মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-২৬,২৭

0
574

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-২৬,২৭
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
২৬

– কি হলো ডক্টর, আপনি চুপ করে আছেন কেন? বলুন মেহু কেমন আছে?

ডক্টর মেহের সম্পর্কে কিছু বলছে না তাই একটু উত্তেজিত হয়ে বলল আলিহান। ডক্টর এখনো কিছু বলছে না নিচের দিকে তাকিয়ে অধোর চেপে ঘন ঘন শ্বাস ত্যাগ করছে। মৌ রাহি রাহনাফ সবাই তাকিয়ে আছে ডক্টরের মুখের দিকে। ডক্টর বলবে পেশেন্ট সুস্থ আছে এই আশা নিয়ে। আলিহান ডক্টরকে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। মৌনতা ভেঙে ডক্টর বলে উঠলো,

– আই এম সরি। আমরা পেশেন্টকে,,, আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই আলিহান ডক্টরের কলার চেপে ধরলো। মৌ আর রাহি দুজনে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয়। রাহনাফ দু-পা পিছিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। অশ্রুতে ভরে গেছে তার চোখের কোটর। কানের কাছে এখনো ডক্টরের বলা কথাটা ভেজেই চলেছে। আলিহান ডক্টরের কলার চেপে ধরে বলতে লাগলো, কি বললেন আপনি, আমার মেহু! আমি আপনাকে ছাড়বো না। ডক্টর আলিহানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবা। ডক্টর আর আলিহানকে এভাবে হাতহাতি করতে দেখে তিনি বলে উঠলেন,

– কি হয়েছে আলিহান! তুই ডক্টরকে মারছিস কেন?

সৈয়দা মাহবুবার কণ্ঠস্বর শুনে সবাই তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা কি সব শুনে ফেলেছে, কখন জ্ঞান ফিরেছে তার। সকলে চিন্তায় পরে যায়। সৈয়দা মাহবুবা দ্রুত পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় ততক্ষণে আলিহান ডক্টরের কলার ছেড়ে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়। সৈয়দা মাহবুবা এসে ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– ডক্টর আমার মেহু কেমন আছে ডাক্তার সাহেব?

ডক্টর কোন জবাব দেয়না। অধোর চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মৌ এসে সৈয়দা মাহবুবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। রাহিও কাঁদছে। আলিহান অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে ডক্টরের মুখ পানে। সৈয়দা মাহবুবা ডক্টরকে চুপ করে থাকতে দেখে ধৈর্য হারা হয়ে আবারও প্রশ্ন করেন,

– আমার মেহু কেমন আছে ডক্টর! আপনি কিছু বলছেন না কেন? আলিহান, রাহনাফ তোমরা আমাকে আমার মেহুর কাছে নিয়ে চল।

ডক্টর মাথা তুলে সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি ওটির ভিতর থেকে একটা নার্স এসে বলে,

– স্যার, পেশেন্ট রিসপন্স করছে। নার্সের কথা শুনে একপ্রকার চমকে উঠে ডক্টর। সে সৈয়দা মাহবুবার মুখ পানে এক পলক তাকিয়ে ততক্ষণাৎ অটির ভিতরে প্রবেশ করে। রাহনাফ আলিহান ওরা যেন তাদের প্রান ফিরে পেল। সৈয়দা মাহবুবা দু-পা পিছিয়ে যেতেই মৌ তাকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,

– মেহুর কিছুই হবে না, তুমি দেখে নিও আন্টি। মেহু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আর যে আমাদের মেহুর এই অবস্থা করেছে তাকে খুঁজে বের করে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তুি দিবো আমরা। তুমি একদম চিন্তা করো না আন্টি।

মৌ-য়ের কথা সৈয়দা মাহবুবার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। তার কানের কাছে শুধু একটা কথাই বেজে চলেছে” স্যার পেশেন্ট রিসপন্স করছে” তাহলে কি এতক্ষণ মেহু রিসপন্স করছিলো না। হাত পা আলগা হয়ে আসে তার। হাটু গেরে নিচে পরেন। আলিহান আর রাহনাফ এসে তাকে তুলে করিডোরে বসিয়ে দেয়। হসপিটালের দেয়ালে সাঁটানো বড় এলইডি টিভির ভিতরে ঘড়ির টাইম দেখে রাহনাফ। এগারোটয় বাজে ছত্রিশ মিনিট। অনেক রাত হয়েছে।এবার মৌ আর রাহিকে বাড়ি ফিরতে হবে। রাহির মা বাবা হয়তো তার জন্যে চিন্তা করছে। সে আলিহানকে বলে ওদের বাড়ি পাঠাতে চায় কিন্তু মৌ বায়না ধরে মেহেরকে না দেখে সে কোথাও যাবে না। রাহিরও একই মতামত। তাই তারা সবাই মিলে অপেক্ষা করতে থাকে ডক্টরের। কখন ডক্টর আসবে আর মেহের ভালো আছে সুস্তি আছে এই খবর শুনতে পারবে তারা।

