মেহেরজান #পর্ব-২৩,২৪

0
660

#মেহেরজান
#পর্ব-২৩,২৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-২৩

গাছের ঝরা পাতাগুলো পাঁকা রাস্তার উপরে বেশ মোটা একটা আস্তরণ তৈরি করেছে। তার ওপর দিয়ে হাঁটলেই শুকনো পাতার মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে। রাস্তার পাশের অধিকাংশ গাছগুলোতেই এখন একটা পাতাও নেই। কেমন একটা অপূর্ণ মনে হচ্ছে। তবে কিছু গাছের নতুন আসা কচি পাতাগুলো যেন তা কিছুটা হলেও আড়াল করতে পেরেছে। মোহিনী আর এদিক-ওদিক না তাকিয়ে দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন। ওইতো, সামনেই অর্ণবদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। গেইটের দুই ধারের ফুলে হলুদ হয়ে যাওয়া রাধাচূড়া গাছ দুটো দেওয়ালের ওপার থেকে উঁকি দিচ্ছে। যেন কারও আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মোহিনীর মনে হচ্ছে এবাড়িতে আসার রাস্তাটা যেন দিন দিন আরও দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সে যতই কাছে আসে, বাড়িটা যেন আরও দূরে সরে যায়। রাস্তাটা শেষই হতে চায় না। বাগান অতিক্রম করে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখলেন আম্রপালি যেন কার সাথে টেলিফোনে কথা বলছেন। মোহিনীকে দেখে মুচকি হাসলেন। মোহিনী কাছে আসতেই টেলিফোনটা নামিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিচু স্বরে বললেন,

“ঠিক সময় এসেছিস। রান্নাঘরে দেখ লাড্ডু বানিয়ে রেখেছি। ওটা নিয়ে সোজা পদ্মার ঘরে চলে যা।”

“কার জন্য রেখেছেন?”

“তোর জন্যই।”

“কিভাবে জানলেন আমি আজ আসবো?”

“ওইভাবেই। এখন যা।”

মোহিনী চলে গেলে আম্রপালি আবার টেলিফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মোহিনী রান্নাঘরে এসে দেখলেন আম্রপালি একটা থালা ভরে লাড্ডু রেখে দিয়েছেন। এরপর নিজেই বিড়বিড় করতে লাগলেন।

“এতোগুলো লাড্ডু আমার জন্য? মানলাম আমি খেতে পছন্দ করি তাই বলে এতোগুলো? বড়মা কি আমার খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিলেন? ধুর, একটু বেশিই ভাবি আমি। কম রাখলে তো পরে আমি নিজেই বলতাম আরেকটু বেশি রাখতে পারলেন না?”

মোহিনী একটা লাড্ডু মুখে পুরে দিয়ে থালাটা নিয়ে সোজা দোতলায় চলে গেলেন।

পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে লাগছে পদ্মাবতীর মুখে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে জানালার পাশে রাখা টেবিল চেয়ারে বসে গাছে কয়টা নতুন পাতা এলো তা খুব মনোযোগ সহকারে গুনছেন তিনি। কাজকর্ম না থাকলে সময় পার করার একটা দারুণ পন্থা। বেশ কয়েকদিন ধরে মোহিনী আসছেন না। অবশেষে সময় কাটানোর জন্য এই রাস্তাটাই বের করেছেন পদ্মাবতী। সামনের শিমুল গাছটায় একটা বেনেবউ এসে বসেছে। অনেক সময় পরে এই পাখিটাকে আবার দেখলেন পদ্মাবতী। পরক্ষণেই ভাবতে লাগলেন কেউ কি আসবে বাড়িতে? কে আসতে পারে? অর্ণব? না, তিনি আসতেও এখনো অনেকদিন বাকি। তবে? হঠাৎ কেউ টেবিলে লাড্ডুর থালাটা রাখতেই চমকে উঠলেন পদ্মাবতী।

“লাড্ডু!”

উচ্ছ্বসিত হয়ে থালার দিকে হাত বাড়াতেই কেউ হাতে আঘাত করলেন। ঘুরে তাকাতেই দেখলেন মোহিনী।

“তোর জন্য নয় এগুলো।”

“মানে? তাহলে কার জন্য?”

“আমার জন্য।”

“তোর জন্য তাহলে তুই আমার ঘরে কেন নিয়ে এসেছিস?”

