যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে #পর্ব_১৫,১৬

0
909

#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_১৫,১৬
Afsana Asha
পর্ব_১৫

মায়ের দোয়ার জোর না থাকলেও বদদোয়ার জোর অবশ্যই উসাইন বোল্টের গতিতে দৌঁড়োয় আর হক আইয়ের মতো তড়িৎ গতিতে নির্ভুল লক্ষ্যভেদী হওয়ার ক্ষমতা রাখে, রাজন মানিকের অফিস কাম ফ্ল্যাটে বসে বসে অনির তাই মনে হচ্ছে এখন। দশটায় সময় দেওয়া ছিলো, অনি আর পরশ এসে গেছে ঠিকঠাক, কিন্তু না রাজন নিজে না তার টিমের কাউকে দেখা যাচ্ছে। যে কয়েকবার এসেছে অনি এখানে, তিনটে ছেলেকে দেখেছে বিভিন্ন ছবি আর ভিডিও ক্লিপ এডিটিংএ ব্যস্ত। তাদের কাউকেও দেখছে না।

কার্ডে দেওয়া মোবাইল নাম্বারে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে যাচ্ছে পরশ, রিং পড়ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। কেটেও দিচ্ছে না। ওদেরকে দরজা খুলে দিয়েছে যে, ঘরের কাজ করে। সে সকালে আসে, সারাদিন কাজ করে বিকেলে চলে যায়। তার কাছে দরজার চাবি থাকে। সে ও কিছু জানে না।

‘ফুন দিতে থাকেন। আইবো না যাইবো কই?’

‘আপনি বলতে পারেন কোথায় গেছে?’

‘ফটুক তুলতে গেছে কই? কতরাইতেই তো আসে না। আমি যেমন রাইন্ধা রাইখা যাই, যেমন বিছানা পাইতা রাইখা যাই ঠিক তেমনি আইসা দেখি সকালে। গেছে, আইয়া পড়বো!’

‘কিন্তু ডেট তো আমাদেরকে দেওয়া আজকে। উনি অন্য কোথাও কীভাবে যাবেন?’ ফিসফিস করে অনিকে বলল পরশ।

‘মিডিয়াতে কাজ করা লোকেরা এমনই হয়, ভাইয়া। কাজে ডুবে গেলে খেয়াল থাকে না। হয়তো ওনার মনেই নেই আমরা অপেক্ষা করছি।’

‘এটা কেমন কথা? বুঝলাম না কিছুই! ওইটা কাজ, এটা কাজ না? নগদ টাকাগুলো গুণে দিলাম। এক টাকাও বাকিতে কাজ করবে না। আর ফোনটা তো ধর বাবা? এত ডিমান্ড কেন দেখায় এই লোক?’

‘লোকটার আসলেই অনেক ডিমান্ড, ভাইয়া। আমি এখানে এসেছি পোর্টফোলিও করাতে এটা শুনে আমার বান্ধবিরা তো হিংসায় মরে যাচ্ছে। আর রবিউল স্যারও বললেন, আমার এবার রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে।’

‘রবিউল স্যার কে?’

‘ওই যে বিজ্ঞাপন করলাম না? এন্টিওয়েভের? ওটার ডিরেক্টর।’

‘তোর সাথে কন্টাক্ট আছে?’

‘থাকবে না? মিডিয়ায় সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। উপরে উঠতে গেলে এগুলোই তো ছোটো ছোটো সিঁড়ি!’ অনেক বড় বড় ভাব নিয়ে কথাগুলো বলছে অনি, যেন কত অভিজ্ঞতা! নিশ্চয় কারো বলা কথাগুলো শুনেছে, এখন চালিয়ে দিচ্ছে, মনে মনে হাসল পরশ।

অনি বলে চলেছে ‘রবিউল স্যার তো আমাকে এখনো ডাকে।’

‘কেন?’

