#মোহঘোর
#পর্বঃ২৩,২৪
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
২৩
তপ্ত রোদের বিভীষিকায় ক্লান্ত যান্ত্রিক নগরী। নাভিশ্বাস উঠা যন্ত্র মানবদের নিরন্তর পথচলা। দগ্ধ রোদে ঘাম জড়িয়ে পিচঢালা সরু পথে হুলস্থুল অবস্থা। পথের ধারে ঝুড়ি পেতে বসা বিক্রেতা। খদ্দেরের আশায় বুক পেতে থাকা। কোলাহলে জর্জরিত পড়ন্ত বিকেলের ঝিমুনি ধরা পরিবেশ। এই যান্ত্রিক শহরে কেউ কারো নয়। নিজেতে মশগুল সবাই। বিবস্নানের ম্লান আলোকচ্ছাটাও পৌঢ়া তেজ। তা অবলীলায় বিধ্বস্ত করছে জনজীবন। ডাসা ডাসা চোখ মেলে চেয়ে আছে রেহাংশী। অপরিচিত, অজানা শহর ঢাকাকে দেখছে গাঢ় চাহনিতে। জ্যাম লেগে আছে মিনেট পাঁচেক ধরে। হালকা টান লেগে আবার স্তব্ধ রিকশার তিন চাকা। ইনজাদের কাঁধের দিকে মাথা হেলিয়ে আস্বাদন করছে শহুরে কালো ধোঁয়ার মিশ্রিত মলয়ের তীক্ষ্ম গন্ধ। গাড়ির হর্ণ, তেল পুড়ানো ধোঁয়া, মানুষের হট্টগোল, সব মিলিয়ে এক ব্যস্ত, কর্মমুখর শহর। রেহাংশী অবলীলায় চোখ মেলে তা দেখছে। আর ভাবছে তার শান্ত, স্নিগ্ধ, ভালোবাসায়পূর্ণ গ্রামের বাড়ির সেই আধপাকা মেঠোপথ, ধান গাছের ডগার ঢেউ, বিস্তৃত নদীর বুকে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ হলদে রোদের ঝিলিক, গাছের ডালে বসে থাকা ডাহুক পাখি, জানালার পাশে বেড়ে ওঠা সেই মস্ত আমগাছ, ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়া সেই সুপারি আর তাল গাছের সারি। কিছুই নেই শহরের এই যন্ত্র মানবদের পরিবেশে। শ্বাস নিতেও যেন মেপে নিতে হয়। বিষাক্ত ধূলিকণা, গ্যাস কমিয়ে আনে জীবশ্বাস।
মাথার ওপর আস্ত নীলাভ আকাশ। রেহাংশী সেই দিকে পূর্ণ নজর ক্ষেপন করল। নীলাভ নভোলোকের মাঝে গুচ্ছ গুচ্ছ শুভ্র জলদ। রেহাংশী হালকা মাথাটা নিচু করে পশ্চিমাদেশে তাকাল। কোথাও শুভ্রতার মায়া নেই। তার একটু ওপরে নীলাভের ভাঁজে ভাঁজে সেজে আছে শুভ্র মেঘ। একদম সমান্তরালে মাথার ওপরের দিকটায় সাদার মায়া যেন হারিয়ে দিলো নীলচে আকাশকে। রেহাংশী মৃদু হাসল। আকাশ নিশ্চয়ই রাগ করবে!
ইনজাদ পাশ ফিরে মেয়েটিকে দেখল। কথা বলা টিয়াপাখি চুপচাপ। সে গাঢ় স্বরে বলল—-
“চুপকথা ! কেন বলো না কথা?”
