#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২৯,৩০
#নবনী_নীলা
২৯
আদিল স্নিগ্ধার এই অবস্থা দেখে একহাতে স্নিগ্ধার গাল স্পর্শ করে অস্থির কণ্ঠে বললো,” কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছো? শান্ত হও, কোনো ভয় নেই। আমি আছি তোমার কাছে।”
স্নিগ্ধা আদিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার চেহারাটা মলিন হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে স্নিগ্ধাকে খুজে না পেয়ে কতটা চিন্তায় ছিলো সে।আদিল ব্যাস্ত হয়ে স্নিগ্ধাকে বালিশে হেলান দিয়ে বসালো।
স্নিগ্ধা খেয়াল করলো তার দুই হাতের কব্জি ব্যান্ডেজ করা। নিজেকে ছাড়াতে সে এতো অস্থির ছিলো যে কোনো কিছুই তার মাথায় ছিলো না।
স্নিগ্ধা একটু আরাম করে বসার চেষ্টা করতেই দেখলো আদিল উঠে পড়লো। তারপর টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে স্নিগ্ধার কাছে নিয়ে এলো। আদিলকে এই প্রথম এতটা চুপচাপ আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। তার কথা চিন্তা করেই কি নিজের এই অবস্থা করেছে আদিল। হটাৎ কেনো জানি স্নিগ্ধার বড্ড মায়া হলো এই ছেলেটির জন্যে।
আচ্ছা নিজের বাবার সম্পর্কে এই কথাগুলো যদি আদিল জানতে পারে? আনোয়ার সাহেবেকে আদিল যে কতটা ভালোবাসে সেটা স্নিগ্ধার জানা আছে। আচ্ছা ফাহাদের কথাগুলো কি সে সত্যি ধরে নিয়েছে? বাকিটা ভাবার আগেই আদিল গ্লাস হাতে স্নিগ্ধার কাছ ঘেঁষে বসলো। স্নিগ্ধাকে পানি খাইয়ে গ্লাসটা একপাশে রেখে দিয়ে অপলকে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধা চেষ্টা করেও সেই দৃষ্টি থেকে নিজের চোখ সরাতে পারলো না।
আদিল স্নিগ্ধার কপালের এলোমেলো চুলগুলো কানের কাছে গুজে দিয়ে হাতের কোমল স্পর্শে স্নিগ্ধার গাল ছুঁয়ে দিলো। শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললো স্নিগ্ধা।আদিল স্নিগ্ধার দুর্বল মুখটা যতবার দেখছে ততবার ফাহাদের প্রতি তার রাগটা আরো দ্বিগুণ হচ্ছে। তার প্রিয় মানুষদের প্রতি ফাহাদের এমন আক্রমনে আদিলের রাগ আর ক্ষোভ আরো বেড়ে গেছে। স্নিগ্ধার কাছে এখন সে নিজেকে সম্পুর্ন শান্ত করে এসেছে। নিজের রাগী রূপটা সে চায় না স্নিগ্ধা জানুক। কিন্তু স্নিগ্ধার আজ এই কষ্টের শাস্তি ফাহাদকে পেতেই হবে।
স্নিগ্ধা চোখ খুলে তাকালো। আদিলের দিকে তাকিয়ে হটাৎ কেনো জানি আদিলকে তার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে এই বুকে কিছুক্ষণ নিরবে নিভৃতে মাথা রেখে শুয়ে থাকে কিন্তু তার অভিমানী মন তাকে বার বার বাঁধা দিচ্ছে। আচ্ছা আদিল এতো চুপচাপ কেনো কিছু বলছে না কেনো? আদিলের খাপছাড়া কথাগুলো আজ কথায় মিলিয়ে গেছে?আদিলকে এতো চুপচাপ থাকতে দেখে স্নিগ্ধা নিরবতা ভাঙলো তারপর বললো,” স্পৃহা কোথায়? ও কেমন আছে? আর অভ্রকে দেখছি না কেনো?”
