মোহঘোর #পর্বঃ৩১,৩২

0
303

#মোহঘোর
#পর্বঃ৩১,৩২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
৩১

পেলব, শুদ্ধ, শীতল প্রভঞ্জনের মিহি পরশ চুমু এঁকে দিচ্ছে রেহাংশীর উষ্ণ দেহের কাঁপনে। প্রিয় মানুষদের দেখার অগাধ তৃষ্ণা তার চোখের মনিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। কুয়াশার শুভ্র চাদর ভেদ করছে নির্মোহ চিত্রভানুর কাঁচা সোনা রঙের স্নেহার্দ্র রোদ। প্রকৃতিতে জাগরণ উঠেছে এক পশলা গুড়ি বৃষ্টির সিক্ত সকাল। সফেদ কুয়াশার আচ্ছন্ন ধরণীর বুকে ঝিরিঝিরি জলদ কন্যার মুহূর্ত ধরে চলা অবিশ্রান্ত জল। থেমে যেতেই পা বাড়ায় রেহাংশী। কর্দমাক্ত আধপাকা পথে সাবধানী পা ফেলছে সে। দম যেন গলায় আটকে যাবে! বাড়ির কাছে এসে বুক ভরে শ্বাস নিল সে। বাড়ির সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই শিউরে উঠে তার কায়া। এক ঝাঁক জড়তার নভোলোক বিদীর্ণ করা রোদ তার ললাটে চুম্বন করল। রেহাংশী আপ্লুত হলো। বাড়ির উঠোন জুড়ে জেগে থাকা সিক্ত মৃত্তিকার ঘ্রাণ ঠেসে ধরল ঘ্রাণেন্দ্রিয়। বাড়ির আমগাছার পত্রপল্লবে গহন দোল। সীমাহীন উচ্ছ্বাসের ভরা জোয়ারে যেন ভেসে যাচ্ছে রেহাংশী। হাজার দিবসের চেনা বাড়িটি আজ কেন অচেনা,অজ্ঞাত, অপরিচিত লাগছে! জুলহাস খন্দকার হাঁক ছাড়তে ছাড়তে বাড়ির বাইরে এলেন। তাকে দেখেই উচ্ছলিত হলো রেহাংশী। গালভর্তি সজীব হাসল। অবহেলিত পাতলা চাদর টেনে নিল গায়ে। চপলতায় বিভোর পা দুটো রুখে যেতে নারাজ। রেহাংশীর হাঁটার বেগ বাড়াল। জুলহাস খন্দকারকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেলল। তিনি অবাক হলেন। ঝমঝম বৃষ্টি শেষে পানি শুষে নেওয়া মাটির মতো জমাট গলায় বলে উঠে রেহাংশী—

“কেমন আছ বড়ো আব্বু? একবার আমাকে দেখতেও গেলে না? বিয়ে হয়েছে বলে পর করে দিলে?”

জুলহাস খন্দকার পরম মমতায় রেহাংশীর মাথায় হাত রাখলেন। চোখের কোটরে নমনীয়তা এনে বললেন—-

“মায়েরা কখনো ছেলেদের পর হয়?”

রেহাংশী অনুযোগের সুরে বলল—

“তাহলে গেলে না কেন?”

“সময় পাইনি রে মা। এদিকটায় এত ঝামেলা হয়েছিল! যাব তো। তোর নতুন সংসার দেখতে। পায়েলের বিয়েটা দিয়ে নেই। তোর দাদী, বড়ো আম্মু সবাইকে নিয়ে যাব। অনেকদিন থাকব। আর রাগ করিস না মা।”

রেহাংশী ছোটো বাচ্চাদের মতো মন ভুলানো হাসল। চট করে হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখ -মুখ মুছে ফুরফুরে হাসল। বলল—

“দাদী কেমন আছে? বড়ো আম্মু, পায়েল আপু? সবাই ভালো আছে তো?”

“আছে, আছে। সবাই ভালো আছে। তুই একা কেন? জামাই কোথায়?”

রেহাংশী ঠোঁট ভর্তি লাজুক হাসল। মৃদু সুরে বলল—

“বাজারে গেছে।”

জুলহাস খন্দকার অপ্রত্যাশিত বিস্ময় নিয়ে বললেন—

“বাজারে কেন?”

