মেহেরজান #পর্ব-৪৬,৪৭

0
990

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৬,৪৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পর্ব-৪৬

গায়ে একটা ধবধবে সাদা শাড়ি জড়িয়েছেন মোহিনী। নিজের ঘরে বসে পায়ে আলতা দিচ্ছেন। আলতা লাগানো শেষ হতেই ঘুঙুর দুটো দু’পায়ে বেঁধে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চুপি চুপি ছাদে উঠে এলেন। আকাশে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। মোহিনী পুরো ছাদে হাঁটাহাঁটি শুরু করলেন। তার খোলা চুলগুলো বাতাসে সুতো কাটা ঘুড়ির মতো উড়ছে। ইশ! আজ যদি পূর্ণিমা না হয়ে অমাবস্যা হতো, তাহলে পরিবেশটা আরও বেশি ভয়ংকর লাগতো। রাতবিরেতে এমন দৃশ্য দেখলে যে-কেউ ভয় পাবে। মোহিনীও তাই চায়। কিছুক্ষণের মধ্যে হলোও তাই। একটা চিৎকার কানে আসলো। মোহিনী ওদিকে তাকাতেই কাউকে ছুটে চলে যেতে দেখলেন। খিলখিল করে হেসে ফেললেন তিনি। নিচে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। মোহিনী ছাদের দরজার কাছে এসে কান পেতে শুনতে পেলেন,

“আমি বলেছিলেন এ-বাড়িতে ভূ’ত ঢুকেছে। কেউ বিশ্বাস করোনি আমার কথা। আজ নিজের চোখে দেখেছি। এতোদিন তো শুধু ঘুঙুর আর লাফালাফির আওয়াজ শুনেছি। আজকে নাচতেও দেখে এলাম। ও-মাগো, ও কি আমাকে দেখে ফেলেছে? আমাকে কি মে/রে ফেলবে এখন? আমার এখন কী হবে?”

“চুপ কর তো। আমাকে দেখতে দে।”

মুখ চেপে হাসি আঁটকানোর চেষ্টা করলেন মোহিনী। অন্যান্য মেয়েদের সাথে তারানার আওয়াজও শুনতে পেলেন। না, আর থাকা যাবে না এখানে। বেশিক্ষণ থাকলে ধরা পড়ে যেতে হবে। মোহিনী চলে যেতে উদ্যত হতেই দূরের বাড়িটার দিকে চোখ আঁটকে গেল তার। আলোকসজ্জায় সজ্জিত বাড়িটা। অজান্তেই মোহিনীর পা দুটো তাকে ছাদের কিনারায় নিয়ে এলো। না চাইতেও মোহিনী ভাবনায় ডুবে গেলেন। কিসের এতো আলো ও-বাড়িতে? আজ হঠাৎ আবার ও-বাড়ির সব খবর জানতে ইচ্ছে করলো মোহিনীর। ইশ! পূর্বাটা থাকলে ভালো হতো। কী হচ্ছে ওখানে সব জানা যেত। কিন্তু মেয়েটাও অর্ণব চলে যাওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় কাজ ছেড়ে দিল। এতোদিন অবশ্য ওখানকার কোনো খবরাখবর জানারও প্রয়োজনবোধ করেননি মোহিনী। কিন্তু এখন কী করে জানবেন? এক কানে ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। কেউ তার কান মুচড়ে ধরেছে। “আহ” শব্দ করে পেছনে ফিরতেই দেখলেন তারানা দাঁড়িয়ে আছেন।

“তারামা, ছাড়ো। ব্যথা লাগছে।”

“লাগুক। এসবের পেছনে তাহলে তুই ছিলি? আগেই বুঝে যাওয়া উচিত ছিল আমার।”

তারানা মোহিনীর কান ছেড়ে দিলেন। মোহিনী আবার সেদিকে ঘুরে তারানার উদ্দেশ্যে বললেন,

“ও-বাড়িতে এতো রাত পর্যন্ত আবার কিসের অনুষ্ঠান হচ্ছে তারামা? জানো কিছু?”

“জানি না। আর ও-বাড়িতে কী হয় না হয় তা জেনে তোর কী?”

