#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_১৭,১৮
Afsana Asha
পর্ব_১৭
‘হ্যালো রোজবাড!’
‘আপনার কি ভুল হচ্ছে কোথাও?’
‘কোথায়? একটা কথাও তো এখনো বলিনি। ভুল কোথায় হলো?’
‘হুম! ঐ একটা কথাই ভুল বলেছেন, মনে হচ্ছে না? ইটস নট আ রোজবাড নাউ, ইটস আ ব্লুমিং ফ্লাওয়ার উইথ অল ইটস বিউটি স্প্রেডিং!’ দুই হাত মাথার দুপাশে দুলিয়ে চোখ নাচায় অনি।
নিচের ঠোঁটটা উপরে তুলে মাথা নাড়ালেন রাজন মানিক। ‘রাইট। রাইট ইউ আর৷ একইসাথে এপিয়ারেন্সএও চেঞ্জ আসছে। এটিটিউড চেঞ্জ হয়ে গেছে। জেসচার বদলে গেছে। এমনকি ভাষাও!’
‘এটা স্ক্রিপ্ট থেকে মেরে দিয়েছি, হাহাহা।’ জোরে হাসল অনি। আশাপাশের মানুষজন তাকালো। লোকের এটেনশন কীভাবে নিতে হয় সেটাও এখন ভালোমতোই জানে অনি।
‘তো! কী শুনছি এসব? সত্যি?’
‘আপনি কী শুনেছেন বা শুনছেন, সেটা সত্যি নাকি মিথ্যা আমি কী করে বলব?’ লাস্যময়ী হাসল অনি।
‘তাও ঠিক। তোমার বুদ্ধিতে আমি চমৎকৃত!’
অনি হাসল শুধু, উত্তর করল না।
রাজন মানিক বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন ‘আবরার এর সাথে নাকি তোমাকে দেখা যাচ্ছে? অনেকেই ঘনিষ্ঠ হতে দেখেছে তোমাদেরকে। বেশ কথাবার্তা হচ্ছে কিন্তু।’
‘যারা বলছে তারা জানে, তারাই ভালো বলতে পারবে। এখন তারা কী দেখেছে, তাদের চোখ জানে। তাদের চোখের দেখাটা আমি কীভাবে দেখি বলুন?’
‘রাইট। এবসলিউটলি রাইট ইউ আর!’ ঠোঁট চেপে থাম্বস দেখালেন রাজন মানিক। তারপর আরো দৃঢ় কন্ঠে বললেন ‘কিন্তু, কথাগুলো আমার কানে এসেছে মানে, কিছু একটা ব্যাপারে আছে। সেটা কি তুমি অস্বীকার করতে চাও?’
‘না। একদম না। কে বলেছে আমি অস্বীকার করছি?’
‘এসব কেন করছ অনি? তোমার একটা সুন্দর পরিবার আছে। তারা তোমাকে ভালোবাসে।’
‘আমিও তো একজনকে ভালোবাসতে চেয়েছি। সে আমাকে কেন ফিরিয়ে দেয়?’
‘তুমি অনেক ছোটো অনি। বুঝতে চেষ্টা করো!’
‘অনেক বুঝি আমি এখন। এটাও বুঝি, পুরো ইন্ডাস্ট্রি জুড়েই কাস্টিং কাউচ মাথা উঁচু করে আছে। এখানে টিকতে গেলে আমাকে কমপ্রোমাইজ করতেই হবে। কাজ পেতে গেলে লোকের মনোরঞ্জন করতে হবে।’
‘কে বলে এগুলো? যেকোনো কাজ একমপ্লিশ করার জন্য শুধুমাত্র দুটো পদ্ধতি আছে। একটা সঠিক আর একটা ভুল। সঠিক যে রাস্তাটা সেটাতে হাঁটতে গেলে লাগে পরিশ্রম, ধৈর্য আর অধ্যবসায়। আর ভুল রাস্তাটা শর্টকাট, যেটা অলস আর অকর্মণ্যদের জন্য, তারাই সুবিধা খুঁজে বেড়ায় আর তাই এইসব দুর্নীতিবাজদের দেখাও তাদের সাথেই মেলে। বহু লোক আছে শোবিজে, ইনফ্যাক্ট তারাই সংখ্যাতে বেশি যার মেধা আর পরিশ্রম দিয়েই সাফল্যের চূড়ায় উঠে গেছে। আর আবরারের অনেক বদনাম ইন্ড্রাস্টিতে, জানো তুমি?’