আদিল শান্ত ভঙ্গিতে বললো,” স্পৃহা ভালো আছে। জিম ওকে তোমার মায়ের কাছে রেখে এসেছে। অভ্র সেইখানেই আছে।”
সিগ্ধা প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলে তাকালো।সে বুঝতে পারছে না আদিল ফাহাদকে নিয়ে কিছু বলছে না কেনো? ফাহাদকে নিয়ে কিছু না বললে তো, কথাটা তাকেই তুলতে হবে যেটা তার পক্ষে খুবই কঠিন।স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করবে কি করবে না? নিজের মনকে স্থির করতে পারছে না। মনকে একটু স্থির করে জিজ্ঞেস করার আগেই জিম রুমে ঢুকে এক নজর আদিলের দিকে তাকালো তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
স্নিগ্ধা ভ্রু কুচকে তাকালো। আদিল উঠে দাঁড়াতেই স্নিগ্ধা আদিলের শার্টের অংশ শক্ত করে ধরে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। আদিল স্নিগ্ধার বিচলিত চোখ দেখে একটু ঝুঁকে এসে স্নিগ্ধার কপালে অধর ছুয়ে দিয়ে বললো,” আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি।”
আদিলের হটাৎ এমন কাজে স্নিগ্ধা বেশ লজ্জা পেলো। শার্টের বাঁধন ছেড়ে দিয়ে হাতটা নিজের কোলে গুটিয়ে নিলো। আদিল হটাৎ এমন করে বসবে স্নিগ্ধা বুঝতে পারেনি।ভেবেই এখন লজ্জা লাগছে।
আদিল রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখে জিম এগিয়ে এলো। আদিল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কি হয়েছে জিম?”
জিম বললো,” পুলিশ অফিসারের সাথে আমার কথা হয়েছে। হান্নানের ডেথ বডির তদন্তের পর তারা হান্নানের শরীরের এক ধরনের বিষ পেয়েছে, বিষটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।”
আদিল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,” বিষ এলো কি করে?”
” রুমে যেই ছুরিটি পাওয়া গেছিলো সেখানেই বিষটা ছিলো।”,জিমের কথা শুনে আদিল অবাক হয়ে বললো,” তাহলে কি সে নিজেকে নিজে? ওয়ান মিনিট,ঐ ছুরিতে কি অন্য কারোর হাতের ছাপ পাওয়া গেছে?”
জিম না সূচক মাথা নেড়ে বললো,” নাহ্। হান্নান ছাড়া আর কারো হাতের ছাপ পাওয়া যায় নি। আমার তো মনে হচ্ছে যে হান্নান জানতো ধরা পড়লে তার মুক্তি নেই।হয়তো সেই কারণেই সে ছুরিটা সঙ্গে করে এনেছিলো।”
আদিল দুই পকেটে হাত ভরে না সূচক মাথা নেড়ে বললো,” নিজেকে শেষ করা এতো সহজ না জিম। যদি নিজেকে শেষ করে দেওয়ার প্ল্যান ছিলো তাহলে সে ধরা পড়ার প্রথমেই কাজটা করতো। এর পিছনে অন্য কোনো গল্প আছে। ফাহাদ নিশ্চই বড়ো কোনো খেলা খেলেছে। সেটাই আমাদের ধরতে হবে।”
জিম মনোযোগ দিয়ে আদিলের কথা শুনলো। আদিল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” আচ্ছা, আমি নিজে একবার পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে দেখবো। তুমি এক কাজ করো। অভ্র কে নিয়ে এসো।”
___________________
স্পৃহা নিজের রুমে পা ছড়িয়ে বসে আছে। ডাক্তার তাকে হাটাহাটি করতে বারণ করেছে। দুদিন ধরে শুধু বিছানায় বসে আছে। বসতে বসতে শুয়ে পড়ছে। কি যে বিরক্তি লাগছে তার। সঙ্গে আছে এই দুষ্টু অভ্র এর এই পাজি ফরিদা আপা। নেটফ্লিক্সে একটু রোমান্টিক সিরিজ দেখবে যে তারও উপায় নেই। বসে বসে অভ্রর সাথে স্লিপিং কুইন দেখতে হচ্ছে। অভ্রর হাত থেকে রিমোটটা নিতে গেলেই সে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে। আর এইদিকে ফরিদা আপা কিছুক্ষণ পর পর খিক খিক করে হেসে উঠছে আর বলছে,” এইগুলা দেখতে তো বড়ই মজা লাগতেসে।”
