মেহেরজান #পর্ব-৩৪,৩৫

0
604

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৪,৩৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-৩৪

“বাড়ি চলেন অর্ণব বাবা। মালকিন আপনের লাইগা অনেক চিন্তায় আছেন। খাওয়াদাওয়াও ছাইড়া দিছেন। একদম অসুস্থ হইয়া পড়ছেন।”

বেশ মনোযোগ দিয়ে মোহিনীর সাথে দাবা খেলছিলেন অর্ণব। নিজের চালটা চেলে জবাব দিলেন,

“আসলেই অসুস্থ নাকি আমাকে বাড়ি ফেরানোর জন্য আবার কোনো নতুন নাটক করছেন উনি? যেমনটা বিয়ে করানোর জন্য করেছিলেন।”

“আসলেই তার শরীলডা তেমন ভালা না। আটদিন হইয়া গেল আপনে বাড়িতে নাই। আপনের চিন্তায় চোখের নিচে কালি পইড়া গেছে একদম। উপায় না পাইয়া সেই আবার আমারেই পাঠাইছেন আপনেরে নিয়া যাওনের লাইগা।”

“কেন? ওনার আসতে কী অসুবিধা ছিল?”

রামু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“ওইযে কইলাম না? তার শরীলডা ভালা না তেমন। তাই আমারেই পাঠাইছে।”

মোহিনী বলে উঠলেন,

“বাড়ি ফিরে যান অর্ণব। আপনার মা, স্ত্রীসহ সকলে অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। এভাবে আর কতদিন?”

‘স্ত্রী’ শব্দটা বেশ জোর দিয়েই বললেন মোহিনী। অর্ণব চোখ তুলে তার দিকে তাকালেন। মোহিনীর দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,

“আপনি চলে যান কাকু। আমার যখন মনে হবে তখন আমি নিজেই ফিরে যাব।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রামু। আজ তৃতীয়বারের মতো অর্ণবকে বোঝানোর জন্য এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এবারও তাকে খালি হাতেই ফিরতে হবে। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

“এখানে থেকে কী বোঝাতে চাচ্ছেন আপনি? আমাকে খুব ভালোবাসেন?”

“আপনাকে ভালোবাসি তা আবার বোঝানোর প্রয়োজন আছে?”

“সেদিন বললাম পালিয়ে যেতে। আপনি এলেন না। কখনো ভাবিওনি এভাবে বিয়ে করে ফেলবেন।”

“আমি আপনাকে তখনই বলেছিলাম যে পালানো কোনো সমাধান নয়।”

“তাহলে সমাধান কী ছিল? পদ্মাকে বিয়ে করা?”

“আমি আপনাকে আগেও বলেছি আর আবারও বলছি। বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি। তাই এটা নিয়ে বারবার কথা শোনাবেন না।”

“এমনভাবে বলছেন যেন কিছুই হয়নি। বাচ্চা নাকি আপনি যে আপনার ইচ্ছে না থাকলেও ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেবে?”

“মনে করুন তাই-ই। বাচ্চা না হলেও বিয়েটা আমাকে ধরে বেঁধেই করানো হয়েছে। আমি তখন কোন পরিস্থিতিতে ছিলাম তা আপনি জানেন না মেহের। তাই বুঝতেও পারবেন না।”

“তো এখন যান না নিজের বউয়ের কাছে। এখানে এসে পড়ে আছেন কেন?”

“যাবো না। আপনার কাছেই থাকবো। কী করবেন আপনি?”

