মেহেরজান #পর্ব-৩৬,৩৭

0
584

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৬,৩৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-৩৬

“শুকনো মরিচের ডালাটা ঘরে নিয়ে যা তো, পদ্মা। দুপুরে যাও একটু রোদ ছিল। এখন তো একদম মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ।”

শকুন্তলা বলতে না বলতেই পদ্মাবতী মরিচের ডালা নিয়ে চলে গেলেন। ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে বসেছেন আম্রপালি আর শকুন্তলা। বহুদিন হয়ে গেছে এভাবে ছাদে এসে বসা হয় না তাদের। তাই আজ একটু সুযোগ পেতেই চলে এসেছেন।

“অর্ণবটা এখনো আমার সাথে কথা বলে না।”

“সবুর করো দিদি। ক’দিনই বা রাগ করে কথা না বলে থাকবে? সবটা হচ্ছে মোহিনীর জন্য। অর্ণব প্রতি রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। নিশ্চিত মোহিনীই আমাদের নামে ওর কানে বিষ ঢালছে।”

“বিয়েটা দিয়ে আমি আবার কোনো ভুল করলাম না তো?”

“কী সব যা-তা বলছো? ভুল করবে কেন? তুমি একদম ঠিক করেছো। অর্ণবও এটা তাড়াতাড়িই বুঝতে পারবে।”

“কিচ্ছু ঠিক লাগছে না। সব কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল মনে হচ্ছে। যে মেয়েটাকে আমি এতো ভালোবাসতাম। তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।”

“মোহিনী তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিল? তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছে।”

“তবুও। কিচ্ছু ঠিক যাচ্ছে না শকুন্তলা। মনটা সবসময় কেমন অশান্ত হয়ে থাকে। কিচ্ছু ভালো লাগে না।”

“তুমি চিন্তা করো না বেশি। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ভুলে যাও পুরনো সব কথা।”

“কত দিন হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখিনা! ওকে বড্ড দেখছে ইচ্ছে করছেরে।”

“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে দিদি? এখনও ওই মেয়েটার কথাই ভাবছো? ও তোমার ছেলের সংসার ছারখার করে দিচ্ছে সেটা দেখছো না?”

শকুন্তলা উঠে দাঁড়ালেন। ছাদের গাছগুলোতে জল দিতে লাগলেন। হলদে কবরীতে ভরে গেছে একটা গাছ। জল দিতে দিতে বললেন,

“ফুলগুলো দেখছো দিদি? যতটা সুন্দর তার চেয়েও বেশি বিষাক্ত। মোহিনী হলো ঠিক এমন। ওপরটা সুন্দর হলেও ভেতরটা বিষে ভরা।”

“কবরী যতই বিষাক্ত হোক। তবুও তো মানুষ গাছ লাগায়।”

শকুন্তলা বিরক্তি নিয়ে বললেন,

“আমাদের পরিবারটা ধ্বংস করে দিতে ওই একটা মেয়েই যথেষ্ট। এখন না বুঝলেও যেদিন আমাদের একটা বড় কোনো ক্ষতি করে দেবে, তখন বুঝবে।”

আম্রপালি জানেন শকুন্তলা ভুল কিছু বলেননি। এই পরিবারটা ভেঙে ফেলতে মোহিনীই যথেষ্ট। অর্ণবকে যেন তিনি একদম নিজের বশে নিয়ে ফেলেছেন। মোহিনীকে ছাড়া যেন অর্ণব আর কাউকে চেনেন না। এ-বাড়ির লোক যেন তার কেউ-ই নয়।
.
.
.
“ঠাম্মা।”

অর্ণব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেই শান্তি দেবী মুচকি হাসলেন। হাত দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকলেন তাকে। অর্ণব যেন এরই অপেক্ষায় ছিলেন। দ্রুত ভেতরে আসলেন তিনি। হামানদিস্তায় পান-সুপারি পিষছেন শান্তি দেবী। তাতেই ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। দাঁতে আর আগের মতো জোর নেই এখন তার। শান্তি দেবীর সাথে কথা বলার সময় অর্ণবের মুখে সবসময় একটা হাসি লেপ্টে থাকে। তার পাশে এসে বসে বললেন,

“ভালো আছো তো ঠাম্মা?”