তার এইসব উল্টা পাল্টা কাজ দেখে স্পৃহার বিরক্তি লাগলেও অভ্রর ভারী মজা লাগছে। সে কার্টুন দেখার মতন করে ফরিদা আপার দিকে তাকিয়ে থাকে। স্পৃহা মুখটা বাংলার পাঁচের মতন করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। হটাৎ রূমের দরজার কাছে টোকা পড়লো। শব্দ শুনে ডান দিকে তাকাতেই সে জিমকে দেখলো। আজকে জিমকে দেখতে অন্য রকম লাগছে। তাকে মোটেও ফরিদা আপার সনি টিভির সিআইডি লাগছে না। বেশ সুদর্শন লাগছে দেখতে। হটাৎ জিমকে দেখে স্পৃহা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই ফরিদা আপা উঠে দাড়িয়ে পরে বললো,” আরে আফনে? কোন সময় আইলেন?”
জিম উত্তরে কিছু বললো না। রূমের ভিতরে প্রবেশ করতেই স্পৃহার দিকে চোখ গেল তার। ঢিলে ঢালা টি শার্ট আর পায়জামা পরে পায়ের উপর পা তুলে বিছানায় বসে আধ সোয়া অবস্থায় আছে সে। পায়জামা আর টি শার্টে স্ট্রবেরির প্রিন্ট করা, এলোমেলো চুল। বলা বাহুল্য খুবই লজ্জাজনক পরিস্থিতে পড়তে হলো তাকে। কিন্তু সেই লজ্জা স্পৃহা মুখে প্রকাশ করলো না। পা নামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসার চেষ্টা করলো। এখন হুড়মুড়িয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই উল্টে হাসির পাত্র হতে হবে তাকে। যা মান সম্মান যাওয়ার ছিলো তা যখন চলেই গেছে আর সে কি করবে।
অভ্র জিমকে দেখে বিছানায় লাফাতে লাগলো। জিম স্পৃহার দিকে মৃদু হেসে তাকালো। তারপর অভ্রকে বললো,” চলো চ্যাম্প তোমাকে নিতে এসেছি। ফটাফট তৈরি হয়ে নাও।”
অভ্র খুশিতে নাচতে নাচতে বললো,” ঠিক আছে। ” বলেই হটাৎ তার কি যেনো মনে পড়লো। অভ্র ফরিদার কাছে ছুটে গিয়ে বললো,” নানু বলেছে আমাকে বাগানের ফুল দিবে। চলো আমাকে নানুর কাছে নিয়ে চলো।”
ফরিদা আপা ফ্যাল করে হেসে উঠলো তারপর বললো,” আইচ্ছা। চোলো।”
অভ্র রীতিমতন ফরিদা আপাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। এই ঘরে এখন শুধু স্পৃহা আর জিম। জিমের দৃষ্টির আড়ালে স্পৃহা পায়জামাটা আরেকটু নিচে নামিয়ে দিয়ে এক দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে যে তার কি পরিমাণে লজ্জা লাগছে শুধু সেই জানে। তাকে যে মারাত্মক পাগলের মতন দেখাচ্ছে সেটা সে ভালো করেই জানে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
জিম স্পৃহার দিকে ফিরল তারপর বিছানার একপাশে বসলো। স্পৃহা নিজের চোখ মুখ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কারণ জিম তার একেবারেই সামনে বসে আছে। তার একবার পলক ফেলাও এখন মুশকিল কারণ সবকিছু এখন জিমের দৃষ্টিতে ধরা পড়বে।স্পৃহা টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুঝতে পারছে জিম তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিশ্চই তাকে দেখে মনে মনে মজা নিচ্ছে সে। ভেবেই তার ভীষন রাগ লাগছে। স্পৃহা রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে দিয়ে কড়া চোখে জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?”
