#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-৪৫,৪৬
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
৪৫
হলুদ পাঞ্জাবি পরে কেবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে রেদওয়ান। ওর সামনেই রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাহি। রাহির ইচ্ছে করছে সামনে থাকা ছেলেটার গলা চেপে ধরতে। দাত কটমট করে হাত উঁচু করেও পরে সেটা নামিয়ে নেয়। রেদওয়ান কেবলার মতো দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। রাহির এমন রেগে যাওয়ার কারন সে বুঝতে পারছে না। রাহি তো হলুদ টিশার্ট পরতে বারণ করেছে তাইতো সে টিশার্ট খুলে পাঞ্জাবি পরেছে তাহলে রাহি এখনো কেন রেগে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস টেনে একটু সাহস যোগিয়ে নিলো সে। দু কদম এগিয়ে রাহির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় রেদওয়ান অতঃপর বলে,
– আমি তো টিশার্ট খুলে ফেলেছি তাহলে আপনি রাগ কেন করছেন।
রেদওয়ানের করা প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে রাহি নাক ফুলিয়ে হাত উঁচু করে ওর গলা চেপে ধরতে নেয়। রেদওয়ান তখন একটু পিছনের দিকে ঝুকে যায়। রাহি, রাগ করে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে রেদওয়ান বলে উঠে,
– আপনি থেকে যান না। নিজের মতো করে সবটা সাজিয়ে নিন।
থমকে দাঁড়ায় রাহি। পিছনের দিকে ঘুরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেদওয়ানের দিকে। রাহি কিছু বলতে যাবে তখনি রেদওয়ানের লেপটপে একটা মেইল আসে। দুইজনেই লেপটপের দিকে তাকায়। রেদওয়ান লেপটপের কাছে গিয়ে মেইলটা ভিউ করে নেয়। তখন রাহি গিয়ে দাঁড়ায় রেদওয়ানের পাশে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মেইল এসেছে। কিছুূদিন আগে রেদওয়ান বিভিন্ন দেশের ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছে এডমিশনের জন্যে। দেশের বাইরের কোন ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স কম্প্লিট করতে চায় রেদওয়ান তাই সে এপ্লাই করে। মেইলটা দেখে সাথে সাথে ডিলিট করে দেয় রেদওয়ান। সে উঠে দাঁড়াতেই রাহি তাকে প্রশ্ন করে,
– আপনি মেইলটা ডিলিট কেন করলেন? এত বড় একটা ইউনিভার্সিটিতে চাঞ্চ পেয়েছেন আর সেটা হেলা করছেন।
রাহির চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে রেদওয়ান। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে বলে,
– জয়েনিং ডেট দেখেছেন তো?
– হ্যাঁ। সাতদিনের মধ্যে জয়েন করতে হবে।
– তাইতো ডিলিট করে দিলাম। আপনি তো আটদিন পর চলে যাবেন। আপনাকে দেখার জন্যে একটা দিনও আমি হাতছাড়া করতে চাইনা। এই আটটা দিন আমার নামে করে দিননা।
রেদওয়ানের এমন বেখেয়ালি কথা শুনে রাহি কি বলবে বুঝতে পারছে না। ছেলেটা এমন কেন? তার এমন খেয়ালিপনা আর ড্রেসকোট কোন কিছুই ভালো লাগে না রাহির। অথচ রাহনাফের সবকিছুই মনে ধরতো রাহির। আর রাহনাফ আর তারই বোনের সাথে প্রেম করেচে কিছুদিন পর তাদের বিয়ে। নিজেই নিজের কপালে হাত রাখে রাহি। ছিহ্, কিসব ভাবছে সে। রেদওয়ান দিকে কিছুক্ষণ শক্তচোখে তাকিয়ে থেকে সে প্রস্তান করে।
