#মোহঘোর
#পর্বঃ২৫,২৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
২৫
মেহমাদের কক্ষের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে ইনজাদ। ভাবাবেশহীন অনুদ্বেগ চাহনি। মেহমাদ তখন তার শার্টের হাতা গোটাচ্ছে। ইনজাদকে দেখেই আলতো হেসে বলল—
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
ইনজাদ নির্মল হেসে স্বত:স্ফূর্ত গলায় বলল—
“চল।”
চোখের তারায় প্রশ্ন খেলল মেহমাদের। কণ্ঠ মলিন করে বলল—
“কোথায়?”
“খাবি। রেহাংশী রান্না করেছে তোর জন্য।”
মেহমাদের চাহনি আনমনেই শিথিল হয়। হাতঘড়ির দিকে তাকায় গাঢ় নজরে। আটটা নয়। মেহমাদ চোখ তুলল। উদ্বেগভরা গলায় বলল—
“রান্না! কীসের রান্না?”
ইনজাদ চমৎকার হাসল। চট করে মেহমাদের কাঁধে হাত রাখল। আচানক তার ভার সামলাতে বেগ পেতে হলো মেহমাদের। হালকা নিচু হলো ঘাড়। চটকদার চোখে চাইতেই ইনজাদ ফিচেল হাসল। জিব ভার করে বলল—
“বউ আমার সকাল সকাল উঠে তোর জন্য রান্না করেছে। আজ খেয়ে যাবি।”
যারপরনাই অবাক হলো মেহমাদ। যে মেয়ে তার উপস্থিতিতে ভুত দেখার মতো ভীত হয়, সে তার জন্য রান্না করেছে! তাও এত সকালে?
মেহমাদের কাঁধ থেকে হাত নামায় ইনজাদ। তার হাতের বাজু ধরে বলল—
“চল, ও বসে আছে।”
মেহমাদ ঘোরগ্রস্তের মতো চেয়ে রইল। তার টাইয়ের নব আলগা হয়ে ঝুলছে। বেমালুম ভুলে গেল সব। ইনজাদ এক পুতুলকে টেনে এনে বসাল মেঝের ওপর পাতা পাটিতে। ফাঁকা ড্রয়িংরুম। ইনজাদরা পাঁচ ব্যাচমেট মিলে ভাড়া নিয়েছিল এই ফ্ল্যাট। তখন এই ড্রয়িংরুমের মেঝেতে বসেই খেতো সবাই।
ইনজাদের ভারী স্বরে ধ্যাণ ছুটল মেহমাদের। পাটির সামনে কয়েক প্রকারের খাবারের বাটি। মেহমাদ অবাক হয়। এত আইটেম মেয়েটা এত দ্রুত রান্না করল কী করে?
মেহমাদের দৃষ্টি সচল হয়। রান্নাঘরের দরজা সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে রেহাংশী। তার নতমুখটায় তাকাল মেহমাদ। এক মুহূর্তে নিজের বোনের কথা মনে পড়ল তার। রেহাংশী চোখের পাতা অনড়। স্থির হয়ে আছে তার দৃষ্টি। পায়ের আঙুলে চলছে ঘর্ষণ। মেহমাদ চোখ নামাল। খাবারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল—
“হঠাৎ এসব কেন?”
ইনজাদ হাসল। মুগ্ধ চোখে তাকাল রেহাংশীর দিকে। কাল সারারাত তাকে ঘুমাতে দেয়নি মেয়েটা। ঘুমকাতর ইনজাদের কান জ্বালিয়ে ফেলেছে। সকালে উঠে কী কী রান্না করবে তার লিস্ট হাতের কর গুনে গুনে ঠিক করেছে সে। রেহাংশীকে বুকে জড়িয়ে তার উম না পাওয়া পর্যন্ত চোখ বন্ধ হয় না ইনজাদের। মেয়েটা কী মায়ায় তাকে ফেলেছে! কিন্তু গতকাল রাতে তার ঘুমের তেরোটা বাজিয়েছে। সারারাত শুধু এপাশ ওপাশ করেছে রেহাংশী। একটু পরপর ইনজাদকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করে, মেহমাদ ভাই এটা খায়? মেহমাদ ভাই ওটা খায়?
