মোহঘোর #পর্বঃ১১,১২

0
489

#মোহঘোর
#পর্বঃ১১,১২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
১১

ঝিনুক বেগমের মাথায় পানি ঢেলে মুছিয়ে দিয়েছে পায়েল। বিছানায় শায়িত তিনি। কাতর, নিরুদ্যম চাহনি। তিনি তার কক্ষেই শুয়ে আছেন।

বসার ঘরে সকলের মস্তিষ্ক উদ্বিগ্ন, উদগ্রীব। পারভেজ মির্জা আড়চোখে চেয়ে সরব গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন—

“যদি নুপূর তোমার স্ত্রী হয়ে থাকে তাহলে তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আর আজ-ই কেন এখানে এলে?”

এহসাস সরস হাসল। নুপূরের দিকে তাচ্ছিল্য চোখে চেয়ে নিরুদ্বেগ স্বরে বলল—

“নুপূরের মামা বাড়ি চন্দ্রপুরে আমার বাড়ি। আমাদের সেখানেই পরিচয়। শুধু পরিচয় নয়, প্রণয় আর পরিণয়ও। কিন্তু তা কেউ জানত না। আমার কেউ নেই। একটা বেকারিতে কাজ করতাম তখন। নুপূরের কলেজের পাশেই ছিল। একবার আমাকে না জানিয়েই নুপূর ওর নিজের বাড়ি চলে আসে। অনেক খুঁজে আমি ওর ঠিকানা বের করি। সেদিন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি ওর সাথে দেখা করতেআসি। কথায় আছে না, “অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়।” আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমার শশুড় আব্বা আর শাশুড়ি আম্মা আমাকে দেখে ফেলে। নুপূরের সম্মানের কথা ভেবে আর আবদারে কাউকে কিছুই বলিনি আমি। মেয়ের সাথে অসভ্যতা করার অপরাধে ওর বাবা আমাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে তিনমাস পর বেরিয়ে আসি আমি। ঢাকা চলে যাই। একটা চাকুরী নেই। বর্তমানে আমার নিজের একটা বেকারি আছে। একটা ছোট্ট দোকানও আছে। নুপূরকে চালানোর পুরো ক্ষমতা আমার আছে। তাই আমি আমার স্ত্রীকে নিতে এসেছি। কিন্তু আমি ভাবিনি, নুপূর এখন অন্য পিঞ্জিরায় আবদ্ধ হওয়ার পায়তারা করছে। আর আপনাদের কথা কী বলব! খোঁজ নিয়েছি আমি। বেশিদিন হয়নি তো এখানে এসেছেন। নাম আর রূপের মোহে একটু খোঁজ-খবরও নেয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না। আর আমার আজকের আসার কারণ, শুধু আপনাদের সত্য দেখানোর জন্য। ভদ্রতার মুখোশে কতটা নোংরা রূপ মানুষের লুকিয়ে থাকে। আমি ইচ্ছে করলেই আরও আগে ঝামেলা করতে পারতাম। তা করলে আপনারা এদের আসল চেহারা জানতেন কী করে!”

এহসাস কথা শেষ করে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল। ধীরপায়ে নুপূরের সামনে গিয়ে বলল—

“টাকার পাহাড় না থাকলে অফুরন্ত ভালোবাসা ছিল তোমার প্রতি আমার। কিন্তু আমি তো তোমার মোহ ছিলাম। নব্য যুবতীর আসক্তি! তোমার মোহ যে এত তাড়াতাড়ি কেটে যাবে তা আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু তুমি আমার মোহঘোর ছিলে না, ভালোবাসা ছিলে। তাই তোমাকে আমি ছাড়তে পারিনি। চলো আমার সাথে।”

এহসাস নুপূরের হাত ধরতেই তা ঝাড়া মেরে সরিয়ে ফেলে নুপূর। ভারী চোখে কটমটিয়ে তাকায়। সজলনেত্রে ঝাপসা লাগছে এহসাসের ভরাট মুখশ্রী। তমালিকা কথা বলতে ভুলে গেছেন। নিজের ভুলে ছেলের সাথে তিনি কী করলেন! ইনজাদ প্রকুপিত দৃষ্টিপাত করল মায়ের দিকে। তমালিকার অশ্রুজল সিক্ত আঁখিদ্বয় ব্যাকুলতায় আচ্ছন্ন।

পারভেজ মির্জা উঠে দাঁড়ালেন। কঠোর চাহনি নিক্ষেপ করলেন জুলহাস খন্দকারের দিকে। কোমল স্বরে বললেন—

“আপনার কিছু বলার আছে খন্দকার সাহেব?”