“বড়মাই তো বললেন।”

করুণ চোখে মোহিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমাকে রেখে একা একা খেতে পারবি তুই?”

মোহিনী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“এভাবে তাকাস না তো তুই। এভাবে তাকিয়ে তুই আমাকে দিয়ে যা খুশি তাই করাতে পারিস। এই যেমন এখন ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও তোর সাথে ভাগাভাগি করে খেতে হচ্ছে।”

মোহিনীর কথা শেষ হতে না হতেই পদ্মাবতী খাওয়া শুরু করলেন।

“খাচ্ছে কীভাবে দেখো। আস্ত একটা রাক্ষসী। আর সবাই বলে আমি নাকি বেশি খাই।”

“এসব কথা বাদ দে তো। আগে বল, বেঁচে আছিস তুই?”

“বেঁচে না থাকলে এখন কি আমার ভূতের সাথে কথা বলছিস তুই?”

“বেঁচে আছিস তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম মরেই গেছিস। একটা নয়, দুটো নয়, পুরো তেরোটা দিন! কোথায় ছিলি এতোদিন?”

“বাড়িতেই।”

“একবারে জন্যও আসলি না তাই? আমার সাথে কথা না বলে তুই থাকিস কী করে বলতো। আমার যে কী অবস্থা হয়েছিল জানিস তুই? কোনো কাজ-কর্ম নেই। বড়মার কাছে যাই, তিনিও কিছু করতে দেন না। ছোটমাও কিছু বলেন না। আর পিসিমা তো পিসিমাই। কারও সাথে ঠিক মতো কথা বলতে পারি না। চিত্রাকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। শেষে উপায় না পেয়ে গাছের পাতা গুনতে শুরু করেছি।”

“ক’টা হলো?”

“কী ক’টা হলো?”

“গাছের পাতা?”

“গুনছিলামই তো। কিন্তু মাঝে তুই এসেই তো সব গুলিয়ে দিলি।”

“পরে আবার গুনে নিস। এখন চল ছাদে যাই। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।”

দুজনে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে দ্রুত ছাদে উঠে এলেন। ছাদে রাখা চন্দ্রমল্লিকার গাছগুলো ফুলে একদম ভরে গেছে। ছাদের এক কিনারে এসে বসলেন তারা। কোথায় থেকে কোকিলের কুহুতান ভেসে আসছে। সেই সাথে কোকিলের ডাক নকল করে আরও একটা আওয়াজ। বসন্ত যে এসে গেছে তা জানান দিতে কোকিলের ডাকটাই যথেষ্ট। দূর থেকে শমিতকে আসতে দেখে পদ্মাবতী বললেন,

“শমিতদা আর শেফালীর প্রেমতো ভালোই চলছে মনে হয়। এখন নিশ্চিত ওর সাথেই দেখা করে ফিরছে।”

“তুই কবে জানলি ওদের প্রেমের কথা?”

“অনেক আগেই।”

“জেনেছিস এটাই অনেক। তুই তো আবার চোখ থাকতেও অন্ধ। না বললে কিছু বুঝিসই না।”

“যাই হোক, খুব তাড়াতাড়িই মনে হয় একটা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে পাবো আমরা।”

“কাদের বিয়ে?”

“কাদের আবার? শমিতদা আর শেফালীর।”

“তোর মনে হয় পিসিমা ওদের বিয়ে হতে দেবেন?”

“দেবেন না কেন?”

“তা জানি না। তবে আমার মনে হয় না হতে দেবেন। উনি তো পারলে শমিতদাকে কোনোদিন বিয়ে না করিয়ে নিজের আঁচলের সাথেই বেঁধে রাখেন।”

“হবে কি হবে না তা ভগবানই ভালো জানেন। আমরা শুধু ওদের জন্য প্রার্থনাই করতে পারি।”

“তাহলে তাই কর।”

হঠাৎ দূরে অনেক লোকজনকে একসাথে দেখে পদ্মাবতী বলে উঠলেন,

“ওখানে এতো লোকজন কেন?”

“কিজানি। দেখে তো মনে হচ্ছে শবযাত্রা।”

“কে মরলো আবার?”