“আমাকে কষ্ট দিয়ে ওরা কীভাবে এতো ভালো আছে? এতো আনন্দ কীভাবে করে ওরা? আমার যে সহ্য হয় না।”

“তাহলে শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে নিজের জ্বালা বাড়াচ্ছিস কেন? নিচে চল। ওদের বলতে হবে ওরা এতোদিন কোন ভূ’তকে ভয় পেত। না, ভূ’ত নয়, পে’ত্নী। পে’ত্নী ধরেছি আজ। চল আমার সাথে।”

মোহিনীকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন তারানা। কিন্তু মোহিনীর মনে এখনো একই চিন্তা চলছে।
.
.
.
সকাল সকাল শেফালীকে রান্নাঘরে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন অনুরাধা। এক মুহুর্তে যেন পুরো বাড়িটাও মাথায় তুলে ফেললেন। মায়ের চেঁচামেচি শুনে শমিত দৌঁড়ে এলেন। কয়েকদিন আগেই এসেছেন তিনি। আজ আবার ফিরে যাবেন। গত সাত মাসে ইতোমধ্যে তাকে বহুবার আসতে হয়েছে শেফালীর জন্য। শমিতকে দেখে অনুরাধা বলে উঠলেন,

“এই তোর বউয়ের জন্য আমি কি কখনোই শান্তিতে থাকতে পারবো না? আর কত অশান্তি দিবি তোরা আমাকে?”

শেফালী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। শমিত বললেন,

“আরে কী হয়েছে সেটা তো বলবেন মা। কী করেছে ও?”

“কে বলেছে ওকে? কে বলেছে এই সময়ে ওকে রান্নাঘরে এসে কাজ করতে? শুনে রাখ শমিত। তোর বউয়ের জন্য যদি আমার নাতি নাতনির কিছু হয় তো ওকে আর এ-বাড়িতে ঠাই দেব না বলে দিলাম।”

“শেফালী, তুমি রান্নাঘরে কী করছো?”

“আরে আমি তো জল খাচ্ছিলাম। তাছাড়া অন্যকিছু করিনি।”

অনুরাধা আবার চেঁচিয়ে উঠলেন।

“জল খেতে এখানে আসতে হবে কেন? ঘরে জল ছিল না? আর না থাকলে আমাদের কাউকে বলতে। আর তাছাড়া এ-বাড়িতে কি ঝি চাকরের অভাব আছে নাকি? একটা গেলে আরেকটা আসে।”

শমিত মুচকি হেসে শেফালীকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন।

“তোমাকে কে বলেছিল ওখানে যেতে? শুধু শুধু মায়ের কথা শুনতে হলো।”

“আমার কী দোষ? তোমার মা-ই একটু বেশি বেশি করেন। আমার বাচ্চা আমার পেটে। এদিকে আমার থেকে ওনার চিন্তা বেশি।”

“চিন্তা তো একটু করবেনই। প্রথমবার দাদি হচ্ছেন।”

“প্রথমবার মা তো আমিও হচ্ছি। আমি তো এতো চিন্তা করছি না।”

“এটা ভালো। আর ডাক্তারও বলেছেন তোমাকে বেশি চিন্তা না করতে।”

“কিন্তু তোমার মা তো সে হতে দিচ্ছেন না। সবসময় আমার চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন।”

“কী চিন্তা চিন্তা শুরু করলে বলো তো? আর মা তো তোমার জন্যই এতো চিন্তা করেন।”

শেফালী নিজের পেটে হাত রেখে বললেন,

“মা আমার জন্য নয়, তোমার সন্তানের জন্য চিন্তা করেন।”

“ওই একই হলো। এখন আর আমার সাথে ঝগড়া শুরু করো না। আমি বের হব এখন।”

“আজই চলে যাবে?”