লজ্জায় বক্ষ:স্থল কেঁপে যাচ্ছে জুলহাস খন্দকারের। হাতজোড় করে বললেন—

“মাফ করবেন। মেয়েদেরকে হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসার এই ফল পাবো তা কখনো ভাবতে পারিনি।”

পারভেজ মির্জা গাঢ় কণ্ঠে বললেন—

“ভালোবাসায় কখনো কখনো প্রয়োজনে লাগাম দিতে হয়। লাগামছাড়া ঘোড়া কখনো তার মালিককে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে না। তাই তার লাগাম টেনে দিতে হয়।”

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন জুলহাস খন্দকার। মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। তার বুকের কাছে হাত দিয়ে রেখেছে রেহাংশী। এহসাস অনুরক্তির সুরে বলল—

“আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। কাউকে অপদস্থ করতে চাইনি আমি। নুপূর আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা সামনে আসতে দেইনি বলেই হয়তো আমাদের সম্পর্কটা এখনো টিকে আছে। না হলে তো অনেক আগেই…..। আমি শুধু আমার স্ত্রীকে ফেরত চাই। এতটুকুই।”

জুলহাস খন্দকার মাথা চাপড়ালেন। নুপূর বাবার পায়ে পড়ল। যেন এবারকার মতো তাকে ক্ষমা করে দেয়। না বুঝে সে ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু মেয়ের দিকে ফিরেও তাকালেন না তিনি। পারভেজ মির্জা সশব্দে ঘোষণা করলেন—

“বিয়ে তো হবেই। ছেলের বউ না নিয়ে আমি এ বাড়ি থেকে যাচ্ছি না।”

ত্রিমুল হকচকিয়ে বলল—

“কিন্তু দুলাভাই, মেয়ে তো….।”

“অন্যের স্ত্রী কেন আমার পুত্রবধূ হবে?”

“তাহলে?”

সকলের আগ্রহদীপ্ত চাহনি। সকল চোখের তীব্র পিপাসা। উৎকর্ণ হয়ে আছে সবাই। পারভেজ মির্জা দারাজ গলায় বললেন—

“বড়ো বোন ভুল করেছে তো তার মাশুল ছোটো বোনকে দিতে হবে।”

উপস্থিত জনমনে আঁকুপাঁকু শুরু হলো। কথাশূন্য পরিবেশে শুরু হলো গুঞ্জন। ইনজাদ হতভম্ব গলায় বলল—

“এসব তুমি কী বলছ বাবা? ”

“ঠিক-ই বলছি। বিয়ে হবে। আর ছেলের বউ নিয়েই ফিরব আমি।”

ইনজাদ নাক-মুখ কুঁচকে অস্বস্তি নিয়ে বলল—

“এই হয় না বাবা। আমি….।”

ঝট করেই পায়েল বলে উঠে—

“আমি এই বিয়ে করতে পারব না। আমি… আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।”

স্বস্তির শ্বাস ফেললেন পারভেজ মির্জা। কিন্তু সকলের চোখে-মুখে বিতৃষ্ণার সাথে সাথে শ্লেষ দেখা গেল। পায়েল মাথা নত করে আছে। পারভেজ মির্জা আত্মবিশ্বাসী গলায় বললেন—

” তোমাকে শঙ্কিত হতে হবে না। নুপূর যা করেছে তারপর তোমার ওপর আমি এক চিলতে পরিমাণও ভরসা করতে পারি না। আমি রেহাংশীর কথা বলেছি।”

সকলের মাঝে আবারও উত্তেজনা শুরু হলো। রেহাংশীর শরীর হিম হয়ে এলো। সে নিস্তব্ধ, নীরব। তমালিকা চোখ পাকালেন। তাকে ইশারায় শাসালেন তার স্বামী। নুহাশ কিছু বলবে তার আগেই পায়েল বিক্ষিপ্ত গলায় বলল—

“রেহাংশীর বিয়ে তো ঠিক হয়ে আছে! ও কীভাবে বিয়ে করবে?”

“ঠিক হয়েছে শুধু। তোমার বোনের মতো বিয়ে করে বসেনি আর তোমার মতো কারো সাথে সম্পর্কেও জড়ায়নি।”

পায়েল অপমানিতবোধ করল। সে নীরব হতেই সপ্রতিভ হলো নুহাশ। ভারী গলায় বলল—

“এইটা কী ধরনের ন্যায়! এক বোনের সাথে বিয়ে ভেঙেছে বলে অন্য বোনকে বিয়ে করতে হবে?”

পারভেজ মির্জা রাগান্বিত গলায় বললেন—

“এখানে এখন আর কেউ একটা কথাও বলবে না। আমি বলব তার উত্তর দেবেন খন্দকার সাহেব।”

জুলহাস খন্দকার হতপ্রায়! দুই মেয়ের কর্মকাণ্ডে বিপর্যস্ত তিনি। ইনজাদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেহাংশীর দিকে। তার মনের গহন অন্ধকারে প্রদীপ জ্বলেছে। নুহাশের মাথা ফেটে যাচ্ছে তীব্র আক্রোশে। রেহাংশীর বিয়ে! এ কিছুতেই হতে পারে না। এতকাছে এসে সে তার তরী হারাতে পারে না।

পারভেজ মির্জা প্রশস্ত গলায় বললেন—

“আপনার সামনে দুটো অপশন। এক. রেহাংশীর সাথে ইনজাদের বিয়ে। এই বিয়ে নাহলে আমি আপনার নামে মানহানির মামলা করব। রতনকে নিয়ে ভাবার কিছু নেই। ইনজাদের মামা সুপ্রিম কোটের অ্যাডভোকেট। আইন বিষয়ক সকল সাহায্য আপনারা পাবেন। দুই. নিজের বিবেককে একবার প্রশ্ন করুন। রেহাংশীর জন্য কে উত্তম। ইনজাদ না রতন? আমরা বিয়ের আসরে অপেক্ষা করছি। আপনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন।”

