#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১১,১২
#নবনী_নীলা
জিম সরু দৃষ্টিতে পিছনে তাকালো। তারপর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো। স্পৃহা তেজী গলায় বললো,” দেখে হাঁটতে পারেন না।”
জিম দাতে দাঁত চিপে তাকালো। মেয়েটা নিজে ধাক্কা দিয়ে তাকে মেজাজ দেখাচ্ছে। জিম বির বির করে বললো,” স্টুপিড।”
বির বির করে বললেও স্পৃহা স্পষ্ট শুনেছে যে তাকে স্টুপিড বলা হয়েছে। তারপর তেলে বেগুনে চটে গিয়ে বললো,” এই আপনি কাকে স্টুপিড বললেন? হ্যা। কি সমস্যা কি আপনার? নিজে এমন রোবোটিক শরীর নিয়ে হাঁটেন, তো দেখে শুনে হাঁটবেন না? আবার আমাকে স্টুপিড বলছে। আমি স্টুপিড হলে আপনি কি? আপনি হলেন স্টুপিডের উপরের লেভেলের স্টুপিড।” বলেই হনহনিয়ে জিমকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
জিম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি আশ্চর্য মেয়ে! শুধু স্টুপিড বলায় পাঁচটা কথা শুনিয়ে দিয়ে গেলো।
স্নিগ্ধা রূমে চুপ চাপ বসে আছে। একটা মানুষ কারোর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকলে কি কোনোভাবে নিজেকে শান্ত রাখা যায়। আদিল রুমে আসার পর থেকেই বুকের কাছে হাত ভাজ করে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা ইচ্ছে করে এমন করছে, তাকে চূড়ান্ত অসস্তিতে ফেলতে চায় সে। স্নিগ্ধা বইয়ের থেকে চোখ সরিয়ে আড় চোখে অভ্রর দিকে তাকালো। অভ্র অদিলের দেখাদেখি এক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। আর কিছুক্ষণ পর পর চোখের পাতা ফেলছে। মানে তাকে কেউ শান্তিতে থাকতে দিবে না। চুপ করে থাকলেও তাকেই জ্বালাবে।
স্নিগ্ধা ফট করে বই বন্ধ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আদিলের দিকে তাকালো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,” এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?”
” তোমার হুট করে এই রাগের কারণ কি? শুধু মেয়েগুলো তোমার ঘরে উকি দিয়েছে এই জন্যে এতো রাগ?”,আদিল শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো। স্নিগ্ধা দাতে দাঁত চিপলো।
এর মাঝেই স্পৃহা ফরিদা আপাকে সঙ্গে নিয়ে রুমে এলো। তারপর নিশব্দে খাবার গুলো একে একে টেবিলে রেখে ফরিদা আপা চলে গেলো। স্পৃহা পা টিপে টিপে আদিলের কাছে গিয়ে নিচু গলায় বললো,” তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। খুবই লজ্জা লাগছে বলতে, আসলে আমার ঐ বান্ধুবি গুলো তোমাকে …..”
এতটুকু বলেই স্পৃহা থেমে গেলো। পরের লাইনগুলো কিভাবে বলবে সে? তার বান্ধুবীগুলো যে এতো ফাজিল সেটা কি তার জানা ছিলো? সকাল বেলা আদিলকে শার্টলেস দেখে ফিসফিস করে উল্টা পাল্টা কিসব বলেছে সেইগুলো শুনেই স্নিগ্ধা ক্ষেপে গেছে।
আদিল স্পৃহাকে চুপ থাকতে দেখে ভ্রু তুলে বললো,” কি হলো? কথাটা শেষ করো।”
স্পৃহা অস্পষ্ট গলায় কোনোভাবে বলেই দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। অভ্র বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে স্পৃহার পিছু পিছু চলে গেলো। অভ্রর এই বাড়িতে একটাই কাজ স্পৃহার পিছু পিছু যাওয়া।
আদিল হাত ধুয়ে এসে স্নিগ্ধার পাশে বসলো। তারপর বাম হাতে টান দিয়ে স্নিগ্ধার সামনে থেকে বইটা নিয়ে নিতেই।স্নিগ্ধা অবাক চোখে তাকালো তারপর হাত বাড়িয়ে বইটা ধরতেই আদিলের চোখে চোখ পড়লো। স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলো। আদিলের চোখের দিকে তাকাতেই গত কালের ঘটনা মনে পড়লো তার। স্নিগ্ধার মধ্যেকার আড়ষ্টতা আরো বাড়লো। আদিল বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বললো,” আবার বই পড়ছো? তা আজকেও কি মিসির আলী?”
