#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-২৮,২৯
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
২৮
৩৮,
ছয়ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে মেহেরের। মেহেরের জ্ঞান ফিরতেই ওকে কেবিনে শিফট করা হয়। সৈয়দা মাহবুবা মৌ আর আলিহান ডক্টরের থেকে অনুমিত পেয়ে সাথে সাথে মেহেরের কেবিনে ডুকে যায়। রাহি সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে সে কি মেহেরের সাথে দেখা করতে যাবে! রাহনাফ করিডোরে বসে এক হাত গালে রেখে তাকিয়ে আছে মেহেরের কেবিনের দিকে। তার চোখ মুখে এখন হাসির ঝলক ফুটে উঠেছে। এতক্ষণ যে দুটি চোখে চিন্তা ছাপ ছিলো এখন সেই চোখে রয়েছে প্রাপ্তির হাসি। মেহেরের জ্ঞান ফিরেছে এর থেকে খুশির খবর তার কাছে আর কি হতে পারে। ওর শরীরে জড়ানো আছে সে রক্তাক্ত টিশার্ট। রক্তগুলো শুকিয়ে জমাট বেধেগেছে। রাহি এসে রাহনাফের সামনে দাঁড়িয়ে ওকে পা থেকে মাথা অব্ধি অবলোকন করে নিলো তারপর বলল,
– তুমি ভিতরে গেলে না রাহনাফ?
রাহনাফ তার দৃষ্টি নামিয়ে রাহির দিকে নিক্ষেপ করলো। গাল থেকে হাত নামিয়ে মাথার চুলগুলা উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
– তুমি ভিতরে যাওনি?
– যাব তো। চলনা রাহনাফ আমরা একসাথে ভিতরে যাই। আসলে আমার কেমন আনইজি ফিল হচ্ছে, তুমি চল না আমার সাথে। মৃদু হেসে বলে রাহি।
রাহির কথার কোন জবাব দেয়না রাহনাফ। ওর মুখশ্রীর দিকে সে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়। সামনের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যায় সে। তারপর পিছনে তাকিয়ে দেখে রাহি এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সে রাহিকে ডাক দিয়ে বলে,
– দাঁড়িয়ে আছো কেন! চল।
রাহনাফের কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় রাহি। প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ পাল্টে যায় কই রাহনাফ তো পাল্টে যায় নি। আগে রাহি রাহনাফ কিছু করতে বললে ওমনি সেটা করে দিত। কোথাও যাওয়া, কলেজ থেকে ফিরতে দেরী হলে রাহি আগে রাহনাফকেই কল করতো। কোন কাজে ব্যাস্ত না থাকলে রাহনাফ গিয়ে রাহিকে বাসায় পৌঁছে দিত। আজও রাহির কথামতো রাহনাফ ওকে নিয়ে মেহেরের কেবিনের দিকে যাচ্চে। মৃদু হেসে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে রাহনাফের পাশে দাঁড়ায় গিয়ে। রাহনাফের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠে,
– আমরণ তোমার হাত ধরে পাশাপাশি হাটার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। সেটা তো আর হলো না। এখন না হয় এইটুকু রাস্তায় একসাথে হাটি। তোমার হাত ধরে না হাটতে পারলাম, পাশাপাশি হাটছি এটাই অনেক। সারাজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে এই মুহূর্তটা আমার কাছে।
মেহেরের হাত ধরে শিয়রের পাশে বসে মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সৈয়দা মাহবুবা। তার দৃষ্টি স্থির মেহেরের মাথায়। অপর পাশে মেহেরের আরেক হাত ধরে বসে আছে মৌ। আলিহান ওর সামনেই বসে গালে হাত দিয়ে গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছে। মেহের এদিক ওদিকে চোখ বুলাচ্ছে। সবার মাঝে সে বিশেষ একজনকে খুঁজে চলেছে। সবাই তো এখানেই আছে তাহলে সে কোথায়! আলিহানকে তার ব্যাপারে জিগ্যেস করবে সেটাও পারছে না কারন তার পাশে বসে আছেন সৈয়দা মাহবুবা। মেহের একবার কেবিনের দরজার দিকে তাকাচ্ছে তো আবার মৌ-এর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকাচ্ছে। মৌ মেহের এমন চাওনির মানে বুঝতে পারছে না। সে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে বাকা চোখে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। মৌ-য়ের মনে গভীর প্রশ্ন জাগে, “মেহের তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেন? আচ্ছা এখানে কি ওর কোন অসুবিধা হচ্ছে! নাকি গুরুত্বপূর্ণ কিছু? যেটা সে সবার সামনে বলতে পারছে না। সে মেহেরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– এমন করে তাকাচ্ছিস কেন মেহু। হিসু করবি। নাকি অন্যকিছু। আমাকে বল আমি তোকে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছি নয়তো কোন নার্সকে ডেকে দিচ্ছি।