রেহাংশী চট করে মাথা নিচু করল। অধরে দোল খেলালো প্রাণবন্ত হাসি। মৃদু শ্বাসে খুশির আমেজ। ইনজাদ প্রশ্বস্ত করল আঁখি। বিকেলের এই নরম আভায় ঘেমে গেছে মেয়েটি। তীক্ষ্ম নাকের ডগায় স্বচ্ছ মুক্তোর দানার মতো ঘাম। গলার কাছটায় জমেছে নোনতা জল। সামনে থাকা ছোটো ছোটো কেশ অবাধ্য কিশোরীর মতো অগোছালো হয়ে আছে। ইনজাদ আলগোছে ললাটের কুন্তল সরিয়ে দিলো। প্রশ্ন করল—
“গরম লাগছে?”
রেহাংশী ছোট্ট করে জবাব দিলো—
“না।”
চোখের হাসির সাথে ওষ্ঠাধরেও বহমান হলো সেই হাসি।
“তাহলে ঘামছ কেন?”
“কই?”
ইনজাদ চাপা স্বরে বলল—
“বিষবাণ এত অবুঝ হয় কী করে?”
রেহাংশী গাঢ় মায়ায় হাসল। শেষ বিকেলের মলিন আভা তার হাসিতে প্রাণ এনে দিলো। মেয়েটির এই দুর্বোধ্য, গূঢ়, হৃৎকুঠির বিদীর্ণ করা হাসিতে বারংবার এক অক্লান্ত , অবিমিশ্র, অপরাস্ত, অপ্রেময় প্রণয়ে আহত হয় ইনজাদ। অক্ষিকোটর হতে নিঃসৃত ঝলক দেওয়া চাহনির নিরবচ্ছিন্ন আঘাতে বিক্ষত হয় তার বুকের পাঁজর। স্বগতোক্তি করল ইনজাদ—
“যদি হাজার রজনী বিনিদ্র কাটে তোমার প্রতিক্ষায়, আমি মেনে নেবো সেই অতন্দ্রি নক্তের আহ্বান। যদি সহস্র বছর কেটে যায় তোমার অভিমানে, আমি ধরণীর প্রতিটি দিন কাটাব তোমার শ্বাসে সংগোপনে।”
চট করে রিকশা থেকে নামল ইনজাদ। আঁতকে উঠে প্রশ্ন ছুড়ে রেহাংশী—
“কোথায় যাচ্ছেন?”
ভীতসন্ত্রস্ত রেহাংশীর কোমল মুখে তাকিয়ে এক দুর্দমনীয় ইচ্ছা জাগল ইনজাদের। বঙ্কিমের ভ্রূ এর মাঝে দেখা গেল চঞ্চলতা। চোখের পাতা ভয়ে প্রসারিত হলো। এক আস্ত চুমু খেতে ইচ্ছে হলো ইনজাদের রেহাংশীর কোমল অধরে। নিজেকে সংযমী রেখে স্বাভাবিক গলায় বলল—
“তুমি বসো, আমি আসছি। মামা খেয়াল রাখবেন। একমাত্র বউ আমার। দ্বিতীয় বিয়ে করার টাকা নাই।”
রিকশাওয়ালার তার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে প্রসন্ন হাসল। রেহাংশী জড়োসড়ো হয়ে বসল। ইনজাদ দুষ্ট হাসির ছলে তার লজ্জার ভাব বাড়িয়ে দিলো দ্বিগুন।
সিনএনজি আর প্রাইভেট কারের ফাঁক গলিয়ে ফুটপাতে উঠল ইনজাদ। একটা চা-সিগারেটের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।
ইনজাদের আঙুলের ভাঁজে সিগারেট। স্বগৌরবে তা ঠোঁটের ভাঁজে দিয়ে ফুঁকে যাচ্ছে। রেহাংশী একটু পরপর বিব্রত হয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করছে। ঝিমঝিম করছে তার শরীর। রিকশা থেকে ইনজাদকে দেখার জন্য ঘাড় ঘুরাতেই রিকশাওয়ালা সাবধানী গলায় বলল—
“ঠিক কইরা বহেন মামি। চিন্তা কইরেন না। ঢাহা শহরের জেম এত সহজে ছাড়ত না।”
রেহাংশী নীরস চোখে এই রোবটপুরীকে দেখে। তার ভালো লাগে না এই শহর। নেই শীতল হাওয়া, পাখির কলতানে ঘুম ভাঙা, রোদের সোনালী আঁচ, রিমঝিম বৃষ্টির টুপটুপ শব্দ। আছে শুধু কোলাহল!