ইনজাদ নিভুনিভু চোখে এক ধমক মারে রেহাংশীকে। চিরায়ত অভ্যাস মতো ইনজাদের কাছ থেকে আলগা হতে গেলেই বিপত্তি বাঁধে।
ঘুম আর হলো কই? রেহাংশীর রাগ ভাঙাতে তার ঘুমের বিসর্জন হলো। ভোরে উঠেই কাজে লেগে যায় রেহাংশী।
মেহমাদের করা প্রশ্নে রেহাংশীর স্থির কায়ায় চঞ্চলতা এলো। সে নরম পায়ে সামনে এগিয়ে আসে। তাদের সামনে বসে। রেহাংশীর এহেন আচরণে বিষম খায় মেহমাদ। নিজেকে সংকুচিত করে। রেহাংশী বাটির মধ্যে থাকা কলার পাতার ভাঁজ খুলে ঝলমলে গলায় বলল—-
“এইটা খেয়ে দেখুন। আমার বড়ো আম্মু বড়ো আব্বুর জন্য ছোটো মাছ এভাবে রান্না করে। বড়ো আব্বুর খুব পছন্দ।”
মেহমাদ নির্লিপ্ত। মেয়েটা তার সামনে কথা বলছে? একদম মিহি বসন্তদূতের কণ্ঠ!
রেহাংশী আরেকটা বাটির ওপর আঙুলের ডগা রেখে বলল—
” আপনার বন্ধু বলেছে, আপনি না কী সজনে ডাল পছন্দ করেন? এইটা খেয়ে দেখুন।”
মেহমাদ স্থির দৃষ্টিতে আবার তাকাল রেহাংশীর দিকে। মাথায় আস্ত খোঁপা। মুখচ্ছবিতে এখন কিশোরী চপলতা। ঠোঁটের কোণে বাচ্চা হাসি। সহসা সে খেয়াল করল রেহাংশীর হাতের দিকে। তার দেওয়া আংটি শোভা পাচ্ছে রেহাংশী অনামিকায়। চট করে বেখেয়ালে বলে উঠে মেহমাদ—
“আংটির ফিটিং ঠিক আছে?”
রেহাংশীর জড়তা উবে গেল। ঝুমঝুমিয়ে বলল—
“হ্যাঁ, এই যে দেখুন। আপনি কী করে বুঝলেন আমার আঙুলের মাপ?”
মেহমাদের সময় ব্যয় হলো না। সে যেন কিছু একটা পেল! যা সে অনেক বছর আগে হারিয়েছে। বলল—
“এইটা আসলে আমার বোনের….।”
মাঝপথে কথা কাটে ইনজাদ। রেহাংশীকে উদ্দেশ্য করে বলল—
“তুমি না আর কী যেন রান্না করেছ? ওগুলো নিয়ে আসো।”
রেহাংশী গাল ভর্তি হাসল। উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল—
“আনছি, আনছি।”
রেহাংশী রান্না ঘরে গেল। ইনজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—
“এসব করলি কেন?”
মেহমাদ হৃদয়ভেদী কণ্ঠে বলল—
“আম্মা দিয়েছে। রেহাংশীর কথা বলতেই মিতুর জন্য বানানো আংটিটা ওর জন্য দিয়ে দিলো। আমার বোনটা আর কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলে কী হতো বলত?”
চোখে ভিজে জল নেমে এলো মেহমাদের। একমাত্র বোনের মৃত্যুর শোক আজও তাকে নাড়া দেয় গহন যন্ত্রণায়। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের সমাজের এক সামাজিক ব্যাধি। ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে গাড়ির বেগ বাড়ানো; এসবের দরুন প্রতি বছর হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে আমাদের দেশে। এর শেষ কোথায়?