মৌ-য়ের কথা শুনে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহের। সে মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে দাত কটমট করে কিছুক্ষণ তারপর সে কেবিনের দরজার দিকে তাকায় আর তখনি তার চোখের সামনে ভেসে উঠে রাহনাফের মলিন মুখখানা। রাহনাফকে দেখতেই মেহেরের অধোরে হাসি ফুটে উঠে। কেবিনে ডুকতেই রাহনাফের ও প্রথমে চোখ আটকে যায় মেহেরের চোখের দিকে। মেহের নিঃপলক তাকিয়ে থাকে রাহনাফের মুখপানে। রাহনাফও তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সে তার দৃষ্টি নামিয়ে আলিহানের দিকে নিক্ষেপ করে। আলিহান তখনো গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভেবে চলেছে। তার পাশে যে রাহনাফ এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল নেই আলিহানের। সে রাহনাফের উপস্থিতি টের পায়নি তাই রাহনাফ আলিহানের কাঁধে তার হাত রাখে। মেহের তখনো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহনাফের দিকে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে রাহনাফের চেহারার একি হাল হয়েছে। সত্যিই যদি মেহের না ফেরার দেশে চলে যেতে তখন কি হতো রাহনাফের! সেটাই ভাবছে মেহের। রাহনাফ আলিহানের দিকে তাকিয়ে বিধায় সে মেহেরে এমন মুগ্ধ দৃষ্টি দেখতে পায় নি। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে আলিহান। মাথা ঘুড়িয়ে পিছনে তাকাতেই দেখতে পায় রাহনাফকে। সে রাহনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে সৈয়দা মাহবুবার দিকে তাকায়। সৈয়দা মাহবুবা তখনো মেহেরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। বড় করে শ্বাস ফেলে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে আলিহান। বিনিময়ে রাহনাফ ও হাসে। তারপর সে মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বলে। আর মৌ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। আলিহান সৈয়দা মাহবুবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– ছোটমনি তোমার শরীর অনেক ক্লান্ত এবার বাসায় ফিরে যাও। রেস্ট নাও। না- হলে তুমিও অসুস্থ হয়ে পরবে। মেহুর পাশে আমরা আছি।
– আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে তোদের এত ভাবতে হবে না। মেহু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলে আমিও একদম ঠিক হয়ে যাব। বলেই চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু ফেললেন সৈয়দা মাহবুবা। তখন মৌ গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর বলে,
– আন্টি চল আমরা এখব বাড়ি ফিরে যাই কাল সকালে আবার চলে আসবো। ততক্ষণে মেহুও সুস্থ হয়ে যাবে আর আমরা অনেক গল্প করবো। এখন চলনা আমরা ফিরে যাই।
আলিহান আর মৌ অনেক্ষণ বুঝানোর পর সৈয়দা মাহবুবা বাড়ি যেতে রাজি হয়ে যায়। আলিহান ওদের নিয়ে বেড়িয়ে যায়। রাহিও তার ড্রাইভারকে কল করে হসপিটালে আসার জন্যে। একে একে সবাই যখন কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায় তখন রাহনাফ গিয়ে মেহেরের পাশে বসে। সে মেহেরের গালে আলতো করে হাত রেখে অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকে মেহেরের মুখ পানে। তারপর সে মেহেরের কপালে তার অধোর ছুঁইয়ে উষ্ণ ভালোবাসার স্পর্শ একে দেয়। মেহের তার আখি বন্ধ করে রাহনাফের স্পর্শ অনুভব করে। তারপর তার গালে রাখা রাহনাফের হাতের উপর হাত রাখে। রাহনাফ মেহের হাত নিজের হাতের মুঠিবদ্ধ করে নেয়। অতঃপর সে মেহেরের হাতের উল্টোদিকেও চুমু খায়। মেহের শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের মুখের দিকে।
রাহনাফকে চোখের ইশারায় মেহেরের কাছে এসে বসতে বলে মেহের। রাহনাফ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসে তখন মেহের তার মাথা তুলে দেয় রাহনাফের কোলে। রাহনাফ মেহেরের চুলে নিজের হাত ডুবিয়ে দেয় আর মেহের রাহনাফের এক হাত ধরে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর মেহের বলে,
– আপনি খুব ভয় পেয়েছিলেন না? প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মেহের।
– ভিষন। আমার তো প্রাণটাই বেড়িয়ে যাচ্ছিলো মনে হচ্ছে। জবাব দেয় রাহনাফ।
রাহনাফ জবাব শুনে ওর হাতটা আরো শক্তকরে ধরে মেহের। অতঃপর বলে,
– আপনি কি ভেবেছিলেন! আমি আর ফিরবো না। শুনুন এত সহজে আমি আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছি না বুঝলেন মশাই। এখনো আমাদের অনেকটা পথ চলার বাকি।আমি হবো রাত আর আপনি হবেন চাঁদ। জোছনা এ ঘর আমাদের!
– আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিবো না লেখিকা সাহেবা। ভালোবাসা চাদরে আজীবন আমার বুকে জড়িয়ে রাখবো আপনাকে। একটাই জিবন আমাদের আর এই জিবনটাই আপনাকে গভীরভাবে ভালোবেসে যাবো। যে ভালোবাসার থাকবেনা অন্ত।
হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই একটু নড়েচড়ে বসে রাহনাফ। মেহেরের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৯]
– আপনি এসব কি বলছেন রাহনাফ। কেউ কেন আমাকে মারতে যাবে! আমি তো কারো কোন ক্ষতি করিনি। তাহলে কেন আমাকে কেউ মারতে চাইবে। আপনার কোথাও ভুল হচ্চে না তো।
কথাগুলো বলে রাহনাফের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো মেহের। ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না কেউ সুপারি দিয়ে ওকে খুন করতে চাইছে। বিষয়টা রাহনাফের মাথায় আসতেই রাহনাফ যখন মেহেরকে প্রশ্ন করে, ও এমন কাউকে চিনে কি না যে ওকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারে। তখন মেহের খুব অবাক হয়। আর প্রশ্ন করে “আমাকে কেউ কেন মারতে চাইবে? প্রতিউত্তরে রাহনাফ বলে,
– রাস্তায় আপনার সাথে যেটা হয়েছে সেটা প্ল্যান মাফিক সাজিয়ে গুছিয়ে করা হয়েছে। তাছাড়া আপনার পেটের ক্ষত বলে দিচ্ছে কেউ আপনাকে মারতে চায়।
রাহনাফের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে মেহের উপরের কথাগুলো বলে। রাহনাফ মেহেরের এক হাত তার নিজের মুঠিবদ্ধ করে অন্যহাত রাখে মেহেরের গালে। অতঃপর বলে,
– আমি জানি লেখিকা সাহেবা আপনি কারো ক্ষতি করতে পারেন। এটা আপনাকে দ্বারা সম্ভবও নয়। কিন্তু কি বলুন তো! আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই অনেক শত্রুর জন্মহয়। না আমারা তাকে চিনি আর না তাকে জানি। তবে তারা আমাদের সামনে আসে শত্রু হয়ে। হতে পারে আপনি অজান্তেই তাদের কোন কিছুতে আঘাত করেছেন। অথবা হতেই পারে আপনার কোন কাজের জন্যে তাদের কাজে ক্ষতি হয়েছে। কিংবা এটাও হতে পারে আপনি তাদের পথের কটা। আপনার কারনে তাদের অসুবিধা হচ্চে। তাদের পথে কটা হয়ে আছেন আপনি। যেটা তারা উপড়ে ফেলতে পারে। দেখুন লেখিকা সাহেবা আপনার পেটের ক্ষতটা দেখুন। পেট বরাবর সোজা নিচের দিকে, কোথাও কিন্তু আচরের দাগ নেই। মানে হলো সে জানতো যে আপনাকে সে আঘাত করবে। আর যদি এটা অনিচ্ছাকৃত ভাবে হত তাহলে ক্ষতটা হত এবড়োখেবড়ো। মানে ছুড়িটা নিচের দিকে না গিয়ে সেটা আপনার পেটের বিভিন্ন অংশে লেগে যেত। যেহেতু সেখানে অনেক ভীড় ছিলো। কিন্তু সেটা হয়নি। ছুড়িটা সোজা আপনার পেটের ভিতরে ডুকে পরেছে। তাছাড়া ছুড়িতে কারো ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও পাওয়া যায়নি। তার মানে কি! কেউ প্ল্যান করে করেছে এই কাজ।
রাহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলো আর অবাক হচ্ছিলো মেহের। রাহনাফের কথা শেষ হতে না হতেই মেহেরের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। কিন্তু সেটা মাটি অব্ধি পরেনি। গাল বেয়ে অশ্রু পড়তেই রাহনাফ সেটা নিজের হাতে মুছে দেয়। মেহের এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তাকে কেউ মেরে ফেলতে চায়। তার এমনও শত্রু আছে। কথাটা যতবার তার মনে পড়তে ততবারই বুক ভেঙে কান্না আসছে। মনটা তার এমনও বলছে, তাহলে সে বেঁচে উঠলো কেন! কারো গলার কাঁটা হয়ে তাকে বেঁচে থাকতে হবে এটা ভাবলেই কষ্ট হচ্চে তার। মেহের যতবার তার চোখ থেকে জল ফেলছে রাহনাফ ততবারই সেটা মুছে দিচ্চে আর তার হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে মেহেরের গালে স্লাইড করছে। রাহনাফ মেহেরের গালে করতে করতে বলল,
