#মোহঘোর
#পর্বঃ৮,০৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
০৮
বদ্ধদৃষ্টিতে আবিষ্ট হয়ে বসে আছে ইনজাদ। ক্যাফের অবারিত প্রান্তে তার উন্মুক্ত সরল দৃষ্টি। পলক না ফেলে সে চেয়ে আছে মগ্ন হয়ে। ক্যাফে সংলগ্ন ফুটপাতে হাজার মানুষের একের পর এক চলাচল। ইনজাদের ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। এমন নয় সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে বা কাউকে দেখার প্রবল বাসনা তার হৃৎপ্রকোষ্ঠে উথালপাথাল করছে। আসলে সে ভাবছে। একরত্তি এক বিষবাণকে ভাবছে।
ইনজাদের পাশে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসেছে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মেহমাদ। মেহমাদ সংকীর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইনজাদের দিকে। তার অনঢ়, অবশ চাহনিতে কোনো পরিবর্তন না করেই প্রশ্ন ছুড়ল—
“কী হয়েছে খুলে বলবি? না কি এভাবে ধ্যাণ ধরে বসে থাকবি! জব পেয়েছিস কই বন্ধুদের ট্রিট দিয়ে তাদের দোআ নিবি, তা না করে কী এমন বোবা ব্যাঙ হয়ে বসে আছিস!”
ইনজাদ পলক ফেলল। রাস্তার ওপারে তার দৃষ্টি। ঝাল মুড়িওয়ালার সামনে দুটো স্কুল ড্রেস পরা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। তার অপর পাশে একটা কিশোর ছেলে। তার কাঁধে স্কুল ব্যাগ। দুটো মেয়ে হেঁটে গেল। একজনকে দেখে চমকে গেল ইনজাদ। মুহূর্তে তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। পলক ফেলে আবার তাকাতেই মনে হলো সে ভুল দেখেছে। ধাতস্থ করে নিল নিজেকে। মেহমাদ চমকিত হলো। সেই সাথে বিরক্ত। নাকের ডগা ফুলিয়ে বলল—
“তুই কিছু বলবি না আমি চলে যাব?”
ইনজাদ হালকা করে ঘাড় ঘুরালো। নরম চোখে চেয়ে মুক্ত গলায় বলল—
“কী বলব?”
মেহমাদ ফোঁস করে দম ফেলল। ঠোঁট চেপে ধরল। নিজের রাগ সংবরণ করে বলল—
“সন্ন্যাসীর মতো আচরণ করছিস কেন তাই বল। জব পেয়ে খুশি হসনি? না কি সেলারি পোষাবে না?”
ইনজাদ তাচ্ছিল্য হাসল। হেয়ালি গলায় বলল—
“দুটোর কোনোটাই নয়। সমস্যা অন্য। সমাধান করতে পারবি?”
মেহমাদ দম্ভ করে বলল—
“প্রেমে পি.এস. ডি. করছি আমি। সেই সম্পর্কে হলে বল।”
বিস্মিত হলো ইনজাদ। তার চোখের কোটর নিজের অগোচরেই প্রশস্ত হলো। কপালে পড়ল ভাঁজ। চোয়ালে এলো দৃঢ়তা। কণ্ঠে উদ্বেলতার সাথে কৌতূহল। আগ্রহী গলায় বলল—
“তোর এমন মনে হলো কেন?”
মেহমাদ শার্টের কলার টেনে ভাব নিল। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল—
“আমার গার্লফ্রেন্ডদের সিরিয়াল কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা আমি নিজেও জানি না। এসব তো আমি চোখ বন্ধ করে বুঝে যাই। তোর সামনে তো চোখ খোলা রেখে বসে আছি।”
হতচকিত ইনজাদ গম্ভীর গলায় বলল—
“প্রেম নয়, দোটানা।”
“খুলে বল। দেখি কিছু করতে পারি কি না।”
ইনজাদ মাথা ঝাঁকাল। প্রথম দিন থেকে ঘটা সব ঘটনা খুলে বলল। এমনকি নিজের ভাবনার কথাও। মেহমাদ শান্তভাবে সব শুনল। মৌনতা কেটে বিজ্ঞের মতো বলল—
“তুই প্রেমে পড়েছিস।”
দ্রুত অস্বীকার করে ইনজাদ। তার বক্তব্য সে শুধু চিন্তিত রেহাংশীকে নিয়ে। তাকে সে ভালোবাসে না। নুপূরকে পছন্দ করে সে। সে ম্যাচিউর। একে অপরকে বোঝার ক্ষমতা তাদের আছে। রেহাংশী নিছক এক বাচ্চা মেয়ে। তাকে নিয়ে ইনজাদ শুধুই শঙ্কিত।
“মোটেও না। রেহাংশীকে আমি ভালোবাসি না।”
মেহমাদ আড় চোখে চেয়ে ধারালো কণ্ঠে বলল—
“আমি কখন বললাম তুই রেহাংশীকে ভালোবাসিস?”
