রংধনুর_স্নিগ্ধতা #পর্ব_২৫,২৬

0
868

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২৫,২৬
#নবনী_নীলা
২৫

স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” এতক্ষণ আপনি নাটক করছিলেন আমার সাথে?” বলেই নিজের হাত ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো সে। রাগটা এবার তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আদিলের এই হাসিতে স্নিগ্ধা রাগান্বিত চোখে তাকালো তারপর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করতেই আদিল স্নিগ্ধার দুই হাত বিছানার সাথে চেপে ধরলো।

স্নিগ্ধা হকচকিয়ে তাকালো চোখের পাতা কয়েকবার ফেলে রাগী কন্ঠে বলল,”কি করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে। আমি থাকবো না আপনার সাথে।”

আদিল স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,” একটা মেয়ে সাথে দেখা করেছি বলে এতো রাগ? আমার বউ যে এত পজেসিভ সেটা তো আমার জানা ছিল না।”

আদিলের কথা শুনে স্নিগ্ধা চোখ বড় বড় করে তাকালো তারপর বললো,” কিসের পজেসিভ? হ্যাঁ! আপনি একটা মেয়ে কেনো হাজার হাজার মেয়ের সাথে দেখা করুন। আমার কি?”

আদিল তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,” তোমার কিছুই না? যদি কিছুই না হবে তাহলে তো তোমার রাগ করা সাজে না। কারণ তারাই শুধু রাগ করতে পারে যারা ভালোবাসে।তার মানে তোমার তো কিছুই যায় আছে না।”

স্নিগ্ধা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে তাকালো তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,” আমার কেনো কিছু যায় আসবে?”

আদিল ভ্রু কুচকে তাকালো। স্নিগ্ধা এখনো মানতে নারাজ। মেয়েটা রেগে আছে ঠিকই কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলবে না। ঠিক আছে, আবরার ফাইয়াজ কম না সত্যি কথাটা একদিন না একদিন ঠিক তোমার মুখ থেকে বের করবে।

আদিল কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে থেকে হাতে বাঁধন আলগা করল। তারপর স্নিগ্ধার পাশাপাশি শুয়ে মাথা নিচে দুই হাত রেখে বলল,” তোমার যখন কিছু যায় আসে না তাহলে আমাকে আগে বলতে পারতে আজ রাতে থেকে গেলেই পারতাম।”

আদিলের হঠাৎ এমন কথায় স্নিগ্ধা বড় বড় চোখ করে তাকালো। আজ রাত থেকে গেলে পারতো মানে? স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কন্ঠে বলল,” মানে?”

আদিল ভাবলেশহীন গলায় বলল,” হুম্, থেকে গেলে মন্দ হতো না। শুধু শুধু এলাম, আমাকে তো তোমার প্রয়োজন নেই।” বলেই ঘাড় কাত করে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো।

স্নিগ্ধার চোখে মুখে আগুন জ্বলছে। সে ক্রোধ নিয়ে বলল,’ হ্যাঁ এসেছে কেনো? এখনি চলে যান। গাড়ী বের করতে বলুন। চলে এসেছেন বলে খুব আফসোস হচ্ছে তাই না? আফসোস করতে হবে না আপনাকে আর। আপনি যান। এক্ষুনি যান।”দাঁতে দাঁত চিপে কথাটা শেষ করলো স্নিগ্ধা।

আদিল সূক্ষ্ম কন্ঠে বলল,” আমার জন্যে এতোক্ষণ অপেক্ষা করলে তোমাকে ফেলে কি করে যাই। এতো সুন্দর বউ রেখে কি যেতে ইচ্ছে করে নাকি?’ বলেই আদিল মৃদু হেঁসে তাকালো।

স্নিগ্ধা আরো চটে গিয়ে বলল,” কে বলেছে? আমি আপনার জন্য জেগে আছি। নিজেকে কি ভাবেন আপনি? আপনার যেখানে ইচ্ছা আপনি যান, যেখানে খুব খুশি আপনি থাকুন। আমি কে হই? আপনার কাছের মানুষের অভাব আছে নাকি?” বলে রেগে উঠে যেতে নিলো কিন্তু তার আগেই আদিল স্নিগ্ধার কোমর জড়িয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো তাকে।