‘ওনারা বিজ্ঞাপন বানাবেন, নাটক বানাবেন। আমাকে অভিনয় করতে ডাকে। কিন্তু আমি সেইসব করব না। লক্ষ্য বড় করতে হবে, রবিউল স্যারের কাজ তো টিভিতে আসবে না, লোকাল চ্যানেলেই থাকবে। ওখানে ক্যারিয়ার হবে না। কিন্তু তিনিই আমাকে প্রথম ব্রেক দিয়েছেন, আমার ক্যালিবার চিনিয়েছেন, তাই অকৃতজ্ঞ হওয়া চলবে না। ওনার সাথে তাই কন্টাক্ট রেখে যাচ্ছি!’ আবারও বিজ্ঞের মতো বলে অনি।

কত খোঁজখবর আর হিসেবনিকেশ করতে শিখে গেছে অনি। পরশের মজাই লাগে ছোটোবোনের মুখে পাকা পাকা কথা শুনতে।

বসে থাকতে থাকতে অনির কোমর ধরে গেছে। ও উঠে একটু পায়চারি করতে লাগল স্টুডিওর ভেতর। লম্বা রুমটা। বাইরে থেকে ঢুকে ছোটো অফিস। তারপরই আরেকটা স্লাইডডোর পার হয়ে স্টুডিও। রাজন মানিকের সলো ফটোগ্রাফ একটা। একপাশে আলো ফেলা হয়েছে। মুখের একপাশ দেখা যাচ্ছে, অন্যপাশে আঁধার। রহস্যময় দেখাচ্ছে। চোখে দ্যুতি, ওয়াটারি আইজ। তারপর একে একে দেশের বেস্ট মডেল আর শোবিজ তারকাদের বেস্ট স্ন্যাপ একেকটা। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। পারফেক্ট সব শট। এই তারকাদের হয়তো সামনাসামনি দেখতে এত ভালো না, যতটা এই ফ্রেমগুলোতে দেখা যাচ্ছে। একটা দেয়াল ভরা রাজন মানিকের সেরা সব ফটোগ্রাফি ফ্রেম!

এককোণে ফটোশেডিং আমব্রেলা, ক্যামেরা স্ট্যান্ড, লাইট গাদা করে রাখা। আটটা কম্পিউটারটেবিলে পিসি, মনিটর, প্রিন্টার, একগাদা তারের জঞ্জাল। একপাশে একটা পাটি আর তোশক গুটিয়ে রাখা। কেউ মনে হয় ঘুমিয়েছিল রাতে এখানে। আগে কখনো এটা দেখেনি অনি। সবসময় ফিটফাট অফিসলুকে দেখেছে। ট্রায়াল ফটোশুটের দিন কিছু প্রপস আর ব্যাকড্রপ দেখেছিল।

এপাশে একটা বড় কাঠের দরজা। ডাবল ডোর। ওপাশটা সম্ভবত বাসার কাজে ব্যবহার হয়। বুয়া ওদিকেই কাজ করছে। একবার শুধু এসে চা দিয়ে গেছে। অনি দরজার কাছে এসে ওপাশে উঁকি দিলো।

‘এই অনি? কী করছিস? আয় এদিকে?’ পরশ জানে অনি চঞ্চল খুব। ওর পায়ের নিচে সর্ষেদানা ছড়ানো থাকে সবসময়। এক মিনিট স্থীর হয়ে বসে থাকা ওর ওর জন্য দুঃসাধ্য। এটা ধরছে, তো ওটা নাড়ছে, এই এখানে তো এক মূহুর্তে হাওয়া। এখানে এভাবে বসে থাকাটা ওর জন্য কষ্টকর। কিন্তু অচেনা, অনাত্মীয় মানুষের ঘরে উঁকি দেওয়াটাও তো ঠিক না।

‘ভাইয়া, দেখে আসি না, ভেতরে কেউ আছে কীনা!’

‘না। তুই এদিকে আস। এখানে বস চুপ করে। আর আধাঘন্টা দেখি। তারপর না আসলে আমরা চলে যাব।’

‘চলে যাব কেন?’ অনি আঁতকে ওঠে।

‘যাব না? এখানে থেকে যাব?’

‘না। তা না। আমরা টাকা দিয়েছি তো!’

‘কী জানি। টাকাটা মার গেল কীনা বুঝতে পারছি না। আজ যাই। কাল এসে আবার খবর নিয়ে যাব।’

‘না। আমি দেখে আসি কেউ আছে কীনা ভেতরে।’

‘কাজের মহিলাটা আছে সে তো দেখলিই!’

‘না, আর কেউ যদি থাকে, কিছু যদি জানা যায়!’

