মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৪৩,৪৪

0
515

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৪৩,৪৪
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
৪৩

আরওয়ান শিকদারকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয় আফিয়া আহমেদকে। পুলিশ যখন আফিয়া আহমেদকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন সৈয়দ নওশাদ আহমেদ নিঃপলক তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। এতদিন যাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে, চোখ বন্ধ করে যাকে ভরসা করেছে, যাকে ভালোবেসে নিজের বিবাহিত স্ত্রী ওর অনাগত সন্তানের কথা না ভেবে তাকে ঘরে তুলেছে। নিজের স্ত্রীর সম্মান দিয়ে ঘরে তুলেছে। শুধু মাত্র আফিয়ার কথা ভেবে নিজের সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানের কথা একবারও মাথায় আনে নি, সে একজন খুনি। আফিয়া আহমেদ একজন খুনি ভাবতেই সৈয়দ নওশাদের বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠছে। ডক্টর বলেছে সৈয়দ নওশাদ যেন কোন কিছু নিয়ে চেনশন না করে তাহলে তার ব্রেন স্টোক করার সম্ভবনা আছে। আর এতে তিনি মারাও যেতে পারেন। এমতাবস্থায় সৈয়দ নওশাদের টেনশন না করার কোন উপায় আছে বলে আমার মনে হয়না। তিনি যতবার আফিয়া আহমেদ কথা ভাবছেন ততবারই তার চোখের সামনে সৈয়দা মাহবুবার অশ্রুসিক্ত নয়ন ভেসে উঠছে। অস্থির হয়ে উঠছেন সৈয়দ নওশাদ।

ড্রয়িংরুমের এক কোনে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে রাহি। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। আফিয়া আহমেদ যতই অপরাধ করুক না কেন! দিন শেষে সে রাহির মা। অধোর কামড়ে হাত দুটি শক্ত মুঠি করে নেয় রাহি। মনে পড়ে আফিয়ার আহমেদের স্নেহের কথা। এক মাত্র মেয়ে বলে তাকে কতটা স্নেহ করেছে, আদর ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছিলো তাকে। আর আজ সেই মা-কে রাহি নিজে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। রাহির থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে রেদওয়ান। মূলত রেদওয়ান আফিয়া আহমেদের সব কৃর্তির কথা জানে। রাহি তার সাহায্য নিয়েই এসব করেছে। রেদওয়ান গিয়ে রাহির পাশে দাঁড়িয়ে ওর মুখপানে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রাহির দৃষ্টি এখনো মেই। ডোরের দিকে। যেখানে সে শেষবার আফিয়া আহমেদকে দেখেছিল। রেদওয়ান অধোর কামড়িয়ে দু হাতের তালু ঘষে নেয়। অতঃপর বলে,

– আমি আসছি রাহি। নিজের খেয়াল রেখ।

রাহি তার দৃষ্টি নামিয়ে সেটা রেদওয়ানের দিকে নিক্ষেপ
করে। অশ্রুসিক্ত নয়নে সে রেদওয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মুখে কিছু না বললেও মন বলছে ুত তাড়া কিসের! থেকে যাওনা আর কিছুক্ষণ। রাহির এমন চাহনি দেখে রেদওয়ানের ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্চে। সে কোন রকমে নিজেকে সামলিয়ে সেখান থেকে চলে আসার জন্যে পা বাড়ালে রাহির দাদি এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– এখন কোথায় যাচ্ছো তুমি। এখন তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না। রাহিকে নিয়ে গল্প করো ওর মনটা ভালো নেই।

দাদির কথা শুনে রেদওয়ান কপালে দুটো মাত্র ভাজ ফেলে রাহির দিকে তাকায়। রাহি এখনো সে আগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেদওয়ানের দিকে। রেদওয়ান রাহির মুখের দিকে মৃদু সূরে বলে উঠে,

– আমি তো চাই সবসময় রাহির পাশে থাকে কিন্তু সে পথটা যে রাহি বন্ধ করে দিয়েছে। দাদি তুমি একটু ওকে বুঝাও না। কেন সে চলে যাচ্ছে?

রেদওয়ানের কথা শুনে রাহি একটু অবাক হয়। তার চোখ মুখে বিস্ময়ের ছাপ।

-চলে যাচ্ছে মানে! কোথায় চলে যাচ্ছে রাহি?

