#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৭,১৮
#নবনী_নীলা
১৭
আদিল স্নিগ্ধার হাতে ক্রিমটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,” আমাকে আর সুযোগ দিতে না চাইলে চুপচাপ ক্রিমটা লাগিয়ে নাও। নয়তো তোমাকে এক্ষুনি, তুলে অন্য রুমে নিয়ে যাবো। তারপর তোমার সাথে যা যা হবে,সেটার দায় ভার সম্পূর্ন তোমার।” শেষের কথাটা বেশ সিরিয়াস হয়ে বললো আদিল। স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। মুখে যা আসে তাই বলতে হবে এই ছেলেকে। মানে নিজের লজ্জা না হয় নাই বা থাকবে তাই বলে অন্য কারোর নেই। স্নিগ্ধা কটমট করে তাকিয়ে আদিলের হাত থেকে ছো মেরে ক্রিমটা নিয়ে নিলো।
আদিল মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো তারপর উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো,” তোমাকে ক্রিম হাতে নিয়ে বসে থাকতে বলিনি। আমি কিন্তু একটু পর চেক করবো।”
স্নিগ্ধা দাতে দাত চেপে বললো,” ব্যাথা দিয়ে এখন আবার হুকুম চালাচ্ছে। একদম ওনার সব কথা মেনে চলতে হবে আমায়।” বেশ ক্ষোভ ভরা কণ্ঠে বললো সে।
আদিল কথাটা শুনে ফেললো তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে কপালের চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে বললো,” অবশ্যই মেনে চলবে। তুমি সবটুকুই তো এখন আমার। আমাকেই তো খেয়াল রাখতে হবে, তাই না?” বলেই ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে এক পলক স্নিগ্ধার দিকে তাকালো।
স্নিগ্ধা মূর্তির মতন বসে আছে। কথাগুলো সে শুনেছে ঠিকই কিন্তু না শোনার ভান করে নিশ্চুপে বসে আছে। আদিলের এমন কথায় তার বুকের ভিতরটায় মৃদু কম্পন শুরু হয়েছে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণে চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। এই ছেলে এমন মারাত্মক আগে বুঝতে পারলে বিয়েই করতো না সে। তাহলে এমন বিপদে পড়তে হতো না।
আদিল ফ্রেশ হওয়ার জন্যে ওয়াশরুমে যেতেই স্নিগ্ধা দীর্ঘঃশ্বাস ফেললো। চুপচাপ মেয়ে হয়েও সে পড়েছে মুশকিলে এই ছেলের সব কথা তাকে চুপ করে হজম করতে হচ্ছে। স্পৃহা হলে ঠিকই দু চারটে কথা শুনিয়ে দিতে পারতো। তারা দুজনেই আপন বোন অথচ কতো অমিল দুজনের মধ্যে। আচ্ছা সে কেনো এমন হলো? ভেবেই এখন নিজের উপর রাগ লাগছে।
আদিল ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো শুধু একটা ট্রাউজার পড়ে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে এসে পড়েছে । গৌড় বর্নের গা বেয়ে মুক্তর মতন পানি গড়িয়ে পড়ছে।
স্নিগ্ধা লম্বা হয়ে শুয়ে আছে এইটা বুঝাতে যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আর কিছু পারুক বা নাই বা পারুক এইটা অনেক ভালো করেই পারে। ছোটবেলায় মা বাবার ঝগড়া হলে কেউ কারোর সাথে কথা বলতো না। তখন স্পৃহা হয় নি তাই তাকে ম্যাসেঞ্জার মানে বার্তাবাহক হিসাবে কাজ করতে হতো। শেষে বিরক্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে থাকতো। তখন উপায় না পেয়ে রেগে গিয়ে হলেও তারা দুজনে কথা বলতেন।