মোহিনী মুখ বাঁকা করে বসে রইলেন। তার এমন কান্ড দেখে মুচকি হাসলেন অর্ণব। খুব খাটাখাটুনির পর মোহিনীর রাগ গলাতে পেরেছেন তিনি। দ্বিতীয়বার আর তার ক্রোধের অনলে পুড়তে চান না।
.
.
.
রামুকে এবারও খালি হাতে ফিরতে দেখে হতাশ হলেন আম্রপালি। সেসময় অর্ণবের চলে যাওয়াটায় তেমন একটা গুরুত্ব না দিলেও এখন বুঝতে পারছেন বিষয়টা বেশ গুরুতর। নিজের সিদ্ধান্তের ওপরই সংশয় হচ্ছে তার। আদৌও কি তিনি সঠিক নাকি অনেক বড় ভুল করে ফেললেন। দেওয়ালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পদ্মাবতী। কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তা মুছে নিয়ে নিজের মনকে শক্ত করলেন। সবে তো শুরু। কে জানে কপালে কী আছে তার। সোজা রান্নাঘরে চলে এলেন তিনি। দেখলেন শেফালী কলার মোচা কাটছেন। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে তিনিও কাজে লেগে পড়লেন।

“অর্ণবদা এবারও এলেন না?”

“না।”

নিচু স্বরে বললেন পদ্মাবতী।

“তুই কী আশা করেছিলি? আসবেন উনি? মেনে নেবেন সব?”

“আশা করা ছেড়ে দিয়েছি আমি। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”

“এখন সব ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না পদ্মা। কই? বিয়ের আগে তো ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিসনি। বুদ্ধি দিয়ে নিজের করে নিয়েছিস অর্ণবদাকে।”

“নিজের করতে পারলাম কই? উল্টো জোর করে ঘাড়ে চেপে বসেছি বলতে পারিস। কাঁটার মতো বিঁধে আছি ওনার গলায়। না পারছেন গিলতে আর না পারছেন উগলে দিতে। সব ছেড়ে ছুড়ে নিজের প্রেমিকার কাছে গিয়ে পড়ে আছেন।”

“শোন পদ্মা, এসব এতো ছোট করে দেখিস না। মোহিনী অর্ণবদার প্রেমিকা ছিল। আর এখন তুই অর্ণবদার বউ। কীভাবে মেনে নিচ্ছিস এসব? আমি হলে তো পারতাম না শমিতকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে দেখতে।”

“তোদের বিষয়টা ভিন্ন। তোরা ভালোবাসতিস একে অপরকে। আমাদের তো আর তা নয়।”

“তাতে কী? পুরুষ মানুষের মন বলে কথা। কখন কার ওপর আসে বলা যায় না। বিয়ের আগে ভালোবাসেনি বলে বিয়ের পরে বাসবে না এটা কী করে বলিস? সবাই কি আর প্রেম করে বিয়ে করে নাকি?”

“কী বলতে চাস তুই?”

“মোহিনীর প্রতি অর্ণবদার যে ভালোবাসাটা ছিল সেটা নিজের জন্য অর্জন কর। সরিয়ে দে মোহিনীকে তোদের জীবন থেকে। একদম ভুলিয়ে দে ওকে।”

তাচ্ছিল্যভরে হাসলেন পদ্মাবতী।

“হাসছিস কেন? ভুলটা কী বলেছি আমি?

“যার ভালোবাসার ধারের কাছেও আমি নেই, তার ভালোবাসা নাকি আবার অর্জন করবো!”

“তা নয়তো কী?”

“যার জন্য এসব করবো সে নিজেই তো এখানে নেই। করবো কী করে?”

“চিন্তা করিস না। আজ রাতে শমিত ফিরবে। ওকে আমি আগেই টেলিফোনে বলেছি তোদের বিয়ের কথা। এলে আবার খুলে বলবো পুরোটা। ও ঠিকই অর্ণবদাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনবে দেখিস তুই।”
.
.
.
শমিত স্নানঘর থেকে হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই শেফালী তার দিকে একটা তোয়ালে এগিয়ে দিলেন। মুখ মুছে শমিত বললেন,

“জানো, আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে অর্ণব আর পদ্মার বিয়ে হয়ে গেছে।”

“বিশ্বাস না করে উপায় নেই। তাই কষ্ট হলেও বিশ্বাস করে নাও।”

“অর্ণব আছে কই এখন?”