রেহাংশী অধর বিস্তৃত করল। চোখে খুশির আবেশ মাখিয়ে বলল—

“প্রথম শ্বশুরবাড়ি আসবে। খালি হাতে আসা যায়!”

কথা শেষ করেই খিলখিলিয়ে হাসে রেহাংশী। জুলহাস খন্দকার প্রসন্ন হাসলেন। মেয়েটা সুখে আছে! শেষ মুহূর্তে নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল হয়নি তার। তিনি গলা প্রশস্ত করে তাড়া দিয়ে বললেন—

“তুই ঘরে যা। ওরা ঘরেই আছে।
ডেকোরেশন আর লাইটিং এর লোক আসবে। দেখি ফোন করে কোথায় ওরা।”

রেহাংশী মাথা ঝাঁকাল। চটপটে অনুভূতিতে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরের প্রতিটি জড়বস্তু যেন তাকে দেখে হাসছে। কোমল স্বরে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। মোলায়েম চোখে সবকিছু অবলোকন করছে রেহাংশী। একরাশ প্রফুল্লতা টগবগ করে ফুটছে তার চিত্তে। রেহাংশী শব্দহীন পা ফেলে পায়েলের ঘরে ঢুকল। তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই চকিতে চিৎকার করে উঠল পায়েল। রেহাংশী খিলখিল করে হেসে বলল—

“আরে থামো, থামো। আমি। ”

পায়েলের প্রাণটা যেন আরেকটু হলে উড়াল দিতো! সে আড়ষ্ট গলায় বলল—

“তুই! এমন কেউ করে?”

রেহাংশী ঝুমঝুম করে হেসে বাতাসে আলোড়ন তুলে। পায়েল আলতো করে জড়িয়ে নেয় রেহাংশীকে। সরল গলায় বলল—

“কেমন আছিস তুই? এত দেরি করলি কেন?”

রেহাংশীর জমাট হৃদয় বিগলিত হলো স্নেহার্দ্র আচরণে। কণ্ঠ সহজ করে বলল—

“ভালো আছি। কাল রাতে এসেছি। ”

“আয় বস।”

রেহাংশীকে হাত টেনে বিছানায় বসায় পায়েল। পায়েলের খুশির পায়রারা যেন তাকে ঘিরে আনন্দ উৎসব করছে। চোখের তারায়, ঠোঁটের ভাঁজে অফুরন্ত খুশির স্রোতোস্বিনীর তীব্র উত্তাল ঢেউ। রেহাংশী ক্ষীণ গলায় বলল—

“নুপূর আপু এসেছে?”

পায়েল সংকীর্ণ হেসে বলল—

“হ্যাঁ, গতকাল-ই এসেছে। জানিস আপু মা হতে চলেছে। এক সপ্তাহ আগেই আমাদের জানিয়েছে।”

সীমাহীন আকাশের শুভ্র মেঘের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল রেহাংশীর অন্তরিন্দ্রিয়। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল—

“সত্যি? ”

“হ্যাঁ। ”

রেহাংশীর খুশির ফোয়ারা তূরন্ত বেগে ছুটতে লাগল। সতেজতায় প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় লালিমা ফুটিয়ে বলল—

“আমি যাই, আপুকে দেখে আসি।”

“যা।”

চপল পায়ে পায়েলের ঘর থেকে বের হতেই সামনে পড়ে রওশন আরা। তিনি ক্ষ্যাপাটে গলায় বললেন—

“এমন ছুটতাছস ক্যান? দাদীরে ভুইলা গেলি?”

রেহাংশী চঞ্চল স্বরে বলল—

“ভুলব কেন? কেমন আছ দাদী?”

“তুই একা কেন? নাতজামাই কই?”