“বুঝতে পারছি না।”

চিত্রা পেছন থেকে বললেন,

“তোরা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? আর আমি সারা বাড়ি খুঁজে মরছি। জেঠিমা ডাকছেন তোদের। নিচে চল।”

দ্রুত পেছনে ঘুরলেন দু’জনে। চিত্রা কখন এসেছেন তারা টেরই পাননি। হয়তো এইমাত্রই এসেছেন। পদ্মাবতী বললেন,

“কে মারা গেছেরে চিত্রা? তুই জানিস কিছু? কার যেন শবযাত্রা যাচ্ছে।”

“শেফালীর বোন আছে না মিতালি? ওরই শবযাত্রা।”

“কী?! মিতালি মারা গেছে? হঠাৎ? কীভাবে হলো?”

“এতো মায়া দেখাস না। মায়া দেখানোর মতো কোনো কাজ ও করেনি। পেটে বাচ্চা নিয়ে আত্মহত্যা করেছে।”

মোহিনী বললেন,

“মানে? কী বলছিস এসব?”

“ঠিকই বলছি। কে জানে কোন ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে পেটে বাচ্চা এনেছে। এখন বিয়ে করেনি দেখে উপায় না পেয়ে বিষ খেয়েছে। নষ্টা মেয়ে একটা।”

পদ্মাবতী বললেন,

“তোরা যাবি আমার সাথে একবার দেখতে?”

চিত্রা উচ্চস্বরে বললেন,

“ভুলেও না। একদম যাবি না তোরা কেউ।”

“কেন?”

“শমিতদা গিয়েছিল। একটু আগে ওখান থেকেই এলো। পিসিমা খুব রেগে আছেন শমিতদার ওপর। কথাও শুনিয়ে দিয়েছেন কতগুলো।”

“তাহলে আর কী করার। ছেলেটার কোন খোঁজ খবর জানিস যে কে করলো এটা?”

“ও এই পাড়ার না। তাই চিনিও না তেমন।”

“কোনো শাস্তি হয়নি?”

“ছেলে তো সম্পুর্ণ অস্বীকার করে দিয়েছে। শেফালীর বাবা-মাও আর থানা-পুলিশের ঝামেলায় যেতে চায়নি বলে তাড়াতাড়ি লাশ নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানে।”

পদ্মাবতী আফসোস করে বললেন,

“অল্পবয়সী একটা মেয়ে। কত বড় ভুলটাই না করলো।”

“তোরা নিচে চল এখন তাড়াতাড়ি।”

“তুই যা। আমরা আসছি।”

চিত্রা চলে যেতেই পদ্মাবতী বললেন,

“মিতালির জন্য আসলেই খারাপ লাগছে। একজন ভুলের মাশুল চুকাতে চিতায় উঠলো। আরেকজন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক’দিন পর বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসারও করবে।”

“ছাড়তো ওদের কথা। যেমন কর্ম তেমন ফল। পাপের শাস্তি দুজনেই পাবে দেখিস।”

“তা-ই ভালো। মাঝখান থেকে একটা নিষ্পাপ প্রাণ চলে গেল। বাচ্চাটার কী দোষ ছিল বলতো?”

“দোষ না থাকলেও ওকে সবাই পাপের ফলই বলতো। ভালোই তো হয়েছে, জন্মানোর আগেই মরে গেছে।”

“এমন ভাগ্য যেন আর কারও না হয়। শেফালী আর ওর বাবা-মায়ের কী অবস্থা এখন ভাব একবার।”

“পরে কোনো সময় গিয়ে একবার দেখা করে আসিস। এখন নিচে চল। কে জানে বড় মা কেন ডাকছেন।”

মোহিনী হাঁটতে শুরু করলেন। তার পেছন পেছন পদ্মাবতীও চলে এলেন। নিচে আসতেই আম্রপালি বললেন,

“মোহিনী, তোকে আমি বলেছিলাম তোর জন্য রান্নাঘরে লাড্ডু রেখে দিয়েছি আলাদা করে। তুই ওটা রেখে কোনটা নিয়েছিস?”

“কেন? আপনি যেটা বলেছিলেন সেটাই তো নিয়েছিলাম। বড় একটা থালায় করে সাজিয়ে রেখেছিলেন।”

“তুই ওই থালার সব খেলে ফেললি?”