স্নিগ্ধা এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকালো। সেই ঘটনা মনে পড়তেই শিউরে উঠলো সে। প্রথম স্পর্শের কথা মনে পড়তেই মনে হলো সেই স্পর্শ সে আবারো অনুভব করছে। আদিল লক্ষ্য করলো স্নিগ্ধার ধরে রাখা বইয়ের প্রান্তভাগের বাঁধন আস্তে আস্তে সহজ হচ্ছে। আদিল বইটা আস্তে করে টানতেই স্নিগ্ধার হাতের বাঁধন ছুটে গেলো। স্নিগ্ধা নিজের দুই হাত গুটিয়ে নিজের কোলে নিয়ে বসে রইলো।
আদিল বইটা একপাশে রেখে খাবারের প্লেটটা হাতে নিতে নিতে বললো,” আজকে আমার মেজাজ একটু খারাপ। কিন্তু তাও তোমার এই রাগ করা দেখে, না হেসে পারলাম না।”
স্নিগ্ধা আড় চোখে তাকালো। আজ সত্যিই লোকটা কেমন শান্ত হয়ে আছে। শান্ত কিন্তু গম্ভির। আদিল বেশ রেগে বললো,” খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেছ কেনো? কি সমস্যা তোমার?”
স্নিগ্ধা বিরক্তির সুরে বললো,” আমার সমস্যা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার ভালোলাগছে না তাই খাবো না।”
আদিল শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো তারপর খাবারের প্লেটটা একপাশে রেখে স্নিগ্ধার দিকে এগিয়ে এসে বললো,” তাহলে চলো দুজনে একসাথে শাওয়ার নেই, আমারো মেজাজ ঠিক হয়ে যাবে।”
কথাটা শুনে স্নিগ্ধার পিলে চমকে উঠলো। আদিলের অন্য সব কথার মতন এই কথাটা দুষ্টামির ছলে বলেনি। কথা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা সিরিয়াস। স্নিগ্ধা জড়সর হয়ে বসলো তারপর তেজী গলায় বললো,” ছি! কি বলছেন এইসব। আপনার লজ্জা করছে না এইসব বলতে?”
আদিল সিরিয়াস হয়ে বললো,” নাহ্ একদম লজ্জা করছে না। এক্ষুনি বুঝতে পারবে তুমি। খাবার নিয়ে রাগ করা আমার সবচেয়ে অপছন্দের কাজ আর তুমি সেটাই করছো। দুপুর কটা বাজে খেয়াল আছে তোমার? ইউ বেটার ফিনিশ দিস ফুড রাইট নাও।”
স্নিগ্ধা বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। খেতে চায়নি বলে এমন হুমকি শুনতে হচ্ছে তাকে? এ কাকে বিয়ে করেছে সে? আশ্চর্য!
স্নিগ্ধা চুপ করে বসে আছে। সে নিজের মত বদলায় নি। এইসব আজগুবি হুমকি দিয়ে কাজ হবে না।
আদিল খাবারের প্লেটটা স্নিগ্ধার দিকে এগিয়ে দিলো। স্নিগ্ধা রেগে প্লেটটা একপাশে রাখলো। আদিলের মাথা যন্ত্রনা আরো বাড়ছে। আর এইদিকে এই মেয়ে কোনো কথাই শুনছে না। ঠিক আছে সেও কম যায় না।
আদিল সুন্দর করে নিজের শার্টের হাতা ভাজ করলো তারপর স্নিগ্ধা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে কোলে তুলে নিলো। স্নিগ্ধা চকিত গলায় বললো,” কি করছেন কি আপনি?”
