ম্যানহোলের_অতলে পর্ব- ২

0
952

ম্যানহোলের_অতলে
পর্ব- ২
লিখাঃ #এম_আর_রাশেদ এবং #মল্লিকা_জাহান

কিশোর মন দুরন্তপনার ছাপ বেশি আঁকড়ে ধরে। তাই সামান্য ক্ষতও প্রভাবে পড়ে পরবর্তী জীবনে। মানুষের উপরিভাগ দেখে বোঝার উপায় কি ভেতরটা কত গভীর? রাস্তার উপরিভাগও তো পরিপাটি কিন্তু ম্যানহোলের অতলটা সম্পর্কেই অজ্ঞাত।

এদিকে পিয়াশ ধারালো ছুড়ি নিয়ে বসে আছে একমনে। হাত কাটবে না গলা কাটবে বুঝতে পারছে না। কাল রাত থেকেই সাধারণ জীবনটা বদলে গিয়েছে। কই ক্লাসের বাকি বান্ধুবীগুলো তো বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে, তাদের মা – বাবা কি এইভাবে অপমান করে? সেদিন ক্লাস সেভেনের যুঁথিকে রিকশায় রাইয়ান স্যারের সাথে দেখেছে। কই তাদের সম্পর্ক নিয়ে এত বাজে কথা তো কেউ বলেনি। লজ্জায় অভিমানে চোখের জল যেন থামার নয়। পিয়াশের বড় বোন সুপ্তি খাবার প্লেট রেখে গিয়েছিলো অনেক আগে৷ এখনো খাবারগুলো ছুঁয়ে দেখেনি পিয়াশ৷ সুপ্তি ভাত গুলো মাখতে শুরু করলো, মেখে এক লোকমা পিয়াশের সামনে তুললো!

— পিয়ু মনি খেয়ে নে।

— আমি খাবো না।

— আজ সারাদিন খাস নি। সন্ধ্যা হয়ে এলো। মা-বাবা তো বকবেই, তাই না! হা কর তো দেখি৷ ছোট বেলায় কত খাইয়ে দিয়েছি৷ জানিস আমি তোর থেকে ছ’ বছরের বড়।

— তো কি বোঝাতে চাও? ছ’ বছরের বড়, তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই। আমার আছে, কেন আছে?

সুপ্তির মন চাইলো ঠাটিয়ে আবারো চড় মারতে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে নিলো। একটা বাটিতে নারিকেল তেল আর লেবু নিংড়ে মিশিয়ে পিয়াশ এর মাথায় ঢেলে আলতো করে হাত দিয়ে ম্যাসাজ করছে। বিল কেটে কেটে তেল দিচ্ছে, এটা মায়ের কাছ থেকে শেখা, কেউ রাগ করলে বাটিতে তেল নিয়ে মিক্স করে বিলি কেটে দেয়৷ এতে মাথা ঠান্ডা হয়, রাগ অর্ধেক কমে যায়। সুপ্তি বিলি কাটছে আর বলছে,

— রাগ করে লাভ কি? প্রেম করিস ভালো তো। মাকে বলে আমি রাজি করিয়ে দেব?

— সত্যি করাবে?

— হু, ছেলেটা কে? কি করে? তুই না গার্লস স্কুলে পড়িস!

— হ্যাঁ ছেলেটার নাম তাওয়াফ । আমাদের স্কুলের সামনে রোজ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় ক্লাস নাইন থেকেই আমায় ফলো করছে। কখনো মুখে টু শব্দ বলে নি।

— তাই প্রেম হয়ে এলো!

— নাহ, তেমন নয়, সে দেখতে বেশ অগোছালো, অর্নাসে পড়ে। তোর সাথেই তো৷ অর্নাস ফাইনাল ইয়ারে। কিন্তু ক্লাস অফ করে আমায় একবার দেখে। একদিন প্রোপোজ করলো, আমি কষে থাপ্পড় দিলাম।

— তুই? ভয় পেলি না?