“সে পরে আসবে।”

“তাইলে তুই আইলি ক্যান? জামাইরে ছাইড়া আইলি ক্যান? জামাইরে আঁচলে বাইন্ধা রাখবি। ভালো কইরা শুইনা রাখ, তোর মায় আমার পোলাডারে খালি রুপের নেশা লাগাইছে, বাইন্ধা রাখতে পারে নাই। নিজে তো মইরা গিয়া বাঁচছে, আমারে পোলা হারা করছে। পোলাডা আমার সেই যে গেল আর আইলো না। শুন মাইয়া, জামাইরে ধইরা -বাইন্ধা রাখবি। নাইলে নিজের কপাল নিজে খাবি। পুরুষ মানুষ বিলাইয়ের জাত। কাঁঢা পছন্দ অইলেও তাজা মাছ পাইলে তা আর মুখে রুচে না। মনে রাখিস।”

রওশন আরার ভয়ংকর কথাবার্তায় রেহাংশী ভীত চোখে তাকিয়ে রইল। সে কখনো চায় না তার স্বামী তার বাবার মতো হোক। স্বামীর ভালোবাসার নিচ্ছিদ্র চাঁদোয়া আবৃত করে রাখুক তাকে। এই তার প্রার্থনা।
,
,
,
দরজায় কড়া নাড়ল। সোফায় বসে থাকা এহসাস উঠে এসে শব্দহীনভাবে দরজা খুলল। রেহাংশী মিহি হেসে বলল—

“কেমন আছেন?”

এহসাস পলক ফেলে ঈষৎ ফাঁক করা অধরে বলল—

“ভেতরে এসো।”

রেহাংশী বিনা ছন্দপতনে ভেতরে ঢুকল। বিছানায় তাকাতে দেখল ঘুমের দেশে তলিয়ে আছে নুপূর। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে! জ্বলজ্বলে রূপে ম্লানতা। শুষ্ক অধরে খসখসে ভাব। চোখের নিচটা প্রাণহীন। রেহাংশী চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল এহসাসের দিকে। এহসাস মুখ খুলল—

“একটু আগেই বমি করেছে। শরীর ভালো নেই।”

রেহাংশী চাপা স্বরে বলল—

” ডাক্তার দেখিয়েছেন?”

“হুম। কিছু হালকা পাওয়ারের ঔষধ দিয়েছে। বাইরে চলো, কথা আছে আমার।”

রেহাংশী নির্বিকার ভঙ্গিতে মাথা হেলিয়ে কক্ষের বাইরে আসে। এহসাস নিঃশ্বাস নিল। গাঢ় স্বরে বলল—

“ক্ষমা করে দিয়ো রেহাংশী। সেইদিন যা করেছি শুধু নুপূরের কথা ভেবে করেছি। ভাবিনি তারপর তোমার সাথে কী হবে! আমি তো অবাক হয়েছি তোমার সাথে ওর মা এত কিছু করার পরও ও বাঁধা দিলো না কেন?”

রেহাংশী নতমুখে চুপ করে রইল। কী বিদঘুটে দিন ছিল! বিয়ে বাড়ির মানুষ তাকে কত কথা শুনিয়েছে। ওইটুক বয়সে প্রেম, তার ওপর তার মাকে নিয়েও গুঞ্জন উঠিয়েছে। বলেছে হয়তো মায়ের সাথেও কারো এমন সম্পর্ক ছিল। তাই তার বাবা মাকে ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েটাও মায়ের মতো হয়েছে। নুপূরের মা দুইদিন রেহাংশীকে ঘরবন্দি করে রেখেছিল। খেতে দেইনি পর্যন্ত।
রেহাংশী আর ভাবতে চায় না। তার কষ্টের অবসান ঘটেছে। এখন শুধু সুখের পায়রাদের প্রবেশাধিকার তার ছোট্ট প্রেমপূর্ণ নীড়ে।

“আসলে…।”

“কেমন আছেন?”

এহসাসের কথার মাঝখানে এসে দাঁড়াল ইনজাদ। স্বাভাবিক আননে অমায়িক হাসি। এহসাস নির্মল গলায় প্রত্যুক্তি করল—-

“ভালো, আপনি কেমন আছেন?”

ইনজাদ কপালের মধ্যখানে কিঞ্চিৎ ভাঁজ তুলল। চোখে হাসল প্রেমময় ভঙ্গিতে। পুরু অধর বিস্তৃত করে সচ্ছল গলায় বলল—

“ভালো। আর ভালো বলেই এত দূর আসতে পেরেছি।”

মৃদু হাসল এহসাস। লজ্জার ভঙ্গিতে চোখ নাড়াল। অপরাধি মুখ করে বলল—-

“একটা কথা বলতে চাই। ক্ষমা চাইতে। না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছিলাম।”

