মেহেরজান #পর্ব-২১,২২

0
634

#মেহেরজান
#পর্ব-২১,২২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-২১

বিন্দু বিন্দু শিশির জমে থাকা ঘাসে পা রাখলেন মোহিনী। গায়ে মোটা শাল জড়ানো। সূর্য অনেক আগে উঠলেও তার দেখা এখনো মেলেনি। গাছের ঝুলে থাকা পাতার ডগায় জমে থাকা শিশির কণাগুলো যেন এখুনি একত্রিত হয়ে টুপ করে নিচে পড়বে। আশেপাশে বসার মতো কোনো জায়গা পেলেন না মোহিনী। সবই ভেজা। তবে এভাবে খালি পায়ে হাঁটতে মন্দ লাগছে না। একটা দুটো করে শিউলি কুড়িয়ে নিজের শাড়ীর আঁচলে রাখছেন পদ্মাবতী। এমন সময় যেন তার ওপর বৃষ্টির বর্ষণ হলো। গাছ ধরে কেউ ঝাঁকাতেই এই কান্ড। ফুলগুলো ফেলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পেছনে ঘুরতেই দেখলেন মোহিনী দাঁড়িয়ে হাসছেন। মোহিনী এখানে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন, টেরই পাননি। একবার কেঁপে উঠে বললেন,

“এমনিতেই শীতে বাঁচি না। তার ওপর এভাবে আমার ওপর জল ঝরাতে পারলি?”

পদ্মাবতী আবার বসে শিউলিগুলো তুলতে লাগলেন। মোহিনী নিজের চাদরটা পদ্মাবতীর গায়ে দিয়ে তাকে ফুলগুলো তুলতে সাহায্য করলেন। ফুল কুড়িয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় মোহিনী বললেন,

“আমাকে একটু জল এনে দে। পা ধুতে হবে।”

“জুতো কী করেছিস?”

“বাগানে ঢোকার আগেই খুলে রেখে এসেছি।”

“দাঁড়া। আমি নিয়ে আসছি।”

পদ্মাবতী এক ঘটি জল এনে মোহিনীকে দিলেন। মোহিনী পা ধুয়ে পদ্মাবতীর সাথে তার ঘরে ঢুকলেন। পদ্মাবতী সূঁচ আর সুতা নিয়ে এসে বিছানায় বসলেন। এরপর ফুলগুলো দিয়ে মালা গাঁথতে শুরু করলেন। মোহিনী তার পাশেই বসে রইলেন। এমন সময় চিত্রা ঢুকলেন তাদের ঘরে। হাতে একটা থালা, যার মধ্যে তিনটা ক্ষীরের বাটি। মোহিনী দেখেই চট করে একটা তুলে নিলেন। বললেন,

“সকাল সকাল ক্ষীর?”

চিত্রা একটা বাটি পদ্মাবতীর হাতে দিয়ে বললেন,

“এই নে খা।”

“কিসের জন্য এটা?”

“আমার জন্মদিনের।”

জিভ কাটলেন পদ্মাবতী।

“একদম মনে ছিল না।”

চিত্রা নিজেও খেতে খেতে বললেন,

“তা মনে থাকবে কী করে? তোদের দুই বান্ধুবীর মাঝে আমি কে? আমার কথা কারও মনে রাখার দরকার আছে নাকি?”

“মনে নেই তো কী হয়েছে? তোর জন্য উপহার ঠিকই এনেছি।”

“কই?”

পদ্মাবতী হাতে থাকা ফুলের মালাটা চিত্রার গলায় পরিয়ে দিলেন। মোহিনী হেসে ফেললেন। চিত্রার উচ্ছ্বসিত মুখটা মুহূর্তেই চুপসে গেল।

“এটা আমার উপহার? এখন আছে, একটু পরেই নেই। এটা না দিয়ে নিজের গলারটাও তো দিতে পারতি।”

মোহিনী বলে উঠলেন,

“এতো লোভ করিস না। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। ”

“তুই আর কিছু বলিস না তো। ইশশশ, দাদার কথা খুব মনে পড়ছে। দাদা থাকলে নিশ্চিত আমি যা চাইতাম তাই দিত।”

পদ্মাবতী বললেন,

“সত্যিই। সেই কবে গেলেন। কতমাস হয়ে গেল। পূজো শেষ করে দেখতে দেখতে দোলও চলে এলো। অথচ তিনি এখনো ফিরলেন না কেন?”