“আমি একা খাইনি তো। পদ্মাও খেয়েছে আমার সাথে। কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো বলুন।”

আম্রপালি মোহিনীকে একটা বাটি দেখালেন। সেখানে আরও বেশ কয়েকটা লাড্ডু রাখা।

“আমি এটার কথা বলেছিলাম তোকে। আর তুই এটা রেখে বাকি সব নিয়ে গিয়েছিস।”

“রান্নাঘরে তো ওই থালাটাই ছিল বড়মা।”

“ওটার পাশে এটাও ছিল। ঢেকে রেখেছিলাম। তোর মনে হয় ওতোগুলো লাড্ডু একসাথে একা একজন মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব যে আমি ওতোগুলো রাখবো?”

“একবার মনে হয়েছিল। কিন্তু অন্যের খবর জানি না, আমার পক্ষে তো সম্ভব। তাই ভেবেছিলাম ওটাই হয়তো। আমার কী দোষ?”

“উফ, তোকে নিয়ে আর পারলাম না। এখন আমাকে আবার সব বানাতে হবে।”

“আপনি এতো চিন্তা করবেন না তো বড়মা। পদ্মা আছে কী করতে? আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। সব পদ্মা বানিয়ে দিবে।”

মুহুর্তেই পদ্মাবতীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মোহিনীকে চিমটি দিয়ে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,

“এই, কী বলছিস তুই এসব? আমি এতোগুলো লাড্ডু কীভাবে বানাতে পারবো?”

“এমন ভাব করছিস যেন না জানি কতগুলো। কেন? খাওয়ার আগে মনে ছিল না? খাওয়ার সময় তো ঠিকই আমার সাথে পাল্লা করে খেলি।”

“তাই বলে এভাবে ফাঁসাবি?”

আম্রপালি বলে উঠলেন,

“তোরা ফিসফিস করে কী কথা বলছিস এতো?”

“তেমন কিছু না বড়মা। আজ পদ্মা বলছিল ওর নাকি কোনো কাজকর্ম নেই। আপনারা কেউ কিছু করতে দেন না। ওর এভাবে বসে থাকতে ভাল্লাগে না। তাই এখন একটা কাজ পেয়ে খুশিই হয়েছে।”

“তুই তাহলে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যা পদ্মা। কিছু লাগলে বলিস আমাকে।”

“আচ্ছা বড়মা।”

পদ্মাবতী অসহায় এর মতো রান্নাঘরে চলে গেলেন। মোহিনী খুব কষ্ট করে নিজের হাসি চেপে রাখলেন। ওদিক থেকে চলে আসতেই শমিত ডাক দিলেন তাকে।

“এই মোহিনী, এদিকে আয়।”

মোহিনী আসতেই প্রশ্ন করলেন,

“কী হয়েছে বলো।”

“ব্যাপার কী তোর? আজ-কাল তো তোর দেখাই মেলে না। অর্ণব নেই বলে এখানে আসতেও মন চায় না নাকি?”

“এমন কিছুই না।”

“এই নে।”

মোহিনী শমিতের হাত থেকে একটা কাগজ হাতে নিতে নিতে বললেন,

“এটা কী?”

“কী আবার। তোর প্রেমিকের চিঠি। শালা খুব খাটায় আমাকে। এতো খাটাখাটুনি তো নিজের প্রেমেও করিনি। যাই হোক, আগের চিঠিটা রেখে দিয়েছিস তো সাবধানে? কেউ পায়নি তো?”

“উম, ওটা তো হারিয়ে ফেলেছি। কই যে পড়েছিল আর খুঁজেই পাইনি।”

“কারও হাতে না পড়লেই হলো। নয়তো তোদের সাথে আমি ফাঁসবো।”

“এতো চিন্তা করো না তো। কেউ পায়নি। পেলে অনেক আগেই জানাজানি হয়ে যেত সব। অনেকদিন তো হয়ে গেছে।”

“তাই যেন হয়। আমি আসি এখন।”

শমিত চলে যেতেই মোহিনী চিঠিটা খুললেন। আগের মতো এতো বড় চিঠি নয় এটা। শুধু দুটো বাক্য লেখা।

“প্রিয় মেহেরজান,
অতি শীঘ্রই আমাদের অপেক্ষার সময় শেষ হতে চলেছে। আমি ফিরছি, আপনার কাছে।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-২৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

