#মোহঘোর
#পর্বঃ৩৮,৩৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
৩৮
কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে তড়াক করে উঠল ইনজাদের মস্তিষ্ক। এই নাম সে শুনেছে। কয়েকবার শুনেছে। জিবরান খন্দকার হতচকিত। রেহাংশীর নামটাও তার আবছা মনে আছে। তিনি সরল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—
“কে তুমি?”
রেহাংশী শক্ত কণ্ঠে বলল—
“কেন? চিনতে কষ্ট হচ্ছে? হওয়ার-ই কথা।”
রেহাংশী কাঁদছে না। তবুও অবিরত ধারায় ঝরছে তার চোখের ধারা। একটু পরপর হেঁচকি তুলছে সে। কান্না রোধের বিফল চেষ্টা। ইনজাদ আশ্চর্য চোখে চেয়ে বলল—
“স্যার আপনি ওকে চেনেন?”
জিবরান খন্দকার অতীতে ডুব দিলেন। আট কী নয় বছরের রেহাংশী তাকে দেখেই ছুটে পালাল। জিবরান খন্দকার ডাকলেন। কিন্তু রেহাংশী শুনল না। ছাদে গিয়ে দরজা আটকে বসে রইল। জিবরান খন্দকার ফিরে গেলেন সেদিনকার মতো। তিনি আরো একবার এসেছিলেন। সেদিনও রেহাংশীর দেখা তিনি পাননি। রেহাংশী তার নানির বাড়ি ছিল। এরপর আর কখনো তিনি খন্দকার বাড়িতে পা রাখেননি। একটু একটু করে তার স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যেতে লাগল রেহাংশী নামের ছোট্ট এক দূরন্ত শিশুর কলতান। বাবা আসার খুশিতে যে রাতভোর জেগে থাকত। শহর থেকে বাবাকে কী কী নিয়ে আসতে বলবে তার লিস্ট তৈরি করে রাখত। বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমানোর অব্যক্ত আবদার সবসময় বুকে গুঁজে রাখত। ব্যক্ত করা হয়নি সেই আবদার। তার আগেই সব কিছু বদলে গেল।
জিবরান খন্দকার অবিশ্বাসী গলায় বললেন—-
“ও ওওর নাম রেহাংশী? বাড়ি কোথায় তোমাদের?”
ইনজাদ ছোট্ট করে বলল—
“মিঠাপুকুর।”
“তোমার বাড়ি মিঠাপুকুর! তুমি খন্দকার বাড়ি চেনো? জুলহাস খন্দকার?”
চোখের কোটর ছোটো করল ইনজাদ। অবিরত গলায় বলল—
“জি, আমার বাড়ির খন্দকার বাড়ির সামনেই। জুলহাস খন্দ…এক মিনিট। আপনি জিবরান খন্দকার, জুলহাস খন্দকারের ছোটো ভাই। অনেক বছর আগে যে বাড়ি ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। তার মানে আপনিই রেহাংশীর বাবা?”
রেহাংশী উনুনের গনগনে আগুনের মতো জ্বলে উঠে বলল—
“না, এই লোকটা আমার বাবা না। এই লোকটা একটা খুনি। আমার মাকে খুন করেছে। আপনি পুলিশকে ফোন করুন। তাড়াতাড়ি ফোন করুন।”
জিবরান খন্দকার আবেগে আপ্লুত হলেন। এতবছর পর মেয়েকে চোখের সামনে দেখে তার শক্ত মনটা হঠাৎ করেই দরিয়া হয়ে গেল। চোখের জলে ভিজে গেল পল্লব। জমাট গলায় বললেন—
“রেহাংশী, মা আমার, কথা শোন আমার।”
জিবরান খন্দকার খানিকটা এগিয়ে গেলেন রেহাংশীর কাছে। রেহাংশী আগুনের গলিত লোহার মতো ছ্যাত করে উঠে বলল—
“একদম ছোঁবেন না আপনি আমাকে। কীসের মেয়ে, কীসের মা! কেউ না আমি আপনার। কেউ না। শুধু জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। খুনি! আমার মাকে খুন করে আমাকে খুনি বানিয়েছে।”
রেহাংশী ইনজাদের দিকে চাইল। তার ব্লেজারের কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল—