শান্তি দেবী পান মুখে দিতে দিতে বললেন,

“আমি তো ভালোই। তুই ভালো আছিস নতুন বউ নিয়ে?”

“আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়ে এখন জিজ্ঞেস করছো ভালো আছি কিনা?”

পদ্মাবতী, শান্তি দেবীর ঘরে ঢোকার সময় অর্ণবের কথার আওয়াজ পেতেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেওয়ালে কান লাগিয়ে চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন।

“এলোমেলো করেছি? কই?”

“এইযে পদ্মাবতীর সাথে বিয়ে করিয়ে।”

শান্তি দেবী ইতোমধ্যেই আরেকটা পান সাজাতে শুরু করেছেন।

“কেন? পদ্মা তো ভালো মেয়ে।”

“ভালো না ছাই। আমি মেহেরকে ভালোবাসি জেনেও মায়ের কথায় আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো।”

“মেহের আবার কে? আগে তো শুনিনি এ নাম।”

“তোমাদের মোহিনী।”

“ওকে মেহের ডাকিস?”

“হ্যাঁ, ওর নাম মেহেরজান। ওর মায়ের দেওয়া নাম। যেটা আমার মা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।”

“তুই ভালোবাসতিস ওকে?”

অর্ণব মুচকি হেসে বললেন,

“এখনো বাসি। তুমি জানতে না? মা বলেননি তোমাকে?”

শান্তি দেবীর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। কিছু একটা ভাবতে লাগলেন তিনি।

“ঠাম্মা?”

“হুম।”

“সেদিন হঠাৎ করে অসুস্থ হলে কীভাবে তুমি?”

“কোন দিন?”

“আমার বিয়ের দিন।”

শান্তি দেবী কোনো উত্তর দিলেন না। অর্ণবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

“বাদ দাও। আয়ায়া।”

অর্ণব বড় করে হা করতেই শান্তি দেবী সাজানো পানটা তার মুখে ঢুকিয়ে দিলেন। অর্ণব পান চিবুতে চিবুতে দু’হাত মাথার নিচে রেখে শুয়ে পড়লেন। শান্তি দেবীর এখনো মনে আছে অর্ণব ছোটবেলায় প্রায়ই তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তেন গল্প শোনার জন্য। তিনি মাঝেমাঝে এভাবেই পান সাজিয়ে তার মুখে দিয়ে দিতেন। পান চিবুতে চিবুতেই ঘুমিয়ে যেতেন অর্ণব। ঠোঁট দুটো একদম লাল টকটকে হয়ে যেত তার।
.
.
.
অন্ধকারে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন পদ্মাবতী। বারান্দার কোণায় রাখা বেলীফুলের গাছটা থেকে কী সুন্দর মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। সন্ধ্যে থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। তার রূপোলী আলোয় সাদা সাদা ফুলগুলো দেখা যাচ্ছে। কোথাও ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে একনাগাড়ে।

“অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী করছিস পদ্মা?”

“এখানে আসুন বড়মা। আকাশে কত বড় চাঁদ উঠেছে দেখে যান।”

আম্রপালি পদ্মাবতীর পাশে এসে দাঁড়ালেন।

“আগেই দেখেছি আমি।”

“আপনি এখানে যে?”

“মাথাটা খুব ধরেছে। ঘরে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোকে একটু দেখে যাই।”

“চা খাবেন? আঁদা চা? দাঁড়ান, আমি বানিয়ে আনছি। এখানেই থাকুন।”

পদ্মাবতী আম্রপালির উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। দৌঁড়ে চলে গেলেন। সামান্য হাসলেন আম্রপালি। বিড়বিড় করে বললেন,

“মেয়েটার ছটফটানি এখনো গেল না।”

আম্রপালি সামনে তাকালেন। বাগানে হালকা আলো জ্বলছে। ওপর থেকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। সাজানো গোছানো পরিপাটি একটা বাগান। আগে বাগানটা ছিল না। পদ্মাবতীর দীর্ঘদিনের পরিশ্রম এটা। গাছ লাগাতে খুব ভালোবাসেন তিনি। ছোটবেলায় মেয়েটা যেখানে যে গাছ দেখতেন তা-ই তুলে সাথে করে নিয়ে আসতেন। খুব যত্ন করে লাগাতেন। অবশেষে আম্রপালি তাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে তার পছন্দ মতো সব গাছ কিনে এনে দিয়েছিলেন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই পদ্মাবতী দু কাপ চা নিয়ে চলে এলেন। আম্রপালি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,

“অর্ণব কোথায়রে?”