স্পৃহার কথায় জিম ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো তারপর বললো,” কিছু না। তারপর? তুমি কেমন আছো? পায়ের ব্যাথা আছে?”
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো তারপর বললো,” পায়ের ব্যাথা কেমন আছে জেনে আপনি কি করবেন? আপনি কি ডাক্তার?”
জিম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” এই জন্যেই তোমার সাথে ভালো করে কথা বলা যায় না। সব কিছুতেই তোমার তেরামি করতে হবে।”
স্পৃহা আড় চোখে তাকিয়ে থেকে মুখ বাকালো। তারপর বললো,” আমি যখন তেরামি করি তাহলে এসেছেন কেনো আমার কাছে? দুদিন পর খুব এসেছে আমার খোঁজ নিতে।” কথা গুলোর মাঝে কোথাও যেনো অভিমানী সুর খুঁজে পেলো জিম।
জিম আর কিছু বললো না। উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো,” আচ্ছা, তোমার ফোন কোথায়?”
স্পৃহা আবারো আড় চোখে তাকালো। হটাৎ জিম তার ফোনের খোঁজ করছে কেনো? মা তো সেই দিনই স্পৃহার ফোন জমা রেখেছে কারণ রাতে না ঘুমিয়ে সে ড্রামা দেখছিলো। যতদিন না পা ঠিক হচ্ছে মা বলেছে ফোন ফেরত দিবে না। স্পৃহা জিমের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই জিম অভ্রর ডাক শুনতে পেলো। অভ্র ডাকছে। জিম স্পৃহার দিকে এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে একটা কিটক্যাট বের করে স্পৃহার পাশের টেবিলের রেখে চলে যেতেই স্পৃহা অবাক হয়ে পিছু ডেকে বললো,” এইটা আপনি আমার টেবিলে রেখে যাচ্ছেন কেনো? আমার এইসব লাগবে না। আমি কি বাচ্চা নাকি?”
জিম হালকা হেসে পিছনে তাকিয়ে বললো,” ওটা তোমার জন্যে না।”
উত্তর শুনে স্পৃহার গা জ্বলে উঠলো। তার জন্যে না তো তার ঘরে এনে রেখেছে কেনো? তার টেবিলে রেখে গিয়ে বলছে তোমার জন্যে না। ইচ্ছে তো করছে লোকটার মাথা ফাটিয়ে দেয়। জিমকে প্রশ্ন করার আগেই সে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। স্পৃহার আর প্রস্ন করা হলো না। ভ্রূ কুচকে কিটক্যাটের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। হটাৎ এক বসন্তের মিষ্টি বিকেলের এক ভালোলাগাময় বাতাস যেনো তার মনকে প্রস্ফুটিত করলো।
মনের মধ্যে কে যেনো বলে উঠলো,” আরে তোর জন্যেই এনেছে রে বোকা মেয়ে।”
[ #চলবে ]
#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৩০
#নবনী_নীলা
স্পৃহা হাত বাড়িয়ে চকলেট নেওয়ার আগেই তার মা রুমে এলেন। স্পৃহা চোরের মতন হাত দুটো গুটিয়ে কোলে রেখে দিয়ে হাসি মুখে মায়ের দিকে তাকালো। আয়েশা খাতুন এসে স্পৃহার পাশে বসে বললেন,” শোন আমি জিমের সঙ্গে একবার তোর আপুর বাড়িতে যাবো। মেয়েটাকে গিয়ে দেখে আসি নয়তো আমার মন শান্ত হবে না। তোর বাবা অফিস থেকে ফিরলে বলবি যে আমি তোর আপুকে দেখত গেছি। আর আমি চলে যাওয়ার পর যেনো না শুনি তুমি বিছানা থেকে এক পা বাড়িয়েছ! কিছু লাগল ফরিদাকে বলবি।”
স্পৃহা ভদ্র মেয়ের মত মায়ের সব কথায় মাথা নেড়ে গেল। আয়েশা খাতুন তবুও বিশ্বাস করলেন না। ছোট মেয়েটা যে কত দুষ্টু সেটা তার জানা আছে।
গম্ভীর গলায় বললেন শুধু মাথা নাড়লে হবে না। আমি যেন এসে তোমাকে এইখানেই দেখতে পাই বুঝতে পেরেছো?
