#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৩
#নবনী_নীলা
স্নিগ্ধা আস্তে আস্তে চোখ চোখ খুললো। কিন্তু তার উঠতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও বেশ শক্তি জুগিয়ে উঠে বসতে বসতে খেয়াল করলো কেউ যেনো তার রুমে চেয়ারে বসে আছে। স্নিগ্ধা হাত দিয়ে চোখ ডলে ভালোভাবে তাকাতেই চমকে উঠলো। এই লোকটা তার বাড়িতেও চলে এসেছে। নাকি সে ভুল দেখছে। স্নিগ্ধা পাশে তাকিয়ে আরো বেশি চমকালো। তার পাশে সেই ফুটফুটে বাচ্চাটি থুতনির নিচে দুই হাত রেখে ঠোঁট উল্টে বসে আছে।
এরা তার ঘরে কি করছে? স্নিগ্ধা একবার বাচ্চাটির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে। আদিল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ স্নিগ্ধার দিকে। স্নিগ্ধা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে বিস্ময় নিয়ে বললো,” আপনি এইখানে কি করছেন? আমার ঘরে এলেন কি করে?”
আদিল মৃদু হেসে দরজার দিকে ঈশার করে বললো,” দরজা দিয়ে।” আদিলের জানে কথাটা শুনে স্নিগ্ধা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাবে আর সেটাই হলো। স্নিগ্ধার রাগ যেনো আকাশ ছুঁয়েছে। সে বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” একদম ফাজলামো করবেন না আমার সাথে।”
পরক্ষনেই ছোটো ছেলেটির হাসির হাহা শব্দটি কানে ভেসে এলো তার। স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বাচ্চাটি আদিলের দিকে তাকিয়ে বললো,” এশকে বকে দিছে।”
আদিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অভ্রর দিকে তাকিয়ে মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকার ইঙ্গিত করলো কিন্তু এতে লাভ হলো না অভ্র জিভের প্রান্তভাগ বের করে ভেংচি কাটলো। স্নিগ্ধা হতাশ হয়ে এদের দুজনকে দেখছে। এর মাঝেই জিম ঘাম মুছতে মুছতে দরজায় টোকা দিলো। আদিল ভ্রু কুচকে তাকাতেই জিম বাইরে আসার জন্যে তাড়া দিলো। জিমকে দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে তার। তাই সে উঠে দাড়ালো তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
স্নিগ্ধা হা করে তাকিয়ে আছে। এরা সবাই তার বাড়িতে কেনো? আর কত ঝামেলা বাধিয়েছে কে জানে। আর কিছু সে চিন্তা করতে পারছে না। কোনো কিছুই এখন তার হাতে নেই। তাই যা হবার হবে। কিন্তু সুযোগ পেলে এই আবরার ফাইয়াজকে যদি নাস্তানাবুদ না করেছে তার নাম স্নিগ্ধতা তাসনিম নয়।
স্নিগ্ধা পাশে বসে থাকা বাচ্চাটির দিকে তাকালো।তারপর কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলো,” তুমি এই বাসায় কি করে এসেছো?”
অভ্র গাল ফুলিয়ে বললো,” আমাকে তুলে এনেছে।”
স্নিগ্ধার ভীষন মায়া লাগলো বাচ্চাটিকে দেখে। স্নিগ্ধা টেনে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বললো,” কি নাম তোমার?”
অভ্র হেসে উঠে বললো,” পিকাচু।” স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,” কিঃ পিকাচু!” অভ্র ঘন ঘন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো যে তার নাম পিকাচু। স্নিগ্ধা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো।কেনো জানি সবার কথা, সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো। ভালো লাগছে না আর সবাইকে নিয়ে ভাবতে।
আদিল বেড়িয়ে আসতেই জিম টানতে টানতে তাকে একপাশে নিয়ে এলো। আদিল অবাক হয়ে বলল,” কি হয়েছে?”
জিম আশেপাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিচু গলায় বললো,” স্যার, আপনার বাবা নাকি এই বাড়িতে আসার উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছেন। উনি এসে পড়লে একটা মারাত্বক সমস্যা হবে। আমরা বিপদে পরে যাবো।”
আদিল ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর ব্যাস্ত হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে বললো,” দাড়াও, আমি দেখছি।” আজ এই বুড়ো একটা না একটা প্যাচ তো লাগাবেই। একে থামাতে হবে। আদিল ফোন দিতেই তার বাবা ফোনটা রিসিভ করলো। আদিল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো,” বাবা?”
ওপাশ থেকে আবরার আনোয়ার সাহেব বললেন,” হুম বলো?”
-” তুমি এখন কোথায়?”
-” এইতো মেয়েটির বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। কিন্তু তুমি কোথায়?”