দাদির করা প্রশ্নে হালকা টনক নরে রাহির। সে দাদির দিকে তাকিয়ে তাকে কিছুক্ষণ তার দৌড়ে সোজা উপরে চলে যায়। রেদওয়ান নিঃপলক তাকিয়ে তাকে রাহির চলে যাওয়ার দিকে। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে রাহি কাঁদছে। চক্ষুদ্বয় কিছু সময়ের জন্যে বন্ধ করে নিল রেদওয়ান। না রাহির এই চাপা কস্ট সে আর নিতে পারছে না। যে করেই হোক রাহির মান ভাঙাতে হবে। তাকে এক সুন্দর হাসি খুশি প্রাণবন্ত জিবন উপরহার দিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাহি কি মেনে নিবে রেদওয়ানের কথা।

দাদির করা প্রশ্নে রেদওয়ানের ভাবনার ছেদ ঘটে,

– কোথায় যাচ্ছে রাহি?

রেদওয়ান নিভু নিভু কন্ঠে বলে,

– নেক্সট ওইকে রাহি সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছে। অভিমানে সে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্চে।

তারপর রেদওয়ান চলে যায় রাহির পিছু। রাহির দাদি সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। তার কানে প্রতিধ্বনির ন্যায় এখনো রেদওয়ানের বলা কথাটা বেজে যাচ্চে।

৫৩,
এলমাদের বাড়ি যেতে যে মুদির দোকানটা সামনে পরে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবা। তার পাশের কয়েকজন মাধ্যবয়স্ক লোক বসে বসে তাস খেলছে আর একে অপরের সাথে কথা বলছে। তারা তাস খেলার পাশাপাশি রাজ্যের যত খবর আছে সেটা নিয়ে আলোচনা করে। সৈয়দা মাহবুবা দোকানটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন তখনি তিনি তাদের মধ্যে একজনের মুখে শুনতে পান, আফিয়া আহমেদের গ্রেফতার হওয়ার কথা। কথাটা শুনে সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে যান সৈয়দা মাহবুবা। তিনি একবার ভাবলেন, তাদের জিগ্যেস করবে, কেন আফিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ! পরক্ষণে মনে পরে, যা হওয়ার হোক তাতে তার কি আসে যায়। তাছাড়া তার সাথে তো সৈয়দ পরিবারের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। সৈয়দা মাহবুবা নিজে সৈয়দ নওশাদ তার এই মিথ্যে সম্পর্কের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে। তাকে তার সুন্দরী বউ আর তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে বিলিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এটাই চেয়েছিল সৈয়দ নওশাদ। লোকগুলোকে পাশ কাটিয়ে দোকানে গিয়ে কিছু পিঁয়াজু কিনে নেয় রাহির জন্যে। তারপর সে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, সুন্দরী রুপরবী গুণবতী সে কেন আজ পুলিশ হেফাজতে।

বাড়িতে এসে মেহেরকে আফিয়ার গ্রেফতার হওয়ার কথা বলেন সৈয়দা মাহবুবা। আফিয়ার গ্রেফতার হওয়াতে মেহের একটু কষ্ট পায় তার কারন রাহি। কিছুূদিন আগে তার বাবা অসুস্থ হয়েছিলো আর এখন মা পুলিশ হেফাজতে। যে মেয়েটা ছোট থেকে সবার আদরে আদরে বড় হয়েছে সে এই কষ্ট কি করে সহ্য করবে কি করে। রাহি তো এখন ওদের বাসায় ও আসে না। রাহির জন্যে খুব খারাপ লাগছে মেহেরের। তাছাড়া আফিয়া আহমেদ কেন গ্রেফতার হলো সেটাও জানতে ইচ্ছে করছে মেহেরের। তাকে দেখে তো ভালোই মনে হয় তাহলে গ্রেফতার হওয়ার কারনটা কি? মেহের কল করে আলিহানকে। আলিহান কিছু জানালেও জানতে পারে। আলিহান আর রাহির তো গলায় গলায় ভাব। আলিহানের কথা মতে সে এই ব্যাপার কিছুই জানে না। মন খারাপ হয়ে যায় মেহেরের। বড্ড ইচ্ছে করছে রাহিকে বুকে টেনে নিতে। তাকে আপন করে নিয়ে বড় বোনের ভালোবাসায় আগলে রাখতে। বড় বোনরা নাকি মায়ের মতো হয়। মেহেরেরও ইচ্ছে করছে রাহিকে তার কাছে এনে রাখতে।