“সময় পেলেই আবার চলে আসবো।”

শেফালীর কপালে চুমু খেয়ে শমিত নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তার পেছন পেছন শেফালীও গেলেন এগিয়ে দিতে।
.
.
.
বাজারের মাঝখানে মস্ত বড়ো একটা গয়নার দোকান। সন্ধ্যেবেলা এই একটা দোকানের আলোয়ই যেন পুরো বাজার ভরে ওঠে। এক মুহুর্তে সকলের নজর কাড়তে যথেষ্ট এই আয়োজন। অভ্রবাবু যে অল্প সময়েই ব্যবসায় অনেক উন্নতি করেছেন তা বেশ ভালোরকমই বোঝা যায়। এতে শ/ত্রুর সংখ্যাও যে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই উন্নতিতে শমিতের অবদানও কম নয়। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও এতোমাসে একদিনের জন্যও অর্ণবকে দোকানে বসাতে পারেননি। সে হিসেবে শমিত তাকে এ-কাজে বেশ সাহায্য করেছেন। দোকানের ভেতরেই অভ্রবাবুর একটা আলাদা কামড়া রয়েছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। সেখানে বসেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। শমিতকে ঢুকতে দেখে বললেন,

“এসো শমিত এসো। তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। তোমাকে ছাড়া যে এসব কত কষ্টে সামলাই, সে যদি বুঝতে তুমি! তা সোজা এখানে এলে নাকি বাড়িতে গিয়েছিলে?”

শমিত বসতে বসতে বললেন,

“সোজা এখানেই এসেছি। দোকানের একটু খোঁজখবর নিতে। অর্ণব এলে বাড়িতে যাবো ওর সাথে।”

“অর্ণব তোমার আসার খবর পেয়েছে?”

“হ্যাঁ, জানিয়েছি।”

“তাহলে দেখো এইতো এলো বলে।”

কথা শেষ করতে না করতেই অর্ণব প্রবেশ করলেন ভেতরে। তাকে দেখে অভ্রবাবু বললেন,

“ওইতো এসে গেছে।”

শমিত উঠে গিয়ে অর্ণবের সাথে করমর্দন আর কোলাকুলি করে বললেন,

“ভালো আছিস?”

“হ্যাঁ। তোর খবর বল।”

“দেখেই তো বুঝতে পারছিস আমি কতটা ভালো আছি।”

“তা আমার বোনটার কী খবর? শেফালী ভালো আছে?”

“ঔ ভালো। শুধু মায়ের সাথেই যা একটু লাগে।”

বলেই দুজনেই হেসে উঠলেন। শমিত আর অর্ণব দু’জনে দুটো চেয়ার টেনে বসলেন। অভ্রবাবু একজনকে ডেকে তিনটে চা পাঠাতে বললেন। অর্ণব বললেন,

“শুধু শুধু এখানে আসতে গেলি কেন আবার? ওখানে আরও ক’টাদিন থাকলেও পারতি ওর সাথে। কষ্ট হলেও এদিকটা কাকু ঠিকই সামলে নিতেন।”

অভ্রবাবু জবাব দিলেন,

“সে নিতাম। কিন্তু তোমাকেও তখন শান্তিতে বসে থাকতে দিতাম না আর। আমার কষ্টটা তোমাকেও বুঝিয়ে ছাড়তাম।”

শমিত বললেন,

“এদিকে কাজটা আরেকটু গুছিয়ে আবার যাবো।”

চা চলে এলে অভ্রবাবু নিজের কাপটা এগিয়ে নিলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“শমিতের যাওয়া-আসা তো চলছেই ওখানে। এবার তোমারও একটু যাওয়া উচিত।”

অর্ণব ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তুললেন। অভ্রবাবু আবার শমিতের দিকে ইশারা করে বললেন,

“আমি ঠিক বলেছি না শমিত? তুমি কী বলো?”

শমিত জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের চা খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