হতভম্ব হয়ে যায় ইনজাদ। নিজের চেতন মনকে দমাতে পারলেও অবচেতন মন তার কথা বলেই ফেলে। ইনজাদ প্রসঙ্গ কাটাতে বলল—
“ফাজলামি করিস না। আমি এমনিতেই বলেছি।”
হা হা করে হেসে উঠে মেহমাদ। ফিচেল গলায় বলল—
“বন্ধু, প্রেমে পড়া বারণ। কিন্তু তবুও মানুষ প্রেমে পড়ে। প্রেম তো এক নেশা, আসক্তি। পৃথিবীর সবচেয়ে নিষিদ্ধ নেশা। এই নেশায় যে একবার পড়ে, শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে বুঝতেই পারে না এই নেশার তীব্রতা কতটা গভীর, নিচ্ছিদ্র আর অসীম। বের হওয়া মুশকিল।
প্রেম! দুই অক্ষরের সবচেয়ে নিখুঁত, ধারালো, হিংস্র শব্দ। প্রেম! দুই অক্ষরের সহজ, মোলায়েম, মন্থর অনুভূতি। প্রেম! দুই অক্ষরের নিষ্ঠুর, নির্দয়, নির্মমতার প্রতীক। যার সত্যিকার আস্বাদনে কেউ জীবন পার করে দেয়, আর কারো অলক্ষ্যে তার সামনেই থেকে যায় তার প্রেম। প্রেম, বড্ড অসহায়! বড্ড পোড়ায়! নির্ঘুম রাতের সাক্ষী হয়। প্রেম, চন্ডি হয়, হয় রণতূর্য! ”
কথা বলতে বলতে গাঢ় হয়ে যায় মেহমাদের কণ্ঠ। ইনজাদ ভারমুক্ত গলায় বলল—
” এখন এসব প্যাঁচাল পারিস না। আই এম কনফিউসড! আমি বুঝতে পারছি না। আমার মস্তিষ্ক সাড়া দিচ্ছে না রেহাংশীকে। নুপূর! যাকে দেখে প্রথমবার আমার কিছু অনুভূত হয়েছে। রেহাংশী! যার চোখের চাহনি, যার কথা, যার প্রতিটি পলক আমাকে ভাবতে বাধ্য করে। যে আমার অবচেতন মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যতবার আমি চোখ বন্ধ করে নুপূরকে ভাবতে চাইছি ততবার রেহাংশীর বাচ্চা চেহারটা আমার সামনে ভেসে ওঠছে। ওই চোখের তীক্ষ্ম চাহনি, ওই ধারালো কন্ঠ। যা ছিন্নভিন্ন করছে আমাকে। কিন্তু যখনই আমি বাস্তব ভাবি আমার মন সায় দিচ্ছে না। আই এম ফেড আফ ইয়ার!”
মেহমাদ টেবিলের ওপর থেকে ঠান্ডা পানির গ্লাস নিয়ে ইনজাদকে এগিয়ে দেয়। ইনজাদ উৎসুক নজরে তাকায়। মেহমাদ আলতো করে ঘাড় কাত করে বলল—
“গিলে নে। আমি বলছি। ”
ইনজাদ পানি পান করে। শান্ত হয়ে বসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। মেহমাদ দুই হাত রাখে টেবিলের ওপর। গলার স্বর অবারিত করে বলল—
“শোন, প্রেমে মানুষ দুইভাবে পড়ে। এক, লাভ এট ফার্স্ট সাইট। মানে প্রথম দেখায় প্রেম। এটা অনেকটা ফ্যান্টাসি টাইপ। আমাদের ফিল্মি জগতে এমনটা হয়। নায়ক নায়িকাকে প্রথমবার দেখেই কুপোকাত। তারপর কো-ইন্সিডেন্টলি তাদের বারবার দেখা হয়। এবং তাদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
দুই, সেটাকে আমি নাম দিয়েছি ” ভালোবাসার পর প্রেম”। এটা একদম আমার নিজস্ব মতামত। তুই একটু ভাব, প্রেম আর ভালোবাসা অনেকটা এক হলেও দুটো আলাদা ভাবার্থ বহন করে। প্রেম করলেই প্রেমিকা হয়। যার চোখের নেশা আমাদের নেশার্ত করে না, করে তার ঠোঁটের আদুরে ছোঁয়া। কিন্তু, যাকে আমরা ভালোবাসি তার ঠোঁট নয়, ওই চোখেই যেন জনম জনম চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। প্রেমিকার পাশ ঘেঁষে বসলে তাকে আরেকটু কাছে এনে দৈহিকক্রিয়ায় মত্ত হতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির পাশে বসে তার চুলের ঘ্রাণেই বিবশ হতে ইচ্ছে হয়। প্রেমিকার সাথে মোবাইলে কথা বললে তাকে দেখার তৃষ্ণা জাগে। ছুঁতে ইচ্ছে করে তাকে একান্তভাবে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির কণ্ঠ শুনেই বলতে ইচ্ছে হয় সময় থমকে যাক এই ধরার, আমি তোমাতেই হবো এই পলেই বিলীণ। প্রণয় নিষিদ্ধ জেনেও হাজারো প্রণয়ী- প্রণয়িনীর জন্ম এই মেদিনীর বুকে। কিন্তু পবিত্র