৩৭,
বেলকনিতে বসে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। উপরের দিকে তাকিয়ে ধোয়া উড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি আর সেই ধোয়া নিমিষেই অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি স্থির করেছেন বিশাল আকাশের ওই রুটির মতো দেখতে চাঁদের দিকে। রাত যত গভীর হচ্ছে কষ্ট গুলো যেন আরো তীব্র হচ্ছে। আফিয়া আহমেদকে এক প্রকার ভালোবেসেই বিয়ে করেছেন তিনি। তাকে প্রথম দেখাতে ভালো লেগেছিলো তার, আফিয়াকে যখন প্রথম দেখে তখন তিনি অবিবাহিতা ছিলেন। মাহবুবাকে বিয়ে করার তিন মাসে পরিচয় হয়েছিলো আফিয়ার সাথে। পরিবারের সাথে বেড়াতে গিয়েছিল স্বপ্নপূরী। আর সেখানে গিয়েই আফিয়াকে প্রথম দেখেছিল সৈয়দ নওশাদ। নওশাদের সেদিন মনে হয়েছিলো স্বপ্নপূরীতে পরি পাওয়া যায়। কারন আফিয়া দেখতে পরির চেয়েও কোন অংশে কম ছিলো না। নওশাদের ধরেই নিয়েছিলো পৃথিবীতে যদি পরি বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা আফিয়াই হবে। তারপর আফিয়ার সাথে আলাপ হয় তার। আফিয়া তখন বেশী কথা বলতো না সারাক্ষণ নিজের ভাবনায় ব্যাস্ত থাকতো সে। নওশাদের কিছু জিগ্যেস করলে শুধু তার দিকে একপলক তাকাতো। প্রয়োজনের দু একটা কথা বলতো সে। আফিয়ার সাথে কথা বলে জানতে পারলো সেই স্বপ্নপূরীতে একটা কাজে এসেছে। তিন দিন সেখানে ছিলো তারা আফিয়াও ছিলো সেখানে। তিন দিন পর যখন সেখান থেকে চলে আসে নওশাদ তখন পথিমধ্যে মনে হয় ইশ আফিয়ার নাম্বারটা কেন নিয়ে আসলাম না। গাড়ি থেকে নেমে যেতে চায় নওশাদ কিন্তু তার বাবার কারনে যেতে পারে না। নওশাদ ছিলো তার বাবার বাধ্য সন্তান।

বাড়ি ফিরে আফিয়ার কথা খুব মনে পরতো তার। রাতে ঘুমাতে পারতো না সে, চোখ বন্দ করলেই আফিয়ার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠতো। স্বপ্নপূরীতে থাকাকালীন লুকিয়ে আফিয়ার কয়েকটা ফটো তুলেছিলো বাড়িতে বসে সেই ছবি দেখতো নওশাদ আর আফিয়াকে নিয়ে হাজারো স্বপ্নের জাল বুনতো। বাসা থেকে বের হলেই আফিয়ার খুজ করতো সে। কিন্তু আর কখনো আফিয়ার দেখা পায়নি সে।

একদিন হঠাৎ করেই নওশাদের বাবা এসে নওশাদকে বলে, তিনি তার অফিরে এক কর্মচারীর মেয়ের সাথে নওশাদের বিয়ে ঠিক করেছে। সেদিন প্রথমবার নওশাদ তার বাবার কথা অমান্যতা করে বলেছিলো আমি এখন কাউকে বিয়ে করবো না। তাছাড়া আমিও একজনকে ভালোবাসি আর তাকেই বিয়ে করবো। নওশাদের বাবা সেদিন নওশাদের পছন্দের মেয়েকে দেখতে চেয়েছিলো। কারন তিনি তার ছেলের পছন্দের সম্মান দিতে চেয়েছিলো কিন্তু নওশাদ জানতো না মেয়েটার বাড়ি কোথায়! কোথায় থাকে? কার সাথে থাকে? মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো নওশাদ। রেগে গিয়ে নওশাদের বাবা বলেছিলো,