আদিল ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিলো। তারপর এগিয়ে এলো। স্নিগ্ধাকে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে দেখে আদিল একটু অবাক হলো। মেয়েটা মাত্র পাঁচ মিনিটে ঘুমিয়ে পড়লো। কীভাবে সম্ভব? আদিল একটু ঝুঁকে এসে কিছুক্ষণ স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো। নাহ্ মনে তো হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাহ্ তার হাত থেকে বাঁচতে অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। ক্রিমটা লাগিয়েছে কিনা কিভাবে জানবে সে? এই মেয়েকে ধরার উপায়ও নেই। ধরলেই তো কেপে উঠে, ঘুমের মাঝেও কেপে উঠবে। নাহ্ দ্বিতীয়বার ঘুমটা ভাঙ্গা ঠিক হবে না।
কিছুক্ষণ পর আদিল লাইট নিভিয়ে অভ্রর পাশে শুয়ে পড়তেই স্নিগ্ধা চোখ মেলে তাকালো। তারপর মুখ ভরে নিশ্বাস নিলো। যাক এই যাত্রায় বেঁচে গেছে।
______
আদিল নিজের অফিসে বসে আছে। স্নিগ্ধার ফোনের কল রেকর্ডিং একটু আগে শুনছে সে। তাই নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টায়, চেয়ারের হ্যান্ডেলে হাত ভাজ করে রেখে দুই আঙ্গুলে কপালের প্রান্ত ভাগ ধরে বসে আছে সে।
জিম ব্যাস্ত হয়ে রুমে এলো। পায়ের শব্দে আদিল চোখ খুলে তাকালো। তারপর কপাল থেকে হাত নামিয়ে দুই হাত টেবিলে রেখে মুষ্টিবদ্ধ করলো। আদিল চোয়াল শক্ত করে বললো,” খবর পেয়েছো?”
জিম মাথা নেড়ে বললো,” হুম, মিস সুনেয়রা নেক্সট উইকে দেশে ফিরছেন।”
আদিল তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” আমি এইবার নিজেই গিয়ে দেখা করবো। তুমি সব ব্যাবস্থা করে রাখো।”
জিম চিন্তিত স্বরে বলল,” সরাসরি আপনার গিয়ে কথা বলাটা কি ঠিক হবে? আমরা তো ছদ্মনামে চেষ্টা করছি।”
আদিল না সূচক মাথা নেড়ে বললো,” আমার অপেক্ষা করার সময় নেই। ফাহাদ স্নিগ্ধা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, ওকে আমার বিরুদ্ধে তুলতে চাইছে। এরপর ও স্নিগ্ধার ফ্যামিলিকে টার্গেট করবে। আমার লাইফে আবার আসার আগেই ওকে আমি সরিয়ে ফেলতে চাই। তাই সবটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে হবে। আর আবরার ফাইয়াজের ইনভাইটেশন বলে কথা, যে কেউ আসতে বাধ্য।”
জিম নিচু গলায় বললো,” স্যার, এইটা সেফ না। রিস্ক নেওয়া কি ঠিক হবে?”
আদিল বাকা হেসে বলল,” ডোন্ট ওরি, আমার কিছু হবে না। ওদের অতো ক্ষমতা হয় নি।” বলেই আদিল নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়ির কাঁটা দুপুর দুইটার কাছে এসে থেমেছে। আদিল ভ্রু কুঁচকে বললো,” জিম তুমি আজ স্পৃহার কলেজে যাও নি? কারা ডিস্টার্ব করছে খুঁজে পেয়েছো?”
জিম নিশব্দে নিশ্বাস ফেললো তারপর বললো,” জ্বি, না। আমি গিয়েছিলাম কিন্তু কাউকে পাই নি! আমার ধারণা এই সবগুলোই স্পৃহার বানানো।”
আদিল ভ্রু কুঁচকে বললো,” যেদিন তুমি রাত জেগে থাকো, সেদিন কি চোর চুরি করতে আসে? আসে না, সুযোগ বুঝে তবেই আসে। যারা ওকে ডিস্টার্ব করছে তারাও নিশ্চই সুযোগের অপেক্ষা করছে। জিম, ওরা যেনো সুযোগটা না পায়, দায়িত্বটা কিন্তু তোমায় দিয়েছি।”
জিম হতাশ চোখে তাকালো। আবার এই মেয়ের সাথে দেখা করতে হবে। চুপ চাপ শান্ত মেয়ে হলে কোনো কথা ছিলো না। এই মেয়ে তো কথা বলে বলে তার মাথা খারাপ করে দেয়। জিম নিরবে হতাশ হয়ে আদিলের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। এই মেয়েটা তাকে যে আর কত হয়রানি করবে কে জানে?
