মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৪১,৪২

0
514

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৪১,৪২
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
৪১

৫১,

দিনের শেষ অংশ টা খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যায় ! পড়ন্ত বিকেল হয়তো একেই বলে ! আর দিনের শেষ ভাগের এই রংটাই বুঝি গোধুলী ! ছাদে বসে গাঢ়ো কমলা রঙ এর অস্তায়মান সূর্য টা দেখছেন সৈয়দা মাহবুবা। সূর্যকে দেখে মনে হচ্ছে সূর্য্যি মামা বুড়িয়ে গেছে , তাকিয়ে আছেন অবলিলায় । চোখে বিন্দু মাত্র আঁচ লাগছে না তার। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তার সৌন্দর্য অবলোকন করলেন সৈয়দা মাহবুবা। কি জানি ! হয়তো সত্যিই সুন্দর প্রকৃতির এই দিন রাতের সন্ধ্যিক্ষন । সৈয়দা মাহবুবা কঠিন হৃদয়ের মানুষের পক্ষে তা খুজে পাওয়া রিতিমত দুঃসাধ্য কাজ । কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখ ঘুরিয়ে মনযোগ দিলেন এক ঝাক ঘরে ফেরায় ব্যাস্ত পাখিদের দিকে।উড়ে চলেছে নিজ গন্তব্যে ! কি ছকে বাঁধা নিয়ম ওদের ! ভোর হতেই জেগে ওঠা , খাবার এর খোজে বেরিয়ে পরা , সারা দিনের সমস্ত কাজ সাঝ বেলার আগেই শেষ করে ঘরে ফেরা ।সত্যিই হয়তো সুন্দর ।
কিছুক্ষন পর সূর্য্যি মামার দিকে তাকিয়ে দেখেন সে কয়েক মিনিটের ব্যাবধানে অনেকটা দূরে চলে গেছে !
এইতো ! কিছুক্ষণ আগেই ঐ মরা বেল গাছটার মাথার উপর ছিলো ,আর এখন নেমে গেছে অনেক নিচে ।
সূর্য্য কে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো তোর কি বড্ড তাড়া !
নাকি সারাদিন ঠায় দাঁড়িয়ে তুই ক্লান্ত ! ধীরে ধীরে সূর্য টা বেলগাছ টার ওপাসে বড় বড় গাছে আড়ালে হারিয়ে গেল । তখনও হয়তো সে ডুবে যায় নি । তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে দিনটাকে আলোকিত করে রাখার চেষ্টা করে গেল । মনে হচ্ছে আকাশ যেখানে মাটি ছুয়েছে ! সেখান কেউ কমলা রং ঢেলে দিয়েছে ।বেচারা ক্লান্ত সূর্য টা অবশেষে আঁধারের মাঝে হারিয়ে যেতেই বাধ্য হলো হয়তো ! সন্ধা তারা তার মহিমায় গোটা শহরে ঢেলে দিলো আবছা কালো অন্ধকারে। চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। তখন শহর নিয়ন আর সোডিয়াম আলোয় আলোকিত ! তবু রাত্রি কে হারাতে পারেনি সে নানা রং এর আলো। কি অদ্ভুত তাইনা! সৈয়দা মাহবুবা চলে আসেন তার রুমে। আযান হয়েছে নামায আদায় করতে হবে।

এদিকে যখন মৌয়ের ঘুম ভাঙ্গে তখন সে দেখতে পায় তার পুরো রুম বাচ্চাদের ছবি আর খেলনা দিয়ে সাজানো। রুমের চার দেয়াল ভর্তি শুধু বাচ্চাদের ছবি। কেবিনেট টা সাজানো হয়েছে খেলনা দিয়ে। খানিকটা অবাক হয়ে মৌ! এইটুকু সময়ের মধ্যে এত খেলনা আর ছবি কোথা থেকে আসলো? চারিদিকে চোখ বুলায় সে। জানালার দিকে তাকাতেই তার চোখ আটকে যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনমূর্তি মানবের দিকে। আলিহান রাহনাফ আর মেহের তিনজনে বারান্দায় কফির আড্ডা জমিয়েছে। তাদের অধোর জুড়ে লেগে আছে প্রাণোচ্ছ্বাস হাসি আর কথার ফোয়ারা। মৌয়ের চোখ আটকে যায় আলীহানের মুখের দিকে। আজ আলিহান কে একটু বেশি খুশি লাগছে। আলিহানের এমন দন্ত বিকাশ হয়তো আগে কখনও দেখিনি মৌ। প্রাণ খুলে হাসছে আলিহানশুধু তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। মৌ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে আলিহানের হাসিমাখা মুখের দিকে। কথার ফুড়ন কাটিয়ে যখন মৌ-য়ের দিকে তাকায় আলিহান তখনই মৌ-য়ের সাথে তার দৃষ্টি সংযোগ হয়। স্মিত হাসে সে। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে মৌ-য়ের কাছে আসে। মৌ ততক্ষণে উঠে বসার চেষ্টা করে। আলিহান লম্বা পা ফেলে মৌ-য়ের কাছে এসে ওকে আলতো করে ধরে বসিয়ে দেয়। পিছন থেকে রাহনাফ আর মেহের দুজনেই হাসি মুখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। আলিহান মৌ-য়ের পাশে বসে বলল,