,
,
,
বিকেলের ফিকে আভা। শহরতলিতে নেমে এসেছে সন্ধ্যার আগমনি বার্তা। পশ্চিমাদেশে ক্লান্ত অরুণ। মৃদু পবনে শীতলতার কিশোরীপনা। ঘনালো হয়নি এখনো তা।
রেহাংশীকে নতুন বাসা দেখাতে নিয়ে এসেছে ইনজাদ। ম্যানেজার যখন বাসার বিভিন্ন বিষয় ইনজাদকে বুঝিয়ে বলছিল, তখন কল করে ত্রিনা। ত্রিনা কথা বলবে রেহাংশীর সাথে। রেহাংশীকে মোবাইল দিয়ে ইনজাদ তখন ভাড়া সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলছে ম্যানজারের সাথে। ড্রয়িংরুমে বিশাল জানালার গ্রিলে মুখ বাড়িয়ে ধূসর আকাশ দেখছে রেহাংশী। তার কানে চেপে রাখা মোবাইল ফোন।
ত্রিনার অভিযোগের পাল্লা খুলল, বলল—
“ঢাকা এসে আমাদের ভুলে গেলে? একবারো এলে না কেন?”
রেহাংশী পাতলা ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বলল—
“আমার কী দোষ! তোমার ভাইয়া যদি না নিয়ে যায় আমি কী করে একা যাব? সে তো আমাকে কারো সাথে কথাও বলতে দেয় না।”
” ওই বিচ্ছুটা এমনিই। ওটাকে আনতে হবে না তোমার। আমি আব্বুকে বলব তোমাকে নিয়ে আসতে। তুমি চলে আসবে আব্বুর সাথে। ওই হুতুমটা আসলে আমার শান্তির মাকে মেরে ফেলবে।”
রেহাংশী ফিক করে হেসে ফেলে। খুশি খুশি গলায় বলল—
“আচ্ছা, আসব।”
“আর শোনো….।”
রেহাংশীর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নেয় ইনজাদ। গলা ভার করে ওপাশের চপল যুবতীকে বলল—
“মামাকে ফোন দে। তোর প্যাচাল রাখ।”
ত্রিনা চেঁচিয়ে বলল—
“দেবো না, কী করবে তুমি?”
“ঠাটিয়ে এক চড় মারব। দে বলছি।”
বিড়বিড় করে কতগুলো গালিতে ভূষিত করল ইনজাদকে সে। অনিচ্ছা থাকার পরেও মোবাইল ফোন হস্তান্তরিত হলো ত্রিমুলের কাছে।
ইনজাদ সহজ গলায় বলল—
“টাকা তো আসেনি মামা!”
ত্রিমুল বিমূঢ় হয়ে বললেন—-
“সরি রে ভাগনে। মনে ছিল না। আমি এখনই পাঠাচ্ছি। তুই চিন্তা করিস না।”
“আরে না। সমস্যা নেই। আমি অর্ধেক পেমেন্ট করে রেখেছি। আর ওরা আমার পরিচিত। ফার্নিচার নেওয়ার পর টাকা দিলেও কিছু মনে করবে না।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি এখন বের হবো। একটা ক্লাইন্টের সাথে দেখা করতে হবে।”
“আচ্ছা, রাখছি আমি।”
মোবাইল ফোন পকেটে রাখে ইনজাদ। রেহাংশীকে ভালো করে নতুন বাসাটা দেখিয়ে তারা বাড়ির প্রধান ফটকের বাইরে বেরিয়ে আসলেই কল করে মানান। ইনজাদকে জরুরি ভিত্তিতে রেস্টুরেন্টে যেতে হবে। ঠোঁট গুজ করে রেহাংশী। ভোলা ভোলা কণ্ঠে বলল—
” আমি?”
ইনজাদ মুগ্ধ হাসল। কণ্ঠ নমনীয় করে বলল—
“চিন্তা কোরো না বিষবাণ। তোমাকে ফেলে যাব না। বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর যাব।”
স্বস্তি পায় রেহাংশী। রাস্তায় পা বাড়াতেই তাদের সামনে এসে থামে একটা গাড়ি। কপাল কুঁচকায় ইনজাদ। সরুগলিতে গাড়ি!
সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। ধীর গতিতে তমসার শামিয়ানা ঘিরে ধরছে দিনের রোশনাইকে। দিবস তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ আঁধার কালোতে। গাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে আসা মেয়েটাকে চিনতে ভুল হলো না ইনজাদের। সিন্ধুজা!