‘তো? তার বদনাম সেটা সে জানবে, সে বুঝবে। আমি জেনে কী করব?’ রাজন মানিকের বাকি কথাগুলো কোনোটাই ধর্তব্যর ভেতর নিলো না অনি।
‘যার তার সাথে শুয়ে এভাবে কাজ নেবে?’ ক্ষেপে গেছেন রাজন মানিক
‘শুয়েই যখন কাজ পেতে হবে, তো আপনার কোরিওগ্রাফার সেজান কেন, আমি আবরারের সাথেই শোবো। আফটার অল, টপ হিরো এখন!
‘তুমি বুঝছ না অনি!’ অসহিষ্ণু হলেন রাজন মানিক
‘আপনিও তো বুঝছেন না!’
‘আবার সেই কথা! আমি তোমার থেকে কত বড় অনি!
‘কেয়া কারু রাম, মুঝে বুঢঢা মিল গ্যায়া!’ মাথা চাপড়ে হেঁয়ালি করে অনি।
‘তুমি ভুল করছ। অনেক পস্তাতে হবে। প্লিজ, ফিরে যাও।
‘ভুল। আমি জানি সব ভুল। ফুলগুলো সব ভুল হয়ে গেছে, ভুল হয়ে যায়, ভুল হয়েই থাকে। কিন্তু ফেরার পথ তো নেই। পথ আছে কীনা খোঁজার ইচ্ছেও নেই।’ উদাস হয় অনি, তারপর গ্লাসের লেমোনেড নেড়ে চুমুক দেয় একটু একটু করে বারচারেক। আস্তে করে বলে ‘আপনি চাইলেই পথ তৈরি করে দিতে পারেন। সেই পথেই ফিরব আমি। তবে আমার সাথে আপনারকেও হাঁটতে হবে আমার হাতটা ধরে। ধরবেন, আমার হাতটা?’ হাতটা বাড়িয়ে দেয় অনি।
রাজন মানিক হাতটা ধরলেন না। ‘পরশ বারবার আসে আর তুমি ফিরিয়ে দাও। ছায়ার মতো তোমার সাথে থাকে সবসময়। এমন ভাই হয় না, অনি। স্বার্থের এই পৃথিবীটাতে এমন ছায়া পাওয়া খুব শক্ত, অসম্ভবই এখন। আর সেই কোন তিনবছর আগে মুখ ফসকে কী না কি একটা কথা বলার অপরাধে সে খুবই অনুতপ্ত।’
অনি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়, ‘আজ অনুতাপ করে লাভ নেই, স্যার। সেদিন তাদেরকে আমার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো। তারা আমাকে গলাধাক্কা দিয়েছে। বারবার, বারবার তারা আমাকে নিয়ে খেলবে, আমাকে নিয়ে ছেলেখেলা করবে, এমন তো হয় না।’
‘ওরা কীভাবে জানবে, সেদিন কী হয়েছিল?’
‘জানার দরকার পড়ে না। জানতে হয় না সবকিছু। কখনো কখনো কিছু না জেনেও শুধু সাপোর্ট করে যেতে হয়। যেমন আপনি সাপোর্ট হয়েছিলেন সেদিন রাতে। আমাকে কিছু বলতে হয়নি। দরজাটা পুরোপুরি খুলে দিয়েছিলেন আমার সামনে।’
‘তুমি আমার কেউ ছিলে না অনি, তোমার জন্য কোনো দায়িত্ববোধ ছিলো না, আমার জন্য সহজ ছিল, একটা অসহায় মেয়েকে আশ্রয় দেওয়া।’
‘ওয়েট ওয়েট, তখন কেউ ছিলাম না, এখন বুঝি কেউ?’ দুষ্টু হাসি অনির চোখ আর ঠোঁটজুড়ে।
রাজন মানিক অনির কথায় বিভ্রান্ত হলেন না, ‘তিনটে বছর চলে গেছে মাঝখান দিয়ে।
‘হ্যাঁ। তো?’