সকলের মাঝে নীরবতা বিরাজ করলেও ফুঁসে যাচ্ছে নুহাশ। পারভেজ মির্জা একটু এগিয়ে গিয়ে রেহাংশীর মাথায় হাত রাখলেন। রেহাংশী ভেজা চোখে সংকোচ নিয়ে তাকাল। তিনি অমায়িক হেসে বললেন—

“আমার ছেলে নিজের মা-কে আমার চেয়ে বেশি সম্মান করে। তাই মায়ের কথা ফেলতে পারেনি। কিন্তু ভালোবাসার দিক থেকে আমি তমালিকার চেয়ে এগিয়ে। আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো। বাকিটা তোমার ইচ্ছে। ”

পারভেজ মির্জা নিজের পরিবার-সহ বেরিয়ে এলেন। অদূরে বসে আছে ইনজাদ। তার দিকে চেয়ে আছেন পারভেজ মির্জা। বাবা-ছেলের এই নীরব আঁতাত ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না ত্রিমুল। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করেন—

“ইনজাদ তো নুপূরকে পছন্দ করে। এখন কী….।”

“ইনজাদ রেহাংশীকে পছন্দ করে। শুধু মায়ের কাতরভরা আবদার রাখতে গিয়ে নিজেকে মনের কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছে আমার ছেলে। আমার ছেলে অপদার্থ নয়। কারো ওপর কর্তৃত্ব দেখানোর পূর্বে তার ওপর অধিকার আদায় করে নিতে হয়। আমি আমার ছেলেকে সেই অধিকার আদায় করে দেবো। একবার চেয়ে দেখ ওর দিকে। কী অবস্থা করেছে নিজের! তবুও মায়ের দেওয়া কথা রাখতে একটা শব্দও করেনি। ”

ত্রিমুলের প্যাচানো মস্তিষ্ক কিছু একটা আঁচ তো করতে পেরেছিল, কিন্তু তা বুঝতে সক্ষম হয়নি। নিজের চতুর বুদ্ধির ওপর ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার!
,
,
,

ফুঁসলে উঠে রেহাংশীকে শাসিয়ে উঠে নুহাশ। খরখরে গলায় বলল—

“তুই আমাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারিস না।”

বদ্ধ কক্ষে রেহাংশীর হৃদয় কেঁপে ওঠল। ভয়চকিত গলায় বলল—

“পায়েল আপু তোমাকে ভালোবাসে নুহাশ ভাইয়া।”

নুহাশ অনুপলেই হিসহিসিয়ে বলল—

“আর আমি তোকে।”

“কিন্তু আমি ইনজাদকে ভালোবাসি। ভালোবাসি, ভালোবাসি।”

ধীরে ধীরে শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে নিচে বসে পড়ে রেহাংশী। জলার্দ্র চোখ অবনত করে জমাট গলায় বলল—

“ফুফু আমাকে কখনো মেনে নেবে না। দাদি কখনো আমার মা-কে মেনে নেয়নি। আমি তোমাকে নিয়ে কখনো এসব ভাবিনি। প্লিজ নুহাশ ভাইয়া, তুমি পায়েল আপুকে বিয়ে করে নাও। আমাকে মুক্তি দাও। এই পারিবারিক মোহঘোর থেকে আমাকে মুক্তি দাও।”

নুহাশ থরথরিয়ে যাচ্ছে। নিজের রাগ নিংড়াতে দেয়ালে সজোরে পাঞ্চ করে বলল—

“আমি তোকে ক্ষমা করব না, কখনো ক্ষমা করব না।”

নুহাশ বের হতেই ডুঁকরে উঠে রেহাংশী। সে চায় না তার মায়ের মতো হোক তার জীবন।
,
,
,
কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই মিটে যায় ইনজাদ আর রেহাংশীর বিয়ে। রতন আর তার বাবা জরুরি কাজে শহরে গিয়েছে।

শেরওয়ানি বদলে একটা টিশার্ট পরেছে ইনজাদ। বুকের অভ্যন্তরে জনান্তিকে পুষে রাখা খুব যতনে তার প্রেমানুভূতির পূর্ণতা ঘটেছে। চোখের তারায় জলপ্লাবনের ধারা জাজ্বল্যমান। তা চুইয়ে পড়ছে নেত্রচ্ছদ দিয়ে। একটু আগে যা হয়েছে তা নিয়ে চিন্তিত নয় ইনজাদ। তার মানসপটে বারবার ভেসে উঠছে রেহাংশীর রোদনভরা দুই আঁখি। মেয়েটা শেষবার যেদিন তার সামনে এসেছিল সেদিনও কেঁদেছিল।বাইরের শোরগোলে নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে ইনজাদ। তাকে দেখেই মামা-মামিসহ, বাবার মুখে অমাবস্যা ছেয়ে যায়। ইনজাদ কঠিন স্বরে বলল—

“রেহাংশী কোথায়?”