_______
স্নিগ্ধা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে নিজেই এই রহস্যের উন্মোচন করবে। এদের জিজ্ঞেস করে করে দাত পরে যাবে তবুও এরা তাকে কিছুই বলবে না সেটা তার বোঝা হয়ে গেছে। আদিলের বাবা এই বাড়িতে থাকেন না। তিনি বেশির ভাগ সময়ই পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় তার এক বন্ধু আছেন। তাদের দুইজনেরই ঘুরে বেড়ানোর শখ।
স্নিগ্ধা সুযোগ বুঝে আনোয়ার সাহেবের ঘরে এলো। আদিলের রুমে এই কয়দিনে সে কম তল্লাশি চালায় নি। কিন্তু কিছুই খুঁজে পায় নি। আনোয়ার সাহেবের রূমের নিশ্চয়ই ফ্যামিলি ফটো থাকবে। এভাবে রুমে আসতে তার বেশ অপরাধবোধ হচ্ছে কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায় নেই।
খুব সাধারণ ভাবে সাজানো রুমটা। ছোট একটা বিছানা যার দুপাশে দুটো মাঝারি সাইজের টেবিল ল্যাম্প। একপাশে বিশাল এক বুকসেলফ, পুরোটাই বইয়ে ভর্তি। তার পাশে একটা টেবিল। একপাশে একটা ইজি চেয়ার। ব্যাস এইটুকুই।
স্নিগ্ধা দেওয়ালে ভালো করে দেখলো। খুব সুন্দর কিছু পেইন্টিং। এই বাড়িতে একই চিত্র শিল্পীর অনেকগুলো পেইন্টিং রয়েছে। নামটা পেঁচিয়ে লেখার কারণে স্নিগ্ধা ঠিক পড়তে পারেনি।
কিন্তু এই রুমে একটা অন্য রকম পেইন্টিং নজরে পড়লো তার। মাঝে ছোট্ট একটা বাচ্চা, বাচ্চাটা অবিকল অভ্রর মতন। অবয়বটা দেখতে অনেকটা এক রকম লাগছে তার কাছে। একপাশে এক বৃদ্ধ হাতে লাঠি নিয়ে হাসি মুখে বসে আছে পরণে সাদা পাঞ্জাবি অন্যপাশে অভ্রকে পিছনে থেকে জড়িয়ে ঝুকে দাড়িয়ে আছে মধ্যবয়সী এক যুবক। বৃদ্ধা আর যুবকটি নিশ্চই আনোয়ার সাহেব আর আদিল। কিন্তু পাশে মুচকি হেসে একটি রূপবতী মেয়ে দাড়িয়ে কোমল চোখে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটির অবয়বটা অন্যরকম পরণে গাঢ় নীল রঙের পাতলা একটা শাড়ি, কৃষ্ণ কালো চুলে কাঠ গোলাপের খোঁপা। পিছনে কৃষ্ণচূড়ার গাছটি যেনো এই ছবিটাকে আরো মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে।
স্নিগ্ধা খেয়াল করলো এই পেইন্টিং ও একই চিত্র শিল্পীর। তার মানে এই চিত্র শিল্পী এদের সবাইকে খুব ভালো করে চিনে। কিন্তু কে সে? স্নিগ্ধা নিজের মোবাইলে ছবি তুলে নিলো। তারপর সময় নষ্ট না করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। কোনো স্টাফ এইদিকে আসার আগেই তাকে বেড়িয়ে যেতে হবে। কারণ এই রুমে তাকে আবার আসতে হবে, তাই কেউ দেখে ফেললে সমস্যা। পরে দেখা যাবে এই রুমেও তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।
______
স্পৃহা কলেজের থেকে বের হতে না হতেই তার মোবাইল বেজে উঠলো। স্পৃহা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো স্নিগ্ধার কল। হটাৎ এমন সময়ে মহারানীর কেনো তাকে মনে পড়লো? স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে কল রিসিভ করে ফোন কানে ধরে বললো,” হটাৎ এমন ভর দুপুরে ফোন করেছিস কেনো?”
