#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_১
Afsana Asha
কবুল বলার মাত্র একুশ ঘন্টা পরেই তালাকের জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে এলো অনি।
এতে অবশ্য গিনেস বুকে নাম উঠবে না,
সবচেয়ে দ্রুততম তালাকের রেকর্ড অনি-ইমরানের হবে না।
কুয়েতি এক দম্পতির নাম আগেই উঠে গেছে বিশ্বরেকর্ডের এই তালিকায় সবার আগে, বিয়ের মাত্র তিনমিনিটের মাথায় সেই কুয়েতি বর-কণে একে অন্যের কাছ থেকে নিষ্কৃতি চান।
বিয়ে হওয়ার পরপর তখনো কোর্টরুম ত্যাগ করেনি কেউই, সদ্য পরিণীতা সারাদিনের ক্লান্তি বা অন্যকোনো কারণে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তার রাজকুমার তাকে ধরে বুকে নেওয়ার বদলে ‘স্টুপিড’ শব্দখানা বেশ চিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করে বসে।
তখনি, কন্যা বর নির্বাচনে নিজের সিদ্ধান্তের ভুল বুঝতে পারে, মহাখাপ্পা হয়ে সেই কাজির কাছেই তালাকের আবেদন করে সেইমূহুর্তেই।
বরের চিড়বিড়ানির সাথে তারও হয়তো অন্য কোনো কিটকিটানি ছিলো। নয়তো আত্মমর্যাদাবোধের পারদ ছিলো আকাশছোঁয়া উচ্চতায়।
ডিভোর্স দিতে এমনিতেও আজকাল কোনো কারণই লাগে না। বউয়ের আক্কেলমাড়ির দাঁত কেন ওঠেনি, বরের গায়ে কেন ঘামের গন্ধ এই অজুহাতেও তালাক দিয়ে দেওয়া যায়!
রিকশা থেকে নেমে ইমরানের পেছন পেছন নিজের পায়ে হেঁটে যাত্রাবাড়ীর কলাপট্টির কাজি অফিসে ঢুকল অনি । এক কামরার অফিসঘর। একটা কাচঢাকা দেওয়া কাঠের টেবিল, টেবিলের একপাশে কালো রঙের কাঠের চেয়ার। আর টেবিল ঘিরে কয়েকটা মেটাল চেয়ার। পাঁচটা চেয়ার আছে, গুণে ফেলল ও। চার হলে ভালো হতো। চার বা চারের গুণিতক সংখ্যাগুলো খুব ভালো লাগে ওর। ও ভাত নেওয়ার সময় চার চামুচ নেয়। অল্প খেলে অল্প অল্প করে চার চামুচ, তবুও চার চামুচই লাগবে। চারপিস মাংস লাগবে বা চারচামুচ ডাল। মাংস কম থাকলে ছিঁড়ে চারটুকরো করে নেয়। হাঁটার সময় চারপা, আটপা করে গুনে চলে। পরীক্ষার খাতায় চার নাম্বার প্রশ্নের উত্তর আগে লেখে। চারটা বা আটটা শিটের ভিতর উত্তর লিখে শেষ করে।
হাত থেকে কিছু পড়ে গেলে চারবার সালাম করে। চারবার না হলে মনের ভিতর খুটখুট করতে থাকে। অনেকবার চেষ্টা করেছে তবুও এই চারের চারব্যুহ থেকে বেরোতে, কিন্তু পারেনি।
এখনো ভুঁরু কুঁচকে গেল, পাঁচনাম্বার চেয়ারটা সরিয়ে ফেললে অস্বস্তি দূর হতো।
এককোণে একটা রঙওঠা স্টিলের আলমারি দেখা যাচ্ছে, তার উপরেও দুনিয়ার কাগজপত্র, ফাইল উঁকি মারছে। আলমারি ঘেঁষে কয়েকটা রেক্সিনে মোড়া সোফা রাখা। কোণায় কোণায় হলদেটে ময়লা ফোম বেরিয়ে আছে। একটার স্প্রিং বসে গিয়ে দেবে আছে। তবুও এখানে চারটাই আছে। একটা ছোট শ্বাস নিয়ে সেখানে বসে পড়ল ও, বসেই চারিদিকে চোখ ঘুরাতে লাগল।