স্পৃহা কুঁচকে ফেলল তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। সে বুদ্ধি খাটিয়ে মাকে বলল, “তুমি আমাকে ফোনটা দিয়ে যাও, তাহলে তুমি যা বলবে আমি সেটাই করব। ফোন হাতের কাছে না থাকলে আমি তোমাকে কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছি না।’
আয়েশা খাতুন ফরিদাকে দিয়ে স্পৃহার কাছে মোবাইল পাঠিয়ে দিলেন। তারপর তৈরি হয়ে জিমের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়লেন। এতোক্ষণ জিমকে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে হয়েছে। স্পৃহা ফোন পেয়ে খুশিতে আত্নহারা। ভাগ্যিস ওই রোবটটা ফোনের কথা মনে করালো নয়তো এই বুদ্ধিটা মাথায় আসতো কি করে।স্পৃহা ফোন অন করতেই দেখলো চার্জ নেই। গাল ফুলিয়ে বিছানার পাশের চার্জারে ফোনটা লাগিয়ে একপাশে রেখে দিয়ে রিমোট হাতে নিয়ে মনের সুখে টিভি দেখতে লাগলো।
___________________
স্নিগ্ধা রুমে চুপচাপ হয়ে বসে আছে। ফাহাদের বলা কথাগুলো সে মাথায় সাজিয়ে উঠতে পারছে না। আরোহী আদিলের বোন আর অভ্র ফাহাদ আর আরোহীর সন্তান। তাহলে আদিল কেনো অভ্রকে নিজের পরিচয়ে বড়ো করছে।কেনো বলছে যে অভ্র তার সন্তান?
ফাহাদকে অপছন্দ করে শুধু এই একটি কারণেই এতো বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে। আর ফাহাদই বা কেনো অভ্রকে নিজের কাছে রাখতে চাইছে না। এই কথাটা ভাবতে ভাবতে স্নিগ্ধার মনে পড়লো ফাহাদের করা প্রশ্নটা যে অভ্র কার সন্তান? হ্যা! শুরুতেই তো ফাহাদ তাকে এই প্রশ্নটা করেছিল। তাহলে কি ফাহাদ জানে না যে অভ্র তারই সন্তান? এর জন্যেই কি আদিল এতো লুকোচুরি করছে অভ্রর পরিচয় নিয়ে, আরোহীর পরিচয় নিয়ে।
স্নিগ্ধার এখন সবচেয়ে বড় কৌতূহল আনোয়ার সাহেবেকে নিয়ে। কোথায় উনি? সেই যে পাহাড়ে গিয়েছেন লোকটার ফেরার নাম নেই। স্নিগ্ধা তাকে নিয়ে এতো খারাপ কল্পনাও করতে পারছে না।
আর আদিল তার কি সবটাই অজানা? ফাহাদের সাথে অন্যায় হয়েছে জেনেও সে ফাহাদকে এতো ঘৃনা করে?কিসের এত জেদ তার? কি আনন্দ পাচ্ছে একটা শিশুকে তার বাবার কাছ থেকে সরিয়ে রেখে। নাকি আদিল ও নিজের বাবার মতন চিন্তা করে। তাহলে তাকে বিয়ে করলো কেনো সে?
স্নিগ্ধা নিশ্চই তার কাঙ্ক্ষিত মেয়েটি নয় কারণ তার থেকেও অনেক রুপবতী আর গুণবতী মেয়েকে সে অনায়াসে বিয়ে করতে পারতো। তাহলে এতো কিছু করে তাকেই কেনো বিয়ে করলো সে?