পদ্মাবতীর মুখটা মলিন হয়ে গেল। মাথা নিচু করে বললেন,

“জানি না।”

“তুই ভালো আছিস তো পদ্মা?”

“ভালো না থাকার কী আছে?”

“আমার প্রতি তোর মনে রাগ পুষে রাখিসনি তো?”

“ছিঃ! তা হতে যাবে কেন?”

“এইযে নিজের ছেলের ভালোর জন্য তোর সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিলাম। তুই ভালো থাকবি না জেনেও।”

“আপনি তো আমাকে সবটা জানিয়েছিলেনই। তবুও আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম। এখন ভালো থাকি আর খারাপ থাকি, তার দায়ভার তো আমারই।”

“বাদ দে এখন এসব কথা।”

পদ্মাবতী চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। কোথাও থেকে গানের সুর ভেসে আসছে ধীরে ধীরে। কেউ গান গাইছে।

“চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা তোমার, গন্ধসুধা ঢালো।”

“শকুন্তলা গান ধরেছে।”

“হুম। শুনছি।”

“খুব মিষ্টি গলা মেয়েটার। ভালো গায়।”

“আগে আমরা সবাই একসাথে বসে ছোটমার গান শুনতাম। আমি, চিত্রা, মোহিনী। এখন কেউ নেই।”

“ভুলে যা আগের কথা।”

“বড়মা, আমার জায়গায় মোহিনী বউ হয়ে আসলে কী হতো? উল্টো আজ সবকিছু আগের মতোই ভালো থাকতো।”

আম্রপালি পদ্মাবতীর মাথায় হাত রেখে বললেন,

“কী ভালো থাকতো, কী খারাপ থাকতো তা আমি জানি না। কিন্তু তুই এসেছিস, এর চেয়ে বেশি ভালো আর কিছু না।”

আম্রপালি কী বলছেন সেদিকে খেয়াল নেই পদ্মাবতীর। বাইরে থেকে শমিতকে আসতে দেখলেন। হাতে কাগজে মোড়ানো জুঁই ফুল। শেফালী ফুলগুলো পেয়ে খুব খুশি হবেন। শমিত বাড়ির সামনে আসতেই শেফালীকে দৌঁড়ে এগিয়ে যেতে দেখলেন। নিশ্চয়ই সদরদরজায় দাঁড়িয়ে শমিতের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। একইভাবে অপেক্ষা তো পদ্মাবতীও করে একজনের জন্য। পার্থক্য শুধু একটাই, একজনের অপেক্ষা শেষ আর আরেকজনের অপেক্ষার সময় কোনোদিন ফুরোবে না।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

দূর থেকে শেফালীকে দেখছেন আম্রপালি। দু’দিনেই কেমন শুকিয়ে গেছেন। সবসময় মনমরা হয়ে থাকেন। কিন্তু শমিত থাকা অবস্থায় এমন ছিলেন না। তখন সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। ওদিকে কাজের চাপ বাড়ায় অভ্র বাবু বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন শমিতকে ফেরার জন্য। তাই সময় পুরো হওয়ার দু’দিন আগেই ফিরে যেতে হলো ছেলেটাকে। তারপর থেকেই শেফালী যেন একদম চুপচাপ হয়ে গেলেন।

“এই শেফালী, এদিকে আয়।”

আম্রপালি ডাকা মাত্র দৌঁড়ে চলে এলেন শেফালী।

“বলুন।”

“বস এখান আমার পাশে।”

“কেন?”

“আহ! বস তো। এতো কথা বলিস কেন তুই?”

শেফালী তার পাশে বসে পড়লেন। আম্রপালি সুঁই সুতো দিয়ে কাপড়ে ফুলের নকশা তুলছিলেন। শেফালীকে দেখিয়ে বললেন,

“সেলাই পারিস?”