সেদিন বিকালে আলিহান বাসায় ফিরার আগে আগে আহমেদ ভিলায় যায়। সৈয়দ নওশাদের সাথে কিছুক্ষণ বিজনেস সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। তবে আফিয়ার কথা জিগ্যেস করে না। আফিয়ার গ্রেফতার হওয়া নিয়ে এমনিতেই আর মানুষিক অবস্থা খারাপ তাই আলিহানও চায়নি তাকে আরো পেশার দিতে। তাই সে রাহির সাথে কথা বলার জন্যে রাহির রুমে যায়। আলিহান যখন রাহির রুমে যায় তখন রাহি তার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। আলিহান রাহিকে রুমে না পেয়ে সোজা তার বেলকনিতে চলে যায়। মন খারাপের বেশীর ভাগ সময় সে বেলকনিতেই কাটায়। ছোট বেলায় রাহি বেলকনিতে বরফ দিয়ে খেলা করতো এটা নিয়ে প্রায়ই আলিহান আর রাহির মাঝে ঝগড়া হতো। আলিহান গিয়ে রাহির পাশে দাঁড়াতেই রাহি আলিহানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। আলিহান ও তার ছোট্ট বোনটাকে দু-হাতে আগলে নিয়ে মাথাা হাত বুলাতে থাকে। সেদিন রাতে রাহির বায়না মেটাতে আলিহান তাকে তার বাসায় নিয়ে যায়।

রাত প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই, গভীর নিদ্রায় শায়িত মেহের। স্বপ্নযোগে মনে হলো কেউ তাকে গভীর ভাবে নিরক্ষণ করছে। কারো উত্তাপ শ্বাস পড়ছে মেহেরের মুখের উপর। গভীর নিদ্রায় আছন্না থাকায় চোখ মেলে তাকানো হলো না তার। কিছুক্ষণ পর মনে হল সে হাওয়াতে ভাসছে। এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায় তার মনে জুড়ে। জোড় কদমে আখি খোলে সে। চোখের সামনে ভেসে উঠে অস্পষ্ট এক এক ছায়ামূর্তি। যার ছায়াটাও তার চেনা। বড্ড চেনা। অস্পষ্ট ভাবে কিছু বলতে চাইলে ছায়ামূর্তি তাকে থামিয়ে দেয়। মেহেরও মাথা নাড়িয়ে ভদ্র মেয়ের মতো চুপ হয়ে যায়। তারপর ছায়ামূর্তি তাকে নিয়ে চলে যায় ছাদে।

ছাদে রং বেরঙ্গের লাইটিং দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় মেহের। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে চারিদকে থাকা লাইটিং দেখছে সে। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে বুকের উপর হাত গুজে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহনাফ। অধোরে তার মুগ্ধকর হাসি। মেহের রাহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,

– এসব কে করেছে ;আপনি! অধোরে তার স্মিত হাসি।

মাথা চুলকিয়ে স্মিত হাসে রাহনাফ। মেহেরের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

– চোখ বন্ধ করো লেখিকা সাহেবা?

মেহের প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকায় রাহনাফের দিকে। রাহনাফের স্থির দৃষ্টি মেহেরের মুখ পানে। মেহের রাহনাফের দৃষ্টির দেখেই তার চোখদুটো আবেশে বন্ধ করে নেয়। তারপর রাহনাফ দু-হাতে আলতো করে মেহের চোখ ধরে ওকে নিয়ে যায় ছাদের অন্যপান্তে। সেখানে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে মেহেরের চোখ খুলে দেয়। চোখ মেলে সামনে তাকাতেই দেখতে পায়, দূর ওই আকাশে একটা বাজি ফুটে আর তাতে স্পষ্ট লেখা,

– হ্যাপি বার্থডে লেখিকা সাহেবা।

চলবে,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪৪]

বিস্ময় দৃষ্টিতে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে মেহের। এর আগে কেউ কোনদিন মেহেরকে এভাবে সারপ্রাইজ দেয়নি। আনন্দে মেহেরের চোখে অশ্রু নেমে আসে। ডান হাতে চোখের কোন থেকে পানি মুছে অধোরে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,