আদিল চুপ করে করে রইলো। ওয়াশরুমে ঢুকতেই স্নিগ্ধার হৃদ কম্পন বেড়ে গেলো। সত্যি সত্যি তো নিয়ে এলো এইবার কি হবে? ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। আদিল স্নিগ্ধাকে ঠিক শাওয়ারের সামনে দাড় করিয়ে দিলো। স্নিগ্ধা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আদিল স্নিগ্ধার এক হাত শক্ত করে ধরে ফেললো। স্নিগ্ধা অপষ্ট গলায় বললো,” ছাড়ুন কি করছেন? আমাকে যেতে দিন।”
আদিল মৃদু হেসে বললো,” এতো সহজে না।” বলেই শাওয়ার অন করলো। আর সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ধারার মতোন পানি এসে ভিজিয়ে দিতে লাগলো তাদের দুজনকে। আদিল এক হাতে স্নিগ্ধার কোমড় জড়িয়ে নিজে ঝুকে এসে স্নিগ্ধার মাথার সাথে নিজের মাথা মিলিয়ে চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে এই বর্ষণের ধারাকে।
এই শীতল পানির বর্ষণেও কেমন এক উষ্ণতা অনুভব করছে স্নিগ্ধা। সেই উষ্ণতায় বার বার কেপে উঠছে সে। চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। নিজের উপর কেনো জানি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে সে। অদ্ভুত এক অনুভূতি ভিতর থেকে নাড়া দিচ্ছে তাকে। কিছুক্ষণ পর আদিল চোখ খুলে তাকালো স্নিগ্ধার দিকে। চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা। হটাৎ আদিল এক ঘোর লাগা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” ভালোবাসো আমায়?”
স্নিগ্ধা পাথরের মতন দাড়িয়ে আছে। প্রশ্নটা শুনে হৃদ কম্পন কয়েকশগুন বেড়ে গেলো তার। হটাৎ এই প্রশ্নের জবাব জানতে চাইছে কেনো আদিল। এই প্রশ্নের উত্তর তো তার কাছে নেই। তাহলে জবাব জানতে চাওয়াটা কি অর্থহীন নয়? আদিল স্নিগ্ধাকে নিজের আরো কাছে এনে জিজ্ঞেস করলো,” বলো, ভালোবাসো আমায়?”
আদিলের এতো কাছাকাছি এসে অস্থিরতায় কেপে উঠলো স্নিগ্ধা। চোখ খোলার সাহস তার নেই। আদিল হাতের বাধন আরো শক্ত করতেই স্নিগ্ধা অস্পষ্ট গলায় বললো,” নাহ্।”
প্রতিউত্তরে আদিল কিছু বললো না। সে নিজেকে সংযত করে হাতের বাধন সহজ করলো। নিরবে নিঃশ্বাস ফেলে শাওয়ার অফ করে দিলো। হটাৎ নিজেকে আদিলের বাঁধন থেকে মুক্ত আবিষ্কার করে চোখ খুলে তাকালো স্নিগ্ধা। কিন্তু আদিলের চোখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই।
একবার নিজের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো স্নিগ্ধা। ভিজে শাড়িটা তার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকার কারণে সব বোঝা যাচ্ছে। স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে দুই বাহু জড়িয়ে ধরে অন্যপাশ ফিরে দাড়ালো।
______
বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে স্নিগ্ধা। ভেজা চুলগুলো মুড়িয়ে রেখেছে শুভ্র রঙের তোয়ালে দিয়ে। আদিল ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে বেরিয়ে এসে দেখে স্পৃহা দ্বিতীয়বারের মতোন খাবার প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকেছে। আদিলই তাকে বলেছিলো আবার খাবার নিয়ে আসতে কারণ আগের খাবারটা ঠান্ডা হয়ে গেছিলো। স্পৃহা স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো,” এমন সন্ধ্যা বেলায়। হটাৎ গোসল করলি যে? ”