স্নিগ্ধা নিচু স্বরে বললো,” শোন, আমার তোর হেল্প লাগবে। তুই তো পেইন্টিং করিস তাই না?”
স্পৃহা রেগে বললো,” এই তুই কি নতুন জন্মেছিস এই পৃথিবীতে। আশ্চর্য! আমার বোন হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, তুই তো পেইন্টিং করিস তাই না?”
স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করে বললো,” আচ্ছা। সরি, ভুল হয়ে গেছে। ভুলে বলে ফেলেছি। রাগ করিস না বোন। আমার কথা শোন।”
স্পৃহা ঠোঁট উল্টে বললো,” আচ্ছা, বল।”
স্নিগ্ধা আসল ঘটনা কিছু বললো না। স্পৃহাকে শুধু ওই পেইন্টারের ঠিকানা বের করে দিতে বললো। স্পৃহা মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিল হটাৎ তার কাধে কেউ একজন হাত দিয়ে ডাকতেই। স্পৃহা পিছনে না তাকিয়ে হাত দিয়ে তাকে ইশারায় থামতে বললো।
ওপাশ থেকে স্নিগ্ধা বললো,” শুন, তুই আমাকে ডিটেইলস সবটা জানা, আমি ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। পরে তোকে সবটা বলবো।”
স্পৃহা উত্তরে কিছু বলার আগে আবার তার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকলো কেউ। স্পৃহা প্রচন্ড রেগে গিয়ে স্নিগ্ধাকে বললো,” আচ্ছা, তোর সাথে পরে কথা বলছি।” তারপর ফোন কেটে দিলো।
ফোন কেটে দিয়ে, সামনে পড়ে থাকা ইটের টুকরা হাতে নিয়ে উঠে দাড়ালো। তারপর ক্রোধ নিয়ে পিছনে ফিরে ইট ছুড়ে মারতে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলো সে। তার পিছনের জিম দাড়িয়ে আছে। ভাগ্যিস দেখে মারতে গিয়েছিলো নয়তো আজ মাথাই ফাটিয়ে ফেলতো এই রোবটের। স্পৃহার এমন আচরণে জিম বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। এই মেয়ে তো মারাত্মক!
[ #চলবে ]
#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৮
#নবনী_নীলা
স্পৃহা ইট হাতে নিয়েই বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” ভাগ্যিস দেখে মারতে গিয়েছিলাম। নয়তো সারা জীবন আপনাকে কপাল কাটা জিম নামে বাঁচতে হতো।”
জিম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,” মানে?”
স্পৃহা বাকা হাসি দিয়ে ইটের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি তো ভেবেছিলাম আজ কপালই ফাটিয়ে দিবো। না দেখে যদি আপনার কপাল ফাটিয়ে দিতাম পরে তো ডাক্তারের কাছে গিয়ে কপাল সেলাই করা লাগতো তারপর সবাই আপনাকে ডাকতো কপাল কাটা জিম। ঐযে নাম শুনেন না আঙ্গুল কাটা জগলু, গাল কাটা জসিম। আপনারটাও তেমন হয়ে যেতো।”
স্পৃহার কথায় জিম রেগে গিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,” হাতের এইটা ফেলে দাও বলছি।”
স্পৃহা ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বললো,” ভয় পেয়েছেন বুঝি? তা রোবট সাহেব আপনি এইখানে কি করছেন শুনি। আমার জন্যে এসেছেন?” একটা ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলো সে।
জিম উত্তরে কিছু বললো না এগিয়ে এসে স্পৃহার হাত থেকে টান দিয়ে ইটটা নিয়ে এক পাশে ফেলে দিয়ে বললো,” তোমার মত মেয়ের পিছু যে কে নেয় তাকে এইবার সত্যি দেখতে ইচ্ছে করছে। তার নিজের জীবনের ভয় নেই মনে হচ্ছে।”
স্পৃহা ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে বললো,” ও আচ্ছা। এতো পেচিয়ে কথা বলার কি দরকার বললেই পারেন আপনি আমার জন্যে এসেছেন।”
স্পৃহার এমন হাসিতে জিম বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। মেয়েটা এত অদ্ভূত কেনো? জিম দৃষ্টি সরিয়ে আশে পাশে তাকালো। আশে পাশে কেউ নেই বললেই চলে। এই রাস্তায় এবার স্পৃহাকে কে বিরক্ত করতে আসবে?