– বিশ্বাস করেন রাহনাফ, আজ আমি এতটাই খুশি হয়েছি যে এর আগে কোন দিনও এত খুশি হয়নি। সত্যি বলছি, সারপ্রাইজটা দারুন ছিলো। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ। জিহ্বাহ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে রাহনাফকে জড়িয়ে ধরে মেহের।

রাহনাফ মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কিছুক্ষণ তারপর ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। বুকের উপর হাত গুজে গিয়ে মেহেরের দিকে তাকিয়ে অধোর চেপে হাসে অতঃপর বলে,

– শুধু থ্যাংক্স দিলে হবে না লেখিকা সাহেবা। আমার তো অন্য কিছু চাই।

রাহনাফের কথা শুনে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেলে মেহের। কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বলে,

– আপনার আবার কি চাই!

বুকের উপর থেকে হাত নামিয়ে ডান হাতটা গালে রেখে ভাবুক ভঙ্গিতে অবস্থান করে কিছুক্ষণ তারপর মেহেরকে কাছে টেনে নিয়ে ওর মুখের সামনে মুখ নেয়। রাহনাফ এতটা কাছে আসায় মেহেরের হার্ট দ্রুত বিট করতে থাকে। চোখ মুখ খিচে বন্ধকরে নিয়ে হাতে উড়না চেপে ধরে। মেহেরের এমন অবস্থা থেকে স্মিত হাসে রাহনাফ। অধোর কামড়ে বলে উঠে,

– আমি চাই তুমি আমাকে,,,

রাহনাফের কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই চট করে চোখ খুলে মেহের। আড়ষ্ট কন্ঠে বলে,

– আমি কি?

– তুমি আমাকে,,

– কি? বলুন কি বলতে চান? অধোর কাঁপছে মেহেরের। এই দৃশ্য দেখে রাহনাফের তৃষ্ণা পায়। পচন্ড রকমের তৃষ্ণা। তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় তাকিয়ে থাকে মেহেরের ঠোঁটের দিকে। নিচের ঠোঁটের নিচে অবস্থানরত তিলটা তাকে বড্ড আকর্ষন করছে। মন বলছে তাকে একটু ছুঁইয়ে দিতে। আর বিবেক বলছে, না রাহনাফ! এটা অন্যায়। নিজের বিবেকের কাছে হার মেনে নিজেকে কন্ট্রোল করার প্রচেষ্টায় চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকে রাহনাফ। মেহের ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে আছে রাহনাফের মুখ পানে। কিছুক্ষণ পর মেহের আড়ষ্ট কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

– কি হলো রাহনাফ আপনি কিছু বলছেন না কেন? কি বলতে চান বলুন?

চোখ মেলে সামনে তাকায় রাহনাফ। মেহেরের চোখের দিকে তার দৃষ্টি স্থাপন করে বলে,

– আপনি ভাবটা কাটিয়ে তুমিতে চলে আসনা লেখিকা সাহেবা। তুমি যখন আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করে তখন মনে হয় আমি তুমার অপরিচিত কেউ। আমি দূরের মানুষ, আমার সাথে কথা বলতে জড়তা বোধ করে তা তুমি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করো।

– কিন্তু,,

– কোন কিন্তু টিন্তু শুনতে চাচ্ছি না আমি লেখিকা সাহেবা। তুমি আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করবে ব্যাস। নাও স্টার্ট। বল।

– দেখুন রাহনাফ আপনি আমার বড়। আর আমি বড়দের সাথে আপনি আগ্গে করে কথা বলবো। অন্যদিক ঘুরে তাকায় মেহের। রাহনাফ বড় করে একটা শ্বাস ত্যগ করে কোমল কন্ঠে মেহেরকে ডাক দেয়,

– মেহু।

রাহনাফ এমন আফিম মেশানো ডাকটা যেন মেহেরের মনে একটা হীম শীতল শ্রোত ভয়ে যায়। অন্যরকম ভালোলাগা অনুভব করে সে। তুবও সে রাহনাফের দিকে না ফেলে ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। রাহনাফ মেহেরের কাঁধে হাত রেখে ওর নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়, মেহের নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে। তবে এই হাসিটা উয্য যেটা সবার চোখে পড়বে না। রাহনাফ মেহেরের চিবুক ধরে উপরের দিকে তাক করার। অতঃপর বলে,