রেহাংশী ফোলা দৃষ্টিতে তাকাল। একটা হোয়াইট ফুলস্লিভ শার্ট পড়েছে সিন্ধুজা। কালো ন্যারো প্যান্ট। তার খোলা চুল দোল খেলছে কোমর জুড়ে। তীক্ষ্ম নাকের ঢগায় রোদচশমা। চট করে তা খুলে হাতে নিল সিন্ধুজা। রেহাংশীর চাহনি ভীত হলো। সিন্ধুজার হৃদয় কাঁপানো নারী সৌন্দর্যে তার ক্ষুব্ধ অনুভূতি। বক্ষদেশের অভীপ্সাপূর্ণ রূপ যেকোনো পুরুষ হৃদয়ে ঝড় তুলে দেবে। ইনজাদের পিঠের দিকের শার্ট খামচে ধরল রেহাংশী। ইনজাদ চট করে ধরতে পারল না সেই কারণ। পরক্ষণে বুঝতে পেরে সচল হেসে বলল—
“তুমি এখানে?”
ঝকঝকে হাসল সিন্ধুজা। উদ্দীপনা নিয়ে বলল—
“একটা বার্থডে পার্টিতে এসেছি। কিন্তু তুমি এখানে কেন?”
ইনজাদ মৃদু গলায় বলল—
“বাসা দেখতে এসেছিলাম।”
“ও আচ্ছা।”
রেহাংশী নীরব, স্থির। তার নির্নিমেখ চাহনি সিন্ধুজার চোখচ্ছেদের অদ্ভুত নাড়াচাড়ায়, ঠোঁটের দোলে, গলার কম্পনে। চোখ ফিরিয়ে ইনজাদের চোখের দিকে তাকাল। তার চোখের দর্পণে কীসের প্রতিচ্ছবি তা বুঝতে চায় রেহাংশী।
চকিতে নড়ে উঠে রেহাংশী। ব্যস্ত হয়ে তাকায় সিন্ধুজার দিকে। সিন্ধুজার মুগ্ধ চাহনি ভেদ করল রেহাংশীর সুক্ষ্ম সাজ। সে বলে উঠে—
“নাইস কালার! ইউ আর লুকিং সো গুড!”
রেহাংশী বিভ্রান্ত হলো। ইনজাদ ছোট্ট করে হাসল। ইনজাদের হাসিতে অপ্রস্তুত চোখে তাকাল রেহাংশী। সিন্ধুজা ভ্রূকুটি করে বলল—
“হাই! চিনতে পারোনি?”
রেহাংশীর আননে থমথমে ভাব। থতমত খেয়ে বলল—
“জিজজজ, জি।”
“ইউ আর লুকিং প্রিটি!”
“ধন্যবাদ।”
“তোমাকে কিন্তু শাড়িতেও দারুন লাগে।”
“আপনি শাড়ি পরতে পারেন না?”
সিন্ধুজা ভাবাবেশ ছাড়া বলল —
“না, আমি শাড়িতে কমফোর্টেবল নই। ”
গাঢ় লাল রঙের গাউন পরেছে রেহাংশী। তার হলদেটে উজ্জ্বল রঙ বিভাসিত। পদ্মলোচনে কালো রেখার মোটা আঁচড়। যা তার দীর্ঘ পল্লবে আচ্ছাদিত আঁখিযুগলের অভিরাম বাড়িয়েছে আঁধার রাতের সন্ধ্যা তারার মতো। পাতলা ঠোঁটের রক্তিম সাজে ধরণী বিভোর। বাঙালি মেয়েদের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে যা উপলব্ধি করছে সিন্ধুজা। জীবনের বেশিরভাগ সময় সে ইংল্যান্ডে কাটিয়েছে।
সহসা ভেসে এলো একটা বাচ্চা কণ্ঠ। গাড়ি থেকে নেমে এসেছে সৌরভ। অধৈর্য হয়ে বলল—
“সিস, কাম অন! দেরি হচ্ছে। ওরা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।”
তিনজোড়া শান্ত চোখ মুহূর্তেই বিদ্ধ হলো সৌরভের দিকে। রেহাংশীর চোখের পল্লব প্রশস্ত হলো। তার দেহে কাঁপন ধরল অনুপলেই। হাতের মুঠো কচলাতে থাকল। টান পড়ল ইনজাদের শার্টে। সে বিব্রত হয়ে চাইল রেহাংশীর দিকে। রেহাংশীর সম্মোহিত চাহনি সৌরভের মুখের আদলে। সিন্ধুজা মোলায়েম স্বরে বলল—
