#মোহঘোর
#পর্বঃ ২,০৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
০২
নির্বাক দৃষ্টিতে বসে আছে ইনজাদ। তার কৌতূহলী মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে হাজারো প্রশ্নের কলকাকলি। রাতের দেখা অস্পষ্ট যোষিতাকে কেন একবার চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল না সে!
ব্যাথাতুর, কাতর মনে বিষবাণের তীক্ষ্ম অচ্ছুঁত আঘাতে জর্জরিত সে।
ছেলের এহেন জমাট হিমালয়ে তাপ লাগান তমালিকা। উৎকন্ঠিত গলায় বললেন—
“কী হয়েছে তোর? মুখ এত শুকনো লাগছে কেন? চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল!”
ইনজাদ নিজের অমীমাংসিত ভাবনা থেকে ফিরে আসে। টানটান গলায় বলল—
“কিছু না।”
ঠান্ডা চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ঘোর আপত্তি করে হকচকিয়ে উঠেন তমালিকা—
“আরে, আরে এই বরফ চা খাচ্ছিস কেন? দে আমি গরম করে দিই। এইসব খেয়ে খেয়ে শরীরের কী হাল বানিয়েছিস সেদিকে খেয়াল আছে!”
ইনজাদ হাসল। মায়ের আদুরে চিন্তায় তার বুকে প্রশান্তির হাওয়া বইল। স্বাভাবিক গলায় বলল—
“আম্মা, আপনি আমাকে ভালো করে দেখেছেন তো। আগের থেকে প্রায় চার কেজি ওয়েট বেড়েছে আমার। আর এই যে গালের মাংস দেখুন, ওজন করলে প্রায় এক কেজি হবে।”
ছেলের কথায় তমালিকা মায়াভরা হাসল। মেঝেতে থু থু ছিটিয়ে বলল—
“বালাই সার, নজর না লাগুক কারো। তোকে এত কথা কে বলতে বলেছে?”
ইনজাদ স্মিতহাস্য অধরে বলল—
“আম্মা, সব মায়েরা-ই নিজের সন্তানদের এমনই দেখে। রুগ্ন, শুকনো এইসব-ই।”
ইনজাদ মায়ের দিকে তাকাতেই তমালিকা মুখ বিকৃতি করে বললেন—
“নিজের শরীরের যত্ন নে। আসিস তো না মায়ের কাছে। সেই শহরে সারাজীবন রইলি। কতদিন পরে এসেছিস খেয়াল করেছিস?”
ঠান্ডা আলু পরোটার খানিক অংশ মুখে পুরে দিয়ে চিবুতে লাগল ইনজাদ। গিলে ফেলে বলল—
“আপনি জানেন আমি ব্যস্ত ছিলাম। মাত্র তো এক বছর।”
“এক বছর তোর কাছে মাত্র হলো?”
“আম্মা, এর আগেও আমি দুই বছর পর একবার বাড়ি এসেছিলাম। মনে আছে তো আপনার?”
তমালিকা চোখের জল ছেড়ে বললেন—
“মানুষ ঠিকই বলে, ছেলেমেয়েরা বড়ো হলে আর বাবা-মাকে চেনে না।”
ইনজাদ চুপ করে রইল। মৌনতা ঘিরে ধরল তাকে। পড়ালেখা শেষ করেছে আরও একবছর আগে। ছোটো একটা পার্ট টাইম জব করে। বিদেশ যাওয়ার ভাবনা আসতেই জাপানিজ ভাষা শেখার জন্য একটা কোর্স শুরু করেছিল। কিন্তু মাঝ পথে অসুস্থতার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আবারও কোর্স শুরু করে। কিন্তু তা আবারও মাঝ পথে বন্ধ করে এ দেশেই কিছু একটা করবে বলে চিন্তা করে। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের একমাত্র সহায় সে। তমালিকা নারাজ ছেলেকে বুকের কাছ থেকে সরাতে। এস. এস. সি. পাশ করেই শহরে পাড়ি জমায় ইনজাদ। হোস্টেল, মেসে-ই কাটে তার যৌবনের অর্ধেক সময়। বাবা পারভেজ মির্জা ব্যাংকে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। চাকুরীরত অবস্থায় জমানো সঞ্চয় দিয়ে এই একতলা বাড়ি বানিয়েছেন। তারা এখানের আদিনিবাসী নয়। ইনজাদের মামার এক পরিচিত বন্ধুর মাধ্যমে খুবই কম দামে এই জায়গাটা কিনে নেন তিনি। বাড়ি তৈরি হওয়ার পর প্রথমবার এসেছে ইনজাদ এখানে।
ইনজাদ নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল—
“সামনের বাড়িটা কাদের আম্মা?”