সামনের সোফাতে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা রাণিগোলাপি রঙের শাড়ি পরেছে। মাথায় ছোট একটা ঘোমটা। খোপার গোলাপ বেরিয়ে আছে। হালকা দুগাছি চুড়ি হাতে। হালকা সাজে লাজুক দেখাচ্ছে। নিজের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হলো ওর। একদম গেঁয়ো দেখতে অনি। লম্বা চুলে কলাবেণি বাঁধা ছিলো, ওর মা টেনে ধরে সেন্টারসিঁথি করে খোপা করে দিয়েছে। গলায় ভারি একটা সোনার নেকলেস, কানে বড় ঝুমকো। গেঁয়োভাবটা আরও প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে।
সামনের মেয়েটা হালকা সাজেও কত উজ্জ্বল! লজ্জা, কিছুটা টেনশন, হয়তো একটু অপরাধবোধ চোখেমুখে লাগিয়ে দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে। আর কী সপ্রতিভ! পাশে বসা ছেলেটার সাথে টরটর করে কথা বলে যাচ্ছে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। একপাশে কাঁত হয়ে কথা বলার সময় কাঁধের লুজফিট ব্লাউজ সরে গিয়ে মিসম্যাচ ব্রার স্ট্রাপ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা তাতে একটুও আড়ষ্ট না। এত আস্তে কথা বলে যাচ্ছে যে দুহাত দূরে বসা অনিও কিছু শুনতে পারছে না।
এখানে যদি ও নিজে হতো, গলার আওয়াজে পাড়া কাঁপত, ভাবল অনি।
মেয়েটার পাশে বসা ছেলেটাই সম্ভবত বর। সেও লজ্জা পাচ্ছে মনে হচ্ছে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। এরা হয়তো বাবা মাকে লুকিয়ে বিয়ে করতে এসেছে!
মানুষ গোপনে বিয়ে করে আর ওর হচ্ছে গোপন তালাক!
মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে ঘূর্ণিঝড়ের মতো করে। বাতাসে অনির জামা ওড়না উড়ে যাচ্ছে। ও ভালো করে ওড়নার সাইড চেপে ধরে গুটিয়ে বসল। ইমরান ওর পাশে বসার সাথে সাথেই কাজিসাহেব এসে ঢুকলেন। এই কাজিই গতরাতে ওদের বিয়ে পড়িয়েছিলেন!
চেয়ারে বসেই উনি সামনের জুটিটাকে ডাকলেন। ওরা উঠে যেতেই আরও কয়েকজন হুড়মুড় করে ঢুকল, ঢুকে তিনজনে তিনটে চেয়ারও দখল করে বসল। আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকল।
‘পিচ্চি?’ ইমরান ডাকল অনিকে। আসলেই ইমরানের তুলনায় অনিকে পিচ্চিই বলা যায়। ইমরান পঁচিশ আর অনি পনেরো।
ইমরান তাগড়া যুবক, টগবগ করে ফুটছে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার, লক্ষ্য পূরণের, অদম্য তাড়না। বড় স্বপ্নের সাথে সেই স্বপ্নপূরণের সম্ভাব্য সব চেষ্টা। অন্যদিকে অনির বাইরে-ভেতরে এখনো বালিকাসুলভ ছটফটানি, কিশোরীর আদুরে চপলতার গন্ধমাখা। ঢাকার অদূরে ফসলের মাঠের বুনো গন্ধ, কিষাণির আদরে তরতর করে বেড়ে ওঠা সবুজ ধানের ডগার জংলি সুবাস ওকে ছেড়ে যায়নি এখনো।
টলটলে চোখে যখন তাকায়, স্বচ্ছ জংলা নদীর মতো, অগভীর সেই নদীর ঠান্ডা জলের ভিতর পা ডুবিয়ে দিতে ইচ্ছে করে কিন্তু গভীরে যেতে মন ডাকে না!