ইনজাদ অনড় গলায় বলল—

“থামুন, আমি জানি আপনি কী বলবেন। রেহাংশীর অতীত আমার অগোচরে। আমি তা শুনতে বা জানতে চাই না। আমি ওর বর্তমান। এবং ভবিষ্যতের সারথি। তাই আমি ওর ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবব।”

এহসাস একগাল প্রশ্রয়ের হাসি হাসল। সশব্দে বলল—

“ধন্যবাদ। নিজেকে হালকা লাগছে।”

ইনজাদ চোখে হেসে বলল—

“বাড়ি আসবেন আমাদের। পাশেই তো। দু ‘কদম হেঁটে চলে আসবেন। এসো রেহাংশী।”

রেহাংশী আপ্লুত গলায় বলল—

“চলে যাবেন কেন? বড়ো আব্বু আপনাকে খেয়ে যেতে বলেছে।”

ইনজাদ অনায়তন গলায় বলল—-

“না। দুই দিনের জন্য বাড়িতে এসেছি। আম্মার হাতের রান্নাই খাবো। আর আমরা তো সন্ধ্যায় আবার আসব এখানে। তুমি চাইলে থাকতে পারো।”

রেহাংশী মাথা ঝাঁকিয়ে না বোধক সম্মতি দিলো। ইনজাদ প্রশ্রয় দিলো তার সম্মতিকে।

চলবে,,,

#মোহঘোর
#পবঃ৩২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সূর্যের প্রস্ফুটিত দগদগে আভার দেখা মিলেনি আজ ধরণী মাতার। থমথমে অম্বুরের অভিমানি কাদম্বিনীর অন্তরালে লুকিয়ে আছে সে। কুয়াশার মায়া কাটিয়ে দিবসমনি দুপুরের স্বচ্ছ মায়ায় আচ্ছন্ন হয়েছে।

তমালিকা আর পারভেজ মির্জা দুপুরে খাওয়ার পর বসে আছেন তাদের শয়নকক্ষে। মৃদু ফাঁক করা দরজা ঠেলে মাথা ঢোকায় রেহাংশী। অনুমতি প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে—

“ভেতরে আসব?”

তমালিকা সপ্রতিভ গলায় বললেন—

“এসো বউমা।”

রেহাংশী ছোটো ছোটো পায়ে অচঞ্চল ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকে। তমালিকা ছোট্ট হেসে বলল—

“কিছু বলবে?”

রেহাংশী মাথা ওপর-নিচে দুলালো।

“কী?”

হাতের প্যাকেট থেকে কিছু একটা বের করে তমালিকার হাতে দিলো। তিনি উৎসুক চোখে চাইলেন। সাদা রঙের পাতলা প্যাকেট থেকে বের করে একটা শাল দিলো পারভেজ মির্জার হাতে। তিনি চকিত চোখে চেয়ে বললেন—

“এসব?”

রেহাংশী স্মিতহাস্য অধরে বলল—

“আপনাদের ছেলে এনেছেন।”

তমালিকা তটস্থ গলায় বলল—

“তোমার জন্য কিছু আনেনি?”

“এনেছেন তো। এই যে নাকফুল।”

রেহাংশী চমৎকার হাসল। গাঢ় মায়ায় আচ্ছন্ন লাজুক হাসি। তমালিকা নিজের প্যাকেট খুলে অবাক বিস্ময়ে চোখের পাতা প্রশস্ত করে বললেন—

“এইগুলো! এইগুলোর তো অনেক দাম?”

রেহাংশী চিকন স্বরে বলল—

“আপনাদের ভালোবাসার কাছে এর মূল্য তো এক ইঞ্চিও নয়। আর তুলনা করাতো বোকামি।”

তমালিকার চোখ নিভে এলো। হাতের জ্বলজ্বলে বালা দুটোর দিকে সরস চোখে নির্নিমিখ চেয়ে রইলেন। টলটল চোখে বললেন—

“ইনজাদ কোথায়?”

“শুয়ে আছেন। তার পিঠে না কী ব্যথা করছে!”

তমালিকা ত্রস্তে উঠে দাঁড়াতেই পারভেজ মির্জা হাঁক ছাড়লেন—

“কোথায় যাচ্ছ?”

