#মোহঘোর
#পর্বঃ২১,২২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
২১
শেষ দুপুরের ক্লান্ত রোদ। পশ্চিমে হেলতে শুরু করা প্রভাকরের রাক্ষুষে দাপট কমে গেলেও তার আভা ছড়িয়ে আছে শহরতলির পথে-প্রান্তরে। যেন গগনবিদারী রক্তক্ষরণ হচ্ছে পিচঢালা সড়ক পথে!
নিমেষহীন চোখে চেয়ে আছে রেহাংশী। কোণার দিকের টেবিলে বসে থাকলেও তার উদ্ভাসিত, কৌতূহলী আর তাচ্ছিল্য দৃষ্টি আটকে আছে রেস্তোরাঁর মাঝের দিকের সামনের টেবিলে। স্লিভলেস পাতলা টপ আর টাইট জিন্স পরা মেয়েটার শরীরীয় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অত্যন্ত প্রস্ফুটিতভাবে ধরা দিচ্ছে মানুষের বাহ্যিক চোখে। রেহাংশীর এমন অদ্ভুত চাহনিতে বিব্রত হলো ইনজাদ। পেছন ফিরে মেয়েটিকে দেখেই সামনে তাকাল। গলা কেঁশে বলল—
” এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”
ধ্যাণ ছুটল রেহাংশীর। চোখ নত করল দ্রুততার সাথে। অস্বস্তি কাটাতে মিইয়ে গলায় বলল—
“কিছু না।”
ইনজাদ হাসল। স্যুপের বাটি থেকে চামচ উঠিয়ে ঠোঁটের ভাঁজে দিলো। সাবলীল গলায় বলল—
“এভাবে আর কখনো তাকাবে না।”
রেহাংশী চমকিত নজরে মাথা তুলল। মোলায়েম চাহনিতে লজ্জারা ভর করল জোরালো মাত্রায়। ইনজাদ চামচটা বাটিতে রেখে টেবিলের ওপর হাত রেখে নরম গলায় বলল—
” ‘ডোন্ট জাজ আ বুক বাই ইটস কভার’ কথাটা নিশ্চয়ই শুনেছ? কারো উপরিভাগ দেখে তাকে চেনা যায় না। কারো জামা-কাপড় তার চরিত্র মূল্যায়ন করতে পারে না। ”
রেহাংশী লজ্জিত হয়। শহুরে মানুষের চালচলন তার বোধগম্য নয়। মেয়েটির শরীরের সমস্ত খাঁজ এমনিতেই বোঝা যাচ্ছে। তাকে দেখে অপ্রস্তুত রেহাংশী। সে যে এ বিষয়ে অবগত নয় তা নয়, তবুও দৃশ্যমান ওই অযাচিত দৃশ্য তার মনের কোণে অদ্ভুত আবছায়া তৈরি করল।
ইনজাদ গাঢ় গলায় ফের বলল—
“এই যে তুমি মেয়েটির দিকে তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ! এতে সে বিব্রত হবে। তবে তারচেয়ে বেশি তুমি হবে। তুমি হয়তো ভাবছ, মেয়েটি উশৃঙ্খল ! একচুয়েলী এইটা আমাদের সংস্কৃতি পরিবর্তনের একটা ধাপ। আমরা ওয়েস্টার্ন কালচার ফলো করতে করতে কখন যে নিজের সংস্কৃতি- সভ্যতা পেছনে ফেলে এসেছি তা নিজেও জানি না। শাড়ি পরা অনেকেই এখন সেকেলে ভাবে। কিন্তু একসময় এই শাড়িতে নারী বোঝাত। বিদেশে কেউ যখন শাড়ি পরে বের হয় তখন কিন্তু ওই দেশের মানুষ আমাদের এই সংস্কৃতিকে ভালোবাসার চোখে দেখে। এপ্রিসিয়েট করে। কিন্তু দেশের মানুষ হয়ে আমরা অনেক সময় তার অবমাননা করি। আর ওয়েস্টার্ন কালচার গ্রহণ করলেই যে মনটা ওয়েস্টার্ন হয়ে যায় তা নয়। আজকাল মানুষ কমফোর্টের জন্য বিভিন্ন কিছু ট্রাই করে।
কিন্তু যাই হোক, এইটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আর কখনো এভাবে দেখবে না কাউকে। এতে মানুষের ধারণায় বাজে ইফেক্ট পড়ে। খাও।”
রেহাংশী ঠোঁট গুঁজ করে বলল—
“খাবো না আমি।”
“একটু কিছু তো খাও। স্যুপটা খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে।”
“না, আমার স্যুপ ভালো লাগে না।”
ইনজাদ একটু ধাতস্থ হয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে কিছু বলতে গেলেই ব্যগ্রতায় বলে উঠে রেহাংশী—
“দয়া করে আপনার পান্ডিন্ত্যের দ্বার খুলবেন না। আমি স্যুপ খাবো না।”
অধর ছড়িয়ে হাসল ইনজাদ। নম্র গলায় বলল—
“কী খাবে বলো।”
“কিছু না।”
“কিছু না খেলে কী করে হয় বিষবাণ! এত কষ্ট করে রেস্টুরেন্টে এলে, কিছু তো খাও। আইসক্রিম খাবে?”