ভালোবাসার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আগের যুগের কথা ভাব, বাবা- মায়ের পছন্দেই ছেলে- মেয়েদের বিয়ে হতো। তারা সংসার করত, সন্তান জন্ম দিতো। হাজার দিবস একে অন্যের সাথে কাটিয়ে দিতো। তাদের ভালোবাসা দিন দিন বাড়ত, কখনো কমত না। কারণ, তারা ভালোবাসার পরে প্রেমে পড়েছে। আগে প্রেম নয়। প্রেম ক্ষণস্থায়ী এক মোহ। মোহঘোর! যার অস্তিত্ব আমাদের চর্মচক্ষুতে, হৃদয়াক্ষীতে নয়। নুপূর তোর সেই প্রেম, তোর মোহঘোর, যার প্রভাব শুধুই তোর চোখে। আর রেহাংশী তোর ভালোবাসা, যার দৃশ্যতা তোর হৃদয়াক্ষীতে, চর্মচক্ষুতে নয়। তাই তোর বদ্ধ দৃষ্টিতেই তার দেখা মিলে।”
অস্থিরচিত্তে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে ইনজাদ। তার অন্তরিন্দ্রিয়ে অসিত জলদের ছড়াছড়ি। বিদঘুটে এক বজ্রধ্বনিতে কম্পিত হচ্ছে সে। কিন্তু বর্ষণ হচ্ছে না। ইনজাত ভীত, উৎকন্ঠিত, উৎপীড়িত। শরীরের প্রতিটি লোমকূপে কী প্রকটরূপে আবির্ভুত হচ্ছে যন্ত্রণা! নিষ্পেষিত সে, দলিত সে। যন্ত্রণায়তুমি কাতরাতে কাতরাতে বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। এক অজানা যোষিতার বিষাবাণে তারা সর্বাঙ্গ বিষাক্ত। বাঁচতে হলে সেই বিষের প্রতিষেধক তার প্রয়োজন। তাই তাকে ফিরতে হবে। সেই যোষিতার কাছেই ফিরতে হবে। উদ্ভ্রান্তের মতো উঠে দাঁড়ায় ইনজাদ। মেহমাদ চকিত গলায় বলল—
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“বাড়ি। ওকে ভালোবাসি কি না জানি না। কিন্তু এই বিয়ে আমি হতে দেবো না।”
“কী করবি? নিজে বিয়ে করবি? আনটি তো আগেই কেল্লাফতে করে রেখেছে।”
“দরকার পড়লে আমার চেয়ে ভালো কাউকে নিয়ে আসব ওর জন্য।”
মেহমাদ রহস্য হাসল। সম্মতি দিয়ে বলল—
“অল দ্যা বেস্ট। আশা করি তুই তোর মনের কথা শুনবি।”
ইনজাদ ব্যস্ত হয়ে ছুটলে সড়ক পথে। শহরাঞ্চলের কোলাহল আজ তার কাছে শান্ত, নির্বিকার, নিশ্চল। সে উদ্ভ্রান্ত, উন্মাধ, উন্মত্ত।
মেহমাদ রহস্যচ্ছলে বলল—
” প্রেম! এক নিষ্ঠুর মায়াজাল,
ক্ষণিকের মোহ, বোঝে না জীবনের টান
তূরন্ত বেগে ছুটে চলা পথিক
মোহঘোরে যার হারায় দিকবিদিক!”
,
,
,
রওশন আরার সুখের শেষ নেই। খুব করে পান চিবুচ্ছেন তিনি। রান্নাঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। মেঝেতে চালের গুড়ার ছড়াছড়ি। দুটো পিড়ির ওপর বসে আছে সোমা আর রেহাংশী। তাদের হাতভর্তি মন্থন করা চালের গুড়ার অংশ। দুইজন খুব মনোযোগ দিয়ে পিঠা বানাচ্ছে। নকশী পিঠা। খেজুর কাঁটার নিখুঁত ব্যবহার করে পিঠা বানিয়ে যাচ্ছে তারা। ঝিনুক বেগম চুলোয় রান্না বসিয়েছেন। গরম তেলে পানি পড়ায় ছ্যাত ছ্যাত আওয়াজ হচ্ছে।
রেহাংশী সোমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—
“সোমা আপা, বিকালে নদীর পাড়ে যাবা? পারুল আসছে। ওর সাথেও দেখা করে আসব।”
সোমা চিন্তিত মুখে দুঃখী গলায় বলল—
“নাগো ছোডো আফা। আইজ না। কাইল যামুনে। আইজ তাত্তারি বাড়ি যাওয়া লাগব। মেহমান আইব।”
“ও আচ্ছা। তাহলে কাল যাব। তুমি তাড়াতাড়ি আইসো।”
“আইচ্ছা। ”
রওশন আরা শান দেওয়া গলায় খেমটি মেরে বললেন—
“এত ফুসুরফুসুর ক্যান? তাত্তারি কাম শেষ কর। আরো কত কাম বাকি।”
“করতাছি, করতাছি। তুমি এত চিল্লাইয়ো না দাদি।”
সোমার কথায় রওশন আরা চোখ রাঙিয়ে চাইলেন। রেহাংশী কথা বাড়াতে মানা করল। রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়ায় নুপূর। থমথমে গলায় বলল—
“রেহাংশী, একটু আমার ঘরে আয় তো।”
রেহাংশী মাথা তুলে বলল—
“তুমি যাও আমি আসছি।”
“হুম।”
,
,
,
“ইনজাদের সাথে তোর কীসের সম্পর্ক?”
