মেহেরজান #পর্ব-৪৮

0
890

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

বেশ চিন্তিত চেহারা নিয়ে মোহিনীকে ডাকলেন তারানা।

“মেহের।”

ছোলার ডাল দিয়ে গরম গরম কচুরি মুখে পুরে মোহিনী বললেন,

“হুম।”

“এর মাঝে অর্ণবের সাথে দেখা হয়েছে তোর?”

“কেন বলো তো?”

“এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম। ও তো ফিরেছে গ্রামে। দেখা করলো না যে?”

“তুমি কি আজকাল নে/শা টেশা করছো নাকি তারামা? উনি আমার সাথে কেন দেখা করতে যাবেন? এতোকিছুর পরও? এসব উল্টাপাল্টা কথাবার্তা না বলে ঠিক করে বলো তো তুমি কী বলার চেষ্টা করছো?”

“আমি আবার কী বলার চেষ্টা করবো? যা বলছি তাই-ই তো।”

“তোমার কথাবার্তা যেন কেমন অদ্ভুত লাগছে।”

“আমার মনে হয় না সেদিনের ব্যাপারে ও-বাড়িতে কেউ কিছু জানে।”

“পদ্মা এখনো চুপ থাকবে ভেবেছো?”

“ও যদি চুপ নাই থাকতো তো তুই এখন এখানে থাকতিস না। জে/লে থাকতে হতো।”

“ওহ। তুমি তাহলে এই নিয়ে চিন্তায় আছো? এতো চিন্তা করো না। কিছু হলে এতোদিনে হয়ে যেত।”

“চিন্তা করবো না মানে? তোর জন্য আমার কতটা চিন্তা হয় তা যদি বুঝতিস। আমি বুঝি না তুই এতো নিশ্চিন্তে কীভাবে আছিস।”

“ওর কিছু হলে নাহয় চিন্তা হতো। কিন্তু কোনো ক্ষতি তো হয়নি তেমন। আর তুমি থাকতে আমার কে কী করতে পারবে তারামা? এখন আরেকটা কচুরি দাও তো।”

তারানা মোহিনীর থালায় আরেকটা কচুরি দিতে দিতে বললেন,

“পদ্মাবতীর নাকি ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে। অর্ণবও চলে এলো খবর পেয়ে। এবার মনে হয় ওদের সম্পর্কটা ঠিক হয়েই যাবে।”

“সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে এটা কী করে বলছো?”

“কেন?”

“অর্ণব পদ্মার জন্য নয়, নিজের ছেলের জন্য ফিরেছেন।”

“সে যাই হোক।”

“তারামা, ও এতো উঁচু থেকে পড়ার পরও ম/র/লো না কেন বলো তো?”

“তোর মুখে যতসব অলক্ষুণে কথা। ওর কিছু হলে তুইও এখানে শান্তিতে থাকতে পারতি না। জেলে পঁচে ম/র/তে হতো।”

মোহিনী তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে বললেন,

“তাও শান্তি পেতাম।”

মোহিনীর কথায় তারানা চুপ করে রইলেন। মোহিনী বললেন,

“তারামা, আমি বলছিলাম কী, আমি ও-বাড়িতে একবার যাবো। পদ্মার ছেলেকে দেখতে।”

“কী! তুই যাবি ও-বাড়িতে।”

“হুম। দেখবো ওর ছেলে দেখতে কেমন হয়েছে। অর্ণবের মতো হয়েছে নিশ্চয়ই।”

“আজই যাবি?”

“উঁহু। ওর ছেলের নামকরণের অনুষ্ঠানে।”

“কিন্তু….।”

তারানা কিছু বলতে গিয়েও আবার থেমে গেলেন। মোহিনী বললেন,

“কী হলো? থেমে গেলে কেন? কী বলতে চাইছিলে বলো।”

“কিন্তু নামকরণের অনুষ্ঠান তো আজ দুপুরেই। তাই-ই তো জানি।”

মোহিনী খাওয়া থামিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,

“ঠিকাছে। আজই যাবো তাহলে। আমার মায়ের সব জিনিসপত্র কোথায় আছে তারামা?”

“আমার ঘরে। কেন?”

“লাগবে কিছু।”