– এই চোখের জলের মূল্য অনেক। এভাবে এটাকে বিসর্জন দিবেন না লেখিকা সাহেবা। কার জন্যে চোখের জল ফেলছেন আপনি! যাকে আপনি চিনেন-ই না। কেন নিজের চোখের জল এভাবে নষ্ট করছেন। আপনি জানেন আপনার চোখের একফোঁটা জলের মূল্য আমার কাছে ঠিল কতটা! আপনার চোখের জল মুছার জন্যে আমি আমার জিবনটাও বাজি রাখতে পারি। প্লিজ লেখিকা সাহেবা এভাবে কাঁদবেন না। আমি সহ্য করতে পারি না। এভাবে পুড়াবেন না আমায়। রাহনাফের জড়ানো কন্ঠ।
মেহের এবার কেঁদেই দিলো। সে ফুফিয়ে কাঁদছে। রাহনাফ কিছু বলতে পারছে না। মেহেরের কান্না দেখে তার চোখেও অশ্রুর ভীড় জমেছে। অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মেহের রাহনাফের হাত শক্তকরে জড়িয়ে ধরে কান্নামিশ্রত কন্ঠে বলে উঠে,
– আমি কার কি ক্ষতি করেছি। কেন কেউ আমাকে মারতে চায়। আমি কারো প্রাণের শত্রু কথাটা ভাবতেই কষ্ট হচ্চে আমার। মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।
রাহনাফ আর চুপটি করে থাকতে পারলো না। সে মেহেরকে তার বুকে চেপে ধরলো। দু-হাতে মেহেরকে আগলে ধরে বলতে লাগলো,
– এভাবে কেন ভাবছেন লেখিকা সাহেবা। এমনও তো হতে পারে সে কোন খারাপ কাজ করতে চাইছে আর আপনার কারনে সেটা সে করতে পারছে না। তাই তারা আপনাকে মারতে চায়। আপনি এভাবে ভেঙে না পরে রুখে দাঁড়ান। দেখুন কে সেই লোক। যে আপনাকে মারতে চায়। আপনি তো কোন অন্যায় করেন নি তাহলে এত দুর্বল কেন হচ্চেন আপনি। ঘুরে দাঁড়ান।সত্যিটা জানুন খুজুন। আমরা সবাই আছি তো আপনার পাশে। কথাগুলো বলেই মেহেরের মাথায় আলতো করে চুমু খায় রাহনাফ। অতঃপর বলে,
– আমি আছি তো আপনার পাশে। আর কোন আঘাত আপনাকে হানতে পারবে না। সবসময় ছায়া হয়ে পাশে থাকবো।
মেহের কোন কথা বলে না। দু-হাতে রাহনাফের টিশার্ট খামচে ধরে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্চে।
৩৯,
ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই রাহি দেখতে পায় তার মা এখনো তার জন্যে জেগে বসে আছে। ড্রয়িংরুমে সুফায় বসে পায়ের উপর পা রেখে টেলিভিশন দেখছে। একমাত্র মেয়ে এত রাত অব্ধি বাড়ির বাহিরে আছে তবুও চিন্তার লেশ মাত্র নেই আফিয়া আহমেদের মধ্যে। অতি আনন্দের সহিত টেলিভিশনে সাউথ ইন্ডিয়ান মুভি দেখছে। রাহি ধীর পায়ে আহিয়া আহমেদের পাশে এসে দাঁড়ায়। টেলিভিশনের দিকে চোখ পড়তেই সে দেখতে পায়, নায়িকা নায়েকের কলার চেপে ধরে কান্না করছে। নায়ক অন্যদিকে তাকিয়ে নায়িকাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। নায়কটা যত তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে নায়িকা ততই তাকে আঁকড়ে ধরছে। সুযোগ বুঝে তার কপালে একটা চুমুও খেল নায়িকা। আর এই দৃশ্যপট ঢের মনোযোগ দিয়ে দেখছে আফিয়া আহমেদ। তার চোখ কিছুটা সংকোচি। অধোরে তৃপ্তিকর হাসি। তবে সেটা বুঝা যাচ্চে না। মনোযোগ না দিয়ে দেখলে কেউ এই হাসি দেখতে পারবে না। রাহি বুঝতে পারে না এই মুভিগুলা এত মনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে। সে মায়েট দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যায়। তখনি আফিয়া আহমেদ ওর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
– এত রাত অব্ধি কোথায় ছিলে তুমি?