আদিলের হঠাৎ এমন কান্ডে স্নিগ্ধ হতবাক হয়ে তাকালো আদিল স্নিগ্ধার কপালের চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে খুব সুন্দর করে হাসলো। আদিলের অদ্ভুত সুন্দর হাসি স্নিগ্ধার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হল।

হঠাৎ মনে হচ্ছে অজান্তেই নিজের কোনো এক অনুভূতি সে প্রকাশ করে ফেলেছে, যে অনুভূতি সম্পর্কে সে নিজেও অব্যাহত নয়
স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তারপর নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।

কিন্তু আদিল হাতের বাধন আরো শক্ত করে ফেলল আর অন্য হাত স্নিগ্ধার গালে ডুবিয়ে দিয়ে বলল,” তুমি কি জানো? রেগে গেলে তোমাকে কতটা সুন্দর লাগে?” ঘোরলাগা কন্ঠে অনুভূতির এমন অভিপ্রায় স্নিগ্ধার গাল দুটো লাল আভায় ভরে গেলো।

বুকের ভিতর ধুক ধুক বেড়েই চলেছে। আদিল স্নিগ্ধাকে নিজের আরো কাছে নিয়ে আসতে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল তার। স্নিগ্ধা আড়চোখে একবার আদিলের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।
আদিলের দৃষ্টি স্পষ্ট ও নিবিড় স্নিগ্ধা কিছু বলতেও পারছিনা। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। আদিল তার খুব কাছে চলে এসেছে। আদিলের নিশ্বাস তার গলায় আঁছড়ে পড়ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আদিল স্নিগ্ধার একদম কাছে চলে এসে অধর দুটি মিলিয়ে। স্নিগ্ধা চোখ বুজে হাত মুষ্টি বন্ধ করে ফেললো।
হটাৎ এতো ঘনিষ্ঠতা তাকে এক রক্তিম আবরণে ঢেকে দিয়েছে।

আদিলের স্পর্শ আরো গভীর হতেই স্নিগ্ধা দুই হাতে আদিলকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হাপাতে লাগলো।

আদিল নিচের ঠোঁট কামড়ে এক বেসামাল দৃষ্টিতে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে চোখ পড়তেই অকারনেই শিউরে উঠলো স্নিগ্ধা। মস্তিষ্কের নিউরন সজাগ হতেই লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে ফেললো সে। দু হাতে নিজের ওষ্ঠ দুটি চেপে ধরে নিজের ভিতরে অন্য এক অনুভূতি আবিষ্কার করলো সে। নিজের এই অনুভূতি নিয়ে ভাবার আগেই বলিষ্ঠ এক হাত তার পেট স্পর্শ করলো।

প্রতিবারের মতন কেপে উঠলো সে। আদিল স্নিগ্ধাকে তার একদম ঘনিষ্ট করে জড়িয়ে ধরে তার চুলের ভাজে মুখ গুঁজে দিলো। শাড়ির আঁচল শক্ত করে চেপে ধরলো সে। দ্রুত নিশ্বাস ফেলতে লাগলো স্নিগ্ধা।আদিলের নিশ্বাস অনুভব করতে পারছে সে।নিজের উপর থেকে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে।

আদিল তার চুলের ভাজে মুখ গুজে ঘোর লাগা কণ্ঠে ” স্নিগ্ধা।” নামটা উচ্চারণ করেই থেমে গেলে। আদিলের এতো কাছে থাকার পরো আদিলের এমন ডাকে স্নিগ্ধার বুকের ভিতরটায় তোলপাড় শুরু হলো।
সেই মিষ্টি ভালোলাগার ডাক প্রত্যাখ্যান করে স্নিগ্ধা আদিলকে সরিয়ে দিতে বললো,” কি করছেন ছাড়ুন।?”খুব ধীর কণ্ঠে বললো সে।

কিন্তু মুহূর্তেই হাতের বাধন আরো শক্ত করে ফেললো আদিল।স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।

আদিল হাত বাড়িয়ে ঘাড়ের ওপর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ফিচেল কণ্ঠে বললো,” অ্যাম গেটিং অ্যাডিক্টেড স্নিগ্ধা। নেশা ধরে যাচ্ছে যে আমার তোমার প্রতি।” কথাগুলো কর্নগোচর হতেই স্নিগ্ধা চোখ খুলে তাকালো। আড় চোখে একবার আদিলের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো তার। আদিলের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো সে।