“আমি আমার মাকে খুন করিনি বিশ্বাস করুন। এই লোকটা খুন করেছে। আমার মাকে যন্ত্রণা দিয়ে তিলে তিলে মেরেছে। আপনি পুলিশকে ফোন করুন না। এই লোকটাকে পুলিশে ধরিয়ে দিন। এর মতো মানুষের খোলা বাতাসে শ্বাস নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই লোকটার জন্য আমার মা মরেছে, এই লোকটার কারণে সবাই আমাকে দূর দূর করেছে, এই লোকটার জন্য আমার ছোটোবেলা নষ্ট হয়ে গেছে। অপয়া, অলক্ষুণে বলে সবাই কথা শুনিয়েছে। আর সে এখানে এসে দিব্যি স্ত্রী- সন্তান নিয়ে সুখে আছে। যখন এতই অপছন্দ তাহলে আমাকে জন্ম দিলো কেন? মেরে ফেলল না কেন আমাকে? জনম ভরে কাঁদার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল আমাকে। আপনি এই লোকটাকে পুলিশে দিয়ে দিন। ফোন করুন না।”
ইনজাদ আলতো করে জড়িয়ে ধরল রেহাংশীকে। পাঁজর কাঁপিয়ে রোদনে আচ্ছন্ন মেয়েটির চোখের জল সবার চোখ সিক্ত করল। সিন্ধুজা, সৌরভ ভাবতে পারেনি তাদের একটা বোনও আছে। সিন্ধুজার মা সাবরিনা বিবশ চোখে চেয়ে রইলেন। নিজেকে তার অপরাধি মনে হচ্ছে। নিজের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে গিয়ে অন্য কারো জীবন নষ্ট করে ফেলেছে সে। কিন্তু সবকিছুর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন জিবরান খন্দকার। তার ছোট্ট রেহাংশী বিবাহিত! সংসার করছে সে। মায়ের মতো হয়েছে। ধারালো স্বরে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে।
রেহাংশীর মা জয়ার সাথে জিবরান খন্দকারের সম্পর্কের বিয়ে ছিল। সুন্দরী জয়ার প্রেমে মত্ত হয়ে অনেকটা মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বিয়ে করে ঘরে তুলেছিলেন তাকে। কিন্তু বছর ঘুরতেই জন্ম হয়ছিল রেহাংশীর। পরিবারের খরচ বাড়ে। জিবরান খন্দকার উপার্জনের জন্য গ্রাম ছাড়েন। ব্যস্ত হয়ে পড়েন কাজে। একটা নতুন গার্মেন্টের ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই ডিভোর্সি সাবরিনার সংস্পর্শে এক নতুন জগত গড়ে তুলেন তিনি। জন্ম হয় সৌরভের। মোহের বশে করা ভুল রূপ নেয় জীবনের সবচেয়ে বড়ো মোহঘোরের। জয়ার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। সম্পর্কে ফাটল তৈরি হয়। ঘুনে ধরা সম্পর্কে টান পড়তেই জয়া বেছেনিলেন মুক্তির পথ। যা তার সন্তানের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল। জয়ার অসুস্থতা বাড়তে থাকে। মায়ের সাথে দূরত্ব বাড়ে রেহাংশীর। রাতভোর জেগে ক্রন্দনে বিহ্বল মাকে তখন খুব অচেনা মনে হতো তার। রেহাংশী জানত না সেই কান্নার কারণ। একদিন হঠাৎ করেই এলো সে দিন। অসুস্থ জয়া জিবরান খন্দকারের সাথে কলহে লিপ্ত হলেন। রেহাংশী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। রাতের প্রহর। হঠাৎ লোডশেডিং হয়। ঘাবড়ে যায় রেহাংশী। অন্ধকারে এক পর্যায় চিৎকার করে উঠেন জয়া। যখন বিদ্যুতের ঝলকে সবকিছু স্পষ্ট হয় তখন জয়ার আত্মারাম তাকে ছেড়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। স্বামীর মুখে তালাকের কথা শুনে অসুস্থ জয়া আর সহ্য করতে পারেননি। হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি পরপারে পাড়ি জমান। সেই থেকে আঁধারে ভয় রেহাংশীর। নিজের জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষকে কেড়ে নিয়েছে সে মিনিট খানেকের আঁধার। এইটাই তার ছোট্ট মস্তিষ্কের বিশ্বাস যা ধীরে ধীরে তাকে জেকে ধরেছে।
ইনজাদ নম্র গলায় বলল—
“শান্ত হও রেহাংশী।”
রেহাংশী ফের তেঁতে ওঠল। রাগ ঝরা কণ্ঠে দাপিয়ে উঠে বলল—
“কীসের শান্ত হবো আমি? হবো না। আপনি পুলিশকে ফোন করছেন না কেন? এই লোকটা এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন?”
