যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে #পর্ব_৬,৭

0
1204

#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_৬,৭
Afsana Asha
পর্ব_৬

‘ইমরানের মা, কি, প্ল্যান কাজে লাগল? ছেলেকে আটকাতে পারবে? দুনিয়ার সব মা, তার ছেলেটা বউয়ের গোলাম হয়ে গেল বলে সুর তুলে কাঁদে। তুমি প্রথম মা যে চাইছে ছেলে তার বউয়ের আঁচলে আটকে থাকুক। হ্যাটস অফ টু ইউ।’ হাসতে হাসতেই আব্দুল মজিদ সাহেব টিটকারি করলেন নিজের বউকে, ইমরানের মাকে।

টিটকারিটা গায়ে মাখলেন না সাইদা।

কয়েকদিন ধরে বিষন্নতা পেয়ে বসেছে তাকে। কারণে অকারণে চোখদুটো ভিজে আসছে।

ঢিলেঢালা ম্যাক্সি পরেন ঘরে, বড় বাটিক ওড়না জড়িয়ে। ওড়নার কোনা দিয়ে চোখ মুছলেন।

বাঁধুক না অনি ইমরানকে।

বড় ছেলে তার। প্রথম সন্তান।

ইকরাম আর ইমা এসে শুধু ঘর ভরিয়েছে, বুকের কাছাকাছি জায়গাটা শুধু ইমরানের জন্যই, সারাজীবন।

মায়ের কোল ছাড়া ঘুমাতোই না। ইকরাম ছোটো তাও ওকে রেখে বড়জনকেই কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে হতো। কোল থেকে নামালেই ঘুম ভেঙে কান্নাকাটি। শীতের দিনে ফ্ল্যানেলের কাপড় দিয়ে বড় হাতার ব্লাউজ বানাতে হয়েছিল নিজের জন্য, কারণ হাত তো লেপের বাইরে থাকে, হাতের উপর মাথা না রাখলে ইমরানের ঘুমই হয় না। তার সেই ইমরান একটু একটু করে দূরে সরতে লাগল।

সব ছেলেদের মা বলে ‘আরেকটু পড়’ সেখানে সাইদা বলতেন ‘আজকে আর পড়তে হবে না, ঘুমা আজকে।’ অন্য বাচ্চাদের চেপে ধরে পড়ানো যায় না, ইমরানকে টেনে ওঠানো যেত না বই থেকে।

কত কত প্রশংসা চারিদিকে, কত ভালো ভালো কথা। ভালোই লাগত তখন।

ঝামেলা শুরু হলো ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পরেও ছেলে যখন ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়তে চাইল।

কি নাকি মার্কেটিং নিয়ে পড়বে, মার্কেটিং বস হবে, ফিলিপ কোটলার, সেদ গোডিন নামগুলো পারলে পুজো করে।

এটা কোনো কথা? বাবা মা কিভাবে মেনে নেয়? মার্কেটিং মানেই তো, ওই যে শার্ট, প্যান্ট, টাই পরে একটা কালো ব্রিফকেস হাতে দোকানে দোকানে ঘোরে। ডাক্তার না, ইঞ্জিনিয়ার না, সরকারি চাকরিও না, এতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র কিনা হবে সেলসম্যান, বাংলায় ফেরিওয়ালা!

কোন বাপ মা মেনে নেবে?

সেই শুরু হয়েছিল যুদ্ধ। ছেলের সাথে বাপ-মায়ের ঠান্ডা যুদ্ধ। আর ছেলেটা প্রতিদিন নিজের ভেতর একটু একটু করে গুটিয়ে যেতে থাকল। এখন মনে হচ্ছে সাইদার, হোক যা ইচ্ছে তাই, মুচি হোক বা হরিজন, তবুও মায়ের কাছে থাক, মায়ের চোখের সামনে থাক।

চোখের পানি মুছে আবার হুহু করে কাঁদতে থাকেন তিনি।

*****

স্যুপের বাটিতে অকারণ নাড়াচাড়া করছে অনি।

ইমরান নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

হাতে মেহেদীর রঙ খুলেছে।

মুখের চেয়ে হাতটা একটু বেশিই উজ্জ্বল অনির।

কনুই পর্যন্ত মেহেদী আঁকানো। দুটো আংটি হাতে। একটা সোনার আর একটা হীরের। পাঁচ পাথরের হীরের আংটি।

