#মেহেরজান
#পর্ব-২৫,২৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-২৫
“চিত্রা, তোর কোনো কাজকর্ম নেই? কী বুঝে এখন রঙ্গোলি দিচ্ছিস?”
“রঙগুলো দেখে এমনিই একটু দিতে ইচ্ছে করলো মা। কোনো কাজ থাকলে বলুন। আমি করে দেবো।”
“স্নানঘরে দেখ কাপড় কেঁচে রাখা আছে বালতিতে। জলদি ওগুলো রোদে দিয়ে আয়।”
“আর একটু বাকি আছে মা। এটা শেষ করে এক্ষুনি যাচ্ছি।”
শকুন্তলা আর কিছু না বলে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেলেন। চিত্রা পদ্মাবতীকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে দৌঁড়ে গেলেন তাকে সাহায্য করতে। আজ অনেকদিন বাদে নিজের ঘর থেকে বেরোলেন পদ্মাবতী। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ ছিল বিছানা থেকে ওঠা নিষেধ। তবে পা’টা এখন আগের তুলনায় ভালো আছে। বিশেষ করে শান্তি দেবীর বলে দেওয়া কৌশলে এক বিশেষ তেল মালিশ করার ফল এটা। আম্রপালি প্রতিরাতে তেলটা খুব যত্ন করে তার পায়ে মালিশ করে দিতেন।
“কী রে? কষ্ট করে উঠে এলি কেন? কিছু লাগলে আমাকে বলতি।”
“কিছু লাগবে না।”
“তাহলে?”
“আর কতদিন এভাবে বিছানায় শুয়ে-বসে থাকা যায় বল? কার ভালো লাগে?”
“পা ঠিক আছে?”
“আগের তুলনায় অনেক ভালো।”
“তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে গেলেই ভালো। আমরা সবাই যে ভয় পেয়েছিলাম যে আবার ভেঙে টেঙেই গেল নাকি।”
চিত্রা পদ্মাবতীকে নিচে নিয়ে এসে একটা মোড়ায় বসতে দিলেন।
“এখানে রঙ্গোলি কে দিল?”
“আমি দিয়েছি।”
“ওহহ। আজ মোহিনী আসেনি চিত্রা?”
“আসলে তো দেখতেই পেতি। তোর ঘরেই আগে যেত।”
“তাও ঠিক।”
“ওই দেখ, ওর কথা বলতে না বলতেই চলে এসেছে।”
মোহিনীকে আসতে দেখে বললেন চিত্রা। রঙ্গোলিতে পা ফেলার আগেই চিত্রা চিৎকার করে উঠলেন।
“দাঁড়া।”
মুহুর্তেই নিজের পা পিছিয়ে নিলেন মোহিনী।
“এই ভরদুপুরে এখানে রঙ্গোলি দিল কে?”
“চিত্রা দিয়েছে।”
“তোর কী আর কোনো কাজ নেই চিত্রা?”
চিত্রা জবাব দিলেন না। পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“স্নানঘরে কাপড় কেঁচে রাখা আছে। তুই এখানেই বস। আমি ওগুলো ছাদে দিয়ে আসি।”
চিত্রা চলে গেলে মোহিনী ইশারায় পদ্মাবতীকে জিজ্ঞেস করলেন চিত্রার কী হয়েছে। জবাবে তিনি শুধু কাঁধ ঝাঁকালেন।
“তুই নিচে কী করছিস? পা ঠিক হয়ে গেছে?”
“আগের চেয়ে ভালো।”
মোহিনী পদ্মাবতীর গালে হাত রেখে বললেন,
“তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যা। কত্তোদিন আমরা একসাথে বের হই না।”
“আর ক’দিন বাদেই যেতে পারবো।”
“তুই থাক। আমি বড়মার সাথে দেখা করে আসি।”
পদ্মাবতী মাথা নাড়লেন। মোহিনীকে দোতলায় উঠে যেতে দেখলেন। এবাড়িতে শান্তি দেবী আর অনুরাধা বাদে প্রায় সবার ঘরই দোতলায়। তবে মোহিনীকে আম্রপালির ঘরের দিকে না গিয়ে তার উল্টো দিকে যেতে দেখলেন। বুঝতে অসুবিধা হলো যে মোহিনী আম্রপালির সাথে দেখা করার কথা বললেও এখন অর্ণবের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। পদ্মাবতীর কেন যেন প্রচন্ড খারাপ লাগতে শুরু করলো। নিজেকে সামলাতে না যত দ্রুত সম্ভব ছুটে গেলেন শান্তি দেবীর ঘরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। চোখে চশমা না থাকায় ঠিকমতো দেখতে পেলেন না শান্তি দেবী। “কে কে” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ফলস্বরূপ পদ্মাবতীর কান্নার গতি আরও বেড়ে গেল।
“কে কাঁদে? পদ্মা, তুই নাকি? ওমা, কাঁদছিস কেন ওভাবে? পায়ে কি আবার ব্যথা করছে নাকি?”
পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। শান্তি দেবী আবার বললেন,
“কী হয়েছে বলবি তো?”
“কিছু হয়নি।”
“কষ্ট পেয়েছিস কারও কথায়?”
“না।”
“তবে?”
“চুপ বুড়ি। এতো কথা কেন বলিস? চোখ তো গেছেই, এবার কিন্তু ঠোঁট দুটোও সেলাই করে দেবো।”
“ওমা, রাগছিস কেন? কী হয়েছে বল আমায়।”
“বললাম না কিছু হয়নি।”
“তাহলে এমনি এমনিই কাঁদছিস?”
“হ্যাঁ, এমনি এমনিই কাঁদছি।”
“বুড়ি হয়ে গেছি বলে কি তোরা আমাকে পাগল ভাবিস নাকি? এমনি এমনি কেউ কাঁদে?”
“আমি কাঁদি। আর একবার যদি জিজ্ঞেস করো কেন কাঁদছি তাহলে আর কোনো দিনও মুখ দেখাবো না আমার।”
পদ্মাবতী দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার দৌঁড়ে চলে যাওয়ার সময় নুপুরের আওয়াজটাই শুধু শুনতে পেলেন শান্তি দেবী।
“একি কথা মেয়ের? পদ্মা, কই গেলিরে? আরে ও পদ্মাবতীই।”
কারও সাড়াশব্দ পেলেন না শান্তি দেবী। কপালে কতগুলো চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো তার।
.
.
.
ছাদে থেকে নামার সময় অর্ণবের ঘর থেকে মোহিনীকে বের হতে দেখলেন চিত্রা। সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“দাঁড়া মোহিনী।”
মোহিনী তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন।
“কিছু বলবি?”
“কই গিয়েছিলি?”
“বড়মার ঘরে যাচ্ছিলাম।”
“কই যাচ্ছিস জিজ্ঞেস করিনি। কই গিয়েছিলি জিজ্ঞেস করেছি।”
চিত্রার কণ্ঠটা একটু অন্যরকম শোনালো মোহিনীর কাছে।
“অর্ণবের ঘরে গিয়েছিলাম। শমিতদা একটা কাজে ডাকতে বলেছে ওনাকে।”
“কাকে বোকা বানাচ্ছিস তুই?”
“মানে?”
“আমার সামনে নাটক করিস না মোহিনী। দাদা আর তোর মাঝে কী চলছে খুব ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছি আমি। শমিতদাকে দিয়ে তো চিঠিও আদান-প্রদান করিয়েছিস। কী ভেবেছিলি? কেউ জানবে না?”
মোহিনী কোনো জবাব দিলেন না।
“খুব ভালোই তো ফাঁসিয়েছিস আমার ভাইকে। তুই কী আর তোর যোগ্যতা কী সেটা ভুলে যাস না। তাই এখনই সাবধান হয়ে যা।”
মোহিনী চুপচাপ তার কথাগুলো শুনে গেলেন। চিত্রা চলে গেলেন কিন্তু তার বলা শেষের কথাগুলো হজম করতে পারলেন না মোহিনী। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচে নেমে এলেন। চলে যাওয়ার সময় সামনে চিত্রার করা রঙ্গোলিটা পড়লো। সাথে সাথে পা দিয়ে নষ্ট করে দিলেন পুরোটা। এতে যেন তার রাগ কিছুটা হলেও কমলো। মোহিনী চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে চিত্রা এসে দেখা মাত্রই চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন।
“কে করলো এটা? কতো কষ্ট করে দিয়েছিলাম আমি। কার সাহস হলো এতো?”
তার চেঁচামেচি শুনে সবাই সেখানে উপস্থিত হলেন। শকুন্তলা বললেন,
“এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?”
চিত্রা চড়া গলায় জবাব দিলেন,
“দেখতে পারছেন না? কে যেন আমার দেওয়া রঙ্গোলিটা নষ্ট করে দিয়েছে।”
আম্রপালি ধমকের সুরে বললেন,
“চিত্রা, মায়ের সাথে কীভাবে কথা বলছিস?”