৫৫,
লেপটপে একটা প্রজেক্ট দেখছিলো রাহনাফ।(WAB) এর পাশেই একটা হসপিটাল তৈরী করতে চায় সে। Woman Association এর যে সকল নরীরা থাকবে তাদের সুচিকিৎসার জন্যে এই হসপিটাল নির্মাণ করতে চায় রাহনাফ। বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে লেপটপে হসপিটালের বিল্ডিং এর মডেলগুলোই দেখছে সে। তখনি তার বাসার কলিং বেল বেজে উঠে, লেপটপটা ওভাবে রেখেই উঠে যায় সে। ব্লাকহোলে তাকিয়ে আগন্তুক দেখে নেয় রাহনাফ। আগন্তুকদের দেখে থমকে যায় রাহনাফ। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দরজা খুলার কথা ভুলে গেছে সে। আবারও কলিং বেল বেজে উঠে। রাহনাফ কিছুক্ষণের জন্যে তার চোখ বন্ধকরে রেখে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে তারপর সে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে সামনে দাঁড়াতেই আগন্তুক এসে রাহনাফকে জড়িয়ে ধরে। রাহনাফ স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা তুলে সামনে দাঁড়াতেই তার দৃষ্টি সংযোগ হয় মেহেরের সাথে। মেহের চোখের ইশারায় রাহনাফ স্বাভাবিক হতে বলে। রাহনাফ আগের ন্যায় দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে আগন্তুকের মাথায় হাত রাখে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসে মেহের।
বিছানার উপর বসে আছে রাহনাফের মা। আর রাহনাফ তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। পাশেই বসে আছে মেহের। রাহনাফের মা রাহনাফের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
– এত অভিমান তোর? আমার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিস তুই। কোথায় কোথায় খুঁজেছি তোকে। কেউ হাড়িয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু যদি কেউ ইচ্ছেকৃত ভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখে তাহলে তাকে ফিরে পাওয়া মুশকিল। কেন নিজেকে আড়াল করে রেখেছিস বাবা। ভাগ্যিস, মেহের তোর সাথে ছিলো। আশ্রমের লোকদের কাছে কতকরে তোর ঠিকানা চেয়েছি, কেউ বলতে পারেনি।
রাহনাফ তার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কোন কথা বলছে না সে। আজ কতগুলো বছর পর সে তার মায়ের কোলে মাথা রেখেছে। পাশ থেকে মেহের বলে উঠে,
– আন্টি আপনি আমাকে চিনেন কি করে?
– তোমাকে কে না চিনে মেহের। মৃদু হাসে রাহনাফের মা। তোমার প্রতিভা আর যুক্তিগত কথার কাছে সমাজের প্রাচিন নিয়মও হার মেনেছে। সবাই তোমাকে এক নামে চিনে, মেহেরুন্নেছা মেহের। একজন একক মায়ের সন্তান। আশ্রমের বাচ্চাদের কাছেই জানতে পারি তোমার আর রাহনাফের রিলেশনের কথা।
মেহের আর রাহনাফের মা দুজনে কথা বলা বলছে আর এদিকে রাহনাফ তলিয়েছে গভীর ঘুমে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমালে নাকি প্রশান্তির ঘুম হয়। রাহনাফও সেই শান্তির ঘুৃম ঘুৃমাচ্ছে। মেহের কিংবা রাহনাফের মা কেউই রাহনাফকে ডাক দিলো না। রাহনাফের মা রাহনাফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