ভালোবাসার অদ্ভূত এই নেশা তাকেও যে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে, সে সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু তাকে পুরোপুরি গ্রাস করার আগেই হুশ ফিরল স্নিগ্ধার। নিজেকে সামলে নিয়ে তাকালো আদিলের দিকে। বেসামাল আদিলের হাত থেকে রেহাই পেতে তাকে ভয়াবহ একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে আদিলের দিকে তাকালো।

আদিলের দুরত্ব কমিয়ে আনতেই স্নিগ্ধা সুযোগ বুঝে আদিলের গলায় সজোরে এক কামড় বসিয়ে দিলো।আদিল ভ্রু কুঁচকে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্নিগ্ধা আদিলকে সরিয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।

তারপর দৌড়ে দরজার কাছে চলে গেলো।প্রথমে দরজা খুলতে পারছিলো না তবে পরে কয়েকবার টানতেই দরজা খুলে গেলো। তারপর স্নিগ্ধা কড়া চোখে একবার আদিলের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দরজা খুলে যাওয়ায় আদিল বেশ বিরক্ত হলো। জিমকে দিয়ে এসব কাজ হবে না তার জানাই ছিলো।

আদিল ঘাড় কাত করে একবার আয়নায় নিজের গলার দিকে তাকালো। একদম দাগ বসিয়ে দিয়েছে স্নিগ্ধা। কিন্তু পরক্ষনেই আদিল নিচের ঠোঁট কামড় হেসে ফেললো।

____________________

এই বাড়ি থেকে বের হওয়া যায় না কেনো সেটাই স্পৃহা বুঝে উঠতে পারছে না। কম দিন তো হলো না উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।

মানে বাড়ি আর বাগানের মাঝেই নিজেকে আটকে রাখতে হয়। বাড়ির বাইরে না গেলে হয়তো এই আরোহী রহস্যের সমাধান হবে না।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্পৃহা অবাক হয়েছে।কারণ অভ্র আর তার পাশে এসে স্নিগ্ধা ঘুমিয়ে আছে।
হটাৎ এইরুমে এসে ঘুমাবার কি প্রয়োজন পড়লো তার? স্পৃহা মুখ কুচকে বিছানা থেকে নামলো। তার মাথা গরম হয়ে আছে। আর সে এই বাড়িতে বন্দী জীবন কাটাতে পারবে না। বাড়ির বাইরে তো সে যাবেই।

ঘুম থেকে উঠে স্পৃহা চোখ কচলাতে কচলাতে নিচে নেমে দেখলো জিম একজন স্টাফের উপর ভীষন রাগারাগি করছে। জিমের বিস্ফোরিত কণ্ঠে রীতিমত ভয় পেয়ে তাকালো সে। যাকে জিম এতো বকাবকি করছে সে একটা কথাও বলছে না রীতিমত কাপছে। স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেলো। ভোর হতে না হতেই লোকটা হিরোগিরি দেখতে শুরু করেছে।

স্পৃহা জিমের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো তারপর কোমর হাত দিয়ে বললো,” এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেনো? ভালো করে কথা বলা যায় না?”

স্পৃহার কন্ঠ শুনেই সে বুঝেছে মেয়েটা আবার এইখানে এসেছে এখন উল্টা পাল্টা কথা বলে তার মাথা খাবে। জিম দাতে দাঁত চিপে বিরক্তি নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তারপর কঠিন গলায় বললো,” সব ব্যাপারে তুমি কথা বলতে আসো কেনো? দেখছনা কথা বলছি?”

স্পৃহা ভ্রূ কুচকে বললো,” কথা বলছেন কোথায়? আপনি তো ধমক দিয়ে লোকটাকে তিন হাত মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছেন।”

জিম রেগে গিয়ে বললো,” তুমি আর তোমার এই স্টুপিড কথাবার্তা আমার সাথে কথা বলতে আসবে না। বুঝতে পেরেছো?” বলেই পাশের স্টাফকে বললো,” আর তুমি গেস্ট রূমে গিয়ে বসো। তুমি আসলে কার রেফারেন্সে এইখানে এসেছো সেটা না জানা অব্দি তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না।” জিমের কথা শুনে লোকটা একবার মাথা তুলে তাকালো। জিম কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কি হলো শুনতে পাও নি, কি বলেছি?”

