#মোহঘোর
#পর্বঃ২৭,২৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
২৭
হেমন্তের বিষণ্ণ তমাসাছন্ন যামবতী। হিমেল প্রভঞ্জনের সারথি হয়েছে ঝিরিঝির আকাশ কন্যা। তার হিমশীতল স্পর্শ যেন ধরণীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিলো। ফোঁটা ফোঁটা ইলশেগুড়ি বৃষ্টিতে সিক্ত হলো ইনজাদ। গায়ের রোম কাটা দিয়ে উঠেছে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠছে সে। শ্রান্ত, অবসণ্ন, অবস্বাদগ্রস্ত দেহ। ধীরগতিতে কলিং বেলে চাপ দিলো। ক্ষণকাল ব্যয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল ভেতরের অপেক্ষারত প্রাণঘাতীনি কন্যা। রেহাংশীকে দেখেই ইনজাদের সমস্ত ক্লান্তি কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। রেহাংশী গালভর্তি মিষ্টি হাসল। ইনজাদ ভেতরে ঢুকেই উলটো হাতে দরজা ভেজাল। অরবে অধর ছোঁয়াল রেহাংশীর কণ্ঠমনিতে। আপ্লুত, প্রসন্ন হলো রেহাংশী। নরম হাসিতে পদ্মকোমল ঠোঁটে আলোড়ন তুলল। ইনজাদ সতেজ গলায় বলল—
“পারফিউম দিয়েছ কেন? তোমাকে না বলেছি পারফিউম দেবে না। তোমার শরীরের ঘ্রাণ-ই আমার ভালো লাগে।”
ইনজাদ জুতো খুলে রেকে রাখল। রেহাংশী দরজার লক লাগাতে লাগাতে বলল—
“পারফিউম দেইনি তো?”
ইনজাদ কিঞ্চিৎ কৌতূহলে আচ্ছন্ন হয়ে বলল—
“তাহলে অন্যরকম লাগল কেন?”
রেহাংশী ঠোঁট চিপে হাসে। ইনজাদ দ্বিধান্বিত হয়। নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়িয়ে বলল—
“বুঝতে পেরেছি।”
স্বামীর পিছু নিল রেহাংশী। ইনজাদ হাতের ছোটো ব্যাগটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখল। শার্টের বাটন আলগা করতে করতে বলল—
” এত খুশি কেন? স্পেশাল কিছু?”
রেহাংশীর চোখে-মুখে প্রানোচ্ছ্বাস। খিলখিল করে হাসছে তার কোমল আনন। ইনজাদ বিভ্রান্ত হলো। ঐৎসুক্য গলায় বলল—
“হয়েছে টা কী আজ বিষবাণের? নতুন শাড়ি, এত খুশি? কেন বিষবাণ?”
রেহাংশী ঝকমকে হেসে ফাঁপা স্বরে বলল—
“আজ আম্মা ফোন করেছিল। কথা বলেছে আমার সাথে।”
ইনজাদ বিস্মিত হলো না। তবে সে চমকিত হলো এই মেয়ের কান্ড দেখে। বিগত আড়াই মাসেও তমালিকা রেহাংশীর সাথে কথা বলেনি। ইনজাদের সাথে কথা হয়। তাও অফিস টাইমে। কিন্তু এই মেয়ের উচ্ছ্বাস! যেন বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারে ভাসিয়ে নেবে সব!
ইনজাদ গাঢ় স্বরে বলল—
“কী বলেছেন আম্মা?”
“আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছে।”
“আমার কথা?”
“হ্যাঁ। আপনি ঠিক মতো খাচ্ছেন কি না, ঘুমাচ্ছেন কি না, কাজে যাচ্ছেন কি না, আপনার শরীর….।”
“আর তোমার?”