দ্বিধান্বিত চোখে তাকাল রেহাংশী। এমন অহেতুক প্রশ্নের কূল- কিনারা পাচ্ছে না সে। চোখ -মুখ কুঁচকে এক অবিশ্বাস্য কথা বলে ফেলল সে।
“স্বামী হয় আমার।”
দাপিয়ে উঠে নুপূর।
“এসব কী ধরনের বাজে কথা?”
“তুমিই তো জিজ্ঞেস করলে।”
“তুই আজকাল অনেক বেশি কথা বলিস।”
“আর তোমরা? তোমরা কিছু বলো না! একটা অজানা মানুষের সাথে আমার কীসের সম্পর্ক?”
“পায়েল তোকে ওর সাথে কথা বলতে দেখেছে। কী কথা বলছিলি?”
“প্রেমের কথা বলছিলাম।”
“রেহাংশী!”
গলা চড়িয়ে চিৎকার করে উঠে নুপূর। রেহাংশী শান্ত। পায়েল বিছানায় বসা থেকে উঠে বলল—
“অজানা-ই যখন, তখন এত কীসের কথা?”
রেহাংশী ফুঁসলে উঠে বলল—
“তুমিও তো দরজা বন্ধ করে নুহাশ ভাইয়ার সাথে কথা বলো। কই, আমি তো তোমাকে কখনো জিজ্ঞেস করিনি এত কীসের কথা তোমার তার সাথে।”
পায়েল বজ্রের মতো চমকে উঠে রেহাংশীকে চড় মারার জন্য হাত তুলতেই তার হাত ধরে নুহাশ। কটমট কর চেয়ে বলল—
“সুযোগ পেলেই ওর গায়ে হাত তোলা তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে পায়েল। দুই বোনের কী আর কোনো কাজ নেই? কে কার সাথে কী করল, কে কী করল শুধু এসব-ই! তোরা যা করেছিস তার ধারেকাছেও নেই রেহাংশী। তবুও আঙুল কেন বারবার ওর দিকে ওঠাস?”
নুহাশের ছোড়া বুলিতে তেঁতে উঠে নুপূর। ক্ষোভিত গলায় বলল—
“নুহাশ! একদম ওর হয়ে দালালি করবে না। ও কী বলেছে শুনেছ?”
“নুহাশ নয়। নুহাশ ভাইয়া বলবি। তোর থেকে প্রায় দুই বছরের বড়ো আমি। আর পায়েল থেকে গুনে গুন সাত। তাই নুহাশ বলার পর সাথে ভাইয়াও বলবি দুজনে।”
দুই বোন আশ্চর্য হয় নুহাশের কথায়। নুহাশ রেহাংশীর হাত টেনে বের হয়ে আসে সেখানে থেকে।
নিজের কক্ষের সামনে আসতেই নুহাশের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রেহাংশী। নুহাশ মনমরা গলায় বলল—
“যা ঘরে যা। তোকে আমি কী বলেছিলাম মনে আছে?”