“হুম। ছোটবেলা থেকেই। মা শিখিয়েছিল আমায়।”

“এইনে। এটায় কর।”

শেফালী আম্রপালির হাত থেকে সুঁই সুতো নিয়ে নিজে সেলাই তুলতে লাগলেন।

“মায়ের কথা মনে পড়ে না তোর?”

“পড়বে না কেন? পড়ে তো। খুব মনে পড়ে। কিন্তু কী আর করবো?”

“তাহলে দেখা করতে যাস না কেন?”

“উনি যেতে দেবেন?”

“কে?”

“কে আবার? আমার শ্বাশুড়ি।”

“কেন যেতে দেবেন না? আর তুই-ই তো বলিস, উনি নাকি সবসময় তোকে এই বাড়ি থেকে বের করার ফন্দি আঁটেন।”

“আঁটেন না আবার?”

“তাহলে? তুই তোর মায়ের বাড়ি গেলে উনি খুশিই হবেন। বলবেন, যাক বাবা, বাঁচলাম অবশেষে এই মেয়েত হাত থেকে।”

শেফালী হেসে উঠলেন।

“কী করবো তাহলে? যাবো?”

“কাছেই তো। গিয়ে থেকে আয় দু’দিন। তোর মন ভালো হবে।”

“আমার মন খারাপ কখন হলো?”

“দেখছি তো আমি। শমিত যাওয়ার পর থেকে সবসময় মনমরা হয়ে থাকিস।”

“ঠিক তা নয়। কিন্তু মাকে বললে যদি যেতে নিষেধ করেন?”

“বলিস না ওনাকে। তুই চুপচাপ যা। আমি পরে জানিয়ে দেব।”

“যদি রেগে যান।”

“সামলে নেব আমি। চিন্তা করিস না।”

শেফালীর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
.
.
বাইরে যাচ্ছিলেন অর্ণব। সদরদরজা দিয়ে বের হতেই কাউকে আসতে দেখলেন। হাতে মিষ্টির হাড়ি। অর্ণব সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনি?”

অপরজন দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললেন,

“নমস্কার। আমি শ্যামল। শেফালীর দাদা। ওকে নিয়ে যেতে এসেছি। ভালো আছেন তো আপনি?”

অর্ণবের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল একথা শুনে। কোনোদিন না দেখলেও ও কে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি অর্ণবের। শ্যামল বললেন,

“শেফালী ভেতরে তো? আমি বরং ওকে নিয়ে আসি।”

অর্ণব কোনো জবাব দিলেন না। শ্যামল বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ পেছন থেকে অর্ণব বলে উঠলেন,

“শেফালী ভেতরে নেই।”

দাঁড়িয়ে পড়লেন শ্যামল। অর্ণবের দিকে ঘুরে বললেন,

“ভেতরে নেই! তাহলে কোথায়?”

“বাগানে।”

“হ্যা?”

“বাড়ির পেছনের বাগানে। ওদিকেই যেতে দেখলাম কিছুক্ষণ আগে ওকে। আপনার জন্য ওখানেই অপেক্ষা করছে।”

শ্যামল কিছুটা অবাক হলেন।

“ওখানে যেতে বলেছে আমায়?

“হুম। চলুন আমি নিয়ে যাই।”

শ্যামলকে নিয়ে অর্ণব বাড়ির পেছন দিকে যেতে লাগলেন। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে বাগানের পর দিঘি ছাড়িয়ে চলে এলেন। শ্যামল একটা শুকনো ঢোক গিললেন। অর্ণবের দিকে না তাকিয়েই বললেন,

“শেফালী কোথায়? ওকে তো দেখছি না।”

অর্ণবের কোনো জবাব এলো না। এখন ভয় লাগতে শুরু করলো শ্যামলের। কোনো ভূতপ্রেত এর পাল্লায় পড়লেন নাকি ভেবেই গলা শুকিয়ে গেল তার। এমনিতেই সন্ধেবেলা। এদিকটাও যেন দেখতে কেমন কেমন। এমন সময় একা এখানে আসলে ভয়ে যেকেউ অজ্ঞান হয়ে যেত। হাত দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে অর্ণবের দিকে ঘুরলেন তিনি। সাথে সাথেই চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। এরই মাঝে অর্ণব কোথা থেকে যেন একটা লাঠি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। শ্যামল কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই অর্ণব লাঠি দিয়ে ইচ্ছেমতো পেটাতে শুরু করলেন তাকে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করে চলেছেন। মুখে শুধু একটাই কথা “আজ শুধু তোর জন্য আমার বোন আত্ম/হ/ত্যা করেছে। তুই মে/রে/ছিস ওকে, খু/নি তুই।” মাথায় জোরে আঘাত করতেই গলগল করে রক্ত পড়তে লাগলো শ্যামলের।