তমালিকা ছেলের কাছে এসে বসলেন। ভরাট দু’চোখে তাকিয়ে বললেন—
“কোন বাড়ি?”
“আমাদের সামনে যে পুরোনো বাড়িটা আছে।”
তমালিকা ছোট্ট তোয়ালে দিয়ে ডাইনিং টেবিল মুছতে মুছতে বললেন—
“ওইটা খন্দকার বাড়ি।”
ইনজাদ যা জানতে চায় তা তো জানা হলো না। তাই পূনরায় প্রশ্ন করল সে—
“ওই বাড়িতে কে কে থাকেন বলো তো?”
তমালিকা চমকিত গলায় বললেন—
“হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস?”
“না, মানে কাল দেখলাম একটা পাগল লোক ওই বাড়ির সামনে বসে আছে। আর একটা মেয়ে ওকে খাবার দিচ্ছিল।”
তমালিকা জ্ঞানসাগরের মতো বললেন—
“ওও, ও তো নুপূর।”
নামটা শুনেই ইনজাদের কানের কাছে যেন নুপূরের ঝনঝন আওয়াজ শুরু হলো। মনে মনে আওড়ালো সে, “নুপূর”।
তমালিকা বলতে লাগলেন—
“ছেলেটা পাগল। প্রায়ই ওখানে এসে বসে থাকে। নুপূর মেয়েটা ওকে অনেক স্নেহ করে। পাগল ছেলেটাও নুপূরকে অনেক সমীহ করে চলে। ওর কথাও শোনে।”
ইনজাদ জানার আগ্রহ নিয়ে বলল—
“নুপূর ওই বাড়ির মেয়ে?”
“হ্যাঁ। ওরা দুই বোন। নুপূর আর পায়েল। আসে তো আমাদের এখানে মাঝে মাঝে। ভীষণ মিষ্টি দুটো মেয়ে।”
“কী করে নুপূর?”
” অনার্স শেষ করেছে। তুই হঠাৎ ওর কথা এত জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
ইনজাদ থতমত খেয়ে মিনমিনে স্বরে বলল—
“আরে তেমন কিছু না। কাল দেখলাম তাই জানতে ইচ্ছে হলো। পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ আছে বুঝলে আম্মা।”
তমালিকা গা ঝাঁড়া দিয়ে বললেন—
“ওতো বুঝতে হবে না। বয়স তো কম হয়নি। এবার বিয়ে থা করে আমাকে একটু স্বস্তি দাও।”
ইনজাদ লজ্জা পেল না। রসালো গলায় বলল—
“স্বস্তি কী করে দেবো আম্মা? বউকে তো আর আমি এই বাড়িতে রেখে যাব না!”
তমালিকা চোখ বাঁকিয়ে বললেন—
“সে পরে ভাবা যাবে। আগে বিয়েটা করো।”
ইনজাদ মুচকি হেসে বলল—
“বেকারের কাছে মেয়ে দেবে কে?”
“বেকার কেন বলছিস? পার্ট টাইম তো করিস।”
“ওসব দিয়ে বউ পালা যায় না আম্মা।”
“তোকে এত চিন্তা করতে হবে না। তোর বাবা একটা মেয়ের কথা বলেছে। ছবি দেখেছি আমি। আমাদের ঘরেই আছে। তুই একবার দেখে বল কেমন?”
