মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৩২,৩৩

0
514

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৩২,৩৩
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
৩২

ছবিটার দিকে নিঃপলক তাকিয়ে আছে মেহের। রাহনাফ এত নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে এটা তার ধারণার অতীত ছিলো। ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে এটা বাস্তব। চোখের সামনে মেহের তার অধোরে সিগ্ধ হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। মেহের ছবিটার উপর হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো,

– আপনি এত ভালো ছবি আঁকতে পারেন। আগে বলেন নি কেন?

– আগে বললে কি করতেন আপনি? মৃদু হেসে প্রশ্ন করে রাহনাফ।

– আপনাকে দিয়ে রোজ একটা করে নিজের ছবি আঁকিয়ে নিতাম। আর সেগুলো আমি আমার রুমের দেয়ালে সাটিয়ে নিতাম। রাহনাফের দিকে তাকিয়ে অধোর প্রসারিত করে হাসি দেয় মেহের। রাহনাফ ও মাথা চুলকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাসে। অতঃপর বলে,

– আচ্ছা বেশ, আরো কিছু বলতে যাবে তার আগে পাশ থেকে মৌ বলে উঠে,

– আমারও একটা ছবি এঁকে দাওনা রাহনাফ ভাইয়া। ওহ সরি শুধু আমার না, আমার আর আলিহানের একটা ছবি এঁকে দিবে আর আমি সেটা বেধে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখবো।

– ঠিক আছে। আচ্ছা আলিহান কোথায়? আসার পরে ওকে একবারও দেখি নি।

রাহনাফের কথার কোন জবাব দিলো না মৌ। মুখ গোমড়া করে বসে রইলো সে। মেহের ও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৌ-য়ের মুখের দিকে। আলিহানকে আজ সকাল থেকেই দেখতে পাচ্ছে না সে। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সে বলেও যায়নি কোথায় যাচ্ছে। মৌ তো আলিহানের স্ত্রী ও নিশ্চয় জানবে আলিহান কোথায় আছে। কিন্তু মৌ-য়ের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না যে আলিহান কোথায় সেটা সে জানে। কপাল কুচকে ফেলে মেহের। কারন মৌ-য়ের চোখ মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। মেহের মৌ-য়ের কাঁধে হাত রেখে বলে,

– কি হয়েছে মৌ? আলিহান ভাইয়ের কথা জিগ্যেস করতে তোর মুখটা অমন কালো হয়ে গেল কেন?

– আসলে আলিহান যাওয়ার আগে আমাকে বলে যায়নি। কোথায় গেছে কার সাথে গেছে সেটাও জানি না। কল করেছি কয়েকবার কিন্তু রিসিভ করে নি।করুন চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে মৌ।

মৌ-য়ের মুখের রিয়্যাকশন দেখে হাসে রাহনাফ। অতঃপর বলে,

– আরে ভাবি চিল। আলিহান হয়তো কোন কাজেই বের হয়েছে চলে আসবে। এত অস্থির হওয়ার কারন নেই। চলে আসবে। আচ্ছা দাঁড়াও কল করছি আমি বলেই বুক পকেট থেকে মোবাইল বের করে আলিহানের নাম্বারে ডায়াল করে। রিং হওয়ার সাথে সাথে কল রিসিভ করে আলিহান।

– দোস্ত কোথায় তুই? তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আয়। মৌ চিন্তা করছে। ওকে না বলে বেড়িয়েছিস কেন?

– এইতো আমি বাসার সামনেই আছি। আর দুই মিনিট লাগবে।

– ওও আচ্ছা আয় তাহলে। কল কেটে দেয় রাহনাফ। মেহেরের দিকে একপলক তাকিয়ে মৌ-দিকে তাকায় সে। অতঃপর বলে,

– আলিহান কে শায়েস্তা করতে পারবে না তুমি মৌ। রাহনাফের কথা শুনে মৌ আর মেহের দুইজনেই ওর দিকে তাকায়। মৌ-য়ের কপালে যেমন কয়েকটা ভাজ পরেছে তেমনি মেহেরর ও। মৌ আলিহানকে শায়েস্তা করবে কিন্তু কেন? ওদের দুজনের মুখের রিয়্যাকশন দেখে রাহনাফ অধোর চেপে হাসে। আর বলে,