মোহিনী উঠে হাত ধুয়ে নিলেন। এরপর তারানার ঘরে এসে খাটের নিচ থেকে একটা ট্রাংক বের করলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যেন পছন্দ মতো কিছু একটা পেলেন তিনি। ছোট্ট একটা বাক্সে একটা গলার চেইন। মোহিনী আর ওটা বের করলেন না। বাক্স বন্ধ করে ওভাবেই নিয়ে গেলেন। নিজের ঘরে এসে আলমারি থেকে আরও একটা জিনিস নিলেন। মোহিনীর এমন কাজে তারানা মোটেও সন্তুষ্ট নন। সেদিন মোহিনী কিছুক্ষণের জন্য ঘাবড়ে গেলেও তারপর থেকেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলেন। তার ভয় যেন একদম কেটে গিয়েছে। কিন্তু এতোদিন পর এখনো তারানা নিজের ভয় কাটাতে পারেননি। তার চিন্তা যেন আরও বেড়েই চলেছে। যতই হোক, মোহিনীকে তিনি নিজের মেয়ে বলেই মনে করেন। তা নাহলে এতো ছাড় তিনি কাউকেই দেননি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সেই মেয়েকেই তার হারাতে হবে। মনের মধ্যে ভয়গুলো আরও বেশি করে গেঁথে যাচ্ছে। তবে প্রার্থনা করা ছাড়া এখন আর উপায়ই বা কী তার!
.
.
বাড়িতে আসা সব লোকজন চলে যাওয়ার পর মোহিনী ভেতরে প্রবেশ করলেন। আজ এ-বাড়িতে প্রবেশ করতে কেউ তাকে আটকায়নি। কেউ দেখেনি এমন নয়। দেখেছে, তবুও আটকায়নি। আটকানোর কোনো প্রয়োজন মনে হয়নি। মোহিনীকে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেই উপস্থিত সকলেই একদম স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। পদ্মাবতী নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। মোহিনী অন্যকারও দিকে খেয়াল না করে সোজা পদ্মাবতীর কাছে চলে গেলেন। তার কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“ঠিক বলেছিলাম আমি। একদম বাবার মতোই হয়েছে। আমি কোলে নিতে পারবো ওকে? নাকি আমার কোলে দিতে আপত্তি আছে?”

পদ্মাবতী আম্রপালির দিকে তাকালেন। আম্রপালি ইশারায় সম্মতি দিলে পদ্মাবতী বাচ্চাটাকে মোহিনীর কোলে দিলেন। কোলে নিয়ে বাচ্চাটাকে খুব আদর করলেন মোহিনী। জিজ্ঞেস করলেন,

“কী নাম রাখলি ওর?”

পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। পাশে থেকে শেফালী আস্তে করে বললেন,

“অরণ্য।”

“ভালো তো। শেফালী, ওকে এটা পরিয়ে দে।”

বলেই শেফালীর হাতে ছোট্ট একটা বাক্স দিলেন মোহিনী। বললেন,

“ওর জন্য ছোট্ট একটা উপহার এনেছি। আমি নিজেও এটা ছুঁইনি। তাই এতে কোনো নর্তকীর স্পর্শও নেই। আশা করি ওকে এটা পরাতে কারও আপত্তি থাকবে না।”

শেফালী চেইনটা বাচ্চাটার গলায় পরিয়ে দিলেন। মোহিনী বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে আবার পদ্মাবতীর কাছে দিয়ে দিলেন। তার উপস্থিতিটা এখানে কেউ-ই যে পছন্দ করছেন না তা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি। তার নিজেরও এখানে থাকতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। তাই দ্রুত ফিরে যাওয়াটাই নিজের জন্য ভালো মনে করলেন। কিন্তু যাওয়ার আগে মোহিনীর চোখজোড়া অন্য কাউকে খুঁজতে লাগলো। কোণায় অর্ণবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি। এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালেন। শকুন্তলা কিছু বলতে যাবেন কিন্তু শুধু শুধু কথা বাড়বে বলে আম্রপালি তাকে থামিয়ে দিলেন। মোহিনী কিছুটা তাচ্ছিল্য করে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কেমন আছেন অর্ণব?”

মোহিনীকে দেখে অর্ণবের ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। তিনি নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন,

“ভালো। আপনি?”

“যেমনটা ছেড়ে গিয়েছিলেন। শুধু একটা জিনিস পরিবর্তন হয়েছে আমার জীবনে। আবারও নাচতে শুরু করেছি।”

অর্ণব কোনো জবাব দিলেন না। মোহিনী আবার বললেন,

“আপনাকে আবার এভাবে দেখবো ভাবিনি। সে যাই হোক, আপনার পরিবারের একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে। সেটাও ফিরিয়ে দিতে এসেছি।”

“কোন জিনিস?”

অর্ণবের হাতে বালাটা দিয়ে মোহিনী বললেন,

“এটা।”

“ওহ।”

“কাল সন্ধ্যায় আমাদের জলসায় আপনার আমন্ত্রণ রইলো।”

আর কিছু বললেন না মোহিনী। শোনারও অপেক্ষা করলেন না। চলে গেলেন। তার যাওয়ার পর সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। গোটা পরিবারের কাছে তিনি একটা আতংক ছাড়া যেন কিছুই নন। শান্তি দেবী অর্ণবের সামনে এসে বললেন,

“বালাটা তো আমি তোর বউকে দিতে বলেছিলাম। তুই মোহিনীকে দিয়েছিলি কেন?”