“ইয়েস, ইয়েস। জাস্ট ওয়েট। ও আমার ভাই সৌরভ।”
ইনজাদ মুচকি হেসে হাত নাড়াল। সৌরভের ব্যস্ত নজর তার ট্যাবে। গেমসে মশগুল সৌরভ গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসল। সিন্ধুজা ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল—-
“আসি, পরে দেখা হবে।”
সিন্ধুজা ভেতরে ঢুকতেই গাড়ি চলতে শুরু করে। রেহাংশী এখনো অপলক চেয়ে আছে। ইনজাদ ভ্রু কুঞ্চন করল। নাক ফুলিয়ে চেয়ে রইল রেহাংশীর নিশ্চল নয়নে। আঁধারের শামিয়ানা বিছিয়েছে সায়াহ্ন। কমলা রঙ টুপ করে মিলিয়ে গেল ধূসর আকাশে। সেই জমাট, অস্বচ্ছ আঁধারেও রেহাংশী স্পষ্ট দেখতে পেল বহু পুরোনো সেই দুই চোখ। ইনজাদ মুখ নিলো রেহাংশীর কানের কাছে। চাপা স্বরে বলল—-
“বিষবাণ! এতটাও ফেলনা নই আমি। এভাবে অন্য কাউকে দেখো না। দিলে লাগে আমার!”
রেহাংশী মোহাচ্ছন্ন হয়ে বলল—
“ওই ছেলেটার চোখ দেখেছেন? একদম তার মতো। একটা চোখ ছোটো।”
চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল ইনজাদ। কৌতূহলদীপ্ত হয়ে বলল—-
“তার? কার?”
“জিবরান খন্দকার!”
চলবে,,,
#মোহঘোর
#পর্বঃ২৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ভাসছে শহর দিনের প্রভায়। স্নিগ্ধ, তরল, সতেজ মলয়ে আবৃত মেদিনীর বুকে হেমন্তের জয়গান। তিরতির করে প্রবাহিত সমীরণের শীতলতায় মৃদু কাঁপন ধরেছে ইনজাদের দেহ প্রকোষ্ঠে। চার ফিটের বিস্তৃত বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছে সে। পূর্বাকাশে উদিত অর্যমা স্বগৌরবে মেলে ধরেছে নিজেকে। শুভ্র আকাশের বুকে উদ্ভাসিত কিরণের মাখামাখি।
ইনজাদের কর্ণরন্ধ্রে ভেসে এলো কলিং বেলের শব্দ। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে নিচে ফেলল। পলেই হেসে ফেলল সে। রেহাংশী নিশ্চয়ই রাগ করবে!
নতুন বাসায় আসার পর মেয়েটা আরও বেশি চঞ্চল হয়েছে। ঘরের সব জিনিসপত্র টিপটপ রাখে। পরিষ্কার, ঝকঝকে।
কলিং বেলের আওয়াজ পেয়েও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেহাংশী। ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা পানির জগে হাত রেখে অনিমেষ চেয়ে আছে দরজার দিকে। কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসলো ইনজাদ। সে ভালো করেই জানত রেহাংশী দরজা খুলবে না। ইনজাদ নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে গিয়ে দরজা খুলল। অস্থির চোখে চেয়ে আছে রেহাংশী। কিছুক্ষণ পর দরজা বন্ধ করে ভেতরে এলো ইনজাদ। টেবিলের ওপর একটা বাটি রাখল। তাতে চার-পাঁচটা মিষ্টি। রেহাংশী ঝোঁক গলায় বলল—
“কীসের মিষ্টি?”