তমালিকা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে আমতা আমতা করে বললেন—

“ইনজাদের পিঠে না….কী ব্যথা..।”

“ব্যথা হলে রেহাংশী আছে তো। তুমি যাও তো মা। ডাইনিং রুমের যে শোকেসটা আছে তার ওপরে একটা স্প্রে বোতল আছে। ওর পিঠে হালকা করে ম্যাসাজ করে দিয়ো।”

রেহাংশী মিহি সুরে বলল—

“জি বাবা।”

রেহাংশী চলে যেতেই আড়ষ্ট গলায় বলে উঠেন পারভেজ মির্জা—

“ছেলেটাকে একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। বারবার কেন অসুস্থ হয়ে যায়…?”

তমালিকা ভাবলেশহীন। তিনি স্বগতোক্তি করে বললেন—

“বিয়ে হলেই কী ছেলেরা মায়ের পর হয়ে যায়?”
,
,
,
বিয়ে বাড়িতে নানান কাজ। গতকাল হলুদে জুলহাস খন্দকার আর এহসাসের সাথে মিলে অনেক কাজ করেছে ইনজাদ। সবকিছুতেই তার সপ্রতিভ অংশগ্রহণ ছিল। অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রমে তার পিঠের মাংসপেশীতে চাপ পড়ে। সকালে খেয়ে আবারো বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে ইনজাদ। উপুর হয়ে শুয়ে আছে সে। রেহাংশী হালকা হাতে পিষ্ঠদেশের বাঁকে মালিশ করে দেয়। ইনজাদ মোলায়েম স্বরে বলল—

“হঠাৎ এত আদর কেন?”

“বাবা বলেছে মালিশ করে দিতে।”

ইনজাদ পাশ ফিরল। সোজা হয়ে বলল—

“ওই বালিশটা দাও।”

রেহাংশী তার মাথার বালিশটা ইনজাদকে এগিয়ে দেয়। সেইটা পিঠের নিচে রেখে আরেকটা বালিশ বিছানার সাথে উঁচু করে দিয়ে তাতে মাথা রাখে ইনজাদ। উদাস গলায় বলল—

” আমি না বললে তো আমার কাছেও আসতে ইচ্ছে হয় না? একটুও মায়া নেই আমার জন্য।”

রেহাংশী ব্যথিত গলায় বলল—

“এমন করে বলছেন কেন?”

তীব্র শ্বাস ফেলল ইনজাদ। ব্যাকসাইডের ব্যথায় সত্যিই কাতর সে। ইনজাদ প্রসঙ্গ পালটালো।
প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে বলল—

“তোমার বাবার কথা মনে পড়ে না?”

রেহাংশী সচকিত চোখে চাইল। স্থির গলায় বলল—

“না।”

ইনজাদ ভ্রূ-বিলাস করে বলল—

“দেখতেও ইচ্ছে করে না?”

রেহাংশীর গলায় রাগ জমা হলো। সশব্দে বলে উঠে—

“না,না, না। কখনো না, কোনোদিনও না।”

তূরন্ত বেগে বিছানা থেকে উঠে যায় রেহাংশী। ইনজাদ আর্ত গলায় ডেকে উঠে—

“রেহাংশী! রেহাংশী।”

ইনজাদের কণ্ঠস্বর রোধ করতে পারল না রেহাংশীর অবিরত চলা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইনজাদ। বিড়বিড় করে বলল—-

“কোনো সন্তান তার বাবাকে এত ঘৃণা কী করে করতে পারে?”
,
,
,

আলস্য দুপুর কাটিয়ে উদাস, বিষণ্ণ বিকেল। নিরাক পরিবেশে থম ধরা অনুভূতি। শীতের প্রকোপ না থাকলে ও ম্লানতায় আবিষ্ট বসুমতী। ঊষাপতি আজ অনুরাগশূন্য। দীপ্ততা ছড়াতে নারাজ। তোয়ধ খর্ব করেছে তার দাপট। আড়াল করে রেখেছে তাকে তার অন্ত:পুরে। শুভ্র নভস্থলে চোখ বুলিয়ে দেখা পাওয়া যায় না তার।

হাতের কুঁচি ধরে রেখে কাঁধ হেলিয়ে কানে মোবাইল চেপে রেখেছে রেহাংশী। টুকটুক করে কথা বলছে সে। ওপাশের যুবতীর মায়াময় ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর।