পেট নিয়ে দোতলায় ওঠা নামা করা শেফালীর জন্য আসলেই কষ্টসাধ্য। তাই নিচতলার ঘরটায় চলে আসতে হয়েছে। এখানে সে একা নয়। পদ্মাবতীও রয়েছেন। অনেক আগেই তিনিও এই ঘরটায় চলে এসেছিলেন। একা থাকতে হচ্ছিলো বলে শেফালীও আর অন্য কোনো ঘরে যাননি। রামুকে বলে এঘরেই আরেকটা খাট পাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন পদ্মাবতী। কিন্তু এতো শোরগোলে আর শান্তি মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। নিজের প্রকাণ্ড পেটে হাত রেখে খুব সাবধানে খাটে এসে বসলেন তিনি। নয়মাসের বেশিই চলছে তার। যেকোনো দিন সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন। তাই খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে এখন তাকে। অন্যদিকে শেফালীর এখনো আরও দুমাস বাকি। বাড়িতে এক সঙ্গে দুজন পোয়াতি নিয়ে শ্বাশুড়িরাও বেশ বিপাকে পড়েছেন। এক্ষেত্রে শকুন্তলা খুব সাহায্য করছেন তাদের। দু’জনেরই দেখভালের দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। সকাল থেকেই তিনি পদ্মাবতীর সাথে এঘরে রয়েছেন। এটা ওটা নিয়ে গল্প করেই চলেছেন। এমন সময় হাতে একটা খাম নিয়ে বিমর্ষ মুখ নিয়ে আম্রপালি এলেন ঘরে। কিছুটা চিন্তিতও। তাকে দেখেই শকুন্তলা বললেন,

“কী হয়েছে দিদি? মুখটা ওমন হয়ে আছে কেন? আর তোমার হাতে ওটা কী?”

পদ্মাবতীও কৌতূহলী হয়ে তাকালেন তার দিকে। আম্রপালি জবাব দিলেন,

“চিঠি। পদ্মার গ্রাম থেকে এসেছে। ওদিক থেকে একজন এসেছিলেন এখানে। তার হাতেই পাঠিয়েছেন। তিনি দিয়ে গেলেন এখন আমাকে।”

পদ্মাবতী বলে উঠলেন,

“কে পাঠিয়েছেন বড়মা? আর কী লেখা আছে ওতে?”

“তোর পিসি পাঠিয়েছেন। তোর ঠাকুমা মা/রা গেছেন। তাই তোকে একবার হলেও যেতে বলেছেন দ্রুত।”

পদ্মাবতীর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে এলো,

“ভগবান ওনার আ’ত্মাকে শান্তি দিক।”

শকুন্তলা একবার আম্রপালি আরেকবার পদ্মাবতীকে দেখে বলে উঠলেন,

“সে কী! পদ্মা এই অবস্থায় কী করে যাবে ওখানে? সম্ভব নাকি এটা? উনি কি পদ্মার ব্যাপারে জানেন না? কী বুঝে যেতে বললেন?”

“তার মা মা/রা গেছেন। তিনি কি আর এতোকিছু ভেবে লিখেছেন? কিন্তু এখন কী করবো? পদ্মাকে যে যেতে বললেন।”

“যেতে হবে না এখন ওকে। পরে নাহয় সময় করে একবার যাবে। তুমি এতো ভেবো না। উনি ঠিকই বুঝতে পারবেন।”

“হুম। হয়তো ঠিকই বলেছিস তুই।”

শকুন্তলার সাথে কথা বলে আম্রপালির চিন্তা যেন কিছুটা হলেও কমলো।
.
.
.
“আজ কোনো কবিতা শোনাবেন না স্যার?”

“স্যার বলো না অর্ণব। নিজেকে কেমন যেন ইংরেজ কর্তা ইংরেজ কর্তা বলে মনে হয়। তুমি বিলেতে বড় হতে পারো। কিন্তু আমি এদেশেই জন্মেছি আর এদেশেই ম/র/বো। তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকবে।”

“ঠিকাছে। আপনার কোনো কবিতা শোনাবেন না রুদ্র?”

“আমার কবিতা? আমি কবি নই। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে দুটো বাক্য বলি। আর সেটাকেই তোমরা কবিতা বলে ধরে নাও।”

“সে যাই হোক। আজ বলবেন কিনা বলুন।”

“না, আজ কবিতা বলবো না। গল্প বলবো একটা। গল্প না অবশ্য। আমার প্রথমবার চুরি করার অভিজ্ঞতা। শুনবে?”

