#মোহঘোর
#পর্বঃ৪২,৪৩
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
৪২
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আকাশ তলে তমসা ছাপিয়ে চলছে বৃষ্টির নৃত্য। ঘন আঁধারের বুকের মাঝে নুপূর ছাড়াই চলছে জলদ কন্যার মনমাতানো নাচের উল্লাস। নিস্তব্ধ, নীরব, নিশুতি রাতের অকাট্য আঁধারকে রূপকথার রাতের মতো মায়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে ওই চাঁদের উজ্জ্বল কিরণ। আকাশের বক্ষপুট বিদীর্ণ করে উঁকি মেরে ধরণীকে আশ্বস্ত করছে সে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে ইনজাদ। তার বিশাল বক্ষ জুড়ে এক দলা নরম মাংস গুঁজে আছে। রেহাংশীর ক্ষীনকায় দেহ পুরোদস্তুর গেঁথে আছে ইনজাদের বুকের মধ্যে। গায়ে তার পাতলা চাদর টানা। এক চাদরেই আবৃত দুই নর-নারী।
হিমশীতল সমীরণের মৃদু কম্পনে শিরশিরে অনুভূতি। আকণ্ঠ জলে ডোবা হতপ্রায় মানুষের মতো ইনজাদের বুকের মধ্যে আরো সেদিয়ে গেল রেহাংশী। স্বামীর উষ্ণতায় সকল শীতলতাকে হারিয়ে দিলো সে। ইনজাদ দুই বাহুর বন্ধনে আঁকড়ে রাখল রেহাংশীকে। মোড়ানো চাদরে দুই দেহের এক কম্পন। ইনজাদের ডান পাঁজরে নিজেকে সমাহিত করে বা’ পাজরে হাত দিয়ে রেখেছে রেহাংশী।
প্রভঞ্জনের দমকা দোল বাড়তেই শিউরে উঠে রেহাংশী। তার শীতালু দেহপিঞ্জর খুঁজতে থাকে উষ্ণতার গহ্বর। সানন্দে বরফ টুকরোটিকে নিজের বক্ষপিঞ্জিরায় জায়গা করে দেয় ইনজাদ। প্রেয়সীর সকল শীতলতা বিগলিত করে তার পুরুষালী উষ্ণতায়।
ইনজাদ সুদূর আকাশে তাকায়। গোলাকার চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বলল—
“তুমি কী করে বুঝলে, ওই নুপূর স্যার এনেছেন?”
রেহাংশী ইনজাদের বুকে রাখা হাতে তার গেঞ্জি মুঠো বন্দি করে বলল—-
” ওটার ডিজাইন পায়েল আপুর নুপূরের মতো।”
ইনজাদ চোখ সরালো অপার বিমুগ্ধ করা চন্দ্রিমা থেকে। মাথাটা একটু নিচু করে রেহাংশীর দিকে চাইল। মিষ্টি কণ্ঠে সন্দিহান মনে বলল—-
“ঠিক বুঝলাম না।”
রেহাংশী কান পাতল ইনজাদের বক্ষস্থলে। মুক্ত গলায় বলল—
“আমি একবার পায়েল আপুর নুপূর চুরি করেছিলাম। তাই পায়েল আপু আমাকে ধাক্কা মেরেছিল। আমার পিঠে ওই দাগ সেইটার ই। বাঁশের কঞ্চি ঢুকে গেছিল। বড়ো আব্বু এইজন্য পায়েল আপুকে খুব মেরেছিল। মা তাই….।”
রেহাংশী আর বলল না। ইনজাদ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল—
“তাই মিসেস জয়া তার একমাত্র বর মি. জিবরান খন্দকারকে মেয়ের জন্য সেই একই ডিজাইনের নুপূর নিয়ে আসতে বলেছিল। কিন্তু তিনি তা বেমালুম ভুলে গেলেন। আজ এত বছর পর মেয়েকে দেখে তার সেই কথা মনে পড়ল। তাই তো?”
“জানি না।”
“আর কী কী চুরি করেছ তুমি?”