সহসা থেমে গেল তোতাপাখি। যে পাখির মায়ায় পড়েছে ইনজাদ। রেহাংশী চুপ হয়ে গেল। নিমগ্ন দৃষ্টি তার মেঝের শুভ্র বুকে। ইনজাদ ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে প্যাকেটটা হাতে নিল। শান্ত পায়ে এগিয়ে এলো। রেহাংশীকে বিছানায় বসাল। মেঝেতে হাঁটু ঠেসে তার সামনে বসল ইনজাদ। গাঢ় নীল রঙের সোনালী পাড়ের প্যাকেট থেকে একটা বক্স বের করে তা রেহাংশীর হাতের তালুতে দিলো। স্বাভাবিক সুরে বলল—
“দেখোতো এইটা পছন্দ হয় কি না।”
রেহাংশী বাচ্চাদের মতো উদগ্রীব হয়ে বলল—
“কী?”
“নোজ রিং। খুলে দেখো।”
রেহাংশী আলতো হাতে ছোট্ট নাকের ফুলটা হাতে নেয়। সাদা রঙের পাথরের ঝলকানিতে চোখের পাতায় খুশি উছলে উঠে তার। রেহাংশী অধৈর্য গলায় বলল—
“পাথরের?”
“না, ডায়মন্ড।”
“ও বাবা! তাহলে তো অনেক দাম।”
ইনজাদ ছোট্ট করে হাসল। আদুরে গলায় বলল—
“আমার বউয়ের চেয়ে বেশি না। মাত্র টুয়েন্টি ওয়ান থাউজেন্ড।”
রেহাংশী চোখে কোটর প্রস্ফুটিত করল তূরন্ত বেগে। বিস্ফোরিত গলায় বলল—
“একুশ হাজার!”
“হ্যাঁ, তো?”
“এত দাম দিয়ে আনলেন কেন? আমার তো একটা সোনার আছে।”
“তাতে কী? বিয়েতে যাবে না। তাই। দাও পরিয়ে দেই।”
রেহাংশী সংকীর্ণ সুরে বলল—
“থাক, আমি পরে নেবো।”
“আমি পরিয়ে দিই।”
“উঁহু। লাগবে না।”
রেহাংশী ইনজাদের ফুলে উঠা বাহুতে হাত দেয়। বুকের কাছে হাত নিয়ে বলল—
“আপনার শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে আছে। যান, হাত-মুখ ধুয়ে জামা পরে নিন।”
ইনজাদ মিষ্টি হেসে ফিচেল গলায় বলল—
“কেন? কন্ট্রোল হচ্ছে না বুঝি!”
রেহাংশী দুর্বল ধাক্কা মেরে বলল—
“দুর! যান তো।”
ইনজাদ একটু উচু করে হাঁটু। রেহাংশীর নাকের ডগায় আঙুল ছুঁইয়ে বলল—
“যাচ্ছি। এইটা পরে নাও। আর খাবার বাড়ো। খিদে পেয়েছে আমার।”
রেহাংশী মাথা ঝাঁকায়। ইনজাদ উঠে চলে যায় সোজা ওয়াশরুমে। রেহাংশীর অবনত চাহনি তখন তার হাতের তালুতে। জ্বলজ্বল করতে থাকা নাকের ফুলে। এত দামি জিনিস সে আগে কখনো পরেনি। এই মানুষটা তাকে এত ভালোবাসে কেন? এত খেয়াল রাখে কেন? কোনো কিছু না চাইতেও যেন ডালা ভরা সুখ তার আঁচলে ঢেলে দেয়। রেহাংশীর নানী তাকে গল্প শোনাত। রূপকথার গল্প। রূপকথার রাজকুমার নাকি রাজকুমারীকে খুব ভালোবাসে! রেহাংশীর মনে হতো সব মিথ্যে, বানোয়াট কাহিনী। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সব রূপকথা মিথ্যে হয় না। তার জীবনে সত্যিই রাজকুমার এসেছে। যে তাকে আকাশসম ভালোবাসে, সায়রের ন্যায় গভীরভাবে তাকে কাছে টানে, পাহাড়ের মতো অটল হয়ে তার পাশে থাকে। রেহাংশীর চোখ ছলছল পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়ে। এত সুখ তার কপালে ছিল বলেই কী তার সব শেষ হয়ে গিয়েছিল?
,
,
,
ইনজাদ খাবার খাওয়ায় ব্যস্ত। রেহাংশীর থমথমে মুখচ্ছবিতে তাকিয়ে বলল—
“তোমাকে না বলেছি খেয়ে নিতে। আমার দেরি হলে বসে থাকো কেন?”