অর্ণব সামান্য হাসলেন। রুদ্র পেশায় একজন লেখক। তবে টুকটাক কবিতাও লেখেন। সেদিন এই পানশালায়ই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল অর্ণবের। দুজনের মাঝে বেশ ভালো সখ্যতাও গড়ে উঠেছে কিছুদিনের মাঝেই। রুদ্রর সাথে কথা বললে তাদের মাঝের বয়সের দীর্ঘ তফাৎটা খুঁজে পান না অর্ণব। আর এটাই হয়তো তাদের বন্ধুত্বের সবচেয়ে বড় কারণ। অর্ণব ঠোঁটে হাসি রেখেই বললেন,

“বলুন তাহলে।”

অর্ণবের জবাব পেয়ে রুদ্রও বলতে শুরু করলেন।

“আমি তখন সবে মাত্র কলেজ পাড় করে ছুটিতে গ্রামে এসেছি। তখন আম কাঁঠালের দিন। গাছ ভরা কাঁচা পাকা মিষ্টি আম। তো আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই ছিল আম বাগান। কিন্তু বাগানের মালিক একটা আমও ছুয়ে দেখতে দিত না কাউকে। আমরাও কম কিসে? সব বন্ধুবান্ধব মিলে একদিন ঠিক করেই ফেললাম ওই বাগানের আম খাবোই খাবো। তা সে চুরি করে হলেও। যেই ভাবা সেই কাজ। সেদিন সব পরিকল্পনা করে রাখলাম। পরেরদিনই সন্ধ্যে নামতে না নামতেই চলে এলাম বাগানে। গাছে আমি উঠলাম। একটার পর একটা আম নিচে ফেলেই চলেছি। এমন সময় কই থেকে যেন বাগানের মালিক চলে এলো। আমার বন্ধুরা নিচে দাঁড়িয়ে আম কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে ব্যস্ত ছিল। মালিকের আসার শব্দ শুনে সা/লা/রা সব আমাকে রেখেই আম নিয়ে পালালো। আমার অবস্থা এমন হলো যে গাছ থেকে নামতে গেলেও ধরা পড়বো। আর না নামলেও নিচ থেকে ঠিকই গাছে দেখা যাবে আমাকে। কী করবো বুঝতে না পেরে গাছেই বসে রইলাম। গাছে থেকে তাকে আসতে দেখলাম। মালিক নয়। অন্য একটা মেয়ে। এসেই বললো,

“গাছে লুকিয়ে থেকে লাভ নেই। আমি দেখে ফেলেছি সব।”

আমিও গাছ থেকে নেমে পড়লাম। বললাম,

“এই, তুই কে? আর কী দেখেছিস?”

“তোমাকে আম চু/রি করতে দেখেছি।”

“আম কে চু/রি করেছে?”

“তুমি চু/রি করেছো।”

“এই যে বললি তুই দেখেছিস সব। এটা দেখিসনি যে ওরা আমের বস্তা নিয়ে পালালো?”

“কারা পালালো? আমি তোমাকেই দেখেছি চু/রি করতে। আর বলেও দেব মালিককে।”

“কী বলবি?”

“বলবো যে তুমি আম চু/রি করেছো।”

আমি কী করবো বুঝতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত কিনা আম চু/রি করতে গিয়ে ধরা পড়লাম! শেষে আবার গাছে উঠে দুটো আম পেড়ে এনে ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম,

“এই নে ধর। কাউকে কিছু বলবি না তুই।”

ও কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো। এরপর বললো,

“তুমি শহর থেকে এসেছো না?”

“হ্যাঁ, তো?”

“এজন্যই তো সামান্য আমটাও চু/রি করতে পারলে না।”

“এই, মা/র খেতে চাস তুই?”

“সাহস কত! আমাকে মা/র/বে! নিজে আম চু/রি করতে পারে না আবার মা/র/তে এসেছে আমাকে।”

“কী চাই তোর? আম দিচ্ছি হচ্ছে না এতে?”

“চুক্তি যখন করতেই চাও তাহলে সেটা আমিই ঠিক করবো। তুমি না।”

“আচ্ছা, তুই-ই বল। কী চাস?”