রেহাংশী উন্মাদগ্রস্ত ! ঘৃণায়, রাগে তার কোমল দেহ থরথর করে কাঁপছে। দ্রুত বেগে গিয়ে জিবরান খন্দকারকে ফের ধাক্কা মারে। তাকে সামলে নেয় সিন্ধুজা। এবার আর পূর্বেকার মতো রাগ হলো না তার। ইনজাদ টেনে ধরল রেহাংশীকে। ধমকে উঠে বলল—
“কাম ডাউন, রেহাংশী। শান্ত হও এবার।”
“কেন হবো? এই লোকটার জন্য আমার পুরো জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। সব থেকেও কিছুই নেই আমার। শুধু এই লোকটার জন্য। আপনি পুলিশকে ডাকুন। এই লোকটাকে জেলে পাঠিয়ে দিন। আমি এর মুখ দেখতে চাই না। চলে যেতে বলুন এই লোকটাকে।”
রেহাংশীকে থামানো যাচ্ছে না। উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ শুরু করল সে। ইনজাদ না পেরে জোরে ধমকে উঠতেই মিইয়ে যায় রেহাংশী। নিভে যেতে থাকে তার চোখ। শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে টলে পড়তেই তাকে জড়িয়ে নেয় ইনজাদ। জিবরান খন্দকার এগিয়ে আসতেই শক্ত কণ্ঠে ঘোষণা করে ইনজাদ।
“প্লিজ স্যার, ডোন্ট টাচ!”
জিবরান খন্দকার মর্মভেদী গলায় বললেন—
“ইনজাদ! ও আমার মেয়ে!”
“বাট নাউ, শি ইজ মাই ওয়াইফ।”
রেহাংশীর অচেতন দেহ কোলে তুলে নেয় ইনজাদ। একজন স্টাফকে নিয়ে এগিয়ে আসে মেহমাদ। হলের ভেতরের দিকে একটা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় রেহাংশীকে। ছোট্ট কক্ষটিতে একটা নরম গদি বিছানো। রেহাংশীকে সেখানে শুইয়ে দেয় ইনজাদ। মেহমাদ চলে যায়। রেহাংশীর এক হাত নিজের অঞ্জলিতে নিয়ে তার শিয়রের সামনেই বসে থাকে ইনজাদ। অপেক্ষা…..।
,
,
,
চোখ পিটপিট করছে রেহাংশী। বিছানার ওপর নিশ্চল তার দেহ। মস্তিষ্কের নিষ্প্রভ স্নায়ু চঞ্চল হতেই ধপ করে উঠে বসে সে। রেহাংশীর দিকে প্রগাঢ় চোখে তাকিয়ে আছে ইনজাদ। সমূলে উপরে যাওয়া বৃক্ষের মতো ইনজাদের গলা জড়িয়ে ধরে রেহাংশী। পাঁজর ভেঙ্গে শব্দহীন কান্নার জো তুলে। ইনজাদ আলগোছে রেহাংশীর পিঠের ওপর হাত রাখে। আলতো স্বরে বলল—
“কান্না থামাও রেহাংশী। প্লিজ..।”
রেহাংশী আরো দৃঢ় করে আঁকড়ে ধরে ইনজাদের গলা। তার সমস্ত ভার ঢেলে দেয় ইনজাদের বুকের ওপর। ইনজাদ অবিচল গলায় ফের বলল–
“প্লিজ কান্না থামাও।”
রেহাংশী হাতের বেড় শিথিল করে। হাঁটু ভর দেওয়া দেহ গদির পাটাতনে রাখে। উলুথুলু চাহনিতে ব্যস্ত সে। চোখের কোটর ঝাপসা। বিছানা থেকে মেঝেতে রাখা দুই পায়ের এক পা বিছানায় রাখে ইনজাদ। রেহাংশীর দিকে ঘুরে বসে। আরেকটু কাছে এগিয়ে যায় রেহাংশীর। ভেজা আঁখিপল্লব চুইয়ে পড়ছে স্বচ্ছ, নোনতা নহর। ইনজাদ রেহাংশীর হাতের কব্জি হাত দিয়ে ঘষে বলল—
“চুড়ি পরোনি কেন?”