“ফুফু আমাকে কখনো মেনে নেবে না নুহাশ ভাইয়া। পায়েল আপুকে তিনি মাথায় করে রাখবেন।”
“আর তোকে আমি মাথায় করে রাখতাম।”
“আমি চাই না আমার জন্য সবাই তোমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাক। পরের দেওয়া কষ্ট বুক পেতে সয়ে নেওয়া গেলেও, আপনজনের ঘৃণাও যে মৃত্যুসম যন্ত্রনা দেয়। আমি কখনো চাইব না তা তুমিও সহ্য করো। পায়েল আপুকে বিয়ে করে নিয়ো তুমি। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। তোমরা ভালো থাকবে।”
রেহাংশী সিক্ত নয়নে ছোটে নিজের কক্ষে। নুহাশের মাও সহ্য করতে পারে না রেহাংশীকে। তার ধারণা রেহাংশীর কারনেই তার স্বামী পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। একদিন রেহাংশীকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছিল নুহাশের বাবা। পথে গাড়ির ধাক্কায় তার পায়ের হাড় ভেঙে যায়। রেহাংশী তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে পাশের খড়ের গাদায়।
চলবে,,,
#মোহঘোর
#পর্বঃ৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
উদাসচিত্তে ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে ইনজাদ। ভীতিহীন স্থির চাহনি। তার বৈবর্ণ আননে প্রভাকরের তেরছা কিরণ। গতকাল বিকেলে ফিরেছে সে। ফেরার পর থেকে তার বেপরোয়া, অস্থির, অসহিষ্ণু হৃৎপ্রকোষ্ঠে ঝড় চলছে। রাস্তায় পায়চারি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ছাদের পাটাতনে চপল পায়ের চলা। দেখা মিলল না কাঙ্ক্ষিত মানুষের। ইনজাদ বিধ্বস্ত। নির্নিমিখ চেয়ে আছে রেহাংশীর ভাঙা জানালায়। এখান থেকে অবশ্য তা দেখা যায় না। তবুও অবুঝ মনের সান্ত্বনা।
ইনজাদ এক বিচিত্র ফন্দি আঁটলো।
বিকেলে স্থবির পরিবেশ। সূর্যের নিষ্প্রভ আভা। মোড়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে ইনজাদ। তার সন্ধানী চোখ পিপলুর অপেক্ষায়। খানিক বাদেই দুরন্ত পিপলু তার দলবল নিয়ে এলো। হাতে ক্রিকেট ব্যাট আর বল। অধর বিস্তৃত হয় ইনজাদের। পিপলুকে ডাক দিয়ে নিজের কাছে বসায়। ছোট্ট বাচ্চাদের ভুলাতে হলে তাদের মুখরোচক খাবার খাওয়াতে হয়। আর পিপলু তো দুষ্টের শিরমণি। পিপলুকে পঞ্চাশ টাকার এক নোট দিয়ে হাসল ইনজাদ। পিপলু চোখ চকচক করে ওঠে। ইনজাদ কিছু একটা বলতেই উল্লাসিত হয় পিপলু।
বিছানায় এলোথেলো হয়ে ঘুমে বিভোর রেহাংশী। আচানক তার গায়ে কিছু একটা পড়তেই হকচকিয়ে উঠে বসে সে। বুকে থু থু ছিটিয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। বুক ভরে শ্বাস নেয়। নিজেকে ধাতস্থ করে। মেঝের ওপর বল দেখে ভ্রূ বাঁকায় রেহাংশী। এ নির্ঘাত পিপলুর কাজ!
রেহাংশী জানালার কাছে আসে। তার জানালায় এখনো কাঁচ লাগানো হয়নি। জোর দেইনি সে। ঘুমো ঘুমো চোখে পিপলুকে দেখেই মেজাজ চওড়া হলো তার। শব্দহীন বাক্যে জানালা দিয়ে তাকে শাসিয়ে নিজের কক্ষ থেকে বের হয়। বাড়ির বাইরে আসতেই রেহাংশীকে দেখে ছুট লাগায় পিপলু। রেহাংশী হাতের বলটা নিয়ে ফুঁসলে উঠে বলল—
“পিপলুর বাচ্চা! চাচাকে যদি না বলেছি আজ। স্কুল বন্ধ থাকায় তোর ঠ্যাঙ অনেক বেড়েছে।”
পিপলু পেছন ফিরে ভেঙচি কেটে খিচতি মেরে পূনরায় দৌড় লাগায়। রেহাংশী হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। সিদ্ধান্ত নেয় পিপলুর বাবাকে সে জানাবে তার ছেলের কর্মকাণ্ড। দম ফেলে যখনই পেছন ফিরে রেহাংশী, আচমকা ইনজাদকে দেখে ভড়কে গিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। বল পিপলু নয় ইনজাদ মেরেছে ঘরের ভেতর।
তাকে পাশ কাটিয়ে সরে আসে রেহাংশী। ইনজাদ ডেকে উঠে।
“দাঁড়াও।”
রেহাংশী শুনল না। তার গতি অশিথিল।
” শোনো রেহাংশী। দাঁড়াও বলছি।”
নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ় রেহাংশী থামল না। ইনজাদ দারাজ গলায় বলল—
“বিষবাণ!”
রেহাংশী থমকাল। পেছন ফিরে দৃঢ় গলায় রাগমিশ্রণ করে বলল—
“এই নামে আমাকে আর ডাকবেন না।”
ইনজাদ নরম পায়ে রেহাংশীর কাছে এসে দাঁড়াল। অতিষ্ঠ গলায় বলল—
“কথা শুনছিলে না কেন আমার?”
“আপনি আর কখনো আমার সাথে কথা বলবেন না।”
ইনজাদ বদ্ধশ্বাসে বলল—
“এই বিয়ে তুমি করবে না।”
রেহাংশী চট করেই হেসে ফেলে। কটাক্ষ করে বলল—
“এখন আমার বিয়েতেও আপনার সমস্যা?”
ইনজাদ গাঢ় গলায় বলল—
“তোমার বিয়েতে আমার কোনো সমস্যা নেই। রতনকে বিয়ে করবে না তুমি।”
রেহাংশী ভাবাবেশহীন চোখে তাকাল। বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে বলল—
“কী সমস্যা আপনার বলুন তো? আমি কাকে বিয়ে করব না করব তা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাতে আপনার কী?”
ইনজাদ নিরেট গলায় বলল—
“রতন তোমার যোগ্য নয়। আরে আমি তো দু’দিন হলো এখানে এসেছি। কিন্তু তুমি তো সব জানো। সব জেনেও কী করে রাজি হলে এই বিয়ের জন্য?”
অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলে রেহাংশী। সরস গলায় বলল—
“আপনার কী আমার বিয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে না কি রতনকে বিয়ে করছি সেই জন্য চিন্তা হচ্ছে? কিন্তু আমি তো ভাবছি, আপনার আমার জন্য চিন্তা কেন হবে? কে হই আমি আপনার?”
ইনজাদের কথা আটকে গেল গলায়। স্বরনালিতে সাপের মতো পেঁচিয়ে গেল তার সমস্ত কথামালা। চোখের পাতা ভার হলো। সিক্ত হলো তা। রেহাংশী শ্লেষাত্মক গলায় বলল—
“উড়ো আহ্লাদ সবাই দেখাতে পারে পরদেশী। এইটাই সমাজের নিয়ম! একজন অসহায় মানুষ যখন রোগে-শোকে জর্জরিত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে কেউ এগিয়ে আসে না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর খাটিয়ার পাশে বসে বলে,” আহ! বড়ো ভালো মানুষ ছিল।” আমরা মানুষগুলো এমন। যদি ভালো মানুষই ছিল তাহলে আগে কেন সাহায্যের হাত বাড়াল না তারা?
কারণ আমাদের সংকীর্ণ মনমানসিকতা, অপরের দুঃখে নামের অশ্রু বিসর্জন। আমরা সবাই সমাজ বদলাতে চাই। তবে নিজের হাতে নয়, অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে।
আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আমি রতনকেই বিয়ে করব। আমার তকদিরে যা আছে তাই হবে। আপনি আর কখনো আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না। আমি এই পৃথিবীর মানুষদের ঘৃণা করি, যারা অন্যকে শুধু সহমর্মিতা দেখায়। আপনিও তাদের মধ্যে একজন। আর কখনো আমাকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করবেন না। কখনো না।”
রেহাংশীর চোখ দিয়ে ঝরা পানিতে তার গাল ভিজে গেল। হাতের উলটো পাশ দিয়ে তা মুছে নিয়ে জোরপূর্বক হাসল সে। চোখের চাহনিতে ছিল একরাশ ঘৃণার পাহাড়। তা ধ্বসে পড়ল ইনজাদে বুকের ওপর।
নিজের কক্ষের জানালা দিয়ে সবটা দেখছে নুপূর। কথার আওয়াজ না আসলেও ভাবভঙ্গি তার দৃষ্টিগোচর হলো।
,
,
,
“কি কথা বলছিলি তুই ওর সাথে?”
রেহাংশী তেরছা গলায় প্রত্যুক্তি করে বলল—
“তাকে গিয়েই জিজ্ঞেস করো।”
নুপূর অসহিষ্ণু গলায় বলল—
“তুই এতটা নিচে নামলি কী করে? সবটা জেনেও বারবার কেন যাচ্ছিস ওর সামনে?”
“আমাকে কেন বলছ? আমি কী করেছি? সে নিজেই আমার সাথে কথা বলেছে। ”
“তাই বলে তুই..।”
নুপূর তার কথা শেষ করতে পারে না। তার পূর্বেই ছুটে আসে পায়েল। বোনের গলা জড়িয়ে ধরে সাগর পরিমান খুশি নিয়ে বলল—
“তমালিকা চাচী ফোন করছে। আজ সন্ধ্যায় ওরা তোমাকে আংটি পরাতে আসবে। ইনজাদও আসবে সাথে।”
বোনের দুই গালে হাত রাখে পায়েল। তার চোখের কোটরে খুশি উপচে পড়ছে। নুপূর নির্লিপ্ত। রেহাংশী বিরস হাসল। সংগোপনে চোখের পানি মুছে নিয়ে বেরিয়ে আসল সেখান থেকে। ঝিনুক বেগম ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মেয়েকে দেখতে আসবে। সেই খুশিতে তোড়জোড় শুরু করলেন। রেহাংশীকে দেখেই চিৎকার করে বললেন যেন তাকে সাহায্য করে। সোমা মুখ বাঁকায়। এখন রেহাংশীকে গাধার মতো খাটাবে।
,
,
,
নতজানু মুখে বসে আছে ইনজাদ। যা কথা বলার তার বাবা- মা বলছে। ইনজাদ শুধু শুনে যাচ্ছে। ঘোরগ্রস্ত সে। রাগে বিহ্বল। ইনজাদের হাত কাঁপছে। চোখের পল্লবে অস্থিরতা। মন-মস্তিষ্কে উদ্বেলতা। নুহাশ দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। রওশন আরা বসেছেন একপাশে অন্যপাশে ঝিনুক বেগম আর জুলহাস খন্দকার। তাদের পাশেই নুপূর। তার নত চোখে একরাশ লাজুকতা। বুকে ডিবডিব শব্দ। চপলতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মুগ্ধ নয়নে আড় চোখে দেখছে ইনজাদকে। আড়ষ্ট হয়ে যায় অনুপলেই। বিবশ দেহপিঞ্জরের সেই কম্পিত যন্ত্রটা যেন হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে ওঠল। তার কাঁধে হাত রেখে সোফার পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে পায়েল। অদূরে এক কোণে ঠায় হয়েছে রেহাংশীর। সে ওখান থেকেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।