চিত্রা চুপ করে রইলেন।
“বেড়াল টেরাল ঢুকেছিল হয়তো। ওটায়-ই নষ্ট করেছে। তুই রাগ করিস না। আমি তোকে আবার দিয়ে দেবো সুন্দর করে।”
“লাগবে না। আপনার পছন্দের বেড়ালই করেছে এটা। আমি জানি কার কাজ এটা।”
“মানে? কে করেছে?”
“কে আবার? আপনার আদরের মোহিনী।”
“ও এমন করবে কেন শুধু শুধু?”
“সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করবেন।”
চিত্রা রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। পদ্মাবতী সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন,
“আমি আবার দিয়ে দিচ্ছি বড়মা।”
“থাক। ওই পা নিয়ে তোকে আর কষ্ট করতে হবে না। একটু পরই দেখবি ওর রাগ চলে গেছে।”
দোতলায় চোখ পড়তেই দেখলেন অর্ণব দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মাবতীকে ইশারায় ওপরে আসতে বলে ঘরে গেলেন তিনি। এই পা নিয়ে বারবার সিড়ি বেয়ে ওঠানামা করাটা আসলেই কষ্টসাধ্য। তবুও পদ্মাবতী ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এলেন। অর্ণবের ঘরে আসতেই দেখলেন অর্ণবের হাতে একটা ইংরেজি বই। ভাবলেন এই লোকটা কি সবসময়ই বই পড়েন? নাকি তিনিই এমন সময় এ ঘরে আসেন?
“চিত্রা আর মোহিনীর মাঝে ঝগড়া হয়েছে?”
“এমন কিছু তো দেখিনি। ঝগড়া হলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম।”
“তাহলে চিত্রা মোহিনীর ওপর রেগে আছে কেন?”
“জানি না। আজ দুপুরেও ঠিকমতো কথা বলেনি।”
“কেন?”
“তাও জানি না।”
“তাহলে জানোটা কী?”
পদ্মাবতী মাথা নিচু করলেন।
“আচ্ছা, তুমি যাও এখন।”
“শুধু এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকেছিলেন?”
“আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো তো কিছু মনে পড়ছে না আমার। তোমার পড়ছে?”
পদ্মাবতী নাবোধক মাথা নাড়লেন। বললেন,
“নিচে থাকতেই তো জিজ্ঞেস করতে পারতেন। আমি এতো কষ্ট করে আবার সিড়ি দিয়ে উঠলাম।”
“নিজের ঘরে যেতে সেই সিড়ি দিয়েই উঠতে হতো তোমায়। এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”
প্রতিত্তোরে পদ্মাবতী শুধু একদিকে মাথা কাত করলেন।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-২৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
ঘুমের মাঝেই একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘুরলেন মোহিনী। এর মাঝে দুচোখ একবার হালকা খোলায় কাউকে যেন দেখতে পেলেন। কিন্তু যাকে দেখলেন সে আদৌও কি এখানে নাকি মনের ভুল? আলসেমিতে চোখ খুলে উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। চোখ বন্ধ রেখেই আবার সেদিকে ঘুরলেন তিনি। এক চোখ বন্ধ রেখে আরেক চোখ হালকা খুললেন। অর্ণব আয়েসি ভংগিতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন। তার ওষ্ঠাধর হাসছে। মোহিনীকে একচোখ খুলতে দেখে তার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন অর্ণব। এক মুহুর্তেই উঠে বসলেন মোহিনী। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আছে। একবার ভালো করে কচলে নিলেন। চোখে এখন আর ঘুমের কোনো চিহ্নই নেই। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। করবেনইবা কীভাবে? স্বপ্ন নাকি বাস্তব তা বোঝার জন্য নিজের হাতে জোরে চিমটি কাটলেন। ব্যথা অনুভব হওয়ায় মুহুর্তেই আবার হাত দিয়ে সে জায়গাটা ঘষতে লাগলেন।
“এবার বিশ্বাস হলো? স্বপ্ন দেখছেন না। বাস্তবই।”
মোহিনী অর্ণবের কাছে এসে তর্জনী দিয়ে তার দেহ ছুয়ে দেখলেন। অর্ণবের চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে গেল। চুটকি বাজাতেই তার চোখের দিকে তাকালেন মোহিনী। অর্ণব ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
“এখনো বিশ্বাস হয়নি?”
“আপনি এবাড়িতে ঢুকলেন কীভাবে?”
“যেভাবে সবাই ঢোকে। দরজা দিয়ে।”
“মানে বাড়ির সীমানায় ঢুকলেন কীভাবে? দেওয়াল টপকে?”