ইনজাদ ছোট্ট হেসে বলল—
“তাদের ঘরে নতুন মেহমান এসেছে।”
রেহাংশী বিস্মায়াবিষ্ট চোখে চেয়ে উৎসুক গলায় বলল—
“শহরে বুঝি মেহমান এলেও মিষ্টি দেয়?”
ইনজাদ ফিচেল হাসল। ধীর পায়ে রেহাংশীর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। রেহাংশীর ভ্রমরকৃষ্ণ কুন্তলে নাক ডুবিয়ে এক লম্বা নিঃশ্বাস টেনে নিল। রেহাংশী হাসল। অস্পষ্ট, নিগূঢ়, ব্রীড়াময় হাসি। আচ্ছন্ন মস্তিষ্কে মত্ত ইনজাদ হালকা হাতে রেহাংশীর চুলের বহর সরিয়ে তার কাঁধের কাছের জামার গলা খানিক নামিয়ে এনে ঠোঁট ছোঁয়াল। আবেশিত, সঞ্চরিত চোখ নিমীলিত করে রেহাংশী। ইনজাদের উষ্ণ শ্বাসের বেগ তরতরিয়ে ছড়াতে লাগল রেহাংশীর কম্পিত দেহের কোণে কোণে। ইনজাদ ছোট্ট করে হাসল। মখমলে গলায় বলল—
“হ্যাঁ, এইটা স্পেশাল মেহমান। আসতে দশমাস সময় তো লাগেই।”
চট করে রেহাংশীর স্থির মস্তিষ্কের স্নায়ু ধরতে পারল না ইনজাদের নিঃসৃত কথার অর্থ। ইনজাদ টাউজারে হাত পুরে উলটো হাঁটা ধরল। রেহাংশী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল—
“তারা বুঝি বিদেশে থাকে?”
ইনজাদ চলনভঙ্গি বদলাল না। দুলতে দুলতে বলল—
“না, অন্য কোথাও থাকে। তাদের আসার জন্য বিয়ের প্রয়োজন, আদর প্রয়োজন।”
রেহাংশী দ্বিধান্বিত গলায় তাড়া দিয়ে বলে উঠল—
“আদর?”
“হ্যাঁ, এই যে তোমাকে আমি যেমন করি; তেমন আদর। ওটা ছাড়া তাদের আসার সম্ভাবনা নাই।”
রেহাংশী তখন মুখভর্তি পানি নিয়েছে পান করার জন্য। চকিতে পানি গলায় আটকে গেল। মুখের পানি চট করে বাইরে বেরিয়ে আসলো তার। হতভম্ব হয়ে গেল নিজের নির্বুদ্ধিতায়।
চা নিয়ে ঢুকল রেহাংশী। মোবাইলে কারো সাথে কথা বলে তা পকেটে রাখল ইনজাদ। রেস্তোরাঁয় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সে। রেহাংশী চায়ের কাপ হাতে রেখে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলল—
“কে ফোন করেছে?”
সহজ গলায় প্রত্যুক্তি করে ইনজাদ—
“তোমার বড়ো আব্বু।”
রেহাংশীর চোখ-মুখ খেলে উঠল ফুটন্ত গোলাপের মতো। তার সুগন্ধ ছড়িয়ে উচ্ছলিত গলায় বলল—
“কী বলেছে বড়ো আব্বু?”
ইনজাদ টাইয়ের নব ঠিক করল। হাতা ফোল্ড করে বিছানায় রাখা হাতঘড়িটা হাতে পরে বলল—
“কাল রাতে যে ফাইল এনেছি সেইটা কোথায়?”
রেহাংশী মৃদু গলায় বলল—
“দিচ্ছি।”
চায়ের কাপ বেড সাইড টেবিলের ওপর রেখে আলমিরা থেকে একটা ফাইল বের করে ইনজাদের হাতে দেয়। সেইটা হাতে নিয়ে খুলে দেখতে থাকে ইনজাদ। রেহাংশী দুই চোখ নিবদ্ধ করে চেয়ে আছে ইনজাদের দিকে। সরস গলায় বলল—
“কী বলেছে বড়ো আব্ব?”