ত্রিমুল কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল—

“আপা, কী শুরু করেছিস বল তো! এমন করিস না। যা হওয়ার হয়ে গেছে।”

ইনজাদ ধারলো চোখে চেয়ে ফের প্রশ্ন করল—

“রেহাংশী কোথায় মামা?”

পেছন থেকে ত্রিনা পটপট করে বলল—

“ফুফু আম্মু রেহাংশীকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। ওকে বাইরে দাড় করিয়ে রেখেছে।”

তেরছা চোখে তাকাল ইনজাদ। খিটখিটে মেজাজে বলল—

“এসবের মানে কী আম্মা? ওকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন?”

তমালিকা হাঁফ ছাড়া গলায় বললেন—

“ওই মেয়ে এই ঘরে আসবে না। ”

“কেন আসবে না?”

“তুই কেন বুঝতে পারছিস না। ওই মেয়ে নিজের…।”

“ব্যস আম্মা। অনেক বলেছেন আপনি। আর একটা কথাও বলবেন না।”

ইনজাদ ঘরের দরজা খুলতে গেলে বাঁধা দিতে উদ্যত হয় তমালিকা। তাকে ধরে রেখেছেন ত্রিমুল। ছেলেকে বকে যাচ্ছেন। যেন কোনো অবস্থাতেই রেহাংশীকে ঘরে না ঢুকায়। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায় ইনজাদ। ঝলমলে মরিচ বাতির চোরা চোরা আলোতে বাড়ির সামনে ছোট্ট দাওয়ায় বসে আছে রেহাংশী। ইনজাদ ছোট্ট করে ডাকল—

“রেহাংশী!”

দরদ মাখা সেই আওয়াজে পেছন ফিরে সে। ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ায়। আলো ঝলমলে পরিবেশে এক অন্যরকম আলো দেখল ইনজাদ। অধর বিস্তৃত করে নির্লিপ্ত হাসল। রেহাংশী নিথর চোখে চেয়ে আছে। কোনো প্রাণ নেই তাতে। ইনজাদ কাছে এসে আলতো করে রেহাংশীর হাত ধরল। মোলায়েম স্বরে বলল—

“এসো।”

রেহাংশীকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই চেঁচাতে লাগলেন তমালিকা। সে কিছুতেই এই বিয়ে মানতে চাইছেন না। স্বামীর কারণে তখন নিজেকে অনেক কষ্ট দমিয়েছেন তিনি। ইনজাদ আলতো চোখে চেয়ে ত্রিনাকে বলল—

“ওকে আমার ঘরে নিয়ে যা।”

ত্রিনা মুচকি হাসে। তার ঠোঁটে খেলছে দুষ্টমিষ্ট হাসি। রেহাংশীকে ইনজাদের কক্ষে নিয়ে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেয় সে। ইনজাদ ক্ষুব্ধ গলায় বলল—

“কী শুরু করেছেন আপনি?”

তমালিকা শ্বাস নিলেন। কণ্ঠে প্রাণ এনে বললেন—

“তুই কেন বুঝতে পারছিস না। ওই মেয়ে যেখানে যাবে সব শেষ করে দেবে। যে মেয়ে নিজের মা…।”

“চুপ করুন আম্মা। আর ওই মেয়ে,ওই মেয়ে কাকে বলছেন? এখন আর রেহাংশী শুধু ওই বাড়ির মেয়ে নয় আমার স্ত্রী। আর কী শেষ হওয়ার কথা বলছেন! শেষ তো আপনি করেছেন। আপনাদের বাঁচিয়েছে রেহাংশী। নাহলে যে দাগ আপনাদের ছেলের গায়ে লাগত তা মুছত কে? ও তো দয়া করেছে আপনাদের ওপর। করুণা করে আপনাদের ছেলেকে বিয়ে করে তার মান-ইজ্জত বাঁচিয়েছে। নাহলে ভাবুন আপনার ছেলের হবু বউ আগে থেকেই বিবাহিত। ব্যাপারটা দারুন না আম্মা!”

“তুই আমাকে কথা শোনাচ্ছিস?”

“সত্য দেখাচ্ছি আম্মা। আমি আপনাকে কখনো বলিনি আমি নুপূরকে পছন্দ করি। বলব কী করে! আমি তো নিজেই কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আপনি কী করলেন, বিয়ে ঠিক করে ফেললেন আমার। তাদের কথা দিয়ে ফেললেন। বাধ্য করলেন আমাকে। ওকে ফাইন। সব তো আপনার ইচ্ছেতেই হচ্ছিল। তাহলে ধোঁকা কেন হলো আমাদের সাথে? আবার সেই দোষ আপনি রেহাংশীর কাঁধে তুলে দিচ্ছেন? সেদিন আংটির জন্যও আপনারা তাই করতেন। সবকিছুর মধ্য ওকেই কেন টেনে নিয়ে আসেন? আমার ভাবতে অবাক লাগছে আম্মা, আপনি সত্যিই আমার সেই আম্মা তো যাকে আমি চিনতাম। কী করে বদলে গেলেন আপনি?”