“অনেক কিছু। পায়েল আপুর নুপূর, নুপূর আপুর টিপের পাতা, দাদীর সুপারি, বড়ো আম্মুর মুরগির ছানা, বড়ো আম্মুর দিয়াশলাই, আপনার আংটি।”
“বাহ! চুরিতে তো অস্কার পাওয়ার কাজ করেছ তুমি। চুন্নিরানী!”
রেহাংশী মাথা তুলল। ইনজাদের চোখের দিকে তাকিয়ে নরম শ্বাসে বলল—
“চুন্নি কী?”
“চোরের ফিমেল ভার্সন।”
“ধুর!”
নিঃশব্দে হেসে উঠে ইনজাদ। সতেজ গলায় বলল—
“এখন থেকে যা লাগে আমাকে বলবে। যা খেতে ইচ্ছে হয় আমাকে বলবে, যা ভালো লাগবে আমার কাছে চাইবে। যতদিন সাধ্য আছে কখনো না করব না তোমাকে। প্রমিজ ইউ।”
রেহাংশী একটু উঁচু হয়ে ইনজাদের চিবুকে চুমু খেল। আবেগপূর্ণ গলায় বলল—
“আমার এখন আর কিছু চাই না। শুধু আপনি আমার পাশে থাকবেন। আর কিছু চাই না আমার।”
ইনজাদ ছোট্ট করে হাসল। চোখের চাহনিতে অদম্য প্রেমের জয়কার। রেহাংশী গুটানো পা হালকা বিছিয়ে দেয়। তাতেই নিজের পা বাঁকিয়ে এনে ঘষতে থাকে ইনজাদ। রেহাংশী কিঞ্চিৎ অভিমানভরা কণ্ঠে বলল—
“এমন করছেন কেন?”
“পা ঠান্ডা হয়ে আছে আমার তাই।”
“সরান।”
” উহু।”
“সরান বলছি, ঠান্ডা লাগছে আমার।”
রেহাংশীর নাকে নাক ঘষে ইনজাদ। আদুরে আপত্তি করে বলল—
“না।”
দাঁতে দাঁত চাপে রেহাংশী। দাঁতের শিরশিরানি কমে তার আপন ভঙ্গিতে। ইনজাদ শব্দ করে হেসে ফেলে। হেসে হেসে শ্বাস টেনে ধরে বলল—
” এই নিয়ে ওয়ান টু মানে টুয়েলভ। হিসেব করে রেখো বিষবাণ। যত বিষ তুমি ঢালবে তার তিনগুন ফেরত দেবো আমি।”
রেহাংশী চোখ মিটমিট করে। দুই হাতে ইনজাদকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখে।
বৃষ্টির ফোটা স্ফীতকারে ঝরতে থাকে। বারান্দার গ্রিল ছলকে ইনজাদের পায়ে এসে পড়ছে। হিম হয় এসেছে তার পা। রেহাংশী একটা উষ্ণ বলয়। বিড়ালছানার মতো গুটি হয়ে আছে।
“ভেতরে চলো বিষবাণ। ঠান্ডা বাড়ছে।”
“উঁহু।”
রেহাংশীর চোখে ঘুমের মহড়া। ইনজাদ ফের বলল—
“চলো, বৃষ্টি বাড়ছে। শীত বাড়বে এবার।”
“উহু।”
ইনজাদ পরাস্ত হয়। আকাশের দিকে তার উদাস চাহনি। বৃষ্টির দরুন বাঁকা চাঁদ মনে হচ্ছে তাকে। ইনজাদ আলতো গলায় বলল—-
” ওইদিকে দেখো রেহাংশী!”
রেহাংলী আলগোছে মাথা তোলে। তাকায় বৃষ্টি ঝরা আকাশে।
ইনজাদ ফিসফিসিয়ে বলল—
“ভেজা চাঁদ। দেখেছ কখনো?”