-আমি তাকদীরে বিশ্বাসী, যদি তুমি কোন ভিখারির মেয়েকেও পছন্দ করে বিয়ে করতে চাও করবে। মনে রাখবে এটা তোমার ভাগ্যে ছিলো। কারন তোমার বাম পাজরের হার থেকে তাকে তৈরী করা হয়েছে শুধু মাত্র তোমার জন্যে। আমি তোমাকে সাত দিন সময় দিলাম তোমার পছন্দের মেয়েকে খুঁজে বের করো অন্যথায় আমার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে তোমার।

সাত দিনের জায়গায় দশদিন কেটে যায় তবুও আফিয়ার কোন খুজ পায়না নওশাদ। ব্যর্থ মনে ভেবে নিয়েছিল, আফিয়াকে তার জন্যে তৈরী করেনি সৃষ্টিকর্তা। তাই সে তার বাবার কথায় তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। নওশাদের বাবা নওশাদকে বলেছিলো, মেয়েকে একবার দেখে নিতে। সেদিন নওশাদ হাসি মুখে বলেছিলো,

– নিজের থেকে তোমার উপর বেশী ভরসা করি বাবা। আমি জানি বাবা তুমি আমার জন্যে সবসময় ভালো কিছুই বেছে নিবে।

নওশাদের বাবা সেদিন নওশাদের মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলো,

– আমি তোর জন্যে এমন একজনকে বেছে নিয়েছি যাকে আগলে রাখলে তোর জিবনটাই বদলে যাবে।

বাবার কথাশুনে মৃদু হেসেছিলো নওশাদ। তারপর ধুমধাম করে মাহবুবার সাথে নওশাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। নওশাদ তখনো জানে না সে কাকে বিয়ে করেছে। কনে বিদায়ের পর যখন সৈয়দ বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছায় তখন নওশাদের মা আসে বউ বরণ করে ঘরে তুলতে। মাহবুবার মুখ তখন লম্বা ঘুমটার আড়ালে। বরণ শেষে নওশাদের মা বউয়ের মুখ দেখার জন্যে ঘোমটা খুলে দেয়। নতুন বউয়ের মুখ দর্শন করেই চিৎকার করে উঠেন তিনি। তার চিৎকার শুনে সকলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। নওশাদের মা তার ছেলের দিকে ক্রোধান্বিত হয়ে তাকিয়ে বলে,

– তুই কাকে আমার বাড়ির বউ করে এনেছিস নওশাদ। এতো কয়লার খনি।

নওশাদের মায়ের কথা কথা শুনে অবাক হয়ে যায় নওশাদ। হাত আলগা করে মাহবুবার হাত ছেড়ে দেয়। ঘাড় ঘুড়িয়ে মাহবুবার দিকে তাকাতেই চক্ষুদ্বয় সংকোচিত হয়ে যায় তার। ঘটনার আকস্মিক দু-পা পিছিয়ে যায় সে।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৭]

মাহবুবাকে দেখে সেদিন প্রথমবার বাবার দিকে রাগ অভিমান আর ঘৃনার দৃষ্টি তাকিয়ে ছিলো নওশাদ। যে বাবা সবসময় তার অজান্তেই তাকে পছন্দের সব জিনিসপাতি দিয়েছে আজ সে কিনা একটা কালো মেয়ের সাথে তার জিবন জুড়ে দিলো। একটা সুন্দর যুবতীর পাশে কালো ছেলে থাকলে মানুষ যতটা না অবাক হয় তার চেয়ে বেশী অবাক হয় একটা সুদর্শন যুবকের পাশে কোন কালো মেয়েকে দেখলে। নওশাদ এখন এই কালো বউকে নিয়ে সমাজে মানুষের পাশে দাঁড়াবে কি করে! সবাই যে তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করবে। না, নওশাদ পারবেনা কারো হাসির পাত্র হতে। মাহবুবাকে গেটের সামনে রেখে সে হনহন করে ভিতরে প্রবেশ করে। কিছুটা অসহায় মুখ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার ক্রোধান্বিত হয়ে মাহবুবার দিকে তাকায় সে। তারপর বলে,