ছেলের কথায় অশ্রুকণা ছলকে উঠল তমালিকার। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি।

চলবে,,,

#মোহঘোর
#পর্বঃ১২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ত্রিনার চতুর, জমঙ্গ, গাঢ় দৃষ্টি। রেহাংশীকে বিছানায় বসিয়ে তার পাশেই ঘেঁষে বসেছে নিজে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রেহাংশীকে দেখছে। শান্ত, নীরব, স্থির। যেমনটা শিকারী শিকার করার পূর্বে অবলোকন করে!

নাকের উপরে থাকা চশমাটা ঠিক করে পূনরায় মনোযোগ সহকারে রেহাংশীকে দেখছে ত্রিনা। বিব্রত হয় রেহাংশী। এত কাছে বসে একজন মানুষ এভাবে দেখাতে তার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে!

ত্রিনা বিস্ময় নিয়ে চট করে বলল—

“তোমার লিপস্টিকটা কোন শ্যাডের? আর এইটা কী রঙ? আমি না বুঝতে পারছি না। তুমি কী জানো?”

রেহাংশী হালকা করে মাথাটা ঘুরিয়ে নরম চোখে তাকাল। ত্রিনা ব্যস্ত হলো রেহাংশীর আঁখিপল্লবে। দীর্ঘ, ঘন, কৃষ্ণকালো পল্লবের দিকে বড়ো করে তাকিয়ে বলল—

“এই তুমি আইল্যাশ লাগিয়েছ? না কী মাশকারা দিয়েছ?”

অপ্রস্তুত হয় রেহাংশী। এসব জিনিস তার হাতের নাগালে নয়। ব্যবহার তো দূর, কখনো ভাবেইনি। নিঃশব্দে ঋণাত্মক মাথা ঝাঁকায় রেহাংশী। ত্রিনা হতাশ হয়। চট করেই এক পশলা বৃষ্টির মতো হেসে ফেলে। অধর বিস্তৃত হয় খুশিতে। বলল—

“তুমি না কিউট। এই তোমাকে আমি কী বলে ডাকব? ভাবী বলব না রেহাংশী? তুমি তো বয়সে আমার থেকে একটু ছোটো হবে। ”

রেহাংশী ঠোঁট চিপে হাসে। ত্রিণা ব্যস্তমুখে বলল—

“তোমার হাসিটাও না সুন্দর। আরেকটু ঠোঁট ছড়িয়ে হাসবে, তাহলে আরও সুন্দর লাগবে। এই শাড়িটা তোমাকে কে দিয়েছে?”

রেহাংশী শাড়ির দিকে তাকাল। জননান্তিকে ভিজে উঠল তার চোখ। মুখটা স্বাভাবিক রেখে বলল—

“এইটা আমার মায়ের বিয়ের শাড়ি।”

“তাই! ও মা, এতদিন রেখে দিয়েছ?”

“হুম।”

“জানো, তোমার নুপূর আপুও না খুব সুন্দর। কিন্তু আমার তোমাকেই পছন্দ। তোমাকে না একদম বারবি ডলের মতো লাগে! ”

রেহাংশী ছোট্ট করে হাসল। মেয়েটা তার থেকে বড়ো হলেও কেমন অদ্ভুতভাবে কথা বলে! হয়তো বাবা-মায়ের ভালোবাসার চাদরে থাকলে এমন-ই হয়! ত্রিনা গরগর করে ফের বলল—

“এই তুমি ইনজাদ ভাইয়াকে কী ডাকবে? নুপূরের সাথে বিয়ে হলে তো দুলাভাই ডাকতে, কিন্তু এখন তো সে তোমার বর! জানো, আমার না একটা কথা মনে পড়ছে। দুলাভাই যখন বর। হাউ ফানি!”

খিলখিল করে হেসে উঠে ত্রিনা। রেহাংশী অপ্রস্তুত হয়। লজ্জায় তার চোখে নেমে আসে। মেয়েটা কীসব বলছে! তৎক্ষণাৎ দরজায় কড়া পড়ে। ইনজাদের ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে আছে।

“ত্রিনা, দরজা খোল।”

ত্রিনা চটজলদি দরজা খুলে দেয়। ইনজাদ ভেতরে ঢুকতেই তাকে দেখে রেহাংশীর দেহ জমে যায়। স্থির, নিষ্কম্প দেহের ভেতর অদ্ভুত শিউরণ হচ্ছে। ইনজাদ একপলক তাকাল রেহাংশীর দিকে। বুক ভর্তি শ্বাস নিল। রেহাংশীর নতজানু মুখ উঁচু হলো না। আড় গলায় বলল—

“তুই যা এখন।”

ত্রিনা প্রসন্ন হাসে। ইনজাদের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—

“তোমার বউটা কিন্তু একদম পুতুলের মতো। মনে আছে আমাকে একটা পুতুল গিফ্ট করেছিলে? ওই যে পিংক কালারের। একদম ওইটার মতো।”

মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসে ত্রিনা। ইনজাদ সচল চোখে রেহাংশীর দিকে তাকাল। তার হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। রেহাংশী হাতের তালু ঘষে যাচ্ছে।

“তুই যা এখন। খেয়ে ঘুমা। আর তোর হুলিয়া চেঞ্জ হয় না কেন? কী পরিস এগুলো? এই ছেলেদের পোশাক পরা ছাড়বি কবে ?”