____________________
এরপর কেটে যায় কয়েকটা দিন। রাহনাফের মা এখন রোজ রাহনাফের বাসায় আসে তাকে দেখতে। সেদিন রাহনাফের মা রাহনাফকে বলে, তাদের সাথে থাকতে। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রাহনাফের খুব করে বলতে ইচ্ছে করে, তোমার অন্য সন্তানদের ভীড়ে আমাকে সময় দিতে পারবে তুমি মা। তোমার সময় হবে মা এই সন্তানের জন্যে। না মা তুমি পরবে না সেটা। তুমি এখন অন্য কারোর মা। যদের ছোট থেকে আদরে আদরে এত বড় করে তুলেছো তুমি। তাছাড়া তোমার অন্য ছেলেমেয়ে গুলো তোমার ভাগ দিবে আমায়। আমি তো পারবো না মা। আমার সামনে সবাই যখন তোমাকে মা বলে ডাকবে! তুমি তাদের আদর করবে এটা আমি কিছুতেই মানতে পারবো না। আমি যে মা কাঙ্গাল। মায়ের স্নেহ ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিতে চাই না। তারচেয়ে ভালো তুমি তাদের সাথেই থাকো। মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে একটু আদর করে দিও।
মেহেরের সামনে এক্সাম। পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত হয়েছে মেহের। রাহনাফ ও এখন তাকে আর বিরক্ত করে না। মেহেরের এক্সামের পরই ওদের বিয়ে হবে। আজ রাহির সিঙ্গাপুর যাওয়ার ফ্লাইট। এতদিন রেদওয়ান রাহির সাথে থাকলেও আজ আসে নি। এমনকি সে একবারের জন্যেও রাহিকে কল করেনি। রাহি বারংবার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে রেদওয়ান কল করছে কি না। ইচ্ছে করছে রাহির নিজেরই কল করতে।
নিজের ব্যাগ পত্র ঘুছিয়ে সৈয়দ নওশাদ আহমেদের কাছে যায় বিদায় নিতে। মেয়ের এমন অভিমানে চলে যাওয়ার কারনে সৈয়দ নওশাদ শুধু চোখের জলই ফেলছে।রাহির চলে যাওয়ার কারনে প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরক্ষ ভাবে যে সেও দায়ী। নিঃপলক রাহির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার জল চিকচিক করছে। ভাগ্য তাকে আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। নিজের ভালোবাসার মানুষগুলো তাকে ছেড়ে চলে যাচ্চে আর সে কিছুই বলতে পারছে না। দাদি রাহিকে আজও চলে যেতে বারণ করে। রাহি তার কথায় কান না দিয়ে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে রাহি। এই বুঝি রেদওয়ান আসবে। শেষ বারের মতো তাকে এক পলক দেখতে আসবে। এভাবে দেখতে দেখতে সে চলে যায় বিমানবন্দরে। সেখানে গিয়েও রাহি অপেক্ষা করে রেদওয়ানের জন্যে। কিন্তু রেদওয়ান আসে না।
৫৬,
মৌ-য়ের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় মেহেরের। সকাল সকাল মৌ-কে নিজের রুমে দেখে বেশ রাগ হয় মেহেরের। মেহের আধোশুয়া হয়ে বসে, ভ্রুদ্বয় কুঁচকে মৌ-য়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুই সকাল সকাল আমার রুমে কি করছিস? তোর কিছু প্রয়োজন হলে আমায় ডাকতে পারতিস।
– এইটুকু হাটাচলা তো আমাকে করতেই হবে মেহু। সারাক্ষণ প্রতিবন্ধির মতো রুমে বসে থাকতে ভালো লাগে নাকি। মুখ গোমড়া করে বলে মৌ।
– ভালো না লাগলেও আপনাকে থাকতে হবে বোইন। এখন বলেন সকাল সকাল আমার রুমে কি করছেন?