রেহাংশী নতমুখে বিরস গলায় বলল—
“একা একা খেতে ভালো লাগে না।”
“তাহলে দোকা করে দিই। আরেকটা বিয়ে করে তোমার জন্য সাথী নিয়ে আসি।”
রেহাংশী মাথা তুলল। চকচক করছে তার দৃষ্টি। খাবারের প্লেট তার সামনেই। তবুও তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। রেহাংশীর প্রদীপ্ত চাহনিতে হেসে ফেলল ইনজাদ। চাটুকদার গলায় বলল—
“জাস্ট কিডিং! তোমাকে হজম করতেই অবস্থা যায় যায় আমার, এখন আরেক ঝামেলা, নো চান্স! খাও।”
রেহাংশীর মুখের কালো আঁধার আরও ঘনীভূত হলো। ইনজাদ ত্রস্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে —
“কী হয়েছে তোমার?”
“আপনি আম্মা- বাবার জন্য কিছু আনেননি কেন?”
অধরে কোণ টেনে নিল ইনজাদ। সরল গলায় বলল—
“আমার মোবাইলটা নিয়ে আসো। টেবিলের ওপর রেখেছি।”
রেহাংশী চেয়ার থেকে উঠে হাঁটা ধরে। কিছু সময় পর মোবাইল ফোন নিয়ে ফিরে আসে। চেয়ার টেনে বসে টেবিলের ওপর হাত রেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে ইনজাদের দিকে। ইনজাদ মোবাইলে কিছু একটা বের করে রেহাংশীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—
“এইটা দেখো।”
রেহাংশী উৎসাহ নিয়ে মোবাইল নিয়ে নেয়। চমকিত গলায় বলল—
“চুড়ি?”
“না, বালা। এগুলোক বালা বলে। আম্মার জন্য অর্ডার করেছি। ”
“আর বাবার জন্য?”
“বাবার অনেক দিনের শখ একটা কাশ্মীরি শালের। আমার এক বন্ধুকে বলেছি। বাড়ি যাওয়ার আগে দেবে বলেছে।”
ইনজাদের খাওয়া শেষ। খালি প্লেটটা হাতে নিয়ে বেসিং এর সামনে যায়। রেহাংশী অপলক চেয়ে আছে মোবাইলের ছবিটার দিকে। হাত ধুয়ে এসে রেহাংশীর পাশে রাখল প্লেট ইনজাদ। রেহাংশীর কাঁধে চিবুক রেখে দুই পাশে হাত রাখে। সশব্দে বলল—
“পছন্দ হয়েছে?”
রেহাংশী অস্ফুট স্বরে বলল—
“হুম।”
“লাগবে?”
“উঁহু।”
ইনজাদ মুচকি হাসল। সচল গলায় বলল—
“চিন্তা কোরো না। কিনে দেবো। দশটা না, পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আমার। কিন্তু এই মাসে হবে না। অনেক খরচ হয়েছে এ মাসে। সামনের মাসে দেবো।”
রেহাংশী ভাবনাহীন মস্তিষ্কে চট করে বলল—
“কত দাম?”
ইনজাদ সোজা হলো। কক্ষের দিকে পা বাড়িয়ে বলল—
“বেশি না। লাখ খানেক। ”
আঁতকে উঠে রেহাংশী। তার মানসপটে ভেসে উঠে সেই দিন। দুমুঠো কাঁচের চুড়ির জন্য তার মামি তাকে কত কথা শুনিয়েছে! আর আজ অদৃষ্ট তাকে লাখ টাকার সোনার বালার স্বপ্ন দেখায়!