স্নিগ্ধা কড়া চোখে তাকাতেই স্পৃহা ভয়ে ভয়ে হেসে বললো,” না মানে খাবার ঠান্ডা হয়ে গেল যে তাই।”
স্নিগ্ধা কড়া গলায় বললো,” আমি এখন খাবো না।”
কথাটা শুনে স্পৃহা আদিলের দিকে আড় চোখে তাকালো। কি আশ্চর্য! কোথায় ফেঁসে গেছে সে? এরা এমন কেনো? মাঝখানে বলির পাঠা সে। আদিল সামনের এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে সরিয়ে বললো,” স্পৃহা তুমি জানতে চাইছিলে না হটাৎ সন্ধ্যা বেলায় তোমার দিদি গোসল করলো কেনো? আমি তোমাকে বলছি। ও যেহেতু খাবে না। প্লেটটা নিয়ে নাও, তারপর নিচে চলো। আমি তোমাকে ইন ডিটেইলস সবটা বলছি।”
কথাটা শুনে স্পৃহা বিষম খেলো। তারপর ঠোঁট টিপে হেসে প্লেটটা নিয়ে যাওয়ার জন্যে হাত বাড়ানোর আগেই স্নিগ্ধা খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে বসলো। দাতে দাঁত চিপে বসে আছে সে। অসভ্য লোকটার মুখে কোনো লাগাম নেই।
[ #চলবে ]
#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১২
#নবনী_নীলা
অভ্র সকাল থেকে বায়না করছে সে ঘুরতে যাবে। এখনই তাকে নিয়ে যেতে হবে এই বায়না নিয়ে সে আদিলের এক পা জড়িয়ে ধরে আছে। আদিল ফোনে ব্যাস্ত হয়ে কথা বলছিলো, সে যেদিকে যাচ্ছে অভ্র তার এক পা ধরে ঝুলে ঝুলে সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। কেউ এই দৃশ্য দেখলে না হেসে থাকতে পারবে না। অভ্র যে শুধু সেটাই করছে তা না কিছুক্ষণ পর পর ডোরেমন ডোরেমন বলে চেচিয়ে উঠছে। আদিল ফোন শান্তিতে কথা বলবে যে তারও উপায় নেই। আবার রাগও করতে পারছে না অভ্রর উপর। অভ্রর মুখের হাসি বলে দিচ্ছে সে নিজের এই অদ্ভূত কাজে বেশ আনন্দ পাচ্ছে।
আদিল চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে পড়লো। তারপর লাইনে থাকা কলটা কেটে দিয়ে বুকের কাছে হাত ভাজ করে তার একপায়ে ঝুলন্ত অভ্রর দিকে তাকালো। আদিল ফোন কেটে দিতেই অভ্র এক গাল হেসে বলল,” ডোরেমন!” ডাকটা বেশ সুর করেই ডাকলো সে।
আদিল ভ্রু কুঁচকে বললো,” ডু আই লুক লাইক এ ডোরেমন? আর ইউ কিডিং উইথ মি?”
অভ্র চোখ পিট পিট করে তাকালো তার মতন চার বছর বয়সী শিশুর কাছে বেশ জটিল লাগলো, আদিলের বলা কথাগুলো। আদিল একট নিশ্বাস ফেলে বললো,” বলো কি চাই তোমার?”
অভ্র ঠোঁট উল্টে বললো,” ঘুরতে যাবো।”
আদিল তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” আচ্ছা,ঠিক আছে কালকে নিয়ে যাবো তোমায়। এইবার পা ছাড়ো।”
অভ্র না সূচক মাথা নাড়লো। আদিল অবাক হয়ে বললো,” কেনো?”
অভ্র চোখ পিট পিট করে বললো,” মজা লাগছে।” আদিল নিরুপায় ভঙ্গিতে সামনে তাকালো। এই ভাবে তার পা ধরে ঝুলতে নাকি এই ছেলের ভালো লাগছে। ভেবে হালকা হাসিও পেলো তার।
স্পৃহা কলেজ থেকে ফিরে অভ্রকে এই অবস্থায় দেখে হাসতে হাসতে শেষ। আদিল কি করবে নিজেও বুঝতে পারছে না। অভ্র কোথা থেকে যে এইসব অদ্ভুত খেলা গুলো শিখে?
স্পৃহা হাসতে হাসতে বললো,” কি করছে ও?”
আদিল নিরস চেহারায় বললো,” দোল খাচ্ছে।”
স্পৃহা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো তারপর অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললো,” বাহ্, দোল খাওয়ার অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে তাহলে?”
আদিল হেসে বললো,” পরীক্ষা কবে তোমার?”