রেহাংশী প্রস্ফুটিত চোখে চেয়ে রইল। বিশাল আঁধার আকাশে এক আলোর বাতি। আপন মহিমায় যে জাগ্রত।
ইনজাদের মৃদু কণ্ঠ——
” তোমার মাঝেই নামব আমি, তোমার ভেতর ডুব
তোমার মাঝেই কাটব সাঁতার, হাসব আমি খুব ।।
তোমার.. মাঝেই জীবনযাপন, স্বপ্ন দেখা স্বপ্ন ভাঙা…”
,
,
,
গত এক সপ্তাহ ধরে ইনজাদ ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তার ধ্যান -জ্ঞান সবকিছুই এখন রেহাংশী। একজন সার্টিফিকেটবিহীন ডাক্তারের প্রথম অঘোষিত রোগী তার নিজের প্রাণ প্রেয়সী। অবশ্য ডাক্তার এখন সুপ্রসন্ন। তার প্রেমময় ঐন্দ্রজালিক ঔষধে কাজ হয়েছে। সেরে উঠছে রেহাংশী। সকল ভয়, আশঙ্কা, ভীতিকে কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলেছে সে। জিবরান খন্দকার রোজ বারকয়েক ফোন করে। ইনজাদের সাথে টুকিটাকি কথা হয়। রেহাংশীকে দেখার আকুল আবেদন তার। ইনজাদ দেয়নি সেই সুযোগ। একটা স্থির চিত্র বা ভিডিয়ো কলেও নয়। তবে জিবরান খন্দকার অসন্তুষ্ট নন। তিনি মনে মনে তুষ্ট। তার মেয়ে উপযুক্ত জীবন সঙ্গী পেয়েছে। তাই তিনি বেহায়া হয়ে রোজ একবার করে আকুতি করেন ইনজাদের কাছে। কিন্তু ইনজাদ নিজের সিদ্ধান্তে অটল।
রান্নাঘরে টুংটাং শব্দ! চুলোর আঁচ কমিয়ে কিছু একটা গভীর মনোযোগে দেখছে রেহাংশী।
ইনজাদ নিজ কক্ষেই পায়চারী করছে। হাতের মধ্যে একটা পেপার। আজকাল সংবাদপত্র, ইন্টারনেট ঘেঁটে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সার্কুলারগুলো দেখে ইনজাদ। বিছানার পাশ টেবিলে রাখা মোবাইলটা আচানক বেজে ওঠল। ইনজাদের সচল পা স্থির হলো। বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কের ভাবনাগুলো স্থবির হলো অচিরেই। কল রিসিভ করে ইনজাদ। মানান ফোন করেছে। জরুরি কাজে ইনজাদকে রেস্তোরাঁয় যেতে হবে। সে আশ্বস্ত করল মানানকে যে, সে যাবে।
হাতে কিছু একটা নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে রেহাংশী। তার হাস্যোজ্জ্বল, চির সবুজ মুখটা অনুপলেই তমসায় ছেয়ে গেল। ইনজাদ শার্টের কলার নামাতে নামাতে বলল—
“মানান ভাই ফোন করেছে। একটু যেতে হবে আমাকে। কাজ শেষ করেই চলে আসবো।”
শুভ্র মেঘের আকাশে কৃষ্ণ পয়োদের সমারোহ হলো। কাঁপন শুরু হলো দেহপিঞ্জরে। রেহাংশীর ভেতর কান্না ওষ্ঠাগত হতেই দৃঢ় স্বরে বলল—
“আপনি যাবেন না।”
ইনজাদ তাকাল। আলতো হেসে স্বাভাবিক গলায় বলল—
“বললাম তো চলে আসবো। এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবো।”
রেহাংশী চোখের জল ছাড়ল। একরোখা স্বরে বলল —
“যাবেন না আপনি।”
“চলে আসবো রেহাংশী, প্লিজ।”
রেহাংশী হার মানলো না। হাতে থাকা পুডিং এর বাটি ঝনাৎ শব্দে মেঝেতে বিক্ষিপ্ত হলো। চমকে উঠল ইনজাদ। অশিথিল চোখে তাকিয়ে ধমকে উঠে বলল—
“রেহাংশী! এসব কী ধরনের ব্যবহার? বলেছি তো কাজ আছে। শেষ করেই চলে আসবো।”
“যাবেন না আপনি।”
ইনজাদের মোবাইল বেজে উঠল সশব্দে। রেহাংশী দ্রুত পায়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে তা খাবলে নিল। সিন্ধুজার নামটা দেখতেই তড়াক করে উঠল তার মস্তিষ্ক। সজোরে ছুড়ে মারল তা মেঝেতে। ইনজাদ আঁতকে উঠা গলায় বলল—
“এটা কী করলে তুমি?”