রান্না ঘরের সমস্ত কাজ শেষ করে কক্ষে আসে রেহাংশী। দৈবাৎ শিরশিরে হাওয়া তাকে আলগোছে ছুঁইয়ে গেল। বারান্দার থাই খোলা। হুরহুর করে বাতাস ঢুকছে। ইনজাদ সিগারেট টেনে যাচ্ছে। রেহাংশী কোমল হাসে। মানুষটার হাজার ভালো অভ্যাসের মাঝে এই একটা বাজে অভ্যাস। তবে অনেকটা কমে এসেছে। রেস্তোরাঁর দরজার পাশে বড়ো করে লেখা ‘নো স্মোকিং’। ম্যানেজার হয়ে নিয়মের বরখেলাপ তো করতে পারে না। তাই এই রাতটুকু নিজের ইচ্ছে মতো ব্যয় করে ইনজাদ। রেহাংশী প্রতিক্রিয়া করে না। প্রথম প্রথম অসহ্য লাগলেও এখন অনেকটা সয়ে নিয়েছে সে। ইনজাদ যখন বুকের মাঝে তাকে টেনে নেয় তখন এক অদ্ভুত মাদকে আসক্ত হয় রেহাংশী। আর কিছু তার ভাবনাতে আসে না। আলগোছে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। থাকনা মানুষটার কিছু বদ অভ্যাস। তাকে তো নিয়ম করে ভালোবাসে, খুব যত্ন করে হৃৎকুঠিরে জায়গা দিয়েছে, প্রণয়ে আসক্ত করেছে, আর কী চাই জীবনে সুখী হতে? রেহাংশী আর কিছুই চায় না। এই মানুষটার বক্ষস্থলেই শীতল পাটির মতো জড়িয়ে থাকতে চায়। নির্ঘুম রাতের আলো-আঁধারের সারথি হতে চায়। জারকাটা দেওয়া শীতের রাতের উম হতে চায়। দু’চোখের পাতায় জাগ্রত স্বপ্ন হতে চায়। সারাজীবন তার হৃৎযন্ত্রের কম্পন হয়ে থাকতে চায়। এ জীবনে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই। রেহাংশীর আঁখিযুগল নিভে আসে।
ইনজাদ ভেতরে প্রবেশ করে। হাওয়ায় শীতলতা। রেহাংশী পাতলা চাদর জড়িয়ে রেখেছে গায়ে। তাই দেখে বারান্দার থাই টেনে দিলো ইনজাদ। ধীরপায়ে এসে প্রথমে হলুদাভ বাতি জ্বালালো। কৃত্রিম উজ্জ্বল বাতি নিভিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। রেহাংশী আড়ষ্ট হয়ে রইল। তার ঘুমো ঘুমো চোখ। দেহের অভ্যন্তরে শীতল স্পর্শে জাগ্রত হলো ইন্দ্রিয়।
চলবে,,,
#মোহঘোর
#পর্বঃ২৮
লেখনীতেঃতাজররিয়ান খান তানভি
রেস্তোরাঁয় ঢুকেই অবাক হলো ইনজাদ। সামনের টেবিলেই তার দুই পরিচিত মুখ বসে আছে। ইনজাদ চমকিত হাসল। চোখে দেখা গেল বিস্মিত ভাব। মেহমাদ সতেজ হেসে নিজের উপস্থিতি জাহির করল। তার পাশেই সিন্ধুজা। তূরন্ত যৌবনে দোল খেলানো এক মনোহারিনী নারী।
ইনজাদ ধীরপায়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। মোলায়েম গলায় কৌতূহল মিশ্রণ করে বলল—
“হঠাৎ এখানে?”
মেহমাদ উত্তর দিলো। সে এগিয়ে দিলো মিহি হলুদ রঙের একটা কার্ড। ইনজাদ দেখেই চমৎকার হাসল। কৌতুকমাখা গলায় বলল—
“ব্যাচলর লাইফের সমাপ্তি টানছিস তাহলে!”
মেহমাদ স্বর ভারী করে বলল—
“তুই বউ বিলাস করিস, আর আমি বিয়ে করতে পারব না?”
ইনজাদ ঠোঁট ভর্তি হেসে বলল—
“শীতকাল তো তোদের জন্য এসেছে। ”
সিন্ধুজা মজা করে হাসল। দুই বন্ধুর খুঁনসুটি সে উপভোগ করছে। দৃঢ় হলো মেহমাদ। শক্ত গলায় বলল—
“রেহাংশীকে আগে থেকেই পাঠাবি। আবার বলিস না রাতে ঘুম আসবে না তোর।”
ইনজাদ কথায় বেগ লাগাল। প্রানোচ্ছ্বাস নিয়ে বলল—
“বউ একা যাবে কেন? আমার সাথে যাবে। বিয়ে করেছি কী বউ ছাড়া থাকতে?”