স্পৃহা ভ্রু নাচিয়ে বললো,” পরীক্ষা দিয়ে কি হবে ভাবছি আর কলেজেই যাবো না।”
আদিল চিন্তিত গলায় বললো,” কেনো?”
স্পৃহা বেশ বিরক্তি নিয়ে বললো,” কিছু ছেলে পিছু নিয়েছে? একেবারে অতিষ্ট করে দিয়েছে।”
পাশ দিয়ে জিম যাচ্ছিলো।স্পৃহাকে ছেলেরা বিরক্ত করছে শুনে সে বেশ অবাক হয়ে তাকালো। স্পৃহা জিমের এমন দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,” কি আশ্চর্য! এমন অবাক হয়ে তাকানোর কি আছে?” স্পৃহার কথায় আদিল ঘাড় ঘুরিয়ে জিমের দিকে তাকালো।
জিম তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,” তোমাকে ডিস্টার্ব করে? কার ঠেকা পড়েছে?”
স্পৃহার মুখের উপর জিমের এমন উক্তি শুনে সে বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” মানে? আমি এতোই খারাপ দেখতে? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? জিজু তুমি এর একটা বিহিত করো!”
জিম তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” বিহিত করার কিছু নেই। যে মেয়ে স্টুপিড কথাটার উত্তরে পাঁচটা কথা শুনিয়ে আসতে পারে। সেই মেয়ে কেউ ডিস্টার্ব করবে আর সেটার ভয়ে কলেজে যাবে না, সেটা অবিশ্বাস্য নয় কি?”
স্পৃহা দাতে দাঁত চিপে জিমের দিকে তাকালো তারপর আদিলকে বললো,” তুমি এই লোকটাকে কিছু বলবে না?”
আদিল বুঝেই পায় না এরা দুজন এইভাবে যুদ্ধ করে বেড়ায় কেনো? আদিল এইবার কি বলবে? সে বেশ কায়দা করে জিমকে বললো,” তোর এইভাবে স্পৃহাকে বলা ঠিক হয় নি। ছিঃ,মেয়েদের সাথে কেউ এইভাবে কথা বলে?”
জিম প্রতি উত্তরে কিছু বললো না তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে রইলো। স্পৃহা রাগী গলায় বললো,” কাল থেকে এই লোকটা আমাকে কলেজে দিয়ে আসবে নিয়ে আসবে। আমি কিছু জানি না, জিজু তুমি এইটা ফাইনাল করো। আমার জীবনেরও দাম আছে, আমারো প্রটেকশন লাগবে।”
এদের দুজনের কান্ড দেখে আদিল হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করছে। এমন সিরিয়াস মুহুর্তে হাসা ঠিক হবে না। আদিল সিরিয়াস হয়ে বললো,” হুম, অবশ্যই এটাই ফাইনাল। জিম এখন থেকে তোমাকে আনা নেওয়া করবে।”
জিম হতবাক হয়ে আদিলের দিকে তাকালো। আদিল ঠোঁট চেপে হাসলো। পরক্ষনেই স্পৃহা মুখ ঘুরিয়ে সিড়ি বেয়ে নিজের রূমে চলে গেলো। জিম হতবাক হয়ে বললো,” এটা কি হলো?”
আদিল হেসে বললো,” আমিও সেটাই ভাবছি।” বলতে বলতে আদিলের হটাৎ অভ্রর কথা মনে পড়লো। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে অভ্র পায়ে ঝুলে নেই। আদিল এদিক সেদিক তাকাতেই তার চোখ আটকে গেলো বারান্দার এক পাশে। অভ্র স্নিগ্ধার কোলে বসে আছে আর ফিসফিস করে দুজনে গল্প করছে। অভ্র যে কখন স্নিগ্ধার কাছে চলে গেছে আদিল খেয়াল করেনি। স্নিগ্ধা কি অনায়াসে অভ্রকে এতটা আদর করে আগলে রাখছে। অন্য কেউ কি পারতো ঠিক এতটা যত্নে অভ্রকে আগলে রাখতে?