“মা তো বললেন দোলের দিন নাকি দাদা ফিরবেন।”

“তাই?”

“বললেন তো তাই। আমি জানি না।”

মোহিনী খাওয়া শেষ করে বললেন,

“আমার জন্য আরেকটু নিয়ে আয় তো। বড়মা বানিয়েছেন। অনেক মজা হয়েছে।”

“আমাদের কথা শেষ হলো না আর তোর খাওয়া শেষ?”

“খাওয়া বাদ দিয়ে এতো কথা বললে তো এমনই হবে। যা নিয়ে আয় আরেক বাটি।”

“আনছি।”

চিত্রা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মোহিনী আর পদ্মাবতী নিজেদের মতো গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
.
.
সকাল থেকেই আম্রপালি, শকুন্তলা, অনুরাধা তিনজনই রান্নাঘরে বসে আছেন। সাথে আরও দু’জন কাজের মেয়ে। বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত তারা। ভাপা, পাটিসাপটা, নকশি, পাক্কূণ, পুলিপিঠা, কী নেই সেখানে? সবই চিত্রার পছন্দের। সাথে ভালোমন্দ বিভিন্ন পদের রান্নাও রয়েছে। চিত্রার জন্মদিন উপলক্ষে আজ দুপুরে কিছু অনাথ শিশু আর গরীবদের খাওয়াবেন তারা। সেটারই প্রস্তুতি চলছে।

“আর পারছি না। সেই সকাল থেকে খেটে মরছি। এভাবে কী আর পারা যায়? দিদি, আমি বরং একটু ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিই। পরে আবার আসবো। তোমরা এদিকটা সামলে নিতে পারবে তো?”

আম্রপালি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। শকুন্তলা বেরিয়ে যেতেই অনুরাধা বললেন,

“পরে আসার কথা বললেও এদিকে আর ফিরে দেখবে না ও দেখো তুমি। খাটাখাটুনি করতে পারবে না তো এসব আয়োজন করার দরকারটা কী ছিল? আমাদের ছেলেমেয়ের বেলায় তো এতো রঙঢং করি না আমরা। তাহলে চিত্রার বেলায় হবে কেন?”

করতে দিন না দিদি। শখ যখন জেগেছে তাহলে সেটা একবার মিটিয়ে নিক।

“ওর মেয়ের জন্মদিন ও পালন করছে করুক। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের খাটিয়ে মারছে কেন বলো তো?”

আম্রপালি মুচকি হাসলেন। এমন সময় শান্তি দেবী ঢুকলেন রান্নাঘরে। নিজের লাঠিতে ভর দিয়ে, খুবই ধীরে ধীরে। সবকিছু একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ভাঙা গলায় বললেন,

“এগুলো কিসের জন্য?”

অনুরাধা বললেন,

“আপনার নাতনির জন্মদিনের জন্য। আপনার বউমা বাইরের কতগুলো লোককে এনে খাওয়াবে দুপুরে।”

“চিত্রার জন্মদিন? মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেল না? কয় বছরের হলো?”

“একুশ মনে হয়।”

“হবে হয়তো। ও তো আমার কাছে আসেই না। আমি জানবো কী করে কতটুকু হলো? পদ্মা ছাড়া তো আমার ঘরে ঢোকার সময়ই কারও হয় না।”

ফ্যাসফ্যাসে গলায় হাসলেন শান্তি দেবী। এরপর আবার নিজের লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলেন। বেশ কষ্টে দোতলায় উঠলেন তিনি। এই বয়সে এমন শরীর নিয়ে এতোগুলা সিড়ি বাওয়া আসলেই কষ্টসাধ্য। পদ্মাবতীর ঘরে এলেন তিনি। নিজের ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরে বেশি প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা যাননা তিনি। বিগত দু’বছরে আজ তৃতীয়বারের মতো এই ঘরটায় এলেন তিনি। আসতেই দেখলেন ঘরে পদ্মাবতী ছাড়াও মোহিনীও আগে থেকে রয়েছেন। পদ্মাবতী শান্তি দেবীকে দেখা মাত্রই তাকে আসতে সাহায্য করলেন। শান্তি দেবী পদ্মাবতীকে ধরে ধরে এসে বিছানায় বসলেন। একদম মোহিনীর সামনে। মোহিনী বললেন,

“এখনো বেঁচে আছো বুড়ি? মরোনি?”