– একটাবার আমার নাম ধরে ডাকো না লেখিকা সাহেবা।

মেহের ইনোসেন্ট মুখ করে রাহনাফের দিকে তাকালে রাহনাফ ওকে আবারো বলে। মেহের একরকম বাধ্যহয়েই বলতে থাকে,

– রা-রাহনাফ তু-তুমি আমাকে এভাবে জোর করতে পারো না।

-ব্যাস আর কিছু বলতে হবে না। রাহনাফ মেহেরের কপালে নিজের অধোর ছুঁইয়ে দিয়ে উষ্ণ ভালোবাসার স্পর্শ একে দেয়। তারপর ওকে নিয়ে দুজনে মিলে এক সাথে কেক কাটে। প্রথমে রাহনাফ মেহেরকে খাইয়ে দেয় পরে মেহেরে রাহনাফকে খাইয়ে দেওয়ার নাম করে ওর পুরে মুখে কেক মাখিয়ে দেয়। তারপর রাহনাফ ছুটতে থাকে মেহেরের পিছু।

পরেরদিন মেহের বেশ মনোযোগ দিয়েই ক্লাস করছিলো, ক্লাসে ছিল নতুন টিচার্স, আহসান। আহসান আজ আর ক্লাসে আসার পরপরই মেহেরের দিকে একপলক তাকিয়ে তার দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। তারপর আর সে মেহেরের দিকে তাকায় নি সে। যদিও মেহের আড় চোখে আহসানের দিকে তাকিয়েছিল আর ভাবছিলো এই নতুন টিচার্সটা এত তাড়াতাড়ি পাল্টি খেল কিভাবে। সামনে বই খুলে কলম কামড়িয়ে কাল রাতের কথা ভাবছে মেহের আর মিটমিট করে হাসছে। তখনি ক্লাসে একজন পিয়ন আসে আর সে এসেই বলে, “মেহের ক্লাসে আছে মেহের। মাঝখান থেকে দাঁড়িয়ে যায় মেহের। তখন সেই পিয়নটি বলে, ‘আপনার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে ‘। এখানে কে আসবে মেহেরের সাথে দেখা করতে কিছুক্ষণ ভাবে মেহের। রাহনাফ নাকি আলিহান! কে এসেছে? আহসানের থেকে পারমিশন নিয়ে বেড়িয়ে যায় মেহের। পিয়ন আগে চলে আর মেহের তাকে অনুসরণ করে পিছনে যেতে থাকে। সেখানে যাওয়ার পর মেহের যাকে দেখে তাকে দেখার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে। অর্ধবয়স্ক এক মহিলা বসে আছে। তার গায়ে সাদা কাপড় জড়ানো। চোখে চসমা আর মাথায় আধাপাকা চুল। মেহের তার পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে এখানে কি করছে, আর মেহেরকেই বা চিনে কি করে! বেশ কৌতুহল জাগে মেহেরের। কৌতুহল বশত সে ভুলেই গিয়েছে লোকটা তার অপরিচিত। মেহের বলে উঠে,

– আন্টি আপনি এখানে? কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দেয় মেহের।

অর্ধবয়স্ক মহিলাটা উঠে দাঁড়ায়। চসমাটা একটু নাড়িচে বলে, তুমি মেহর, মেহেরুন্নেছা মেহের ঠিক বললাম তো।

– জ্বি। আমিই মেহের।

– বাহ, ভারি মিষ্টি দেখতে তুমি। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। আমার ছেলেটার পছন্দ আছে বলতে হবে।

এতক্ষণ মেহেরের মুখে একটা হাসি লেগে থাকলেও, এই অর্ধবয়স্ক মহিলাটির কথা শুনে মেহেরের মুখের হাসি উবে যায়। হ্যাঁ মেহের সুন্দর তাই বলে এত প্রশংসা করার কি আছে। শুধু গায়ে সাদা চামড়া দেখলে মনুষটা সুন্দর হবে! তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে হবে। এটা কেমন ধারনা। আসলে তো সেই মানুষটা সুন্দর যার মনটা সুন্দর। মুখ গোমড়া করে বলে,

– আপনার কথার মানে বুঝতে পারলাম না।

– আমি কি বলতে চাইছও সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো মেহের। প্রথম দেখাতেই তুমি যে ভাবে রিয়্যাক্ট করলে তার মানে তুমি আমাকে আগে থেকেই চিনো। রাহনাফ ছিনিয়েে! প্লিট মেহের বল, রাহনাফ কোথায়! আজ কটা বছর যাবৎ ওকে খুজে বেড়াচ্ছি আমি।