‘এত অধৈর্য কেন হচ্ছিস? আয়, বস এখানে।’

একটু ইতস্তত করল অনি তারপর সোজা চলে গেল ভেতরে। ‘এই মেয়েটা কোনোদিন কারো কোনো কথা শোনেনি। নিজের মনে যা আছে সেটা ও করবেই ‘ ভুরু কুঁচকে বসে থাকল পরশ।

লম্বা একটা করিডোর। বাইরের আলো পুরোপুরি উজ্জ্বল করতে পারেনি। এই দেয়ালটা ভর্তি একটা মেয়ের ফ্রেম। কোনো নান্দনিকতা নেই, নেই কোনো আর্টিফিশিয়াল লাইট, ডেকোরেশন নেই, পুরোনোদিনের ক্যামেরায় তোলা সাধারণ সব ফ্রেম। সব ফ্রেমেই মেয়েটা হাসছে, একগালে টোল ফেলে মেয়েটা হাসছে, তার সাথে তার চোখও হাসছে!

নি আরেকটু ভেতরে উঁকি দিলো। কাজের মহিলাটি এগিয়ে এলো ‘কিছু লাগব আপা? কিছু কইবেন?’

‘না। আর কেউ নাই বাসায়? ছবির এই মেয়েটা কে?’

‘হইবো কোনো মঠেল।’

‘মডেল? এই বাসার কেউ না?’

‘না তারে দেখিনাই কোনোদিন। এইবাসায় মেয়েলোক কেউ থাকে না। মেয়েরা যারা আসে, ওইপাশ দিয়ে ফটু তুলে যায়গা। সব বেটাছেলে থাকে। আসে, যাই, রাইতে থাকে। আউল বাউল খায়, এত্তগুলা বাসন বানায় রাখে। দুনিয়ার আউলা ঝাউলা করে রাখে ঘরবিছানা। যেইখানে খায় সেইখানেই কাচরা ফালায় থোয়।’

‘ও। আচ্ছা। আমি বাইরে গিয়েই বসি।’

অনি ফিরে আসতে আসতেই একজন এলো। ট্রায়ালের সময় যাদের সাথে কাজ হয়েছে তারা কেউ না। পোস্টপ্রডাকশন বলে যে কাজগুলো হয়, সেই কাজগুলো করে এই ছেলেটি। ফটো এডিটিং, পডকাস্ট তৈরি এইসব। কম্পিউটারের সামনেই দেখেছে ছেলেটিকে আগে। পরিচয় হয়নি। ছেলেটি পরশকে বলল ‘আপনারা?’

‘আজকে আমাদের ডেট ছিলো।’

‘রাজন স্যারের?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওহ! স্যারের তো একটা একসিডেন্ট হয়েছে।’

‘কী বলছেন? কীভাবে? কখন?’

‘গতকাল রাতে, বাসায় ফেরার পথে হাইওয়েতে গাড়িটা ব্রেকফেল করে। সাথে সাথে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’

‘এখন কী অবস্থা!’

‘অবস্থা বেশি একটা খারাপ না। পায়ে ফ্র‍্যাকচার হয়েছে, শরীরে কয়েক জায়গায় জখম আছে।’

‘আর কেউ ছিলো সাথে? মানে অন্যদের কী অবস্থা?’

‘ড্রাইভার ছিলো। টিমের আরও চারজন ছিলো। সবাই টুকটাক আহত হয়েছে।’

‘ওহ। রিলিজ দেবে কবে?’

‘আজই দেবে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। কিন্তু আপনাদের কেউ জানায়নি? আজকের স্কেজিউল পোস্টপন্ড হয়েছে এটা কেউ বলেনি আপনাদের। কল করে ইনফর্ম করার কথা তো!’

‘না, জানায়নি তো! আমরা অনেকক্ষণ বসে আছি।’

‘এমনটা তো হওয়ার কথা না। একটা মেসেজ হলেও তো রাখার কথা। দেখুন তো?’

পরশ নিজের মোবাইল বের করে চেক করতে থাকলে অনির মনে পড়ে গেল, ফরমে ও নিজের ফোন নম্বর দিয়েছিল। মোবাইল তো বন্ধ করে ব্যাগের ভেতর রাখা। ও তাড়াতাড়ি মোবাইল চালু করে দেখল, মেসেজ এসেছে। পরশকেও দেখালো।

‘তাহলে আমরা আর বসে থাকি কেন? রাজন সাহেব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক। আমাদের জানিয়ে দিলে, আমরা আসব আবার।’

অনি উঠল না দেখে পরশ আবার তাড়া দিলো, ‘চল? অনি? এখানে তো আর কাজ নেই।’

অনি মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল ‘না ভাইয়া, আমি থাকি?’