লোকটা চোখ নামিয়ে ফেললো তারপর হা সূচক মাথা নেড়ে চলে গেলো। লোকটা চলে যেতেই জিম স্পৃহার দিকে তাকালো। স্পৃহা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জিম চলে যেতে নিলো স্পৃহা পথ আটকে বললো,” আচ্ছা এই লোকটা কি কোনো দামী গ্লাস ভেঙে ফেলেছে যে এমন উত্তম মাধ্যম কথা শুনালেন?”

জিম ভ্রূ কুচকে বললো,” হোয়াট ননন্সেস? ঐ লোকটা যাই করুক তোমার এতো চিন্তা হচ্ছে কেনো?”

স্পৃহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” আপনি এতো কথা পেটে রেখে ঘুমান কি করে? বদহজম হয় না আপনার?”

জিম বিরক্তি নিয়ে তাকালো তারপর স্পৃহার হাত ধরে টেনে ওকে সরিয়ে দিয়ে উপরে উঠে গেল।

জিম আদিলের রূমের সামনে এসে থামলো। রূমের দরজা খোলা দেখে সে ভিতরে চলে এলো। আদিল এখনো ঘুমিয়ে থাকলেও তাকে জাগিয়ে তোলা জরুরী। জিমের কাছে আর কোনো উপায় নেই। জিম নিজের ফোনের অ্যালার্ম রিং টা বাজিয়ে ফোনটা আদিলের মাথার কাছে রেখে দিল। হটাৎ ফোনের এমন আওয়াজে ধীরে ধীরে আদিলের ঘুম ভাঙলো।

ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই জিমকে দেখে ভ্রূ কুচকে তাকালো সে। জিম ফোনটা হাতে নিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে পকেটে ভরে বললো,” একটা জরুরী কথা আছে। আপনাকে এক্ষুনি উঠতে হবে।”

আদিল ঘুম ভরা চোখে উঠে বসলো তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,” বেলা সাতটায় তোমার কি প্রয়োজন পড়লো জিম?”

জিম নিচু স্বরে বললো,” এই বাড়িতে আমার একজনকে সন্দেহ হচ্ছে। নতুন একজন স্টাফ নাম আলম। তাকে আমার সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। তাকে নাকি রমিজ মিয়ার অনুপস্থিতে রাখা হয়েছে? আপনি এই ব্যাপারে কিছু জানেন?”

আদিল ঘুম থেকে উঠে চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলো। ভাবতে ভাবতে তার কপালে ভাঁজ পড়লো। কারণ এমন কাউকে সে অনুমতি দিয়েছে বলে তো মনে হয় না। আদিল বেশ কিছুক্ষন ভাবলো তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,” নাহ্। আমি কাউকে অনুমতি দেই নি। লোকটা কোথায় আছে এখন?”

” আপাদত গেস্ট রুমে যেতে বলেছি।”, চিন্তিত সুরে বললো জিম।

আদিল মাথা নেড়ে বললো,” সন্দেহজনক কিছু তোমার নজরে পড়েছে?”

জিম হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” ভোর পাঁচটা থেকে খেয়াল করেছি সে সারা বাড়ি ঘুরে বেরিয়েছে। বেশ কয়েকবার অভ্রর রূমে গিয়েছে। আর আরোহী ম্যাডামের রূমের সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে ছিলো।”

[ #চলবে ]

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২৬
#নবনী_নীলা

জিম হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” ভোর পাঁচটা থেকে খেয়াল করেছি সে সারা বাড়ি ঘুরে বেরিয়েছে। বেশ কয়েকবার অভ্রর রূমে গিয়েছে। আর আরোহী ম্যাডামের রূমের সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে ছিলো।”

জিমের কথা শুনে আদিল এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। গেস্ট রুমের উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।

রুমে এসে বেশ অবাক হল আদিল। এই লোকটাকে কখনো সে এর আগে দেখিনি, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মুখ কি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে অথচ কাছে যেতেই সে নিজেকে খুব ভীতু নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। জিম দরজাটা বন্ধ করতেই আড়চোখে তাকালো লোকটা। আদিল এগিয়ে এসে লোকটা ঠিক সামনে একটি টুল টেনে বসল। কতক্ষণ চুপ করে থেকে সামনে বসা লোকটার চোখের দিকে তাকাল।

তারপর শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,” কে তুমি? এ বাড়িতে এসেছো কেন?”