– না মানে বলছিলাম এই সকাল থেকে বিকাল অব্ধি কাউকে কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিল সে। কার সাথে দেখা করতে গিয়েছে সে বউকেও বলে যায়নি। আচ্ছা আলিহানের গোপন কোন গালফ্রেন্ড নেই তো। গালে হাত রেখে বলে রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে চক্ষুদ্বয় বড় বড় হয়ে যায় মৌ আর মেহেরের। মৌ কিছু বলতে না পারলেও মেহের বলে,

– কি সব আবোল তাবোল বলছেন রাহনাফ। এমন কিছুই নয়। ভাইয়ার হয়তো কোন দরকার পরেছে তাই বেড়িয়েছে। তাছাড়া আমরা সবাই জানি আলিহান ভাই মৌকে কতটা ভালোবাসে।

– সেটা তো আমিও জানি। কিন্তু কি এমন মহান কাজে বেড়িয়েছে যে নিজের বউকে পর্যন্ত বলে যায় নি। আচ্ছা মৌ-প্লাস ভাবি তুমিই বলো কি এমন কাজে বেড়িয়েছে সে। শুনো আলিহান কিন্তু এতটাও ভালো মানুষ না। কলেজে থাকা কালীন অনেক মেয়েই ওর পিছুপিছু ঘুড়তো। আর হ্যাঁ, ডিপ্লোমা ২য় বর্ষে থাকাকালীন ওর একটা গোপন গার্লফেন্ড ছিলো। সারাক্ষণ তার সাথে চ্যাটিং করতো, আর হাসতো। আমি যতবার তার কথা জিগ্যেস করেছি আলিহান ততবারই আমাকে এড়িয়ে চলেছে। সেই মেয়েটা কে আজ অব্ধি আমরা কেউ জানিনা। মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে বলল রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে বিষন্নতায় ছেয়ে যায় মৌ-য়ের মুখ। এক রাশ কালো মেঘেরা এসে ভীড় করেছে মৌ-য়ের মুখে। আকাশে মেঘ করলে যেমন বৃষ্টি হয় তেমনি মৌ-য়ের মনে মেঘ জমে চোখের কোটরে এসে অশ্রুর ভীড় জমিয়েছে। আলিহান কি সত্যিই ওর গার্লফেন্ডের সাথে দেখা করতে গেছে। আচ্ছা কোথায় আলিহান! ও যাওয়ার আগে আমাকে কিছু বলে যায়নি কেন? আজ সারাদিন কোথায় ছিলো সে! মনে মনে ভাবছে মেহের। তখনি ওর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে দরজার পাশ থেকে আলিহান বলে উঠে,

– এমন কিছুই হয়নি মৌ। আমার একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ পরে গেছিলো তাই তাড়াতাড়ি চলে গেছিলাম। রুমের ভেতরে প্রবেশ করে আলিহান। সে মৌ-য়ের দিকে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মৌ মুখ ভেঙচি কেটে অন্যদিকে ঘুরে তাকায়। এই দৃশ্য দেখে হাসে আলিহান ও রাহনাফ। রাহনাফ আলিহানের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বলে,

– বউকে কিছু না জানিয়ে সারাদিন বাড়ির বাহিরে কাটানো তাইনা। এবার যাও বউয়ের মান ভাঙাও। মৌ-য়ের দিকে তাকায় রাহনাফ। মৌ তখনো অন্যদিকে ঘুরে চোখের জল ফেলছে। আলিহানের গোপন গার্লফেন্ড আছে হয়তো এটা সত্যিই ভেবে বসে আছে সে। রাহনাফ মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

– মেয়ে মানুষগুলা এমনি হয় তাইনা। দেখনা একটুতেই কেমন কেঁদে ফেলছে। অথচ ও ভুলেই গেছে তুই কলেজ লাইফের শুরু থেকে ওর সাথে প্রেম করিস।