রেহাংশী কিছু সময় চুপ থেকে বলল—
“হুম।”
“কোন ফ্লেভার? ম্যাংগো, ব্ল্যাকবেরি, স্টবেরি, ভেনিলা, বাটার স্কচ….।”
“দুর! চুপ করুন তো। এত নাম বলার কী আছে? একটা হলেই হলো।”
ইনজাদ ছোট্ট করে হেসে বলল—
“তোমার কোনটা পছন্দ বলো?”
রেহাংশী ভাবান্তরহীন গলায় বলল—
“কোনোটাই না।”
চোখে হাসল ইনজাদ। রেহাংশী চোখের পল্লব নাচিয়ে তাকাল। চোখা নাক-মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠল। ইনজাদ তিমনকে ডাকল। তাকে ম্যাংগো আর বাটার স্কচ ফ্লেভারে আইসক্রিম আনতে বলে। রেহাংশীকে দেখেই চট করেই হাসল সে। তারপর চলে যেতেই রেহাংশী চোখ বড়ো বড়ো করে বলল—
“এই ছেলেটা এখানে কাজ করে? ওর কী পড়াশোনা শেষ? দেখে তো আমার থেকেও ছোটো মনে হয়! এত জলদি পড়া শেষ হলো কী করে?”
“উঁহু, ও এখনো পড়ে। এখানে পার্ট টাইম জব করে।”
“ও।”
তিমন কিছুক্ষণ পর আইসক্রিম নিয়ে আসে। একগাল ফুরফুরে হেসে রেহাংশীর দিকে তাকায়। তার জন্য আলাদা একটা আইটেমও নিয়ে আসে। ক্যাপিচিনো! ইনজাদ মুচকি হেসে বলল—
“কফি কেন এনেছ?”
তিমন মায়াময় হাসল। অল্প বিস্তর গলায় বলল—
“এইট আমার তরফ থেকে ম্যামের জন্য।”
ইনজাদ রেহাংশীর দিকে তাকাল। মৃদুহাস্য অধরে তার দিকে চোখ রেখেই বলল—
” আইসক্রিমের সাথে কফি! হোয়াট আ কম্বিনেশন!”
লজ্জায় গাঢ় হলো তিমনের চোখের দর্পণ। কোমল চোখে চেয়ে কানের লতিতে টান ধরে বলল—
“সরি স্যার।”
“ইটস ওকে। তোমার ম্যাম না খেলেও আমি খেয়ে নেবো। আমার খাওয়া রুচি তোমার ম্যামের তুলনায় ভালো।”
তিমন প্রাণোচ্ছল হেসে রেহাংশীর দিকে তাকিয়ে লজ্জামিশ্রিত গলায় বলল—
“সরি ম্যাম।”
“আরে না, না। কিছু হবে না। আমি খেয়ে নেবো।”
আরেক দফা মন জুড়ানো হাসল তিমন। তার চোখ দুটো খুশিতে টগবগ করে ওঠল।
গলিত আইসক্রিম ঠোঁটের কোণে লেগে আছে রেহাংশীর। ইনজাদ নিগূঢ়, মোহবিষ্ট, আবেশিত নজরে তাকিয়ে আছে। রেহাংশীর অধরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে তার বুকের পাঁজরে। মেয়েটার চোখের পল্লবের ওই বঙ্কিম ধাঁচে হাজার দিবস চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ইনজাদ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে রইল। আচানক তার ধ্যাণ ছুটে। শশব্যস্ত হয়ে পেছন ফিরতেই হৈ-হুল্লোড় শুনতে পায়। মেয়েলী তীক্ষ্ম স্বর কাঁচবন্ধ রেস্তোরাঁয় ঝংকার তুলল।
ইনজাদ ব্যগ্র গলায় বলল—
“তুমি বসো, আমি আসছি।”
উদ্বিগ চোখে চেয়ে রইল রেহাংশী। গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এলো।
রেস্তোরাঁর সামনের দিকের টেবিলে একটি মেয়ের জোরালো কণ্ঠস্বরে কাঁপন উঠেছে স্টাফদের দেহে। চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ। ইনজাদ ব্যস্ত পায়ে এসেই বলল—
“এক্সকিউজ মি! কী সমস্যা আপনার?”