সিন্ধুজা শব্দ করে হেসে ফেলল। মেহমাদ আর ইনজাদের অধরেও ঝরঝর করে হাসি ঝরতে লাগল। ইনজাদ হাসি চাপল। নম্র স্বরে বলল—
“অবশ্যই যাব। বাড়ি থেকে আসি আগে। রেহাংশীর কাজিনের বিয়ে। আর তিয়ার বিয়ে হয়ে যাবে। ইশ ! বেচারিকে হালাল হওয়ার আগে একবার দেখতে হবে আমার। কতদিন দেখি না ওর চাঁদমুখ।”
মেহমাদ টগবগিয়ে বলল—
“শালা, একদম যাবি না তুই ওর সামনে। তোর জন্য আমাকে অনেক ভুগতে হয়েছে।”
ইনজাদ গা দুলিয়ে হেসে বলল—
“মাই গড! আমার অপেক্ষাতরীটার বিয়ে হয়ে যাবে, আর আমি তার সাথে দেখা করব না?”
মেহমাদ উঠে এলো। ইনজাদের গলার দিকে চেপে ধরে গটগট করে বলল—
“বউ ছাড়া এসেছিস তো এক লাথি দিয়ে বের করে দেবো। আর যদি ওকে ফোন করেছিস, অনিতার সাথে কী করেছিস মনে আছে? রেহাংশীকে গিয়ে বলব। তখন দেখবি কেমন লাগে। চাঁদনী রাত, তুমি আমি সাথ! বুঝবি তখন।”
ইনজাদ হাসতে হাসতে হুটোপুটি খেলো। মেহমাদ থেকে গলা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল—
“বল গিয়ে। আই ডোন্ট মাইন্ড। আমার বউ তোর ললিপপের মতো না। ”
“একদম ওকে কল করবি না তুই। গেলাম আমি। হলুদের আগের দিন রেহাংশীকে পাঠাবি। মনে থাকে যেন।”
“হ ভাই, শীতকালের কম্বল কেনার টাকা বাচঁব। যা ভাগ।”
মেহমাদ খলখল করে হাসল। সিন্ধুজার দিকে তাকিয়ে বিদায় ভাষণ দিয়ে বলল—
“আসি সিন্ধুজা। এসো কিন্তু বিয়েতে। সবাইকে সাথে নিয়ে। তিয়া তোমার কথা বলেছে।”
চোখে সম্মতি দিলো সিন্ধুজা। মেহমাদ যেতেই কৌতূহল জাগল সিন্ধুজার চোখের পাতায়। ঐৎসুক্য গলায় বলল—
“কী হয়েছে বলোতো তিয়ার সাথে তোমার?”
“আরে তেমন কিছু না। একদিন রাতে তিয়া ফোন করেছিল। মেহমাদ তখন ওয়াশরুমে। আমি ফোন রিসিভ করেছিলাম। তিয়া বুঝতে পারেনি। ওকে আমি পরদিন সকালে হাতিরঝিলে আসতে বলেছিলাম সকাল সাতটা। বেচারি, দুই ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। মেহমাদের মোবাইল থেকে রাতে নাম্বার ব্লক করে রেখেছিলাম। গাধাটা নয়টা পর্যন্ত সেই ঘুম। আমার নাম্বারে কল করলে ওকে ধরিয়ে দেই। গাধাটা উঠেই ছুট লাগায়। আর পরে জানতে পেরে বেচারাদের ব্রেক-আপ হতে হতে প্যাচ-আপ হয়।”
সিন্ধুজা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে শ্বাস রোধ করে বলল—
“হাউ ফানি!”
কিছুক্ষণ হাসির শব্দহীন তান্ডব চলল। ইনজাদ সহসা বলে উঠে—
“কিছু খেয়েছ?”