– শালা দিলি তো আমার বউটাকে কাঁদিয়ে । এবার আমি কি করে সামলাবো। মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে বলে আলিহান।

– তুই তোর বউ সামলা আমি বরং মেহেরকে নিয়ে একটি গুরে আসি। ও আচ্ছা সারাদিন কোথায় ছিলি বললি না তো।

রাহনাফের করা শেষ প্রশ্নে থমকে যায় আলিহান। নির্বিকায় দাঁড়িয়ে থাকে সে কিছুক্ষণ। আলিহান কোথায় গেছিলো কার সাথে দেখা করতে গেছিলো এটা জানতে পারলো তো সব শেষ হয়ে যাবে। ব্যাপারটা বেশীদূর গড়াতে দেওয়া যাবে না। টপিক চেঞ্জ করার জন্যে আলিহান বলে উঠে,

– মৌ কাঁদছিে। এবার রুম থেকে বের হো। পরে তোকে সবটা বলবো।

আলিহানের কথা মতো রাহনাফ রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। মেহেরও একবার মৌ-য়ের মুখ পানে তাকিয়ে প্রস্থান করে। সবার চলে যাওয়ার পর আলিহান গিয়ে মৌ-কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মৌ ছাড়ানোর চেষ্টা করলে সে আরো জোরে ওকে চেপে ধরে কাঁধে নিজের অধোর ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,

– রাগ হয়েছে আমার মৌ-পাখিটার!

মৌ কোন জবাব দেয়না। আলিহান এবার মৌ-কে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নিয়ে মৌ-য়ের দু-গালে নিজের হাত রেখে বলে,

– রাহনাফের কথায় অভিমান হয়েছে। মৃদু হাসে আলিহান। অতঃপর বলে, রাহনাফ তোমার সাথে ফান করেছে মৌ-পাখি। আমি তো কলেজ লাইফ থেকে একজনকেই ভালোবাসি মৌ পাখি। সে আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। রাতের পর রাত জেগে যার সাথে চ্যাটিং এ ব্যাস্ত থাকতাম। না দেখে শুধু কথা বলেই প্রেমে পড়েছি তার। পরে একপলক দেখায় সেই ভালোবাসাটা যেন তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিলো। ভালোবেসেছি তাকে খুব।

আলিহানের কথা শুনে মৌ অভীমানে কন্ঠে বলে উঠে,

– এ এটাতো আমি। আমিই তোমাকে ট্যাক্স করতাম।

– হুম। আমি শুধু আমার মৌ পাখিটাকেই ভালোবাসি।

৪২,
শীত চলে আসার পর থেকেই সকালগুলো ইদানীং কী অসহ্য অলসতা নিয়ে হাজির হয়, যা বলে বোঝাতে পারবে না আফিয়া আহমেদ। ইচ্চে করে দু-চোখ বন্ধ করে রাখতে। কিন্তু সেটা আর হবে না। ঘড়িতে এলাম ভাজছে। সে জানান দিচ্ছে এখন আর ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। উঠতে হবে। ব্রেকফাস্টের সময় হয়েছে। যদিও এ বাড়িতে সময়টাই তার হাতে নিয়ন্ত্রণ। অলসতাকে পাশ কাটিয়ে উঠে বসে আফিয়া আহমেদ। ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায়।

ড্রাইনিং টেবিলে বসে সৈয়দ নওশাদ আর আফিয়া আহমেদ রাহির জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। এতদিন বুয়া রাহির খাবারটা তার রুমে দিয়ে এসেছে। কিন্তু কাল রাতেই রাহি আবার আগের মতো সবার সাথে বসে ডিনার করে তাই সকলে ভাবছে ব্রেকফাস্ট ও সকলের সাথে করবে। অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পরেও যখব রাহি আসে না তখন আফিয়া আহমেদ একটা সার্ভেন্টকে ডেকে বলেন, রাহিকে ডেকে দিতে। সার্ভেন্ট আফিয়া আহমেদের কথা মতো রাহির রুমে যায় রাহিকে ডাকতে কিন্তু সে সেখানে গিয়ে রাহিকে খুজে পায়না। কথাটা সৈয়দ নওশাদ আর আফিয়া আহমেদের কানে আসতেই তারা পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে রাহিকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও রাহিকে খুজে পাওয়া যায়না। বাড়ির আশে পাশে, আত্নীয় স্বজন, ও রাহির সকল বন্ধুদের বাড়িতে কল করে সৈয়দ নওশাদ কিন্তু কেউই রাহির সন্ধান দিতে পারে না। ধপ করে সুপায় বসে মাথায় হাত রাখে সৈয়দ নওশাদ। রাহি বাড়িতে নেই। কোন আত্নীয়দের বাড়িতে ও যায়নি। ওর বন্ধুরাও ওর খবর জানে না। তাহলে রাহি এখন কোথায়???