রেহাংশী নির্বাক। তার কণ্ঠদেশে চাহনি বিদ্ধ করল ইনজাদ। বলল–
“গলায়ও কিছু পরোনি।”
রেহাংশী নাক টানছে। হাতের উলটো পাশ দিয়ে সিক্ত চোখ মুছে নেয়। ইনজাদ ফিচেল হাসে। রেহাংশীর ভাঁজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে দুষ্ট করে চাহনি। তার পায়ের কাছে শাড়িতে হাত গলায় ইনজাদ। ছোঁয়ার মাত্রা উপরের দিকে উঠতেই পা সরিয়ে নেয়ে রেহাংশী। ঠান্ডা গলায় বলল–
“এমন করছেন কেন?”
ইনজাদ অধর বিস্তৃত করে বলল—
“হাসো না কেন? হাসো, হাসো।”
রেহাংশীর গলায়, গালে অধরের ছোট্ট স্পর্শ আঁকে ইনজাদ। ফুরফুরে হেসে বলল—
“এত কান্নার কীসের? আমার বিষবাণ কাঁদবে কেন? অন্যকে কাঁদাবে। আমার মতো।”
রেহাংশী মুখ ভার করে বলল—
“আমি আপনাকে কাঁদাই?”
“তা নয়তো কী? কিছু হলেই তো কথা বন্ধ করে দাও, খাওয়া বন্ধ করে দাও, আমাকে তো কাছেও ঘেঁষতে দাও না।”
“এত ঘষাঘষি কীসের আপনার?”
ইনজাদ ফিক করে হেসে বলল—
“শীতকালে ঘষাঘষিই তো ভালো। শরীর গরম থাকে।”
খলখল করে হেসে উঠে ইনজাদ।
চলবে,,,
#মোহঘোর
#পর্বঃ৩৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
“আপনি হাসছেন?”
ইনজাদ হাসি বন্ধ করল। নির্মোহ গলায় বলল—
“হাসব না তো কী করব? এতটুকুর জন্য কেউ এভাবে কাঁদে?”
রেহাংশী অভিমানী গলায় বলল—
“আপনার কাছে এতটুকু মনে হচ্ছে?”
“তা নয়তো কী! কী অবস্থা করেছ নিজের?”
ইনজাদ পকেট হাতড়ে একটা টিশু বের করল। মৃদু শীতলতায়ও ঘেমে যাচ্ছে রেহাংশী। তার চুলের খোঁপা হতে চুল বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। চোখের জলে ধুয়ে গেছে মুখের চামড়ায় আস্তরণ পড়া প্রসাধনীর। কপালে, চোখের নিচে, চিবুকে জমেছে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মতো ঝকঝকে ঘাম। ইনজাদ বড়ো দানাগুলো হাত দিয়ে পরম যত্নে মুছে দিলো। বাকি ঘাম মুছে দিলো টিশু দিয়ে চেপে। কপট হতাশতা দেখিয়ে বলল—
“এত টাকা খরচ করে মেকওভার করালাম, সব জলে ধুইয়ে দিলে। কতগুলো টাকা লস করালে আমার বলোতো?”
রেহাংশী ভাসন্ত চোখে চাইল। এই মুহুর্তেও মানুষটার মজা করা বন্ধ হয় না! রেহাংশী নির্নিমেষ চাহনিতে হেসে ফেলে ইনজাদ। আবেশিত গলায় বলল—
“মায়ের কথা মনে পড়ছে?”
রেহাংশীর ম্লান চাহনি অনুপলেই সরব হলো। ইনজাদ ঠোঁট ছোঁয়াল রেহাংশীর ললাটে। মৃদু স্বরে নিজের গরজেই বলল—
“আম্মার কাছে কিছুদিন রেখে আসি তোমাকে? যাবে?”