– এই কয়লার ড্রাম যেন কিছুতেই ভিতরে প্রবেশ না করে। একে আমি আমার বউ হিসাবে মানি না।

নতুন শ্বশুর বাড়িতে পা রাখার সময় সব মেয়ের মনেই একটা স্বপ্ন থাকে। থাকে প্রিয়জনকে ঘিরে হাজারো স্বপ্ন। সেদিন নওশাদের কথা শুনে নিমিষেই মাহবুবার সব স্বপ্ন ভেঙে চুড়মার হয়ে যায়। ছলছল দৃষ্টিতে সে নওশাদের দিকে তাকায়। নওশাদের দৃষ্টি তখন স্থির তার বাবার দিকে। তাই সে মাহবুবার চোখের পানি দেখতে পায়নি। নওশাদের কথার সাথে তার মা ও বোনরা সকলে সায় দেয়। যখনি মাহবুবাকে তাদের বাড়ি থেকে বিদায় করবে ঠিক তখন রুখে দাঁড়ায় নওশাদের বাবা। নওশাদের বাবার এক কথা, এটা তার বাড়ি। এ বাড়িতে মাহবুবা থাকবে।এতে কারো অসুবিধা হলে সে বাড়ি থেকে চলে যেতে পারে।

সেদিন প্রথমবার বাবার মুখের উপর কথা বলে নওশাদ। সে রেখে গিয়ে বলে উঠে,

– তুমি আমার বাবা! নাকি ওই মেয়েটার?

– দুইজনের-ই। মৃদু হেসে জবাব দে নওশাদের বাবা। নওশাদ তুমি বলেছিলে আমি সবসময় তোমার জন্যে সেরাটাই বেছে নিবো। এবারও নিয়েছি। একটু সময় দেও একদিন এই কালো মেয়েটার জন্যে তোমার মুখ উজ্জল হয়ে উঠবে।

নওশাদ সেদিন স্মিত হেসে তার বাবার কথার প্রতিউত্তরে বলেছিলে,

– এই মেয়েটা উজ্জল করবে আমার মুখ! যার মুখ দেখতে গেলেই হাজারখানা লাইটের প্রয়োজন হবে।

অপমানে সেদিন মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো মাহবুবা। নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু নিরবে চোখের জল ফেলছিল মাহবুবা। তার বাবা তাকে এ কোথায় বিয়ে দিলো, এখানে তো সবাই সুন্দরের পূজারী। তার যে একটা ভালো মন আছে, সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখার একটা মন আছে সেটা কেউই দেখতে পারছে না। সবাই শুধু বাহিরের সুন্দরর্যটাই দেখছে। এ জন্যেই বোধহয় বলে, আগে দর্শনদারী পরে গুণবিচারী।

নওশাদের বাবা মাহবুবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

– কাঁদছিস কেন! আমি আছি তো। আমি তো আরেকটা বাবা। যে তোকে তোর সম্মান ফিরিয়ে দিবে।

বাবার কথায় মৃদু হেসেছিলো মাহবুবা। হয়তো সে তার আরেকটা বাবাই ছিলো।তারপর মাহবুবা সে বাড়িতেই থাকতে শুরু করে নওশাদের সাথে নওশাদের রুমে শুধু জায়গা পায়নি নওশাদের পাশে। কনকনে শীতে ফ্লোরে ঘুমিয়ে থাকতো মাহবুবা। কখনো কখনো নওশাদ রেগে গেলে তার উপর দিতো পানি ঢেলে। তীব্র গরমে বাহিরে শুয়ে থাকতো। মশা তার শরীরের অর্ধেক রক্ত খেয়ে নিতো। সে না পেতে কয়েল আর না পেতো এরোসল। খাবার সময় সবাই যখন টেবিলে বসে খেত তখন মাহবুবা রান্নাঘরের এক কোনে বসে খেত। নওশাদের বাবা যখন বাড়িতে থাকে তখন সে বাড়ির বউয়ের মর্যাদা পেত অন্যসময় তাকে কাজের লোকের মতো ব্যবহার করা হতো। কাজের কারনে বেশীর ভাগ সময়ই বাড়ির বাহিরে কাটাতো নওশাদের বাবা। মাহবুবা কারো কাছে কোন অভিযোগ করতো না। মুখ বুজে সব সহ্য করে নিতো। এভাবেই চলতে থাকে সময়। নওশাদের মা একদিন হঠাৎ করেই তার স্বামিকে জিগ্যেস করে,