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩৩]

সৈয়দ নওশাদের অপেক্ষার অবসান ঘটে দারুন একটা চমকপ্রদ দিয়ে। সকাল সকাল এরকম একটা সারপ্রাইজ পাবেন তিনি সেটা কখনো কল্পনাও করেন নি সৈয়দ নওশাদ। ড্রয়িংরুমে পায়চারী করছিলেন আর ভাবছিলেন রাহির কথা। রাহি কোথায় যেতে পারে সেটা নিয়েই ভাবছিলেন সৈয়দ নওশাদ আর আফিয়া আহমেদ বসে কাঁদছিলেন। রাহিকে খুজে না পাওয়ার কারনে অস্থির দুইজনেই। বিষন্নমনে বসে মাথায় হাত রেখেছেন সৈয়দ নওশাদ। রাহি কোথায় আছে! রাহিও কি তার সাথে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো। ছোট্ট থেকে যে মেয়েটা বাবা বলতে অজ্ঞান আজ সেই মেয়েটাই তার বাবার উপর অভিমান করে বাড়ি ছেলে চলে গেল। যাবার আগে একবারও ভাবে নি তাকে ছাড়া তার বাবা কি করে থকাবে। এই রাহিই তো যাকে দিয়ে সৈয়দ নওশাদ তার সকল আহ্লাদ পূরন করেছে। ছোট থেকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে তাকে। রাহি যখন হাটা শিখে তখন তার হাত ধরে হাটতে শিখিয়েছে রাহিকে। আজ সেই রাহিই তার উপর রাহ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। সৈয়দ নওশাদ মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন তার চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু কণা বেড়িয়ে গাল বেয়ে পরে আর তখনি সে শ্রবণ করে তার সেই চিরোচেনা কন্ঠস্বর। কথাটা যেন এখনি তার কানের কাছে প্রতিধ্বনি হচ্ছে বারবার।

– নওশাদ, কেমন আছিস বাবা।

মাথা তুলে সামনে তাকায় সৈয়দ নওশাদ। এতগুলা বছর পর নিজের মাকে বাড়িতে দেখতে পেয়ে হতবম্ব হয়ে যায় সৈয়দ নওশাদ। অবলার মতো তাকিয়ে থাকে তার বৃদ্ধা মায়ের মুখ পানে। আফিয়া আহমেদ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে যায়। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই বুড়িটা কি সত্যিই এখানে এসেছে। এতবছর পর আবার এই বাড়িতে ফেরার সাহস সে পেল কোথা থেকে! না এই বুড়িকে কিছুতেই এ বাড়িতে থাকতে দেওয়া যাবে না। না হলে সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে মাথা খেয়ে ফেলবে। আফিয়া আহমেদের ভাবনার ছেদ ঘটে সৈয়দ নওশাদের মায়ের কাপাকাপি গলার কন্ঠ শুনে।তিনি দু-হাত বাড়িয়ে ছেলের দিকে তাক করে রেখেছেন। সৈয়দ নওশাদ ছুটে এসে তার মায়ের কোলে ঝাপটে পরে। ছেলে মায়ের কোলে ঝাপটে পড়েছে আর মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আদর করছে। কত সুন্দর সিগ্ধ আর মনোরম দৃশ্য এটা। একটা মায়ের কাছে এক চেয়ে সুখের সময় আর কি হতে পারে। সৈয়দ নওশাদের মা তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

– বললি না তো বাবা, কেমন আছিস?