রেহাংশী কথা বলল না। আদুরে চড়ুই পাখির ছোট্ট শরীরটা গুঁজে দিলো ইনজাদের বুকে। ইনজাদ পা সরাল। রেহাংশীকে বসতে দিয়ে বিছানায় রাখা পা টা ছড়াল। ইনজাদের শরীরের সাথে লেপ্টে গেল রেহাংশী। ইনজাদ পা টেনে এনে একটা বলয়ে আবদ্ধ করে নিল রেহাংশীকে। তার গলায় এক হাত জড়িয়ে রেখে আরেক হাতে ব্লেজারের ভেতরে হাত গলিয়ে দিয়ে শার্ট খামচে রেখেছে রেহাংশী। ইনজাদ বাম হাতের বেড়িতে রেহাংশীর কটিদেশ আবদ্ধ করল। ইনজাদের মুখের কাছে মুখ নিয়ে ভাবুক চোখে তাকিয়ে রইল রেহাংশী। ইনজাদ চিবুক ঠুকল রেহাংশী কপালে। ঠান্ডা স্বরে বলল—
“রেখে আসবো তোমাকে?”
ঢোক গিলে নিল রেহাংশী। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল—
“উঁহু।”
“যাবে না?”
“উঁহু।”
ইনজাদ অন্য হাতও কাজে লাগালো। দুই হাতে বন্দি করে নিল প্রেমময়ীকে। তার প্রশস্ত, দৃঢ় বক্ষ পাটাতনে মিশে রইল ক্লান্ত, শ্রান্ত রেহাংশী। মাথাটা রাখল ইনজাদের স্বরনালির কাছে। বুকের একপাশ অনুভব করছে স্বামীর উষ্ণতা পূর্ণ হৃদয়ের কম্পন। গলা থেকে হাত নামাল রেহাংশী। আড়ষ্ট হয়ে রইল নিরুপদ্রপ শেষ আশ্রয়ের বুকে। ইনজাদ অপ্রতিরোধ্য গলায় বলল—
“বাঙালি মেয়েরা সব এক। আর যাই হোক, এরা শাশুড়ির আশেপাশে ঘেঁষতে চায় না।”
নিরুত্তর রেহাংশী বিমর্ষতার অবসান হলো না। ইনজাদ নরম স্বরে বলল—
“আম্মা যে কেন আমাকে বাদাম ওয়ালা দুধ খাওয়ালো না! এতবার নাম শুনেও আমি একবারো খেয়াল করতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম নাম তো অনেকেরই এক হয়। মানুষও যে এক তা বুঝতে পারিনি।”
“অমানুষ!”
ইনজাদ চমকে ওঠল। নমনীয় কণ্ঠে বলল—
“এভাবে বলতে নেই রেহাংশী।”
এক হাত উঠিয়ে রেহাংশীর মাথাটা আরেকটু চেপে নিল নিজের সাথে ইনজাদ। স্বরভার করে বলল—
“বি স্ট্রং রেহাংশী। জীবন অনির্ণীত। অমোঘ মৃত্যু ছাড়া সব পরিবর্তন হতে পারে। জীবন সংবিধান ওপরওয়ালার লিখিত। আমরা যা অবশম্ভাবী ভাবি তা সবসময় নাও ঘটতে পারে। আবার এমন কিছুও ঘটতে পারে যা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি। জীবন বাস্তব চোখ দিয়ে দেখতে হবে। ওপরওয়ালা তাই করেন যা তাঁর বান্দাদের জন্য সঠিক। তিনি সর্বদ্রষ্টা! আমাদের তার ওপর ভরসা রাখতে হবে। তোমার মনে আছে বিয়ের দিন সকালে কী হয়েছিল? আমি তোমার সাথে কথা বলতে তোমাদের বাড়ির পেছনে গিয়েছিলাম। কতবার তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, শুধু একটিবার বলো যে তোমার মনে আমার জন্য একটু হলেও জায়গা আছে। কিন্তু তুমি! সেদিনও চোখের জলে ফিরিয়ে দিয়েছিলে আমায়। কিন্তু আজ তুমি আমার অর্ধাঙ্গীনি। কারণ, ওপরওয়ালা চেয়েছেন তাই। আমার হৃদয়ের ডাক তো তিঁনি শুনেছেন। তোমারও শুনবে। নিজেকে শক্ত করো বিষবাণ। আমার বিষবাণ হেরে যাবে না। অন্য কেউ তোমার জন্য লড়ার আগে, তোমার নিজেকে নিজের জন্য লড়তে হবে। আমি সবসময় তোমার ছায়া হয়ে থাকব।”