ইনজাদ মোলায়েম হাসল। তার হৃদয়ের সর্বনাশ তো হয়েই আছে, এবার তার সর্বনাশ হওয়া বাকি।
,
,
,
পাটায় মটমট আওয়াজে মরিচ পিষে চলছে রেহাংশী। তার ঘর্মাক্ত মুখে ছোটো ছোট কেশ লেপ্টে রয়েছে। নাক টেনে যাচ্ছে বারবার। আঁখিযুগল হতে নামছে শীতল নহর। ঠোঁট কামড়ে হাতের জ্বালা-পোড়াকে অবজ্ঞা করে নিজের কাজ করে চলছে সে।
একটা চেয়ারে এক পা উঠিয়ে রেখেছেন রওশন আরা। মুখভর্তি পান। চিবিয়ে যাচ্ছেন অবলীলায়। রেহাংশীর পাশে দাঁড়ানো কাজের মেয়ে সোমা টগবগ করে বলল—
“দাদীআম্মা, ছোটো আফারে উঠতে কন। আমি বাইট্টা দিতাছি মরিছ। দেখতাছেন না কেমনে কানতাছে। হাত জ্বলতাছে হের।”
রওশন আরা খেঁকিয়ে উঠলেন—
“তোরে কতা কইতে কইছি? যা আমার সামনেত তে। ওর কাম ওরে করতে দে। জামাই বাড়ি যাইয়া কী বইয়া খাইতে পারব না কি?”
রেহাংশী হাত থামায়। মাথা তুলে তাকায়। ঝাপসা চোখে চেয়ে অসহায় মুখ করে বলল—
“দাদী, বাকিটা কাল পিষে দেবো। হাত জ্বলছে আমার।”
“ছুপ। এইডি শেষ কইরা তারফর এনতে যাবি। তারাতারি কর।”
রওশন আরা আয়েশি ভঙ্গিতে পান চিবুতে লাগলেন। রেহাংশী আর কথা বাড়ালো না। বাটা মরিচ দিয়ে ছোটো মাছ খাবেন বলে প্রায় আধা কেজি শুকনো মরিচ বাটিয়েছে তাকে দিয়ে। নরম হাত বেশিক্ষণ সইতে পারেনি।
সোমা নিঃশব্দে দাঁত কিড়মিড় করে। বিড়বিড় করে বলল—
“বুইড়া শয়তান বেডি! বড়ো দুই নাতিন ঢেঙ ঢেঙ কইরা ঘুরে তহন কিচ্ছু হয় না। ছোটোডারে দিয়াই এসব করান লাগে তার। খচ্চর বেডি!”
“এই তুই খাড়াইয়া আছোস ক্যান? যা নিজের কাম কর গিয়া।”
রওশন আরার ধমকে সচল হয় সোমা। দমদম করে পা ফেলে চলে যায় সেখান থেকে।
,
,
,
ঠান্ডা দুধের ভেতর হাত চুবিয়ে বসে আছে রেহাংশী। দুই হাতের পাঞ্জা লাল হয়ে গেছে। প্রায় ঘণ্টা খানেক কেঁদেছেও সে। নুহাশের কামনাপূর্ণ দৃষ্টি রেহাংশীর সিক্ত কপালে। সেখান থেকে ক্রমশ নামতে নামতে তার গলদেশে। কানের পাশের চুলে হাত লাগাতে গেলেই তেঁতে উঠে রেহাংশী—
“একদম ছোঁবে না আমায়।”
নুহাশ বিরক্ত হয়। চোখ কুঁচকে নাকের নাটা ফুলিয়ে বলল—
“সমস্যা কী তোর? এমন সাপের মতো ফণা তুলছ কেন? তোকে কী খেয়ে ফেলছি আমি?”