উত্তরে লোকটা কোন জবাব দিল না তার চাওনিতে একটু ভয় থাকলেও কেমন যেন এক অদ্ভূত ভাবে তাকিয়ে রয়েছে সে।

লোকটাকে চুপ থাকতে দেখেন আদিল দ্বিতীয় বার করা ধমক দিয়ে বলল ,”কে তুমি? একটা কথা আমি দ্বিতীয়বার বলতে পছন্দ করি না। তাই তুমি কে? তোমার উদ্দেশ্য কি? আর কে তোমাকে পাঠিয়েছে? সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে তবেই তুমি ছাড়া পাবে।

আদিল আর জিম দুজনেই অবাক কারণ লোকটা কোন কথাই বলছো না। গুটিসুটি মেরে ভয়ার্ত চোখে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলছে।

আদিলের রাগ মাত্রাছাড়া হলো, তার বাড়িতে ছদ্মবেশে লোকটা কি করে এলো ভেবেই তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আদিল রাগ সামলাতে না পেরে লোকটার কলার শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” যা জানতে চেয়েছি চুপচাপ বল। নয়তো তোমার এমন অবস্থা করব তুমি ভাবতেও পারছ না। কি নাম তোমার?

আদিল খেয়াল করলো সামনে বসে থাকা লোকটি ঢোক গিলছে। তারমানে সে ভয় পেয়েছে। এটাই তো চাই ভয় দেখিয়েই সবটা জানতে হবে তাকে। কারণ যদি এই ছেলেকে ভয় দেখিয়ে সে কিছু বের করতে না পারে তাহলে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। আর এটা সে কিছুতেই চায় না কারণ, পুলিশ পর্যন্ত খবর গেলে ফাহাদকে কোনদিনও তার ধরাই হবে না। ক্ষমতার জোরে ঠিক নিজের লোককে বাঁচিয়ে নিবে নয়তো নিজেই শেষ করে ফেলবে।

আদিলের ধমকে কাজ হলো। লোকটা বলল,” আমার নাম হান্নান। আমি আমি এখানে আপনার একজন কর্মচারী রাতুলের অবর্তমানে এসেছি। সে একটু অসুস্থ।”

আদিল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,” কার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছ?তোমার গলায় তো রাতুলের আইডি কার্ড ঝুলছে। ‘

লোকটা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,” খোঁজ করে দেখুন সে সত্যি অসুস্থ। আর কার্ড নিয়ে এসেছি যেনো বিপদে পড়লে কাজে লাগে।”

আদিল হান্নানের কলার ছেড়ে দিয়ে জিমের দিকে তাকালো। জিম হান্নানের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,” রাতুলের সাথে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু রাতের ফোন ধরছেনা রাতুলের অবর্তমানে যে তুমি এসেছো আমাদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি?”

হান্নান নামের লোকটি প্রথমে চুপ করে রইলো। তারপর বললো,” এসব করতে হয় আমি জানতাম না।”

আদিল ছেলেটি কলার ছেরে দিয়ে উঠে দাঁড়াল তারপর পকেট এ দুই হাত ধরে কঠিন গলায় বলল,” তোমার এই মিথ্যে কথা গুলো আমরা সত্যি ভেবে তোমাকে ছেড়ে দিবো সেটা যদি ভেবে থাকো তাহলে সেটা ভুল।তোমাকে কে পাঠিয়েছে সেটা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। তোমার যা করার আমিই করবো কিন্তু তার আগে রাতুলের সঙ্গে তোমরা কি করেছো সেটা জেনে নেই। তারপর তোমাকে …..।” বাকিটা না বলেই রুমে থেকে হনহনিয়ে বেড়িয়ে পড়ল আদিল।

জিম বের হওয়ার সময় গেস্টরুমটা বাইরে দিয়ে তালাবদ্ধ করে দিলো।

রাতুল আদিলের খুবই বিশ্বস্ত একজন কর্মচারী প্রায় অনেক বছর ধরেই বাড়িত কাজ করতেছে কয়েকদিন ধরে হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে আসলে এভাবে চলে যাওয়াটা সে খেয়াল করিনি কিন্তু হঠাৎ কী এমন হলো এভাবে চলে যেতে হতো?