‘এখন তো ফ্যামিলির কাছে ফিরে যাও।’
‘আমি না আপনাকে আর নিতে পারছি না। যাস্ট নিতে পারছি না। তিনটে বছর একটা বড় কাজ পেলাম না। অথচ আপনি লোকটা একবার কাভারে এনে ফেললেই, আমার আর কষ্ট করে আবরারের টায়ার্ডনেস দূর করতে যেতে হয় না।
‘আমি তো প্রফেশনের সাথে কম্প্রোমাইজ করব না, অনি। তা তো তুমি জানো।’
‘হ্যাঁ জানি। জানি বলেই নিজের উপায় নিজে খুঁজি। আপনার ফেভার চাইছি না। একেবারেই ভুলে গেছি সেটা, বিশ্বাস করেন। কিন্তু আপনাকে আমার চাই। এই জন্মেই চাই। কাভার ফাভার সব ভুলে যাব, শুধু রাজন মানিক লোকটাকে দিয়ে দিন আমাকে।
‘একদিন খুব পাগলামি মনে হবে এসব!
‘পাগলামি করেছিলাম ভেবে খুব একচোট হাসব! প্লিজ!’
‘অনি? অনেক কথা হয়েছে। তুমি জেদি ঘোড়ার মতো ঘাড় ফুলিয়ে বসে আছো। বেশ, তুমি চুলোয় যাও, তোমার মা, ভাই গোল্লায় যাক। আমি আর কোনো উপদেশ দিতে আসব না। আমার উপদেশের তুমি থোড়াই কেয়ার করো!
‘শুধু আপনাকেই তো কেয়ার করি, মেরে জান!’ বলতে বলতে অনির মোবাইলে মেসেজ নোটিফিকেশন বাজল টুং করে। মেসেজটা দেখে অনি হেসে উঠল।
রাজন জিজ্ঞেস করলেন ‘কী ব্যাপার হাসছ যে?’
‘আমার মনে হচ্ছে আজকের মতো আমাদের আলোচনা পর্ব সমাপ্ত হইয়াছে। আমাকে এখন উঠতে হবে।
নায়ক সাহেব গাড়ি পাঠাচ্ছে। গাজিপুর শুটিং লোকেশনে তার নাকি খুব একা একা লাগছে!’ চোখ টিপে দেয় অনি।
অনি চলে যাওয়ার পর পুরো সন্ধ্যেটা ওখানেই কাটিয়ে দেন রাজন মানিক, যতক্ষণ না রেস্তোরার ওয়েটাররা এসে, বিনীতভাবে উঠে যেতে বলল, তাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে।
*****
অনি আবরারের কাছে যায় না। সোজা নিজের বাসায় চলে আসে। বিছানার উপর শরীরটা ছেড়ে দেয়। চার সংখ্যাটাকে অনি নিজে যেমন ছাড়তে পারে না, চার নিজেও অনিকে ঘিরে রাখে। অনির এইটুকু জীবনে পুরুষও চারজন, সে লম্পট হয়েই আসুক বা প্রেমিক হতে। ইমরান পেয়েছিল অনির অধিকার, কিন্তু সে অনিকে দরজা থেকেই ফিরিয়ে দিলো। তারপর সেজান, হয়তো লোকটা খুব তাড়াহুড়ো না করলে অনির জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ হতে পারত। অনেকগুলো ভালো মূহুর্ত আছে দুজনের, যা এখন শুধুই তিক্ত স্মৃতি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি দ্বিগুণ বয়সী রাজন মানিক মানুষটাকে তীব্রভাবে চায় অনি। সে যতবার ফিরিয়ে দেয়, প্রত্যাখ্যান করে, অনি ততবার ফিরে যায়। কারণ তার প্রত্যাখ্যানে অপমান নেই, অপারগতা আছে শুধু। লোকটা ভালোবাসায় ভয় পায়, ভালোবাসতে ভয় পায়, অনির ছেলেমানুষীকে ভয় পায়। অনির পাশে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে থেকে যেতে চায়। আর চতুর্থজন আবরার!
শোয়া থেকে উঠে বসে আঙুলগুলো চারবার করে মটকে নিলো ও তারপর হাসল। চোখের সামনে টিভি পর্দার মতো ভেসে আসলো দৃশ্যগুলো। অনি নামের সতেরো বছরের মেয়েটা রাজন মানিকের বুকে আছড়ে পড়েছে নিজের সবটুকু আবেগ নিয়ে।
‘ছিঃ অনি, সামনে পুরো জীবনটা আছে, পাগলামি করে না।
‘পাগলামি করব, আপনি সামলে নেবেন আমাকে।’
‘এভাবে হয় না। এটা ভালোবাসা না।
‘তবে কী?
‘তোমাকে সেদিন আশ্রয় দিয়েছিলাম বলে তোমার কৃতজ্ঞতাবোধ আমার প্রতি, যেটাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল হচ্ছে তোমার।
‘আপনি কীভাবে জানলেন আমি ভুল করছি?