জিম স্পৃহার পিছু পিছু হাটছে কেনো সে বুঝতে পারছে না। স্পৃহা কিছুদুর গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে জিমের দিকে তাকালো। জিম স্পৃহাকে দাড়িয়ে পড়তে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। দাড়িয়ে পড়লো কেনো মেয়েটা? জিম এগিয়ে এসে বললো,” হটাৎ দাড়িয়ে পড়লে কেনো? কোনো সমস্যা?”
স্পৃহা চিকন গলায় বললো,” একসাথে হাটি, চলুন।” চ উচ্চারণ করতেই জিম তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” নাহ্। যাও আগে হাটো।”
স্পৃহা ভ্র কুচকে বললো,” আপনি না ভালো কথার মানুষ না।”
জিম ভাবলেশহীন ভাবে বললো,” আমার সাথে ভালো কথা বলতে হবে না তোমায়। তুমি চুপ চাপ হাটো।”
স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। এই লোকটা এমন ভাব করে যেনো, তার সাথে হাঁটলে মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আস্ত একটা ঘাউরা কোথাগারের!
স্পৃহা যেতে যেতে খেয়াল করলো হঠাৎ দুটো ছেলে তার দুপাশে এসে একই গতিতে তার সঙ্গে হাঁটা দিয়েছে। স্পৃহা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো এদের মধ্যে একজনই তো রোজ তার পিছু নেয়।
অসভ্যটা আজ আবার আরেকটাকে সঙ্গে করে এনেছে। স্পৃহা বেশ জড়সর হয়ে দাড়িয়ে পড়তেই ছেলে দুটি শব্দ করে হেসে উঠে স্পৃহার সামনে এসে দাড়ালো। স্পৃহা দাতে দাত চিপে ছেলে দুটোর দিকে তাকালো। এদের চুল টেনে ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। প্রতিদিন ঠিক এইভাবে তার পিছু পিছু আসে আর উল্টা পাল্টা বকে।
ছেলেগুলো দুষ্ট চোখে স্পৃহার দিকে তাকাতেই স্পৃহার রক্ত টগবগ করে উঠলো। সে শুধু অপেক্ষা করছে কখন জিম এসে এদের আচ্ছা করে দু ঘা লাগিয়ে দিবে। দেখে সে একটু তৃপ্তি পাবে।
জিম ভাবলেশহীন ভাবে পকেটে দুই হাত ভরে স্পৃহার পাশে এসে দাড়ালো। ছেলে দুটো জিমকে দেখে একটু নার্ভাস হয়ে গেলো। প্রতিদিন এই সময় রাস্তা ফাঁকা থেকে আজ হটাৎ জিমকে দেখে একজন বলে উঠলো,” এ আবার কই থেকে এলো?”
স্পৃহা রেগে গিয়ে বললো,” মহাকাশ থেকে এসেছে। কেনো তোদের যেতে ইচ্ছে করছে?”
আরেকজন স্পৃহার কোথায় বিচ্ছিরি ভাবে হেসে উঠে বললো,” গেলে কি আর একা যাবো? তোকে তো সাথে নিয়েই যাবো।”
বলেই স্পৃহার দিকে এগিয়ে যেতেই জিম সানগ্লাস খুলে হাতে নিলো তারপর এক হাত মেলে বাধা দিয়ে সামনে এসে দাড়ালো। নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” কি সমস্যা? এভাবে পথ আটকে দাড়িয়ে আছো কেনো? রাস্তা ছেড়ে দাড়াও।”
স্পৃহা জিমের এমন স্বাভাবিক আচরণে ক্ষেপে গিয়ে বললো,” কি আশ্চর্য! ওরা কি আপনার ভাই লাগে নাকি? এভাবে কোমল কণ্ঠে বলার কি আছে? দু চারটে দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে পারছেন না?”