“বেশ করেছি। এত কীসের কথা ওর সাথে আপনার? কেন কথা বলেন ওর সাথে আপনি?”
“আমি ওর সাথে কথা বলি?”
“আপনার কী মনে হয় আমি কিছু বুজি না? এই জন্য আপনি এখান থেকে যেতে চান না। সারারাত ওর সাথে কথা বলেন তাই না?
“হোয়াট রাবিশ! কী বললে তুমি? এসব ভাবলে কী করে ?”
“আপনারা কথা বলতে পারবেন আর আমি বলতে পারব না?”
ইনজাদ ফুঁসে যাচ্ছে। মেজাজ তিরিক্ষি তার। কী বলছে এই মেয়ে? এত সন্দেহ? এই তার ভালোবাসার প্রতিদান! অন্যায় করেছে সে। জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল। যার প্রাপ্যতা যতটুকু তাকে ততটুকুই দেওয়া উচিত। না হলে তার দাম থাকে না।
ইনজাদ কথা বলল না। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে থাকল। থরথরিয়ে যাচ্ছে রেহাংশী। নিচ্ছিদ্র রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। টেবিল থেকে তুলে নিল সিরামিকের ফ্লাওয়ার ভাস। তার মাথার অংশটুকু হাতে রেখে বিছানার হেডবোর্ডে জোরে বারি মারল। কর্কশ শব্দ ঝড় তুলল ইনজাদের কর্ণরন্ধ্রে। চকিতে ফিরে তাকাল। ভাঙা ফ্লাওয়ার ভাসের এবড়ো-থেবড়ো জায়গাটুকুর আঁচড় বসাল হাতে রেহাংশী। ইনজাদ তূরন্ত বেগে ছুটে এলো। কাটা অংশটুকু থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ইনজাদ চেপে ধরল সেই ক্ষত জায়গা।
“পাগল হয়েছে তুমি? আমাকে মেরে ফেলতে চাইছ?”
রেহাংশী অন্য হাতে ইনজাদকে আঁকড়ে ধরে ব্যাথাতুর গলায় বলল—
“কোথাও যাবেন না আপনি। ওদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না। আমি ওদের মুখও দেখতে চাই না। আমাকে আম্মা আর বাবার কাছে নিয়ে চলুন। আমরা ওখানেই থাকব।”
ইনজাদ বিধুর গলায় বলল—
“একদিন তোমার এই অভিমান আমার প্রাণ নিয়ে ছাড়বে বিষবাণ। জীবন্ত লাশ বানিয়ে দেবে তুমি আমায়।”
চলবে,,,
#মোহঘোর
#পর্বঃ৪৩
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে ইনজাদ। তার মন, মস্তিষ্ক অশান্ত, উদ্বেলিত, বিচলিত। মেহমাদ গাঢ় নজরে তাকিয়ে আছে। ইনজাদের গম্ভীর আননে চিন্তার রেখা প্রস্ফুটিত হচ্ছে ধীরে ধীরে।
মেহমাদ কণ্ঠ সচল করে বলল—
“তুই এত ভাবছিস কেন?”
ইনজাদ শ্বাস ফেলল। অসহায় স্বরে বলল–
“তুই বল আমি কী করব? এই মেয়ে আমার কোনো কথাই শুনছে না। ভাবতে পারছিস! কী করেছে ও? কী ভাবে ও আমার সম্পর্কে?”