রেহাংশীর ঝিম ধরা মস্তিষ্কে জ্ঞাত হলো না ইনজাদের বাণী। সে নির্বিকার চেয়ে রইল। অনুভব করতে লাগল নিজের ক্ষীণ হৃৎকম্পনের বিপরীতে স্বামীর সচল হৃৎস্পন্দন।
ইনজাদ শ্বাস ফেলল। সন্ধানী গলায় বলল—
“আমার মনে হয় তোমার মা মারা যাওয়ার আগেই সৌরভের জন্ম। স্যার ভুল করে ফেলেছেন হয়তো না বুঝে। ঘোরের বশে বুঝতেই পারেননি কী করছেন তিনি। তার মোহ, তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো মোহঘোর।”
রেহাংশীর বিবশ দেহে জঙ্গমতা এলো। ইনজাদের বুক থেকে দেহ সরিয়ে স্থির চোখে তাকাল তার দিকে। ইনজাদ চোখে হাসল। প্রেয়সীর চোখ ভরা জলে ডুবে যেতে ইচ্ছে হলো তার। গভীর প্রণয়ে আস্থার সেতুবন্ধন তৈরি করল। রেহাংশীর ভীত মনে প্রাণের সঞ্চারণ হলো। গহীন অন্তঃকরণ হতে প্রশ্ন ছুড়ল—
” আমি কখনো আপনার মোহঘোর হয়ে যাবে না তো?”
রেহাংশীর ওষ্ঠাধরের সুধা শুষে নিল ইনজাদ। প্রগাঢ় মোহবিষ্ট গলায় বলল—
“তার আগে যেন এই দেহ থেকে প্রাণটা চলে যায়।”
রেহাংশী তূরন্ত বেগে ঝাপটে পড়ে ইনজাদের বক্ষস্থলে। দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে ইনজাদের গলা জড়িয়ে ধরে। এতটা দৃঢ় যেন পাঁজর ভেঙে স্বামীর অন্তঃপুরে লুকিয়ে যাবে!
দরজায় কড়া পড়তেও রেহাংশীর ধ্যান ছুটল না। ইনজাদ পিঠের ওপর আলতো হাত ঘষে বলল—
“কেউ এসেছে রেহাংশী।”
রেহাংশী গলা ছাড়ল না। জেদি, একরোখা বাচ্চাদের মতো জড়িয়ে ধরে রাখল ইনজাদকে। ইনজাদ তাড়া দিলো। করাঘাতের শব্দ জোরালো হচ্ছে। রেহাংশী নিশ্চিত হলো। ইনজাদকে ছেড়ে গদিতে বসল। ইনজাদ নরম পায়ে কক্ষের বাইরে আসে। মেহমাদ দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন। ভ্রূ তুলে ইশারায় প্রশ্ন ছুড়ে, রেহাংশী কেমন আছে? মাথা নাড়িয়ে তার অবস্থার স্বাভাবিকতা জানান দেয় ইনজাদ। মেহমাদ স্বাভাবিক গলায় বলল—
“তাহলে ওকে নিয়ে যা। রেস্টের প্রয়োজন ওর।”
ইনজাদ মনমরা গলায় বলল—
“সরি ইয়ার! ঝামেলা হয়ে গেল আমার জন্য।”
“সরি বলছিস কেন? আমি তো মনে করি যা হয়েছে একদম ঠিক হয়েছে। আঙ্কল যা করেছে তার পরিণতিটা তার জানার দরকাল ছিল। বাদ দে সেসব। যা এখন। খেয়াল রাখিস ওর।”
“হুম। স্যার কোথায় এখন?”
