#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব২৬
রাত নয়টা পঁয়ত্রিশে পাঁচ লাখ টাকা কাবিনে রাকিন আর রুমির বিয়ে হয়ে যায়। কাবিনের টাকা রাকিনের পরিবারই ঠিক করেছে। রাকিন কাবিনের টাকা নগদে পরিশোধ করতে চায়, তাই তার সাধ্য মতো টাকার পরিমাণ রাখার অনুরোধ করেছে। রুমির বাবা মা অপ্রত্যাশিত ভাবে এমন প্রস্তাব পেয়ে এতটাই অবাক হয়েছেন যে কোন কিছু নিয়ে অতিরিক্ত ঘাটা ঘাঁটি করতে চাইলেন না। রাকিন তার প্রথম বিয়ের কথা শুরুতেই খুলে বলেছে। যেহেতু রুমিরও এটা দ্বিতীয় বিয়ে, তাছাড়া রাকিন হাসান রুমির সম্পর্কে সবকিছু কাছ থেকে জেনেও রুমি আর তিতলিকে খুশী মনে নিজের জীবনের অংশ করতে যখন চাইছে তখন এই বিষয়টা ওনাদের কাছে বড় কোন সমস্যা মনে হয়নি।
যদিও আত্মীয় স্বজনদের হঠাৎ ফোন করে বিয়ের কথা জানাতে সবাই ভীষণ অবাক হয়েছে। কিন্তু তারপরও স্বল্প সময়ের ভেতর সবাই হাজির হয়েছেন। রুমির মামার আরও বেশি কাবিন ধরার ইচ্ছে ছিল, অন্তত দশলাখ, কিন্তু বোন আর দুলাভাই রাজি দেখে এই নিয়ে কথা বাড়াননি।
রুমির ছোটবোন রশ্মি স্বামীকে নিয়ে এই শর্ট নোটিশে মিরপুর থেকে চলে এসেছে। এছাড়া মামা মামী, আর তিন চাচা চাচীও এসেছেন। রাকিন তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ আটজন মানুষকে আনার ব্যবস্থা করেছে। অল্প সময়ের ভেতর পঁচিশ জন মানুষ নিয়ে খুব ছোট করেই বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হয়ে যায়। রুমির আর পোশাক বদলানো হয়নি, যে লাল বালুচরি শাড়ি পরে আজ হাসানকে বিয়ে করতে কাজী অফিসে গিয়েছিল, সেই লাল বালুচরিতেই রাকিনকে তিনবার কবুল বলে গ্রহণ করে নেয়।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রুমি বিয়ে নিয়ে নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু মরিয়ম আপা আর রুমির আম্মা এমন করে বোঝালেন যে আর না করতে পারেনি। আরও একবার নিজের ভালো থাকাটা অদৃষ্টের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে রুমি। এমনকি রাকিনের আম্মা যখন মাথায় হাত বুলিয়ে বালা দুটি পরিয়ে দেন, তখনও একদম নিশ্চল ছিল সে। সাহেদা বেগম রুমিকে ধরে সবাইকে সালাম করায়।
“রুমি তোমার কথা রাকিন যতটুকু আমাকে বলেছে, আমি বুঝতে পারছি, আমার ছেলেটার মতো তুমিও পরিস্থিতি আর দুর্ভাগ্যের শিকার। তবে মা তোমাদের দু’জনের কাছেই অনুরোধ থাকবে, খুব হুট করে নতুন জীবনে ঢুকলেও হুট করে কোন সিদ্ধান্ত আর নিও না। আমি বহুদিন ধরে রাকিনের পেছনে পরে আছি, কিন্তু জীবনটা আবার গুছিয়ে নিতে ও প্রস্তুত ছিল না। এখন একদম হঠাৎ করে ও তোমার কথা বললো, আমিও না করতে পারিনি। আগেরবার তো নিজে দেখেশুনে বিয়ে দিয়েও ছেলে সুখী হয়নি। এবার নিজের পছন্দে যেহেতু তোমরা দু’জন বিয়ে করছো, আশা করি সুখ খুঁজে পাবে। না পেলেও খোঁজার চেষ্টাটা অন্তত করবে।”
রুমি কোন উত্তর দিতে পারে না, বলা হয় না যে এবারও নিজের পছন্দে নিজের জীবনসঙ্গী বাছাই করছে না ও। আগের বার পরিবার করেছে, আর এইবার বোধহয় অদৃষ্ট। নিতান্তই কলের পুতুলের মতো বসে ছিল রুমি। মরিয়ম আপা আর রশ্মি হালকা মেকআপ দিয়ে ওকে সাজিয়ে দিয়েছে। সাহেদা বেগম একসেট সোনার গয়না বের করে দেন, যেগুলো রুমিরই গয়না, ডিভোর্সের পর ওনার কাছে ছিল। আগের গয়না গুলো দিয়েই আবার বৌ সাজে রুমি।