– যা কিছু প্রয়োজন হবে আমাকে বলবে ওকে। একা একা ব্যাঙয়ের মতো লাফাবে না বলে দিলাম। ওয়াশরুমে যাবে?

মৌ অবলার মতো তাকিয়ে থাকে আলিহানের দিকে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে একটা মানুষের মাঝে এত পরিবর্তন হয় কি করে? আচ্ছা বাবা হওয়ার আনন্দটাই মনে হয় এরকম। আমার বাবারও এরকম আনন্দ হয়েছিলো। ছোট বেলাতে মায়ের মুখে শুনেছি, আমার জন্মের এক বছর পর্যন্ত বাবা কোন দিন রাতে ঠিক মতো ঘুমায়নি। বাবা মায়ের কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে যায় মৌ-য়ের। বিষন্নতায় ছেয়ে যায় তর মুখখানা। আলিহান মৌ-য়ের গালে হাত রেখে বলে,

– কষ্ট হচ্ছে তোমার! বমি করবে?

দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে নাসূচক জবাব দেয় মৌ। অতঃপর আলিহান মৌ-কে নিয়ে বারান্দায় বসিয়ে দিয়ে সেখান থেকে প্রস্তান করে। মেহের এসে মৌ-য়ের নিকটে বসে দুইঠোট প্রসারিত করে হাসি দিয়ে বলে,

– আমি খালামনি হবো মৌ। আমাদের বাড়িতেও একটা ছোট্ট রাজকন্যা আসবে। আমার আরেকটা মা আসবে।
পুরো বাড়ি দৌড়াবে, ছোট ছোট হাত দিয়ে আমার সাথে খেলা করবে। আধো আধো করে সবাইকে ডাকবে। আমার তো ভাবতেই কেমন কেমন অনুভূতি হচ্ছে। আচ্ছা মৌ তোর কেমন লাগছে রে। শোননা কাল মার্কেট গিয়ে বেবীর জন্যে ছোটছোট জামাকাপড় কিনে নিয়ে আসবো কেমন।

– মৌ তোমার বোন নিহাত পাগল হয়েছে। অতি সুখে পাগল যাকে বলে । আড় চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল রাহনাফ। রাহনাফের কথা শুনে মেহের তার ভ্রুদ্বয়ে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বলে উঠে,

– এই আপনি চুপ করুন তো। বাড়িতে নতুন মেহমান আসছে। তার জন্যে সব সব কিছু আগে থেকেই ঘুছিয়ে রাখতে হবে তাইনা। আবারও অধোর প্রসারিত করে হাসে মেহের।

– হুম সেটাই। তুমি যা শুর করেছ তাতে মনে হচ্ছে নতুন অতিথির আগমন ঘটে গেছে। আরে বাবা এখনো অনেক সময় বাকি। তাছাড়া তুমি জানলে কি করে রাজকন্যা আসবে? রাজপুত্র তো আসতে পারে তাইনা।

রাহনাফের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় মেহের। ছেলে বাবুর জন্যে সে কি জামাকাপড় কিনবে ভেবে পায়না। কিছুক্ষণ পর আলিহান আসে হাতে এক প্লেট ফল নিয়ে। মৌ-য়ের পাশের চেয়ার টেনে বসে আলিহান। তারপর এক এক করে সে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে থাকে। রাহনাফ উঠে দাঁড়ায় তারপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করে।