মেয়েটি ফিরে তাকাল। গাঢ় কফি কালারের টপস গায়ে পরা মেয়েটির ধারালো চাহনি, বজ্রের মতো কণ্ঠ আর তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্ব। আড় ঠোঁটে দাঁতে দাঁত চাপল মেয়েটি। ইনজাদকে দেখেই ফুঁসে উঠে বলল—
“ও আপনি তাহলে এখানকার ম্যানেজার?”
ইনজাদ নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বলল—
“জি।”
মেয়েটি রাগের অগ্নি বর্ষণ করে বলল—
“হোয়াট দ্যা হেল! এই আপনাদের সার্ভিস? চুল! স্যুপে চুল?”
ইনজাদ গম্ভীর চোখে তাকাল। টেবিলের ওপর আঁখি নিবদ্ধ করে। দৈবাৎ অভূতপূর্ব ঘটণা ঘটল। মেয়েটি টেবিল ক্লথ ধরে একটান মারতেই টেবিলের সব খাবার পড়ে গেল মেঝেতে। ইনজাদ কঠিন শান্ত। মানান পাশ ঘেঁষে এসে চাপা স্বরে বলল—
“ঝামেলা কোরো না ইনজাদ।”
ইনজাদ পুরো রেস্তোরাঁয় চোখ বোলাল। অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সকলের উৎসুক চাহনি। ইনজাদ গাঢ় স্বরে চট করে বলে উঠল—
“সবাই শান্ত হোন। কেউ বিচলিত হবেন না। আপনারা সবাই যার যার জায়গায় বসুন।”
মেয়েটির শরীর কাঁপছে। ইনজাদ কোমল চোখে তাকাল। সাবলীল গলায় বলল—
“বলুন, কী সমস্যা আপনার? একদম ডিটেলসে বলবেন। আর বাংলায়। যেন আপনার প্রতিটি শব্দ সকলের বোধগম্য হয়।”
চলবে,,,
#মোহঘোর
#পর্বঃ২২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
মেয়েটির তীক্ষ্ম দৃষ্টি ভেদ করল ইনজাদের কঠোর, স্পষ্ট স্বর। মেয়েটি হাসল। তীর্যক হাসি। রেস্তোরাঁর রান্নার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও ততক্ষণে রিসিপশনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শেফ তুষারের তখন নাজেহাল অবস্থা। উৎসুক শ্রোতাদের তখন আগ্রহের শেষ নেই। মেয়েটি সম্পূর্ণ রেস্তোরাঁয় চোখ বুলাল। ইনজাদের দিকে ভাবহীন চোখে চেয়ে বলল—
“খাবার রান্না করার আর সার্ভ করার সময় দেখে নেবেন। এইখানে মানুষ বিনা পয়সায় খেতে আসে না। উপরন্তু আপনারা অন্যান্য রেস্টুরেন্ট থেকে দ্বিগুন দাম আদায় করেন। আর আপনাদের এই সার্ভিস! একটা কফি অর্ডার করেছি তাতে চুল! এখন বলবেন না চুলটা মেয়েদের। ”
মেয়েটি কফির মগ থেকে পাওয়া চুলটা ইনজাদের চোখের সামনে ধরে। ইনজাদ নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে চাইল। স্টাফদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। সবাইকে যথেষ্ট সেফ থেকেই সব ধরনের কাজ করতে বলা হয়েছে। মাথায় ওয়ান টাইম টুপি, হাতে গ্লাবস এমনকি মাস্কও। আস্ত মাথা ঢেকে রেখেই রান্না ঘরের কাজ সামলায় তুষার। এদিক থেকে সে সচেতন। ইনজাদের কড়া নির্দেশ। খাবার নিয়ে কোনো ধরনের গাফেলাতি সে মেনে নেবে না।
ইনজাদ দৃঢ় হয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল—
“ইউ আর রং ম্যাম, এমনটা হতেই পারে না।”
মেয়েটি তটস্থ চোখে চেয়ে বলল—
“কী বলতে চান আপনি? আমি মিথ্যে বলছি?”