“আছেন। বসে আছেন হলরুমে।”
“হুম। ওকে, যাচ্ছি আমি।”
ইনজাদ ভেতরে ঢুকে। উৎসুক চোখে দাঁড়িয়ে আছে রেহাংশী। ইনজাদ অধর কোণে হাসল। রেহাংশীর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল—
“চলো।”
রেহাংশী দ্বিরূক্তি করল না। হলরুমের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন জিবরান খন্দকার। তার পুরো পরিবার চেয়ে আছে রেহাংশীর দিকে। কিন্তু রেহাংশীর সম্পূর্ণ মনোযোগ তার স্বামীর চপল পায়ে। সে তাই অনুসরণ করল। আপাতত প্রফেশনাল সম্পর্কও ইনজাদের দৃষ্টির অগোচরে।
,
,
,
নিকষকৃষ্ণ নভোলোকে ঝুলে থাকা রুপালি থালার অবিরত কিরণে মাখো মাখো রাতের আঁধার। অদূরে ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকা দালানগুলো থেকে ছিটকে আসা ক্ষীণ আলো আবছা আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। শীতল মলয়ে হিম হয়ে হয়ে আছে দেহ। সেই শীলতার ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছে ইনজাদ।
সময় এখন মধ্য রাতের ওসপার। ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ, ভুতুড়ে নগরী কঠিন শান্ত। ইনজাদ হাতের ফিল্টার টুকু বারান্দার গ্রিলের সাথে চেপে নিভিয়ে নিল। ছুড়ে ফেলল বাইরে।
থাই টেনে ভেতরে এসে আবার তা টেনে দিল। আলো জ্বলছে ঘরে। তন্দ্রায় বিভোর রেহাংশী। গায়ে পাতলা চাদর টানা। ইনজাদ বিড়ালপায়ে হেঁটে সুইচবোর্ডের কাছে গেল। রেহাংশীর ঘুমন্ত, নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে গাঢ় শ্বাস ফেলল। লাইট অফ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তমসার চাঁদোয়ায় ঢেকে গেল শয়ন কক্ষ। থাই ভেদ করে আসছে চন্দ্রকিরণ! ইনজাদ পর্দা টেনে দিলো। ঘন আঁধারে নিমজ্জিত হলো পুরো কক্ষ। ধীর পায়ে বিছানার কাছে এসে বসল সে। আঁধারে চেয়ে রইল রেহাংশীর দিকে। কিছু বুঝা না গেলেও অনেক কিছু বুঝে নিল ইনজাদ। বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। দুই চোখের পাতা এক হলো না তার। ভয়, শঙ্কিত মনের দৃঢ় বিশ্বাস রেহাংশী জেগে উঠবে। হলোও তাই। ঘণ্টা খানিকের ব্যবধানে আচমকা চোখ ছুটে গেল রেহাংশীর। নিভুনিভু চোখে আঁধার কালো দেখে শিউরে উঠল সে। দ্রত উঠে বসে ঘায়েল হওয়া পাখির মতো ছটফটাতে লাগল। চিৎকার করে বলতে লাগল—
“লাইট বন্ধ করেছেন কেন? লাইট জ্বালান! দয়া করে লাইট জ্বালা!। ”
ইনজাদ বিদ্যুৎ বেগে উঠে বসে। অস্পষ্ট সবকিছু। আঁধার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে রেহাংশীকে খুঁজে নিল। জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। সান্ত্বনার সুরে বলল—
“বি কোয়াইট রেহাংশী। শান্তু হও।”
“দোহাই লাগে আপনার। লাইট কেন বন্ধ করেছেন? লাইট জ্বালান, লাইট জ্বালান।”
“আগে তুমি চুপ করো। শান্ত হও।”
“না, আপনি লাইট কেন বন্ধ করেছেন। জ্বালান, জলদি জ্বালান।”
রেহাংশী হাত-পা ছুড়তে থাকে। অন্ধকারে কোথায় কী হচ্ছে টের পাওয়া যাচ্ছে না। বদ্ধ বাতাসে রেহাংশীর ক্রন্দনেরা শুধু প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ইনজাদের চোখে নখ লেগে যায় রেহাংশীর, গলায় আঁচড় লাগে। ইনজাদ রুষ্ট হয়। জোর করে ধমকে উঠে সে। নিভে যায় রেহাংশী। সমাহিত হয় স্বামীর বুকে। তার অন্তঃকরণের ক্লেশ কমেনি। তরতর করে ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত দেহে। ইনজাদ মোলায়েম গলায় বলল—
“কেন পাগলামি করছ? এমন করো না রেহাংশী।”
“আপনি বলতে পারেন, কী দোষ করেছি আমি? কেন আমার সাথে এমন হলো?”