‘অনি, তোমার ভাই বারবার আসছে তোমাকে নিতে। তুমি চলে যাও?’ কঠিন হয় রাজন মানিকের গলা
‘আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। যাব না। যাব না। যাব না! ওদের কাছে ফিরে গেলে সবার আগে আপনাকেই ছাড়তে হবে আমাকে। সেই শর্তই সামনে রাখবে ওরা। আমার মন কোনোদিন বুঝবে না, আমি জানি।’
‘খুব বেশি নিচে নেমো না, অনি। আমাকে কোনো প্রলোভনেই ভুলিয়ে তুমি আমার ম্যাগাজিনের কাভারে আসতে পারবে না। আমার অনেক দোষ আছে, কিন্তু বাচ্চা একটা মেয়ে সিডিউস করবে আর আমি তার আঙুলে নাচব বা নাচাবো এমন দোষ নেই।’
স্মৃতির পুরোনো পথ হেঁটে বর্তমানে ফেরে অনি। বিছানা থেকে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে নামে।
‘তুমি দেখো, রাজন মানিক। বুড়ো লোকটা। আমি অতটাই নামব, যেখান থেকে টেনে তোলা যায়। আর আমাকে টেনে তুলতে হলে তোমাকে হাতটা বাড়াতেই হবে।’ আপনমনে হাসে অনি।
আবার পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। খুব আবেগের মূহুর্তে একদিন নিজের গায়ের টিশার্টটা খুলে ফেলেছিলেন রাজন মানিক। বিস্ফোরিত চোখে অনি দেখেছিল একটা পোড়া মাংসের শরীর। পৃথিবীর কুৎসিততম দৃশ্য। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়েছিল ও। অনির মাথায় বিলি কাটতে কাটতে রাজন মানিক বলেছিলেন ‘বাড়িতে হিটারে রান্না হতো। কত বয়স আমার, দশ এগারো হবে। সকালের কাজ শেষ করে মা ঘরে গিয়ে শুয়েছে। হিটারের তার খুলতে ভুলে গেছে। আমি আমার ছোটো ফুটবল নিয়ে খেলছি একা একা। একটা লাথি দিয়েছি বলে। একটু জোরেই মনে হয়। বলটা চলে গেছে হিটারের কাছে। বলটা ড্রিম্বলিং করতে গিয়ে হাত পড়ল হিটারের তারে। কোথাও একটা লিকেজ ছিলো, শক লাগল। হাই ভোল্টেজ ইলেক্ট্রিসিটি ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো গনগনে হিটারের উপর। আমি চিৎকার করতে পেরেছিলাম কীনা মনে নেই আমার। জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। তিনমাস হাসপাতালে ছিলাম। তারপর বাড়ি ফিরলাম, একটা পোড়া শরীর নিয়ে, বিভৎস দেহ নিয়ে।’
একটু থেমে রাজন মানিক ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন করিডোরের সাদামাটা ফ্রেমগুলোর সামনে। ফ্রেমের ছবিগুলোর মেয়েটির মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন ‘আমরা প্রেম করেছিলাম। ভালোবাসা হয়েছিল কীনা জানি না। প্রেম করেছিলাম। আমি তখন চাকরি করি। ফার্মাসিউটিক্যালসে। বেশ ভালো স্যালারি। বাড়ি থেকে বিয়েটা মেনে নিলো। ঘটা করে বিয়ে হলো আমাদের। রাতের খুব অন্তরঙ্গ মূহুর্তে, আমার পিঠে হাত দিয়ে আঁতকে উঠল ও। তারপর সারারাত কাঁদল। ওর মনে হচ্ছিল ও প্রতারিত হয়েছে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ইনসিডেন্টটা ওকে আমি জানাইনি। হ্যাঁ। কথাটাতে কোনো ভুল ছিলাম না। আমি লুকিয়েছিলাম, জেনেবুঝে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম সত্যটাকে। ভয় হতো, ওকে যদি না পাই! কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম কই? তিনটে দিন অবিশ্রান্ত কাঁদল ও। তারপর বৌভাত অনুষ্ঠানের পর ফিরানিতে চলে গেল। আমারও মনে হোলো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এতটা অপরাধবোধ আর গ্লানি আর নিতে পারছিলাম না। ষোলোদিনের মাথায় ডিভোর্স লেটার এলো। তার তিনমাস পরে খবর পেলাম আবার বিয়ে করেছে ও। শখ করে ক্যামেরা কেনা ছিলো, শখেই ছবি তুলতাম। শুধুমাত্র ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়।’
অনি সেদিন হুহু করে কেঁদেছিল। আজও কাঁদছে। একটা মানুষ, যার জীবনটা একেবারে অনির মতো। অপূর্ণতায় পরিপূর্ণ। অপূর্ণতাগুলো প্রেমে ভরপুর করে দিতে চায় ও। বয়স মানে না, সমাজ মানে না, প্রতিবন্ধকতাগুলোকেও আমলে নেয় না। কী হয়, সব বাদ দিয়ে নিজের ইচ্ছেয় একটা জীবন যদি বাঁচা যায়!