শান্তি দেবী ভেংচি কেটে বললেন,

“আমি ক্যান মরুমরে ছেমরি? তুই মর।”

মোহিনী হাসিতে ফেটে পড়লেন। মাঝেমাঝে শান্তি দেবীর মুখে এভাবে কথা বলা শুনতে ভালোই লাগে তার। রামু ছাড়া এভাবে কেউ কথা বলেন না। শান্তি দেবী বললেও খুব কম। মোহিনী হাসি থামিয়ে বললেন,

“বুড়ি হয়েছো তুমি আর মরবো আমি?”

“আমি বুড়ি হয়েছি তো কী হয়েছে? এখনই মরতে হবে নাকি? আমি মরলে মনে হয় তোরা বাঁচিস।”

“আমি বাঁচি বা না বাঁচি, পদ্মা তো বেঁচে যাবে। সারাদিন ওকে কতো খাটাও তুমি ভাবো একবার? সারাদিন শুধু ওকে এটা ওটা করার হুকুম দিয়েই যাও।”

“আমি হুকুম করবো না তো কী তুই করবি? জমিদার বাড়ির বউ আমি না তুই?”

“এখন তুমি। পরে নাহয় আমি হবো। তোমার বরের নাম যেন কী ছিল? দেখতে খুব সুদর্শন ছিলেন তাই না? বেঁচে থাকলে দেখতে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছেন আমার জন্য। আমার রুপের কাছে যে-কেউ হার মানতে বাধ্য।”

“কোথাকার কোন রুপের রানী এলেনরে আমার! তুই কী জানিস আমার রুপের কথা? যৌবনে তোদের থেকে কত বেশি সুন্দরী ছিলাম আমি ভাবতেও পারবি না। এমনি এমনি জমিদার বাড়ির বউ হইনি। প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে বিয়ে করে ওপাড় বাংলা থেকে এপাড়ে নিয়ে এসেছিলেন আমায়। আর তুই এসেছিস আমার মৃত স্বামীকে কেড়ে নিতে? হয়েছিস তো একদম কাঠির মতো। ফুঁ দিলেই উড়ে যাবি।”

শান্তি দেবী হাঁপিয়ে উঠলেন। মোহিনী ভ্রু নাচিয়ে পদ্মার উদ্দেশ্যে বললেন,

“বুড়ি খেপেছেরে পদ্মা।”

“উফফফ, কী শুরু করলে তোমরা? সবাই আমাকে বলো বাচ্চা অথচ এখন নিজেরাই বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছো। দিদা, তুমি কী বুঝো না ও তোমাকে রাগাতে চাইছে। তাই এসব বলছে। আর তুমিও ওর কথায় কান দিয়ে রাগছো।”

“আমাকে রাগাতে কী মজা পায় ও?”

“সেটা আমি কী জানি? ওকেই জিজ্ঞেস করো।”

শান্তি দেবী মোহিনীর দিকে তাকালেন। মোহিনী বললেন,

“শান্তি পাই শান্তি দেবী। শান্তি পাই।”

পদ্মাবতী শান্তি দেবীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“এবার বলো, কোনো দরকারে এসেছো?”

“কেন? এখানে কী দরকারেই আসতে হবে?”

“আমি তা বললাম কখন?”