“কারো জীবনে কারো হাত নেই। সব আল্লাহর বিধান। তিঁনিই মালিক।”
রেহাংশী ডুকরে ওঠল। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। থরথর করা গলায় বলল—
“মা আমাকে কেন ছেড়ে গেল বলেন তো? একটুও মায়া হলো না আমার জন্য? তার স্বামীই তার কাছে সব? আমি কেউ না? এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আমাকে একা ফেলে চলে গেল!”
” মায়েরা নিষ্ঠুর হয় না রেহাংশী। পৃথিবীতে একমাত্র মা আছেন, যিনি বিনা স্বার্থে সন্তানকে ভালোবাসেন। যা হয়েছে ভাগ্যের লিখন। তাতে আমরা মানুষরা কিছুই করার ক্ষমতা রাখি না।”
রেহাংশী শ্বাস ফেলল। বুক কাঁপিয়ে কেঁদে বলল—
“এত ভালোবাসা কী করে ভুলে গেল? আমাকে একা করে চলে গেল! জিবরান খন্দকার তাকে ছেড়ে যাবে বলে সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? ভাবলো না আমার কী হবে? আমি কার কাছে থাকব?”
“আমার কাছে, আমার কাছে থাকবে তুমি। আল্লাহ যা কেড়ে নেন তার চেয়ে দ্বিগুন ফেরত দেন। আমার আম্মা কী তোমার মা নয়, আমার বাবা কী তোমার বাবা নয়? আমি তোমার কেউ নই?”
ইনজাদের বুক থেকে মাথা তুলে রেহাংশী। গাঢ় অন্ধকারেও এক অদ্ভুত, ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে ইনজাদের ভরসায় আবিষ্ট দুই চোখ দেখতে পারছে রেহাংশী। বদ্ধ কক্ষের, বদ্ধ বায়ুতে ভরসা, বিশ্বাসের তীব্র ঘ্রাণের ঘূর্ণন চলছে। অবিশ্বাস্য প্রশ্ন করল রেহাংশী।
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
অন্ধকার নীরবতায় ঝংকার তুলল ইনজাদের পুরুষালী কণ্ঠস্বর।
“বিশ্বাস হয় না আমাকে?”
“হয় না, একটুও হয় না। আপনারা সবাই এক। শরীরের মায়া সব। এই চামড়া ঝুলে পড়তেই সব ভালোবাসা শেষ। নোনতা স্বাদে মন ভরে গেলে আর ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হবে না। ভালোবাসা নিঃশেষ হয়ে যায়। অন্ধকারে বিলীন হয়ে যায়।”
ইনজাদ থেমে গেলো। তিক্ত সত্য হজম করতে সময়ের প্রয়োজন। মৌনতা ভেঙে বলল—
“যেখানে জিবরান খন্দকার আছে, সেখানে জুলহাস খন্দকারও আছে। যেখানে রতন আছে, সেখানে নুহাশও তো আছে। আমার ভালোবাসায় আমি কমতি রাখিনি রেহাংশী। যদি সত্যিই শরীরের মোহ আমাকে টানত তাহলে সেদিন পাগলের মতো ছুটে যেতাম না তোমার কাছে। মিনতি করতাম না তোমার স্বীকারোক্তির জন্য। আমি কথা দিচ্ছি, আমার জীবনের শেষ যৌবন পর্যন্ত আমি তোমার হয়ে থাকব। শরতের আকাশ হও যদি, তার মেঘ হয়ে থাকব আমি। তোমার আশ্লেষে পূর্ণতা আমার, তোমার বিরহে শূন্যতা। আমার হৃৎকুঠিরের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী তুমি, ব্যবচ্ছেদ করা হৃৎপিন্ডের বিষবাণ আমার। তোমার মাঝেই আমি, আমার সর্বত্র তোমার অধিকার। তোমার বিষেই যেন প্রাণহরণ হয় আমার।”
চলবে,,,