চট করেই তার পাশে এসে বসল ইনজাদ। রেহাংশী চকিতে তাকাল। তার ভ্রূ যুগল টানটান হলো। অক্ষিকোটর ভরে গেল উৎসুকতায়। ইনজাদ মোহবিষ্ট হাসল। রেহাংশীর দিকে ঠান্ডা পানীয় এগিয়ে দিয়ে বলল—
“এইটা খাও। ”
কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল—
“ভেতর থেকে ঠান্ডা করে দেবে তোমায়। আর যেইটুকু উষ্ণ থাকবে ওইটা আমার জন্য।”
রেহাংশী চোখ-মুখে খিঁচে নিল। লোকটা কীসব বলে!
“কি হলো খাও।”
“আপনি খেয়েছেন?”
“না। তুমি খাও।”
বোতলের মুখ খুলে দিলো ইনজাদ। তাতে চুমুক লাগায় রেহাংশী। তার মুখের দিকে অতলান্ত প্রেমময় চাহনিতে আড়ষ্ট হলো ইনজাদের বাঁধনহারা নয়নযুগল। নিচের অধরের খাঁজে জমা নোনতা বৃষ্টির ফোঁটা আঙুল দিয়ে মুছে দিলো ইনজাদ। রেহাংশী থামিয়ে দিলো তার ঠান্ডা পানীয়ের স্রোত গেলা। ইনজাদের দিকে ভরাট চোখে চাইল। ডানহাতে থাকা ফ্লাওয়ার ক্রাউনটা চট করে মাথায় বসিয়ে দিলো ইনজাদ রেহাংশীর। বিস্ময়ে আবিষ্ট হলো সে। ইনজাদ সরস গলায় সম্মোহিতের ন্যায় বলল—
“মাই ফ্লাওয়ার গার্ল, উইল ইউ বি মাই হার্ট?”
রেহাংশী চোখ গুঁজে দিলো ইনজাদের বাহুর সাথে। লজ্জানত মুখ রাঙা হলো শিমুল ফুলের রক্তিম আভায়। আরক্ত মুখের ব্রীড়াতে কাতর রেহাংশীকে বাঁচাতে চোখ ফেরাল ইনজাদ। মেয়েটার লজ্জা কমাতে পারেনি সে। আনমনেই তার অধর বিস্তৃত হলো নিজের পরাজয়ে। রেহাংশী আড়চোখে চাইল ইনজাদের দিকে। জ্যাম ছুটলেই রিকশা চলতে শুরু করল। তার মাথায় শোভা পাচ্ছে ফুলের মুকুট। যেন ফুল রাজ্যের রাজকন্যা সে, আর পাশে তার সুদর্শন রাজকুমার। ইনজাদের হাতে দিকে তাকাল রেহাংশী। প্রেমাত্মক চাহনিতে চাইল ইনজাদের মুখের দিকে। পবনের আধিক্যতে উড়ছে ইনজাদের ঝাকড়া চুল। সেইদিকে বদ্ধদৃষ্টি রেখে ইনজাদের আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল গুঁজে দিল রেহাংশী। আস্ত কাঁধ জুড়ে নিজের ভর ফেলে অন্য হাত দিয়ে সেই আঙুলের ভাঁজ গুঁজে দেওয়া হাত বুকের সাথে জড়িয়ে নিল সে।
রেহাংশীর পীড়িত মনে জাগ্রত হয় এক ভয়ংকর,অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়। এই মানুষটা তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। সে চায় না তার মায়ের সাথে যা ঘটেছে তার সাথেও তাই ঘটুক। ভালোবাসা যেন মোহঘোর না হয়ে যায়!