“তুমি আমাকে লিখতে পড়তে শেখাবে।”

ওর কথা শুনে একটু অবাক হলাম। তারপর বললাম,

“আমার কি খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই নাকি যে এখন তোকে লেখাপড়া শেখাবো।”

“জিজ্ঞেস করিনি। আমার দাবি রেখেছি। হয় লেখাপড়া শেখাবে নয়তো সব বলে দেব। আরও বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলবো।”

“বাচ্চা একটা মেয়ে। তার আবার তেজ কত! ঠিকাছে। পড়াবো তোকে। কিন্তু মুখ বন্ধ রাখবি।”

আমার বাবা খুব কড়া লোক ছিলেন। তার কানে একথা গেলে আমাকে আস্ত রাখতেন না। তাই মেনে নিলাম ওর কথা। এভাবেই আমাদের মাঝে একটা চুক্তি হলো। কিন্তু একটু পর যা হলো তা সত্যিই আমার ভাবনার বাইরে ছিল। কোত্থেকে যেন বাগানের মালিক এলো লাঠি নিয়ে। এসেই জিজ্ঞেস করলো,

“এই, কী করছিস তোরা এখানে?”

মেয়েটা এক মুহুর্তও না ভেবে গড়গড় করে বলে দিল,

“চো’র ধরেছি দাদু। এ তোমার বাগানের আম চু/রি করছিল। এর মধ্যেই এখান থেকে তিন বস্তা আম পা’চার করেছে নিজের বন্ধুদের নিয়ে। আমি দেখে ফেলেছি বলে আমাকেও ঘুষ দিতে চাইছিল।”

মেয়েটা এক নিঃশ্বাসে সব বলে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! এক বস্তার অর্ধেকও আম ভরেনি আর এ বলে কি না তিন বস্তা! বাগানের মালিকের দিকে তাকাতেই দেখি সে রক্তবর্ণ দুটো চোখ নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। পালানো ছাড়া আর উপায় নেই। তাই আমিও দিলাম ভোঁ দৌঁড়।”

বলা শেষ হতেই দুজনেই হেসে উঠলেন। অর্ণব বললেন,

“আমি ভুল না হলে আপনার সকল কবিতা এই মেয়েটার উদ্দেশ্যেই লেখা।”

“তুমি ভুল নও। ঠিকই ধরেছো।”

“এই একটা দিক দিয়েই হয়তো আমরা একই। দুজনেই প্রেমে ব্যর্থ।”

“উহু। ভুল বললে। তুমি নিজের জন্য তোমার প্রেমিকাকে ছেড়েছো। আর আমি তার কথায়, তার ভালোর জন্য তাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। আমি ব্যর্থ নই। আমি এখনো তাকে আগের মতোই ভালোবাসি। সে একবার ডাকলে তার কাছে ফিরে যেতে রাজি। আমি নিজ হাতে তাকে বিয়ের মণ্ডপ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম। সবকিছু ঠিকই যাচ্ছিল। ততক্ষণ পর্যন্তই যতক্ষণ না আমি বুঝতে পেরেছিলাম বিয়ের দিন তার চোখে জল নিজের জন্য নয়, বরং আমার জন্য ছিল। কিন্তু আমি বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম। এরপর আর তার বাড়ির সামনে গিয়ে তাকে এক নজর দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার হাতে।”

“আপনার প্রেয়সীর নাম বলবেন না কাউকে কোনোদিন?”

রুদ্র অর্ণবের পরিচয় জেনে আগেই বুঝে গিয়েছিলেন সে কে। তবে তা প্রকাশ করেননি। অর্ণবের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন,

“বলবো আজ। শুধু তোমাকে বলবো।”

“আমাকেই কেন?”

“সেটা তুমি এমনিই বুঝে যাবে।”

“কী নাম তার?”

“আম্রপালি। আম্রকাননে খুঁজে পাওয়া এক অন্যরকম আম্রপালি।”
.
.
.
“কেমন আছিস মোহিনী?”

খুব ক্লান্ত লাগছিল মোহিনীর। সে সাথে ঘুমও পাচ্ছিলো। তাই বালিশে মুখ গুজে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ডাকটা শোনা মাত্রই যেন সব ঘুম উড়ে গেল তার। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

“তুই!”

