ম্যানহোলের_অতলে পর্ব-৩

0
884

ম্যানহোলের_অতলে
পর্ব-৩
লিখা : #এম_আর_রাশেদ এবং #মল্লিকা_জাহান

আকাশ মেঘলা, ঝুম বৃষ্টি নামলো বলে। বিষাদের জলকণা ঘনীভুত হয়েছে সমস্ত হৃদয় জুড়ে। সবার চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। মুখে কারো ‘রা’ শব্দটি নেই। প্রার্থনা সবার এক কেন্দ্রেই জড়ো, সুস্থ হয়ে উঠুক মেয়েটি। সুপ্তি তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে জিজ্ঞেস করছে,

— মা পিয়াশ সুস্থ হয়ে উঠবে তো? ও ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। ও হাজারটা অপরাধ করলে শাস্তি আমায় দিও মা। আমি কোনো প্রতিবাদ করবো না। কিন্তু তুমি বলো মা ওর কিছু হবে না, বলো!

সুপ্তির এই প্রশ্ন সুলতানার কাছে এখন পৃথিবীর সবথেকে কঠিন প্রশ্ন বলে মনে হচ্ছে। এর কোনো উত্তর জানা নেই। নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। আজ যদি বিষ মিশ্রিত সেই কথার ফলায় মেয়েকে বিদ্ধ না করতো, তবে এমন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হতো না। ছোট্ট মেয়ে, এতোটা কড়া করে না বলে বুঝালেও তো পারতো! কিন্তু এখন তো নিরুপায়। মুখে আঁচল গুঁজে, সে নিজেও কেঁদে চলেছে।
সুপ্তির বাবা আমির সাহেব দেয়ালের একপাশে দাড়িয়ে বুকে পাথর চেপে নিভৃতে অশ্রু ঝড়াচ্ছে। পুরুষও তো কাঁদে।
ঘড়ির কাটা চক্রাকারে আবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে দীর্ঘশ্বাসও বেড়ে চলেছে।
হঠাৎ অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টরের আগমন। নিঃশ্বাস যেন সবার গলায় আটকে যাবার উপক্রম। এই বুঝি কোনো সুসংবাদ অথবা অঘটন ঘটতে চললো।
সুপ্তি দৌড়ে ডক্টরের কাছে গেলো। সুলতানা বেগম, আমির শেখ, সুপ্তির চাচা পেছন পেছন গেলো। সুপ্তি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে পাহাড় সম জড়তা নিয়ে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করল;

— ডক্টর পিয়াশের কি অবস্থা, ও ঠিক হয়ে যাবে তো? বলুন ডক্টর আমার বোন ঠিক হবে তো? বলুন না!

একরাশ গম্ভীরতা, প্রিয়জনের তীব্র প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে চিরন্তন সত্যটা জানাতে সামান্য হলেও কুণ্ঠিত হয়। তবুও সব জড়তা উপেক্ষা করে বলে ওঠে;

— পিয়াশ এখন সুস্থ-অসুস্থের আবর্তিত চক্রের উর্ধ্বে চলে গেছে। সে আর ফিরবে না। চলে গেছে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে।

কথাগুলো শুনতেই সুপ্তি নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনা। মনে হলো বুকের পাঁজর ছিঁড়ে কেউ কলিজার অর্ধাংশ কেটে নিলো। জোড়ালো চিৎকারে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সুপ্তিকে তাৎক্ষণিক হসপিটালের নার্সরা কক্ষে নিয়ে যায়। সুপ্তির মা সুলতানা বেগম আর্তনাদের ফেটে পড়ে। আমির সাহেব এবার কন্ঠ রোধ করে নিভৃতে কাঁদতে ব্যর্থ। একটা গামছা দিয়ে ভেজা শরীর মোছা হলে শরীরের প্রতিটি বিন্দু কণা শুষে নেয়। কিন্তু সেই গামছার জল যখন আধিক্য পরিণত হয় তখন শুষ্ক শরীরও ভিজিয়ে দেয়। তার ছোট ভাই আজিমের গলা জড়িয়ে ধরে উচ্চস্বরে পিয়াশ বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।
প্রশাসনের পোশাক পড়ে দেহকে সাধারণ থেকে আলাদা করা যায়, কিন্ত হৃদয়কে আলাদা করা যায় কোন মহিমায়? বড় ভাইয়ের এমন তীব্র আর্তনাদ, আর নিজ ভাতিজীকে হারিয়ে এবার আজিম সাহেব নিজেকে আর দমাতে পারলেন না। চোখের বাঁধ তীব্র চাপে ফেটে পড়লো। আমির সাহেবকে জড়িয়ে ধরে তিনি নিজেও কাঁদতে লাগলেন। যার হারিয়ে যায় সেইতো বোঝে হারানোর ক্ষত কতটা গভীর। এক সপ্রতিভ আলোক বস্তু নিভে যায় চোখের পলকে।