“মোহিনীর ওখানে।”

“কী! তুমি তো আমাকে বলেছিলে অর্ণব বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু মোহিনীর ওখানে যে গেছে, এটা তো বলোনি।”

“ওভাবে কী আর এতোকিছু বলা যায়? এখন তুমি এসেছো। আস্তেধীরে আবার শুরু থেকে বুঝিয়ে বলবো সব।”

“তা বলো। কিন্তু এখন খেতে দাও। এতোটা রাস্তা এসেছি। আসতে আসতে খিদে পেয়েছে খুব। পেটে খিদেই চো চো করছে।”

“অপেক্ষা কর কিছুক্ষণ। রান্না বসিয়ে এসেছি। তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে তা তো আর আগে জানতাম না। ভেবেছিলাম রাত হবে অনেক।”

“আমিও তো তাই-ই ভেবেছিলাম।”

“ব্যবসা কেমন চলছে?”

“সে চলছে বেশ।”

“মামা এলেন না?”

“দু’জনই চলে আসলে ওদিকটা কে দেখবে? ওখানেও তো কাউকে থাকতে হবে নাকি?”

“তাও ঠিক।”

“বাদ দাও ওসব। আগে বলো তুমি কেমন আছো?”

“যেমনটা ছেড়ে গিয়েছিলে।”

“আমি কি আর ইচ্ছে করে গিয়েছি নাকি? কতদিন তোমাকে দেখিনি। মনে হচ্ছে যুগ পেরিয়ে গেছে।”

“কী করবে বলো? তোমার মা তো আমাদের আলাদা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। রাতে একঘরে থাকতে দেন কিনা দেখ।”

“ধুর। আবোলতাবোল বলো না তো। মা এতোটাও খারাপ না যতটা তুমি ভাবো।”

“কেন? ভুল তো বলিনি। বিয়ের পর তুমি যতদিন বাড়িতে ছিলে, তোমার ধারের কাছেও থাকতে দেননি উনি আমাকে। রাতে পদ্মার ঘরে ঘুমোতে হতো। এরপর জোর খাটিয়ে এ-ঘরে ঢুকতে হয়েছে আমাকে। আমার স্বামীর ঘরে আমি থাকবো না তো কে থাকবে?”

শেফালীর কথা শুনে সামান্য হাসলেন শমিত। বললেন,

“তুমিই থাকবে। কার এতো সাহস যে তোমাকে এ-ঘরে থাকতে দেবে না।”

“থাকবে কয়দিন এখানে?”

“এসেছি তো দু’সপ্তাহের জন্য। এখন দেখি ক’দিন থাকতে পারি। যতদিনই আছি, তোমাকে খুব আদর করবো। কতদিন পর বউটাকে কাছে পেলাম আমার।”

হাত ধরে এক টানে শেফালীকে কাছে টেনে নিলেন শমিত। চেঁচিয়ে উঠলেন শেফালী।

“এই কী শুরু করলে? ছাড় আমাকে। দরজা খোলা আছে। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ।”

“কিসের সর্বনাশ? আমার বউকে আমি আদর করছি। তাতে কার কী?”

শেফালীর গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। শমিতের চোখে চোখ মেলাতে পারছেন না তিনি।

“ছাড় আমাকে। রান্না পুড়ে যাবে। তুমি না বললে তোমার খিদে পেয়েছে। নিচে আসো। আমি খাবার বাড়ছি।”

নিজেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শেফালী।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

বাড়ির সদরদরজার সামনে পায়চারি করছেন শমিত। আর একটু পর পরই বাইরে উঁকি দিয়ে দেখছেন। অবশেষে অর্ণবকে আসতে দেখেই এগিয়ে গেলেন সেদিকে। তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। শমিতের আসার খবর পেয়ে অর্ণবও আর সেখানে বসে থাকতে পারলেন না। চলে এলেন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। কোলাকুলি করে শমিত বললেন,

“কী খবর বন্ধু?”