আম্রপালি বেশ জোরে দরজা খুলে শেফালীর ঘরে ঢুকে পড়লেন। তাকে দেখেই শেফালী বলে উঠলেন,

“দেখুন না বড় মামি। সেই কখন বাড়িতে খবর পাঠিয়ে বিকেল থেকে তৈরি হয়ে বসে আছি। দাদা নাকি নিতে আসবে। অন্ধকার হয়ে গেল কিন্তু এখনো নিতে এলো না কেউ।”

“যেতে হবে না তোকে। তোর দাদা আসবে না।”

“কেন?”

“কে যেন তোর দাদাকে মে/রে রক্তাক্ত করে ক্ষেতে ফেলে রেখেছিল। দু’জন জেলে ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় অচেতন অবস্থায় পেয়েছে ওকে। তারপর তোদের বাড়ি খুঁজে বের করে দু’জন ধরাধরি করে ওকে দিয়ে এসেছে।”

বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন শেফালী।

“কী!”

“হুম। চিন্তা করিস না তুই এখন আর। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনলাম।”

আম্রপালির কথাগুলো শুনে শেফালী একদম হা হয়ে গেছেন। বিশ্বাসই করতে পারছেন না কিছুতে।
.
.
.
বহুদিনের পুরনো ভাঙা পরিত্যক্ত এক শিবমন্দিরে বসে আছেন মোহিনী। তার একটু দূরেই অর্ণব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগার খাচ্ছেন। এর গন্ধ মোহিনীর সহ্য হয় না। তাই মোহিনীর সামনে সিগার না জ্বালানোর যথাসম্ভব চেষ্টা করেন অর্ণব। চাঁপা ফুলের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে। কাছেপিঠেই কোথাও চাঁপা ফুটেছে। কিন্তু মোহিনীর হাতে কদম। ফুলের সাদা অংশটা একটা একটা করে তুলে ফেলে দিচ্ছেন তিনি। তার মাথায় চলছে অন্য চিন্তা। মোহিনী নিজে যে কষ্টটা পেয়েছেন তার শতগুণ কীভাবে পদ্মাবতীকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় তা-ই ভাবছেন। কিন্তু এর জন্য তার অর্ণবকে প্রয়োজন। অর্ণবের মাধ্যমেই তাকে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে হবে। এতে অর্ণবের ওপর কী প্রভাব পড়বে তাতে মোহিনীর কিছু যায় আসে না। যার জন্য এতোকিছু হলো, সে কেন ছাড় পাবে? অর্ণব ফিরতেই মোহিনী বলে উঠলেন,

“আমায় বিয়ে করবেন অর্ণব?”

“করবো। কিন্তু তার আগে পদ্মাবতীকে ছাড়তে হবে।”

“আমি চাই আপনি এখনই আমাকে বিয়ে করুন।”

“সেটা সম্ভব নয় মেহের।”

মোহিনী উত্তেজিত হয়ে বললেন,

“কেন? পদ্মাকে তো ঠিকই বলার সাথে সাথে বিয়ে করে ফেলেছিলেন।”

“কতবার আপনাকে বলেছি মেহের? আর কতবার বলবো? বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি। তবুও আপনি কথায় কথায় এই বিষয়টা বারবার টেনে আনেন।”

অর্ণবকে ঠিক কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তা বেশ ভালো করেই জানেন মোহিনী। উঠে অর্ণবের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

“ঠিকাছে। অন্তত সিঁদুরটা তো পরিয়ে দিন। কিসের ভরসায় থাকবো আমি আপনার?”

অর্ণবের সামনে ছোট্ট একটা সিঁদুর কৌটা তুলে ধরলেন মোহিনী।

“বাচ্চাদের মতো আচরণ করবেন না মেহের। আর এটা আপনি কোথায় পেলেন?”