খাকি রঙের গ্যাবার্ডিন প্যান্টে ঢাকা নিজের উরুর উপর আঙুলের আঁকিবুঁকি করতে করতে ইমরান গাঢ় স্বরে বলল, ‘দেখ, পিচ্চি, আমার কিছুই করার নেই। করার ছিলোও না। আমার এব্রোড ভিসা কিছুতেই পেতাম না, আব্বা যদি ফাইন্যান্স গ্যারান্টার না হতেন। তুই মনে কষ্ট নিস না, যেটা সত্যি সেটাই আমি বলছি। আজ তুই হয়তো মন খারাপ করবি, কিন্তু যখন বড় হয়ে যাবি তখন দেখবি আমি যা করছি তাতে তোর ভালো, আমার ভালো, সবার ভালো।’
অনির এতো ভালো ভালো আর ভালোর কথা বিরক্ত লাগছে। ওর কান্নাও পাচ্ছে। সারা গ্রামের আদুরে অনি, সবার চোখের মণি আহ্লাদী অনি, কান্না আটকাতে রেজিস্ট্রি অফিসের ময়লা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকল।
ইমরান অনির দিকে তাকায় ভালো করে। কালোঘেঁষা মেয়েটা। কিন্তু মুখশ্রী সুন্দর। সেই সুন্দর ওর চোখে ধরা দেয় না। একটু গেঁয়ো, জংলী ছাপই বরং স্পষ্ট। ইমরানের মন খারাপ হয়। ভার্সিটি টপার, স্মার্ট আর ভীষণভাবে ক্যারিয়ার ফোকাসড ছেলের জন্য এই মেয়েকে খুঁজে এনেছে ওর মা!
সবসময়ই ওর সাথে এমনটাই হয়। মার্কেটিংয়ে পড়ার খুব আগ্রহ ছিলো।
নতুন নতুন মার্কেটিং স্ট্রাটেজি, ক্যাম্পেইন, এডভারটেইজমেন্টগুলো খুব টানত।
কিন্তু গড়পড়তা বাঙালি বাবা-মায়ের চোখ আটকে থাকে ওই ডাক্তার নয়তো ইঞ্জিনিয়ার, আর ওইদুটোকে কেন্দ্রে রেখে চারিদিকে চক্কর দিতে থাকে। ইমরান অনেকখানি জোর করেই, কান্নাকাটি, অনাহার অনশনের বিনিময়ে কমার্স নিয়ে পড়ার অনুমতি পেয়েছিল। আর তাতেই যেন ও বিক্রি হয়ে গেছে একেবারে। বাবা মা যা ইচ্ছা তাই করেছে ওর সাথে – এতটা যে, জেদের মতো দেখাচ্ছে। সব কথা বাধ্যগত সন্তানের মতো মেনেও নিচ্ছে ইমরান।
জাপানের তোহোকু ইউনিভার্সিটিতে হান্ড্রেড পার্সেন্ট টিউশন ওয়েভারে পোস্ট গ্রাজুয়েশন এর সুযোগ পাওয়াটা যেন বাবা মাকে একটু গর্বিত করবে ভেবেছিল ও কিন্তু হয়েছে অন্যরকম।
সবসময় পড়াশুনা, কো কারিকুলামে ব্যস্ত থাকায় পরিবারের সাথে সময় দিয়েছে কম। একসাথে আড্ডা দেওয়া হয়নি, তাড়াহুড়ায় সকালের নাস্তা হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা দৌঁড়ের উপর, লাঞ্চটা টিফিনবক্সে নইলে ক্যান্টিনে আর ডিনারও বইয়ে মুখ গুঁজে।
বিয়ে, জন্মদিন, মরাবাড়ির জটলায় ওকে পাওয়া যায়নি। একসাথে বসে সিনেমা দেখেনি, শপিঙে যায়নি, ঘুরতে যাওয়ার সময় কোনো না কোনো ক্লাসটেস্ট নইলে অন্তত ডিবেট কম্পিটিশন এসে বাগড়া দিয়েছে। কারও কান্নায় ও কাঁধ এগিয়ে দেয়নি, নিজের আনন্দের ভাগ কাউকে উজাড় করে দেয়নি।
ফলে নোটিশ বোর্ডের রেজাল্টশিটে একেবারে প্রথম হতে হতে পারিবারিক হৃদ্যতা, পারস্পারিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক এসে তলানিতে ঠেকেছে।
স্কলারশিপটা পাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই ইমরানের মা সাইদা কঠিনভাবে বেঁকে বসলেন। তার মনে এক আজব ধারণা গেঁড়ে বসল যে, ইমরান আর কখনোই দেশে ফিরবে না!