“খবর তো দেখতেই পারছিস।”

“এতোদিন পর দেখা হলো। চল ছাদে গিয়ে আড্ডা দেই। বাজার থেকে বড় বড় মিষ্টি আম আনিয়েছি তোর আর আমার জন্য। শেফালীকে বলে রেখেছি তুই এলে কেটে দিতে। হয়ে যাক আবার তোর আমার সেই ছেলেবেলার মতো আম খাওয়ার প্রতিযোগিতা।”

“দাঁড়া তাহলে। আমি ঘরে গিয়ে একটু হাতমুখ ধুয়ে আসছি।”

“আরে আমার ঘরে চল। একই তো হলো।”

শমিত অর্ণবকে তার ঘরে নিয়ে এলে অর্ণব চোখে মুখে জল ছিটিয়ে নিলেন। দুপুরে খাওয়ার পর লম্বা একটা ঘুম দিয়েছিলেন অর্ণব। ঘুম ভেঙেছে রামুর ডাকে। এরপর মোহিনীকে কোনোরকম জানিয়ে ঘুম ঘুম চোখেই চলে এসেছেন তিনি। তাকে বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে রামুও নিজের কাজে চলে গেছেন। হাতমুখ ধুয়ে শমিতের সাথে ছাদে চলে গেলেন তিনি। কারও সাথে দেখা করার প্রয়োজনবোধ করলেন না।

“এবার বল। এসব হলো কী করে? মানে এমন কী হলো যে তোর আর পদ্মার বিয়ে হয়ে গেল?”

“তুই যাওয়ার পরে এখানে অনেককিছুই ঘটেছে। হঠাৎ করে মা যেন কেমন পাল্টে গেলেন। মোহিনীকে দেখতেই পারেন না একদম। পদ্মাবতীর সাথে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। যেদিন বিয়েটা হলো সেদিন সকালে ঠাম্মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাই। ঠাম্মার অসুস্থতাকেই কাজে লাগিয়েছেন মা। আসলে সবই ছিল ছোটমার মায়ের বুদ্ধি। কে জানে কীভাবে কী বুঝিয়েছেন মা আর ঠাম্মাকে। প্রথমে তো শুধু মা ছিলেন। এরপর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ঠাম্মাও একই কথা শুরু করলেন। বাধ্য হয়েই বিয়েটা করতে হয় আমাকে।”

“তার মানে সবকিছুর পেছনে ছিল ছোটমার মা। এই বুড়িটা তো দেখা যায় সুবিধার না একদমই। উনিই কিন্তু বলেছিলেন তোকে আর আমাকে মামার কাছে পাঠাতে। শুধু মা বাঁধা দিয়েছিলেন বলে আমাকে পাঠাতে পারেননি। তোকে একাই যেতে হয়েছে।”

“আছে নাকি এখনো বাড়িতে?”

“ছোটমার মা।”

“নাহ। আমি এসে তো দেখিনি। চলে গেছেন বোধহয়।”

“ঠাম্মাকে দেখেছিস? কেমন আছেন এখন?”

“হ্যাঁ, ঘরেই আছেন। দেখে তো সুস্থই মনে হলো। আদৌও কি অসুস্থ হয়েছিলেন নাকি এখানেও তোকে বোকা বানানো হয়েছে?”

শমিতের প্রশ্নে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন অর্ণব। তার কথা একদম ফেলে দেওয়ার মতো না। আগে এটা কেন মাথায় আসেনি অর্ণবের? শেফালী বড় একটা থালায় আম নিয়ে ছাদে আসলেন। তাদের সামনে থালাটা রেখে বললেন,

“কী খবর অর্ণবদা? আমাদের সবাইকে তো একদম ভুলেই গিয়েছিলেন মনে হয়। জানেন বড় মামি কত্তো দুশ্চিন্তা করছিলেন আপনার জন্য?”

“এইতো। আছি কোনরকম। ভালো আছিস তুই?”

শেফালীর দ্বিতীয় প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন অর্ণব।

“হ্যাঁ, অনেক ভালো আছি।”

“পিসির সাথে ঝগড়া করিস না তো আবার?”

“না না, উনিও আমাকে এড়িয়ে চলেন আর আমিও ওনাকে।”

তার কথায় অর্ণব, শমিত দু’জনেই হেসে উঠলেন। শেফালী চলে গেলে শমিত বললেন,

“তারপর, এখন কী করবি ঠিক করলি?”