— না। মনে জোর ছিলো সে আমায় কিছু করবে না। তারপর সারা রাত ঘুমাতে পারি নাই। কি অদ্ভুত টান বল তো আপু! একেই কি ভালোবাসা বলে? আমি পরের দিন দেখি তাওয়াফ সেখানে নেই৷ বিশ্বাস কর সেদিন রাতে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেক কেঁদেছি।

— তারপর।

— তারপর পরেরদিন স্কুলে গেলাম, গিয়ে দেখি সে স্কুলের গেটে। আমি দৌড়ে গিয়ে আবার থাপ্পড় মারলাম। তারপর কেঁদেই দিলাম। তারপর অনেক জড়িয়ে ধরলাম।

— সবার সামনে?

— কি করবো! ভালোবাসি আমি তাকে।

— কতদিনের সম্পর্ক?

— এক সপ্তাহ। কাল নিয়ে দুই দিন রাতে দেখা করেছি। কালই প্রথম ওইভাবে আমায়….

কথাটা শেষ করতে পারলো না পিয়াশ ঠাটিয়ে চড় মারলো সুলতানা৷ উচ্চকণ্ঠে বললো,

— লজ্জা করে না! বয়স কত তোর, ১৫ মাত্র।

— এই বয়সে তোমারও বিয়ে হয়েছিলো মা!

— আবার মুখে মুখে কথা! তোর বিয়ের শখ। তোকে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দিতে আমার হাত কাঁপবে না। নষ্টামি করে ভালোবাসা বোঝাও।

পিয়াশের রক্তিম চোখ, যেন সে কোনো অপরাধ করে নি। এটা নৈতিকতার অংশ। সুলতানা আবারও হাত তুলতে না পেরে প্লেটের খাবার গুলো এক ঝটকায় ফেলে দিলো৷ বাসনের ঝনঝন আওয়াজ চারপাশে, কেউ কোনো কথা বলছে না।

সুপ্তি, সুলতানাকে নিয়ে বাইরে এলো। মায়ের এই ধরনের রুপ কখনো দেখি নি। সুলতানাকে চেয়ারে বসিয়ে পানির গ্লাস হাতে দিয়ে বললো,

— বাচ্চা মেয়ে মা!

সুলতানা শিউরে কেঁদে উঠলো৷ আঁচল দিয়ে নাক মুখ মুছে নিলো। নাক লাল হয়ে আছে তার। কেঁদে বললেন!

— কে বাচ্চা? পিয়াশ! দুই দিন পর ম্যার্ট্রিক পরীক্ষা। আমি ভেবে নিয়েছি মেয়ের জাত, বিয়ে দিয়ে দেবো। খুব তাড়াতাড়ি, কোনো দরকার নেই। কি দরকার আমার, বল? না হয় সবাই চলে যা, যেখানে দুই চোখ যায়, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো দুই মেয়ে মরে গেছে৷ অপমানের থেকে মরণ ভালো৷ মানুষ দেখিয়ে দেখিয়ে বলবে, ওই যে গলা কাটা তাওয়াফের সাথে উনার মেয়ে পালিয়ে গেছে, সহ্য হবে না। যা সবাই আমায় একা থাকতে দে৷ সর আমার সামনে থেকে।

সুপ্তি সরলো না মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। নিঃশ্বাস এর শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না।

রাত নয়টা বাজে। এমন সময় আমির সাহেব বুকে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে। মাথায় পানি ঢালছে সুলতানা। সুপ্তি হসপিটালে আর চাচাদের খবর দিয়েছে, নিজের দাঁড়োয়ানকেও ডেকেছে৷ আসছে না এখনো। পিয়াশের রুমে গিয়ে দেখে ফ্লোরে ভাতগুলো ঝড়ানো, পরিষ্কার করা হয় নি। পিয়াশের দিকে রাগী কন্ঠে উচ্চারণ করলো,

— অভিমান নিয়েই বসে থাক৷ বাবার অবস্থা ভালো না৷ সে খেয়াল আছে?