মেহমাদ তরল শ্বাস ফেলল। দুই হাতের অঞ্জলি দিয়ে পুরো মুখ ঘুরিয়ে চিবুকে এনে বলল—
“ও আসলে অনেক টেনশনে আছে। ও তোকে সন্দেহ করে না। ও তোকে হারানোর ভয় করে। সিন্ধুজা ওর সমস্যা নয় সমস্যা সিন্ধুজা ওর বাবার সাথে রিলেটেড। ওর মস্তিষ্ক এটা মানতে চাইছে না যে পৃথিবীর সব পুরুষ এক নয়। মানতে পারছে না সব পুরুষ বদলায় না।”
“এখন তুই বল আমি করব? কী করে বিশ্বাস করাব আমি ওকে, যে আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি।”
মেহমাদ বিজ্ঞের মতো বলল—
“তুই ওকে ভালোবাসিস তা ও ভালো করেই জানে। আর জানে বলেই তোকে হারানোর ভয় ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তোর তো খুশি হওয়া উচিত। ভাগ্যবান তুই! কোনো এক নারী তোকে তার সর্বস্ব মেনেছে।”
“তোর ফিলোসফি তোর কাছে রাখ। আমার ভয় হয়। ওকে রেখে কোথাও যেতে পারি না আমি। ওই মেয়ে ভয়ংকর। ওর রাগের পরিধি তোর জানা নেই। নিজের ক্ষতি করতে রেহাংশী একবারো ভাববে না। ভাববে না ওর কিছু হলে আমার কী হবে? ছোট্ট একটা কারণে কী করেছে বুঝতে পারছিস তুই?”
মেহমাদ নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে রইল। গাঢ় কণ্ঠে বলল—
“সময় দে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ কর।”
ইনজাদ কৌতূহলী চোখে তাকাল। মেহমাদ তার ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে ইনজাদকে দিলো। ইনজাদ কপাল কুঁচকে বলল—
“সাইক্রিয়াটিস্ট?”
“হুম। ওর মানসিক চাপ কমাতে কাউন্সিলিং এর প্রয়োজন। তোর মনে আছে, ইফতারের কথা? যুথির সাথে ব্রেকআপের পর ও দুইবার সুইসাইড করতে গেছিল! সেই ছেলে এখন একটা আইটি ফার্মের মালিক। রেহাংশীও ঠিক হয়ে যাবে। ভরসা রাখ। কার্ডটা রাখ। তুই জানাস কবে যাবি। আমি জানিয়ে রাখব তাকে। তিয়ার পরিচিত।”
ইনজাদ নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। মেহমাদ উঠে দাঁড়ায়। মোলায়েম স্বরে বলল—
“আমি এখন যাই। কিছু লাগলে জানাস আমাকে।”
“আচ্ছা। একটা কাজ করতে পারবি?”
“বল।”
“মোবাইলটা ভেঙে ফেলেছে আমার। তোকে টাকা দিচ্ছি একটা সেট নিয়ে আয়। এখন বাইরে যেতে পারছি না।”
মেহমাদ অল্প বিস্তর হেসে নিজের মোবাইল ফোন থেকে সিম বের করে ইনজাদকে দিয়ে দেয়। ইনজাদ আপত্তি করে বলল—
“আরে কী করছিস?”