– হসপিটালে। চলে যেতে নেয় রাহি। কয়েক কদম সামনে এগোতেই আফিয়া আহমেদের আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
– তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি একেবারে সুস্থ। তাহলে এত রাত অব্ধি হসপিটালে কেন ছিলে?
– মেহের আপু অসুস্থ। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
রাহির কথা শুনে হাত থেকে রিমোট পরে যায় আফিয়া আহমেদের। চমকে উঠে সে। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত রাহির দিকে তাকায় সে। আর বলে,
– কি- কি নাম বললে তুমি?
– মেহের আপু। এত অবাক কেন হচ্ছো। মনে হচ্ছে নামটা প্রথম শুনলে।
রাহির করা প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায় আফিয়া আহমেদ। সে রাহির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
– যে মেয়েটা তোমার থেকে তোমার ভলোবাসা কেড়ে নিয়েছি তুমি তাকে দেখতে গিয়েছিলে রাহি! তোমার শরীর ঠিক আছে তো? রাহি, মেহের তোমার থেকে তোমার ভালোবাসাকে কেড়ে নিয়েছে। ও তোমার শত্রু। আর শত্রুর উপর কখনো দুর্বল হতে নেই।
– এসব তুমি কি বলছো মা। মেহের আমার থেকে আমার ভালোবাসাকে কেড়ে নেয়নি। বরং আমি এমন একজনকে ভালোবেছি যে কখনোও আমাকে ভালোবাসে নি। একপক্ষ ভালেবাসা ছিলো আমার। তাহলে মেহের কি করে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে বল মা! আর হ্যাঁ কি যেন বললে তুমি! ওহ হ্যাঁ মেহের আমার শত্রু নয় মা, সে আমার বোন।
কথাগুলো বলেই হনহন করে নিজের রুমে চলে যায় রাহি। আফিয়া আহমেদ অবাক হয়ে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাহির বলা কথাটা এখনো তার কানের কাছে বেজে চলেছে। তাহলে কি রাহিও সত্যিটা জেনে গেছে। আর যদি সে সত্যিটা জেনে থাকে তাহলে সে মেহেরকে বোন হিসাবে মেনে নেয় কি করে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রাহি তার দৃষ্টির বাহিরে চলে যায়। আফিয়া আহমেদ সুফায় বসে পরে। তখন শিড়ি দিয়ে নামতে নামাতে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ বলে,
– মা যাকে মেরে ফেলার জন্যে কিলারদের সুপারি দেয়, মেয়ে তাকে দেখতে পুরো রাতটাই হসপিটালে কাটিয়ে দেয়। ভারী অদ্ভুত!
সৈয়দ নওশাদের কথা কানে আসতেই শিড়ির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আফিয়া আহমেদ। সে গলার স্বর কিছুটা মোটা করে বলে উঠে,
– কি বলতে চাও তুমি?
– এই যে,রাহি মেহেরকে নিজের বোন বলে দাবী করেছে। এখন যদি সে জানতে পারে তার বোনের এই অবস্থার জন্যে দায়ী তার মা। তখন কি রাহি তোমাকে ক্ষমা করবে। কি করে দাঁড়াবে রাহির সামনে! আফিয়া তুমি বুঝতে পারছো কত বড় অন্যয় তুমি করেছো? একটা ভালো মা হতে গিয়ে খুনি হতে যাচ্ছিলে। নিজের মেয়ের কথা ভাবতে গিয়ে তুমি ভুলে গেছো মেহেরে ও কোন মায়ের সন্তান। তুমি শুধু,,,,
সৈয়দ নওশাদ তার বলা কথাগুলো শেষ করতে পারলো না তার আগেই রাহি উপর থেকে চিৎকার করে উঠলো মা বলে। রাহির চিৎকার শুনে তারা দুইজনেই উপরে তাকায়। সেখানে রাহি অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করে তাকিয়ে ছিলো তার মায়ের দিকে। সৈয়দ নওশাদের বলা প্রত্যেকটা কথা সে শুনে নিয়েছে। কি হবে এখন??
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।