নিজের ভয় কমাতে আরেকটু জোরে চেপে ধরল ইনজাদের হাত। ইনজাদ অস্বাভাবিকতা আঁচ করে চাইল। রেহাংশীর নির্বিকার, নিমেষহীন, সমাহিত চাহনি। ইনজাদ চক্ষু আড়ালে তার অধর ছোঁয়াল রেহাংশীর ললাটে। আবক্ষ প্রেমে ডুবল রেহাংশী।
চলবে,,,
#মোহঘোর
#পর্বঃ২৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
শুভ্র ধোঁয়ার কুন্ডলি ঘুরপাক খাচ্ছে ইনজাদের চোখের দর্পণে। শ্রান্ত চোখের চাহনি মত্ত সেই দৃশ্য দেখাতে। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে এক পা সোজা আর অন্য পা ভাঁজ করে বসে আছে সে। আঙুলের মাঝে কলুষিত শোভা বর্ধন করছে জ্বলন্ত সিগারেট। ইনজাদের পাশেই বসে আছে মেহমাদ। তার অন্তর্গূঢ় চাহনি। খরখরে গলায় বলে উঠে—
“ঘরে বউ রেখে আমার ঘরে বসে আছিস কেন?”
নেশাক্ত মনুষ্যের মতো ঘাড় ঘুরাল ইনজাদ। চোখের পাতা ভারী হয়েছে। জড়ানো গলায় বলল—
“রেহাংশী সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না।”
মেহমাদ তির্যক গলায় বলল—
“তো!”
“কিন্তু ও কিছু মুখে বলে না।”
“এই জন্য এখানে এসেছিস? আমার ঘর কী তোর ফাঁকা মাঠ মনে হয়? বের হ শালা!”
ডাসা এক লাথি বসাল মেহমাদ ইনজাদের পায়ের কাছে। আধ খাওয়া সিগারেটটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই টানতে থাকে। সুখ সাগরে ডুবে গিয়ে বলল—
“বউ বিলাস করছিস উইথ আউট ট্রিট!”
ইনজাদ স্থবির গলায় বলল—
“বিয়েতে যাসনি কেন? আমার কী দোষ?”
মেহমাদ তিরস্কার করে বলল—
“পরতে গিয়েছিল তো গলায় নুপূর! রেহাংশীকে নিয়ে আসলি কেন?”
ইনজাদ ভাবনাহীন চোখে তাকাল। শীতল গলায় বলল—
“ভালোবাসি ওকে আমি।”
মেহমাদ হাসল। সেই হাসিতে প্রগাঢ় তৃপ্ততা। নেই কোনো শব্দ। ইনজাদ পিঠ টানটান করল। সরল গলায় বলল—
“ব্যাংকার তো হলি, এইবার বিয়েটা কর।”
সিগারেটে চূড়ান্ত টান মারল মেহমাদ। বাকি ফিল্টারটুকু বিছানার কাঠের অংশের সাথে চেপে ছুড়ে ফেলল। সপ্রতিভ গলায় বলল—
“কথা বলেছি আব্বার সাথে। আম্মা একটু খেচখেচ করছে আর কি! তবে মেনে নেবে। তিয়া ওর বাবা- মাকে জানিয়েছে। দেখা করেছি আমি। আপত্তি করার চান্স নেই।”
ইনজাদ স্বর ভার করে বলল—
“তাহলে আর কি! করে নে বিয়ে।”
“হুম।”
“বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলেছি আমি। নতুন বাসাও দেখেছি। দুই বেডের রুম। ড্রয়িং-ডায়নিং একসাথে। আমার হয়ে যাবে। তোর সমস্যা নেই তো?”