“এমনিই এসেছি। গল্প করতে। ওরা তো সবাই রান্নাঘরে ব্যস্ত। আমার সাথে কথা বলার সময় কোথায়? চিত্রা কই গেছেরে? শুনলাম আজ ওর জন্মদিন।”

“এসেছিল তো। এখন কই গেছে কে জানে।”

মোহিনী বললেন,

“ওকে পাঠিয়েছিলাম আমার জন্য আরেক বাটি ক্ষীর আনতে। সেই যে গেল আর ফেরার খবর নেই।”

“এতো খাস কীভাবে তুই? খাবার যায় কই বলতো? সেই তো দেখতে একেবারে শুকনো কাঠি।”

মোহিনী পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,

“আমার পেট ছাড়া আর কই যাবে দিদা?”

“রান্নাঘরে দেখে এলাম। কতো রকমের রান্না হচ্ছে। আজ তো তোর জন্য উৎসব লেগে গেছে।”

“আগেই গন্ধ পেয়েছি আমি। এজন্যই তো সেই কখন থেকে এখানে বসে আসি।”

পদ্মাবতী বললেন,

“তুই যে তখন বললি তুই আমার জন্য বসে আছিস। আমার কাজ শেষ হলে আমাকে নিয়ে বাইরে যাবি।”

“সে তো যাবোই। কিন্তু দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ করে।”

“কোথায় যাবি?”

“সেটা খাওয়ার পরে ঠিক করবো।”

“তারমানে তুই খাওয়ার জন্যই বসে আছিস। আমার কোনো দাম নেই তোর কাছে।”

“আরে যার জন্যই থাকি, একই তো হলো।”

“না, এক হলো না।”

“একই হলো। চুপ কর তুই।”

মুহুর্তেই যেন পদ্মাবতী খেপে গেলেন। শান্তি দেবী বললেন,

“এইতো একটু আগেই দু’জন একদম ঠিক ছিলিস। এক মুহুর্তে এমন ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলি?”

“মোহিনীর জন্যই তো।”

“আমি কী করলাম? অযথা রাগ দেখাবি না একদম বলে দিলাম।”

“আমি অযথা রাগ দেখাই তাই না?”

“হ্যা, আমার সাথে কথা বলবি না একদম। তোর আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

পদ্মাবতী কেঁদে ফেললেন। হঠাৎ এভাবে কেঁদে ফেলায় মোহিনী কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পদ্মাবতী নিজের কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

“আমি অযথা রাগ দেখাই না। তুই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবি না একদম। তোর সাথে কথা না বলে কীভাবে থাকবো আমি?”

মোহিনী বুঝতে পারলেন না কী বলবেন। পদ্মাবতীর হৃদয় অনেক কোমল। একটুতেই কষ্ট পায় এটা জানেন মোহিনী। তাই বলে এই সামান্য একটা ব্যপারে এভাবে কেঁদে ফেলবে বুঝতে পারেননি। তবে এমন যে প্রথমবার হয়েছে তাও নয়। প্রায়ই তাদের ঝগড়া হলে পদ্মাবতী কেঁদে ফেলতেন। তা সে যত ছোটখাটোই হোক না কেন। মোহিনী পদ্মাবতীর মাথায় হাত রেখে বললেন,

“ঠিকাছে। কথা বলা বন্ধ করবো না তোর সাথে। তুই আসলেই একটা বাচ্চা।”

মোহিনীকে ছেড়ে দিলেন পদ্মাবতী। কান্না থামিয়ে কিছুটা শান্ত হলেন। নাক টানতে টানতে বললেন,

“আর কখনো আমার সাথে এভাবে কথা বলবি না।”

“ঠিকাছে বলবো না।”

পুরো ঘটনাটা চুপচাপ দেখে গেলেন শান্তি দেবী। এরপর মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

“তোদের ঢং দেখে আর বাঁচি না। তোদের বন্ধুত্বের কাছে দুই বোনও হার মানবে। দেখবোনি কতদিন টেকে এই বন্ধুত্ব। কারও নজর যেন না লাগে আবার।”

উঠে দাঁড়ালেন শান্তি দেবী। চশমাটা খুলে পাশে রেখেছিলেন তিনি। আবার চোখে দিয়ে বললেন,

“কিসের চশমা যে পরি আমি? চশমা পরার পরও সব সেই ঘোলাই দেখি।”