“নে, বাসায় আরো একটা আছে। তুইও তো একবার নিজের নতুন মোবাইল আমাকে দিয়েছিলি তিয়াকে গিফ্ট করার জন্য। ফেরত নিসনি তো আর। আমি তো পুরান দিলাম। রেখে দে। আসি আমি। আমার বোনের খেয়াল রাখবি। নাহলে তোর মাজার হাড্ডি ভাঙব।”
ইনজাদ গালভর্তি হেসে বলল—
“তিয়াকে নিয়ে বাসায় আসিস।”
“হুম।”
,
,
,
নিদ্রাচ্ছন্ন রেহাংশী। গায়ে চাদর টানা। তার হাত বেরিয়ে আছে বিছানা থেকে দূরে। চুল ছড়িয়ে আছে বিছানায়। ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা রেহাংশীর মোবাইল ফোন থেকে নিজের সিম খুলে নিল সে। মেহমাদের দেওয়া মোবাইল ফোনে সিম ইনসার্ট করে পকেটে নিয়ে নিল।
ধীর পায়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। নৈঃশব্দে বসল মেঝেতে। রেহাংশীর বাড়িয়ে থাকা হাতটা চাদরের আদলে ঢেকে দিলো। তার অবিন্যস্ত চুলে হাত গলালো। কপালে, গালে বিছিয়ে থাকা চুল আঙুলের সাহায্যে কানের পেছনে গুঁজে দিল। ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো গাঢ় মায়ায়। মৃদু স্বরে ডাকল—
“রেহাংশী! উঠো, সন্ধ্যা হয়েছে।”
কিঞ্চিৎ শব্দের ঝংকার আলোড়ন তুলল রেহাংশীর কর্ণগহ্বরে। গায়ের চাদরে নিজেকে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে চোখের পাতা শক্ত করে নিল। ইনজাদ হালকা হেসে ফের ডাকল—-
“রেহাংশী! ওঠো, মামা -মামি আসবে। তাড়াতাড়ি ওঠো।”
রেহাংশী চট করে চোখ খুলল। ধড়াম করে উঠে বসল। প্রসারিত চোখে বলল—
“কী বলছেন? মামা-মামি আসবে? কখন? কবে?”
ইনজাদ বিছানায় হাতের ভর দিয়ে উঠে রেহাংশীর পাশে বসল। স্মিত কণ্ঠে বলল—
“তারা রওনা দিয়েছে।”
“আপনি আমাকে আগে বলেননি কেন? এখন কী হবে বলুন তো? আমি কিচ্ছু রান্না করিনি।”
“রান্না নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। মামি করে নেবে।”
রেহাংশী মৃদু রাগ দেখিয়ে বলল—-
“পাগল হয়েছেন আপনি? বেড়াতে এসে কেউ রান্না করে?”
এলোমেলো চুল গুলো হাত খোঁপা করে নেয় রেহাংশী। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে আসে। ইনজাদ সতেজ গলায় বলল—
“এত ব্যস্ত হতে হবে না। আস্তে ধীরে করো।”
“মামা-মামি প্রথমবার আসবে। কী ভাববে বলুন তো?”
“কী ভাববে?”
“ভাববে, ছেলের বউ কোনো কাজের না।”
ইনজাদ চোখে হাসল।
“দুপুরে ঔষধ খেয়েছিলে?”
“হুম।”
“আচ্ছা যাও। কী রান্না করবে করো। আমি একটু নিচে গেলাম।”
রেহাংশী কপালে ভাঁজ তুলল। চোয়াল শক্ত করে উদ্বিগ্ন গলায় বলল—
“কোথায় যাবেন?”
ইনজাদ লম্বা শ্বাস ফেলল। চোখে সতেজতা নিয়ে বলল—-
“মাথা ধরেছে আমার।”
রেহাংশী বুঝতে পারল ইনজাদের সিগারেটের নেশা উঠেছে। সকালেই সিগারেটের খালি প্যাকেট ময়লার ঝুড়িতে ফেলেছে সে। নিরুদ্বেগ গলায় বলল—
“যান, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। অনেক রান্না বাকি।”
ইনজাদ আলতো হেসে বলল–
“আচ্ছা।”
,
,
,
সন্ধ্যার গাঢ় তিমির। আকাশে এক ফালি চাঁদ। হিমশীতল প্রকৃতি। অগ্নিসখে যেন বরফ ভেসে বেড়াচ্ছে! ইনজাদ টিশার্টের ওপর ফুলস্লিভের ভারী গেঞ্জি পরেছে। চায়ের দোকান থেকে ছিটকে আসছে আলো। ইনজাদ এক কোণে দাঁড়িয়ে একটা ইটের ওপর তার বাম পা তুলে রেখেছে। বাম হাতে সিগারেট ডানহাতে মোবাইল ফোন কানে চেপে রেখেছে।
” সরি মানান ভাই। যেতে পারিনি আমি। আমি স্যারকে জানিয়ে দিয়েছি। আমার পক্ষে আর এই চাকরিটা করা সম্ভব না। স্যারকে আমি আপনার নাম রিকোমেন্ড করেছি। আর ওই কোম্পানির লিস্টটা আপনার ইমেইলে পাঠিয়েছি। কোম্পানিটা ভালোই। তবে আপনি আরেকবার ক্রস চেক করে নেবেন। পারলে একটু সরাসরি তাদের সাথে কথা বলবেন। স্যারের সাথে বা সিন্ধুজার সাথেও একবার কথা বলে নেবেন।”
মানান নরম কণ্ঠে বলল—
“বুঝলাম, কিন্তু শ্বশুরকে বারবার স্যার কেন বলছ?”