আদিল সামনের চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে সরিয়ে ব্যাস্ত হয়ে বললো,” আমি আসছি। আমি আসার আগে তুমি একদম বাড়ির ভিতরে আসবে না।” বলেই কল কেটে ফোনটা পকেটে ভরে সিড়ি বেয়ে দোতলা থেকে নেমে এলো। সদর দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগেই স্নিগ্ধার মা গলা উচু করে বললেন,” এতো ব্যাস্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছো? কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নিগ্ধার বাবা অফিস থেকে ফিরবে।”
আদিল থমকে দাড়ালো। পরক্ষনেই মৃদু হেসে বললো,” বেশি দেরি হবে না। আমি এক্ষুনি ফিরে আসবো।”
আয়েশা খাতুন মাথা নেড়ে বললেন,” ঠিক আছে যাও।”
আদিল আর জিম দুজনেই বাড়ির বাইরে এসে দাড়ালো।আদিলের ভীষন রাগ লাগছে। না জানিয়ে লোকটা এমন হুট হাট কাজ করে বসে কেনো। এইসবের কি কোনো মানে হয়?
আদিল কোমরে হাত রেখে বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই তাদের একটি গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামলো। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবরার আনোয়ার। মাথা ভর্তি ধূসর রঙের চুল। এই বয়সেও সে ভীষণ ফিট। তার চোখে মুখে বয়সের ছাপ নেই বললেই চলে। প্রানবন্দ একজন মানুষ।
তিনি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন,” বাহ্, বাবার আগেই দেখি তুমি তোমার শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত। তা এই ঝামেলার মধ্যে আরেকটা পরিবারকে কি টেনে আনার কোনো প্রয়োজন ছিলো?”
আদিল তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” এটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল কি? অভ্র ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে ওকে আর কত এক বাসায় বন্দি জীবন কাটাতে হবে? সুযোগ পেলেই সে বেড়িয়ে যেতে চায়। অভ্রর আসল পরিচয় সামনে আসলে ওর কতটা বিপদ সেটা তুমি ভেবে দেখেছো?”
আনোয়ার সাহেব গম্ভির গলায় প্রশ্ন করলেন,” কি যে প্যাচ বাধিয়েছ তুমি? যাই হোক আমি মেয়েটির মা বাবার সাথে কথা বলতে এসেছি। এতেও কি কোনো সমস্যা আছে তোমার?”
” হ্যা অবশ্যই। আমি চাইবো না, তুমি উল্টা পাল্টা কিছু বলে সব কিছু ভেস্তে দাও।”, বলেই বিরক্তির নিশ্বাস ফেললো তারপর সবটা বুঝিয়ে বললো।
আনোয়ার সাহেব হেসে বললেন,” মনে হচ্ছে প্রথম দেখায় মেয়েটির প্রেমে পরে গেছিস।” বলতে বলতে তিনি বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। জিম ঠোঁট চেপে নিজের হাসি থামলো।
আদিল তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে জিমের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,”হোয়াই আর ইউ লাফিং?” বলেই কড়া চোখে তাকিয়ে বাড়ির ভিতরে এলো।
আনোয়ার সাহেব বাড়ির ভিতরে আসতেই আয়েশা খাতুন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মানুষটাকে তার খুব চেনা চেনা লাগছে। এর মাঝেই আদিল এসে উপস্থিত হলো আয়েশা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বললো,” ইনি আমার বাবা।”
⭐ আয়েশা খাতুন করিডোরের এক প্রান্তের বেতের সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন। কাজের মেয়েটিকে পাঠিয়েছেন আদিল নামের ছেলেটিকে যেনো ডেকে এনে।
আদিল ঠিক বুঝতে পারছে না, তাকে কি জন্যে ডাকা হয়েছে। আয়েশা খাতুন হাতের ইশারায় তাকে তার সামনের সোফায় বসতে বললেন। আদিল সেটাই করলো। আদিলের মনে হচ্ছে স্নিগ্ধার মায়ের সন্দেহ বেড়েছে তাদেরকে নিয়ে।
আয়েশা খাতুন কঠিন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,” মানুষ চিনতে আমি কখনো ভুল করি না। তবে আজ করে ফেলেছি। তোমার বলা প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেই ভুলটা করেছি।”আদিল এতটুকু শুনেই চোয়াল শক্ত করে ফেললো। তার বুঝতে আর বাকি রইলো না।