ছেলেগুলো হটাৎ স্পৃহার এমন উক্তি শুনে ঘাবড়ে গেল। জিমকে দেখে তাদের সুবিধার মনে হচ্ছে না। জিম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” এরপর থেকে যেনো এই মেয়ের আশে পাশে না দেখি। নয়তো হাঁটার জন্যে পা থাকবে না। বাকি জীবন হুইচেয়ারে কাটাতে হবে ।” বলেই ছেলে দুটোকে চলে যেতে ঈশারা করতেই ছেলে দুটো বেশ ঘাবড়ে গেলো জিমের এমন গাম্ভীর্যতা দেখে। একজন হুট করে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতেই আরেকজন ও ছুটে পালালো।
স্পৃহা হতভম্ব হয়ে জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” এই আপনাকে ডায়লগ দিতে কে বলেছে? হাত পা নেই মারতে পারলেন না?”
জিম নিজের সানগ্লাস পড়তে পড়তে বললো,” এরা আমার স্ট্যান্ডার্ড না, যে মারামারি করে এদের ভয় দেখাবো। এদের জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট।”
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,” আমি কোথায় ভাবলাম এই দুইটাকে মেরে ভর্তা করে দিবেন তা না..”বলেই নিরাশ চোখে জিমের দিকে তাকালো।
জিম আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” বেশি বড় বড় কথা বলো না। আমাকে তো ইট দিয়ে মারতে এসেছিলে আর এদের বেলায় হাতে তো একটা পাথরও তুললে না। এদের কি ভাড়া করে এনেছো নাকি?”
” ফালতু বলবেন না তো। আমাকে কি বাংলা সিনেমার হিরোইন পেয়েছেন যে টাকা দিয়ে গুন্ডা ভাড়া করবো।”, চটে গিয়ে বললো স্পৃহা।
জিম ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” উইল ইউ স্টপ নাও?” স্পৃহা মুখ বাঁকিয়ে হাঁটতে লাগলো। কোথায় ভেবেছিলো ছেলেগুলোর মার খাওয়া দেখে মজা নিবে কিন্তু না এই লোকটা কিছুই করলো না। আর এই বদমাইস দুটো এতো ভীতুর ডিম জানা থাকলে সে নিজেই এদের পিটিয়ে লাল করে দিতো। এই লোকের সামান্য কথায় ভয় পেয়ে পালালো।
_________
ফাহাদ রেজওয়ান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আফজাল সাহেব একমাত্র মেয়ের জামাই। আফজাল সাহেবের এই পজিসন টিকিয়ে রাখতে ফাহাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ফাহাদের ক্ষমতার কারণেই এই পজিসন এখনও তার দখলে, বয়স কম হলেও ফাহাদের ক্ষমতার কারণেই তাকে সবাই মান্য করে। বিশাল এই বাড়িটিতে সে বলতে গেলে একাই থাকে। সঙ্গে জিসান মানে তার ডান হাত বলা যেতে পারে, সে থাকে।
জিসান বেশ হন্তদন্ত করে ছাদের পুল সাইডে এলো। জিসান ফাহাদকে সুইমিং করতে দেখে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
মিনিট পাঁচেক পর, ফাহাদ জিসানকে খেয়াল করলো তারপর দুই হাতে সামনের চুলগুলো সরিয়ে বললো,” কি হয়েছে? এতো রাতে এইখানে কি করিস?” বলতে বলতে সুইমিং পুল থেকে উঠে দাড়িয়ে পড়লো তারপর সাদা তোয়ালে দিয়ে হাতে মুখ মুছে নিলো।
জিসান মাথা তুলে তাকালো তারপর একটা ঢোক গিলে বললো,” বস, রুহুল সাহেব মানে যার কাছ থেকে টাকা পাওনা ছিলো। চিনতে পারছেন? ভদ্র লোকের দুটি মেয়ে আছে।”
ফাহাদ তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে বললো,” হুম, চিনতে পেরেছি। কিন্তু কি হয়েছে?”