“ভুলে গেলে? ভালো। বাড়ি গিয়ে বোনের বিয়ে খাওয়া হচ্ছে! আর আমাদের এখানে একবারো এলে না।”

রেহাংশী স্নিগ্ধ গলায় বলল—

“আমি কীভাবে যাব? তোমার ভাইয়া তো সময় পাচ্ছে না। এইবার ঢাকা ফিরলে অবশ্যই যাব।”

ত্রিণার গলায় এবার রাগ ঝরে পড়ল।

“তোমাকে তো বলেছি, আব্বুর সাথে চলে এসো। তুমি তো শুনলেই না।”

“মন খারাপ করো না মিষ্টি পায়রা। আসব তো। এখান থেকে ঢাকা ফিরলে তোমার ভাইয়ার বন্ধু বিয়ে। সেখান থেকে ফ্রি হলেই তোমাদের ওখানে যাব।”

ত্রিনা কণ্ঠ পরিবর্তন করল। অসহায় স্বরে শুধাল—

“সত্যি?”

“সত্যি।”

“আসবে কিন্তু মিষ্টি বউ। নাহলে কিন্তু কথা বলব না তোমার সাথে।”

“আচ্ছা, আচ্ছা। আসব, এখন রাখি? দেরি হচ্ছে আমাদের।”

“ওকে।”

রেহাংশী কান থেকে মোবাইল নিয়ে সাবধানে বাড়িয়ে ধরে ইনজাদের দিকে। ইনজাদ নিবিড় আবেশে অভিভূত হয়ে রেহাংশীকে দেখছিল। তার সমাচ্ছন্নতায় ভাটা পড়ে। ইনজাদ চাহনি শিথিল করে বলল—

“দিয়ে যাও।”

তীক্ষ্ম সুরে ভ্রু উঠিয়ে বলল রেহাংশী—

“আমি কী করে দেবো? আপনি নিয়ে যান।”

ইনজাদ তাচ্ছিল্য সুরে বলল—

“পারব না। দিয়ে যাও।”

বিছানায় স্থবির হয়ে বসে রইল ইনজাদ। রেহাংশী চোখের পাতা নাচিয়ে বলল—

“নিয়ে যান না!”

“পারব না।”

“ধুর! থাক তাহলে।”

মোবাইলটা ধুম করে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখে রেহাংশী। শাড়ির কুঁচি গুঁজে নিয়ে কাঁধে আঁচল তোলে। নিজেকে পরিপাটি করে মোবাইল নিয়ে ইনজাদের কাছে এসে দাঁড়ায়। ইনজাদ ঠোঁট চিপে হাসে। রেহাংশী সন্দিহান গলায় বলল—

“হাসছেন কেন?”

রেহাংশীর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে প্রত্যুক্তি করে ইনজাদ—

“তোমাকে বাংলাদেশের পতাকা মনে হচ্ছে। বিয়েতে কেউ সবুজ শাড়ি পরে? সাথে লাল ব্লাউজ! ”

“কেন মানচিত্র মনে হচ্ছে না?”

দুষ্ট হাসির ঝলক দেখা গেল ইনজাদের চোখে-মুখে। রহস্যচ্ছলে বলল—

“একটু আগে তাই মনে হচ্ছিল। কোথাও সবুজ, কোথাও লাল, কোথাও…।”

“চুপ করুন আপনি।”

“পরলে কেন এই শাড়ি?”

রেহাংশী প্রসন্ন গলায় বলল—

“আম্মা দিয়েছে তাই পরেছি।”

“আম্মা দিলেই কী পরতে হবে না কি?”

“আম্মা ভালোবেসে দিয়েছেন, পরব না কেন? আপনার সমস্যা হলে আমার থেকে দূরে থাকবেন।”

ইনজাদ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল—

“দূরে থাকার জন্য কী বিয়ে করেছি না কি! আর তোমার ফ্যামিলি…যা খাটানোর খাটালো আমাকে!”

রেহাংশী শাষানো গলায় বলল—

“আপনাকে কে বলেছে এসব করতে?”

“মানাও তো করেনি। কই নতুন জামাই আপ্যায়ন করবে তা না, বাড়ির কাজ করালো! মেরি ফুটি কিসমাত!”

” একদম আমার পরিবারের দোষ দেবেন না। নিজেই তো যেচে গেছেন।”

“সেটাই তো। তোমার বড়ো আম্মু ভেবেছে ফ্রি টাকায় জোয়ান মরদ পাওয়া গেছে। আর কি!”