ইনজাদ যেন শুনেও শুনল না। সে চেয়ে রইল ফাইলের ছোটো ছোটো ইংরেজি অক্ষরগুলোতে। রেহাংশী চোখ পিটপিট করে চাইল। প্রবল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন ইনজাদ তার প্রশ্নের জবাব দেবে! কিন্তু তেমন কিছুর আভাস না পেয়ে ফের বলল—
“কী হলো! বলুন না, বড়ো আব্বু কী বলছে?”
ইনজাদের কর্ণকুহর হলো সেই শব্দ। সে ভাবনা কেটে চাইল রেহাংশীর দিকে। ললাটের মধ্যভাগে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফুটিয়ে অস্বচ্ছ স্বরে বলল—
“হু, উহু। কিছু বলেনি তো।”
রেহাংশী ঝলসে উঠল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল—
“দুর! মিথ্যে বলছেন কেন? বলুন না কী বলেছে।”
ইনজাদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করল। ফাইল বন্ধ করে হাতে রাখল। নিভুনিভু চোখে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে বাম ভ্রুয়ে আঁচড় কেটে বলল—
“সরি, ভুলে গেছি কী বলেছে তোমার বড়ো আব্বু।”
“আপনি আবার মিথ্যে বলছেন?”
“একদম না।”
অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল রেহাংশী। ধুম করে এক কামড় বসাল ইনজাদের হাতে। ইনজাদ মৃদু শব্দ করল। ছিটকে সরে পড়ল রেহাংশী। ইনজাদ চোখের সামনে হাত এনে দেখল, দাঁত বসিয়ে ফেলেছে রেহাংশী। হাত থেকে চোখ সরিয়ে রেহাংশীর দিকে তাক করল। রেহাংশী ভয়ে ভয়ে কুণ্ঠিত চোখে তাকাল। থমথমে, ম্লাণ চাহনি। ইনজাদ গাঢ় কণ্ঠে বলল—
“সাহস তো তোমার কম না। রিটার্ন নেওয়ার ক্ষমতা আছে?”
“তাহলে বলছেন না কেন?”
“কী বলব?”
“বড়ো আব্বু কী বলেছে।”
ইনজাদ এগিয়ে গেল রেহাংশীর কাছে। তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল—
“কামড় দিলে কেন?”
রেহাংশী মাথা নত করল। ছোটো বেলা থেকে এক বাজে অভ্যাস তার। কোনো কিছু নিয়ে বারংবার পায়তারা করলে দাঁত শিরশির করে রেহাংশীর। একবার নুহাশের হাতে বসিয়েছিল কামড়। তাকে গজ পর্যন্ত বাঁধতে হয়েছিল। ইনজাদ হাতের বেড় শক্ত করল। সতেজ গলায় বলল—
“এই নিয়ে তিনবার। আমি কিন্তু একবারেই শোধ করব। তখন কান্নাকাটি করলে চলবে না।”
রেহাংশী মাথা উঁচু করল না। স্তব্ধ হয়ে রইল সে। ইনজাদ হাসল। ঘার বাঁকিয়ে নিচু হয়ে বর্ষণ করল প্রেমাত্মক বৃষ্টির। সিক্ত হলো প্রবল বর্ষণে প্রেয়সী। তুষ্ট হলো দেহ-মন। ইনজাদ সাবলীল গলায় বলল—
“পায়েলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। যেতে বলেছে আমাদের।”
রেহাংশীর আড়ষ্ট দেহ মুহুর্তেই তারল্যতায় টগবগিয়ে ওঠল। শ্বাসে দীপ্ততা নিয়ে বলল—
“নুহাশ ভাইয়ার সাথে?”
ইনজাদ অবিশ্বাস্য চোখে চাইল। সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—
“তুমি কী করে বুঝলে নুহাশের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
রেহাংশী ঠোঁট চিপল। কণ্ঠ রোদ করে মাথানত করল। ইনজাদ বাঁকা হেসে বলল—-
“বাহ! তোমার বোনেরা দেখি সুপার ফাস্ট। তুমি পিছিয়ে পড়লে কেন? খুঁজে পাওনি কাউকে?”
সশব্দে হেসে উঠে ইনজাদ। রেহাংশী আনম্র দৃষ্টিতে তাকাল। ইনজাদ কণ্ঠ নরম করল। বলল—
“সামনের সপ্তাহে বিয়ে।”
“আমরা যাব?”