‘থাকবি মানে? কী করবি? অসুস্থ মানুষ এসে কি শ্যুট করতে পারবে আজকে?’

‘না, তা না।’

‘তবে কী?’

অনি খানিকক্ষণ নাক ঘষে। তারপর ইতস্তত করে বলে ‘বাসায় কোনো মহিলা মানুষ নেই। দেখাশুনা করার কেউ নেই।’

পরশের হঠাৎ কথা আসে না মুখে। ও হতবাক গলায় বলে ‘তুই নিশ্চয় এটা বলছিস না যে, এখন তুই ওনার শুশ্রূষা করবি?’

অনি কথা বলে না। মাথা নিচু করে রাখে।

‘কোনো দরকার নেই। না উনি আমাদের আত্মীয়, না পরিচিত কেউ। আর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিচ্ছে মানে তেমন গুরুতর কিছুও না। আর সেরকম হলে চব্বিশঘণ্টা নার্সের ব্যবস্থাও আছে। সবচেয়ে বড় কথা যাদের ব্যাপার, তারা বুঝবে। উপযাচক হয়ে কিছু করার দরকার নেই।’

‘না ভাইয়া। আমরা উপস্থিত আছি। এখন এভাবে চলে যাওয়া যাবে না।’

পরশ বুঝে উঠতে পারে না অনিকে। ওর চেনা অনি আমূল পালটে গেছে আর প্রতিদিন একটু একটু করে ও সেটা জানতে পারছে।

অনিকে আশ্বস্ত করার অভিপ্রায়ে ও বলল ‘আমাদের কাছ থেকে উনি টাকা নিয়েছেন অনি। এটা ওনার কাজ। সুস্থ হলে ঠিক করে দেবে। ভালো করেই করবে। একদম ভাবিস না।’

‘না, মানে, ম্যাগাজিন কাভারে ফটো আসার একটা ব্যাপার আছে। কোনোভাবে ওনাকে খুশি করা গেলে…’ থেমে থেমে বলে অনি।

পরশ রেগে যায় ‘আমি বুঝতে পারছি না অনি, তুই এমন তোষামোদি হয়ে উঠলি কবে থেকে? খুশি করে কাজ উদ্ধার করাটা তোকে কে শেখালো?’

‘অত কথা জানি না ভাইয়া, আমার উপরে ওঠা লাগবে, সেটা যেভাবেই হোক না কেন….’

চলবে
Afsana Asha

#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_১৬

একটা সিনেমার মহরৎ অনুষ্ঠান। আলোকিত স্টেজে নায়ক, নায়িকা, পরিচালক, প্রযোজকরা কেক কাটছে। সহপ্রযোজক লোকটা নায়িকার পাশ থেকে সরছে না। কেক কেটে নায়িকার বুকের উপর দিয়ে হাত উড়িয়ে নায়কের মুখে দিলো। নায়িকা একটু বিব্রত। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেই কেক নিয়ে ওই লোকটাকে খাইয়ে দিলো। ঘনঘন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ পড়ছে। টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, সিনে ম্যাগাজিন সাংবাদিকেরা বাইট নিতে ব্যস্ত।

মঞ্চের নিচের দিকে ভীড়টা অন্যধরনের। ব্যুফে ডিনারের আয়োজন অতিথিদের জন্য। সফেদ টেবিলরানারে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। সবাই প্লেট ভরে ভরে খাবার নিয়ে খেতে ব্যস্ত। অনি এখানে ক্যামেরাম্যান সেজানের সাথে এসেছে। একজন নির্মাতার সাথে কথা বলিয়ে দেবে সেজান। বিজ্ঞাপনচিত্রে মেইন লিডের জন্য। ফটোশুটের পরে অনেক রকম অফার পেয়েছে অনি, কিন্তু একটাও মেইন রোল পায়নি। সবাই বলেছে অনির এক্টিং স্কিল ভালো না। ভালো হাইট আর ফিগার নিয়ে শুধু র‍্যাম্পেই হাঁটা যায়৷ মেইন্সট্রিম মিডিয়ায় আসা যায় না।