“আরে না। খাবো না কিছু। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”
“তা তো জানি ম্যাডাম। প্রথমে কিছু খেয়ে তো নাও।
“উঁহু।”
ইনজাদের দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় সিন্ধুজা। ইনজাদ সেদিকে নজর ফেলতেই সিন্ধুজা অবারিত গলায় বলে যায়—
“একটা রিসোর্ট দেওয়ার কথা ভাবছি। ড্যাডের সাথে কথা বলেছি। তুমি একটু দেখে বলোতো জায়গাটা কেমন হবে?”
ইনজাদ দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরে ভাবছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কপাল চুলকে বলল—
“আই থিংক না দেওয়াটা বেটার।”
সিন্ধুজা হতবাক গলায় বলল—
“কেন?”
“গাজিপুর! গাজিপুরে রিসোর্টের অভাব নেই। চৌরাস্তা থেকে শুরু করে…। স্প্রিং ভ্যালি রিসোর্ট, রাজেন্দ্র ইকো, পুষ্পদাম পিকনিক স্পট, হ্যাপি ডে ইনন, অঙ্গনা, আরশিনগর হলিডে। আরো আছে। আই থিংক তোমার এমন জায়গা রিসোর্ট প্ল্যান করা উচিত যেখানে চাহিদার তুলনায় প্রাপ্যতা কম। ”
সিন্ধুজা গভীর ভাব নিয়ে বলল—
” তো?”
ইনজাদ চেয়ার থেকে পিঠ আলগা করে। চটপটে গলায় বলল—
“তুমি নারায়ণগঞ্জ ট্রাই করতে পারো। সায়রা গার্ডেনের নাম শুনেছ? ইটস আমেজিং! এইটা যখন স্থাপিত হয় তখন এর আয়তন ছিল ত্রিশ বিঘা। এখন আরো বিস্তৃত হয়েছে। কী নেই সেখানে! ফুল গাছ থেকে ঔষধি গাছ, সুইমিংপুল থেকে পুকুর, রেস্টুরেন্ট, বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠ সব আছে। কটেজগুলোও দারুন। সাজেক ভ্যালি ফিলিংস দেবে। পুরো না হলেও কিছুটা। নামগুলোও জোস! মাধবীলতা, কুঞ্জলতা, কলমিলতা। ইচ্ছেকরলে কাপলদের জন্য এইরকম কটেজ স্পেশাল অফারে রাখা যায়। ওখানে রিসোর্টের স্বল্পতা আছে। তোমাকে অবশ্য আরো অনেক কিছু আমলে নিতে হবে। নাহলে প্রথম ধাপে ফেল করবে। তবে আগে তোমাকে সেখানে গিয়ে জায়গা দেখে আসা উচিত। আর রিসোর্টে ডেবলপ সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা।”
“তুমি গিয়েছিলে না কি?”
ইনজাদ ছোট্ট করে হেসে বলল—
“বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলাম।”
“আমি তো ভাবলাম রেহাংশীকে সাথে নিয়ে গেছ।”
ইনজাদ লাজুক হেসে বলল—
“না, ওকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। সময় পাইনি আসলে।”
“সো স্যাড! ওকে থ্যাংস আ লট। ড্যাডের সাথে বসতে হবে। তোমাকে পরে জানাচ্ছি আমি। ”
ইনজাদ ঘাড় নাড়াল। সিন্ধুজা হাসি হাসি মুখে উঠে যায়। দরজা কাছে গেলেই ডেকে উঠে ইনজাদ। থমকে যায় সিন্ধুজা। ইনজাদ একটু এগিয়ে গিয়ে কৃতজ্ঞতার সুরে বলল—-
“ধন্যবাদ।”
সিন্ধুজা অবাক বিস্ময়ে তাকাল। ভ্রূ জোড়া কুঞ্চি করে চোখের পাতা প্রশস্ত করল। ইনজাদ গাঢ় মায়ায় বলল—
“ছুটির ব্যবস্থা করে দিলে তাই। আমার প্রক্সি তো তোমাকেই দিতে হবে।”
সিন্ধুজা হেয়ালি গলায় বলল—
“ইটস ওকে ইয়ার। এখানে ধন্যবাদের কী আছে। ইনজয়! বাই অ্যান্ড টেক কেয়ার।”
সিন্ধুজার অধরের কোণে এক সুপ্ত হাসির ঝিলিক ওঠল।
,
,
,
নিশুতি রাত। ঘনালো তমসার আকাশ জুড়ে নেই কোনো তারার ফুলকি। বাসায় ফিরেছে ক্লান্ত ইনজাদ। ঘর্মাক্ত দেহ থেকে শার্ট খুলতেই চোখে পড়ে বিছানার পাশে থাকা গুছানো ব্যাগ। ইনজাদ ভ্রু নাচায়। জোরালো কণ্ঠে রেহাংশীকে ডাকল। স্বামীর কণ্ঠ পেয়ে শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এলো রেহাংশী। ইনজাদ কপালে ভাঁজ তুলে বলল—
“এসব কী?”