“যেখানেই পাই। আমাকে এটা পরিয়ে দিতে আপনার সমস্যাটা কোথায়? নাকি সাহস নেই?”

“আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না মেহের। আপনি জানেন আমি কী কী করতে পারি।”

“বেশ। এতোই যখন সাহস তাহলে সিঁদুরটা পরিয়ে দিন আমাকে। ভয় পাচ্ছেন কেন?”

“আমি ভয় পাচ্ছিনা।”

“পাচ্ছেন। আমাকে সিঁদুর পরানোর এতটুকুও সাহস নেই আপনার।”

অর্ণব আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেন না। মোহিনীর বলা কথাগুলোর একেকটা শব্দ যেন তার গায়ে এসে খোঁচা মেরে যাচ্ছে। অগত্যা সিঁদুরটা মোহিনীর সিঁথিতে পরিয়ে দিতে হলো তাকে।

“খুশি এবার?”

মোহিনীর চেহারায় হাসি ফুটে উঠেছে। কিন্তু অর্ণবের হাতে শুধু সিঁদুর পরাটা মোহিনীর উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পরবর্তী কাজটা করলেন তিনি। অর্ণবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তার সাদা পাঞ্জাবীতে সিঁদুরের দাগ লাগিয়ে দিলেন।

“অনেক খুশি।”

মোহিনীকে ছাড়িয়ে নিলেন অর্ণব। নিজের খুব একটা কাছে আসতে দেননা তিনি মোহিনীকে, যদি না মোহিনী নিজে থেকেই হঠাৎ করে এসে পড়েন তো। তার বিবেক তাকে বাঁধা দেয় এ কাজে।

“এখন আপনার বাড়ি ফেরা উচিত।”

“পৌঁছে দিয়ে আসুন। এতোরাতে একা যেতে পারবো না।”

অর্ণব অধর প্রশস্ত করলেন। তিনি জানেন মোহিনী একাই যেতে পারবেন। তবুও তাকে পৌঁছে দিতে বলছেন।

“চলুন।”

মোহিনীকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজে বাড়িতে ফিরলেন অর্ণব। ভুল করে নিজের ঘরে ঢুকে পদ্মাবতীকে দেখতেই আবার ঘুরে যাচ্ছিলেন অর্ণব। পেছন থেকে পদ্মাবতী ডেকে উঠলেন।

“শুনুন।”

না চাইতেও দাঁড়ালেন অর্ণব।

“কী সমস্যা?”

পদ্মাবতী অর্ণবের সামনে এসে কিছু বলতে যাবেন তখনই তার চোখ পড়লো পাঞ্জাবীতে লেগে থাকা সিঁদুরের ওপর। সবকিছু যেন মুহূর্তেই তালগোল পাকিয়ে গেল তার৷ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,

“আপনি বিয়ে করেছেন? ঘরে বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে করেছেন আপনি?”

পদ্মাবতীর এমন আচরণে অর্ণবও কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এরপরই এমন ব্যবহারের কারণ খুঁজে পেলেন। সিঁদুরের দাগটা আগে খেয়াল করেননি তিনি। কিছু বলতে যাবেন কিন্তু তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই পদ্মাবতী আবার বলতে শুরু করলেন,

“ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন না? ওই মোহিনীকে বিয়ে করেছেন? কোন সাহসে? কোন সাহসে ওই নোংরা মেয়েটাকে বিয়ে করলেন আপনি?”

অর্ণব স্ব জোরে পদ্মাবতীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। এরপর নিজের ওপরই রাগ হলো তার। আগে কখনো কোনো মেয়ের গায়ে হাত তোলেননি তিনি। নিজেকে শক্ত রেখে বললেন,

“মেহেরের ব্যাপারে একটা খারাপ কথাও শুনতে চাই না আমি। তোমার এতো বড় স্পর্ধা হলো কী করে ওকে কিছু বলার? এতো সাহস কে দিল তোমায়? আর কোনোদিন তোমার মুখে ওর নামটাও শুনতে চাই না আমি। মনে থাকে যেন।”

পদ্মাবতীকে আঙুল তুলে শাসিয়ে গেলেন অর্ণব। গালে হাত দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন পদ্মাবতী। নিজের চোখের জলকে আটকাতে গিয়ে বারবার কেঁপে উঠছেন তিনি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here