– এতক্ষণ কেমন ছিলাম জানিনা তবে এখন আমি খুব ভালো আছি। সৈয়দ নওশাদ তার মা-কে ছেড়ে তার গালে হাত রেখে বললেন। তুমি এসেগেছ আমি কি খারাপ থাকতে পারি বল মা।

– এতই যদি মা-কে ভালোবাসো তুমি তাহলে তাকে এতদিন আশ্রমে রেখেছিলে কেন বাবা। তোমার কাছে রেখে দিলেই তো পারতে। মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলে রাহি। রাহির কন্ঠ শুনতে পেয়ে সৈয়দ নওশাদ ও আফিয়া আহমেদ দুইজনেই দরজার দিতে তাকায়। সেখানে রাহি দু হাতে দু খানা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা পা ফেলে ভিতরে প্রবেশ করে রাহি। আকস্মাৎ সৈয়দ নওশাদ গিয়ে রাহিকে জড়িয়ে ধরে। রাহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

– কাউকে কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলি তুই। জানিস আমার কত টেনশন হচ্ছিলো। আরেকটু হলে আমার প্রানটাই বেড়িয়ে যেত।

– আমি তো দাদিকে আনতে গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি কি এখনো ছোট বাচ্চা নাকি। কোথায় বের হলে তোমাদের এত টেনশন করতে হবে। শান্তু হও বাবা।

সৈয়দ নওশাদ রাহিকে ছেড়ে দেয়। রাহির মুখের দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

– সন্তান যতই বড় হোকনা কেন? বাবা মায়ের কাছে তারা সবসময়ই ছোট থাকে। যেদিন তুই মা হবি সেদিন বুঝবি।

– সত্যিই কি তাই বাবা! সব বাবা মায়েরা কি সন্তানদের কষ্ট বুঝতে পারে! তুমি পারো বাবা? চোখের সামনে বাবাকে পেয়ে তাকে বাবা বলে ডাকতে না পারার কষ্টটা কি তুমি ফিল করতে পারো। দেখনা আমি কিসব বলছি। সবাই কি আর সবার কষ্ট বুঝতে পারে। মৃদু হাসে রাহি। আচ্ছা আমি দাদিকে নিয়ে রুমে যাচ্ছি। অতঃপর রাহি চলে যায়। সৈয়দ নওশাদ অবলার মত তাকিয়ে থাকে রাহির চলে যাওয়ার দিকে। রাহি যে তাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলেছে এটা বুঝতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। আফিয়া আহমেদ তার হাতের মুঠি শক্তকরে নেয়। অনেক কষ্টেএই বুড়িটাকে বাড়ি থেকে বিদায় করছিলো সে আবার এসে জুটলো সে এই বাড়িতে। এখন সারাদিন বুড়ির ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে হবে।