“হ্যাঁ। ”
রেহাংশীর মন উৎফুল্ল হলো। গ্রামের সুমিষ্ট বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার জন্য ইতি-বিতি করছে তার অন্তঃকরণ। প্রিয় মুখগুলো দেখার জন্য ছটফটিয়ে যাচ্ছে মন। এবার শুধু অপেক্ষা। রেহাংশীর পুরো দেহে প্রশান্তি ছেয়ে গেল। ইনজাদ মৃদু গলায় বলল—
“সারা ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখাব তোমাকে। একটু সময় দাও আমায়। রেস্টুরেন্টের নতুন কাজটা একটু গুছিয়ে নেই।”
“কবে যাব আমরা?”
“আগামী শুক্রবার।”
রেহাংশীর চিত্ত দুলে ওঠল। ঝিলিক দেয়া রোদের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে বলল—
“কতদিন থাকব আমরা?”
“দুই দিন।”
“মাত্র দুই দিন? বিয়ের অনুষ্ঠান-ই তো তিনদিনের। হলুদ, বিয়ে, বৌভাত। তাহলে দুই দিন কেন?”
“সময় নেই আমার হাতে। বললাম তো রেস্টুরেন্টে কাজ আছে।”
“তাই বলে মাত্র দুই দিন! কতদিন বাড়ি যাই না!”
ইনজাদ গম্ভীর মুখে বলল—
“তাহলে থেকে যেয়ো। বাড়িতে থাকার এত শখ যখন।”
রেহাংশী খুশি হলো। হেসে হেসে বলল—
“তাহলে আমাকে রেখে আসবেন। পরে গিয়ে নিয়ে আসবেন। কতদিন ফুফুর বাসায় যাই না। বিয়ের দিন যাব।”
ইনজাদের মেজাজ বিগড়ালো। বলে কী এই মেয়ে! যাকে ছাড়া সে চোখ বন্ধ করতে পারে না তাকে রেখে আসবে ক্রোশো দূর! এও কী সম্ভব? আচানক রেহাংশীকে চূড়ান্ত বিস্ময়ে আবিষ্ট করল ইনজাদ। একটানে বুকে পাটায় ফেলে তার গাল চেপে ধরল। ইনজাদের এহেন আচরণে হতবাক হয়ে গেল রেহাংশী। ভয়ে কেঁপে উঠল তার হৃৎপ্রকোষ্ঠ। ইনজাদ চোখ বড়ো করে রাগ দেখিয়ে বলল—
“আরেকবার এই কথা বললে একদম সারাজীবনের জন্য রেখে আসব। তখন অন্ধকারে ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেট ভরে বাতাস খেয়ো। এতটা পাষাণ কেন তুমি? একটু্ও মায়া লাগল না আমার জন্য? থাকতে পারবে আমাকে ছাড়া?”
ছলছল করে উঠর রেহাংশীর হাস্যোজ্জ্বল চোখ দুটো। নিভে গেল তার খুশির প্রদীপ। নিজের ওপর কেমন আঁছোয়া রাগ হলো তার। এই মানুষটাকে ছাড়া সে আদৌ থাকতে পারবে না। তবুও কী করে বলে ফেলল এসব!
ইনজাদ হেসে ফেলল। রেহাংশীর কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বলল। শিমুল ফুলের মতো রক্তিম হয়ে উঠল রেহাংশীর ম্লান মুখচ্ছবি। নিজেকে ছাড়াতে তৎপর হয়ে উঠল তার ইন্দ্রিয়। ইনজাদ রাশভারী গলায় বলল–
“যাচ্ছি আমি। খেয়ে নিয়ো দুপুরে। খাওয়ায় অনিয়ম করে অনেক ভুগিয়েছ আমাকে। এবার এমন কিছু করলে বাড়ি যাওয়া ক্যান্সেল। মনে থাকে যেন।”
স্বামীর আদরে মাখা ধারলো শাসনে সায় দিলো রেহাংশী। ইনজাদ চোখে হাসল।
“আসি আমি।”
“হুম।”
চলবে,,,