প্রতিবারের মতো এবারও চৌধুরী বাড়িতে বেশ বড় করে দোল উৎসব হচ্ছে। পাড়াপ্রতিবেশি সবাই এসে জড়ো হয়েছে এখানে। বাতাসে মিশে আছে নানা রঙের আবির। পরনের সাদা পোশাকগুলো রঙ লেগে একাকার। বাইরে সবাই হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত। অথচ এই আনন্দের দিনটাই পদ্মাবতীর জন্য হয়ে উঠেছে কষ্টের একটা দিন। সবাই যখন আবির আর গুলাল নিয়ে রঙ খেলায় মেতে উঠেছে, তখন তিনি নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ লুকিয়ে চাপাকান্নায় কাতর। হঠাৎ চিত্রা এসে দরজায় কয়েকটা ধাক্কা দিলেন।

“এই পদ্মা, সবাই বাইরে আর তুই ঘরে কী করছিস? তাড়াতাড়ি বের হ। সবাই নিচে কতো মজা করছে। আয় তাড়াতাড়ি।”

শোয়া থেকে উঠে বসলেন পদ্মাবতী। দুই গাল রঙে লাল হয়ে আছে। আর চোখ দুটো লাল হয়েছে কান্নায়। বিছানা থেকে নেমে চুল আর শাড়ি ঠিক করে নিলেন। বললেন,

“তুই যা। আমি একটু পরে আসছি। চোখে আবির ঢুকে গেছে। সেটাই পরিষ্কার করছি।”

“আচ্ছা। আমি গেলাম। আসিস কিন্তু তাড়াতাড়ি।”

স্নানঘরে ঢুকলেন পদ্মাবতী। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারছেন না। কেঁদে চোখমুখ একদম ফুলিয়ে ফেলেছেন। এভাবে বাইরে গেলে যেকেউ বুঝে যাবে তিনি কান্না করেছেন। তারপর শুরু হবে হাজারো প্রশ্ন। কী হয়েছে, কেন কান্না করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই তো। কেন কান্না করেছেন তিনি? অর্ণব আর মোহিনীর কথা জানতে পেরে? অর্ণবের জন্য এভাবে কেঁদে চোখ ভাসিয়েছেন তিনি? হয়তো তাই। আজ সকালেও কী সুন্দর সবার সাথে আনন্দে মেতে ছিলেন। তার পাশে থেকেই অর্ণব যখন মোহিনীকে টেনে নিয়ে আবির লাগিয়ে ভালোবাসার কথা বললেন, নিজের চোখকান কোনোটাকেই বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। মুখে আবির লেগে থাকায় অন্যরা তাদের চিনতে পারেনি তাতে কী? তিনি তো ঠিকই চিনতে পেরেছেন তার ভালোবাসার মানুষটাকে। অথচ কালরাতেও কতটা আনন্দে ছিলেন অর্ণবের ফিরে আসা নিয়ে। আর ভাবতে পারলেন না তিনি। আবারও কেঁদে ফেললেন। চিৎকার করে। কিন্তু সেই চিৎকার কারও কানে পৌঁছালো না। কাঁদতে কাঁদতেই মুখে বারবার জলের ঝাপটা দিতে লাগলেন। কিন্তু সেই জলও তার চোখের জলকে ঢাকতে পারলো না। বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত করলেন। হাতমুখ ধুয়ে স্নানঘর থেকে বের হলেন। গালে এখনো রঙের দাগ রয়েই গেছে। স্বাভাবিক হয়ে ঘর থেকে বের হতেই কই থেকে যেন মোহিনী এসে তার দুগাল আবার রঙে রাঙিয়ে দিলেন।

“সবার গালে আবির লেগে আছে। তোর গালে নেই কেন?”

“ধুয়ে ফেলেছিলাম।”

“কিরে, চোখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? কেঁদেছিস নাকি?”