ইনজাদ একবারও চোখ তুলে তাকাল না। যেন সে তাকালেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর কাণ্ডটি আজ ঘটে যাবে। বিষবাণের কথা সে শুনেছে। তাকাবে না আর। সকলের মুখে উজ্জ্বল হাসি। তমালিকা ক্ষুদ্র চোখে তাকাল রেহাংশীর দিকে। মেয়েটার শারীরিক গঠন ছিমছাম, উজ্জ্বল গায়ের রং, বয়সটাও কম। ছেলের জন্য এ মেয়েটাকেই প্রথম পছন্দ হয়েছিল তার। কিন্তু পরবর্তীতে নানান জনের নানান কথা শুনে মত পালটে যায় তার। ছেলের জীবনে তিনি কোনো ধরনের ঝুঁকি চান না। তার উপর মেয়েটার কেউ নেই। এতিম! না, চোখ ফেরান তমালিকা। ঝিনুক বেগম রেহাংশীকে নাশতা আনার কথা বললেন। কোনোরকম দ্বিরূক্তি ছাড়াই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় সে।
চকিতে একটা জোরালো শব্দ হয়। সোমার বিস্ফোরিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। রান্নাঘরের কাছাকাছি ছিল নুহাশ। দৌড়ে গিয়ে হতবাক সে। ভাতের পাতিল নিচে পড়ে মাড়সহ ভাতের অর্ধেকটা রেহাংশীর পায়ের ওপর। রেহাংশী শ্বাস আটকে বসে আসে। গলায় স্বর নেই। চোখ-মুখ খিঁচে নোনা জলের সমুদ্র নির্গত হচ্ছে চোখের পল্লব চুইয়ে। নুহাশ শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসতেই প্রতিবাদ করে উঠে রেহাংশী।
“আসবে না তুমি। ছোঁবে না আমাকে।”
নুহাশ দমে যায়। বাড়ির সকলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দেখে মেঝেতে বসে আছে রেহাংশী। সকলের ভয় জড়িত চাহনি। হতভম্ব, হতবাক ! এক মুহূর্তের জন্য পাথর বনে গেল সবাই। সকলের চিৎকার চেঁচামেচিতে উঠে আসে ইনজাদ। রান্নাঘরে রেহাংশীকে দেখেই চোখের পল্লব ছড়িয়ে বড়ো একটা শ্বাস ফেলে সে। পায়ের দিকটা জমে গেছে তার। হাঁসফাঁস করছে অন্তঃকরণ। দ্বিধাগ্রস্ত ইনজাদ দৈবাৎ চিৎকার করে উঠে—
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনারা?”
ইনজাদ ছুটে এসে রেহাংশীকে ক্রোড়ে আবৃত করে নেয়। রান্নাঘরের ওপরের বেসিং এর নিচের দিকটাতেও বড়ো একটা বেসিং আছে। ইনজাদ সেটার কাছেই রেহাংশীকে বসায়। কল ছেড়ে পা টানটান করে দেয় জলস্রোতের নিচে। ঠোঁট কামড়ে ধরে রেহাংশী। ইনজাদের বুকের কাছে খামচে ধরে। যত পানি পড়ছে নিজেকে সংকুচিত করছে সে। রেহাংশী কোনো শব্দ করল না। নীরব স্রোত নামছে তার নেত্রযুগল দিয়ে। ব্যাথা দমাতে হাতের বেড় শক্ত করছে। তাতে করে ইনজাদের শার্টের ওপরের দিকের দুটো বোতাম ছিঁড়ে যায়। তার নগ্ন বুকে রেহাংশীর ক্ষীপ্ত হাতের দংশন। গেঁথে যাচ্ছে প্রতিটি আঙুলের নখের ডগা। সেদিকে মনোযোগ নেই ইনজাদের। রেহাংশীর প্লাজো আরেকটু উপরে উঠিয়ে নিজের হাত পানির স্রোতে ধরে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরো পোড়া জায়গাটায়। বাড়ির সকলে স্থির হয়ে চেয়ে আছে। নুহাশের মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে রাগে। সে তৎক্ষণাৎ সরে আসলো সেখান থেকে। রেহাংশী মুখ গুঁজে দেয় ইনজাদের বুকে। তক্ষুণি কিছু একটা অনুভূত হয় ইনজাদের। সে সপ্রতিভ চোখে তাকাল। রেহাংশী বুক থেকে কপাল উঠাতেই জলেভরা চোখ দুটো দৃশ্যমান হলো ইনজাদের চক্ষুদর্পণে। রেহাংশীর বুকের ওঠানামা বাড়তে লাগল । নিমেষহীন ওই দীর্ঘ ভেজা আঁখিপল্লবে চেয়ে রইল ইনজাদ। এক অদৃশ্য, অাছোঁয়া আকুতি তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। রেহাংশীকে আরেকটু চেপে ধরল ইনজাদ। তার বক্ষস্থলে যেন আস্থার নীড় খুঁজে পেল রেহাংশী। ইনজাদ চিবুক রাখে রেহাংশীর মাথার ওপর। স্বগতোক্তি করল—“নিজের ক্ষমতা চিনে নাও বিষবাণ। এখনো দেরি হয়ে যায়নি। পরদেশী না হয় পর-ই থাকুক। আপন মানুষ খুঁজে নাও।”
রেহাংশীর কাতর দৃষ্টি অসহায় করে তুলল ইনজাদের চিত্ত। দেহের ভেতর যে ছোট্ট কম্পিত যন্ত্রটা আছে তার কম্পন যেন ধীরে ধীরে নীরব হয়ে আসছে। রেহাংশী তার পুরো শরীরের ভর ছেড়ে দিলো ইনজাদের ওপর। পায়ের দিকটায় তাকাতেই গা কাঁটা দিয়ে ওঠে তার।ফর্সা পা লাল হয়ে আছে যেন ছোঁয়া লাগতেই গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে! রেহাংশীকে বুক পাঁজরে চেপে ধরে কোলে তুলে নিল ইনজাদ। সকলের হতভম্ব চাহনি এখনো স্থির। বার্নল না থাকায় আপাতত পেস্টের ব্যবহার করে সে। চরম বিরক্তও হয়। এত প্রয়োজনীয় একটা জিনিস ঘরে নেই!