দেশের প্রতি, বাড়ির প্রতি, পরিবারের জন্য, মায়ের জন্য কারো জন্যই ওর কোনো টান নেই, এতো প্রমাণিত সত্য।
বোন ইমার যেদিন ছেলে হলো, সি সেকশন করা লাগল, ব্লাডের জোগাড়ে কত দৌঁড়াদৌঁড়ি, অথচ ইমরানকে কোথাও পাওয়া যায়নি, সেদিন ওর কুইজ টেস্ট ছিলো। সাইদা নিজে যেদিন পড়ে গিয়ে পা ভাঙল, ছোটোটা ইকরাম ফোন করেছিল ওকে, উদাস কন্ঠে ও নাকি বলেছিল ‘আমি এসে কী করব, ডাক্তার দেখছে, ফ্রাকচার হলে প্লাস্টার করে দেবে। বাড়ি নিয়ে চলে আসবি।’
ছেলের যতই মায়ের প্রতি টান না থাকুক, হাজারটা অভিযোগই নাহয় থাকুক সাইদার, শত শত অভিমানেই ভাসুক তবুও হাত বাড়ালে ছোঁয়া তো যায়, ঘুমিয়ে থাকা মুখটা দেখে কলিজা ঠান্ডা হয়, ইমরানের পছন্দের খাবার রান্না করেই মাতৃস্নেহ তৃপ্ত হয়।
জাপান যাওয়ার খবরটা পেয়েই তাই আঁতকে উঠেছিলেন সাইদা। তিনি ঠিক জানেন, ইমরান আর দেশে ফিরবেই না।
পাখি উড়াল দিলে আর কি খাঁচায় ফেরে? অসম্ভব, ইমরান আর আসবে না দেশে!
নিজের মনে ভেবে ভেবে অবশেষে সমাধান বানিয়েছেন, জাপান যাওয়ার আগেই বিয়ে দেবেন ছেলেকে।
আর একেবারে ফটফট করা শহুরে মেয়ে না, একটু সুন্দর, ছোটোখাটো, দুনিয়াদারি কম বোঝা একটা মেয়ে চাই তার ইমরানের বউ করতে।
যে কীনা একটু মায়ের আঁচলে ঝুলাঝুলি করে এখনো, সহজে ইমরানের কথায় সুদূর পরবাসে পাড়ি জমাবে না, দেশেই থাকবে আর স্বামীকেও রাখবে, ঠিক এমন একটা মেয়ে চাই তার।
ঠিক এমন পেয়ে গেলেন অনিকে। একটু বেশিই ছোটো বয়সে। কয়েকবার মন এদিক সেদিক গেলেও শেষটা অনির লোভ আর ছাড়াতেই পারেননি।
একরকম স্বামী, পুত্র, কন্যা সবাইকে জোর করিয়ে মত করে নেন।
এদিকে অনির মাও প্রথম প্রথম নিমরাজি ছিলেন, পরে বড় ঘর-বর দেখে মেয়ের বয়স ভুলতে পেরেছেন।
কিন্তু বাপমরা মেয়ের বড়ভাই পরশ পিতৃসমান অধিকারে বেঁকে বসেছিল, তার ভাষায় ‘এতটুকু’ বোনের বিয়ে দিতে কিছুতেই রাজি ছিলো না। রীতিমতো হুংকার করছিল।
বহুকাঠখড়ই পোড়াতে হয়েছে এই বিয়েতে সবাইকে রাজি করিয়ে শুভকাজ ঘটাতে, দুজনকেই, সাইদাকেও, অনির মা সুমনাকেও।
কিন্তু সেই কাঠখড় পোড়ানো আগুন জ্বলে প্রজাপতির যজ্ঞ হওয়ার আগেই পানিতে চুবিয়ে দিতে এসেছে ইমরান নিজেই। বিয়ের রাত পেরুতেই তালাকের আয়োজন সুসম্পন্ন হওয়ার অপেক্ষা!