পদ্মাবতী এগিয়ে এসে তার হাতে থাকা জিনিসগুলো একপাশে রাখলেন। বললেন,

“আমাকে দেখে তোর চোখ ওমন ছানাবড়া হয়ে গেল কেন? ভূ’ত দেখলি যেন।”

“কেন এসেছিস এখানে?”

“ওমা! এটা আবার কেমন প্রশ্ন? কতমাস হয়ে গেছে তোকে দেখিনি। তোকে দেখতে ইচ্ছে করলো তাই এসেছি। জানিস এখানে আসার জন্য বাড়িতে কত মিথ্যে কথা বলে বেরোতে হয়েছে! অনেক কথা বানিয়ে বানিয়ে বলার পর একা আসতে পেরেছি। নয় কেউ তো আমাকে এসময় একা ছাড়তেই চাচ্ছিলো না। বাড়িতেও সবসময় আমার সাথে কেউ না কেউ থাকেই।”

নিজের পেটে হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো বলছিলেন পদ্মাবতী। মোহিনীর নজর যতবার পদ্মাবতীর পেটের দিকে পড়ছে ততবারই অর্ণবের করা প্রতারণার কথা মনে পড়ছে। আর মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে।

“এখান থেকে চলে যা পদ্মা।”

“যাবো কি রে? সবে তো এলাম। দেখ আমি তোর জন্য কতকিছু নিয়ে এসেছি। শোনপাপড়ি, হাওয়াইমিঠাই, সন্দেশ। তোর এগুলো খুব পছন্দ তাই না? সেদিন শেফালীর সাধ এর অনুষ্ঠান হলো। আমি থাকতে পারিনি। আমার বেলায়ও ও থাকতে পারেনি। তোর কথা খুব মনে পড়েছিল তখন।”

মোহিনী জবাব দিলেন না। পদ্মাবতী মন খারাপ করে বললেন,

“ঠিকাছে। তুই যদি চাস তো আমি চলে যাবো। কিন্তু তার আগে তোকে কিছু কথা বলতে চাই।”

“কী কথা?”

পদ্মাবতী মোহিনীর আরও কাছে এসে বললেন,

“তুই অর্ণবকে খুব ভালোবাসিস না? কিন্তু তোর থেকেও যে আমি বেশি ভালোবেসেছি তাকে। তাই তো নিজের করে নিতে পেরেছি। আর এখন তার সন্তানের মাও হবো আমি।”

“তো? আমি কী করবো তাতে? তুই আমার ঘরে এলি কী করে? কেউ আঁটকালো না তোকে?”

বলেই মোহিনী উচ্চস্বরে তারানাকে ডাকতে লাগলেন। পদ্মাবতী বললেন,

“আঁটকেছিল। পরিচয় দেওয়ার পর আর আঁটকায়নি।”

মোহিনী ভ্রুকুটি করে চেয়ে রইলেন। পদ্মাবতী বললেন,

“জানিস, এতোগুলো মাসে অর্ণব একবারও আমার খোঁজ নেননি।”

“আমাকে বলছিস কেন একথা?”

“কারণ তিনি এখনো তোকে ভালোবাসেন। তুই তাকে আঁটকে রেখেছিস। তোর সাথে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন তাই না? লুকিয়ে দেখাও করেন নিশ্চয়ই?”

“এমন কিছুই না। তুই চলে যাচ্ছিস না কেন আমার চোখের সামনে থেকে?”

“তুই চলে যা না।”

“মানে?”

“আমাদের জীবন থেকে। চলে যা তুই।”

“আমি কোথায় যাবো?”

পদ্মাবতী মোহিনীর দু-হাত ধরে ফেললেন। প্রচন্ড অস্থির লাগছে তাকে। কিসের ভয় যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। পদ্মাবতী মিনতির স্বরে বললেন,

“অনেক দূরে কোথায় চলে যা। যেখানে তোকে কেউ চিনবে না। তোর আসল পরিচয় জানবে না। সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে পারবি। তুই বল কোথায় যাবি। আমি নিজে দিয়ে আসবো তোকে। টাকা পয়সার কোনো অভাব থাকবে না তোর। সব দেব আমি।”

মোহিনী এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

“পাগল হয়ে গেছিস তুই?”