পরেরদিন সকাল সকাল কলেজে পৌঁছায় মেহের। যদিও কলেজে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিলো না তার। প্রিন্সিপ্যাল স্যার কাল রাতে কল করেছিল বিধায় আজ তাকে কলেজে আসতে হয়েছে। কলেজে গিয়েই প্রথমে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে দেখা করে মেহের। স্যার তার হাতে একগাদা খাতা ধরিয়ে দিয়ে বলে এগুলো আহসানের কাছে পৌঁছে দিতে। খাতাগুলো হাতে নিয়ে অবলার মত দাঁড়িয়ে থাকে মেহের। এই আহসান স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে অসস্তি বোধ করে সে। স্যার যখন ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে তখন বেশ বিব্রত বোধ করে মেহের। স্যারকে কিছু বলতে চেয়েও বলে উঠতে পারেনা সে। বেশ অস্বস্তি হয় তার। প্রিন্সিপাল স্যার কে উদ্দেশ্য করে মেহের জড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠে,

– আ- আমাকে এগুলো নিয়ে যেতে হবে স্যার।

– এনি প্রবলেম??

মেহের স্যারের দিকে মুখ বাকা করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মিহি কন্ঠে বলে,

– জ্বি জ্বি-না স্যার।

মেহের যখন আহসানের কেবিনে আসে তখন আহসান ভিডিও গেম খেলছিল। মেহের ধীরপায়ে এগিয়ে আহসানের পাশে দাঁড়ায়। হাসানের মনোযোগ দৃষ্টি মস্তিষ্ক সব একসাথে কাজ করছে ভিডিও গেমএর উপর তাই সে মেহের উপস্থিতি টের পেল না। মেহের আড়চোখে হাসানের দিকে তাকায়। আহসান যখন কিবোর্ডের বাটন চাপে তখন তার হাতের সাথে মুখের বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করে। তার নাক চোখ ঠোট একেক সময় একেক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেয়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহের। এই ভিডিও গেমের ভিতরে কি আছে যে মানুষ যখন গেম খেলে তখন দিন দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যায়, ভেবে পায়না মেহের। খাতাগুলো টেবিলের উপর রাখে সে। চলে আসার জন্য কয়েক পা বাড়াতে গিয়ে পিছন থেকে আহসান তাকে ডাক দেয়।

৫২,
কেটে গেছে সপ্তাহ খানেক। সৈয়দ নওশাদ আহমেদ এখন নার্সিংহোমে থাকে সর্বক্ষণ। নার্সিংহোমে এখন তার বাড়ি। তাকে তিন মাস নার্সিংহোমে রেখে ফিজিওথেরাপি দেওয়া হবে সুস্থ করার জন্য। আফিয়া আহমেদ দু-বেলা নার্সিংহোমে যাওয়া-আসা করেন। রাহি এখন বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে কাটায়। কলেজ টিউশান তারপর বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আর কোন কোন দিন রাতের বেলায় বন্ধুদের বাড়িতে থেকে যায়। বাড়িতে আসলে দমবন্ধ লাগে তার। মনে হয় কেউ পিছন থেকে তার গলা চেপে ধরেছে। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কলেজ শেষে রাহি চলে যায় পুলিশ স্টেশনে, পুলিশ স্টেশনের ভেতরে প্রবেশ করতেই তার দেখা হয়ে যায় সেদিনের সেই যুবকের সাথে।যাকে সে হিমুর ছোট ভাই বলে সম্বোধন করেছে। যুবকটিকে দেখে রাহি তার ভ্রুদ্বয়ে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে কারণ তার পরনে আজও রয়েছে হলুদ টি শার্ট । যদিও আজ সে প্যান্টের পরিবর্তে ট্রাউজার করেছে। রাহি তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। যুবকটাকে উপেক্ষা করে চলে যায় পুলিশ স্টেশন এর ভিতরে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪২]