“আমি কী চোর যে আমাকে দেওয়াল টপকে আসতে হবে?”
“কেউ আঁটকালো না আপনাকে? সবাই আসতে দিল?”
অর্ণব পেছনের দিকে হেলান দিয়ে আরেকটু আরাম করে বসলেন। বললেন,
“কার এতো সাহস যে আমাকে আঁটকাবে?”
রজনী ঘরে ঢুকলেন। হাতে এক কাপ চা। অর্ণবকে দিতেই তিনি বললেন,
“ধন্যবাদ।”
“আর কিছু প্রয়োজন পড়লে ডাকবেন।”
“এখন আর তার প্রয়োজন পড়বে না।”
মোহিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। রজনী চলে যেতেই ধপ করে অর্ণবের পাশে বসে পড়লেন। সামনে আগে থেকেই একটা খালি চায়ের কাপ রয়েছে। অর্ণব চায়ে চুমুক বসাতেই মোহিনী জিজ্ঞেস করলেন,
“কখন এসেছেন আপনি?”
“হবে একঘন্টার মতো।”
“এতোক্ষণ বসে ছিলেন! আমাকে ডাকতে পারতেন।”
“ইচ্ছে করলো না।”
“কেন?”
“আপনার ঘুমন্ত মুখটা দেখার সৌভাগ্য আগে কখনো হয়নি। অপরুপ সুন্দর লাগছিল আপনাকে। তাই আর ডাকিনি।”
“ঘুমিয়ে থেকে ফুলে যাওয়া তৈলাক্ত মুখটা সুন্দর?”
“আপনাকে তো তাই লাগছিল। একদম নিষ্পাপ একটা বাচ্চার মতো করে ঘুমাচ্ছিলেন। হা করে।”
মোহিনী সামান্য হাসলেন।
“কেন এসেছেন?”
“আপনার সাথে দেখা করতে কারণের প্রয়োজন? আর যদি কারণের কথাই বলেন তাহলে আপনি যদি এভাবে এতো বেলা ঘুমিয়ে থাকেন, আমার সাথে দেখা করতে এতো অনিয়ম করেন তাহলে আমাকে তো আসতেই হবে।”
“মোটেও আমি এতো বেলা ঘুমাই না। সকালে উঠেছিলাম। নাস্তা করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচ্ছা, আপনাকে এখানে আসতে কেউ দেখেনি তো?”
“আমি লুকিয়ে লুকিয়ে আসিনি। যারা দেখার দেখেছে।”
“সম্পর্কটা কেন এতো আগাচ্ছেন অর্ণব? যার পরিণতির কোনো নিশ্চয়তাই নেই।”
অর্ণব চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন,
“পরিণতি কী হবে জানিনা। তবে আমি আপনার হাত কখনোই ছাড়বো না মেহেরজান।”
.
.
.
চৈত্রের কাঠফাটা রোদে বারান্দায় রাখা দোপাটি গাছটা নুয়ে পড়ছে একদম। তিনদিন আগেই গাছটা এনে বারান্দায় লাগিয়েছেন পদ্মাবতী। কিন্তু ঠিকমতো যত্ন না নেওয়ায় তার এই হাল। অন্যদিকে নীল অপরাজিতা আর কুঞ্জলতাটা এখনো বারান্দার শোভাবর্ধন করেই যাচ্ছে। পদ্মাবতী চায়ের জন্য কয়েকটা অপরাজিতা তুলে নিলেন। ঘরে এসে টেবিলের ওপর ফুলগুলো রাখতেই জানালার বাইরে চোখ পড়লো তার। মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। জানালার একদম কাছের নিমগাছটায় পাখি বাসা বেঁধেছে। ক’দিন পর ডিম পারবে। তারপর সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। সারাদিন কিচিরমিচির করবে। ভাবতেই খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে পদ্মাবতীর। কত শখ ছিল একটা পাখি পোষার। কিন্তু শকুন্তলার অনুমতি ছিল না বলে সে শখ আর পূরণ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন ঘরে না পুষলেও জানালা দিয়ে তো প্রতিদিন দেখতে পারবেন। আচ্ছা, কী পাখির বাসা এটা? পদ্মাবতী আশেপাশে দেখতে লাগলেন। কিন্তু কোনো পাখি দেখতে পেলেন না। হয়তো খাবারের সন্ধানে কোথাও উড়ে বেড়াচ্ছে। পরে আসলেই দেখতে পারবেন।
“পদ্মা।”
চকিতে পেছনে ঘুরলেন পদ্মাবতী। মটরশুঁটির ডালা হাতে আম্রপালি দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মাবতী ঝটপট এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে ডালাটা নিয়ে বসে পড়লেন খোসা ছাড়াতে। তার সাথে আম্রপালিও বসলেন। খোসা ছিলতে ছিলতে বললেন,
“খেয়েছিস?”