ইনজাদ অল্প বিস্তর হাসল। চোখে সাবলীলতা রেখে বলল—
“মিথ্যে কি না জানি না। তবে আপনার অভিযোগ সত্য নয়। পুরো রেস্টুরেন্টে তিনটা ক্যামেরা আছে। তিনটা ক্যামেরা গভীর পর্যবেক্ষণের সাথে পুরো রেস্টুরেন্ট কভার করে। আপনি সত্য বলছেন কি মিথ্যে তা বের করতে আমার দুই মিনিট লাগবে।”
ইনজাদ থামল। মেয়েটি স্বাভাবিক। তার চোখে- মুখে অস্বাভাবিক না দেখে খানিক চমকাল ইনজাদ। গাঢ় কণ্ঠে বলল—
“মানান ভাই, মনিটরিং রুমে গিয়ে ফুটেজটা দেখে আসুন।”
মেয়েটি বাঁকা হাসল। ইনজাদ সদর্পে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুজল। দারাজ গলায় বলল—
” আমরা আমাদের কাস্টমারদের পুরো খেয়াল রাখি। তাদেরকে বেস্ট জিনিসটা সার্ভ করার চেষ্টা করি। দামের ব্যাপারে অনেকের-ই সংকোচ থাকতে পারে। আমি তা ক্লিয়ার করছি। আমাদের এখানে দুটো শিফটে কাজ হয়। যারা এখানকার সার্ভিস বয় তারা সবাই স্টুডেন্ট। তবুও আমরা তাদের এখানে নিয়োগ দিয়েছি। এইটা আমাদের রেস্টুরেন্টের মালিক একান্ত ইচ্ছে মোতাবেক। আমরা এখানে বেস্ট জিনিসটাই ইউজ করি। সেইটা তেল থেকে শুরু করে দশ টাকা দামের একটা ডিম-ই হোক না কেন! আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এখন বলতে পারেন এইটা সম্ভব নয়। আমি বলব সম্ভব। আমরা আমাদের ব্যবসায়িক নৈতিকতা মেনে চলি। প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে ভালো জিনিস খুঁজে বের করা এতটা সহজ নয়। আমরা তার জন্য আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করেছি। যার দরুন স্বাভাবিকের চেয়ে আমাদের খরচ বেশি হয়। আপনি ইচ্ছে করলে করলে আমাদের কিচেনরুম দেখতে পারেন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, যদি আপনার মনে হয় আমাদের রেস্টুরেন্টে ভোক্তা সংরক্ষণ আইনের কোনো নিয়ম ভেঙ্গেছে আপনি যেকোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারেন।”
মেয়েটি দাম্ভিক হাসল। বলল–
“তাহলে চলুন। পরখ করে নেওয়া যাক।”
ইনজাদ বাঁধা প্রদান করে বলল—
“নো ম্যাম। এভাবে আমি আপনাকে অ্যালাউ করব না। আগে আপনাকে কথা দিতে হবে, যদি আপনার অভিযোগ মিথ্যে হয় তাহলে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।”
মেয়েটি চমকিত গলায় বলল—
“কীসের ক্ষতিপূরণ?”
“আমাদের যে গুড ইউল আপনি ভূলুন্ঠিত করলেন তার ক্ষতিপূরণ।”
মেয়েটি শ্লেষমিশ্রণ করে বলল—
“ও রিয়েলী!”
