যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে #পর্ব_৩

0
1327

#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_৩

সাইদার খুব ব্যস্ত দিন আজ। ইমরান দেশে আছে আর তিনটে দিন। ওর পছন্দের রান্না হবে সব।

ছেলেটা নিজেই জানে না ও কী কী পছন্দ করে। মাছের পেটিটা খায় নাকি লেজের অংশটা। কচকচে হাড়ওয়ালা গোশ নাকি হলদেটে চর্বিওয়ালা তুলতুলে মাংস? তেঁতুলের টক দেওয়া ডাল নাকি জিরেফোঁড়ন নেওয়া পাতলা ডাল? সাইদা জানে। ছেলে মায়ের আবেগের প্রতি যতটা উদাসীন, মায়ের আকর্ষণ যেন ততটাই বেশি।

খাওয়া নিয়ে কোনো ঝামেলা করে না ইমরান, যাই দেওয়া হয় সামনে খেয়ে নেয়।

মাঝে মাঝে তো সাইদার মনে হতো, ইমরানের স্বাদগ্রন্থিই নেই, লাউ-কুমড়োর ফারাকই ধরতে পারে না।

উচ্ছে দিয়ে ভাত থেয়ে সহজেই পটলের তেতো হওয়ার দুর্নাম করে দেয়। তবে ভালো খেতে ভালোওবাসে।

বড়ির তরকারি, কচুর লতি, নারকেল দুধে কলার মোচা বাটা, গরুর বটভাজা এইসব হাবিজাবি নিজের মহামূল্যবান সময় থেকে একটু বেশি সময় নিয়েই খায় ও।

কোনো কোনোদিন একচামচ ভাত বেশিও চেয়ে বসে।

ভাবতে ভাবতেই চোখ লাল হয়ে এলো সাইদার। প্রথম সন্তান – ইমরান, কোন সুদূর বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি দেবে।

সেখানে নিজে রান্না করে খেতে হবে – হোটেল ফোটেলে তো হারাম-হালালের বাছবিচার নেই।

কবে পেটপুরে খেতে পারবে, আবার? তবে এই ছেলে সব পারে।

পাউরুটি আর কলা দিয়েও মাস কাবার করে দিতে পারবে। খালি ভাত কপকপিয়ে খেয়ে নেবে-লবনও চাই না ওর।

কুমড়োর বড়িগুলো লাললাল করে ভেজে, গরম পানিতে দমে বসিয়ে ডাইনিংএ এসে বসলেন সাইদা। রান্না-আতিথেয়তা সবই একসাথে করতে হচ্ছে।
বিয়ের পরে ছেলে যাবে শ্বশুরবাড়ি বউ নিয়ে, এমনটাই নিয়ম।

কিন্তু ইমরান চলে যাবে তাই সাইদা শশুড়বাড়িই উঠিয়ে এনেছে এখানে।

অনির মা, মামি, চাচা, চাচি, ভাই-বোনে বাড়ি ভরা।

একটু ধকল যাচ্ছে শরীরের উপর দিয়ে, তবে মনে জোর পাচ্ছেন।

অনিকে দেখেই এই জোর পেয়েছেন তিনি। কী যেন আছে ওই মেয়ের চোখেমুখে, মুখপানে চাইলে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না চট করে। বেঁধে ফেলে সবাইকে। ইমরানকেও বাঁধবে- তাই তো তড়িঘড়ি করে, ওইটুকু মেয়েকে ঘরে এনেছেন তিনি।

সাইদার বাপের বাড়ির দেশের মেয়ে সুমনা। বেশ ভালো পরিবার। স্বামি মরেছে বছর পাঁচ। পরশ, অনি আর অলি তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। ভাশুর, দেবর, ননদ সবার সাথেই বেশ ভালো সম্পর্ক। এই পরিবারটাকে বেশ লাগে সাইদার, আর ওই অনি – অনির ছোটোবেলা থেকেই দেখছেন ওকে। যতবার বাপের বাড়ি গেছেন অনি তার আঁচলে আঁচলে ঘুরেছে, এইটুকু থেকে পুরোটা চেনেন সাইদা ওকে।

একটু দুরন্ত, একটু বেশিই ছুটোছুটি করে, ঘরকন্যায় হয়তো কোনো কাজেই লাগবে না, তবুও অনিন্দ্য সুন্দর মুখশ্রী দিয়ে ইমরান বশ মানলেই তার হবে। হয়তো বশ মেনেছেও। সকাল সকালই বউকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে।

পলাশডাঙার মেয়েদের প্রশংসা করলেন তিনি মনে মনে। তিনি নিজেও ওই পলাশডাঙারই মেয়ে।

ছেলেরা অল্পবয়সী বউয়ের আঁচলে তাড়াতাড়িই বাঁধা পড়ে। বাঁধুক না ওকে অনি, ভালো করে বজ্রগেরোয় আটুক, যেন বিদেশ গিয়ে আর মন না বসে বাছাধনের, ফিরে আসে বছর না ঘুরতেই।

বউয়ের টানেই নাহয় মায়ের কোলে ফিরে আসুক!