মেহমাদ চিন্তাহীন গলায় প্রত্যুত্তর করে—
“আরে না। রিফাতের মেসে থাকব কয়েকদিন। সমস্যা নেই। তোর বিয়ের আগেই ভাবা উচিত ছিল। রেহাংশী এখানে কমফোর্টেবল নয়।”
ইনজাদ নত গলায় বলল—
“সরি ইয়ার!”
“আরে ধ্যাত! সরির কী আছে? এমনিও এত বড়ো ফ্লাটে আমরা দুইজন কী করব! ওরা যখন ছিল তখন না হয় পোষাত। কিন্তু এখন! ত্রিশ হাজার টাকা কী কম কথা! আমাদের আরো আগেই ভাবা উচিত ছিল। দুই মাস শুধু শুধু বাড়তি টাকা দিলাম….।”
“আজ সিন্ধুজা এসেছিল রেস্টুরেন্টে।”
ইনজাদের কথায় থেমে গেল মেহমাদ। প্রবল আগ্রহদীপ্ত হয়ে বলল—
“মানে? সত্যি ! ও ফিরল কবে?”
“জানি না। তবে আজ এসেছিল। মাই গড! শি ইজ ভেরি ডেঞ্জরাস!”
মেহমাদ ফিচেল হেসে রহস্য করে বলল—
“সাবধান! দূরে থাকিস ওর কাছে থেকে। বিলাতি হোয়াইট র্্যাট। ”
ইনজাদ মুচকি হাসল। তার চোখে সতেজতা। শূন্যে তাকিয়ে মায়াচ্ছন্ন হয়ে বলল—
“ডোন্ট ওয়ারি বন্ধু! যেই নেশা ধরেছে তা কাটাতে এই জীবন লেগে যাবে আমার। ডাইভ্রাট হওয়ার চান্স নাই।”
“কেন? রেহাংশী কী তোকে আফিম খাইয়েছে না কোকেন? না কি এলএসডি গিলিয়েছে?”
ইনজাদ অদ্ভুত শব্দ করে মাদকভরা কণ্ঠে বলল—
“বি প্র্যাকটিক্যাল। বলা যাবে না। বিয়ে কর, জেনে যাবি।”
মেহমাদ ফিক করে হেসে ফেলে। ইনজাদ অনুজ্জ্বল হেসে বলল—
“গেলাম, নেশা ধরেছে আমার।”
মেহমাদ ছোট্ট করে হাসল। ইনজাদ উঠে ওয়াশরুমে যায়। ভালো করে কুলকুচি করে ফিরে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে প্রশ্ন ছুড়ে—
“সিন্ধুজা কী করে রে?”
“আপাতত কিছু না। বিজন্যাস ম্যানেজমেন্টের ওপর একটা কোর্স করেছে শুনেছি। ”
“আর কে আছে ওর?”
“আঙ্কলের একটা ছেলে আছে। সিক্সে পড়ে। তার ওয়াইফ…।”
মেহমাদ থেমে গেল। ইনজাদ তোয়ালে সরিয়ে ঔৎসুক্য দৃষ্টিতে চাইল। মেহমাদ আবার বলতে শুরু করল—
“এসব কিছুর মালিক আনটি। আঙ্কলের সাথে বিয়ে হওয়ার পর তিনি এসব দেখাশোনা করেন। পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি তার নামে। আনটি এখন ঝামেলাহীন থাকতে চায়। সিন্ধুজা আনটির প্রথম স্বামীর সন্তান।”
“তোর সাথে ওদের পরিচয় হলো কী করে?”