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে উলটো করে দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে বসল মেয়েটি। তার চিবুক লেগে আছে চেয়ারের উঁচু জায়গায়, যেখানে পিঠ হেলান দেওয়া থাকে।
ইনজাদ গৌরবের সাথে বলল—
“আমরা আমাদের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন ঠিকভাবে মেনে চলি। তাতে বিন্দুমাত্র হেরফের হয় না। আপনি আপনার অধিকার মতো আমাদের ওপর অভিযোগ করতে পারেন উইথ প্রুভ। কিন্তু, যদি তা মিথ্যে প্রমানিত হয় তার ক্ষতিপূরণও আপনাকে দিতে হবে। আপনার জন্য এইটা নিছক একটা রেস্টুরেন্ট হলেও অনেকের জন্য তার একমাত্র উপার্জনের রাস্তা। এখানে কোনো দুষ্কর্ম নয়,বরঞ্চ মানুষের খিদের চাহিদা পূরণ করে আমরা আমাদের চাহিদা পূরণ করি। অর্থের বিনিময়ে যারা এখান থেকে নিজেদের আহার গ্রহণ করেন তারা জানেন আমরা তাদের কী সার্ভিস দিই। আমরা কাউকে জোর করিনি। চার্টে বিল দেওয়াই আছে। তা জানা সত্ত্বেও তারা এখানে আসেন। আর কেন আসেন সেইটা এখানকার ভি আই পি কাস্টমারদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। আশা করি আপনার বোধগম্য হয়েছে, কেন এখানে খাবারের দাম বেশি রাখা হয়।”
মেয়েটি বাঁকা হেসে ভাবাবেশ ছাড়া বলল—
“হাউ ফানি! তাই বলে দ্বিগুন?”
“বলেছি তো ম্যাম জোর করিনি। আল্লাহ পাক মানুষকে বিবেক ও বুদ্ধি দুটোই দিয়েছেন। সাথে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ প্রাণী হওয়ার সম্মান। তারা নিশ্চয়ই নিজের বিবেক আর বুদ্ধি কাজে লাগাবে।”
উৎসুক শ্রোতারা তৃপ্ত হলেন। রেহাংশী ভীতসন্ত্রস্ত চিত্তে ইনজাদের পাশে এসে দাঁড়াল। ক্ষুণ্ণ চোখে চেয়ে সংকোচ মনে ইনজাদএর ডান হাত আলগোছে ধরল। মেয়েটি কৌতূহলী চোখে চেয়ে আগ্রহী স্বরে বলল—
“হু ইজ শি?”
“শি ইজ মাই ওয়াইফ।”
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট ঢোগ গিলল রেহাংশী। মেয়েটি আপাদমস্তক তাকে স্ক্যান করে দেখল। রেহাংশী ছোট্ট স্বরে ভয় জড়োয়া কণ্ঠে বলল—
“কী হয়েছে?”
ইনজাদ চোখে হেসে সরস গলায় বলল—
“কিছু না।”
মেয়েটি চোখের কোণে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বক্রোক্তি করল—
“ওয়াইফকে নিয়ে এসেছেন! নাইস!”
হিসাবরক্ষক মানান মনিটরিং রুম থেকে ফিরে এসে ইনজাদের কানের কাছে কিছু একটা বলল। ইনজাদের অধরে খেলে গেল তুষ্টির হাসি। ঝলমলে চোখে চেয়ে বলল—-
“তো বলুন ম্যাম, এবার আমাদের ক্ষতিপূরণ আপনি কীভাবে দেবেন?”
সকলের প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে ঘায়েল হলো মেয়েটি। কিন্তু অবলীলায় সে উঠে দাঁড়ায়। মুচকি হাসল। রেহাংশী জড়িভূত হয়ে ইনজাদের গা ঘেঁষল। ভয়ভীত চাহনি। মেয়েটি দাম্ভিকতার সাথে ইনজাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ধারলো কণ্ঠস্বরে বিদীর্ণ করল শব্দহীন পরিবেশ।
“ওয়েল, বলুন কী করতে হবে আমায় মি. ইনজাদ মির্জা?”
ইনজাদ অল্প বিস্তর বিভ্রান্ত হলো। ভ্রক্রুটি করে বলল—
“তেমন কিছু নয়। আগামী একমাস আপনাকে আমাদের রেস্টুরেন্টের প্রমোটিং করতে হবে, অনলাইন বা অফলাইন। যেইটা আপনার সুবিধা। বাড়তি খরচের কারণে বিজ্ঞাপনের খরচ কম করা হয়েছে আমাদের। ফলশ্রুতিতে আমাদের প্রচার হয়নি তেমন। সেই কাজটা না হয় আপনি করুন, নিজের খরচে।”
“আর ইউ জোকিং?”