পিয়াশ নড়লো না, টেবিলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। রাগে হাত ধরে টানলো। যেটা দেখলো এর জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। সুপ্তি বিকট চিৎকার দিলো। সুলতানা ছুটে এলো। পিয়াশ ধারালো ছুড়ি দিয়ে নিজের গলা কেটেছে৷ রক্ত দিয়ে জামা লাল হয়ে আছে। রক্তাক্ত হয়ে আছে পিয়াশ। ধারালো ছুড়ি টা ফ্লোরে পরার টুং শব্দ হলো। আমির সাহেব ছুটে এলো। কতটা সাহস হলে গলায় ছুড়ি ধরতে পারে মানুষ। খুব তাড়াতাড়ি হসপিটালে নেওয়া প্রয়োজন। বাকিটা ঝাপসা চোখে কেউ দেখতে পারছে না। শব্দবিহীন শোক পালন করছে সবাই।

হসপিটালের বাইরে বসে আছে তিনজন মূর্তি হয়ে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। আমির সাহেবের ছোট ভাই আজিম অনেক দৌড়াদৌড়ি করছে। আজিম সাহেব ঢাকা জেলা পুলিশের অধিকর্তা৷ সুপারিটেনডেন্ড অব পুলিশ। (এসপি) সুইসাইড কেস হলেও পুলিশের সাহায্য ছাড়া হসপিটালে সমস্যা হয়। আজিম সাহেব লম্বা, মোটা মানুষ। উনার দেখলে চোর দৌড়ে পালাবে এমন মনে হয়। আগে ফর্সা হলেও এখন রং তামাটে৷ আজিম সাহেব প্রচুর রুক্ষ্ণ স্বভাবের। সাধারণ কথাও কেউ ধমক ভাবতে পারে। আজিম সাহেব ডাক্তারকে অনেকটা ধমকের স্বরেই বলেছে,

— এই অপারেশন এখনই হবে। বাচ্চা মেয়ে৷ ছুড়ি নিয়ে ম্যাজিক খেলা দেখাতে যাক বা সুইসাইড করুক। আইন আমাকে শেখাবে না৷ অন ডিউটি এসপিকে হ্যারাজমেন্ট করায় কেস ঢুকে দেবো। মানহানির একটা করবো বুঝাতে পারলাম নাকি পারলাম না?

ডাক্তার অনেক ঘামড়ে গিয়ে অপারেশন করাতে গেলো। আমির সাহেব বেশ কষ্টে আছেন,
তিনি ব্যাকুলতা নিয়ে বললো,

— ঠিক হবে তো রে সব?

— ক্যানো হবে না? লাশ জীবনে অনেক দেখেছো তুমি, আর আমি লাশ ফেলেছি। ডাক্তারকে মেরে ফেলে গুম কেস করে দেবো। আমায় চিনে না!

আমির সাহেব নিজের কথা ভুলে গেছেন, একটু আগে ব্যাথায় উঠতে পারছিলেন না এখন পায়চারী করছে চিন্তায়। এসপি আজিমের ফোন এলো। ফোন করেছে আয়ান, আয়ান মাত্র বছর খানেক কাজ করেছে তার আন্ডারে। প্রচুর মেধাবী, এই সাব-ইন্সপেক্টর আয়ান রহমান।
নতুন একটা কেসে যেতে হবে। আজিম সাহেব চলে যেতেন কিন্তু উপায় নেই যাওয়ার। কে যেন একটা মানুষকে কোদাল নিয়ে কুপিয়ে মেরেছে। পেছনের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে৷ কেসটা আয়ান হ্যান্ডেল করুক। পিয়াশ এর খবর আসা না পর্যন্ত কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। টেনশন হচ্ছে প্রচুর৷ অলরেডি আইজিপি স্যারের কল এসে গেছে, উনাকে কি বলা যায় ভাবছে আজিম সাহেব৷ পুলিশের নিজেরও পরিবার আছে, এটা কেন যেন সবাই ভুলে যায়। ভুলে যায় তাদেরও শরীর খারাপ হয়, প্রিয় জনের বিছানায় শুয়ে থাকলে দেখলে বুকটা ধুকপুক করে উঠে, চেনা মুখটায় রক্ত দেখলে পা অবশ হয়ে যায়। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে নিজের। চোখ বন্ধ করে দোয়া করলো, “হে সৃষ্টিকর্তা সুস্থ করে দিন। ও যে সেদিনের বাচ্চা মেয়েটা। মেয়ের মতো নয়, মেয়ে ভাবি আমি। সুস্থ করে দিন আমার মেয়েটাকে। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here