বেশ কতগুলো ফ্যাশন শোতে অংশ নিয়েছে অনি। লাইমলাইট পেয়েছে, শোস্টপার হিসেবেও ক্যাটওয়াক করেছে লাক্সের ফ্যাশন উইক রানওয়েতে। এখন কমার্শিয়ালে একটা ব্রেক চাই ওর। হন্যে হয়ে আছে। রাজন মানিকের সাথে সম্পর্ক ভালো হলেও, তার কাছ থেকে এক্সট্রা কোনো বেনিফিট পাওয়া যাবে না, সেটা বুঝে গিয়েছে অনি, যখন সারাদিন অসুস্থ মানুষটাকে সেবা করেও সিনেম্যাগাজিনের কাভারে ওর ছবি আসেনি। তাই সেজানকে ধরেছে ও। সেজান, রাজন মানিকের সাথেই কাজ করত। স্টিল ফটোগ্রাফিতে বেশ নাম। তারকাপাড়ায় জানাশোনাও ভালো। সিনেমাটোগ্রাফিতেও নাম করে ফেলেছে। বেশ কয়েকটা ভালো কাজ ইতিমধ্যেই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে।

এখানে আজকে সেজানের ইনভাইটেশন আছে। নায়িকার ক্লোজআপ নিতে ব্যস্ত অনেকক্ষণ। সবাইই ব্যস্ত। হয় নায়িকাকে নিয়ে, নইলে খাবার নিয়ে। অনি একা একা বোর হচ্ছে। মহরৎ শেষে সংবাদ সম্মেলন। বেশ অনেকটা সময়। ও দুটো স্প্রিং রোল, একটা ক্র‍্যাবভাজা, একটুখানি চাউমিন আর একটা বাটিতে থাই স্যুপ নিয়ে বসল। সবাই কোল্ড ড্রিংকস নিচ্ছে, ও নিলো না। এখানে ডায়েট কোক নেই, দেখেছে ও। ও অবাক হয়ে খেয়াল করেছে শোবিজের লোকেরা একেবারেই ডায়েটসচেতন না, খাবার যাই হোক হামলে পড়ে, অথচ এদেরই ফিটনেস ধরে রাখা উচিত সবচেয়ে বেশি।

স্যুপ মুখে দিয়ে ইমরানকে মনে পড়ল ওর,

প্রথমবার স্যুপ খেয়েছিল ইমরানের সাথে। কেমন একটা বাজে গন্ধ লেগেছিল নাকে, আর মনটাও ভালো ছিলো না তখন। ইমরানের কথা খুব একটা মনে পড়ে না এখন আর ওর, মাঝে মাঝে বিশেষ কোনো সময়ে, সময়ের তুলনা করে। এখন যেমন স্যুপে চুমুক দিয়ে প্রথমবারের অভিজ্ঞতা মনে পড়ল!

এখন স্যুপ বেশ ভালো লাগে, থাই স্বাদেরটা সবচেয়ে মজা লাগে। কিন্তু এখন আবার ভালো লাগছে না। মাথায় টেনশন কাজ করছে। এত মানুষ চারিদিকে, এত এত তারকা। এই তারকাদের কারো চোখে কি ও পড়ে না? এমন হাইটের বাঙালি মেয়ে, ঘুরে একবার তো তাকানো উচিত। অনির খুব করে মনে হয় কোনো একদিন অমিতাভ রেজা চলে আসবে, অনিকে তার কোনো বিজ্ঞাপনে কাস্টিং করতে, নইলে মালেক আফসারী কোনো এক অনুষ্ঠানে ওকে দেখেই পছন্দ করে ফেলবে তার আপকামিং সিনেমার হিরোইন হিসেবে। শাকিব খানেরও তো কখনো মনে হতে পারে, অনির সাথে তার একটা হিটজুটি হবে৷ বা আফরান নিশো, তার কোনো নাটকে অনিকে নেওয়ার জন্য পরিচালককে অনুরোধ করবে। স্যুপের বাটিতে টুকটাক নাড়াচাড়া করতে করতে স্বপ্ন দেখছিল অনি। কাজশেষে সেজান এলো, একা একাই। কাউকে সাথে নিয়ে এলো না। অনি দ্বিধায় পড়ল ‘সেজান ভাই, আপনি একা?’

‘একা কই? তুমি তো আছ?’