কতবার ফেরাবে ওকে রাজন মানিক? কান্না ভুলে হাসে অনি। তারপর ঘুরে ঘুরে নাচে আর গান ধরে –
“যখন এসেছিলে, যখন এসেছিল
অন্ধকারে চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপার
চাঁদ ওঠে নি
যখন এসেছিলে, যখন এসেছিল
হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম
অনুভবে জেনেছিলেম
হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলে
অনুভবে জেনেছিলেম
প্রাণে তোমার পরশখানি বেজেছিল গানের তার
যখন এসেছিলে, যখন এসেছিলে
তুমি গেলে যখন একলা চলে, চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে
চাঁদ উঠেছে
তুমি গেলে যখন
তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার
পড়ে আছে মালা তোমার
তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার
পড়ে আছে মালা তোমার
বুঝেছিলেম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে
যখন এসেছিলে, যখন এসেছিলে
অন্ধকারে চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে
চাঁদ ওঠে নি
যখন এসেছিলে, যখন এসেছিলে
চলবে
Afsana Asha
#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_১৮
‘অনি, আসলে না তুমি? খুব একা একা লাগছে বললাম না? বোর হচ্ছি!’
‘আমারও না ভাল্লাগছে না।’
‘কেন সোনা?’ নাকে নাকে আদুরে ভঙিতে বলে আবরার।
‘দেখো না, চার বছরের বেশি আমি কাজ করছি, লিডরোল পেলাম না এখনো, না একটা প্রমিনেন্ট কমার্শিয়াল। আমিও বোর হচ্ছি। ছেড়েছুড়ে গ্রামে চলে যাব ভাবছ। লাউ আর শিমের গাছ লাগাব। পালংশাকের ক্ষেত থাকবে। দুটো ছাগল, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আর একটা গরু থাকবে আমার। একখাঁচা কোয়েল পুষব…’
‘থামো থামো। কতদূর চলে যাচ্ছ…’ অনির কথার ইঙ্গিত ধরে ফেলে আবরার ‘প্রডিউসাররা হিট জুটি ছাড়া ইনভেস্ট করতে চায় না, আমি কী করব বলো, জান? এখন যে কয়টা নাটক আমার হাতে সব মিলার সাথে। আমি তোমার কথা কায়েস ভাইকে বলে রেখেছি। সামনে একটা নাটক আসছে, ভ্যালেন্টাইনের, ওটাতে তোমাকে কাস্ট করতে বলেছি। কিন্তু বোঝোই তো, আজকাল সবই কনজিউমার প্রডাক্ট। দর্শক যেটা খায়, সেটাই বেশি করে বানানো হয়। আমার আর মিলার জুটি এখন দর্শক ভালো খাচ্ছে…’
আবরারের কথা শেষ করতে না দিয়েই অনি বলে ‘আচ্ছা, মিলা ও তো আছে টিমে না? তাহলে কেন বোর লাগছে? মিলা আর তোমার তো ভালো কেমিস্ট্রি, তাই না? ওকে একটু ডাকো না? আমার না খুব অসময়ে ঘুম পাচ্ছে। আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি, প্লিজ।’ খট করে ফোনটা রেখে দিলো অনি।
আবরার অনিকে নিয়ে খেলছে নাকি অনি আবরারকে নিয়ে, বলা মুশকিল, একা একা হাসে অনি।
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে অনি। এক ঘুমেই সকাল হয়ে যায়।
ঘুম ভাঙে কলবেলের আওয়াজে। চোখ ডলতে ডলতে পিপহোলে চোখ দিয়ে দেখে অলি এসেছে। দরজা খুলে ওকে বসতে বলে ফ্রেশ হয়ে আসে অনি।
মিল্কশেক রাখা ছিলো ফ্রিজে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে অলির পাশে বসল।
‘সকালবেলা এসব খেতে ভালো লাগে?’