ইনজাদ সিগারেটে টান দিলো। বাকিটুকু নিচে ফেলে ইটের ওপর থেকে পা সরিয়ে পিষে দিলো। নির্মল গলায় বলল—
“তার সাথে আমার কোনো পার্সোনাল সম্পর্ক নেই। যা আছে প্রফেশনাল।”
“তাহলে পার্সোনাল সম্পর্কের জন্য প্রফেশন কেন ছাড়ছ?”
“রেহাংশীর জন্য। আমি ছাড়া ওর ভরসা করার মতো কেউ নেই মানান ভাই। সেই আমিটাও যদি ওর ভরসার কেন্দ্রবিন্দু না হতে পারি, তাহলে ও কোথায় যাবে? বাদ দিন। রাখি, ভালো থাকবেন। ভাবীকে নিয়ে বাসায় আসবেন। আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
চকিতে কারো কণ্ঠ শুনতে পায় ইনজাদ। নিয়নের বাতির আলোতে সে তার মামাকে দেখল। ইনজাদ গালভর্তি হেসে ডেকে উঠল—
“মামা!”
ত্রিমুল কাউকে ইনজাদের ঠিকানা জিজ্ঞেস করছিল। তার কণ্ঠেই সামনে তাকাল। ইনজাদকে দেখেই প্রসন্ন হাসল। ইনজাদ হেঁটে গেল সামনে। বলল—-
“এত দেরি করলে যে?”
“আরে ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। এই চিপাগলির মধ্যে বাসা নিলি ক্যান?”
ইনজাদ অধর বিস্তৃত করে বলল—
” আমি তোমার মতো বড়োলোক্স নই। শহরে নিজের বাড়ি আর গাড়ি থাকলে, আর কী লাগে! ভাড়া বাসা ওই চিপাগলিই। কেমন আছ মামি?”
সুরমা এক পশলা হেসে বললেন—
“ভালো, তুমি কেমন আছ?”
“ভালো। তোকে জিজ্ঞেস করব না। ওইখানেই দাঁড়া।”
ত্রিনা নাক ফুলিয়ে বলল—
“তোমার জিজ্ঞেস করতে হবে না। হুহ!”
সুরমা আর ত্রিমুল মুচকি হাসল। ত্রিমুল প্রশ্ন ছুড়লেন—
“এখানে কী করছিলি?”
ইনজাদকে সুযোগ না দিয়েই ফটফট করে বলা শুরু করে ত্রিনা—
“হাওয়া খেতে এসেছে হাওয়া। স্মেল পাচ্ছ না? ছি! ইয়াক! রেহাংশী যে কী করে এটাকে সহ্য করে!”
ইনজাদ অপ্রস্তুত হলো। ইচ্ছে করছে ঠাসা এক চড় বসাতে ত্রিনার গালে। নিজের অভীপ্সাকে দমন করল সে। হেসে বলল—
“ব্যাগ দাও আমার কাছে।”
” আরে না, তোর নিতে হবে না। ”
ত্রিনা টগবগ করে বলল—
“তোমার নিতে হবে না। পরে মিষ্টি বউ বলবে, তার বরকে দিয়ে আমরা কুলির কাজ করিয়েছি।”
সুরমা ধমকি মেরে বললেন—
“তুই চুপ করবি? থাম। রেহাংশী কেমন আছে ইনজাদ?”
“ভালো, এখান দাঁড়িয়ে কথা বলবে না কী? বাসায় চলো। ও অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। আর, ওকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। যেভাবে চলছে চলতে দাও।”
চলবে,,,