‘না, সেটা বলিনি।’

‘তো, কী বলেছ? ক্র‍্যাবটা কেমন? বেশ না? টেন্ডার? নাকি কড়কড়া?’

‘ভালো।’

‘তুমি ক্র‍্যাব খাচ্ছ, দেখতে ভালো লাগছে।’

‘মানে?’

‘মানে হচ্ছে, সচরাচর মেয়েরা আরেকটু সময় নেয়, তুমি অনেক এডভান্স।’

‘ক্র‍্যাব খাচ্ছি বলে এডভান্স?’

‘ক্রেজি শোনাচ্ছে? আসলেই তাই। চিংড়ি যতটা আদর করে রান্নাঘরে ঢোকাই আমরা, জাতভাই হয়েও কাঁকড়া ঠিক ততটাই দূরে। কাঁকড়া খাওয়াটা একটা ট্যাবু এখনো। তুমি অনেক তাড়াতাড়ি এটা ভেঙেছ। বাকীগুলোও উতরে যাবে।’

‘আমি সব পারব, সেজান ভাই। আপনি শুধু একটু রাস্তাটা দেখিয়ে দেন। আজকে বলেছিলেন না, একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন?’

‘কে? মুনিম ভাই? হ্যাঁ বলেছিলাম তো! এইমাত্র এলো আর চলেও গেল। ব্যস্ত মানুষ তো!’

খাবারগুলো বিস্বাদ লাগল অনির কাছে। ‘আমি খুব আশা করেছিলাম সেজান ভাই।’

‘এভাবে কী হয় অনি রাণি? আশা তো কতজনই কতকিছুরই করে। সব আশায় কি ফল ধরে? অপেক্ষা করতে হয়। সাধনা করতে হয়। ধৈর্য রাখো।’

‘আর কত ধৈর্য রাখব বলেন? ছয়মাস হয়ে গেছে আমি র‍্যামপে হাঁটছি, এখনো একটাও কাজ পেলাম না। আমি পর্দায় আসতে চাই, সেজান ভাই, প্লিজ!’

‘অনি তুমি অনেককিছু বোঝো না, অস্থির হও শুধু। হবে আস্তে আস্তে। মানুষ ছয়বছর ঘুরেও একটা চান্স পায় না। আচ্ছা যাও, সামনের সপ্তাহে আমি অরণ্য স্যারের অফিসে যাবো, ওনাকে নিয়ে একটা ফটোফিচার করতে, তখন তোমার কথা বলব।’

‘সত্যি? থ্যাঙ্কিউ সেজান ভাই।’

‘আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি এটা কি জানো?’ ফিসফিস করে বলে সেজান।

‘জানি।’

‘কচু জানো!’ হাসে সেজান।

অনিরও ভালো লাগে সেজানকে। খুব গুরুত্ব দেয় ওকে। ফটোশুটের পরে প্রথম র‍্যাম্পে হেঁটেছিল সেজানের রেফারেন্সে। লাক্স সামার উইকলির মতো বড় শোয়ে। সেই শোটার স্পেশাল কয়েকটা ছবি ও তুলে দিয়েছিল। ডানদিক থেকে কপালে ফোকাস করলে অনির ছবিগুলো খুব আবেদনময়ী হয়, এটা ওই আবিস্কার করেছে।

শোএর আগেপরে দুজন একসাথে থাকে, মনে হয় কাপল। অনিকে নিয়ে বেশ পজেসিভও দেখা যায় সেজানকে। রাতে ট্যাক্সি ডেকে নিজেই পৌঁছে দেয় অনিকে। অনির নিরাপত্তার জন্য ভালো হলেও সুমনার অগ্নিদৃষ্টির সামনে ভষ্ম হতে যথেষ্ট এটা। আর একবার দুবার না প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা এটা। নিত্যদিনই সুমনা গজগজ করে, রেগে যায় একেবারে ‘রাত কয়টা বাজে, অনি? ভদ্রলোকের মেয়েরা এইসময় বাড়ি ফেরে?’

*****

উবারে করে ফেরার সময় আজকে ফেরার রাস্তা দেখে বুঝল ওরা বাসায় যাচ্ছে না। অনি সেজানকে জিজ্ঞাসা করল ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘কেন? আমার সাথে যেতে আপত্তি আছে?’

‘না, তা না। জানতে চাইছি। আর দেরি হলে মা ভীষণ বকে তো!’