পুলিশ স্টেশন থেকে বের হয়ে রিক্সার জন্যে রাস্তার মাঝখানো দাঁড়ায় রাহি। গ্রীষ্মের তীব্র রোদ এসে পড়ছে রাহির মুখপানে। বাম হাতটা কপালের উপর রেখে উত্তাপটা কমানোর চেষ্টা করছে সে। পরন্তু দুপুর। রাস্তায় খুব একটা যানবাহনের চলাচল নেই। রিক্সার জন্যে এদিক ওদিক উকি ঝুঁকি দিচ্ছে রাহি। আর তখনি কেবলা মার্কা হাসি দিয়ে রাহির সামনে এসে দাঁড়ায় সেই যুবকটা। যাকে যাকে দেখামাত্রই ভ্রুদ্বয় কুঁচকে দু-পা পিছনে চলে যায় রাহি। যুবকটা তার বত্রিশ পাটি বের করে বলে উঠে,

– আপনি কিন্তু এখনো ধন্যবাদ দেননি।

রাহির চোখমুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে। কপাল কুঁচকে বলে উঠে,

– আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?

রাহির করা প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বত্রিশ পাটি বের কর হেসে নিজের উপস্থিতি বুঝায় যুবকটা। ফেসটাতে সিরিয়াস ভাব এনে বলে,

– পুলিশ স্টেশনে কি করতে এসেছিলন আপনি?

– সবাই যা করতে আসে আমিও তাই করতে এসেছি। আড়ষ্ট কন্ঠে কথাটা বলে সমানের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যায় রাহি। সামনেই একটা রিক্সা এসে দাঁড়িয়েছে। রাহি গিয়ে রিক্সায় উঠে বসে একবারও পিছনে ফিরে তাকায় না সে। পিছন থেকে যুবকটা চেঁচিয়ে বলে,

– পুলিশ স্টেশনে তো ক্রিমিনালরা আসে। আপনি কোন ধরনের ক্রাইম করেছেন! চুরি নাকি মার্ডার! যুবকটার কথা শেষ করার আগেই রিক্সা ছুটে চলে যায়। যাওয়ার আগে রাহি যুবকটার পানে একপলক তাকিয়ে মৃদু হাসে। কেন হাসে সেটাও জানে না সে। যুবকটার ড্রেসকোট দেখে নাকি তার করা বেহায়াপনা দেখে! শুধু জানে যুবকটাকে দেখে তার হাসতে ইচ্ছে করছে। রাহির হাসি দেখে যুবকটা তার ডানহাতটা বুকের বা পাশে রাখে। বিড়বিড় করে বলে উঠে,

– চুরি তো করেছেন আপনি মিছ ধানি লংকা তবে সেটা এই অবুজের মন।

_____________________
দেখতে দেখতে কেটে যায় তিন মাস। সৈয়দ নওশাদকে এখন তার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। সে তার হাতটা একটু আকটু নাড়াতে পারলেও পা একদমই নাড়াতে পারে না। ডক্টররা তারকে ফিজিওথেরাপি দেওয়া অফ করে দিয়েছে কারন তার আগের অবস্থায় ফেরার কোন সম্ভবনা নেই। শুধু শুধু থেরাফি দিয়ে শরীরের সতেজ কোষগুলো নষ্ট করতে চান না। সৈয়দ নওশাদ আহমেদ এখন হোইল চেয়ারের বসে থাকে সর্বক্ষণ। তাকে কেউ খাইলে দিলে খেতে পায় নতুবা না। তবে তার সেবার জন্যে সর্বক্ষণ নিয়োজিত আছে দুইজন নার্স। আলিহান সৈয়দ আহমেদ ইন্ডাস্ট্রিয়ালের দায়িত্ব নিয়েছে যদিও সে এই দায়িত্বটা নিতে চাইনি। মৌ আর মেহেরের জোড়াজুরি সৈয়দা মাহবুবার উপদেশ মেনেই সে এই কোম্পানির দায়িত্ব নিয়েছে। এই কোম্পানির মালিক শুধু সৈয়দ নওশাদ আহমেদই নয় আলিহানও এর অর্ধেক মালিকানা আছে। সৈয়দ নওশাদ আহমেদ এখন কোম্পানির কোন দায়িত্বই পালন করতে পারবে না তাই পুরো কোম্পানির দায়িত্ব আলিহান নিজের কাঁধে নিয়েছে। আফিয়া আহমেদ এতে বাধা হয়ে দাঁড়ালে রাহনাফের কথায় সে দমে যায়। কোম্পানির দায়িত্ব নেওয়ার পর আলিহানকে তাদের আহমেদ ভিলায় থাকতে বলা হয়েছিলো, আলিহান সেটা প্রত্যক্ষাণ করে মেহেরদের সেই বেরঙ চিলেকোঠায় থাকছে। রাহনাফ ব্যাস্ত এখন তার [WAB] তৈরীর কাজে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে এসে দাড়ায় মেহেরের বারান্দার সামনে। দূর থেকে এক পলক দেখে সে আবার চলে যায়। অবশ্য এই নিয়ে মেহেরের মনে অনেক অভিমান জমে আছে। তবে চোখের তৃষ্ণা মেটাতে মাঝতে সে রাহনাফের পাগলামি সেটা মেহেরের অভিমান ভাঙর জন্যে যতেষ্ঠ। দূর থেকে এক পলক দেখে দুইজনেই চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নেয়। মনটাকে শীতল করে নেয়। রাহির এখন সেই হিমু রুপি যুবকটার সাথে অনেক ভাব জমেছে। এতদিন রাহির সব কাজে সে তার পাশে থেকেছে। রাহির মন খারাপের সময় তার মন ভালো করে দিয়েছে। বেশ ভালো সম্পর্ক হয়েছে তাদের মাঝে।