‘অনি, আমি অনেক চেষ্টা করেছি মাকে বোঝাতে, এই বিয়েটা আমি করতেই চাইনি বিশ্বাস কর। কিন্তু মা কিছুতেই শুনল না। আমি যে স্কলারশিপটা পেয়েছি, সেটা আসলে টিউশন ওয়েভার। আমি বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ পাবো কিন্তু আমার থাকা, খাওয়া, অন্যান্য খরচ আমাকেই দিতে হবে। জাপান সরকারকে আমার নিশ্চয়তা দিতে হবে যে সেই খরচটা আমি বহন করতে পারব। ন্যুনতম এমাউন্টটা ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখাতে হবে। আব্বা সেই গ্যারান্টি দিচ্ছেন। আমার খুব দরকার ছিলো এটা। তুই কি বুঝতে পারছিস, পিচ্চি?’
কান্না চাপার প্রচেষ্টায় চোখমুখ লাল করে মাথাটা উপর-নিচ করে অনি। বুঝছে ও সবই।
ওর দিকে তাকিয়ে ইমরান আবার বলে ‘পিচ্চি, তোর সাথে আমার কিছু ম্যাচ হয় না। আমরা একসাথে থাকার জন্য তৈরিই হইনি। আমরা দুজন একসাথে থাকাটা একেবারেই অসম্ভব। বুঝতে চেষ্টা কর। বয়সে তুই কতটা ছোটো, আমার থেকে। বুদ্ধিতে ছোটো, তোর তো এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি। পড়াশুনোয়ও তুই কত ছোটো, আমার সাথে তুলনা করাও যায় না। নাইনে না এখন?’
‘হ্যাঁ’ কান্নাচাপা গলায় বলে অনি।
‘ফাইনালে তো একটায় ফেইলও করেছিস?’
অনি চুপ করে থাকে।
‘ আমার সাথে তোর যায় না। আমরা কখনোই ভালো থাকব না। বুঝতে পারছিস?’
‘হ্যাঁ, আপনি একদম ফর্সা আর আমি কালো।’ অনির বড় বড় দুই চোখ ছাপিয়ে পানির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে তখন।
অনির কথা শুনে অবাক হয় না ইমরান। হেসে ফেলে। এটাও সত্যি। নাক,চোখ,মুখ সুন্দর হওয়ায় ওকে রূপবতীদের কাতারে ফেলে দেওয়া যায় অনায়াসেই, কিন্তু ইমরানের পাশে দাঁড়ালে নিতান্তই কালো রঙটাই চোখে পড়বে সবার আগে।
ইমরান ফর্সা, খাওয়া নিয়ে আলগা আহ্লাদ না থাকায় শরীরে মেদ জমতে পারেনি, একহারা গড়ন, বেশ সুপুরুষ।
কিন্তু ওটাই শুধু পার্থক্য করে না, অনি আনস্মার্ট, কথা আঞ্চলিকতাদুষ্ট, মানসিকভাবে অপরিপক্ক – নিতান্তই ভালো না বাসলে ইমরানের মতো স্মার্ট, মেধাবি ছেলের ওকে ভালো লাগার কোনো কারণই নেই। কোনোদিকেই অনি ওর সমকক্ষ না।
আর ইমরান তো ওকে ভালোবাসে না। পছন্দই করে না। ইনফ্যাক্ট, পড়াশুনা ছাড়া এইমুহূর্তে ও কাউকেই ভালোবাসে না। অনি শুধুই একটা উটকো ঝামেলা ওর কাছে।
নিজের হতাশা চেপে ও অনিকে সুন্দর করে বোঝাতে চাইল শুধু, কোনোভাবেই ওরা দুজন একসাথে থাকতে পারে না। এই বিয়েটা স্থায়ী হতে পারে না।
‘কাঁদবি না পিচ্চি। আজকে তোর কান্না পাচ্ছে। কিন্তু একদিন বুঝবি, আমি তোর উপকার করেছি। আমি তোকে ভালোবাসি না। তোকে বিয়ে করতে চাইনি। বিশ্বাস কর, আমি চেষ্টা করেছি বিয়েটা আটকানোর। মা এত তাড়াহুড়ো করল যে আমি ভালোমন্দ কিছু ভেবে অন্য কোনো উপায় বেরই করতে পারলাম না।’