আজিম সাহেব নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলেন। এই মুহুর্তে সে নিজে ভেঙে পড়লে হবেনা বরং সবাইকে সান্ত্বনা দেয়া প্রয়োজন। ছোট্ট মেয়ে, আত্মহননের মতো এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় সবাই মর্মাহত, বাকরুদ্ধ। পিয়াশের বাবা কোনো ভাবেই চাইছিলেন না যে তার মেয়ের পোস্টমর্টেম হোক। এমনিতেই প্রচন্ড আঘাতে জর্জরিত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে। তার উপর মরে গিয়েও আবার সেই কাটাছিড়া, এটা যেন কোনো ভাবেই মানতে নারাজ।
যেহেতু আজিম সাহেব নিজেই পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সেহেতু তেমন কোনো বাঁধা বিঘ্নতা ছাড়াই হসপিটালের যাবতীয় ঝামেলা আড়ালে মিটিয়ে নিলেন। লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স আনা হলো। সুপ্তির জ্ঞান ফিরতেই কান্নার আর্তনাদে ফেটে পরে।
কোনো রকমে সুলতানা বেগম, সুপ্তিকে গাড়িতে তুলে দেয়। আজিম সাহেব তার বড় ভাইকে নিয়ে রওয়ানা দেয়।
অ্যাম্বুলেন্স নামক চলন্ত যন্ত্র আর্তনাদ বয়ে ছুটে চললো বাড়ির অভিমুখে। হসপিটালে বসেই আজিম সাহেব ফোনে আত্মীয়দের খবর দেন।

বিষাদের জল কণা আকাশেও যেন আজ সইলো না। ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। গাড়ির চাকা আর পীচ ঢালা রাস্তার ঘর্ষণের সাথে তৃপাক্ষিক হয়ে যোগ দেয় অবিরাম বৃষ্টি, সাথে এক অদ্ভুত রকমের শব্দ। এই শব্দটা সুপ্তির অচেনা নয়, বরং চেনা এবং এখন বেদনারও বটে। সে ভাবনাতে হারিয়ে যায়। এইতো সেদিনের কথা, পিয়াশ তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। স্কুল ছুটির একটু আগেই সুপ্তি পিয়াশ কে আনতে যায়। আকাশ মেঘলা ছিল তাই সুপ্তি ছাতা নিতে ভোলে না। ছুটির পর বৃষ্টি শুরু হলো। ছাতা মেলে পায়ে হেটে ওরা দু’জন বাসায় ফিরছে। মাঝে মধ্যে রাস্তার উঁচু নিচু জাগায় জমে থাকা পানিতে পিয়াশ ঝপাৎ করে লাফ দিয়ে নিজে তো পুরো ভিজে যায় আর সুপ্তিকেও নাজেহাল করে ছাড়ে। পারলে তো পিঠের উপর কিল লাগিয়ে দেয়! পিয়াশও বেশ চৌকস, তখন সুন্দর দাঁতগুলো বের করে খিলখিল করে হেসে ফেলে। এখানেই সুপ্তির দূর্বলতা অজান্তে নিজেও হেসে ফেলে। একটা প্রাইভেট কার পাশ দিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই পিয়াশ বলে ওঠে;

— আপু শোন শোন শব্দটা কি সুন্দর!

— এখানে সুন্দরের কি হলো?

— সুন্দরই তো। তুই তো বুঝিস না। আমার অনেক ভালো লাগে কেনো জানিস?

— কেনো?

— গাড়ির চাকা, পীচ ঢালা রাস্তা আর বৃষ্টির শব্দ একসাথে হয়েছে তাই।

সুপ্তি ওর কথা শুনে নীরবেই হাসে।

সেদিন হয়তো পিয়াশের বলা ওই শব্দের ভাষাগুলো গুলো বুঝতে পারেনি। আজ ধীরচিত্তে সেইসব কথনগুলো ভেসে উঠছে মনের কিনারায়। ভাবনায় ছেদ পড়তেই আবার কান্নায় লুটিয়ে পড়ে সুপ্তি।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাড়িতে অসংখ্য মানুষের ভীর আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীতে ভরে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স বাড়ির সামনে পৌছুতেই কান্নার মাতম পড়ে যায়।
সুলতানা আর সুপ্তিকে আত্নীয়স্বজনরা ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। আজিম সাহেব আমির সাহেবকে পুলিশের গাড়িতে করেই নিয়ে আসে। পুরো বাড়ি বিভীষিকাময় আর্তনাদে ছেয়ে গেছে। সুপ্তির বড় ফুপি মেহেরুন্নেছাকে তার বড় ছেলে সজল ফোন দিয়ে পিয়াশের ব্যাপারে জানিয়েছে। তারা সবাই এসেছে। সজল সুপ্তির কাছে গিয়ে কান্না স্বান্তনা দিতে ব্যস্ত।
আজিম সাহেব নিজেকে শক্ত করে বাকীদের স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠল।
এমন মর্মাহত সময়ে ফোন রিসিভ করা সবথেকে বিরক্তিকর বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও রিসিভ করতেই অপর দিক থেকে বলে ওঠে;

— হ্যালো স্যার আয়ান বলছি। আপনি এখন কোথায়?