শান্তি দেবী মাঝেমাঝে যেমন সব ভুলে যান আবার তেমনই মাঝেমাঝে তার সবকিছু কীভাবে মনে থাকে এটা ভেবে পাননা অর্ণব। তবে তিনি যে রেগে যাননি তা কথা শুনে বুঝতে পারছেন। কিন্তু তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলেন না অর্ণব।
.
.
.
বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছেন পদ্মাবতী। কিছুতেই ঘুম আসছে না। মোহিনী চলে যেতে যেতেও তাকে কী একটা দুশ্চিন্তায় ফেলে গেলেন। অর্ণবকে কাল সন্ধ্যার জলসায় আমন্ত্রণ জানালেন। অর্ণব কি সত্যিই যাবেন সেখানে? না, অর্ণব যাবেন না। অর্ণব যে সেখানে আর যেতে পারেন না এব্যাপারে নিশ্চিত পদ্মাবতী। এই কয়দিনে তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছেন মোহিনী নামক দুশ্চিন্তাটা তার জীবন থেকে চিরদিনের মতো চলে গেছে। এখন তার আর অর্ণবের সম্পর্কটা আর বাকি পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতোই ভালোবাসায় ভরপুর। অর্ণব এখন আর মোহিনীকে ভালোবাসেন না। শুধু তাকেই ভালোবাসেন। অনেক চেষ্টার পর এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিতে পেরেছেন পদ্মাবতী। এসব ভাবতেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। খাটের পাশেই দোলনাটায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে অরণ্য। ওই ভালো। আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেসবে ওর কিচ্ছু যায় আসে না। ওরই এখন যত সুখের দিন। ঘরে হ্যারিকেন এর টিমটিম আলো জ্বলছে। বারান্দার দরজা দিয়ে হুহু করে শরীর হিম করা শীতল হাওয়া আসছে। যা গরম পড়েছে! হাতপাখায় আর কুলোয় না। এখন এই হাওয়াটাই ভরসা। পদ্মাবতী উঠে বারান্দায় এলেন। অর্ণব একটা সিগার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মাবতী পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার পিঠে মাথা রেখে চোখ বুজে রইলেন। বাইরে প্রচন্ড জোরে বাতাস বইছে। সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এরমধ্যে বিদ্যুৎ চমকে প্রথম বাজটা পড়লো। অর্ণব সিগার শেষ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে এলেন। পদ্মাবতীর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই সাথে চারপাশের পরিবেশটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পদ্মাবতী দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলেন,

“আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারজন। বড়মা, অর্ণব, আমার সন্তান আর মোহিনী। মোহিনী, যাকে আমি ভালোওবাসি আবার ঘৃণাও করি। যার সাথে বন্ধুত্বের মতো একটা পবিত্র সম্পর্ক আমি নিজের হাতে নষ্ট করেছি। যার ভালোবাসার পরিবর্তে আমি তাকে দিয়েছিলাম বিশ্বাসঘাতকতা। পৃথিবীতে যার কাছে আমি সারাটা জীবন দোষী হয়ে থাকবো। কিন্তু আমাকে তো না চাইতেও এসব করতে হয়েছে। নিজের স্বার্থের জন্য। কারণ আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণাও তাকেই করি। আর ঘৃণার পরিমাণটা হয়তো ভালোবাসার চেয়ে বেশিই ছিল। তাইতো কত ক্ষতি করার চেষ্টা করেছি আমি ওর। মে/রেও ফেলতে চেয়েছি। আবার নিজেই নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছি। কিন্তু আমার কর্মের শাস্তি যে আমাকে এভাবে পেতে হবে তা কোনোদিন ভাবতেও পারিনি। অন্যের ক্ষতি করতে গিয়ে আমি নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে ফেলেছি। যা আর কোনোদিন পূরণ হবার নয়। কোনোদিনও নয়। আমার সাথে যা যা হয়েছে তার জন্য আমি কোনোদিনও মোহিনীকে দ্বায়ী করবো না। এসবের জন্য দ্বায়ী আমি নিজেই। আমার সন্তান…”

আর ভাবতে পারলেন না পদ্মাবতী। তার আগেই ভেতর থেকে অর্ণবের ডাক এলো।

“ভেতরে এসো পদ্মাবতী। অরণ্য ঘুমের মধ্যে ভয় পাচ্ছে।”

ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো তার। ভেতরে এসে বারান্দার দরজা লাগিয়ে অরণ্যর কাছে এলেন। বাজ পড়ার শব্দে ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছে বেচারা। অর্ণব ইতোমধ্যেই উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে পড়েছেন। পদ্মাবতী সাবধানে অরণ্যকে কোলে তুলে নিলেন। বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালেই তার সমস্ত দুশ্চিন্তা, হতাশা দূর হয়ে যায়। তার ভাগ্য থেকে দুঃখ দুরাশা দূর করতেই যে বাচ্চাটা এসেছে এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারেন তিনি। অর্ণবের পাশে বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন পদ্মাবতী।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here