‘খেয়ে দেখ?’
অলির কাছে এগিয়ে দিতেই ও নাক সিঁটকে ফেলে ‘এটা কী?’ মিল্কশেক না তো!’
‘না। স্মুদি। কীসের স্মুদি জানিস? বেবি স্পিনাচ। বাচ্চা পালংশাক!’
‘ছিঃ! ইউউ। খাস কীভাবে?’
‘অভ্যাস হয়ে যায়। তারপর ভালো লাগে।’
‘অভ্যাস করার দরকার কী?’
‘ফিট থাকতে। এই একটা গ্লাস, সকালে ব্রেকফাস্ট লাগবে না, একবারে ব্রাঞ্চ সেরে ফেলব, সাড়ে বারোটা কী দেড়টায়!’
এইভাবে শরীর ফিট রাখার চাইতে আলুভর্তা দিয়ে একপ্লেট ভাত খেয়ে উঠে, আমি ভুটকি হবো!’
‘তোর মেডিকেল এডমিশন হয়ে গেছে?’
‘না। পাশ মার্কই আসেনি।’
‘এত পড়ে তাহলে কী করলি?’
‘আমি তো মেডিকেলের জন্য পড়িনি। ডিইউর জন্য পড়েছি। ওটা হবে। ক ইউনিটে না হলেও ঘ ইউনিটে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘পড়ছিস ভালো করে?’
‘হুম।’
‘পড়া বাদ দিয়ে এত সকালে এখানে এলি কেন?’
‘মা পাঠালো।’ অলি একটা শপিং ব্যাগ এনেছে সাথে। আড়ং এর। ওটার ভেতর থেকে দুটো প্ল্যাস্টিকের ফুড কন্টেইনার বের করল।
‘কী ওতে?’
‘খিচুড়ি আছে। ইলিশ মাছ আছে। গরুর মাংস ভুনা করে দিয়েছে। দুইদিন তোর আর রান্না করতে হবে না।’
‘আমি এমনিতেও রান্না করি না। খাইই তো কম। কাজু, আমন্ড আর শশা। মাঝেমাঝে স্যুপ আনিয়ে নেই। রাতে একটা আপেল, কখনো একপিছ মাছভাজা। খুব বেশি ইচ্ছে হলে পাস্তা নইলে বিরিয়ানি হোম ডেলিভারিতে আনিয়ে ফেলি।’
‘তবুও মায়ের রান্না। তোকে ছাড়া খায় কীভাবে?’
‘হুহ!’ মুখ বাঁকায় অনি।
একটা চামচ এনে কন্টেইনারটা নিয়েই বসে যায়, প্লেট আনার ঝামেলা করে না।
‘মজা হইছে রে! খাবি তুই?’ এক চামচ মুখে পুরে অলিকে জিজ্ঞেস করে অনি।
‘হুম। তুই খেয়ে দে আমাকে। আমি নাস্তা করে আসিনি।’
‘তুই এলি কেন? ভাইয়া আসতে পারত।’
‘ও আসে আর প্রতিবার মন খারাপ করে যায়। তুই ওর কোনো কথা শুনিস না।’
‘বাদ দে এইগুলা। এই বিষয়ে অনেক কথা হয়ে গেছে। অনেকবার হয়ে গেছে।’
‘সেলিব্রেটি হয়ে দেখায়ে দিতে হবে, এই জিদ নিয়েই বসে থাকবি?’
অনি উত্তর দেয় না।
অলি প্রশ্ন করে ‘তা তুই ডাক পাস না কেন?’
‘আমার মেরিট নেই, অভিনয় আসে না, শুধু গ্ল্যামার দিয়ে র্যাম্পে হাঁটাই যথেষ্ট।’ হাই তুলতে তুলতে বলে অনি।
‘আর রাজন স্যার। উনি তো তোর সবচেয়ে কাছের মানুষ। ভাই বোন থেকেও বেশি হয়ে গেছে। সে তোকে ব্রেক দিতে পারে না?’
‘ না। এই কারণ দেখিয়ে রাজন মানিকও আমাকে হাইলাইট করবে না।’
‘আর তোর এত কন্টাক্ট? কত জায়গায় তো কাজ করলি?’
‘অনেক জায়গায়ই ডাকে। স্ক্রিনটেস্টে বাদ পড়ে যাই। আমার ডায়লগ থ্রোয়িং নাকি হয় না। চরিত্রের সাথে মিশতে পারি না। বাদ দে তো!’