“নো ম্যাম। ইটস আ রুলস। আপনি কোনো প্রুভ দেখাতে পারেননি। ”
ইনজাদ একটু ঝুঁকল। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল—
” আর ফুটেজ দেখিয়ে আমি আপনার ইমেজের ফালুদা করতে চাই না। আপনার আরেকটু খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।”
ইনজাদ আরেকটু ঝুঁকে মেয়েটির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—
“টেবিলের মাঝে যে ফ্লাওয়ার ভাস ছিল তার মাঝে হিডেন ক্যামেরা ছিল ম্যাম। আই থিংক আর কিছু বলতে হবে না।”
মেয়েটি চট করেই হেসে ফেলল। ইনজাদ সোজা হয়ে দাঁড়াল। মেয়েটির হাসিতে বিব্রত হলো ইনজাদ। মেয়েটির সহসা ক্ল্যাপিং এ সকলে আরেক ধফা চমকাল। সে উচ্চ আওয়াজে বলল—
” সরি, সরি এভরিওয়ান।”
মেয়েটির পাতলা গোলাপি ওষ্ঠাধরে খেলল দুর্ধর্ষ হাসি। ইনজাদ ভড়কে গিয়ে বলল—
“হোয়াট?”
মেয়েটি অনাবিল হেসে হাত বাড়াল হেন্ডশেকের জন্য। মুগ্ধ গলায় বলল—
“হাই! আই এম সিন্ধুজা।”
ইনজাদ উদ্ভাসিত চোখে চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় নিয়ে বলল—
“সিন্ধুজা! ”
“ইয়েস।”
ইনজাদ থতমত খেয়ে বলল—
“আআআআপনি! সিন্ধুজা! সিন্ধুজা আহসান?”
সিন্ধুজা ছোট্ট করে হেসে বলল—
“জি।”
“ও মাই গড! আই এম সো সরি ম্যাম। আসলে আমি…।”
ইনজাদকে মাঝ পথে থামিয়ে দিলো সিন্ধুজা। সতেজ গলায় বলল—
“ইটস ওকে।”
“কবে ফিরলেন আপনি? আর স্যার?”
“ড্যাড সামনের সপ্তাহে আসবে। তুমি ড্যাডকে ইমেইল করেছিলে। তাই আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে বলল। অনেক নাম করেছে ড্যাড তোমার। তাই পরখ করে দেখলাম। আই এম রিয়েলী ইমপ্রেসড।”
ইনজাদ মিষ্টি করে হাসল। মাথাটা নিচু করে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে মসৃণ কপালে লজ্জাভাব কাটাতে আঁচড় কাটল। রেহাংশী অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে। হতভম্ব সকলের দৃষ্টি মুহূর্তেই শিথিল হলো।
,
,
,
নিজের বসার কক্ষে রেহাংশীকে বসাল ইনজাদ। তার সামনে চেয়ারের নিচের দিকে পা ভাঁজ করে শূন্যে ভর দিয়ে বসল ইনজাদ। রেহাংশী আকণ্ঠ উৎসুকতা নিয়ে বলল—
“মেয়েটা এমন করল কেন?”
ইনজাদ সচল গলায় বলল—
“জানি না। তুমি এখানে বসো, আমি কথা বলে আসছি।”
ইনজাদ উঠতে গেলে তার হাত টান দিয়ে ধরে রেহাংশী। ছোট্ট মুখটায় ভয়ের লুকোচুরি। কাজলকালো চোখে ভীতি। তার কপালে উষ্ণ চুম্বন করল ইনজাদ। গালে হাতে দিয়ে বিশ্বাসের সাথে বলল—
“ডোন্ট ওয়ারি। কথা বলেই চলে আসছি আমি।”
একগাদা জড়িভূত অনুভূতি নিয়ে নিজেকে সংকুচিত করে বসে রইল রেহাংশী।
,
,
,
সিন্ধুজার সামনে একটা কার্ড এগিয়ে দিলো ইনজাদ। তার ঠোঁটের ভাঁজে তখন শোভা পাচ্ছে সরু স্ট্র। ইনজাদ মৃদু গলায় বলল—
“স্যারকে আমি পুরো ব্যাপারটা জানিয়েছি। তারা আমাকে বলেছে একমাস পরে তারা পেমেন্ট করবে। এত বড়ো রিস্ক! অবশ্য রিস্ক অ্যান্ড রিটার্ন একই সাথেই চলে।”
“কত হতে পারে সেই অ্যামাউন্ট?”