যদি সত্যিই ভালোবাসতো তাহলে তো তাকে সবটা জানাতো। এইটুকু বিশ্বাস কি তাকে করা যেতো না? নাকি সেদিনের মিডিয়ার প্রচার করা সেই মিথ্যে কথাটাকে সত্যি প্রমাণ করতে এইসব করেছে সে।
অভ্রর সত্যিটা আড়াল করতেই কি তাকে বিয়ে করেছে আদিল? হয়তো সেটাই। কারণ তার মতন এমন সাধারণ মেয়েকে আবরার ফাইয়াজ কেনো বিয়ে করতে যাবে? আবরার ফাইয়াজের জীবনে হয়তো অন্য কেউ আছে। থাকাটাই কি স্বাভাবিক নয়?
এইসব চিন্তার মাঝেই আদিল একটা ট্রে হাতে খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো। স্নিগ্ধা নিশ্চুপে চেয়ে রইলো। ট্রে টা স্নিগ্ধার পাশে রেখে আদিল বললো,” তোমার শরীর এখন দুর্বল তাই তোমাকে ঘন ঘন খাবার খেতে হবে। তাই চটজলদি খাবারটা শেষ করো।”
স্নিগ্ধা খাপছাড়া ভাবে বললো,” আমি খেলেই বা কি এমন হবে?”
স্নিগ্ধার কথা আদিল ঠিক ধরতে পারলো না। তার কপালে হালকা ভাজ পড়লো। তারপর কিছু একটা ভেবে স্নিগ্ধার পাশে বসে বললো,” না খেলে সুস্থ হবে কি করে।”
স্নিগ্ধা কাঠ গলায় বললো,” আমাকে নিয়ে আপনি না হয় আর নাই বা ভাবলেন।” স্নিগ্ধার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ধনুকের মতন আদিলের হৃদয়ে বিধলো।
আদিল বুঝতে পারছে ফাহাদ স্নিগ্ধাকে কিছু তো বলেছে। নিশ্চই স্নিগ্ধা জেনে গেছে অভ্র তার বোনের সন্তান। আরো কি কি বলেছে ফাহাদ সেসব বেশ আন্দাজ করতে পারছে সে। স্নিগ্ধার রাগ হওয়াটা তাই স্বাভাবিক কিন্তু এতে করে তাদের মাঝে আরো দুরত্ব বারুক সেটা সে চায় না।
আদিল শান্ত গলায় বললো,” তোমার ভুল হচ্ছে তোমাকে নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি আমাকেই নিয়ে ভাবছি কারণ তোমার সুস্থ হয়ে উঠাটা আমার জন্যে প্রয়োজন। আমাকে ভালো থাকতে হলে তো তোমাকে ভালো হয়ে উঠতেই হবে।”
সুপের বাটি ট্রে থেকে হাতে নিয়ে স্নিগ্ধার দিকে এক পলক তাকালো আদিল।
আদিলের কথাগুলো এবার আর স্নিগ্ধা নিজের মন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিলো না। মন থেকে তার দূরত্ব আরো বেড়ে গেছে। স্নিগ্ধা অভিমানী নয়নে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধার এই চোখের ভাষা পড়তে একটুও কষ্ট হলো না আদিলের সে জানে স্নিগ্ধা কি শুনতে চায়। তবুও সেই কথাগুলো বলার সময় এখনও আসেনি। আদিল বুঝেও চোখ নামিয়ে ফেললো তারপর চামচে করে ফু দিয়ে ঠান্ডা করে সুপটা স্নিগ্ধার মুখের কাছে নিতেই অভিমানী মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তার চোখের ভাষা কঠিন।
আদিল হাল ছাড়লো না কোমল গলায় বললো,” আমার ভালো থাকার কথা নাই বা ভাবলে। তোমার মা তোমাকে দেখতে আসছে তার কথাটা তো ভাবো।তোমাকে এমন দেখতে কি তার ভালো লাগবে?”