রেহাংশী কঠোর গলায় বলল—
“বাজে কথা বলবে না নুহাশ ভাইয়া।”
“বাজে কথা কেন? তুই যেমন করছ, বিয়ার পর কী করবি? জামাইরে হাত লাগাইতে দিবি না?”
রেহাংশী জ্বলন্ত চোখে তাকায়। সময়ে -অসময়ে এই মানুষটা ওকে সাহায্য করে বিধায় তাকে সহ্য করা, নাহলে…। আজও দুধ এনে দিয়েছে নুহাশ। হাতের জ্বালা কমাতে ঠান্ডা দুধ কার্যকরী।
“আমার জামাইরটা আমি বুঝব। তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি যা করছ তা নিয়ে ভাবো। যেদিন ধরা খাবে সেদিন বড়ো আব্বু তোমার হাড়গোড় ভেঙে এই বাড়ি থেকে বের করবে।”
নুহাশ মিচকি হেসে বলল—
“তুই আছিস না। তুই থাকতে নো চিন্তা। তোর মতো পাহারাদার থাকতে আমার আর কী লাগে?”
রেহাংশী তপ্ত গলায় বলল—
“কী জঘন্য!”
নুহাশ ফিক করে হেসে ফেলে। সে দেখতে সুদর্শন হলেও এই মুহূর্তে রেহাংশীর বমি পাচ্ছে।পায়েল রেহাংশীর কথা কখনোই শুনবে না। বিয়ের আগে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে সে মারাত্মক ভুল করছে।
নুহাশ নম্র সুরে বলল—
“নুপূর যা করেছে ওর জন্য ভালো ছেলে আশা করা বোকামি। আর পায়েলের কথা আমি কী বলব বল! আমার চেয়ে ওর প্যারা বেশি। তুই ই বল আমি ওর ঘরে যাই না ও আমার ঘরে আসে?”
রেহাংশী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল—
“দাঁ-কুমড়ার ওপর পড়ুক আর কুমড়া-দাঁ একই কথা। পায়েল আপুর একা দোষ দেবে না।”
“আচ্ছা দিলাম না। তুই এখনো ছোটো তাই এসব তুই বুঝবি না। একবার যদি এই মজা বুঝিস তাহলে আর ভুলবি না।”
সটান হয়ে দাঁড়ায় রেহাংশী। ব্যস্ত গতিতে উঠার কারণে তার হাত ছিটকে দুধের ফোটা পড়ে নুহাশের চোখে-মুখে। দগদগিয়ে বলল—
“আর একবার যদি এসব বাজে কথা আমার সামনে বলেছ, আমি সত্যিই বড়ো আব্বুকে সব বলে দেবো।”
নুহাশ তড়িৎ বেগে দাঁড়িয়ে বলল—
“কী বলবি তুই?”
“যে তুমি…।”
ঝননন করে একটা শব্দ হলো। চকিতে তারা দুজন সেদিকে চাইতেই দেখল, রেহাংশীর জানালার কাঁচ ভেঙে কিছু মেঝেতে কিছু তার বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। চিৎকার করে উঠে সে।
“ও আল্লাহ! দিলো আমার জানালার বাকি সর্বনাশ করে!”
জানালার কাঁচে আগে থেকেই ফাটল ছিল। এখন ষোলোকলা পূর্ণ হলো। ঝনঝন করে তা ভেঙে জানালার কপাট শূন্য হলো। রেহাংশী সাবধানে পা ফেলে জানালার কাছে এগিয়ে আসে। কাঁচশূন্য পাল্লা ভালো করে মেলে ধরে বাইরে তাকায়। পাড়ার পিচ্চিদের দেখে তপ্ত শ্বাস ফেলে সে। লম্বা লম্বা পা ফেলে নিচে নামতে থাকে।
,
,
,
ক্ষুব্ধ গলায় দাপিয়ে উঠে রেহাংশী—
“তোদের কে না কতবার বলেছি একদম এখানে খেলবি না। দিলি তো আমার জানালার কাঁচ ভেঙে?”