বিকেলে স্নিগ্ধা আর অভ্র জিমের সাথে কারাগারের ফিরলো। স্নিগ্ধার জন্যে এই বাড়িটি কারাগার থেকে কম না। আদিল তাদের ফিরবার আগেই কোথায় যেনো বেরিয়েছে। জিমের উপর দায়িত্ব দিয়েছে ওদের সাবধানে বাড়ি নিয়ে আসার।
আদিলের এই বাড়িটিতে প্রাণ নেই, আনন্দ নেই, হইচই নেই।
স্নিগ্ধা চুপচাপ সভাবের মেয়ে তার শান্ত জিনিস পছন্দ কিন্তু এই বাড়িটি মাত্রাতিরিক্ত নির্জন।
আদিল নামক প্রাণীটি এই বাড়িতে থাকলেও একটা রমরমা পরিবেশ থাকে আর সে না থাকলে কেমন নিশ্চুপ হয়ে থাকে।
স্নিগ্ধা নিজের মধ্যে এই ক্ষুদ্র এক পরিবর্তন লক্ষ্য করছে।
আদিলকে কি তার ভালো লাগছে?
মনে মনে এগুলো সে কি চিন্তা করছে ভেবেই তার অবাক লাগছে। ইদানিং আদিলকে নিয়ে সে বেশি ভাবছে।
হুট করে এমন পরিবর্তনের কারণ কি? নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করলো স্নিগ্ধা। কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না।
স্নিগ্ধা নিজের ভাবনার জগতে থাকতেই হটাৎ অভ্রর কান্না শুনতে পেলো সে। স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ব্যাথা পেয়েছে ভেবে অস্থির হয়ে বেরিয়ে দেখে সেই লক করা রুমটির সামনে দাড়িয়ে অভ্র কাদঁছে। জিম তাকে কি যেনো বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু অভ্র বুঝতে চাইছে না। স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে অভ্রকে কোলে জড়িয়ে ধরলো, তারপর জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” ও এইভাবে কাদছে কেনো?”
জিম নিচু গলায় বললো,” অভ্র এই রূমে যেতে চায় কিন্তু এই লকের পাসওয়ার্ড আমার জানা নেই। স্যার না আসলে কিছু করা যাবে না। উনি রওনা দিয়েছেন এক্ষুনি এসে পড়বেন।”
স্নিগ্ধা হাঁটু ভাঁজ করে বসে অভ্রর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,” একটু অপেক্ষা করো। এভাবে কাদতেঁ হয় না। কি আছে ঐ রুমে?”
অভ্র চোখের পানি আবারো ছল ছল করতে লাগলো। সে কাদো গলায় বললো,” আম্মুকে দেখবো। ওকে বলো খুলে দিতে।”
স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে তাকালো। আম্মুকে দেখবে মানে? স্নিগ্ধা অভ্রকে বুকে টেনে নিয়ে অবাক হয়ে জিমের দিকে তাকালো তারপর জিমকে জিজ্ঞেস করলো,” মাকে দেখবে মানে? কি আছে ঐ রুমে?”
এই প্রশ্নের উত্তরে জিম চুপ করে রইলো। স্নিগ্ধা দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার আগে কারোর ব্যাস্ত পায়ের আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো আদিল চলে এসেছে। আদিল এসেই ব্যাস্ত হয়ে অভ্রকে স্নিগ্ধার থেকে নিয়ে নিজের কোলে আনলো তারপর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,” কি হয়েছে কাদঁছ কেনো?”
অভ্র অস্পষ্ট গলায় বললো,” আম্মুকে দেখবো। ” আদিল এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না। অভ্রকে কোলে নিয়ে সেই দরজার সামনে চলে গেলো। তারপর দরজায় পাসওয়ার্ড আর নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে দরজা খুললো। স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে দাড়ালো। দরজাটা খুলতেই প্রথমেই বিশাল এক ছবি চোখে ভাসলো স্নিগ্ধার। রুমটা খুব যত্নে সাজানো। চোখের পলক না পড়তেই রুমটার দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। স্নিগ্ধা বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলো। যাদের যে নিজের জীবনের সাথে এতো যত্নে জড়িয়ে নিয়েছে তাদের মনে যে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ন কেউ বাসা বেধে বসে আছে সেটা তো তার জানাই ছিলো না। কেমন অস্থির লাগছে স্নিগ্ধার! এ কোন নতুন ধাঁধা?
[ #চলবে ]