কথাটা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শান্তি দেবী। তার কথায় চোখ মুছতে মুছতে সামান্য হাসলেন পদ্মাবতী। বললেন,

“কারও নজর লাগবে না আমাদের।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-২২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

প্রতিদিনের মতো আজও বিন্দু বিন্দু শিশির জমা দূর্বার ওপর থেকে শিউলি কুড়িয়ে নিচ্ছেন পদ্মাবতী। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলেন কুয়াশার চাদর ভেদ করে ক্রমশ একটা অবয়ব এগিয়ে আসছে তার দিকে। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। অবয়বটি ঘাসের ওপর পড়ে থাকা শিশিরভেজা শিউলিগুলো মারিয়ে একদম সামনে চলে আসতেই সেই চিরচেনা মুখটা ভেসে উঠলো পদ্মাবতীর সামনে। দিঘির জলের মতো শান্ত মনটা হঠাৎ করেই স্রোতস্বিনীর মতো অস্থির হয়ে উঠলো। মনে হাজারো কথা জমিয়ে রেখেও মুখে কিছু প্রকাশ করতে পারছেন না তিনি। অর্ণবকে স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই কোথা যেন বালতি ভরা জল এসে পড়লো তার ওপর। মুহুর্তেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। বিছানা থেকে “মাগো” বলে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। গায়ে থেকে জল ঝারতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সামনে মোহিনীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সব পরিষ্কার হয়ে গেলো তার কাছে যে কী হয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। গায়ে মোটা কম্বল জড়িয়ে বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। মোহিনী এসে একটা পাত্র ভরে জল ঢেলে দিয়েছেন তার ওপর। গায়ের শাড়িটা খুব এলোমেলো হয়ে আছে। তা-ই ঠিক করতে করতে বললেন,

“কী করল তুই এটা?”

“আমার কোনো দোষ নেই। আমি তো আরও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তুই মরে গেছিস ভেবে। জানিস কত্তোবার ডেকেছি তোকে?”

“তাই বলে এভাবে জল ঢেলে দিবি? তাও এমন শীতে?”

“এখন আর এমন কী শীত?”

পদ্মাবতী জানালা খুলে দিতেই একটা হিম করা শীতল বাতাস এসে গায়ে লাগলো তার। একে তো ভেজা গা, তার উপর এমন বাতাসে যেন জমে গেলেন তিনি। কয়েকবার দাঁতে দাঁত লেগে এলো। বাইরে তাকালেন তিনি। কুয়াশায় সব ঢেকে আছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।

“বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না আর তুই বলছিস শীত নেই?”

“আছে কিন্তু তেমন একটা না। এমনিতেই শীত চলে যাচ্ছে। তাই চল বাইরে গিয়ে পরিবেশটা একটু উপভোগ করে আসি।”

পদ্মাবতী ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছয়টা বাজে। বললেন,

“তোর মেজাজ বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে। ছয়টা বাজে কেবল। এতো সকালে কই যেতে চাস তুই?”

“যেখানে ইচ্ছে করবে। জায়গার অভাব নাকি এখানে?”

“আরেকটু ঘুমাতে দে না মোহিনী।”

“আচ্ছা, ঘুমা তুই।”

পদ্মাবতী অবাক হলেন। এতো সহজে মেনে নেওয়ার মেয়ে নয় মোহিনী। তাহলে কারণ কী? পদ্মাবতী বিছানার দিকে তাকাতেই দেখলেন শোয়ার জায়গাটা একদম ভিজে গেছে।

“বিছানা তো দিয়েছিস একদম ভিজিয়ে। এখন তো বলবিই ঘুমাতে। দাঁড়া একটু। আমি শাড়ি পাল্টে আসছি।”

পদ্মাবতী শাড়ি পাল্টে আসতেই দু’জনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