‘শিল্পিদের ঘর সংসার থাকতে নেই এইজন্য। এখন তুমি যদি নায়িকা হয়ে যাও, ধরো ইদের আগে আগে। ইদে মুক্তি পাবে যে ছবি তিন শিফটেও সেটার কাজ শেষ করতে পারো নি। লেট নাইট শিফটেও কাজ করতে হবে, তখন? তখন যদি মা বকার ভয় করো তবে শোবিজে আসাই উচিত হয়নি তোমার।’ একটু যেন রেগে যায় সেজান। নাকি পার্টিশেষে এলকোহলের প্রভাব?

উবারের গাড়ি এসে থামে সেজানের বাসার সামনে।

অনি একটু যেন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এখানে কেন সেজানভাই?’

‘অনি, অনেককিছুই বোঝো না তুমি। কম দিন হয়নি কাজ করছ। এমন ন্যাকা ন্যাকা কথা কেন বলো?’

‘মানে?’

‘আই নিড আ মোমেন্ট, আই ওয়ান্ট টু ফিল ইউ!’

সেজানের চোখ নরম হয়ে এসেছে, কন্ঠে আকুতি।

অনি শক্ত হয়ে যায়। ‘না।’

‘না মানে কি? অনি আই লাভ ইউ! প্লিজ।’

ভাড়ার গাড়িটা বেরিয়ে গেল হুশ করে। এগারোটা বাজে ঘড়ির কাঁটায়। অনির ভয় করতে লাগল।

‘অনি, অনি, প্লিজ, আজকের রাতটা শুধু প্লিজ! আই নিড ইউ!’ আড়ষ্ট হয়ে আসা অনির হাত ধরে টানল সেজান ‘প্লিজ, অনি সিন কোরো না, আবাসিক এলাকা।’

অনি আরও শক্ত হয়ে যায়।

সেজান রেগে যায় এবার। দাঁতে দাঁত ঘষে বলে ‘ইন্ডাস্ট্রিতে এভাবেই কাজ হয় অনি। কাজ পেতে এটাই করতে হবে তোমাকে। আজকে আমার সাথে শুতে হবে কালকে কোনো প্রডিউসারের সাথে। আর যদি টেন্ডার চিকপিক হও তো ইটস নট ইওর প্লেস বেইবি। তুমি ঘরে বসে সীতা-সাবিত্রি নইলে শাবানা আপার সিনেমা দেখবে আর চোখের পানি ফেলবে। ক্যামেরাম্যান হচ্ছে এই ইন্ডাস্ট্রির ভগবান। সে চাইলে তোমার ক্যারিয়ার তৈরি করে দিতে পারে নইলে ছুঁড়ে আছাড় মারতে পারে। এমনও হতে পারে, তোমার আমার টিম একটা দারুণ ক্লিক করল, আমরা একের পর এক কাজ সাইন করতে লাগলাম!’ আবারও মিনতি করে সেজান ‘প্লিজ অনি, চলো? লাভ ইউ, জান!’

অনির চোখে পানি এলো না। শুধু ফোঁপাতে থাকল অপমানে। ধপ করে বসে পড়ল গ্যারেজের মেঝেতে। ওর মনে পড়ল পরশ কথা নিয়েছিল ওর কাছ থেকে, কখনো লোভ করবে না।

বিড়বিড় করে বলল ও ‘অসম্ভব!’

‘এখন চলো। অরণ্য স্যারের অফিসে তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাব আমি। প্লিজ!’

অনি পিছু হটতে শুরু করে। বেরিয়ে আসতে চায়। সেজান গলা উঁচু করে ‘কোথাও কাজ পাবে না তুমি, কোথাও যেন কাজ না পাও, সেই ব্যবস্থাই করব আমি। অনি ভুল করছ তুমি।’

দৌড়ে বেরিয়ে আসে অনি।

রাত অনেক। মানুষের চলাচল আছে তবুও নিরাপত্তার অভাব। মানুষের কাছ থেকেই তো ভয়। মানুষের বেশে, মুখোশের আড়ালে কে আছে চেনা বড় দায়।

সিএনজি নিয়ে বাসায় ফিরতে দেরিই হলো ওর। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘরে ঢুকতেই সুমনার রোষের মুখে পড়ল, ‘রাত কয়টা বাজে অনি? এসব আর কতদিন চলবে?’