স্নিগ্ধার মন নরম হলো না। সে অন্যদিকে এক মনে তাকিয়ে আছে। আজ আর তাকে ভোলানো সম্ভব নয়। যতদিন না আদিল তাকে সবটা বলছে সে কোনো কথা শুনবে না।
____________________
স্পৃহা ফোন হাতে নিয়ে অবাক একটা নাম্বার থেকে এতোগুলো কল এসেছে তার ফোনে? বাপরে! কার এতো মনে পড়ছিল তাকে? স্পৃহা ফোনটা চার্জার থেকে খুলে সেই নাম্বারে কল করলো।
জিম সবে ড্রয়িং রুমে এসে বসেছে। চোখ বন্ধ করে সোফায় গা হেলিয়ে দিতেই তার ফোন বেজে উঠলো। জিম বিরক্তি নিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো তারপর রিসিভ করে বললো,” হেলো! কে?”
স্পৃহা জিমের কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পেরেছে যে এটা সেই রোবোটিক মানুষ। কি আশ্চর্য! তার নাম্বার লোকটা মোবাইলে সেভ করেনি? স্পৃহা রেগে গিয়ে বললো,” হেলো কে? এইটা কেমন কথা? আপনি নিজে আমাকে এতোগুলো কল দিয়ে এখন জিজ্ঞেস করছেন হেলো কে?”
এমন খিটখিটে কণ্ঠস্বর শুনে জিমের বুঝতে বাকি রইলো না ফোনের ওপাশে কে। জিম তপ্ত নিশ্বাস ফেললো তারপর চুপ করে রইলো।
স্পৃহা জিমকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো,” আমাকে এতোগুলো কল দিয়ে এখন মুখে তালা মেরে বসে আছেন কেনো? কি জন্যে এতো কল করেছেন বলুন।”
জিম বেশ বিব্রত হয়ে ফোনের দিকে তাকালো। কি বলবে সেটা মনে মনে গুছাতে চেষ্টা করলো কিন্তু ঠিক পেরে উঠলো না। আমতা আমতা করে বললো,” অভ্রর জন্যে কল করেছিলাম। তোমাদের বাড়িতে ছিলো সে কারণেই চিন্তা হচ্ছিলো।” বলেই নিরবে একটা নিশ্বাস ফেললো সে।
” ও আচ্ছা? শুধু এই জন্যেই কল করেছিলেন বুঝি?” সন্দেহের কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো স্পৃহা।
জিম চুপ করে রইলো। হটাৎ কেনো জানি ভীষন নার্ভাস লাগছে তার। ফোন হাতে সে দাড়িয়ে পড়লো তারপর দুই আঙ্গুলে কপাল ঘষে বলল,” ঠিক তা না!”
স্পৃহা জিমের কণ্ঠ শুনে বেশ মজা পেলো। লোকটা কি ঘাবড়ে গেছে নাকি? স্পৃহা আরো ভয় দেখতে বললো,” ঠিক তা না তো, ঠিক কি?”
জিম অপ্রীতিকর একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে গেলো। স্পৃহার খোঁজ নিতেই সে ফোন করেছিলো কিন্তু এই সত্যিটা সে কেনো জানি মুখে বলতে পারছে না। নিজেকে কেমন যুক্তিহীন মনে হচ্ছে। একটা মেয়েকে সে কেনো এতবার কল করলো। শুধু সে কেমন আছে একবার জানার জন্যে? কথাগুলো ভেবে জিম নিজেই অবাক। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কল কেটে দিয়ে পুনরায় সোফায় গা হেলিয়ে বসলো সে। দুহাতে কপালের অগ্রভাগ ধরে চিন্তা করতে লাগলো সে।
স্পৃহা হটাৎ জিমের এমন কাণ্ডে বেশ ক্ষিপ্ত হলো। আশ্চর্য! এইভাবে একটা মেয়ের মুখের উপর কল কেটে দিলো লোকটা? কতো বড় অপমান!
[ #চলবে ]