আদিল দ্রুত লোকাল দোকান থেকে হবু দুলাভাইয়ের জন্য সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে ভীষণ সাদামাটা আয়োজন। কিন্তু রুমি আর রাকিনকে যখন পাশাপাশি বসানো হয় যেন ঘরময় আলো খেলে গেল। দু’জনকে এতটাই মানিয়েছে যে এই সাধারণ সাজেই বর কনেকে অপরূপ লাগছে। ঘরে থাকা আড়ংয়ে কাঠের নকশা করা আয়না যখন সামনে ধরে রুমির মুখটা রাকিনকে দেখানো হয়, রাকিনের মনে হচ্ছিল “পাইলাম, অবশেষে আমি ইহাকে পাইলাম।”
রুমি অবশ্য মুখ তুলে চায় না।
রুমির যেহেতু কিছু গোছানো নেই, তাই আজ রাতটা এই বাসায় থেকে কাল রাকিনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সবাই। কিন্তু রাকিনের আম্মা জেসমিন আক্তার ছেলে বৌ নিয়ে আজই রওনা দিতে চান। নতুন বৌ বরণ করে নিতে ওনার তর সইছে না। শেষ পর্যন্ত ছোট একটা হাত ব্যাগে নিজের আর তিতলির প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস গুছিয়ে নেয় রুমি। সারাদিন মরিয়ম আপা ছায়ার মতো ওর পাশেই ছিল,
“আপু, তোমার এই শরীরে আমার জন্য এত কষ্ট করেছ। কোন একদিন তীব্র অভিমানে তোমাকে বলেছিলাম, আমার বোন হলে বাসায় থাকতে কী না করতে পারতে কিনা। আজ সেই কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। আমার বোনও বোধহয় আজ আমাকে এভাবে সামলে নিতে পারতো না। ঠিক যেখানে আমার পাশে দাঁড়ানো দরকার ছিল, তুমি সেখানে দাঁড়িয়েছ। তোমার আর ভাইয়ার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো সারাজীবন। দোয়া করো সুখী না হই, অন্তত তিতলিকে নিয়ে ভালো যেন থাকি।”
“সুখী হবে রুমি, বিশ্বাস করো, মানুষ চেনার একটা চোখ আছে আমার। আমি শিহাবকে চিনেছিলাম ঠিক ঠিক। আজ রাকিনের মাঝে সেই বহুদিন আগের শিহাবের ছোঁয়াই পাচ্ছি। দেখ ও তোমার হাত ছাড়বে না।”
বিদায় বরাবরই বেদনার, বাবা মা কে ছেড়ে আরেকবার যেতে রুমির হৃদয়ে একই রকম রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বাবা অবসরের পর অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছেন। আদিলটা যেমন স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে, রুমি আর রশ্মির বিদায়ের পর কী নিজের সংসারে মা সাহেদা বেগমের দিনগুলো ভালো কাটবে, আদিল আর আদিলের স্ত্রী কী সব দায়দায়িত্ব নেবে। রুমি কী পারবে দূর থেকে বাবা মায়ের খেয়ালটা রাখতে, আগের মতো মায়ের হাতে কিছু খরচ দিতে। মা মুখে না বলুক, রুমি জানে ঐ সামান্য কয়টা টাকাই সাহেদা বেগমের শক্তি এখন। রাকিন বা তার পরিবার কী বিয়ের পর এতে বাঁধা দেবে! আর তিতলি! তিতলিকে কী ওনারা নিজেদের অংশ রূপে গ্রহণ করবে, না বৈরী পরিস্থিতিতেই ওর শৈশব কাটবে। রাকিন তিতলির বাবা না হোক, অভিভাবক কী অন্তত হবে! এমনই হাজারো প্রশ্ন সাথে নিয়ে বাড়ি ছাড়ে রুমি, কোলে ছোট্ট তিতলি, যে ভীষণ খুশি, অনেকদিন পর সাজুগুজু করে মায়ের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে, সাথে আছে প্রিয় রাকিন আঙ্কেল। নানা নানু যদিও রাকিন আঙ্কেলকে আব্বু বলতে বলেছে, কিন্তু তিতলির মন তা মানতে নারাজ, তার তো আব্বু আছেই, যদিও আব্বু এখন আর দেখা করতে আসে না। তবুও রাকিনকে সে আঙ্কেলই বলবে, আব্বু না।
(যারা আমার লেখা পছন্দ করেন, তারা বইটই এপস হতে আমার সদ্য প্রকাশিত ই-বুক “প্রেম কিংবা দ্রোহ” সংগ্রহ করতে পারেন। দুটি অপ্রকাশিত গল্প রয়েছে ই-বুকে। আশা করি ভালো লাগবে। মূল্য ২৫ টাকা।
যেভাবে বইটই থেকে ই-বুক ক্রয় করবেন:
(চলবে)