“বিয়ের পর। সরো, সরো যেতে দাও।”

ত্রিনা তূরন্ত বেগে বেরিয়ে যায়। দরজা লক করে দেয় ইনজাদ। রেহাংশীর শ্বাস ভারী হতে থাকে। আচমকা কম্পন শুরু হয় তার শরীরে। শাড়ির আঁচল মুঠোয় নিয়ে অভাবিতরূপে কচলাতে থাকে। পায়ের আঙুল ঘষে যাচ্ছে একে অপরের সাথে। ইনজাদ মৃদু চোখে তা দেখছে। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে! তার বিষবাণ ভয়ও পায়!

ইনজাদ আরেকটু এগিয়ে আসে। ঘনঘন শ্বাস নিতে থাকে রেহাংশী। ইনজাদের ফর্সা বাড়ন্ত পদযুগলের দিকে চেয়ে তার শরীরের কম্পন বাড়তে থাকল। গলা শুকিয়ে আসছে। নিজেকে সংকুচিত করার প্রয়াসে মনে হচ্ছে কোনো বলয়ে নিজেকে আবদ্ধ করে নেবে। ইনজাদ বিনা শব্দ করে রেহাংশীর সামনে বসে। জড়ীভূত দেহে একটু একটু করে চোখের পল্লব উপরের দিকে ওঠায় রেহাংশী। ইনজাদের মুখচ্ছবি সম্পূর্ণ দৃষ্টিগোচর হতেই হেসে ফেলে ইনজাদ। সেই হাসিতে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় রেহাংশীর। পৌষের শীতের মতো জাড়কাটা দিয়ে উঠে তার কোমল দেহ। ইনজাদ অতি স্বাভাবিক গলায় বলল—

“ক্ষমা করবে আমাকে?”

ইনজাদের এই কণ্ঠ শূলের মতো বিঁধলো রেহাংশীর থমকে যাওয়া হৃৎপিন্ডে। এক মুহূর্তের জন্য তার শ্বাস নিতে কষ্ট হলো। অধর ছড়াল সে। ইনজাদ বিষণ্ণ সুরে বলল—

“আমি জানি ক্ষমা পাওয়ার মতো কিছু আমি করিনি। তবুও আশা তো রাখতে পারি। কারো প্রাণ তো কেড়ে নেইনি। নিজের প্রাণ অন্য কাউকে দিয়ে বসেছিলাম। ভাবতে পারিনি সেই প্রাণ ছাড়া এই দেহের কী হবে?”

“চাচী কোথায়?”

ইনজাদ ঠোঁট গুজ করে বলল—

“আম্মার প্রেশার ফল করেছে। এখন ভালো আছে। শুয়ে আছে ঘরে। চাচী নয়। এখন আর তার সাথে তোমার প্রতিবেশীর সম্পর্ক নয়। আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না যে?”

রেহাংলী থমকাল। চোখ তুলে পূর্ণ নজরে ইনজাদকে দেখল। দেখা হয়নি মানুষটাকে এত ভালো করে। হলুদাভ ফর্সা গায়ের রঙে লম্বাটে আনন। ততটাও লম্বা নয়, আবার গোল বললেও সঠিক হবে না। পুরু, দীর্ঘ, ভ্রমরকালো ভ্রু। তার নিচে দুটো গভীর, গম্ভীর, সুডোল চোখ। চোখের মনি পুরোপুরি কালো নয়। হঠাৎ করে কেউ তাকালে বাদামি ভেবে নেবে। পুরু ওষ্ঠাধর। যাতে লেগে আছে অস্পষ্ট হাসি।
ইনজাদ হতাশ গলায় বলল—

“ডিসাইড করেছ আমার সাথে আর কথা বলবে না? তাহলে তো সেদিন মরে গেলেই ভালো হতো।”

আঁতকে উঠে ইনজাদের মুখ চেপে ধরে রেহাংশী। দমকা গলায় বলে উঠে—

“এসব কী বলছেন? কেন বলছেন?”

ইনজাদ সেই পদ্মকোমল হাত মুখ থেকে সরিয়ে তার তালুতে ছোট চুমু খেলো। বিদ্যুৎ বয়ে গেল যেন রেহাংশীর কম্পিত দেহ ভেদ করে। সে হাত ছাড়ল না ইনজাদ। নির্মল গলায় বলল—

“তোমার মুখ দেখে যাওয়ার পর আমার জবটা হয়েছে। যেখানে একজন ইমপ্লয়ির তিন থেকে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা লাগে, সেখানে আমার তো সার্টিফিকেট ছাড়া কোনো এক্সপেরিয়েন্স নেই। তবুও জবটা আমিই পেলাম।”

রেহাংশী স্নেহসিক্ত গলায় বলল—

“আল্লাহ যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। এতে অন্য কারো হাত নেই।”

“তাহলে তুমি কেন ভাবো যা হচ্ছে তা তোমার কারণে হচ্ছে?”