কিন্তু এবার পুরো বিষয়টা তাকে ভাবাচ্ছে রাতুলকে বহুবার ফোন করো কোনভাবে তার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি তাই আদিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে নিজে গিয়ে দেখা করবে।

আদিল সময় নষ্ট করলো না তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ল। তবে জিম সঙ্গে যেতে চাইলে আদিল বারণ করল। বাড়িতে তার অবর্তমানে একজনকে থাকা দরকার আর জিম এর থেকে বেশি বিশ্বাসী হয়তো সে আর কাউকে করো না।

__________________

কাবাডে নিজের শাড়ি গুলো গুছিয়ে রাখতে গিয়ে স্নিগ্ধা একটি বক্স খুঁজে পেলো। তার শরীর ভাজে এটা কি করছো? আগ্রহ নিয়ে বক্সটা খুলতেই আদিলের দেওয়া সেই প্রথম উপহারটি চোখে পড়ল তার।

এখানে যে রেখেছিল তার মাথায় ছিল না। স্নিগ্ধা বক্স খুলে লকেটটা হাতে নিলো। সে রাতে সে লকেটটা ভালো করে দেখেনি। কিন্তু জিনিসটা অনেক সুন্দর সবচেয়ে বেশি সুন্দর এই নীল পাথরটা, যা সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।

লকেট হাতে নিতেই স্নিগ্ধার একটা কথা মনে পড়ল। আদিল তখন তাকে লকেটটা দিয়ে বলেছিল,”সে যেনো এইটা সব সময় পড়ে।’ তখন উত্তর এসে বলেছিলো,” ভালবাসার প্রথম উপহার ভালোবেসে তবেই পড়বে সে।”

লকেটা দেখে হঠাৎ তার মনে পড়ল এই কথাগুলো। সে তো ভুলেই গিয়েছিল। আচ্ছা সে যে বললো যেদিন ভালোবাসবে সেদিন পড়বে। সে কি পেরেছে ভালোবাসতে? নিজের মনে এই প্রশ্ন জাগতেই স্নিগ্ধা লকেটটা বক্সে করে তুলে রাখলো। মনের এই প্রশ্নটা সে আবারো অগ্রাহ্য করলো। সবটা শাড়ী গুছিয়ে কাবাডে তুলতে যাবে, হঠাৎ স্পৃহার চিৎকার কানে এলো তার।

সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মক ব্যথা পেয়েছে স্নিগ্ধা।অনেক উচু থেকে পড়ার কারণে বলতে গেলে পা মচকে গেছে আর হাতের প্রায় অনেক জায়গায় কেটে গেছে। মাথাও বেশ আঘাত পেয়েছে সে। স্পৃহা ব্যথায় আর্তনাদ করছে কিছুক্ষণ পরপর।

স্পৃহার এমন অবস্থা হয়েছে সে উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পাচ্ছে না আর এসবের মাঝে ডান হাতের তালু থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে। রক্ত সহ্য করতে পারে না সে। রক্ত দেখলেই তার শরীর ভীষণ ভাবে কাঁপতে শুরু করে এবং মানসিকভাবে এই চাপ সে নিতে পারে না।

স্পৃহার এমন আর্তনাদের সবাই ছুটে এসেছে কর্মচারী থেকে শুরু করে সবাই। উঠে দাড়াতে পর্যন্ত পারছে না সে। আর এই দিকে থর থর করে কাপছে স্পৃহা।

সেই মুহূর্তে জিম এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিলো স্পৃহাকে। স্পৃহা ব্যাথায় জিমের শার্ট চেপে ধরেছে।

স্নিগ্ধা এসেই হতভম্ব হয়ে গেলো। অভ্র দৌড়ে স্পৃহার কাছে চলে এসেছে। স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে স্পৃহার পাশে বসলো। তারপর চিন্তিত গলায় বললো,” কি করে পড়ে গেলি তুই? নিজের অবস্থা দেখেছিস? এই জন্যে তোকে বলি একটু সাবধানে চলা ফেরা করবি। দেখলি তো কতটা ব্যাথা পেয়েছিস?”