ইনজাদ থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার সন্দিহান মন বলছে, এ পায়েল! তাকে দৃষ্টিগোচর করল না রেহাংশী। বাচ্চারা এর আগেও তার জানালা ভেঙেচে। এবার আর ছাড় নেই। ইনজাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিপলু থেকে ব্যাটটা ছিনিয়ে নিয়ে শাসিয়ে বলল—
“আমার জানালা ঠিক করে দিয়ে বল, ব্যাট নিয়ে যাবি। নাহলে এই নিলাম তোদের ব্যাট, এইটা জ্বালিয়ে চড়ুইভাতি খাবো, বুঝলি?”
পিপলু অন্যসব বাচ্চাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকায়। রেহাংশীকে নিয়ে পাড়ায় উদ্ভট কথার প্রচলন আছে। তাই বাচ্ছারা আর কোনো শব্দই করল। বাচ্চারা এতক্ষণে ব্যাট নিয়ে চম্পট দিতো, বলের মায়া তারা জানালার কাঁচ ভাঙার সাথে সাথেই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বাঁধ সাধলো ইনজাদ।
ব্যাট নিয়ে হাঁটা ধরল রেহাংশী। দৈবাৎ ভরাট, মসৃণ পুরুষ কণ্ঠে থমকে যায় সে।
“শোনো!”
রেহাংশী পেছন ফিরল। দুই হাতে ব্যাটের উপরিভাগ ধরে অনিমেষ চেয়ে রইল সামনের অপরিচিত পুরুষটির দিকে। ইনজাদ ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে যায়। অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল রেহাংশীর। ইনজাদ স্থির হয়ে বিগলিত হাসল। মোলায়েম স্বরে বলল—
“ব্যাটটা দিয়ে দাও। ওদের দোষ নেই। বলটা আমি মেরেছি।”
ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাল রেহাংশী। ফুলে উঠা গলায় বলল—
“তাহলে আপনি আমার জানালাটা ঠিক করে দেবেন।”
চোখে হাসল ইনজাদ। সম্মতি দিয়ে বলল—
“দেবো। দিয়ে দাও ব্যাট আর বল।”
“আগে বলুন আপনি আমাকে তুমি কেন বলছেন?”
“তুমি আমার ছোটো তাই।”
“ছোটো হলেই কাউকে প্রথম দেখায় তুমি বলতে হবে? এইটা কোনো ডিকশনারির ভদ্রতা?”
রেহাংশীর কথায় মুচকি হাসল ইনজাদ।
“সরি। আপনি ব্যাট আর বল দিয়ে দিন।”
অকস্মাৎ পায়েলের কণ্ঠে কেঁপে উঠে রেহাংশী। ইনজাদ চমকাল। এইটা যদি পায়েল হয় তাহলে ও কে?
পায়েল তরতর করে বলল—
“তুই এখানে আর আম্মু তোকে সে কখন থেকে ডাকছে। চল তাড়াতাড়ি। আর এসব তোর হাতে কেন?”
“আরে দেখোনো ওরা আবার আমার জানালা ভেঙে দিয়েছে!”
চট করেই ইনজাদ বলে উঠে—
“ভালোই হয়েছে। এইবার মুক্ত বাতাস বিনা দ্বিধায় খাবেন।”
আড় চোখে তাকাল রেহাংশী। পায়েল মুখভর্তি হেসে বলল—
“আপনি কে? আপনাকে তো আগে কখনো দেখিনি?”
ইনজাদ স্বাভাবিক স্বরে বলল—
“আমি ও বাড়িতে থাকি। পরশু রাতে এসেছি।”
অবাক গলায় বলল পায়েল—
“আপনি তমালিকা চাচীর ছেলে?”
“জি।”
“ও, আপনি তো ঢাকা থাকেন?”