রেহাংশী সিক্ত পদ্মের ন্যায় হেসে ওঠে। হেসে হেসে বলল—

“জোয়ান মরদ আবার কী?”

“যুবক ছেলে।”

“ও বাবা! নিজেকে যুবক মনে হচ্ছে আপনার?”

ইনজাদ কপট রাগ দেখিয়ে রেহাংশীর হাত টেনে তার কটিদেশ চেপে ধরে। রেহাংশী ভয়ে বিহ্বল হয়ে বিপন্ন গলায় বলল—

“আরে,আরে ছাড়ুন। শাড়ি খুলে যাবে আমার!”

ইনজাদ অপ্রসন্ন গলায় বলল—

“দুই ঘণ্টা ধরে কী শাড়ি পরলে যে খুলে যাবে?”

“আরে, ছাড়ুন তো।”

ইনজাদ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রেহাংশী। আর্ত গলায় গাল ফুলিয়ে বলল—

“কী করলেন বলুন তো! আমার শাড়িটাই নষ্ট করে দিলেন।”

দরজায় আওয়াজ হলো। সচল হলো দুই কপোত-কপোতী। তমালিকা ভেতরে আসলেন। মৃদু হেসে বিস্ময় নিয়ে বললেন—

“মাশা আল্লাহ! আমার মেয়েটাকে কী সুন্দর লাগছে!”

চকিতে রেহাংশী ডুবে গেল লজ্জার জলেশ্বরের গহ্বরে। নতজানু মুখে তার কায়া ঝনঝনিয়ে ওঠল। তমালিকা কাছে এগিয়ে গেলেন। রেহাংশীর হাত নিয়ে বললেন—

“দেখি হাতটা দাও।”

রেহাংশী কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতে বালা জোড়া পরিয়ে দিলেন তমালিকা। রেহাংশী অতর্কিত বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে প্রতিবাধ করে বলল—

” আম্মা, এগুলো তো আপনার?”

“আমার হয়েছে তো কী হয়েছে? মায়ের জিনিস কী মেয়ে পরতে পারে না?”

রেহাংশীর পদ্মনেত্রে জোয়ার ওঠল। সাশ্রুনেত্রে জড়িয়ে ধরল তমালিকাকে। ইনজাদে তমালিকার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। স্বামীর দিকে ঝাপসা চোখে তাকাল রেহাংশী। ইনজাদের বলা সেই কথা তার মনে পড়ল। ইনজাদ মৃদু হেসে মিছে শ্লেষাত্মক গলায় বলল—

” আম্মা, মেয়েকে পেয়ে ছেলেকে ভুলে যাবেন না আবার! যত যাই হোক পেট থেকে আমি এসেছি।”

তমালিকা ছেলের দিকে মেকি রাগি চোখে তাকিয়ে বললেন—

“পাজি ছেলে! এসব কী ধরনের কথা?”

“ভয় হচ্ছে আম্মা। মেয়েদের সাথে পেরে ওঠা দায়!”

তমালিকা হাসলেন। খুশ মেজাজে বললেন—

“কম-বেশি হবে কেন? তোরা দুইজন আমার কাছে এক।”

রেহাংশীর কপালে আস্ত চুমু খেলেন তমালিকা। ইনজাদ বিগলিত হাসল। তমালিকা ইনজাদের দিকে তাকালেন। তাড়া দিয়ে বললেন—

“রেডি হচ্ছিস না কেন?”

“আমি তো রেডি।”

তমালিকা চোখ পাকিয়ে বললেন—

“কীসব গেঞ্জি ফেঞ্জি পরেছিস। বিয়েতে কেউ এসব পরে? যা, একটা ভালো পাঞ্জাবি পরে নে।”

“আরে বিয়ে কী আমার না কি? আমি পাঞ্জাবি পরব কেন?”

রেহাংশী ফিক করে হেসে চট করে বলে ফেলল—

” আরে বর যেইটা পরে ওটাকে শেরওয়ানি বলে বুদ্ধু!”

দুই জোড়া চাহনি পলেই বিদ্ধ হলো রেহাংশীর দিকে। রেহাংশী আস্ত কামড় বসায় নিজের জিবে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here