সোফার দুই পাশ খামচে ধরে বসে আছে রেহাংশী। সকলের নিস্তব্ধতায় কেমন ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হলো। পানি গড়িয়ে পড়ছে রেহাংশীর চোখের কোণ থেকে। ইনজাদ বিস্মিত হয়। মেয়েটা একটা শব্দও করল না!
ঠোঁট কেটে গেছে রেহাংশীর। ব্যাথার কথা ভুলতে ঠোঁটের ওপরেই সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে। ঝিনুক বেগম আচমকা চিৎকার করে উঠলেন—
“আমি বলেছিলাম না। কেউ তো আমার কথা বিশ্বাস করো না। এই মেয়ে যেখানে যাবে অনিষ্ট করেই ছাড়বে।”
জুলহাস খন্দকার ঈষৎ বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন—
“অযথা কথা বলো না তো। মেয়েটার পায়ের অবস্থা দেখেছ?”
“আমি কী আর সাধে বলি। শোনো না তো আমার কথা। যেই মেয়ে নিজের মা-কে খেয়েছে সে আর কী করবে!”
এইবার শব্দ করল রেহাংশী। ছলকে উঠা পানির ন্যায় ঝরল তার চোখের জল। ইনজাদ তাকাল। মৃদু হাসল। কাঁদল তাহলে! ব্যাথা অনুভূত হয় তাহলে এই মেয়ের!
ইনজাদ শক্ত গলায় বলল—
“আম্মা, আংটি দিন।”
সবাই চমকে গেল। অভিব্যক্তি পরিবর্তন হলো সবার। শুধু ভাবাবেশ হলো না রেহাংশীর। সে নীরব স্রোত ঝরাতে লাগল। তমালিকা ব্যস্ত হয়ে আংটি খুঁজতে লাগল। তাড়াহুড়োর মাঝে সোফায় রেখেই চলে গিয়েছিলেন। এখন খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি কড়া চোখে তাকালেন। ঘটনার বর্ণনায় সকলের মাঝে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। আংটি যাবে কোথায়?
আরেকবার আঙুল উঠবে রেহাংশীর ওপর। সেই সুযোগ দিতে নারাজ ইনজাদ। সহসা সে এক অদ্ভুদ কাজ করল। মায়ের হাত থেকে একটা স্বর্ণের চুড়ি খুলে নুপূরের হাতে পরিয়ে দেয়।
আকাশ ছোঁয়া বিস্ময় খেলে গেল উপস্থিত মানব- মানবীদের চোখে। তাদের সেই চাহনি বিদীর্ণ করল ইনজাদের কথার বাণ—
“জীবনে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। যার আগাম ধারণা তো দুর, শরীরের লোমের পাশ দিয়ে চলে গেলেও তার আভাস পাওয়া যায় না; যদি না স্বয়ং ভাগ্যবিধাতা চান। তাই, তার সৃষ্ট মানুষকে দোষ দেওয়া বন্ধ করুন। আমাদের জীবনে তাই ঘটবে যা তিঁনি ঘটাতে চান। কোনো মানুষের তাতে উপস্থিতি নেই।
আসুন আম্মা। চলো বাবা। আর আপনারা বিয়ের আয়োজন করুন। যত দ্রুত সম্ভব এই বিয়েটা হয়ে যাওয়াই ভালো। তাতে অন্তত আপনাদের ভ্রান্ত ধারণার ইতি ঘটবে।”
রেহাংশী মাথা তুলল না। শুধু হাতের মুষ্টি শক্ত করল।তার কোমল হাতের মুঠোতে ছোট্ট লাল বক্স।
চলবে,,,