“তারা বলেছে প্রতি সপ্তাহে চারবার ডেলিভারি হবে খাবার। দুটো অনাথ আশ্রম, একটা এনজিও আর একদিন কিছু পথশিশুদের জন্য। সব মিলিয়ে সপ্তাহে প্রায় দুই লাখ হবে। মাস শেষে তা আট লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। তাদের গুড উইল অ্যান্ড রিটার্ণ পলিসি প্রশংসার দাবিদার। আমি অবশ্য খোঁজ নিয়েছি। কোম্পানির চেয়ারম্যান আমেরিকা থাকেন। বর্তমানে হৃৎরোগে আক্রান্ত তিনি। কোম্পানির সিইও তার নাতি। যথেষ্ট অনুরাগী তিনি দাদার বর্ষ পুরোনো এই ঐতিহ্য সম্পর্কে। তবুও আপনি খোঁজ নিন। কোনো গোলমাল হলে আমার পক্ষে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া অসম্ভব।”
সিন্ধুছা চমৎকার করে হাসল। তার হাসিতে লাজুক হাসল ইনজাদ। এত বড়ো একটা কন্ট্রাক্ট হাত ছাড়া করা ঠিক নয়। কিন্তু তাতে ঝামেলাও অনেক। স্টাফ, কাঁচামাল আর সময় সবকিছুর পরিবর্তন প্রয়োজন। আগের চেয়ে দ্বিগুন খরচ। ব্যাপারটা বিশাল। তাই ইনজাদ নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। যেহেতু সে শুধু এখানকার একজন ভেতনভুক্ত কর্মচারী।
সিন্ধুজা কিছুক্ষণ মনোযোগ সহকারে কার্ডটা দেখছে। এক্আ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। বিভিন্ন কান্ট্রিতে তাদের আধিপত্য বিস্তার। আচানক কেঁপে উঠে ইনজাদের মোবাইল ফোন। অতি সন্তর্পনে পকেট থেকে বের করে দেখল রেহাংশী কল করেছে। ইনজাদ মুচকি হাসল। কল রিসিভ করেই টেবিলের ওপর উলটো করে রাখল মোবাইল ফোন। সিন্ধুজা আশ্বস্ত গলায় বলল—
” ওকে আমি খোঁজ নিচ্ছি। ড্যাডের সাথে কথা বলে তোমাকে জানাচ্ছি।”
“ওকে ম্যাম।”
সিন্ধুজা উৎসুক হলো। টেবিলের ওপর দুই হাত রেখে ইনজাদের দিকে মনোযোগী হয়ে বলল—
“প্রফেশনাল কথা বাদ। তুমি আমাকে ম্যাম নয় সিন্ধুজা বলতে পারো।”
ইনজাদ গাঢ় মায়ায় হাসল। ঝট করেই প্রশ্ন ছুড়ল সিন্ধুজা—
“বিয়ে করেছ কবে?”
“দেড় মাস।”
“কি নাম ওর?”
“রেহাংশী।”
“নাইস নেম। মিনিং জানো? আর গ্রামের মেয়ে বুঝি?”
“হ্যাঁ। রেহাংশী মানে দিব্য বা অদ্ভুত। ও আসলেই অদ্ভুদ। বলতে পারেন অদ্ভুত মায়াবিনী। যার পদ্মদিঘীর মতো দুই চোখে মায়ার বহর। ”
ইনজাদ মোহবিষ্ট হলো। তার গলার স্বরে মাদকতা ভর করল। ওপাশ থেকে সব শুনতে পেল রেহাংশী। তার বুকের সাগরে ঢেউ তুলল অগাধ জলরাশি। সিন্ধুজা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল সম্মোহিত ইনজাদের চোখের তারায়। যেখানে শুধুই প্রেয়সীর জন্য আকণ্ঠ মুগ্ধতা আর ভালোবাসা।
চলবে,,,