“কোন বিষয়ে?”

“আরে তোর বিয়ের কথা বলছি। একদিকে মোহিনী আরেকদিকে তোর বউ। ইয়ে মানে পদ্মা। কী করবি তুই?”

“জানি না। তবে শীঘ্রই এর একটা সমাধান বের করবো।”

শমিত এ-বিষয়ে অর্ণবকে কোনো পরামর্শ দিতে পারলেন না। কারণ তিনি জানেন অর্ণবের জীবনে মোহিনীর গুরুত্ব ঠিক কতটা। আবার পদ্মাবতীকে ছেড়ে দিতেও বলতে পারেন না। যতই হোক, পদ্মাবতীকে নিজের বোনের থেকে কম মনে করেন না তিনি।
.
.
.
সাদা রঙের ফুলগুলো যেন একটু বেশিই প্রিয় পদ্মাবতীর। তাই বাড়ির সামনে গন্ধরাজ, টগর, শিউলি, হিমচাঁপা, বেলী আর কামিনীর চারা লাগিয়েছিলেন তিনি। সারাবছরই যখন কোনো না কোনো ফুল ফুটে থাকে,তখন মন আসলেই খুশিতে ভরে ওঠে তার। তবে আজ সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখতেও মন্দ লাগছে তার। ফুলে কেমন লাল হয়ে আছে গাছটা! মোহিনীর পছন্দে একটা নাগচাঁপা গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। এখন আর গাছটার যত্ন নেন না একদমই। তবুও দিব্যি কী সুন্দর ফুল দিয়ে যাচ্ছে গাছটা। বেলীর একটা চারা তুলে অর্ণবের ঘরে নিয়ে এলেন পদ্মাবতী। এ-ঘরের বারান্দাটা বড় হওয়ায় অর্ণবের অনুপস্থিতিতে টবে করে বেশ কিছু গাছ লাগিয়েছিলেন এখানে। বেলীর চারাটা ভালো করে পুতে জল দিয়ে হাত ধুয়ে নিলেন তিনি। এরপর অর্ণবের বইগুলো মুছে আবার গুছিয়ে তাকে রাখতে লাগলেন। বেশ ধুলো পড়ে গেছে বইগুলোর গায়ে। অর্ণব নিজের ঘরে ঢুকতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। পদ্মাবতীকে এখানে আশা করেননি তিনি। মাত্র কয়েকদিনে ঘরের নকশাই পাল্টে গেছে একদম। এবার বুঝতে পারলেন শমিত কেন তাকে তার ঘরে আসতে দিচ্ছিলেন না। জোর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন।

“তুমি এ-ঘরে কী করছো?”

“মানে? আমার তো এ-ঘরেই থাকার কথা। তাই না? অবাক হওয়ার তো কিছু নেই।”

অর্ণবের কথা বাড়াতে একদমই ইচ্ছে হলো না। পদ্মাবতী যে তার ঘরটা দখল করে নিয়েছেন তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন। পোশাক বের করতে গিয়ে আলমারি খুলতেই আরেক দফা ধাক্কা খেলেন তিনি। এখানে শুধু পদ্মাবতীর শাড়ি। অর্ণবের একটাও পোশাক নেই। রাগান্বিত স্বরে বললেন,

“আমার জামাকাপড় কই? ওগুলো কী করেছো তুমি?”

“এতোক্ষণ ছাদে ছিলেন দেখেননি? ধুয়ে শুকোতে দিয়েছি ওগুলো। নিজের কাপড়-চোপড় ঠিক মতো ধুতে দেন না কেন আপনি? ঘামের গন্ধ আসছিল ওগুলো দিয়ে।”

“তাহলে এখন আমি কী পরবো?”