‘নতুন কথা বলো, মা।’ অনিকে ক্লান্ত দেখায়।

‘এইগুলো কেমন জামাকাপড়? এইগুলো পরে রাতবিরাতে পুরুষ মানুষের সাথে বাড়ি ফিরলে ছিঃছিৎকার পড়ে যাবে না?’ অনি একটা লো কাট গাউন পরা। এতেই সুমনা ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। অন্যসময় র‍্যাম্পে হাঁটার ড্রেসগুলো তো ডিজাইনারকে দিয়েই আসতে হয়। আজ তো পার্টি ছিলো।

‘মা, আমি শাওয়ার নেবো প্লিজ!’ অনি পাত্তা দেয় না সুমনার কথা বা রাগ কোনোটাকেই।

অনির পথ আটকায় সুমনা। আজ এর দফারফা হতেই হবে। ‘খবরদার তুই আমার ঘরে ঢুকবি না। নিজে তো নষ্ট হইছিস, ছোটোটারেও নষ্ট করবি?’ এরপর ছেলেকে ডাকল চিৎকার করে, ‘পরশ, এদিকে আয়।’

পরশের ঘুম আসছিল না, ও অনির ফেরার অপেক্ষা করছিল। বারবার ফোনে ট্রাই করে পাচ্ছিল না। নিজেও অনিকে বকুনি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। সুমনা ওকে দেখেই চিৎকার করল ‘আজকে এই মেয়ে প্রতিজ্ঞা করবে, ও আর এইসব করবে না, নইলে আমি ওকে এইঘরে ঢুকতে দেব না।’ বলেই দুইহাত দিয়ে দরজার চৌকাঠ ধরে ব্যারিকেড দিলো।

‘অনেক রাত হইছে, মা।’ পরশের কথায় সুমনা আরও জ্বলে উঠলেন ‘হ্যাঁ, এতরাতে কারা বাড়ি ফেরে জানো? আমি ওকে ঘরে ঢুকতে দেবো না। ও ঢুকলে আমি বেরিয়ে যাব।’

‘আহ মা, এখন মানুষ শুনছে না?’

‘শুনুক। শুনতে কেউ বাকি নেই আর।’

এই বাকবিতন্ডা নেওয়ার মতো মানসিকতা অনির আর নেই। ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, ‘মা, তুমি থামবা? কাল সকালেই চলে যাবো আমি।’

‘আহ অনি? তুই ও তো কথা বাড়াচ্ছিস!’ পরশের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমনা বলল ‘কাল সকাল আবার কী, এখন বের হবি তুই?’

রাগে কাঁপতে কাঁপতে সুমনা বসে পড়ল মেঝেতে। হাই প্রেশার আছে তার। সিচুয়েশন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে কীনা ভেবে পরশ তাড়াতাড়ি বলল ‘ঠিকই তো অনি, তোকে সবরকম সাপোর্ট দিই, তাও তুই কথা শুনিস না। তোর জন্য আমরা কাউকে মুখ দেখাতে পারছি না। বেরো তুই ঘর থেকে?’ মা কে সামলাতে গিয়ে অনির কোথায় আঘাত করল পরশ, তা ও বুঝল না।

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলো অনি, এখন খেই হারালো। পরশও ওকে ভুল বুঝল? গুটি গুটি পায়ে ও নেমে গেল রাস্তায়।

সুমনাকে ঠান্ডা করে পরশ অনিকে খুঁজতে বেরোলো। ও ভেবেছিলো হয়তো ছাদে বা নিচে গ্যারেজে বসে থাকবে। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলেই ডেকে নিয়ে আসবে। কিন্তু অনি কোথাও নেই। রাস্তার মাথায় গিয়ে পরশ ক্রমাগত ফোন দিতে থাকল। অনির ফোন সুইচড অফ আসছে। পরশের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো! অভিমানী অনি কোথায়, কী বিপদ ঘটিয়ে দিলো আবার!

রাত তিনটের সময় টালমাটাল পায়ে রাজন মানিকের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল অনিকে। টুক টুক করে নক করল। রাজন মানিক তখনো কাজ করছেন। রাতজেগে কাজ করা তার নেশা, দিনে পড়ে পড়ে ঘুমোন। দরজা খুলতেই অনি কাতর হয়ে বলল ‘আমাকে থাকতে দেবেন এখানে, প্লিজ?’

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here