— হ্যাঁ আয়ান, আমি আমার বড় ভাইয়ের বাড়িতে এসেছি। আমার ছোট ভাতিজী সুইসাইড করেছে। (বলতেই গলা ভার হয়ে এলো)

— আয়ান দুঃখ প্রকাশ করে বললো; স্যার নিজেকে শক্ত রাখুন নিশ্চয়ই এটা মর্মাহত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। কিন্তু যেটা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেঙে পড়বেন না। বাকীদের সান্ত্বনা দিন। স্যার আমি কি ওখানে আসবো?

— তুমি আসলে আমার অনেক ভালো হয়।

— আপনি একটু অপেক্ষা করুন স্যার আমি আসতেছি।

আয়ান রেইনকোট পড়ে বাইকটা নিয়ে রওয়ানা হয় আমির সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্য। বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। প্রতিটি মৃত্যুই আয়ানের নিকট এখন সাধারণ মনে হয়। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে মানুষ স্থির হয়ে যায়। মৃত্যু চিরন্তন শুধু কারণ গুলোই বিচিত্র। কেউ আত্মহত্যা, কেউ অপঘাতে, কেউ রোগে, কেউ ভুগে শেষে একটা শব্দেই দাঁড়ায়, সেটা মৃত্যু।
বাতাসের ঝাপটায় মৃদু বৃষ্টির জল কণাও জোরালোভাবে রেইনকোটে লেগে চুইয়ে চুইয়ে নীচে পড়ছে। বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে সেখানে পৌছে যায়।
আয়ানকে দেখে আজিম সাহেব কিছুটা স্বস্তি পেলো। ছেলেটা কাজে অনেক দায়িত্বশীল বলেই বীনা দ্বিধায় ভরসা করা যায়।
মৃত বাড়িতে আত্মী-স্বজনের সহায়তায় কর্মযজ্ঞ চলছে। অসংখ্য মানুষ এসেছে শেষবারের মতো দুরন্তপনা এক মেয়ের মুখখানি দেখতে। সহপাঠীরাও দলে দলে এসে ভীর জমিয়েছেল। সবার মুখে গম্ভীর ভাব। পরিবারের লোকজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার অবিরত চেষ্টা চলছে। আয়ান ভীর ঠেলে আজিম সাহেবের কাছে গিয়ে কথা বলল। লাশটা দেখার জন্য আয়ান এগিয়ে যায়। যেহেতু সে নিজেও একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাই কাটা অংশটুকু পর্যবেক্ষণ করতেই চমকে যায়। আজিম সাহেবের কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করে স্যার লাশের কি পোস্টমর্টেম হয়েছে? আজিম সাহেব সংকুচিত ভাবে প্রতুত্তর দিলেন;

— না পোস্টমর্টেম হয়নি। কেনো কি হয়েছে?

— স্যার পিয়াসের লাশটা দেখে আমার কেনো যেন খটকা লাগছে। আপনার তথ্য মতে পিয়াশ আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আমি পিয়াশের গলার ক্ষতটা পর্যবেক্ষন করেছি। যদি আত্মহত্যা হয় তবে গলায় যে গভীর ক্ষতটা আছে সেটা কি করে সম্ভব? ভাবুন তো কেউ নিজে থেকে আত্মহত্যা করতে চাইলে নিজের গলায় এতোটা গভীর ক্ষত কিভাবে তৈরি করতে পারে? তার আগেই সেন্সলেস হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশী। আর দেখে মনে হচ্ছে হুট করে একটানে কাটা হয়নি ধীরে ধীরে কাটা হয়েছে।
আজিম সাহেব এমন তথ্যে ভরকে যান যেহেতু পোস্টমর্টেম হয়নি তাই জানার উপায়ন্তর নেই। আর নিজেদের লোক বলে শোকেই মাতম ছিলেন। কিভাবে কি হয়েছে তা নিয়ে ভাবার অবকাশই পায়নি। বাচ্চা মেয়ে হাতে ছুড়িও ছিল। সেই অনুযায়ী যা দেখেছে শঙ্কাও সেই দিকে ধাবিত হয়েছে। বাড়তি কিছু ভাবেনি। দ্রুতপদে পর্যবেক্ষণের জন্য পিয়াশের লাশের দারপ্রান্তে হাজির হয় আজিম সাহেব। দেখে তিনি নিজেই চমকে যান। অচিরেই ভাবতে লাগলেন, তবে কি এটা খুন??

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here