আয়েশা খাতুন আরো বললেন,”প্রাথমিক উত্তেজনায় ছিলাম, তাই তখন এতো কিছু কিভাবে ঘটেছে আমি সেটা জানতেই ব্যাস্ত ছিলাম। ঘটনা গুলো আদও ঘটেছে কিনা সেটা নিয়ে আমার মনে কোনো প্রশ্ন জাগেনি। প্রস্ন জেগেছে অভ্র নামের ওই ছোট্ট শিশুটিকে দেখে। বাচ্চাটা খুব সুন্দর কিন্তু আমার মেয়ের সাথে তার কোনো মিল আমি খুজে পাই নি। আর মা হয়ে আমি নিজেও কিছু কথা ভুলে গেছিলাম। যাই হোক তুমি সারা পৃথিবীকে ফাঁকি দিলেও একজন মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না।”
আদিল নিরবে শুনছে। সে জানে সে ভুল করছে, তবে একটি জীবন বাঁচাতে ভুল করছে। তাই এই ছোট ছোট ভুল গুলো সে গোনায় ধরছে না। অভ্র কোনো ক্ষতি সহ্য করা তার পক্ষে কঠিন।
আয়েশা খাতুন ভারী কণ্ঠেই বললেন,” তবুও বলবো তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তোমার বাবা আমার খুব পরিচয় সে কারণে নয়। তোমাকে ঠিক কি কারণে আমার পছন্দ সেটা আমি নিজেও বোঝার চেষ্টা করছি। কি বলো তো কিছু জিনিষ আমার বা তোমার হাতে থাকে না। যা লেখা থাকে সেটা মেনে নিতেই আমরা বাধ্য। জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিনটাই বিধাতার লিখন।
আমি যত বড় স্কুলের প্রিন্সিপাল হই না কেনো? দিন শেষে আমিও এখন মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিণী। আমার মেয়েকে কোনো লাঞ্ছনা সহ্য করতে আমি দিবো না। লোকে তার দিকে আঙুল তুলুক সেটা আমি চাই না। তাই কাল তোমাদের কাজী ডেকে খুব গোপনেই বিয়েটা সেরে ফেলবো।”
আদিল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। সামনে বসে থাকা এই মহিলাকে দেখে সে খুবই একরোখা জেদী মনে করেছিলো। কিন্তু তার এই স্নেহময়ী মাতৃরূপে সে রীতিমত মুগ্ধ। নিজের মায়ের কোনো কথা তার মনে নেই ঠিক কিন্তু সামনে বসে থাকা এই ভদ্র মহিলাটিকে দেখে তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়লো। আদিল মৃদু হেসে বললো,” আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আপনার মেয়ের কোনো ক্ষতি হতে দিবো না।”
আয়েশা খাতুন বিশ্বস্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,” আমার মেয়ের কিছু হলে তো, তোমাকে আমি আমার আসল রূপ দেখাবো। শুধু তো ভালোটাই দেখছো। চরম খারাপ দেখোনি।”
আদিল মুখের হাসি আরো প্রশস্ত করলো। আজ তার আফসোস হচ্ছে। তার মা বেচেঁ থাকলে হয়তো তার দিদি এভাবে তাদের ছেড়ে চলে যেতো না। মা না থাকার ঘাটতিটা সে আজ আরো বুঝতে পারছে।
⭐ অভ্র জেদ ধরেছে সে আজ কিছুতেই আদিলের সাথে ফিরবে না। সে স্নিগ্ধার কাছেই থাকবে। আনোয়ার সাহেব ফিচেল হাসি দিয়ে তাকালেন। অভ্র বাড়িতে সারাদিন একা একা কালো কোট পড়া সিকিউরিটির সাথে থেকে থেকে এতো বড় হয়েছে। আজ হটাৎ এতো মানুষ দেখে তার খুশির শেষ নেই।
আনোয়ার সাহেবের বেশ ভালো লাগছে।স্নিগ্ধা মেয়েটি বড় মায়াবী। যদিও মেয়েটির চোখে মুখে হতাশা আর বিষণ্ণতা স্পষ্ট। ভেবেই খারাপ লাগছে মেয়েটিকে কতো ঝড় ঝাপটার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
অভ্র স্নিগ্ধার হাত শক্ত করে ধরে দাড়িয়ে আছে। আদিল তখন থেকে এক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা সেটা ভালোই বুঝতে পারছে। লোকটা এতো বেহায়া তার জানা ছিলো না। এতো মানুষের সামনে কি সুন্দর তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটার সব প্ল্যান ভেস্তে গেছে কিন্তু তাতেও তার কোনো লজ্জা নেই। স্নিগ্ধার হটাৎ কেনো জানি মনে হচ্ছে আদিল তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
স্নিগ্ধা খেয়াল করেছে আদিল তার দিকে এভাবে তাকালেই তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। কিন্তু কেনো? ভয়ে!
স্নিগ্ধা আড় চোখে আদিলের দিকে তাকাতেই আদিল চোখে হাসলো। সে হাসিতে স্নিগ্ধার গা জ্বালা করছে।
চলবে…