#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব২৩
রাকিন বারবার চশমাটা ঠিক করার বাহানায় রুমিকে দেখে নিচ্ছে। কী মিষ্টি লাগছে রুমিকে, গোলাপি জামদানীর সাথে হালকা সোনার গয়না, আর মাথার হাত খোঁপায় সাদা বেলীফুল। মুখে যতটুকু প্রসাধনী না হলেই নয়, চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক, দুই হাত ভর্তি একরাশ কাঁচের চুড়ি। সবমিলিয়ে চমৎকার।
আজ রুমির ছোটবোন রশ্মির বিয়ে। রৌশন আপা ছাড়া রুমির কলিগরা মোটামুটি সবাই এসেছেন। রুমি বাবা মায়ের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেয়। হাসান বেশ আগ্রহ নিয়ে রুমির বাড়ির সবার সাথে কথা বলে। রুমির ছোটভাই আদিলের সাথেও পরিচিত হয়। রাকিন বরাবরই চাপা স্বভাবের, কুশল বিনিময় ছাড়া তেমন কিছু তার মুখ দিয়ে বের হয় না। কয়েকবার রুমির সামনে এসে ভেবেছে দুটো প্রশংসার কথা বলবে। কিন্তু গলা শুকিয়ে যায়। তারচেয়ে বরং তিতলির সাথে মেশা রাকিনের জন্য সহজ হয়।
আড় চোখে বারবার রুমিকে দেখতে দেখতে রাকিনের মনে হচ্ছে কতদিন বিয়ে বাড়িতে এত স্নিগ্ধ সুন্দর সাজে কাউকে দেখে না। ইদানীং বিয়ে বাড়িতে আসা প্রত্যেক মেয়ের একই রকম পার্লারের চড়া সাজের প্রলেপ, সেট করা চুল, আর ভারী গয়নার বাহার দেখতে দেখতে কেমন একঘেয়ে লাগে। বৌর সাথে সাথে বাড়ির অন্য মেয়েরাও ব্রাইডাল সাজে ঘুরে বেড়ায়। টিকলি, নোলক আর লেহেঙ্গার ভীরে কে যে কনে, কে যে কনের বোন, তা বোঝা দায়। রুমি তিতলিকেও সুন্দর একটা ফ্রক পরিয়েছে। রাকিনের সাথে তিতলি বেশ মিশে গিয়েছে, এখন রুমির কলিগদের ভীরে তিতলি রাকিনের কোলেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
“মরিয়ম আপু, তুমি এসেছ, এত এত খুশি হয়েছি। আর শিহাব ভাইয়া আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ আপুকে নিয়ে এসেছেন।”
“রুমি তুমি নিজে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছ, না এসে পারি। তবে বেশিক্ষণ থাকব না। রুমনকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওর দাদু আর ফুপির কাছে রেখে এসেছি।”
“ওকেও নিয়ে আসতেন আপু। ওর এখানে কোন সমস্যা হতো না, আমি খেয়াল রাখতাম।”
“জানি রুমি। তবে ইচ্ছে করেই আনিনি, এত লোকের ভীর ও পছন্দ করে না। থাক বাদ দাও, তোমার কথা বলো, এত সুন্দর লাগছে, আজ অনেকের নজর ঘুরে ঘুরে তোমার দিকেই আটকে যাচ্ছে।”
“আর নজর আটকানো আপু। যখন আমার সাথে তিতলির কথা শুনবে, নজর ঘুরতে সময় লাগবে না। এই দায়িত্ব সবাই নিতে পারে না।”
মরিয়ম ঘুরে একবার হাসান, আরেকবার রাকিনকে দেখে। হাসান আড্ডায় ব্যস্ত। রাকিন একপাশে বসে তিতলিকে জিলাপি খাওয়াচ্ছে।
“রাকিনকে দেখ। এমনি মুখচোরা, কিন্তু তিতলির সাথে কেমন মিশে গেল।”
“হ্যাঁ আপু, আমিও অবাক।”
সময় গড়িয়ে যায়, বিয়ের আয়োজন ভালো ভাবেই শেষ হয়। কলিগরা একে একে সবাই বিদায় নেয়। হাসানও রুমির কাছে বিদায় নিতে আসে। “রুমি তোমাকে কিন্তু আজ একদম একদম গোলাপি পরী লাগছে।” সেই একই রকম হৃদয় মোচড় দেওয়া মিষ্টি হেসে বলে হাসান।
রুমির মনে অনেক প্রশ্ন আছে, যা সে মরিয়ম আপার বাসা থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছে, আর রশ্মির বিয়ে শেষে যার জবাব খুঁজবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে হাসানের সামনে তার সেসব কিছুই মনে পড়ে না। তার মনে হয় এই তো সত্য, এই তো সুন্দর। তারপরও কিছু প্রশ্ন করার সময় এসেছে, “হাসান, আব্বা আম্মার সাথে তোমাকে আলাদা করে একটু পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। আর তিতলির সাথেও।”
“সবার সাথে পরিচিত তো হয়েছি। নতুন করে কী হবো? আর তিতলি তো রাকিনের সঙ্গই ছাড়ছে না। মানে রাকিন সবাইকে দেখাতে চায় সে বাবাহীন মেয়েকে কত আদর করছে।”
‘বাবাহীন মেয়েকে আদর’ কথাটা রুমির বড় কানে লাগে। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “রাকিন ভাই তো বড়দের সাথে অতটা কথা বলেন না। হয়তো বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। আর বাচ্চারা যেখানে আদর পায় সেখানে যায়। তুমি তো ওভাবে তিতলিকে সময় দাওনি। যাক সে কথা, আমি বলছিলাম অফিসিয়াল ভাবে আমাদের দুই পরিবারে পরিচিত হওয়ার কথা। আমার পরিবারে তোমার, আর তোমার পরিবারে আমার।”
“রুমি, তুমি এক বাচ্চার মা, কোন টিনএজ মেয়ে তো না যে এত অস্থির হচ্ছ। তুমি আমার সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করো, আর আমিও। এর বাইরে অফিসিয়াল দিকে আস্তে আস্তে যাই। আমরা তো একসাথে একান্তে সময়ও কাটাইনি এখনো। রিলেশনে থাকাকালীন যতটা কাছাকাছি আসা দরকার তাও তো আসা হলো না। আমি বুঝতে পারছি দীর্ঘদিন একা থাকায় একটা স্থায়ী সম্পর্কের জন্য তুমি অস্থির হয়ে আছ। কিন্তু তার আগে আমাদের দুজন দুজনকে আরও কাছ থেকে জানা প্রয়োজন, তাই না? চলো কাল তো ছুটির দিন, আমার সাথে বাইকে করে আশুলিয়া যাবে, একান্তে সময় না কাটালে বিশ্বাস আর ভালোবাসা আসবে কি করে। যাবে বলো?”
রুমি সহসা কোন জবাব দেয় না। হাসান জানাতে বলে চলে যায়। রুমি খেয়াল করিনি, কিন্তু রুমির মা সাহেদা বেগম দূর থেকে হাসান আর রুমি দু’জনকেই খুব ভালো করে খেয়াল করছিলেন।
(চলবে)