“এখন না হলেও একদিন ঠিকই হয়ে যাবো রে। এভাবে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না আমি।”

“এসব নাটক বন্ধ কর পদ্মা। অর্ণবের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আর রাখতেও চাই না।”

মুহূর্তের মধ্যেই চেহারা পাল্টে গেল পদ্মাবতীর। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। সেই সাথে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,

“মিথ্যে বলছিস। তোর সাথে সম্পর্ক না থাকলে উনি এখন আমার কাছে থাকতেন। আমার খোঁজ নিতেন। তাহলে নেন না কেন?”

মোহিনী তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

“কারণ উনি তোকে ভালোবাসেন না। একটু আগেই তো বললি যে অর্ণব এখনো আমাকে ভালোবাসেন। তাহলে তোকে কী করে ভালোবাসবেন? একসাথে কখনো দু’জনকে ভালোবাসা যায় নাকি? ইশ! তোর জন্য বড্ড কষ্ট লাগেরে পদ্মা। এতো চেষ্টা করেও অর্ণবের ভালোবাসা পেলি না। নামে মাত্র তার স্ত্রী হয়েই রইলি। অর্ণব শুধু আমাকে ভালোবেসেছেন। তুই আজ এসব কথা বলে তার প্রতি আমার বিশ্বাস আবার ফিরিয়ে দিলিরে পদ্মা। ভেবে দেখলাম। আমি এখন আর তাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবো না।”

সারা গা যেন জ্বলে গেল পদ্মাবতীর। উঁচু স্বরে বললেন,

“শেষ পর্যন্ত নিজের অবস্থান দেখিয়েই দিলি তুই? এর চেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারিস। যতই হোক, সামান্য একটা বাইজী বলে কথা। অন্যের স্বামীকে নিজের মায়ার জ্বালে ফাঁসিয়ে অন্যের সংসার ভাঙা ছাড়া আর কিইবা করতে পারিস তোরা? ঘরে বউ থাকতেও পুরুষ যখন অন্য নারীকে নিয়ে আসে তখন তাকে কী বলে জানিস? র/ক্ষি/তা। তুই সারাজীবন অর্ণবের র/ক্ষি/তা হয়েই থাকবি। বউ হতে পারবি না কোনোদিন। তোর তো বাপ-মায়েরও কোনো হদিস নেই। কে জানে তোর মা কী করেছিল। কার সংসার নষ্ট করেছিল যে তোর বাবাও তোকে কোনোদিন খুঁজতে এলো না। তোর মতো মেয়ের সাথে যে আমার এতো বছরের বন্ধুত্ব ছিল এটা ভাবতেও এখন ঘেন্না লাগছে আমার। গা গুলিয়ে উঠছে।”

বলেই পেছন ঘুরে হাঁটা দিলেন পদ্মাবতী। এসব কী বলে গেলেন তিনি! একদম সহ্য করতে পারলেন না মোহিনী। দৌঁড়ে বাইরে এলেন পদ্মাবতীর পেছন পেছন। সিড়ির কাছে আসতেই এক ধাক্কায় পদ্মাবতীকে ফেলে দিলেন। পদ্মাবতীর দেহটা সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়লো। নিচে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। মোহিনী নিজের কান্ডে নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। মাথায় হাত দিয়ে সিড়ি ধরে সেখানেই ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। সবার আগেই ছুটে এলেন তারানা। মোহিনীকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে আর পদ্মাবতীকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে সবকিছু বুঝতে এক মুহুর্তও লাগলো না তার। মোহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন উঠলেন,

“এটা তুই কী করলি মেহের?”

আরও কিছু মেয়ে আসতেই সকলে মিলে পদ্মাবতীকে ধরাধরি করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে গেলেন। চরণকে পাঠালেন অর্ণবদের বাড়িতে খবর পাঠাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চরণ এসে এ-বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়ালেন। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,

“ও বিবিজি, আপকি বহু সিড়িওছে নিচে গির গায়্যি হ্যে। আম্মাজিনে উসকো আসপাতাল লেকার গায়্যি হ্যে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here