যুবকটির এবার এক অসুখ হলো। ভীষন মন খারাপের অসুখ। সে রাতবিরেত শুধু রাহিকে নিয়ে ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে এক সময় তার মনে হলো, হৃদয় নামক প্রণয়ের সমূদ্রের সমূদয় জল আকস্মাৎ শুকিয়ে গেছে। চারিদকে শুন্য মরুভূমি। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে গেল সে। মনে হচ্ছে তার জ্বর আসছে। শরীর কাপিয়ে মন খারাপের জ্বর। বিছানায় শুয়ে নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করলো সে। অজ্ঞাতসারে কল দিয়ে বসলো রাহির নাম্বারে। তাকে কল দিয়েই নিভু নিভু কন্ঠে বলল,

– আমি আজ ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত। মিটিয়ে দিন আমার তৃষ্ণা। আপনার কন্ঠ শুনিয়ে আমাকে একটু শান্তুি দিলে হয় না। একটা লম্বা সুখের দীর্ঘশ্বাসের অনেক প্রয়োজন আমার ।

রাহির সেই সময়ের অস্তিত্ব হীম করা শ্বাস প্রশ্বাসের ধ্বনি আজও যুবকটার মস্তিষ্কে অনুসরণ করে। অথচ আজ বারো দিন তাদের কোন কথা হয়না।যুবকটির মনে পরে তাকে।তার মখমলি চুল স্পর্শ করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে তার অন্তরিন্দ্রিয়। পুনশ্চ মনে করিয়ে দেয় সেই সমিকরন, ভালোবাসা এক নিঃসঙ্গতার নাম। ভালবাসলে সে নিঃস্ব হবেই।

আজকের দিনটা অন্যদিনের থেকে আলাদা। রাতে বৃষ্টির পর সকালে সূর্য মিষ্টি আলো দিচ্ছে। বাতাশে বৃষ্টির গন্ধ। সকালের রোদের নমনীয়তা আর মৃদু মন্দ হওয়ায় মন ভালো হওয়ার কথা থাকলেও রাহির মন ভালো হয়নি। জানালার রেলিং এর উপর হাত রেখে দাড়িয়ে রোদ্রউজ্জল সকাল দেখছে। রাতের আকাশের মেঘ কাটিয়ে সকালে সূর্যিমামা উকি দিয়েছে ঠিক যেন #মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। এত সুন্দর। সকালে মন খারাপ রাহির। রেদওয়ানের কথা তার বড্ড মনে পরছে। যদিও তার ড্রেসকোটে রাহি তাকে হিমু বলেই সম্বোধন করে। আর তেরোদিন হতে চলল রেদওয়ানের সাথে কোন যোগাযোগ হয়না রাহির। অবশ্য তার সাথে যোগাযোগের সব রাস্তাই রাহি নিজে বন্ধ করে দিয়েছে। রাহনাফকে ভালোবেসে সে হেরেছে তাই আর নতুন করে কাউকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে চায়না রাহি। রাহনাফ মানুষটা হুট করেই তার জিবনে এসেছিল তেমনি হুট করেই সে হাড়িয়ে গেছে। লম্বা একটা শ্বাস নিলো রাহি। তখনি নিচ থেকে তার মায়ের চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে বসে। দেয়ালে সাঁটানো কেলেন্ডারের দিকে তাকিয়ে আজকের তারিখটা দেখে স্মিত হাসে রাহি। চোখের কোটরে তার অশ্রুর ভীড়। অনামিকা আঙ্গুলের সাহায্যে চোখের কোটর থেকে পানি মুছে নিয়ে ধীর পায়ে রুমের বাহিরে চলে আসে।।

ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখতে পায় সেখানে পুলিশের আনাগোনা। তাদের সাথে রেদওয়ানও আছেন। রাহির প্রথমে চোখ আটকে যায় রেদওয়ানের উপর। ছেলেটার চোখের নিচে কালো দাগ বসে গেছে। মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো। রাহি তার দৃষ্টি নামিয়ে আফিয়া আহমেদের দিকে তাকায়। সুপায় বসে নিষ্পলক আফিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। রাহি তার বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইন্সপেক্টর রায়হানের সামনে গিয়ে বলে উঠে,

– সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো ইন্সপেক্টর সাহেব।

ইন্সপেক্টর রাহির হাতে একটা ফাইল তুলে দেয়। রাহি ফাইলটা হাতে নিয়ে সবগুলা ডকুমেন্ট ভালো করে পরখ করে নেয়।অতঃপর সে ইন্সপেক্টরের হাতে ফাইলটা দিয়ে বলে,

– আপনারা উনাকে নিয়ে যেতে পারেন।

নিচের দিকে তাকিয়ে অধোর কামড়ায় রাহি। বুক ফেটে কাননা আসছে তার। কোন রকমে নিজের কান্নাটা আটকে রাখে সে। তারপর সৈয়দ নওশাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। একজন মহিলা পুলিশ আফিয়া আহমেদের সামনে দাঁড়িয়ে হাতকড়া উপরে তুলে বলে, তাকে এরেস্ট করার জন্যে। উপস্থিত সকলে হচকচিয়ে যায়। সবচেয়ে বেশী অবাক হয় সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। কিন্তু সে মুখে কিছু বলে উঠতে পারে না। আফিয়া আহমেদ রাহির দিকে তাকায়। রাহির ছিলো তখন অসহায় দৃষ্টি। নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। আফিয়া আহমেদের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার। আফিয়া আহমেদ রাহির সামনে দাঁড়িয়ে রাহির মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,

– উনারা এসব কি বলছে রাহি! আর আমাকে এরেস্ট কেন করতে চাইছে!

আফিয়া আহমেদের কথায় স্মিত হাসে রাহি। অধোর কামড়িয়ে উপরের দিকে তাকায়। কিছু সময়ের জন্যে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে নেয় অতঃপর বলে,

– তোমাকে কেন এরেস্ট করতে চাইছে তাইনা মা! মৃদু হাসে রাহি। আমায় হাসালে মা। তুমি সত্যিই জানো না তোমাকে কেন এরেস্ট করতে চাইছে। সত্যিটা তুমি যতই লুকানোর চেষ্টা করো না কেন? একদিন না একদিন সেটা প্রকাশ হবেই। মা তুমি খুনি। একটা মানুষের প্রান নিয়েছো তুমি। তোমার অপরাধের শাস্তি তো তোমাকে ভোগ করতেই হবে।

রাহির কথা শুনে চমকে উঠে সৈয়দ নওশাদ সহ তার মা। অবাক চোখে তারা একবার আফিয়া আহমেদের দিকে তাকায় তো আরেকবার রাহির দিকে তাকায়। আফিয়ার আহমেদের যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। দু-পা পিছিয়ে পরে যেতে নিলে রাহি তাকে আকরে ধরে। আফিয়া আহমেদ রাহির দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলল,

– এসব তুই কি বলছিস রাহি!

– কেন মা তুমি সব ভুলে গিয়েছ? নাকি ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছো কোনটা! আচ্ছা বেশ আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, আরওয়ান শিকদারের কথা মনে আছে তোমার মা।

রাহির কথা শুনে আফিয়া আহমেদের চোখ কপালে উঠে যায়। রাহিকে ধাক্কাদিয়ে সড়িয়ে সুফায় বসে পরেন তিনি। নিচের দিকে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস ত্যাগ করতে থাকেন। চোখের সামনে ভেসে উঠে আরওয়ান শিকদারের সেই রক্তাক্ত মুখ।

চলবে,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here