মৌ মেহেরের সামনে একটা খাম ধরে বলে,
– এই নে ধর, তোর নামে চিঠি আসছে।
মেহেরে খামটা হাতে নিয়ে সেটা এপিট ওপিট করে দেখতে থাকে। কারন এখনে কোন প্রেরকের নাম দেওয়া নেই। তাহলে প্রেরক কে! কে পাঠালো এই চিঠি।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৪৬]
আমার জিবনটা সিনেট্যিক্স হয়ে গেল না। না হলে কি আর আমি নিজেই নিজের মাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতাম। আপু, জানি এই নামে ডাকার অধিকারটা তুমি আমায় দাওনি। তাই বলে তো আমাদের সম্পর্ক মিথ্যে নয়। তুমি না মানলেও আমি তোমারই ছোট বোন। আপু, প্রথম যখন তোমাকে আমি রাহনাফের সাথে দেখেছিলাম সেদিন থেকেই তোমার প্রতি আমার ঈর্ষার সৃষ্টি হয়। কেন জানো! রাহনাফকে আমি ভালোবাসতাম। আজও হয়তো বা! যাই হোক, পরে যখন জানতে পারি রাহনাফ ও তোমাকে ভালোবাসে তখন আমি সুই*সাইড করতে গিয়েছিলাম কারন রাহনাফকে ছাড়া আমার পক্ষে বেচে থাকা অসম্ভব ছিলো। সেদিন তুমি আমায় রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে দাও। তুমি না চাইতেও আমার জিবন বাঁচিয়েছ। জানো আপু, সেদিন হসপিটালে আমি একটা সত্যি জানতে পারি। যে সত্যিটা আমার পুরো জিবনটাই বদলে দেয়। আলিহান ভাই আর রাহনাফ আমাকে দেখতে যায় আমার কেবিনে। তখন বাবা আর আলিহান ভাইয়ের মাঝে কথা হয় তোমাকে নিয়ে। আমি সেদিন জানতে পারি তোমার কথা। তুমি আমার বোন! তোমার আর আন্টির সম্পর্কে যেদিন জেনেছি সেদিন থেকেই বাবার প্রতি ঘৃনা জন্মেছে আমার। যে বাবাকে আমি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতাম তার মেন্টালিটি এত নিচু ভাবতেই বুক কেপে উঠতো। চলে যাই রাহনাফের থেকে দূরে। তোমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো নি। আচ্ছা অন্যায় তো করেছে আমার বাবা, এখানে আমার দোষটা কোথায়! তারপর রইলো আমার মায়ের কথা!! বাবার অতীত জানার পর ভেবেছিলাম আমার মা অনেক ভালো। আমার সেই ধারণাটাও বদলে যায় তোমার ফাইনাল ডিবেটের দিন। যেদিন রাস্তায় তুমি ছুড়িঘাত হয়েছিলে। তোমাকে মারার জন্যে শহরের এক নামকরা কিলারকে সুপারি দিয়েছিল আমার মা। হ্যাঁ তোমার ওই অবস্থার জন্যে দায়ী আমার মা। সেদিন সব জানার পর আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাই। কিন্তু আলিহান ভাই আমাকে থামিয়ে দেয়। বলে মা বাবা যতই খারাপ হোকনা কেন তাদেরকে কষ্ট দিও না। তুমি তাদের ভুলগুলো শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করো। আলিহান ভাইয়ের কথা মতো আমিও সেটাই করছিলাম, দাদিকে আশ্রম থেকে ফিরিয়ে আনি। বাবা মাকে সময় দেই। এর মাঝে বাবা আর মা দুজনে ঝগড়া করে, মা বাড়ি থেকে চলে যায়। বাবা সেদিন রাতে স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যায়। তার চিকিৎসা নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম আমি। সারাদিন রাত ছুটাছুটি করতাম হসপিটালে। এর মধ্যে একদিন সকালে রাহনাফ এসে হাজির হয় আমার মাকে নিয়ে। রাহনাফ আমার মাকে কোথায় পেল? আমি কোন প্রশ্ন করিনি। কারন সেদিন রাহনাফ চোখ দেখে আমি প্রশ্নগুলো করার সাহস পাইনি। পরে রাহনাফ আমার সাথে হসপিটালে আসে। মাকে হসপিটালে রেখে আমরা দুজনে একটা রেস্টুরেন্টের চলে যায়ই। আর সেখানে জানতে পারি আমার মায়ের পরিচয়। তার অতীত। জানো আপু, যে মা আমাকে তার গর্ভে ধারন করেছে সে একজন খুনি। ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃনা ধরেছে আমার। রাহনাফের বাবার খুনি আমার মা। যে রাহনাফ তার রাজত্ব আর বিলাসি জিবন ছেড়ে আশ্রমে বড় হয়েছে সেই রাহনাফের বাবার খুনি আমার মা। একদমই ভেঙে পড়েছিলাম আমি। তারপর আমার জিবনে আসে এক হলুদ প্রেমি। তাকে দেখলে তুমিও অবাক হবা আপু।সে হিমুকে ভালোবেসে হলুদকে ভালোবাসে। তার সবগুলা ড্রেসই হলুদ রংয়ের। সবসময়ই হলুদ পরে। এমনি সে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হলেও ব্রাজিলের জার্সি পরে। তাই আমি তার নাম দিয়েছি হলুদ পঙ্খি। মাঝে মাঝে তার কথা ভাবলে আমার হাসি পায়। ছেলেটা খুব অদ্ভুত।
আর ভিষন ভালো। জানো আপু ছেলেটা আমার প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি তাকে না করে দিয়েছি। আমি তো দেশ ছেড়ে চলেই যাচ্ছি তাহলে কেন শুধু তার প্রতি মায়া বাড়াবো বলতে পারো। যদি কোনদিন তার সাথে তোমার দেখা হয় তাহলে তাকে বলে দিও, রাহিও তাকে মিছ করবে। তোমার হাতে যখন এই চিঠি পৌঁছাবে তখন আমি হয়তো তোমার থেকে অনেক দূরে থাকবো আপু। তবুও বলবো আমি তোমায় অনেক মিছ করবো। আর যদি পারো বাবাকে একবার দেখে এসো। এতে বাবারও ভালো লাগবে। বাবার তো তার করা ভুলের শাস্তি পাচ্ছে তাকে আর শাস্তি দিওনা আপু।
তুমি অনেক লাকি আপু, আন্টির মতো একজন মা পেয়ে। যাকে নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাচতে পারবে তুমি। যারা শুধু বাহ্যিক সুন্দরর্য দেখে মানুষকে বিচার করে, তাদের বলতে ইচ্ছে করছে, তাদের মতো বোকা প্রানি এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। মানুষের বাহিরের সুন্দরর্য না দেখে তার মনটা দেখুন কেমন। তাহলেই প্রকৃত মানুষ চিনতে পারবে। অবশেষ তোমায় একটা কথা বলি আপু, তুমি না চাইলেও আমি তোমায় আপু ডাকবো। দয়া করে আমার থেকে এই অধিকার কেড়ে নিও না। আর যদি পারো আমার মা-কে ক্ষমা করে দিও। ইতি, তোমার অনাকাঙ্ক্ষিত বোন।
মেহেরের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো চিঠির উপর। মেহের চিঠিটা পাশে রেখে উঠে দাঁড়ায়। মৌ অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। তারও খুব খারাপ রাহির জন্যে। রাহি এতটা কষ্ট পেয়েছে। সত্যিই তো যা কিছু হয়েছে এতে রাহির দোষটা কোথায়? কেন রাহিকে এতটা কষ্ট পেতে হলো। কেন ওকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হলো। মেহের উড়না দিয়ে মাথা ডেকে হাতে পার্স নিয়ে বেড়িয়ে যেতে নিলে, পিছন থেকে মৌ বলে উঠে,
– কোথায় যাচ্ছিস মেহু?
– রাহনাফের বাসায়।
– এই অসময়ে!
– হ্যাঁ। মা আমাকে খুজ করলে বল আমি একটা কাজে বেড়িয়েছি।
চলে যেতে নেয় মেহের। তখন মেহেরের সামনে এসে দাঁড়ায় আলিহান। ঘুম থেকে মৌকে কাছে না পেয়ে মেহেরের রুমে চলে আসে সে। মেহেরের তাড়াহুড়ো করে কোথায় যেতে দেখে আলিহান কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে প্রশ্ন করে,
– সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস!