“তিয়া পড়াত সৌরভকে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইনজাদ। মেহমাদ বিছানা ছেড়ে উঠে এলো। আলমিরা থেকে একটা লাল রঙের প্যাকেট বের করল। তার মধ্যে ছোট্ট একটা বক্স। ইনজাদের কাছে এগিয়ে এসে প্রাণখোলা হেসে বলল—
” এইটা রেহাংশীর জন্য। বিয়েতে যেতে পারিনি তাই দেওয়া হয়নি। আর এখানে এসেও এত ঝামেলার মাঝে ভুলে গেছি। ফিটিং চাইলে ঠিক করে নিস।”
দ্বিরুক্তি করল না ইনজাদ। আংটির বক্সটা যত্নের সাথে নিল। মৃদু হাসল সে।
,
,
,
নিজের কক্ষে প্রবেশ করল ইনজাদ। বুকশেল্ফের কাঁচের ওপর আঙুল দিয়ে বিড়বিড় করছে রেহাংশী। ইনজাদ নিঃশব্দে পাশে দাঁড়াল। স্বামীর উপস্থিতি বুঝেও কোনো প্রতিক্রিয়া করল না রেহাংশী। আঙুল টপকে টপকে চলছে।
ইনজাদ ছোট্ট করে হাসল। নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে নিজের কাজ আওড়াল। রেহাংশীর শাড়ি ভেদ করে তার অসংবৃত উদরে গাঢ় স্পর্শ আঁকল। রেহাংশী নিরুত্তাপ। জিবের ডগায় তখন সংখ্যার আনাগোনা। ইনজাদ বুকে ঠেকাল রেহাংশীর পিঠ। পেলব, তুলতুলে উদরে বাড়ল গহন ছোঁয়া। নিজের ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঠেকাল রেহাংশীর কানের কাছে। নীরব ঘর্ষণে আন্দোলিত হলো রেহাংশীর স্থবির কায়া। তবে সে বাঁধা দিলো। নিজের কাজে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে স্বামীর ছোঁয়ায় বেড় লাগাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলল। চোখের দৃষ্টি বুকশেল্ফের কাঁচে আবদ্ধ রেখেই ইনজাদকে থামানোর চেষ্টা করল। থামল না প্রেমিক পুরুষ। অপ্রতিরোধ্য, দুর্দমনীয় হয়ে উঠল জনান্তিক ছোঁয়া। রেহাংশী হার মানল। থমকে দিলো চেষ্টা। ইনজাদের সাহস বাড়ল। অপ্রমেয়, অনিরুদ্ধ, অতলান্ত সংসর্গে অসহায় হয়ে পড়ল রেহাংশী। প্রাণহারিণীর স্পর্শকাতরতায় বিগলিত দেহে আর তাপ বাড়াল না ইনজাদ। রেহাংশী কাছ থেকে সরে বিছানায় বসল। রেহাংশী তরল শ্বাস ফেলল। কলিজায় বিঁধে থাকা তীর তাকে এ যাত্রায় বাঁচতে দিলো!
ইনজাদ মোবাইল ফোনে মনোনিবেশ করল নিজেকে। গুনে শেষ করল বইয়ের বহর রেহাংশী। স্থির হলো সে। শ্বাস ভারী করে বলল—
“একশ পঞ্চাশটা বই! আপনি এত বই পড়েছেন?”
ইনজাদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল—
“হ্যাঁ। আর ওগুলো বেশিরভাগ একাডেমিক বই। কিছু সাজেসন্স আর অলটারনেটিভ বই আছে। গোটা কতক গল্প- উপন্যাস আছে। পড়া হয়নি তেমন। ঢাকা আসার পর যত বই কিনেছি একটাও ফেলেনি। জমিয়েছি।”
রেহাংশী ফিক করে হেসে ফেলল। ভ্রূ বাঁকিয়ে তাকাল ইনজাদ। রেহাংশী হেসে হেসে বলল—
“আমি তো এক বছরের বই দিয়ে অন্য বছর সাদা কটকটি কিনে খেয়েছি।”
ইনজাদ নাকের উপরিভাগের ললাট কুঞ্চন করল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল—
“সাদা কটকটি কী?”