অনিকে ওড়নার কোণায় নাক মুছতে দেখে ইমরান বিরক্ত হলো। পকেট থেকে এক টুকরো ফেসিয়াল ট্যিস্যু বের করে দিতে দিতে বলল ‘এতো কান্নাকাটির কী আছে, অনি? আমি তো কাল রাতে তোকে সব বুঝিয়েই বলেছি। আমি ইচ্ছে করলে এই বিয়েতে তোকে আটকে রেখেই যেতে পারি। আমার কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু ক্ষতিটা তোর হবে। সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে। আর কেউ না জানুক, তুই তো জানলি, তুই কোনো সম্পর্কে বাঁধা নেই। তুই স্বাধীন। তোর জীবন তুই তোর ইচ্ছেমতো চলবি, ইচ্ছেমতো কাটাবি। মনমতো সঙ্গি বাছাই করবি।’
অনি চোখ তুলে তাকায় না। কথা বলে না। ইমরানই বুঝানোর চেষ্টা করে যায় ‘তুই আজকে বুঝবি না, পিচ্চি। আজকে আমার উপর রাগ করবি। আজকে তোর কষ্ট হবে। আমি যা করছি, তোর ভালোর জন্যই।’
‘আমি তো আপনারে ডিস্টার্ব করতেছি না। কসম, কোনোদিন করুম না। ডিভোর্সের কী দরকার? আপনে যাইতেছেন, যানগা।’
‘তা করা যায়। তাতে সমস্যাটা তোর। আমি কবে ফিরব, ঠিক নেই। বাড়িটা আমার কাছে জেলখানার মতন। আমার মুক্তি চাই। মুক্তি আমি তোকেও দিয়ে যেতে চাই। আমার নামের সাথে জুড়ে থাকলে, জীবনে তো এগোতে পারবি না। তখন এই নামটাই তোর কাছে কারাগারের মতন হবে। নামসর্বস্ব সম্পর্ক তোর পায়ে শিকল জড়িয়ে রাখবে।’
অনির মাথায় হাত রাখে ইমরান। হুল্লোররত বিয়েপার্টির দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে ‘আয়, আমাদের সময় হয়ে গেছে। আমি এভাবে তোকে না এনে, জাপান গিয়েই ডিভোর্স নোটিশ পাঠিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু তাতে করে তোর অপমান হতো বেশি। তোর এক্সপেক্টেশন বাড়ত, আমার নামের সাথে এটাচমেন্ট তৈরি হয়ে যেত। অনেক কষ্ট হতো তোর। প্লিজ, এভাবে কাঁদিস না। আমার অপরাধের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের বাবা, মা আর ছেলের জেদাজেদির মাঝখানে এসে পড়েছিস তুই।’
অনি এত কথা বোঝে না। এত বড় বড় কথা বুঝতেও ইচ্ছে করে না। যাদের তালাক হয় তাদের অনেক কষ্ট। ওদের গ্রামে, উত্তর পাড়ার জরিফুফুর স্বামিও জরিফুফুকে তালাক দিয়েছে। মা-বাপ নেই, ভাইয়ের সংসারে দিনরাত খেটে দুটো খেতে পায়। কোনো বিয়ে-শাদি আনন্দ অনুষ্ঠানে জরিফুফুকে কেউ ডাকে না।
সীমা আপা, রিমা আপার বিয়েতে অনি থাকবে না, ওকে কেউ ডাকবে না, এইকথাটা মনে আসার সাথে সাথেই তো আঁতকে উঠল অনি!
ওর ইচ্ছে করছে ইমরানের পাদুটো জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তাতে কি ইমরানের সিদ্ধান্ত বদলাবে?
চলবে….