– আমার এমন হিরের টুকরো ছেলেকে ওই কালো মেয়ের সাথে কেন বিয়ে দিলেন আপনি? এমন তো নয় যে আমাদের সংসারে অভাব অনটন, আর আপনি সেই অভাব ঘুচাতে একটা কালো মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। কি নাই আমাদের, বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা কিসের অভাব আমাদের। যেখানে একটা মডেল থেকে শুরু করে সব সুন্দরী মেয়েরা আমার ছেলেকে একবার দর্শনে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।

স্ত্রীর এমন অভিমানী সূরে মৃদু হাসে নওশাদের বাবা। তারপর তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মৌনতা গ্রাস করে তার মাঝে। কিছুক্ষণ পর মৌনতা ভেঙে সে বলতে থাকে,

– বাড়ি গাড়ি অর্থ সম্পৎ প্রপার্টি নাম জশ খ্যাতি এর কোন কিছুই আমার না। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার কথা শুনে অবাকে চরম শিখরে পৌঁছে যায় নওশাদের মা। তিনি আবার বলেন, এগুলো যদি কারো হয়ে থাকে তাহলে সেটা মাহবুবার বাবা। হ্যাঁ গিন্নী, আমি যা বলছি এসব সত্যি। সেদিন যদি মাহবুবার বাবা এসে আমার পাশে না দাঁড়াতো তাহলে হয়তো আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতাম না। গরীব চাষার ছেলের ছিলাম আমি। মানিকের বাবার ছিলো অঢেল সম্পত্তি আর আমার বাবা ওদের জমিতে চাষাবাদ করতো। মানিক আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। দুজনেই পড়াশুনায় ভালো ছিলাম। সেদিনের কথা আমার আজও মনে আছে। চারশত টাকার জন্যে আমার পরিক্ষা আটকে গিয়েছিলো। যে পরিক্ষা না দিতে পারলে আজ হয়তো আমি এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতাম না। জানো সেদিন মানিক নিজের জমানো টাকাগুলো আমায় দিয়েছিল আর আমি সে টাকা ফি দিয়ে পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করি। পরে অবশ্য আমি টাকাগুলো ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু সময়মত তো আমি টাকা যোগাড় করতে পারিনি। একেই হয়তো বলে সুসময়ের বন্ধু।তারপর শহরের বড় কলেজে ভর্তি হয়ে শহরে চলে আসি। স্কলারশিপের টাকা দিয়েই পড়াশুনার খরচ চলতো। শহরের আসার দুই বছর পর বাবা মারা যায় তারপর আমি আমার মাকে নিয়ে শহরে চলে আসি। তখন আমার উপরে পড়ে সংসারের ভাড়। পড়াশুনার পাশাপাশি দু-চারটা টিউশানি করেই সংসারের খরচ চালাতাম আর আমার মা শেলাই কাজ করতো। ব্যাস্ত হয়ে পরি শহরে জিবন চালাতে আর পড়াশুনা নিয়ে। গ্রামের কথা ভুলে যাই। পড়াশুনা শেষে যখন একটা চাকরি পাই তখনি গ্রামে যাই মানিকের সাথে দেখা করতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে মানিকের দেখা মেলে নি। কারন বছর তিনেক আগে নদী ভাঙনে মানিকরা ভিটামাটি হাড়ায়। মানিকের বাবা ওদের নিয়ে নাকি শহরে চলে আসে। ফিরে এসে শহরের অলিতে গলিতে খুঁজেছি মানিককে কিন্তু ওর দেখা মেলেনি। তারপর শুরু হয় আমার বিজনেস! বিজনেস নিয়ে এতটাই মত্ত ছিলাম ভুলেই গিয়েছিলাম মানিকের কথা। তারপর বিয়ে, বউ বাচ্চাদের নিয়ে সুখের সংসার সাজাই। ততদিনে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম মানিকের কথা। মানিক নামের কেউ আমার বন্ধু ছিলো সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন আমার নিজের একটা কোম্পানি আছে। সেখানে হাজার হাজার লেবার দিয়ে কাজ করাই আমি। মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী করেছি আমি। যেখানে কর্মহীন লোকেরা এসে কর্ম যোগাড় করে। এইতো সেদিনের কথা,
মিটিং শেষ করে মাত্র আমার কেবিনে এসে বসে বিশ্রাম করছি তখনি এক পিয়ন এসে বলল,