“হ্যাঁ।”
ধাক্কা মেরে উঠে রেহাংশী। পায়েলের ধ্যাণ কেটে বলল—
“চলো,বড়ো আম্মুতো ডাকছে।”
“হ্যাঁ, চল। আসি, চাচীকে আসতে বলবেন আমাদের বাসায়।”
“বলব।”
রেহাংশী ব্যাট আর বল ইনজাদের হাতে দিয়ে দেয়। তার চোখে- মুখে রাগের আভা স্পষ্ট দেখল ইনজাদ। তারা চলে যেতেই হাঁটু ভেঙে বসে সে। পিপলুকে ডেকে বলল—
“এদেল মধ্যে পায়েল কে?”
পিপলু দাঁত কেলিয়ে বলল—
“ওই যে পরে যে মায়াইটা আসলো ওইটা পায়েল আপু। আর ওই ভুতনী হলো রেহাংশী।”
ইনজাদ ভ্রু কুঁচকে বলল—
“ভুতনী মানে?”
“আরে তুমি জানো না। ওই রেহাংশী ভুতনী যেহানেই যায় মানুষ মইরা যায়, না হলে হাত-পা ভাইঙ্গা যায়। আর ওই ভুতনি কারো রে ধমক দিলে ওর জর আইয়া পড়ে। ওয় রাইতের বেলা ছাদে একা ঘুরে। এর লাইগা ওরে আমরা ভুতনী ডাকি।”
আচমকা ইনজাদের কাল রাতের কথা মনে পড়ল। তাহলে কী সে নুপূরকে নয় রেহাংশীকে দেখেছে?
বাকি কথাগুলো তার মস্তিষ্কে যাওয়ার আগে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
চলবে,,,
#মোহঘোর
#পর্বঃ৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
আঁধারিয়া অম্বরে চেয়ে আছে রেহাংশী। তার দুই চোখের পাতায় অবসাদ, ক্লান্তির পাহাড় শরীর জুড়ে। তবুও ঘুমপরীরা লুকোচুরি খেলছে তার সাথে। আজ খাওয়া হয়েছে তার। নির্নিমিখ চাহনিতে ওই ভরাট চাঁদকে দেখছে সে। চাঁদ সবসময়ই তার কাছে তাচ্ছিল্যের পাত্র। কারণ চাঁদও তার মতো। অন্যের আলোয় আলোকিত।
ছাদের বাউন্ডারির সাথে চেপে দাঁড়িয়ে আছে ইনজাদ। আধো আলোছায়াতে অদূরের আবছা অবয়বটিকে দেখার অক্লান্ত প্রয়াস। কিন্তু তাতে সাফল্য নেই।অবয়বটির চেহারা আজও অস্পষ্ট। তবে ইনজাদের চেতনা বিভ্রান্ত। আদৌ সে অবয়বটি যাকে সে খুঁজছে তার না কী অন্য কারো?
সহসা রেহাংশীর চোখ যায় ইনজাদের দিকে। তাকেও সে স্পষ্ট দেখতে পারছে না। তবে সে নিশ্চিত অন্ধকার অবয়বটি ইনজাদের। রেহাংশী চোখ সরাল। তার দীর্ঘ আঁখিপল্লব বন্ধ করে মায়ের চেহারা মনে করার চেষ্টা করল। সুশ্রী মুখটি সে শুধু ছবিতেই দেখেছে। বাস্তবে যা দেখেছে বয়সের সাথে তা ভুলে বসে আছে। রেহাংশী তার বাবাকে মনে করতে চায় না। তার বাবা আরও একটা বিয়ে করেছে। শুনেছে সে ঘরে তার একটা ছেলেও আছে। রেহাংশী কখনো সেই ছেলেকে দেখেনি। দেখবে কী করে? এই বাড়ি থেকে যাওয়ার পর দুই একবার এসেছিল তার বাবা, কিন্তু ধীরে ধীরে এই বাড়ির পথও হয়তো তিনি ভুলে গেছেন।
চোখ খুলে তাকাল রেহাংশী। গুমোট শ্বাস ফেলল। অদূরের অবয়বটি এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে। হাতে জ্বলন্ত কিছু একটা। রেহাংশী আর দাঁড়াল না। চাঁদের আলো কাটা দেয় তার গায়ে।
রেহাংশীর প্রস্থানে ইনজাদ তটস্থ হলো। সেও নিচে নেমে আসে। অপেক্ষার অবসান না ঘটিয়ে শেষ হলো আরেকটি প্রহর।
,
,
,
প্রত্যুষের মিষ্টি রোদে প্লাবিত ধরনী। সোনা রোদে ঝলমল করছে পত্র-পল্লব। পাতার ফাঁক-ফোকর গলিয়ে তিরতিরে রশ্মি ঢুকে যাচ্ছে জানালা দিয়ে। ঝিনুক বেগম চা বানাতে গিয়ে চিৎকার শুরু করলেন। চিনি পেলেন না কোথাও। টেবিলে খাবার দিয়ে রান্নাঘরে পা রেখেছে রেহাংশী। পাটায় মসলা পিষছে সোমা। ঝিনুক বেগম রেহাংশীকে বললেন—
“যা তো পাশের দোকান থেকে চিনি নিয়ে আয়।”
রেহাংশী চমকে উঠে বলল—
“আমি?”