সুমনা, অনির চাচিরাও কাজে সাহায্য করছেন। শুধু ইমরানের জন্য রান্না হচ্ছে তা তো না, বড় বড় হাড়িতে মেহমান নওয়াজিও চলছে। সবাই সাহায্য করছে কম, বেশি – ধুমধাম করে বিয়েটা না হলেও, হাসি-ঠাট্টা-মজায় সবাই পুষিয়ে নিচ্ছে।

শুধু পরশের চোয়াল শক্ত। ছেলেটা বিয়েতে তো রাজি হয়ইনি, ইমরান আর অনির বয়সের তফাত তো আছেই, বিয়ের চারদিনের মাথায় বর দেশের বাইরে অনির্দিষ্টকালের জন্য চলে যাবে এটাও মানতেই পারছে না ও।

অনি, অলি দুটোবোনই ওর খুব আদরের। বোনেদের ভবিষ্যৎ জীবনের সামান্য কালো মেঘের ছায়াও ওকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।

বয়স কম হলেও গায়ে-পায়ে বড় হয়ে যাওয়াতে এমনিতেই অনিকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মুকুল দানা বাঁধতে শুরু করেছিল।

গ্রামের ছেলেছোকরাদের আনাগোনাও চলে বাড়িঘিরে। কিন্তু নিজেকে এতোটাও ঠুনো মনে হয়না পরশের যে সাততাড়াতাড়ি এইরকম অদ্ভুত বিয়ে দিতে হবে।

ওর মনোভাব বুঝতে পেরেই সুমনাও ওকে বিয়ের কথাটা লুকিয়ে গিয়েছিলেন।

পরশ জানত, শুধু আংটি পরানো হবে, বিয়ের কথাটাই পাকা হয়ে থাকবে। বছর দুই পরে ইমরান ফিরলে তখন বিয়ে হবে অনি আর ইমরানের।

কিন্তু এখানে এসে দেখল, সব উলটো। একেবারে কাজি ডেকে বিয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

অনি আন্ডারএইজ হওয়ায় কমিশনার অফিস থেকে অনুমতিপত্রও আনা হয়েছে।

সব একেবারে গোছানো। আজীবন পাওয়া ভদ্রতার শিক্ষা ওর কন্ঠরোধ করে রেখেছে। তার চেয়ে বড় কথা, অনির চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখেছে পরশ। ইমরানের নামোল্লেখে সেই খুশিমুখে রক্ত ছলকে ওঠে তাও খেয়াল করেছে ও। আর তাই ওর প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ নিরস্ত্র আর নিশ্চুপ হয়ে আছে।

কিন্তু ইমরানের অনিচ্ছাও তো চোখ এড়ায়নি ওর।

তাই অশনী সংকেত বেজেই চলেছে মনের ভেতর আর ছটফট করছে ভেতর ভেতর।

সুমনা, অনির বড়চাচি, ছোটচাচি সবাই হাত লাগাচ্ছে সাইদাকে সাহায্য করতে। বেশ পারিবারিক আবহ। সাইদার আত্মতুষ্টি হয় সেদিকে তাকিয়ে। সবার ভিতরেই সহযোগী মনোভাব।

খারাপ কিছু করেননি সাইদা এই পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কে জড়িয়ে, নিশ্চিন্ত লাগে তার।

দুপুরের খাবার একটু দেরিতেই হয় এই বাড়িতে। আড়াইটা-তিনটে বেজে যায়। আজকে আরেকটু দেরি হচ্ছে। অনি আর ইমরানের জন্য অপেক্ষা করছিল সবাই। একটু আগে ইমরান ফোন করে জানিয়েছে, ওরা বাইরেই খাবে আজকে।

রান্না করে সাজিয়ে রাখা ইমরানের সব প্রিয় খাবারগুলোর তাকিয়ে সাইদার একটু মন খারাপ হলো কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন, একটু খুশিও হলেন মনে মনে, হয়তো বুনো বাঘ পোষ মানছে।

ছেলের অসম্মতিতে তাকে বিয়ে দেওয়ার অপরাধবোধ লঘু হয়ে এলো অনেকটাই।

একটু অন্তরঙ্গ সময় যদি হৃদ্যতা বাড়িয়ে দেয় একটু হলেও তবে বিরহ সেই সম্পর্ককে আরও অনেকখানি দৃঢ় করে দেবে। মনে মনে আশ্বস্তই হলেন তিনি বেশ খানিকটা !

চলবে

Afsana Asha

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here