মেহের কি বলছে বুঝতে পারছে না। সে অর্ধবয়স্ক মহিলাটির আরে নিকটে চলে যায়। তারপর বলে,

– আপনি শান্ত হোন আন্টি আমি আপনাকে আপনার ছেলের কাছে পৌছে দিবো।

মেহেরের কথা শুনে সে চোখ তুলে মেহেরের দিলে তাকায়। তার চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝড়ছে। চোখের জলের যদি কোন রং থাকতো তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যেত এটা আনন্দের অশ্রু। এতদিন পর ছেলেটাকে কাছে ফিরে পাওয়ার আনন্দের অশ্রু। মেহের তার দিকে নিঃপলক তাকিয়ে মনে মনে বলতে থাকে,

– হ্যাঁ আন্টি আমি আপনার আপনার ছেলের কাছে পৌঁছে দিবো। আপনি যেমন ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল তেমনি আপনার ছেলেটাও যে তার মা-কে কাছে পাওয়ার জন্যে মরিয়া।

৫৪,
আজ কলেজে না গিয়ে সোজা রেদওয়ানের বাসায় চলে যায় রাহি। অবশ্যই রেদওয়ান জোর করেছিল বলেই সে গিয়েছে। রেদওয়ানের ছোট বোনটা রাহিকে দেখতে চেয়েছে তাই সে রেদওয়ানের বাসায় যায়। আজ রেদওয়ানকে দেখেই বিব্রত হয় রাহি। কারন আজ ওর গায়ে ছিলো বাজ্রিলের জার্সি যেটার রংও হলুদ। রাহির মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে এই হলুদের মাঝে আপনি পেয়েছেনটা কি? হলুদ রং ছাড়া কি আর কোন কালার নেই! তাহলে কেন শুধু হলুদ কালারের ড্রেস পরিধান করেন আপনি। রাহি রেদওয়ানদের বাসায় গেলে রেদওয়ানের মা ও বোন দুজনে মিলে রাহিকে অনেক আপ্যায়ন করে। রেদওয়ানের বোন ওকে ওদের পুরো বাড়ি ঘুরে দেখায়। ছয়তলা বাড়িয়ে ওরা থাকে পাচ তলাতে বাকি সবগুলা ভাড়া দেওয়া। উপরের তলার তাকে ব্যাচেলর। পুরো বাড়ি ঘুরে দেখার পর রাহি চলে বসে রেদওয়ার রুমে। রেদওয়ান তখন ওয়াশরুমে ছিলো। রাহি পুরো রুমটাতপ চোখ বুলায়। রেদওয়ানের রুম দেখে রাহির হার্ট এটাক করার মতো অবস্থা। সে মাথায় হাত রেখে বিছানায় বসে পরে। জানালার পর্দা থেকে শুরু করে বেডশিট সব হলুদ রংয়ের। কয়েক মিনিট পর রেদওয়ান ওয়াশরুম থেকে বের হয় শুধু মাত্র একটা টাওজার পরে। রাহি তখনও মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলো তাই রেদওয়ার উন্মুক্ত শরীর সে দেখতে পায়নি। রেদওয়ান তাড়াতাড়ি করে কাবার্ড থেকে একটা হলুদ রংয়ের টিশার্ট পরে নেয়। তারপর রাহির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে,

– মাথা যন্ত্রনা করছে? আমি টিপে দিবো। আমি কিন্তু অনেক ভালো মাথা মেসেজ করতে পারি।

রেদওয়ানের কথা শুনে মাথা তুলে সামনে তাকায় রাহি। রেদওয়ানের দিকে তাকাতেই তার মেজাজ যায় বিগড়ে। সে কাটকাট গলায় বলে,

– এই যে মিস্টার হলুদ পঙ্খী, আপনার কি হলুদ কালার ছারা অন্য কোন কালারের ড্রেস নাই।

রাহির ডাক শুনে ফ্যালফ্যাল নয়নে সে তাকায় রাহির দিকে। রাহি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে কাবার্ডের কাছে চলে যায়, অন্য কালারের ড্রেসের জন্যে। সে কাবার্ড খুলে সেখানেও হতাশ। কারন কাবার্ডের ভিতরের থাকা সবগুলা ড্রেসই হলুদ রংয়ের।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here