‘কত কত একট্রেসই তো দেখি ঠিক করে বাংলাও বলতে পারে না। তাদের কীভাবে নেয়? তোর কেন হয় না?’
‘অনেক কাহিনী আছে। ধর, কেউ কেউ হুট করে লাইমলাইট পেয়ে ফেমাস হয়ে গেছে, কেউ কেউ যাস্ট নেপোটিজমের জোরে রাজ করে যাচ্ছে। আবার কেউ পরিশ্রম করে অনেক। আরও অনেক ব্যাপারস্যাপার আছে। তুই বুঝবি না।’
‘আচ্ছা বুঝলাম না। কিন্তু তুইও তো কাজ করছিস। পরিশ্রমও তো করিস।’
‘আমি ভুল করেছি প্রথমদিকেই এক্সট্রা রোলগুলো একসেপ্ট করে। তখন তো আর এসব বুঝি না, একটা কোনো কাজ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে এতসবকিছু ভাবিইনি। যেখানেই ডাক পেতাম, রাজি হয়ে যেতাম।’
‘তাতে কী?’
‘ অনেকে এটাকেও অজুহাত করে আমাকে বাদ দেয়। এই যে নায়িকার বান্ধবীর রোল, এসবকে বলে শর্টরোল, যারা শর্টরোল করে ফেলে তাদেরকে নাকি বড় রোলে ব্রেক দেওয়া যায় না। ফ্রেশফেসের ভ্যালু আছে শোবিজে, এক্সট্রা রোলগুলোকে এক্সট্রাই থেকে যেতে হয়।’
‘আচ্ছা বুঝলাম। আর আবরারের ব্যাপারটা কী? ওকে নিয়ে ভাবছিস কিছু। মানে, তোরা কী একসাথে আছিস? আই মিন, এনি রিলেশনশিপ, কমিটমেন্ট? আবরারের গুণে তো ঘাট নেই। কাপড়চোপড়ের মতো মেয়ে পালটায়। তোর ব্যাপারটা কি?’
‘কোনো ব্যাপার নাই।’
‘ আবরার তোকে ভালোবাসে?’
‘সেটা জানি না। ভালো মনে হয় কাউকেই ও বাসে না। আমিও ওর জীবনে পার্মানেন্ট কেউ হতে চাই না। শুধু শোবিজে এস্টাবলিশমেন্ট চাই।’
‘এত হিসাবনিকাশ কীভাবে শিখলি তুই? কী বোকা ছিলি কয়েকটা দিন আগেও!’
‘আমার মতো ঘাত প্রতিঘাতের জীবন যদি হতো তোর, তবে তুইও বয়সের আগেই ম্যাচিউরড হয়ে যেতি।’
‘তোর সাথে যা যা হয়েছে, অবশ্যই খারাপ হয়েছে। কিন্তু এর চাইতেও খারাপ অনেককিছু অনেকের সাথেই ঘটে। সবাই তোর মতো করে না।’
‘আমার মতো কী? কী করে না? আমার মতো করে না, বলতে হলে আমার জায়গায় আসতে হবে তোকে। আমার অবস্থায় পড়ে ভাবতে হবে, কী করা উচিত আর কোনটা করা উচিত না। কখনো এমন সময় আসে উচিতবোধ কাজ করে না। তখন শুধু সামনে থাকা রাস্তাটাই চোখে পড়ে। রাজন স্যার বলেন, অর্জুনের মতো মাছের চোখেই লক্ষ্যভেদ করতে হলে অন্য কোনোদিকে তাকাবো চলবে না। আমি জানি আমাকে এই ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করতে হবে, এর জন্য যা যা করা দরকার সব করব আমি। সরে আসব না।’
‘অনি? বাসায় চল? ভাইয়া খুব মন খারাপ করে। মা কাঁদে।’
‘যাব। যাব না কেন? সময় আসুক।’
‘এত জেদ করিস কেন? ক্ষমা করে দে না! নরম হ প্লিজ!’
‘এই তোর না পরীক্ষা আছে? যা তো! আমি ঘুমাব।’
‘ঘুমালে ফিট থাকবি কীভাবে? মোটা হয়ে যাবি না?’