“নিচের তাকে দেখুন। আরও অনেকগুলো রাখা আছে। ওখান থেকে নিন। আমি ছাদে থেকে ওগুলো নিয়ে আসছি।”

অর্ণব দেখলেন তার সব পোশাক ধুয়ে ইস্ত্রি করে ভাজ করে রাখা আছে নিচের তাকে। ধুতি পাঞ্জাবী বের একটা তোয়ালে নিয়ে স্নানঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,

“আমার জিনিসপত্র ধরবে না তুমি।”

পদ্মাবতী মুচকি হেসে ছাদে চলে গেলেন। অর্ণব স্নান করে বের হতেই দেখলেন ছাদে থেকে আনা তার সব কাপড় বিছানায় রেখে দিয়েছেন পদ্মাবতী। এতে কিছুটা বিরক্তও হলেন তিনি।

“আপনি আপনার জিনিস আমাকে ধরতে মানা করেছেন তাই এনে ওভাবেই রেখে দিয়েছি কাপড়গুলো। নিজে ভাজ করে রাখবেন।”

“নিজেকে খুব চালাক ভাবো তুমি?”

“কেন?”

“কী ভেবেছো? তোমার এই হাসিখুশি চেহারা দিয়ে বশ করে ফেলতে পারবে সবাইকে? মায়ায় জড়িয়ে ফেলবে? সুন্দর মুখটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তোমার কুৎসিত মনটা কেউ দেখতে পারবে না ভেবেছো?”

অর্ণবের বলা কথাগুলো যেন পদ্মাবতীর হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধলো। তার ব্যথা এই নরম মনটা নিতে না পারায় অশ্রু হয়ে ঝরছে।

“কী করেছি আমি? এভাবে কেন কথা বলছেন?”

“এতোকিছু করার পরও বলো কী করেছো? আফসোস। বিশ বছর একসাথে থাকার পরও মেহের তোমাকে চিনতে পারেননি।”

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“সে কথা তোমাকে বলতে হবে এখন?”

ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন অর্ণব। নিজের বাবার খালি পড়ে থাকা বন্ধ ঘরে ঢুকলেন। ঘরটা বন্ধ থাকলেও একদম পরিষ্কার। অর্ণব জানেন তার মা প্রতি সপ্তাহে ঘরটা পরিষ্কার করে যান। মায়ের কথা মনে পড়তেই মনে হলো তার ঘরে এখনো যাওয়া হয়নি। দেখা করা হয়নি এখনো তার সাথে। যাবেন কি যাবেন না একবার ভেবে আবার মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেরে ফেললেন অর্ণব। দরজা আটকে জানালা খুলে দিলেন। এ ঘরে কোনো বারান্দা নেই। জানালা খুলতেই চোখে পড়লো বাড়ির পেছনের বাগান আর দিঘিটা। বাগানটা কোনো জঙ্গলের থেকে কম মনে হয় না। কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে। তখন এই বাগানটাই জোনাকির আলোয় ভরে উঠবে। বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতেই যেন চোখে ঘুম চলে এলো। আজকাল ঘুমটা যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে তার। দিনের বেশিরভাগটাই কাটে ঘুমিয়ে। তবুও যেন চোখে সবসময় ঘুম লেগে থাকে তার।

________________________

পাখির কলরবে ঘুম ভাঙলো শেফালীর। শমিতের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছেন তিনি। ঘুম ঘুম চোখে শমিতের দিকে তাকালেন। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন তিনি।

“দেখ কেমন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে!”

শমিতের নাক চেপে ধরলেন শেফালী। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে উঠলেন শমিত। নাক ছেড়ে দিয়ে হাসলেন শেফালী। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা খুলে দিতেই ভোরের আলো এসে লাগলো তার মুখে। শমিত আগের মতোই ঘুমাচ্ছিলেন। চোখে আলো লাগতেই উল্টো ঘুরে গেলেন। বাগানে অর্ণবকে হাঁটতে দেখলেন শেফালী। কাল অনেক রাতে দেখেছিলেন হাতে বেলীফুলের গোড় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। নিশ্চয়ই মোহিনীর কাছে গিয়েছিলেন। একটা শাড়ি নিয়ে স্নানঘরে চলে গেলেন শেফালী। এরপর পূজো করে রান্নাঘরে যাবেন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here