“তুই না তো কি আমি? দেখছিস না সোমা কাজ করছে। আর তোকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার পাঠাচ্ছি না। পাশেই দোকান। যা নিয়ে আয় জলদি। ওরা কাজে বের হবে।”
রেহাংশী কিছুক্ষণ ইতি-বিতি করে দাঁড়িয়ে রইল। ঝিনুক বেগম একটা বাটি করে কিছু খাবার দিয়ে বললেন—
” এগুলো ওই পাগলা মামুনরে দিবি। আর বলবি নুপূর বাসায় নাই। ও ফিরলে যেন আসে।”
“আচ্ছা।”
,
,
,
বাড়ির বাইরে আসতেই পিপলু আর তার বন্ধুদের দেখল রেহাংশী। সমস্বরে বলে চলছে—
” পাগলা তোর দাঁড়িতে কী? তেতুল গাছের চাটনি। ভুতনীর লগে করে ভাব, আমি তোর নাটাই বাপ।”
রেহাংশীর মেজাজ চড়া হয়। মামুনকে একা পেলেই পিপলু তার শয়তানির বাক্স খুলে বসে। পাড়ার সবচেয়ে বিচ্ছু ছেলে পিপলু। রেহাংশী টগবগে চোখে তাকিয়ে আবার নিভে যায়। মামুনেকে বাটি দিয়ে বলল—
“নুপূর আপু নেই।”
মামুনের শার্টের হাতা তার কব্জি ছুঁইয়ে বেরিয়ে আছে। তা দিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে বলল—
“কোথায় গেছে, কোথায় গেছে?”
“মামার বাড়ি। চলে আসবে। তুমি আজ আর এসো না।
মামুন ভাই, তুমি কী নুপূর আপুকে বিয়ে করবে?”
বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল মামুন। দাঁত কেলিয়ে বলল—
“বিয়ে, বিয়ে। আমি বিয়ে করব।”
“তাহলে এসব কেন পরো? তুমি যদি এমন নোংরা থাকো তাহলে নুপূর আপু তোমাকে বিয়ে করবে না। সে কোনো সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে।”
নুপূর চলে যাবে কথাটি শোনা মাত্র রেগে আগুন হয়ে যায় মামুন। খাবার-সহ বাটি ছুড়ে ফেলে বলল—
“না, নুপূর যাবে না। নুপূর যাবে না। মেরে ফেলব আমি।”
ভয়ে আঁতকে উঠে রেহাংশী। মামুনকে শান্ত করার জন্য বলল—-
“আরে, আরে তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আপু যাইনি তো। শান্ত হও। তুমি বাড়ি যাও। তুমি আজও ব্রাশ করোনি। ছিঃ! নুপূর আপু জানলে তোমার সাথে কথাই বলবে না।”
“আমি ব্রাশ করব, আমি ব্রাশ করব।”
“খাবার ফেলে দিলে কেন?”