জিসান পুনরায় মাথা নিচু করে ফেলে বললো,” স্যার, উনি আত্মহত্যা করেছেন। এই মাত্র খবর পেয়েছি। ”
ফাহাদ চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ জিসানের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর পাশেই মদ্যপানের একটি বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে হাতে নিয়ে নিশ্চুপে বসে রইলো। তারপর এক চুমুক দিতেই জিসান বললো,” বস্, এইবার কি করে টাকা আদায় হবে। রুহুল সাহেবের স্ত্রীকে চাপ দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।”
ফাহাদ গ্লাসে আরেক চুমুক দিয়ে গ্লাসটা টেবিলে রেখে বললো,” নাহ্, ওনার স্ত্রী কে চাপ দেওয়ার দরকার নেই। রুহুল সাহেবের বড় ভাই শুনেছি বিশাল ব্যাবসা করে। দরকার পড়লে অনেক চাপ দাও নয়তো ছেলে মেয়েকে তুলে আনো। যে করেই হোক আগামীকালের মধ্যে টাকা আমি চাই। তার জন্যে যা করা লাগে করো।”
জিসান হা সূচক মাথা তারপরও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বলার আছে তার কিন্তু কীভাবে বলবে সেটাই মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে। জিসান চিকন গলায় বললো,” বস্ , সুনেয়রা ম্যাডাম শুনছি দেশে ফিরছেন। যদিও তিনি কিছু জানান নি আমাদের তবে আমি খবর পেয়েছি।”
ফাহাদ চোয়াল শক্ত করে একটা ভ্রু তুলে বললো,” মানে? আমাকে না জানিয়ে দেশে ফিরছে?।” বলেই চুপ করে গেলো তারপর জিসানকে হাতের ঈশারায় চলে যেতে বললো।
গ্লাস হাতে নিয়ে এক চুমুকে সম্পূর্নটা শেষ করে গ্লাসটা এক পাশে রেখে ফোনটা হাতে নিলো। তারপর কয়েকবার কল করলো কিন্তু সুনেয়রা ফোন তুললো না। কয়েকবার কল করেই ফাহাদ ভীষন রেগে গেলো দাতে দাত চেপে ফোনটা ছুঁড়ে মারলো। মেঝেতে পড়তেই ফোনটি চূর্নবিচূর্ণ হয়ে গেলো। রাগে চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে তার। সুনেয়রা সবটাই ইচ্ছে করেই করছে বুঝতে বাকি রইলো না তার।
_______
এতো রাতে স্পৃহার কল পেয়ে স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকালো। এই মেয়ের তো এই বেলায় ফোন দেওয়ার কথা না। স্নিগ্ধা তার পাশের টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিলো। তারপর ফোন কানে ধরতেই স্পৃহা ভয়ার্ত গলায় বললো,” আপু জানিস। রুহুল সাহেব আছেন না। উনি ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনে হয় বাঁচবেন না।”
স্নিগ্ধা অভ্রর পাশে বসেছিলো। মৃত্যুর কথা শুনে স্নিগ্ধা ফট করে দাড়িয়ে পড়লো। বুকের ভিতরে ধুক করে উঠলো তার। স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করে বললো,” মানে? কি আজে বাজে বলছিস। এভাবে বলে নাকি?”
স্পৃহার কণ্ঠ আরো কাতর হয়ে উঠলো সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,” আপু এই গলিতে কান্নার আওয়াজ পর্যন্ত ভেসে আসছে। বাবা মা মিতু আর নিতুর বাড়িতে গেছে। আমার না ভীষন ভয় লাগছে। তুই আয় না আপু।” বলেই অঝোরে কাদতেঁ লাগলো স্পৃহা।
[ #চলবে ]