এটা ইমরান পরিয়েছে ওকে। ইমরানকে দিয়ে পরানো হয়েছে।

সেদিকে তাকিয়ে ইমরান ভাবতে লাগল, একটা কাগজ, একটা আংটি দিয়ে কত সহজে একটা মানুষকে অধিকার করা যায়। ওই গয়নাগুলো হয়ে যায় অধিকারবোধের প্রতীক। শুধু দামে নয় সম্পর্কের মানেও ওই অলংকারগুলো ভীষণ দামি হয়ে ওঠে। বিয়ের আংটি বা নাকের গয়না কারো কারো কাছে প্রাণের চেয়ে দামী হয়ে যায়।

শরীরে প্রাণ থাকতে ওই গয়নার অধিকার ছাড়তে চায়না কেউ।

আর মাঝের থেকে অধিকারবোধ ছেড়ে দিলে? গয়নাগুলোও কি ফেলনা হয়ে যায়?

হয়তো অনি ফিরিয়ে দেবে গয়নাগুলো, নইলে নিজের কাছে গোপনে রেখে দেবে এমনভাবে যেন চোখে পড়ে না কখনো। ফেলনা গয়নায় চোখ পড়ে ইমরানকে যেন মনে পড়ে না কখনো।

নিজেকে সেই ফেলে দেওয়া আংটির মতো মনে হতে লাগল ইমরানের।

বাবা-মার সাথে একটা জেদাজেদির খেলা চলছিল এইকদিন।

জোর করে বিয়ে দেবে? দাও। বাধ্য করবে বিয়ে করতে? করো। বেশ! দেখো আমি কী করি? আমিও দিলাম ছেড়ে। এবার? বাবা মায়ের সাথে জীবনের দরকষাকষির এই খেলার নিজেকে বিজয়ী করে নিলো গোপনেই। আর জিতে গিয়েই পরাজিত হওয়ার অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে গিলে নিলো ওকে।

‘অনি?’

‘হুম’

‘কী করবে, এখন।’

‘এখন?’ চিন্তিত দেখায় অনিকে। একটু ভেবে বলল ‘আপনাদের বাসায় তো যাবো। তাই না? নাকি আর কুনো কাম আছে?’

‘সেটা বলিনি। জানতে চেয়েছি, আমি চলে যাওয়ার পর কী করবে?’

‘ওহ! আমি? জানিনে তো। বাড়ি চলে যাব। কিন্তু আপনের মা কি যাইতে দেবে? আপনে একটু বলে দিয়েন?’

সহজ আর স্বাভাবিক উত্তর অনির।

কিন্তু ইমরানের রাগ হতে থাকে।

এতো সহজে কেন মেনে নেবে অনি সব? ঝগড়া করবে না? দাবি করবে না?

ইমরানের কথায় নিজের অধিকার সব এত সহজে ছেড়ে দেবে?

হয়তো ছোটোমানুষ, তাই। বুঝতে পারছে না কিছু, কী হচ্ছে ওর সাথে? একটু বড় হলে নিশ্চয়ই বুঝবে।

তখন হয়তো জবাবদিহি করতে ইমরানকে দরকার পড়বে ওর। হিড়হিড় করে টেনে আনবে ওকে সুদূর থেকে, উত্তরের প্রত্যাশায়।

সেই জবাবদিহির মঞ্চে অনির আসামীর কাঠগড়ায় নিজেকে দেখতে রোমাঞ্চকর লাগে ইমরানের।

বয়স তো ইমরানেরও বেশি না। বই আর স্বপ্নের মাঝখানে নারীঘটিত চিন্তা কখনো বাধ সাধেনি।

সেদিক দিয়ে অনিই ওর জীবনের প্রথম নারী।

অনির দিকে তাকিয়ে নতুন প্রেমে পড়া যুবকের মতো আনন্দ হতে লাগল ওর।

ও ভুলে গেল এই একটু আগেই এই মেয়েটার সাথে সবরকম সম্পর্ক নিজের হাতে ছিন্ন করেছে ও।

কতকটা নির্বুদ্ধিতায়, কতকটা অকারণে!

