট্রাক ওকে অতিক্রম করে চলে যায়। রাহি তাকিয়ে থাকে ছুটে চলা ট্রাকের দিকে। ট্রাক চালক তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। কিছুসময়ের মধ্যে ট্রাক চলে যায় রাহির চোখের অগোচরে। রাহি গিয়ে মেহেরকে টেনে তুলে বলে,

– এটা কি করছিলে তুমি আপু। দেখে চলবে তো।

রাহির মুখে আপু ডাক শুনা মাত্রাই চোখ-মুখ শক্ত করে মেহের। কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে শক্ত গলায় বলে উঠে,

– তোমাকে আগেও বলেছি, আমাকে আপু ডাকাবা বা। শুনতে পাওনা তুমি। আর হ্যার আমাকে এক্সিডেন্ট থেকে বাচানোর জন্যে ধন্যবাদ। তাই বলে তুমি আমার বোন হবে যাবা না। আমার একটাই বোন সেটা মৌ। অনলি মৌ, বুঝতে পারছো তুমি।

– তুমি সমসময় আমার উপর রাগ দেখাও কেন? অভিমানী সূরে বলে রাহি।

– তুমি আমাকে বিরক্ত কেন করো। দেখ তুমি আলিহান ভাইয়ের বোন আর আলিহান ভাই আমার দুলাভাই, সেই হিসাবে তোমাকে আমার বাসায় থাকতে দিয়েছি তোমাকে সম্মান দিয়েছি। তাই বলে ভেবোনা তুমি আমাকে বিরক্ত করলে আমি তোমাকে কিছু বলবো না । কেন এসেছো আমার পিছু পিছু? চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে প্রশ্ন করে মেহের।

– তুমি একা আসছিলে তাই ভাবলাম যদি তুমি একা একা বোরিং ফিল করো।

– একা কোথায় আমি। আমার সাথে চারিপাশের এই বিশাল সুন্দর প্রকৃতি আছে তো। উপরের দিকে তাকিয়ে বলল মেহের। তুমি চলে যাও রাহি। আমার ধর্যের পরিক্ষা নিও না। চলে যাও। রাহির দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে মেহের। রাহি অশ্রুসিক্ত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে মেহেরকে প্রশ্ন করে, বাবার অন্যায়ের শাস্তি আমায় কেন দিচ্ছো? তুমি আমার বড় বোন হয়েও আমাকে মেনে নিতে পারছো না। আমার কি দোষ বলো। আমাকে মানে নিতে তোমার কিসের এত প্রবলেম।

মেহের শুধু তাকিয়ে থাকে রাহির মুখ পানে কোন কথা বলে না সে। তারপর নিরবে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

৩৪,
জাতীয় ডিবেট ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। মেহেরের এক হাতে ওইনারের ট্রফি আর কয়েকটা কাজগ। অন্যহাত দিয়ে গলায় ঝুলানো মেডেলটা ধরে হাসি মুখে সকলের সাথে কথা বলছে সে। মেহেরের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। তার দৃষ্টি স্থির মেহের অধোরে লেগে থাকা হাসির দিকে। এই মেয়েটার হাসি দেখলে যে কারো প্রাণ জুড়িয়ে যায় সেখানে সৈয়দ নওশাদ তো তার বাবা। মেয়ের মুখের হাসি যে স্বর্গের চেয়েও দামি। সব বাবারাই চায় তার মেয়ের মুখে অফুরান্ত হাসি লেগে থাকুক সারাটা জিবন। সৈয়দ নওশাদ ও এমনটাই চেয়েচে কিন্তু সে আর সব বাবার মতো না। সে এক মেয়েকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে লালন পালন করলেও অন্য মেয়টা পায়নি তার আদর স্নেহ ভালোবাসা। এমনি সে তার পরিচয়টুকুও পায়নি। পেয়েছে সমাজের মানুষের অবহেলা অপমান লাঞ্ছিত আর কটু কথা। একদিন যে সমাজ তাকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিল আজ সেই সমাজই তাকে একটা সম্মান দিয়েছে। মেহের আজ ডিবেট প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়েছে। মেহেরে আজকের ডিবেট ছিলো #আধো_রাতে_যদি_ঘুম_ভেঙে_যায় এই বিষয় নিয়ে। আজ মেহেরের বক্তব্য শুনে বিচারক সহ সমস্ত প্রতিযোগীই কেঁদেছে। কারন সে আজ বক্তব্যে রেখেছিলো তার জিবন নিয়ে। তর সাথে ঘটে যাও ঘটনা গুলো নিয়ে। তার অসহায়ত্ব নিয়ে সকলে যখন তার সামনে তাকে সান্তনা দিয়ে চোখের আড়াল হতেই তাকে নিয়ে সমালচোনার মেলা বসায় সেটা নিয়ে। মেহের আজ তার বক্তব্যের মধ্যে দেশে সিঙ্গেল বাবা মা শব্দের প্রচলন আনার কথা উল্লেখ করেছে। যাতে কোন সন্তানকে আর মানুষের কটু কথা শুনতে না হয়। সিঙ্গেল বাবা মা-রা মাথা উচু করে বাঁচতে পারে। কারন পারিবার ভাঙ্গার গল্পটা সবার অগোচরে থাকে। পরিবার ভাঙ্গা সংসার ভাঙ্গা বাবা মায়ের বিচ্ছেদ সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে সন্তানের উপর। এতে করে সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সৈয়দ নওশাদের অবহেলা সৈয়দা মাহবুবার আত্নসম্মানে গেলেছিল তাই হয়তো তিনি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ না হয়ে একজন সিঙ্গেল মাদার প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। মেহেরের বক্তব্য শুনে বিচারকগন কেঁদেছেন। টেলিভিশনে সরাসরি মেহেরের বক্তব্য শুনে রাষ্ট্রপ্রতি নিজে এসে মেহেরের সাথে দেখা করেন। পুরুস্কার হিসাবে তাকে দুই লক্ষ টাকার চেক একটা গোল্ড মেডেল আর সম্মাননা প্রধান করেন। সৈয়দ নওশাদ ও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। মেহেরের বক্তব্য শুনে সে কেঁদেছেন। সকলের সামনে যখন মেহের নিজেকে একজন সিঙ্গেল মাদারের মেয়ে হিসাবে পরিচয় দিচ্ছিল তখন সৈয়দ নওশাদের বলতে ইচ্ছে করছিলো মেহের আমার মেয়ে আমি মেহেরের বাবা। কিন্তু সে সেটা করতে পারেন নি কারন মেহের তাকে বাবা হিসাবে স্বীকার করে না।

প্রায় দশ মিনিট আগে রাহনাফকে কল করে এখানে আসতে বলেছে মেহের। এতক্ষণে হয়তো রাহনাফের এখানে চলে আসার কথা। মেহের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিকে তাকাতাকি করছে। আজ মেহেরের জিবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন এই দিনে রাহনাফের সঙ্গ না দিলে কি করে হয়। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে রাহনাফকে কল করে মেহের। মেহেরের থেকে কিছুটা দূরত্বে কল বেজে উঠে তবুও রাহনাফ কল রিসিভ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়। রাহনাফ মোবাইল কানের কাছে ধরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে মেহের মুখের উপর দৃষ্টি রেখে। মেহেরও মোবাইল কানে নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের চোখের দিকে।

চলবে,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here