– স্যার একটা লোক কাজের সন্ধানে এখানে এসেছে। সেই সকাল থেকে বসে বসে অপেক্ষা করছে। আমি তাকে অনেকবার বলেছি এখানে কোন কাজ নেই তবুও সে বসে আছে।

পিয়নের কথায় লোকটাকে দেখার খুব ইচ্ছে হয়। আমি পিয়নকে বলি তাকে ভিতরে নিয়ে আসতে। পিয়ন তাকে ভিতরে নিয়ে আসে। তাকে দেখার পরে আমার চোখ কপালে উঠে যায় কারন সেটা আর কেউ না সেটা ছিলো মানিক। মাথার চুলে পাক ধরেছে শরীরের চমড়া কুঁচকে গেছে। ওকে দেখে খুব অবাক হই আমি। তারপর ওকে আমার পরিচয় দেই। কারন মানিক আমাকে চিনতে পারেনি। আমি মানিককে কোম্পানির ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করে চাইলে সে অস্বীকার করে কারন ওর সেই যোগ্যতা নাই। তাই সে বাকিদের মতো একজন সাধারন কর্মচারী হিসাবে আমা কোম্পানিতে কাজ করে।

মানিক কাজের মধ্যে কিছু নিয়ে ভাবতো। সবসময়ই সে ভাবতো। তাই একদিন সুযোগ বুঝে আমি ওর কাছে ওর ভাবনার কারন জানতে চাই। আর তখনি শুনি মাহবুবার কথা। মেয়েটা কালো ভিষন কালো। পাত্রপক্ষ বারবার এসে ওকে দেখে চলে যায়। কালো মেয়েকে কি আর কেউ ঘরের বউ করবে। এদিকে মানিকের ছেলে ছেলের বউরা মাহবুবাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্যে উঠে পরে লেগেছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই মাহবুবাকে ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্যে। পাত্রপক্ষ নিয়ে ওদের বাড়িতেও যাই। মাহবুবাকে দেখা মাত্রই আমি অবাক হয়। কারন এটাই সেই মেয়ে যে একদিন আমার আর তোমার ছেলের প্রান বাঁচিয়েছে। আমাকে রক্ত দিয়েছে। রওনাক মাহবুবাকে না চিনলেও আমি ঠিক চিনেছি। আচ্ছা তুমিই বলো যার বাবার মন এত উধার তার মেয়ে ভালো হবো এটাই স্বাভাবিক। আমি আমার মত পাল্টে ফেলি। মাহবুবাকে আমার ঘরে নিয়ে আসার প্ল্যান করি রওনাক তো বিয়ে করে ফেলেছে তাই নওশাদের সাথে মাহবুবার বিয়ে দেই।

স্বামির কথা শুনে সেদিন মন গলেছিল নওশাদের মায়ের। সে মেনে নিয়েছিলো মাহবুবাকে।

বিয়ের একবছর পর হঠাৎ করেই আফিয়ার সাথে দেখা হয় নওশাদের। শপিংমলে একটা দোকানে সেলম্যনের কাজ করতো সে। সেদিন আফিয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পরপর দেখা হওয়ার কারনে আবার ওদের মাঝে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। ততদিনে মাহবুবাকে ছুঁয়েও দেখেনি নওশাদ। তাই হয়তো আফিয়ার সাথে তার াসম্পর্কটা খুব তাড়াতাড়ি গটে। দিন দিন যায় তাদের সম্পর্কটা আরো। হঠাৎ করেই শুনতে পারে মাহবুবা সন্তান সম্ভবা। অনেক খুশি হয় নওশাদের বাবা। ঘটনাটা নওশাদ প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে মেনে নেয়।

আফিয়ার সাথে নওশাদের রিলেশন শুরু হয়। হঠাৎ একদিন আফিয়া নওশাদকে বিয়ে কথা জানায়। সেদিন নওশাদ মাথা নিচু করে কোন জবাব না দিয়েই চলে আসে। কি বলবে সে আফিয়াকে তার একটা বউ আছে সে সন্তান সম্ভাবনা।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here