সেসব ভুলে অপলক তাকিয়ে থাকল ও ষোড়শী অনির দিকে, সকালের যে সেন্টারসিঁথি দেখে মনে মনে ব্যাঙ্গ করছিল, এখন সেখানেই মন আটকে আছে যেন। কপালের ঠিক মাঝখান দিয়ে, ফসলের ক্ষেতের সরু আলপথের মতো, যত্নবিবর্জিত ইষৎ কটা চুলগুলোকে দুপাশে বিভাজিত করে সরলরেখার মতো চলে গেছে, টানটান করে বাঁধা খোপা অবধি।

একবেলা আগে যা ভিষণ অসহ্য লাগছিল, মনের দ্রুততম পরিবর্তনে সেই সিঁথিপথে ওর মন আনাগোনা করতে লাগল।

অনভ্যস্ততায় ঘোমটাখানি হয়তো পড়ে কাঁধের উপর এলিয়ে এসেছিল। অনি আস্তে করে মাথাঢাকা ঘোমটায় সুন্দর কপালখানা ঢেকে নিলে ইমরান যারপরনাই বিরক্ত হলো।

কিন্তু ওর হয়তো ভালো লাগার সময় চলছে, ভালো লাগার অসুখে পড়েছে, অসুখ তো আর বলেকয়ে, সময়-জ্ঞান মাপামাপি করে আসে না!

গাঁয়ের বধূর মতো ঘোমটাটানা, গেঁয়ো অনিকেও ওর এখন খুব ভালো লাগছে। কেমন জানি বউ বউ মনে হলো!

চলবে
Afsana Asha

#যখন_এসেছিলে_অন্ধকারে
#পর্ব_৭

বাসায় পৌঁছেই ইমরানের খুব অস্থির লাগতে লাগল। কী যেন একটা খুব ভুল হয়ে গেছে। স্কুলে পড়ার সময় পরীক্ষার আগে কলম নেওয়া হয়নি নইলে এডমিট কার্ড ভুলে বাসায় রেখে গেলে যেরকম ছটফট করত মন সেরকমটা লাগছে। সারা বাসায় মানুষ গিজগিজ করছে, কিন্তু ইমরানের ঘরে ইমরান একা। ওকে বিরক্ত করায় বারণ আছে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপ কোলের উপরে রেখে কাজ করছিল, উঠে বসে মাথাটা ডানেবাঁয়ে ঝাঁকাতে শুরু করল। ঠোঁটদুটো টিপে ধরে নিজের মনেই খানিক বিড়বিড় করল ‘খুব ভুল হচ্ছে।’ কিন্তু কী ভুল হচ্ছে মনে পড়ল না। উঠে গিয়ে সব পেপারস চেক করল, লাগেজে নেওয়া জিনিসপত্রের লিস্ট ধরে ধরে রিচেক করল, কোথাও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফেলে যাচ্ছে কীনা! চিন্তামুক্ত হলেও ছটফটানিটা কমল না। ওর ঘরের সাথে এক টুকরো বারান্দা। বারান্দাওয়ালা ঘর ইমরানের পছন্দ না। দরজা খুলে রাখলে বাতাস এসে সব কাগজ, নোটশীট এলোমেলো করে দিয়ে যায়।

ঘরটা ইমার।

মেয়ে হওয়ার সুবাদে ইমা আলাদা একটা ঘর পেয়েছিল নিজের ভাগে। টিপটপ করে সাজিয়ে রাখত ঘরটা। ইকরামের সাথে রুমশেয়ার করতে হতো ইমরানের।

ইকরাম নাকি লাউডসাউন্ডে গান শোনে, গেম খেলার সময় হাত পা ঝাঁকায়, ইমার বিয়ের পরে ঘরটা খালি হলে, এই অজুহাতে একদিন নিজের বইখাতা নিয়ে মেয়েলি আলমারি, ড্রেসিং টেবিলে সাজানো ঘরটার দখল নিয়েছে ও।

ইমা শশুরবাড়ি থেকে এসে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল কিন্তু ইমরান বা বাবা-মা কারো কাছেই পাত্তা পায়নি।

ইকবালের চোখ চলে গেল ড্রেসিং টেবিলের দিকে – একগাদা কাচের চুড়ি খুলে রাখা, চুলের ক্লিপ, একটা খোলা সেফটিপিন, একপাশে দলা করে রাখা ব্যবহৃত কাপড়, ফাঁক দিয়ে অন্তর্বাস বেরিয়ে আছে, একপাশে পাট করে গুছিয়ে রাখা শাড়ির বান্ডিল, তার উপর অবহেলায় সোনার কাঁকন পড়ে আছে। প্যারাসুট নারিকেল তেলের নীল রঙের বোতল, পেন্সিল কাজল, চিরুণির দাঁতে লম্বা লম্বা চুল পেঁচানো – একটা রাতের ভেতর ঘরটা আবার মেয়েলি আগ্রাসনের শিকার!

সেসব দেখে মুখ দিয়ে ‘চ্যু’ করে একটা শব্দ করল ইমরান আর তখনই ওর অস্থিরতা কমে এলো। কোথায় ভুল হয়েছে বুঝতে পারল আর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here