“হুম।”
“কী খেলি?”
পদ্মাবতী একটু ভেবে বললেন,
“ওইতো গরম ভাত, মাছ, ডাল আর…”
আম্রপালি থামিয়ে দিলেন।
“আর মিথ্যে বলিস না। এসবের কিছুই রান্না হয়নি আজ।”
“তাহলে?”
“যদি খেতি তাহলেই দেখতে পেতি। খিচুড়ি, মাংস আর ডিমের তরকারি করেছিল শকুন্তলা।”
পদ্মাবতী শুকনো ঢোক গিললেন। সকালে একবার মাংসের গন্ধ এসেছিস তার নাকে। আরেকটু ভেবে যদি উত্তর দিতেন তাহলে আর ধরা পড়তে হতো না। এ ভেবে আফসোস করতে লাগলেন তিনি।
“মিথ্যে বললি কেন?”
“সত্যি বললে বকুনি দিতেন।”
“বকেছি এখন?”
পদ্মাবতী দুদিকে মাথা নাড়লেন।
“তাহলে? আর খাসনি কেন এখনো?”
“ইচ্ছে করছিল না।”
“ইচ্ছে না করলেই খাবিনা? আয়নায় মুখটা দেখেছিস? আরও শুকিয়ে গেছিস। চোখ দুটো একদম কোটরে চলে গেছে। খাওয়াদাওয়ায় এতো অনিয়ম করছিস কেন?”
“কই অনিয়ম করলাম? আজ খাইনি শুধু।”
“না খেয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘুরে যখন পড়বি তখন টের পাবি কই অনিয়ম করেছিস।”
“আর করবো না।”
“সবসময় এক কথা। আর করবো না! ইদানীং তোকে প্রায়ই দেখি মনমরা হয়ে থাকিস। কেন বলতো?”
“কই? না তো।”
“বললেই হলো? আমার কি চোখ নেই? সত্যি করে বল তোর কী হয়েছে? চিত্রা, মোহিনীর সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
“ওদের সাথে আমার ঝগড়া হতে পারে?”
“তাহলে?”
“কিছুই হয়নি।”
“আজ মায়ের ঘরে গিয়েছিলাম। তার কাছে শুনলাম তুই নাকি কতদিন আগে তার ঘরে গিয়ে কাঁদছিলি?”
এবার পদ্মাবতী বুঝতে পারলেন আম্রপালি কোন উদ্দেশ্যে তার ঘরে এসেছেন। কিন্তু তিনি যাই করুন না কেন, পদ্মাবতী মুখ খুলছেন না কিছুতেই।
“আমি কেন কাঁদতে যাবো? তাও দিদার ঘরে গিয়ে। আমার কি ঘর নেই? দিদার তো এমনিতেই মাঝেমাঝে মাথা ঠিক থাকে না। কী বলতে কী বলেছে কে জানে।”
“তুই তাহলে যাসনি তার ঘরে?”
“যাই তো। শুধু ওষুধ খাওয়াতে যাই। তাছাড়া তো তেমন যাওয়া হয় না দিদার ঘরে।”
আম্রপালি ভ্রু কুঞ্চিত করে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণের জন্য ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। নীরবতা ভেঙে আম্রপালি বললেন,
“অর্ণব যে কই গেছে। সকাল থেকে দেখছি না।”
“ওনাকে তো সকালে বাইরে যেতে দেখলাম।”
“কোন দিকে গেছে?”
“তা জানি না। শমিতদার সাথে গেছেন হয়তো।”
“কিন্তু শমিতকে তো ওর ঘরেই দেখে এলাম।”
পদ্মাবতী ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকালেন।
“তাহলে জানি না।”
“ইদানীং প্রায়ই ও যেন কই যায়। কিন্তু কই যায় তা দেখতে পারিনি।”
“কোনো কাজেই যায় নিশ্চয়।এতো চিন্তা করবেন না। সে তো আর বাচ্চা না।”
“বাচ্চা না তাতে কী? সন্তান ছোট হোক আর বড় হোক, সন্তানের জন্য মায়ের মন সবসময়ই চিন্তিত থাকে।”
পদ্মাবতী ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন।
চলবে…