“কাঁদবো কেন? চোখে আবির ঢুকে গিয়েছিল। তাই জল পড়ছিল। এজন্যই তো চোখমুখ ভালো করে ধুয়ে আসলাম।”

“ব্যাপার না। বাইরে চল। আবার রঙ লাগাবো। ঘর নোংরা করলে তো বড়মা সেই তোকে আর আমাকে দিয়েই আবার সব পরিষ্কার করাবেন।”

“তুই যা। আমি আরও আবির নিয়ে আসছি। ছোটমার ঘরে রয়েছে।”

“ঠিকাছে। তাড়াতাড়ি আয়।”

“হুম।”

মোহিনী চলে যেতেই পদ্মাবতীর চোখ দুটো আবার ভরে উঠলো। কান্না দমিয়ে রাখতে গলায় কেমন যেন চাপ অনুভব করলেন। চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই সাথে সাথে মুছে ফেললেন তিনি।

“কয়েক মাসের ভালোবাসার জন্য এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারবো না আমি। ভাগ্যিস মনের সুপ্ত অনুভূতিটা কখনো প্রকাশ করিনি। তোদের মাঝে আমি কখনো ছিলামও না আর আসবোও না। তোর অর্ণব তোরই থাকলো। কিন্তু আমাকে তো অন্তত একবার জানাতে পারতিস। কেন লুকালি মোহিনী?”

শকুন্তলার ঘরে এসে আবিরের থালা নিয়ে বাইরে চলে গেলেন পদ্মাবতী। কিন্তু এই ঘটনাটা শত চেষ্টা করেও কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারছেন না তিনি। বারবার মনে হতেই কান্না উপচে আসছে।
.
.
.
নিজের ঘরে বসে পান সাজাচ্ছিলেন তারানা। রজনী ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন,

“মেহের এখনো বাড়ি ফেরেনি রজনী? সেই কোন সকালে না গেল।”

“ফিরলে তো দেখতেই পেতে আম্মা। ওকি আর এখন এখানে থাকবে?”

পান মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলেন,

“কেন? হঠাৎ এ কথা বলছিস কেন?”

“কাল রাতে তো ওই ছেলেটা গ্রামে ফিরেছে শুনলাম। মোহিনীকে এখন আর এবাড়িতে কিভাবে আটকে রাখবে বলো?”

“মানে? কোন ছেলে? কার কথা বলছিস তুই?”

“আমার কাছে আর কিছু লুকাতে হবে না আম্মা। আমি অন্ধ নই। দেখতে পাই সব। আর এটাই জানি যে তুমি ওদের ব্যাপারে সব জানো।”

“বেশি কথা বলিস না তো রজনী। চুপ থাক।”

“আমি নাহয় চুপ থাকবো। তাই বলে কি এসব লুকানো যাবে? সেদিন তুমি জেনেছো, আজ আমি জেনেছি, কাল ও-বাড়ির লোকজন জানবে। এরপর আস্তে আস্তে গ্রামের সবাই জেনে যাবে। তখন আমরা এখানে টিকে থাকতে পারবো ভাবছো?”

তারানা কোনো জবাব দিলেন না। রজনী আবার বললেন,

“এমনেই গ্রামের সবাই ভাবে ওদের ঘরের ছেলেরা আমাদের জন্য নষ্ট হচ্ছে। আমাদের জন্য ওদের সংসার ভাঙছে। আচ্ছা, ওদের পুরুষরা যদি বাড়িতে ঝগড়া করে এখানে এসে মদ খেয়ে পড়ে থাকে তাহলে সেটার দায় কি আমাদের? চরণ তো তাও ওগুলোকে বের করে দিয়ে আসে। আমরা তো শুধু পেট চালানোর দায়ে একটু নেচে পয়সা কামাই।”

“কী করতে বলছিস তুই সরাসরি বলতো। এতো কথার কী আছে?”

“আমি কী বলবো? শুধু সময় থাকতে মোহিনীকে একটু সামলাও আম্মা। নয়তো ওর জন্য আমাদের ভুগতে হবে। প্রমিতার কথা মনে নেই? ওকে মারার পর কিন্তু সব লোকজন মিলে আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে মারতে চেয়েছিল আমাদের। শুধু ওই জমিদারের বউ বাঁধা দিয়েছিল বলে পারেনি। প্রতিবারই যে পারবে না এমন তো নয়। তাই বলছি সময় থাকতেই কিছু একটা করো তুমি।”

তারানা এবারও নিরবতা পালন করলেন। কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। রজনী বললেন,

“কী হলো? কী ভাবছো?”

“কিছু না। তুই কী বলতে এসেছিলি?”

“ওই পরী ছাদে থেকে দেখেছিল বাইরে লোকজন আবির মেখে ঘোরাঘুরি করছে। তাই বায়না করছিল বাইরে বের হওয়ার।”

“বাইরে বের হতে হবে কেন? চরণকে টাকা দিয়ে বল আবির এনে দিতে। কোথাও বের হবি না তোরা। যা করার ছাদে কর।”

“এই কথাগুলো যদি তুমি মোহিনীকেও বলতে পারতে আম্মা!”