“আরে সাদা কটকটি। এমন মোটা হয়। আপনি খাননি?”
“ওগুলো সাদা নয় অফ হোয়াইট বা ক্রিম কালার বলে।”
“একটা হলেই হলো।”
ইনজাদ মুচকি হাসল। মৃদু গলায় বলল—
“এদিকে এসো।”
রেহাংশী কাছে এসে দাঁড়ায়। তাকে উরুর ওপর বসায় ইনজাদ। রেহাংশীর মুখটা ইনজাদের মুখ থেকে একটু ওপরে। বিনা দ্বিধায় তার তপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়তে লাগল ইনজাদের চোখে-মুখে। ইনজাদ সরস গলায় বলল—
“সামনের মাসে আমরা নতুন বাসায় যাচ্ছি। তোমাকে নিয়ে যাব। দেখে আসবে।”
“মেহমাদ ভাইয়াকে বলেছেন?”
“হ্যাঁ। আর এক সপ্তাহ তো। বাড়িওয়ালাকে দুই মাস আগেই বলে রেখেছি। ভাগ্য ভালো যে অন্তিম মুহূর্তে বাসা পাওয়া গেছে। না হলে হোটেলে উঠতে হতো।”
“মেহমাদ ভাইয়া রাগ করেনি?”
ইনজাদ রেহাংশীর ডান হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে ঠোঁট ছোয়াল। একটু অসচেতন হতেই ব্যালেন্স নষ্ট হয় রেহাংশীর। দ্রুতবেগে ইনজাদের কাঁধের দিকটা খামচে ধরে। ইনজাদ নরম গলায় বলল—
“আরে না। ও তো আগেই একবার বলেছিল।”
তৎক্ষণাৎ মোবাইল বেজে উঠে ইনজাদের। স্ক্রিনে ভেসে উঠে “বাবা” শব্দ। ইনজাদ রিসিভ করল। রেহাংশী গভীর মনোযোগে চেয়ে রইল ইনজাদের দিকে। সে উৎকর্ণ হয়ে শুনছে বাবা-ছেলের কথোপকথন, আর মুগ্ধ দৃষ্টি ইনজাদের স্নেহার্দ্র আননে। ইনজাদের কপালের ফ্যাকাশে তিল থেকে শুরু করে তার চিবুকের শেষ অব্দি প্রগাঢ়, প্রেমাত্মক চাহনিতে অবলোকন করছে রেহাংশী। ইনজাদের রেডিস ওষ্ঠাধরের কম্পনে গলা শুকিয়ে আসে তার। ঊষর গলায় কষ্টকর ঢোক, চোখের পাতায় লজ্জারা হুটোপুটি খাচ্ছে। রেহাংশী উঠে যেতে চাইলেও পারল না। তার কটিদেশ তখন ইনজাদের দৃঢ় হাতের বাধনে আবদ্ধ। নিজেকে ধাতস্থ করে ইনজাদের কানে কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—
“আমি বাবার সাথে কথা বলব।”
মিনিট না যেতেই কল কাটল ইনজাদ। অধৈর্য গলায় বলে উঠে রেহাংশী—
“কাটলেন কেন? বললাম না আমি কথা বলব!
কতদিন হয়েছে কারো সাথে কথা বলি না। আপনি নাম্বারও দিলেন না আমাকে।”
ছো মেরে ইনজাদের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নেয় রেহাংশী। তাতে লাভ হলো না। মোবাইল লক। ইনজাদ নিজের জয়ে বাঁকা হাসল। বলল—
“এদিকে এসো।”
রেহাংশী নিচের ঠোঁট বাঁকিয়ে ফুলাল। বাচ্চা বাচ্চা চাহনিতে অসহায় গলায় বলল—
“এমন করলেন কেন?”