ঘন কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে চলেছেন দু’জনে। যতই এগুচ্ছেন, রাস্তা ততই দৃশ্যমান হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকটায় চলে এসেছেন। বাজারের একদম মাঝখানে বিশাল বড় বটগাছটার চারপাশে গোল করে ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাধাঁনো চত্বরের ওপর একটা পাগল শীতে কাচুমাচু করে শুয়ে আছে। সারাদিন বাজারেই ঘুরে বেড়ায় আর রাতে এই গাছটার নিচে ঘুমায়। দোকানপাট তেমন একটা খোলেনি এখনো। একটা টঙের দোকান আর একটা ভাপা আর চিতই পিঠার দোকান খুলেছে মাত্র। টঙের দোকানে বসে কতগুলা লোক চা খাচ্ছিলেন। মোহিনী আর পদ্মাবতীকে আসতে দেখে কিছু সময় তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার নিজেদের কাজে মনোনিবেশ করলেন তারা। পিঠার দোকানে একজন বৃদ্ধা বসে বসে পিঠা বানাচ্ছেন আর পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটা সেগুলো ক্রেতাদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। লোকজনগুলো সেখানে বসেই মরিচ, কালোজিরা, ধনিয়া, সরিষার মতো বিভিন্ন বাটা দিয়ে গরম গরম ভাপ ওঠা চিতই খেতে ব্যস্ত। পদ্মাবতী বললেন,

“ইশশশ, আগে জানলে সাথে করে টাকা নিয়ে আসতাম। খেতে ইচ্ছে করছে খুব।”

“উড়ে তো যাচ্ছে না কিছু। পরে এসে খাস।”

“তাও ঠিক।”

“দৌঁড় লাগাবি পদ্মা? আগে যেমন লাগাতাম?”

“এখন?”

“হ্যাঁ, সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটা শেষ সীমানা।”

মোহিনী আর কথা না বাড়িয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলেন। উপায় না পেয়ে পদ্মাবতীও তার পেছন পেছন দৌঁড় লাগালেন। শাড়ি পরে দৌঁড়ানোটা তার কাছে একটু কষ্টসাধ্যই বটে। বেশ অনেকটা রাস্তা দৌঁড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে এসে থেমে পড়লেন মোহিনী। প্রতিবারের মতো এবারও তিনিই জিতলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে গাছের নিচে থাকা বাঁশের তৈরি বেঞ্চে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পদ্মাবতীও চলে এলেন। থেমেই হাঁপাতে শুরু করলেন।

“তুই আমার সাথে কোনোদিনও পেরে উঠলি নারে পদ্মা।”

“তুই সবসময় আমার শাড়ি পরার সুযোগ নিস। এটা পরে এতো জোরে দৌঁড়ানো যায় নাকি?”

“থাক, আর অজুহাত দিস না।”

“একদম অজুহাত দিচ্ছি না।”

পদ্মাবতী মোহিনীর পাশে বসে পড়লেন। বসে বসে এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাতে লাগলেন মোহিনী। কুয়াশা আগের তুলনায় এখন অনেকটা কমে গেছে। দূরে কতগুলো বাচ্চা গোল হয়ে বসে আগুন পোহাচ্ছে। উদাম গায়ে কাঁপতে কাঁপতে হাত দুটো গরম করে পুরো শরীরে উষ্ণতা ছড়ানোর বৃথা চেষ্টা করছে তারা। পদ্মাবতী বললেন,

“অনেক হাঁপিয়ে গেছি। জল খাবো।”

“এখন কোথায় জল পাবি তুই?”

পদ্মাবতী এদিক-ওদিক তাকালেন। কাউকে আসতে দেখলেন এদিকে। বললেন,

“জল না পেলাম। রস খেয়েই না হয় তৃষ্ণা মেটাই।”

লোকটা যখন আরেকটু কাছে আসলো, মোহিনী দেখলেন রোগাপটকা একটা ছেলে। তার চেয়ে ছোটই হবে। সামনে আসতেই পদ্মাবতী তার উদ্দেশ্যে বললেন,

“এখন নিয়ে আসলে গাছ থেকে?”