রেহাংশী চুপ হয়ে যায়। যুক্তির মায়ার জালে আবদ্ধ হয় সে। ইনজাদ হৃষ্ট দৃষ্টিতে তাকায় রেহাংশীর নরম, তুলতুলে মুখের দিকে। চোখচ্ছেদ জলার্দ্র। ইনজাদ হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে একটু উঁচু হয়। রেহাংশীর হাত নিজের বুকের বা’পাশে ধরে আরেক হাত দিয়ে অতি সন্তর্পণে তার চোখের পল্লব ছুঁইয়ে দেয়। জলসিক্ত সেই আঁখিপুটের ভেজা স্পর্শ ইনজাদের আঙুলের ডগায়। সেই পানি রেহাংশীর ঠোঁটে এঁকে দেয়। নিজের ঘাড় নামিয়ে আনে রেহাংশীর গালের কাছে। তীক্ষ্ম নাকের ডগার ঘষা মেরে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। রেহাংশীর অন্তর্দেশে জলপ্লাবনের ধারা ঝিরিঝিরি করে বইতে লাগল। অনতিক্রম্য সংকোচ যেন অনুপলেই উবে গেল। দীর্ঘ তৃষ্ণা নিয়ে ইনজাদকে ঝাপটে ধরল। ইনজাদ অপ্রমেয় প্রণয়ে দুরদিগম্য, দুর্ভেদ্য বলয়ে আবদ্ধ করল রেহাংশীকে। বক্ষের সমস্ত জায়গাজুড়ে বিষবাণের বিষে আড়ষ্ট হয়ে গেল সে। রেহাংশীর কাঁধের কাছে উষ্ণ শ্বাস বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনাস্বাদিত, হঠাৎ আগমন ঘটা এক তীব্র, প্রকট, পরিস্ফুটিত অনুভূতিরা সুড়সুড়ি দিতে লাগল। ইনজাদ চাপা স্বরে বলল—

“এইটুকুর অধিকার তো আমার আছে। লাইসেন্স পেয়েছি তো।”

ক্রন্দনে আচ্ছন্ন রেহাংশী। তার নেত্রদ্বয়ের স্ফীত ধারায় ভিজে উঠল ইনজাদের টিশার্ট, খামচে ধরল বুকের কাছে। ইনজাদ হাতের বেড় দৃঢ় করে ফিচেল গলায় বলল—

“গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেলবে না কী আমাকে?”

“আপনাকে।”

“ইশ! তাহলে এত হ্যান্ডসাম বরটা মিস হয়ে যাবে তোমার।”

রেহাংশী ভরা যমুনার বাঁধ ভেঙে দেয়। ইনজাদ মজার ছলে রেহাংশকে জড়িয়ে নিয়েই মেঝের ওপর শুয়ে পড়ে। হতভম্ব রেহাংশী তড়িঘড়ি উঠে বসে।
মাথার নিচে হাত দিয়ে তার উপর শিয়র রাখে ইনজাদ। চটপটে হাসে। সেই হাসিতে ভ্রু কুঁচকায় রেহাংশী। সংকোচ নিয়ে বলল—

“হাসছেন কেন?”

ইনজাদ নিমীলিত আঁখিতে আবেশিত গলায় বলল—

“ঘুম পাচ্ছে আমার। কতদিন শান্তিতে ঘুমাই না!”

মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ইনজাদের কোমল, সুশ্রী, বিমর্ষ মুখের দিকে আয়তলোচন দুটো স্থির করে রাখে রেহাংশী। অজ্ঞাত স্বর বের হলো তার গলা থেকে। কেমন বিদুর শোনাল তা। বলল—

“কেন?”

চট করে চোখ মেলে ইনজাদ। ঘাড় কাত করে মোহনীয় সুরে বলল—

“যদি বলি তোমার জন্য! বিশ্বাস করবে?”

ব্রীড়াতে কাতর হয় রেহাংশী। জমে হিমালয় হয়ে এলো সে। চোখ নামিয়ে নিল। পাঁজরে পাঁজরে সংঘর্ষ চলছে। ইনজাদ উঠে বসে। রেহাংশীর একদম কাছে। তার গালে হাত রাখে। চোখ তুলে তাকাল রেহাংশী। মৌনতায় নেমে এলো চোখের বার্তা। একে অন্যের মোহে আচ্ছন্ন হওয়ার মাহেদ্রক্ষণ। ইনজাদ তার তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠাধর ছুঁইয়ে দেয় রেহাংশীর সমান্তরাল, মসৃণ ললাটে। চক্ষু মুদন করে মেয়েটি। শ্বাসক্রিয়া বাড়তে থাকে। নীরব ঘাত-প্রতিঘাতে একে অন্যকে পর্যদুস্ত করার নিরন্তর প্রচেষ্টা। ইনজাদের হৃৎকুঠিরে আগুনের শিখা জ্বলে ওঠে। অভেদ্য, দুর্গম, নিচ্ছিদ্র দূর্গ জয়ের অভীপ্সা জাগ্রত হয় তার পুরুষ মনে। অধরের স্নেহার্দ্র ছোঁয়া ললাট চুইয়ে নেমে আসে চোখের পাতায়। বসন্তের প্রজাপতি উড়তে থাকে রেহাংশীর অন্তঃকরণে। ইনজাদ হাসে। শব্দহীন তৃপ্তিকর হাসি। রেহাংশীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—

“এক বিষবাণে আমার ঘুম কেড়ে নিলে! এখন তো পুরো বিষকুন্ড আমার। যখন প্রতিটি শিরা-উপশিরায় তোমার বিষ প্রবাহিত হবে, বাঁচব তো আমি?”