স্পৃহা স্নিগ্ধার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর প্রায় কেঁদে ফেলে বললো,” আমি পড়িনি আমার মনে হলো কে যেনো আমাকে ধাক্কা দিয়েছে।”স্নিগ্ধা আর জিম দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো।

অভ্রর চোখে মুখে ভয়। সে টিভিতে ভূতের মুভিতে এমন অনেক কাহিনী দেখেছে। অভ্র দুই হাতে নিজের কান বন্ধ করে জিমের বুকের সাথে মিশে রইলো। জিম অভ্রকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো তারপর স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,” এমন কিছুই হয় নি। এই বাড়িতে কে তোমাকে ধাক্কা দিবে। হয়তো এটা তোমার মনের ভুল স্পৃহা।”

স্পৃহা কাপা শরীরে চোখ তুলে তাকালো জিমের দিকে তারপর কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে নুইয়ে পড়লো।

স্নিগ্ধার বুকের ভিতরটা অস্থিরতায় ভরে গেলো। স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে বললো,” জিম তুমি এখনো এইখানে কি করছো? গাড়ী বের করো ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।”

জিম এগিয়ে এসে স্পৃহাকে তুলে ধরলো তারপর মুখে পানি ছিটা দিতে দিতে স্নিগ্ধাকে বললো,” আমি ডক্টর কে ফোন করেছি এক্ষুনি এসে পড়লো।”

স্নিগ্ধা আরো অস্থির হয়ে বললো,” না। এইভাবে হবে না। ওকে হসপিটালে নিতে হবে। জিম প্লীজ গাড়ি বের করো। আমার বোন এমনিতেই অল্পতে ঘাবড়ে যায়।”

জিম চেষ্টা করে যাচ্ছে স্পৃহার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্যে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

এবার হসপিটালে নিতেই হবে কিন্তু তা হলে স্পৃহা আর অভ্র ওদের কি হবে? সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না কারণ রিস্ক আছে। তাকে একাই স্পৃহাকে নিয়ে যেতে হবে। বাড়ির সিকিউরিটি কে আরো সচেতন করে দিয়ে যেতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই হাতে।

জিম স্পৃহাকে আবার কোলে তুলে নিলো। তারপর স্নিগ্ধাকে বললো,” আপনি বাড়িতে থাকুক। অভ্রকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। এমনিতেই ও ভীষন ভয় পেয়েছে।”এইটুকু বলেই জিম গাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো।

যেতে যেতে তার কোলে থাকা এই কিশোরী মেয়ের দিকে সে এক পলক তাকালো। গাছের শুকনো পাতার মতন নেতিয়ে পড়ে আছে এই প্রাণচঞ্চল মেয়েটি। স্পৃহার এই মুখটা হটাৎ কেনো জানি জিমের ভিতরে এক ঝড় তুললো।

স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে অভ্রকে জড়িয়ে ধরলো।ভয়ে অভ্রর হার্টবিট মারাত্মক ভাবে বেড়ে গেছে। স্নিগ্ধা প্রথমে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো তারপর অভ্রকে কোলে তুলে বললো,” ভয় পাচ্ছো কেনো তুমি ? কিছু হয় নি। এইতো তোমার খালামণি কিছুক্ষণ পর বাসায় চলে আসবে।”

অভ্র কোনো কথা বললো না স্নিগ্ধাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। স্নিগ্ধা অভ্রকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। তারপর অনেক কষ্টে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। অভ্র কিছুতেই ঘুমাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টার পর সে ঘুমিয়েছে।

জিম বের হয়েছে প্রায় এক ঘন্টা কিন্তু এখনো কোনো খবর পায় নি সে। মনের ভিতরটা কেমন জানি করছে। স্নিগ্ধা নিজের ফোন নিয়ে রুমের থেকে বেরিয়ে এলো তারপর গেষ্ট রুম পেরিয়ে যেতেই সে দেখলো রুমটায় তালা বন্ধ করে রাখা কিন্তু আজ হটাৎ এই রুমে তালা মেরে রাখা হয়েছে কেনো? সকালের ঘটনাটা তার জানা নেই। সব কিছুর মতোই এই ঘটনাটিও তার থেকে আড়াল করা হয়েছে।

স্নিগ্ধা রুমটার দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আগেই কে যেনো পিছন থেকে রুমাল দিয়ে তার মুখ চেপে ধরলো।

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here