ব্যাগের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল রেহাংশী। লাজুক স্বরে বলল—
“কাল বাড়ি যাব। তাই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি।”
ইনজাদ তপ্ত শ্বাস ফেলল। বুক টানটান করে বলল—
“বাড়ি যাওয়ার জন্য এত উতলা কেন তুমি? আমার কাছে থাকতে ভালো লাগে না?”
রেহাংশীর চোখে নেমে এলো কাতরতা। নিস্পৃহ গলায় বলল—
” আমি কী তা বলেছি।”
ইনজাদ কদম বাড়িয়ে এগিয়ে গেল। ঘাঢ় নিচু করল। তার শার্ট এখনো গায়ে ঝুলছে। বোতাম খোলা থাকায় অসংবৃত প্রশস্ত বুক দেখা যাচ্ছে। ইনজাদ চাপা স্বরে বলল—
” আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?”
রেহাংশী মাথা উঁচু করল। দিঘীর জল কাণায় কাণায় পূর্ণ। ধরা গলায় অব্যক্ত অনুভূতির অকাট্য যুক্তি —
“রাতের আলো কখনো চাঁদকে ছাড়া থাকতে পারে? দিনের শুরুতে চাঁদ হারিয়ে গেলেও, আঁধার কালো যখন জাগ্রত পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন স্বমহিমায় প্রস্ফুটিত হয় জ্যোৎস্নানাথের। অন্ধকার আকাশকে পৃথিবীর কোনো শক্তি চাঁদ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। আপনি আমার জীবনের সেই চাঁদ। আপনার আলোয় আমার অন্ধকার জীবন আলোয় উদ্ভাসিত। এখন বলুন, আপনাকে ছাড়া আপনার বিষবাণ থাকতে পারবে? তার মূল্য দেবে এই পৃথিবী?”
ইনজাদ গভীর, নিচ্ছিদ্র, অতলস্পর্শী মায়ায় জড়িয়ে ধরল রেহাংশীকে। শ্বাস অবরোধ করে স্বামীর বুকে মাথা রাখে রেহাংশী। থমথমে গলায় বলল—
“আপনি তো নুপূর আপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তাই না? নুপূর আপুতো আমার থেকে সুন্দরী!”
ইনজাদ চোরা হাসল। হাতের বেড় শক্ত করল। বুকে চাপ লাগে রেহাংশীর। কোনো শব্দ করল না সে। ইনজাদ নিষ্কম্প গলায় হিসহিসিয়ে বলল—-
“বাহ্যিক সৌন্দর্য শুধু চর্মচক্ষুতে হানা দেয়। এক নিমিষে যেমন বিদীর্ণ করে চোখের আরশি তেমন তা খানখান করে দেয় তার অস্তিত্ব। হৃদয়ের আরশিতে যে প্রণয়ের সূত্রপাত তার প্রতিফলণ ঘটে হৃদয়াক্ষীতে। যার প্রস্ফুটিত রূপ ধীরে ধীরে প্রণয়কাননে রূপ নেয়। সেই কাননের সমস্ত ফুলের সৌরভ তুমি। আমার বিষবাণ! যার নেশায় নেশাক্ত আমি, আমার আমি আসক্ত। কাটবে না এই নেশা আমার, আসক্তিহীন এই আমি জীবন্মৃত।”
চলবে,,,