‘না। ট্রেডমিলে চার কিলো দৌঁড়ায় নেবো। এই যে খিচুড়ি খেলাম। এটার জন্য আরও চারকিলো এক্সট্রা দৌঁড়াতে হবে।’
‘তাইলে না খাইতি! এত দৌঁড়াতে গেলে কাজ করে কখন মানুষ। ধর বলিউডের নায়িকারা। ওরা কী শুধু শাকপাতা খায়? সবসময়? ভালো খেতে ওদের মন চায় না? রুচিতে লাগে?’
‘অনেক সময় খায়। পেট ভরে মাটন বিরিয়ানি খায়। এক্সট্রা চিজ দিয়ে ডাবল পেটি বার্গার খায়। ম্যাক এন চিজ খায়। গুলাবজামুন খেয়ে ফেলে গোটাকয়। খেয়েদেয়ে ঢেঁকুর তুলে, ওয়াশরুমে গিয়ে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে ফেলে দেয় সব। খাওয়াও হলো, শরীরেও লাগল না কিছু।’
ছিঃ। এইটা জীবন? এইভাবে গ্ল্যামার ধরে রেখে বেঁচে থাকার লাভ কী?’
‘দেখ, সবার কাছে সবার কাজ বেশি গুরুত্ব রাখে। নায়িকাদের কাজ হচ্ছে নিজেকে ফিট রাখা, মেদহীন থার্টি ফোর, টুয়েন্টি ফোর, থার্টি ফোর রেশিওতে ফিগার আটকে রাখা। দাগহীন চকচকে নিঁখুত মুখ রাখা। তাই শরীরচর্চা আর রূপচর্চা থাকে দিনের রুটিনের বেশীরভাগ সময় জুড়ে। এটাই ওদের মেইন কাজ। গ্ল্যামার ধরে রাখতেই হবে। প্রপার ডায়েট মানতে হবে। জিম করতে হবে। আমার যখন অনেক টাকা হবে, ঘরেই একটা জিমনেসিয়াম থাকবে, বুঝছিস? একটা অটো ট্রেডমিল কিনব। আমারটা তো ম্যানুয়াল। টেনে টেনে দৌঁড়ানো লাগে। পায়ে ব্যথা করে। মাসলক্র্যাম্প হয় রাতে ঘুমানোর সময়।’
‘আর?’
‘ডিজাইনার কালেকশন দিয়ে ভর্তি ক্লজেট। জামা, জুতো, ঘড়ি, গগলস, ব্যাগ!’
‘আর?’
‘একটা পোরশে। কী কিউট একেকটা গাড়ি রে অলি…’ এইটুকু বলেই অলির দিকে তাকিয়ে অনি থেমে যায়। অলি চাপা হাসিতে ভেঙে পড়েছে। ওর মাথায় চাপর দিয়ে অনি বলে ‘তুই কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছিস?’
অলি চট করে অনিকে জড়িয়ে ধরে ‘আগের মতো হয়ে যা অনি। বাসায় চল। এসব তোকে দিয়ে হচ্ছে না মানে হবে না।’
‘কী হবে না? হতেই হবে। আমি হেরে যাব না অলি।’
‘হার জিত নিজের ক্যাপাবিলিটির ভেতর থেকে ঠিক করতে হয় অনি। কেউ যদি তোকে হিট দেয়, বলে পারলে পিএম হয়ে দেখাও, তুই কী পিএম হওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে পিকেটিং শুরু করবি? রাস্তা গরম করা আর রাজপথের রাজনীতি এক না। তেমনি এইভাবে শোবিজে ক্যারিয়ার করাও সম্ভব না। হয়তো একটা ব্রেক তুই পেতে পারিস, কিন্তু এই ইন্ড্রাস্টিতে তোর মেধা না থাকলে টিকবি কী করে? হয়নি যখন ছেড়ে দে না?’
‘কী করব তবে। পড়াশোনা? ওটাও তো আমার দ্বারা সম্ভব না। তাহলে কী এইরকম অযোগ্যই থেকে যাব? আমাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে অলি!’
‘কার কাছে? কার কাছে নিজেকে প্রমাণ করবি তুই?’
‘যা অলি। আমি ঘুমাব। আমার কথা বলতে ইচছে করছে না।’
অলিকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই বের করে দিয়ে বিছানায় কাঁথামোড়া দিয়ে শুয়ে পড়ে অনি। ঘুমের বদলে গত হওয়া চার বছরের স্ট্রাগল চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পরদিনই রাজন মানিক পরশের সাথে যোগাযোগ করেছিল। পরশ অনিকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। কিন্তু অনির জেদের কাছে হেরে গেছে।
নিজের জায়গা তৈরি না করে ও ফিরবে না।
চলবে