লজ্জায় রাঙা হয় রেহাংশীর বদন। অধরে ধরে কাঁপন।মুগ্ধ নয়নে তা হৃদয় জুড়িয়ে উপভোগ করছে ইনজাদ। তার অপ্রতিরোধ্য ওষ্ঠাধরের সাহস বৃদ্ধি পায়। প্রাণনাশিণীর কাছে নিজেকে সোপর্দ করতে ব্যাকুল সে। কিন্তু বাতাস কাঁপিয়ে বেজে উঠল মোবাইল ফোন। পা ছড়ায় ইনজাদ। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ব্যগ্রতা নিয়ে তার রিসিভ করেই ধমকে উঠে বলল—

“তোর খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নেই! অসময়ে ফোন করিস কেন?”

মেহমাদ বিরক্তি নিয়ে বলল—

“ফিকিরি আলাপ করবি না। তাড়াতাড়ি ঢাকা আয়।”

ইনজাদ চমকিত গলায় বলল—-

“বিয়ে করেছি বাসর করিনি এখনো! আর তুই বলছিস ঢাকা যেতে! মাথা খারাপ তোর?”

নিজের কথায় নিজেই হতভম্ব হয়ে যায় ইনজাদ। রেহাংশীর চমকিত মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ভোলা ভোলা হাসি দিয়ে বলল—

“জাস্ট আ মিনিট।”

ইনজাদ উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ায়। কালো আকাশের এক ভরাট চাঁদ। সেদিকে চেয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল—

“পাগল হয়েছিস? কী বলছিস তুই?”

“দেখ ভাই, আমার কিচ্ছু করার নাই। আঙ্কল কাল রাতের ফ্লাইটেই সিংগাপুর যাবে। তাই বিকেলের মধ্যেই রেস্টুরেন্টের উদ্বোধনের কাজ শেষ করবে। তুই দুপুরের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছা।”

ইনজাদ বিষিয়ে উঠা গলায় বলল—

“মানে কী এসবের? বিয়ে করেছি মাত্র। কত ঝামেলা শেষ করেছি জানিস! বউয়ের সাথে এখনো দুটো কথা বলতে পারিনি আর তুই বলছিস ঢাকা যেতে। রেস্টুরেন্ট শুরু করতে তো আরও এক সপ্তাহ লাগার কথা!”

“ভাইরে ভাই! বউ পালিয়ে যাচ্ছে না তোর। তবে কাল যদি ঢাকা না আছিস তোর চাকরি নির্ঘাত পালাবে। আর কিছু জানি না। বাকি টা তোর ইচ্ছে। ইচ্ছে হলে আয়, নাহলে বাসর কর। যেইটা তোর খুশি। পরে আমাকে কিছু বলতে পারবি না।”

মেহমাদ লাইন কেটে দেয়। হাতের ঘড়ির দিকে দৃষ্টি ফেলে ইনজাদ। ব্যস্তময় চাহনি তার। রেহাংশী ভয় জড়িত গলায় বলল—

“কী হয়েছে?”

ইনজাদ নিরদ্বেগ স্বরে বলল—

“আমাকে সকালেই ঢাকা যেতে হবে।”

“সকালেই চলে যাবেন?”

ইনজাদ তাকাল। রেহাংশীর চোখ জোড়ায় বিস্ময়ের সাথে উদ্বেলতা। ইনজাদ মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে অবিচলিত গলায় বলল—

“চিন্তা কোরো না। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না। তুমিও আমার সাথে যাবে। চেঞ্জ করে হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আমি বাবার সাথে কথা বলে আসছি।”

ইনজাদ দ্রুতপায়ে দরজা কাছে যেতেই রেহাংশীর নিমগ্ন কণ্ঠস্বর—

“আমার কাছে তো আর শাড়ি নেই।”

ইনজাদ ফিরে তাকাল। উর্বরমস্তিষ্ক এতসময় ঘোরের মধ্যে ছিল। না হলে মেয়েটা শাড়ি পরে আছে তা একবারও লক্ষ্য করল না সে! শাড়ির ভাঁজে শরীরে বাড়ন্ত ভাব আসলেও মুখটা সেই বাচ্চাদের-ই। ইনজাদ নরম হাসল। বলল—

“তুমি বসো, আমি ত্রিনাকে পাঠাচ্ছি।”

মেয়েটাকে শাড়িতে দেখেই যেন আরেক দফা প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হলো ইনজাদের। তবে নিরুদ্বেগ সে। রহস্য হাসে ইনজাদ। যা তার তা শুধু তার-ই। অন্য কারো সেখানে কোনো অধিকার নেই।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here