“আমার মুখের ওপর কথা বলিস না তো। খুব বাড় বেড়েছিস তোরা। যা এখান থেকে।”

“যাচ্ছি।”

বলেই রজনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তারানার মন থেকে চিন্তা দূর হলো না।
.
.
.
নিজের মনকে যতই শান্তনা দিক না কেন, তবুও আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছেন না পদ্মাবতী। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছেন। আগের মতো সবার সাথে আনন্দ করছেন না। ব্যাপারটা মোহিনীর নজর এড়ায়নি।

“কী হয়েছে তোর বলতো আমাকে।”

মোহিনীর কথায় চমকে উঠলেন পদ্মাবতী। মোহিনী স্থিরদৃষ্টিতে পদ্মাবতীর দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু পদ্মাবতী কিছুতেই তার চোখে চোখ রাখতে পারছেন না।

“কই? কিছু হয়নি তো। কী হবে আবার?”

“উহু, আমি খেয়াল করেছি। বাড়ির ভেতর থেকে বের হওয়ার পর থেকেই তুই যেন কেমন চুপচাপ মনমরা হয়ে আছিস। আনন্দ করছিস না আগের মতো। একা একা থাকার চেষ্টা করছিস। তাই বলছি ভালোয় ভালোয় আমাকে বলে দে কী হয়েছে।”

মোহিনীর কথায় পদ্মাবতী কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু মোহিনীকে তা বুঝতে না দিয়ে হঠাৎ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হঠাৎ করে এভাবে হাসায় মোহিনী তাজ্জব বনে গেলেন।

“আজব তো। হাসছিস কেন গাধার মতো?”

হাসি থামিয়ে পদ্মাবতী বললেন,

“গাধাকে তুই কবে হাসতে দেখলি?”

“গাধাকে হাসতে দেখিনি কিন্তু তোকে দেখেছি। এবার বল হাসলি কেন ওভাবে?”

“তোর কথা শুনে। আজ-কাল কি চোখে বেশি দেখছিস নাকি তুই?”

“কেন?”

“তা নাহলে যা কেউ দেখছে না সেটা তুই কী করে দেখছিস?”

“তোকে কিছু জিজ্ঞেস করাই উচিত হয়নি। দাঁড়া, আমি বড়মাকে জানাচ্ছি। উনিই তোর পেট থেকে কথা বের করবেন।”

মোহিনী উঠে দাঁড়াতেই পদ্মাবতী তার হাত ধরে টান দিয়ে আবার বসিয়ে দিলেন।

“সবাই কি কম চিন্তায় যে তুই আবার তাদের নতুন করে চিন্তায় ফেলতে চাস? কিচ্ছু হয়নি আমার। ওসব তোর ভুল ধারণা। বস এখানে।”

পদ্মাবতী কিছু হয়নি বললেও মোহিনীর মন মানলো না। কিছু বলতে যাবেন তখনই শকুন্তলা দূর থেকে বললেন,

“রান্নাঘর থেকে মিষ্টির থালাগুলো নিয়ে আয় তো পদ্মা।”

“যাচ্ছি ছোটমা।”

পদ্মাবতী এক মুহুর্ত দেরি না করে চলে গেলেন। যেন মোহিনীকে এড়িয়ে যাওয়ারই একটা সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। মোহিনী আর কিছু বলতে পারলেন না। অর্ণবের দিকে তাকাতেই দেখলেন তিনি আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা গাছের সাথে পা লাগিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা খাচ্ছেন। মোহিনীকে ইশারা করে ডাকতেই তিনি মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলেন। ওদিকে পদ্মাবতীকেও মিষ্টির থালা নিয়ে আসতে দেখলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই মিষ্টিগুলো হাত থেকে পড়ে গেল তার। পায়ে হাতে দিয়ে চিৎকার করে বসে পড়লেন তিনি। সম্ভবত হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছেন। মোহিনী দৌঁড়ে কাছে যেতেই দেখলেন একটা গর্তে পা আঁটকে গিয়েছিল তার। পা’টা খুব বাজেভাবে মোচকে গেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here