“ডেকেছি তোমাকে আমি।”
ভাবাবেশ ছাড়া পূনরায় ইনজাদের উরুর ওপর বসল রেহাংশী। ইনজাদ মোবাইল নিয়ে নেয়। গাঢ় স্বরে বলল—
“এইটা শাস্তি। আমাকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি।”
রেহাংশীর চোখের আয়তন ছোটো করল। ক্ষুণ্ণ গলায় বলল–
“সেইটা তো অনেক আগের।”
“শাস্তি কঠোর হওয়া উচিত। যাতে পরবর্তীতে তার পূনরাবৃত্তি না ঘটে।”
রেহাংশী মনোকষ্ট নিয়ে বলল—-
“তাই বলে..।”
“কথা দাও আর কখনো এমন করবে না। ঝগড়া হলেও কথা বন্ধ করা যাবে না, বিছানা আলাদা করা যাবে না।”
রেহাংশীর ক্ষুদ্র পদ্মলোচনে জল জমা হলো। মাথা নাড়িয়ে বলল—
“করব না।”
রেহাংশীর বাজুতে চিবুক ঠুকে ইনজাদ। সশব্দে বলল—
“তাকাও আমার দিকে।”
রেহাংশীর অক্ষিকোটর প্রশস্ত হলো। নতমুখ উঁচু হলো।ভাবুক গলায় বলল—
“কী?”
“না ঘুমালে কী হয় জানো?”
রেহাংশীর চোখের পাতায় ভাবনার প্রজাপতি উড়তে লাগল। নানা রঙের প্রজাপতির ফাঁকে সে দেখত পেল একজোড়া গম্ভীর, মোহনীয়, ভরাট চোখ। রেহাংশীর অমীমাংসিত, সন্দিহান, ভীত চাহনি। ইনজাদ মৃদু হেসে বলল—
“না ঘুমালে ডার্ক সার্কেল হয়। এই যে দেখো এখানে। তোমার কারণে আমি কত রাত ঘুমাতে পারিনি।”
রেহাংশী ত্রস্ত কণ্ঠে বুকে পাথর চাপা অনুভব নিয়ে বলল—
” আমি কী করেছি?”
ইনজাদ হেয়ালি গলায় বলল—
“এই যে বিছানা আলাদা করেছ! তুমি কী জানো, তোমার সৌরভ ছাড়া আমার এখন ঘুম আসে না! মধ্য রাতের ঘুমকাতুরে দুই চোখও তোমায় খুঁজে! তোমার উষ্ণ শ্বাস যতক্ষণ না আমার গলা ছুঁয়ে দেয় ততক্ষণ আমার হৃৎকম্পন সচল হয় না। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার বিষবাণ! ভুলেও আর এ ভুল কোরো না। পার্থিব নেশা তো আমি ছাড়তে পারব, কিন্তু তোমায় ছাড়তে পারব না। এই নেশা ছাড়লে মৃত্যু অনিবার্য।”
রেহাংশী আচমকা গলা জড়িয়ে ধরল ইনজাদের। নিরেট গলায় বলল—
“আর কখনো এমন করব না। আপনি আর এমন কথা বলবেন না। দোহাই লাগে আপনার।”
ইনজাদ নরম হাসল। হাতের বাঁধন দৃঢ় করতেই রেহাংশী পুরোদস্তুর পুরে গেল ইনজাদের বক্ষ পিঞ্জিরার ছায়াতলে।
হিসহিসিয়ে বলল—
“এমন করার সুযোগ দেবো না আমি। মনে রেখো, তোমার শ্বাস আমার থেকে যত দূর হবে, আমার নিঃশ্বাস এই পৃথিবীর হাওয়া থেকে তত দ্রুত বিলীন হবে।”
রেহাংশী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ভয়ে আড়ষ্ট, দুঃখে কাতর, প্রণয়ে দগ্ধ হয়ে দুই বাহুতে ডুবন্ত সায়রের শেষ আশ্রয়ের মতো আঁকড়ে ধরল ইনজাদকে।
চলবে,,,