– মৌ-য়ের থেকে জেনে নিও আমার লেট হচ্ছে। বলেই আলিহানকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় মেহের। আলিহান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহেরের চলে যাওয়ার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে দৃষ্টির আগোচরে চলে যায় মেহের। আলিহান তখন তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৌ-য়ের দিকে। মৌ-য়ের চোখে চিকচিক পানি দেখে আলিহান দ্রুত পায়ে ওর কাছে গিয়ে হাটু গেরে বসে, ব্যাস্ত হয়ে প্রশ্ন করতে থাকে,
– তোমার কি হয়েছে মৌ! কষ্ট হচ্ছে! কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলে আমাকে?
মৌ ছলছল চোখে আলিহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আলিহান, রাহি!
– কি হয়েছে রাহির?
– রাহি দেশ ছেড়ে চলে গেছে আলিহান।
মৌ-য়ের কথা শুনে উঠে দাঁড়ায় আলিহান। মাথায় হাত রেখে কিচ্ছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে সে। মৌনতা ভেঙে মৌ-য়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বলে,
– কোথায় গেছে! কখন গেছে জানো কিছু?
মৌ আলিহানের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বিছানায় পরে তাকা চিঠিটা ওর হাতে দেয়। আলিহান চিঠি হাতে নিয়ে মৌ-য়ের পাশে বসে পড়তে থাকে।
চিঠি পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায় আলিহান। মৌ-কে নিয়ে তাদের রুমে যায়। তারপর ফ্রেশ হয়ে সে বেড়িয়ে পরে আহমেদ ভিলায় যাওয়ার জন্যে।
________________________
গভীর ঘুমে নিমজ্জিত রাহনাফ। কাল রাতে কাজের চাপ ছিলো অনেক তাই ঘুমাতে পারেনি।ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। জানালার কাজ ভেদ করে সূর্যের লাল রশ্নি এসে পড়ছে রাহনাফের মুখে। এখন যদি কেউ পর্দাটা টেনে দিত। এর মধ্যে কলিং বেলটা বেজে উঠে। গভীর ঘুমে থাকায় আর উঠা হয়না। পরপর কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পরেও উঠে না রাহনাফ। তাই আগন্তুক বিরতিহীন ভাবে কলিং বেল চাপতে থাকে। ঘুম উবে যায় রাহনাফের। বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে। মুখে হাত দিয়ে বড় করে হাই তুলে সে। এদিকে আগন্তুক এমন ভাবে কলিং বেলটা চেপে যাচ্ছে যে রাহনাফের কানটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বিছানা ছেড়ে উঠে দ্রুত দরজা খুলে দেয় রাহনাফ। দরজার ওপাশে মেহেরকে দেখে একটু অবাক হয় রাহনাফ। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দরজার ওপাশে থাকা মেহেরের দিকে। মেহের রাহনাফের চাহনি উপেক্ষা করে ওকে ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে।
মেহের আর রাহনাফ মুখোমুখি বসে আছে। রাহনাফের দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির। অনুতাপে ভুগছে সে। রাহনাফ কখনো ভাবতেও পারেনি রাহি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। মেহের উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহনাফের দিকে। মেহের রাহনাফের হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে। হাতে উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকায় রাহনাফ তখনি মেহের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
– চুপ করে থেকো না রাহনাফ। বল রাহির মায়ের সাথে তোমাদের কিসের সম্পর্ক। তাকে কি করে চিনো তুমি।
মেহেরের প্রশ্নের জবাবে বড়করে শ্বাস ত্যাগ করে রাহনাফ। অতঃপর বলতে শুরু করে,
চলবে,,,,,,,, (ইনশাআল্লাহ)
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।