ছেলেটা পদ্মাবতীর চেনা। তিনি বললেন,

“হ্যাঁ, মাত্রই পেরে আনলাম হাড়ি দুটো।”

“আমাদের একটু দিয়ে যাও। অনেক তেষ্টা পেয়েছে।”

ছেলেটা তাদের হাতে মাটির পেয়ালায় খেজুরের রস এগিয়ে দিতেই দুজনে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। পদ্মাবতী বললেন,

“এখন সাথে করে টাকা আনিনি। বিকেলে বাড়িতে এসে তোমার দামটা নিয়ে যেও। পারবে তো?”

“আচ্ছা দিদি। আপনাদের তো আমি চিনিই। কোনো সমস্যা নেই।”

“ঠিকাছে।”

ছেলেটা চলে যেতেই মোহিনী উঠে দাঁড়ালেন।

“কী হলো?”

“বসে থাকতে ভাল্লাগছে না।”

“ফিরে যাবি?”

“কী করবো আর?”

“আমাকে নিয়ে এলি কেন তাহলে? জানতাম তুই এমনই করবি।”

“ঠিকাছে। আর রাগিস না। পরে যাবো বাড়িতে। চল নদীর দিকটায় যাই।”

পদ্মাবতী কিছু সময় মোহিনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর চেঁচিয়ে বললেন,

“ভাল্লাগে না আমার। তোর সকাল সকাল কোনো কাজকর্ম নেই তাই এমন শুরু করেছিস। সাথে আমাকেও জ্বালাচ্ছিস। একবার এখানে যাই আবার ওখানে যাই। কোথাও একটু ঠিকমতো বসে থাকতেও দিচ্ছিস না। এখন নদীতে যাবি কী করতে?”

“তোকে মাঝ নদীতে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলতে যাবো।”

মোহিনী পদ্মাবতীর হাত ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে গেলেন।

নদীর জল অনেকটা কমে গেছে। জলে পা ভিজিয়ে ঘাটে বসে রয়েছেন মোহিনী। তার থেকে অনেকটা দূরে পদ্মাবতী বসে আছেন। ইচ্ছে করেই মোহিনীর থেকে দূরে বসেছেন তিনি। কারণ তিনি জানেন মোহিনী চাইলেই সত্যি সত্যি তাকে নদীতে ফেলে দিতে পারেন। মোহিনীর মধ্যে আজ একটা অস্থিরতা কাজ করছে। যা অন্যান্য দিনের থেকে আলাদা। পদ্মাবতীর চোখে সেটা ঠিকই ধরা পরেছে। কিন্তু এর কারণটা বুঝতে পারছেন না তিনি। মোহিনী পেছনে ঘুরে পদ্মাবতীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। পদ্মাবতীও তার উদ্দেশ্যে একটা হাসি ফিরিয়ে দিলেন।
.
.
.
স্নান সেরে ছাদে বসে সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছেন চিত্রা। শ্যামলের সাথে দেখা হয় না তাও অনেকদিন হলো। আজ যে করেই হোক দেখা করতে হবে। কীভাবে দেখা করা যায় তারই পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত এখন তিনি। হঠাৎ শকুন্তলার ডাক শুনতে পেলেন। সেই ডাকে সাড়া দিলেন তিনি।

“আসছি মা।”

কথাটা বলেই উঠে পড়লেন চিত্রা। ছাদে থেকে নেমে শমিতের ঘরের সামনে দিয়ে আসতেই দরজার কোণায় একটা ভাজ করা কাগজ পড়ে থাকতে দেখলেন। সেটা তুলে নিয়ে খুলে পড়তেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল চিত্রার। একটা চিঠি। মোহিনীর উদ্দেশ্যে লেখা অর্ণবের চিঠি। চিত্রার বুঝতে সমস্যা হলো না যে শমিত এব্যাপারে সব জানেন। বর্তমানে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম শমিত। এভাবে আরও কত চিঠি শমিত আদান-প্রদান করেছেন তা জানেন না চিত্রা। তবে এটাই যে প্রথম নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত। সাথে সাথে কাগজটা আবার ভাজ করে নিজের কাছে লুকিয়ে ফেললেন তিনি। এটাই হয়তো ছিল আজ মোহিনীর এতো চঞ্চলতার কারণ। হয়তো মোহিনীর অজান্তেই চিঠিটা এখানে পড়ে গেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here