৪৩,
প্রকৃতিকে জ্যোতির অলংকার পরিয়ে নিঃশব্দ পায়ে নিবিড় সন্ধ্যা নামে পৃথিবীতে। প্রবীণ দিনকে পিছনে ফেলে অচেনা অনবদ্য রূপে সন্ধ্যারানি এসে হাজির হয়। তবে সন্ধ্যা বড়াে চঞ্চলা, এসেই বিদায় নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ক্ষণস্থায়ী বলে তার রূপে অমন বিরহ-ব্ৰত, পবিত্র প্রেম মাধুর্য, অমন সকরুণ স্নিগ্ধতা। সন্ধ্যা ধীর পায়ে এসে চপল চরণে চলে যায় । আকুল অশ্রুসজল নয়নে সন্ধ্যাতারা তাকে বিদায় জানায়। সন্ধ্যা কোমল-গম্ভীর-স্নান-উজ্জ্বল মিশ্রিত এমন শ্রী, এমন এক পূর্ণ সৌন্দর্য ভাষায় তার চিত্রকল্প অঙ্কন সত্যিই অসাধ্য ।
ষড়ঋতুর বাংলায় সন্ধ্যা বড়াে বৈচিত্র্যময় । বর্ষার সন্ধ্যার আকর্ষণ প্রবল গভীর। প্রকৃতির সঙ্গে মানবহৃদয়ও এতে একাকার হয়ে মিশে যায়। হেমন্ত-সন্ধ্যার মােহমুগ্ধ লাবণ্যে আমাদের চোখে পলক পড়ে না। শীতের সন্ধ্যা কুয়াশার শুভ্র বসন গায়ে বিধবার মতাে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে তার মমতা আর চোখে তার করুণা ঝরে পড়ে । বসন্ত-সন্ধ্যার মৃদু-মন্দ বাতাসে মন যে কেমন করে, তা কী করে বলব …। সন্ধ্যার নির্জনতা : সন্ধ্যা শান্ত, স্তব্ধ, গম্ভীর। সন্ধ্যা ধরণিকে এক অপূর্ব মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে । চারদিকে রহস্যের ইন্দ্রজাল । অস্পষ্টতার এক পরাবাস্তব চিত্রকল্প । বুক ভরা কথা নিয়ে প্রকৃতি যেন মূক হয়ে থাকে । সারা দিনের কর্মকোলাহলের মাঝে তার যে আতিগুলাে অবহেলায় চাপা পড়ে থাকে, সে যেন তার সবটুকু এক মধুর মৌনতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন। নিস্তব্ধ নিবিড় দিগন্তহীন ঘন আঁধারে চোখ রেখে কী এক অব্যক্ত বেদনার ভাবে আমাদের হৃদয়ে সুর অনুরণিত হয়ে ওঠে। এমন একটা সময়ে যদি প্রিয় মানুষটার হাত ধরে পাশাপাশি হাটা যায় তাহলে যেন সময়টা আরো বেশী মাধুর্য হয়ে উঠে। মেহেরের ও মনে হচ্ছে সময়টা যেন এখানেই থেমে যায়। এই সন্ধায় প্রিয় মানুষটার সাথে পাশাপাশি হাটতে পারাটা একটু বেশীই ভালোলাগে। অসুস্থতার কারনে মেহের রাহনাফের এক হাত জড়িয়ে রেখেছে। রাহনাফ মেহেরের হাতের উপর আলতো করে তার হাত রেখে হাটছে। দুজনের মাঝে যেন কথার ফুয়ারা ফুটেছে।

– লেখিকা সাহেবা, চলুন বাসায় ফিরে যাই। মনে হচ্ছে ঝড় শুরু হবে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল রাহনাফ। এখন গ্রীষ্মকাল। সারাদিনে প্রখর রোদ থাকলেও মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়। যে ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় গরীব কাঙ্গালে ঘড় বাড়ি। চারিদিক কেমন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। ধমকা হওয়া বয়ছে। মেহের আকাশের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে বলল,

– সেটাই তো ভালো ছিলো।

– কোনটা?? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রাহনাফ।

– আমার দিনে উজ্জলতা রোদের উপর নির্ভর করে না। বরং তোমার হাসির উপর নির্ভর করে। এইটা।

– আচ্ছা পারমিশন দিলেন তাহলে?

– আবার। একটু শক্তগলায় বলে মেহের।

– আচ্ছা সরি। চল বাসায় ফিরে যাই। ঝড় আসছে।

– পরে যাব। আগে বৃষ্টিতে ভিজবো তারপর বাসায় যাব।

– মেহের তুমি অসুস্থ। এই অবস্থায় বৃষ্টিতে ভেজাটা ঠিক হবে না। তাছাড়া এখন বৃষ্টি হবে না ঝড় হবে ঝড়। চল বাসায় ফিরে চল। একরকম জোড় করে রাহনাফ মেহেরকে নিয়ে বাসায় দিকে চলে আসে।পথিমধ্যে শুরু হয় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি সাথে ধমকা হাওয়া। শীতে মেহের হাত ভাজ করে নেয়। এটা রাহনাফের চোখে পড়তেই সে তার পরনে থাকা শার্টটা খুলে মেহেরের গায়ে জড়িয়ে দেয়।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here