মামুন আবার সেই খাবার কুড়িয়ে নিতে গেলে রেহাংশী বাঁধ সাধে। শান্ত স্বরে বলল—
“তুমি বাসায় যাও। ব্রাশ করে,গোসল করে, খেয়ে ঘুমাবে। নুপূর আপু আসলে আমি তোমাকে জানাব। কেমন?”
“হু, হু।”
মামুন উঠে দাঁড়ায়। হেলেদুলে চলতে থাকে। তার দিকে তাকাতেই রেহাংশী দেখল ইনজাদ তাদের বাড়ির দরজায় দাঁড়ানো। পিপলু কুটকুট করে হেসে যাচ্ছে। তাকে ধরার জন্য হালকা ছুট লাগাতেই পিপলুকে আর পায় কে! দলবল নিয় দৌড়। কিন্তু তাকে আটকাল ইনজাদ। রেহাংশী তপ্ত আভা ছড়ানো মুখশ্রীতে ইনজাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইনজাদ বিগলিত হাসে । বলল—
“নিন, কী সাজার দেবার দিন। আমি ধরে রেখেছি।”
রেহাংশীর মাথায় অন্য কিছু আসলো না। তার একমাত্র লক্ষ্য পিপলুর কাল মলে দেওয়া। করলও তাই। পিপলু খেমটি মেরে বলল—
“ভুতনী!”
রেহাংশী ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয়। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় ইনজাদ ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। হাত শিথিল করতেই পিপলু ছুট লাগায়। তার মুখ নিঃসৃত ধ্বনি—
“ভুতনী, ভুতনী, ভুতনী। তেতুল গাছের ভুতনী।”
জিব দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভেঙচিও কাটল। রেহাংশী জোর গলায় বলল—
“আরেকবার পাই তোকে, তোর ঘাড় ভাঙব আমি।”
ইনজাদ ঢোক গিলে বলল—
“সত্যিই কী ঘাড় ভেঙ্গে দেবেন না কী?”
“প্রয়োজন পড়লে দেবো।”
গটগট করে হাঁটা ধরে রেহাংশী। তার পিছু নেয় ইনজাদ। পেছন থেকে পাশে। রেহাংশী প্রতিক্রিয়া করল না। ইনজাদ ইতস্তত করছে। বলবে বলবে বলেও বলা হচ্ছে না। কী বলবে সে?
মিইয়ে গলায় বলল—
“মামুনকে আজ তোমার আপু খাবার দেয়নি কেন?”
” আপু বাসায় নেই।”
“কোথায় গেছে?”
ইনজাদ প্রশ্নটা এত দ্রুত করল যে থমকে গেল রেহাংশী। সন্দিহান গলায় বলল—
“তা দিয়ে আপনার কী দরকার?”
ইনজাদ মৃদু গলায় বলল—
“আমার না। মামুনের দরকার।”
“তো আপনি প্রশ্ন করছেন কেন?”
ইনজাদ বিরক্ত হলো। মেয়েটা কী ভালো করে কথা বলতে পারে না। দেখতে তো সুন্দরী, কথাবার্তা কেন এমন!
আসলেই পৃথিবী জোড়া মানুষের সবাইকে সব গুণ দেওয়া হয় না। কোনো না কোনো খামতি তো থাকেই। মেয়েটার রূপে যেমন কেউ ঝলসে যাবে, তেমন কথার ছুরিতে তার কলিজাও চিড়ে দেবে।
ইনজাদ অসহ্য গলায় বলল—
“আপনার মা কী জন্মের সময় মুখে মধু দেয়নি?”
রেহাংশী তাচ্ছিল্য চোখে তাকিয়ে কটাক্ষ করে বলল—
“না, বিষ দিয়েছে। ”
হনহন করে চলতে শুরু করে রেহাংশী। ইনজাদের পা আর বাড়ল না। সেখানেই থমকে গেল এক অভূতপূর্ব ভয় আর জড়তায়।
চলবে,,,