#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৩৩,৩৪
#নবনী_নীলা
৩৩
হাসপাতালে স্নিগ্ধা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল বিষয়গুলোকে খুব সহজ ভাবে নেওয়া। সে কল্পনাও করতে পারেনি সবকিছু কতটা জটিল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে ফাহাদ।কিছুক্ষণ আগে তার অস্ত্রোপচারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ডান পায়ের বুলেটটি অপারেশনের মাধ্যমে বের করে নিয়ে আসা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বেরিয়ে বললেন যে চিন্তার কোনো কারণ নেই। অস্ত্রোপচারের কাজ সফল হয়েছে কোনো ঝুঁকি নেই।
এবার কিছুটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে। ঘটনার আবির্ভাব কিভাবে হয়েছে?
নিতান্ত প্রয়োজনেই স্নিগ্ধা ব্যাকুল হয়ে ফাহাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। ফাহাদের ফোন নাম্বার পাওয়া গেলেও কোনো ভাবেই সে ফোন তুলছে না। বার বার চেষ্টা করেছে কিন্তু সম্ভব হয় নি।
স্নিগ্ধা খবর খুব কম দেখে বললেই চলে। কিন্তু সেদিন কিচেনে যাওয়ার সময়ে খবরের কিছু কথা তার কানে আসে। পুরোটা সে বুঝতে পারে না তবে পুরোটা জানার কৌতূহল বাড়লো তার। এই বাড়িতে অভ্র ছাড়া আর কাউকে কখনো সে টিভি দেখতে দেখে নি। তাই হটাৎ আজ টিভিতে নিউজ চলছে শুনতে পেয়ে আগ্রহ নিয়ে সে ড্রইংরুমে আসলো।
ড্রইং রুমটা বিশাল। আদিল সোফায় আরাম করে বসেছে। একটা হাত সোফার হ্যান্ডেলে ছড়িয়ে দিয়ে অন্য হাতে কফির মগ ধরে আছে। আর ঠোঁটের কোনে সূক্ষ্ম হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। স্নিগ্ধা কোনো শব্দ করলো না। কৌতূহলী হয়ে টিলিভিশনের হেডলাইন পড়তে গিয়ে তার বিষ্ময়ের সীমা রইল না।
হেডলাইন পরে নিশ্চিত না হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে খবরটাও সে শুনলো। সম্পূর্ন ঘটনা না জানলেও সে যতটুকু বুঝেছে সেখানে এইটাই স্পষ্ট যে ফাহাদকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। বেশ বড়ো কোনো কারণ বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু কারণটা কি সেটা স্নিগ্ধা বুঝতে পারছে না।
আদিলের দৃষ্টি এতক্ষণ টিভির দিকে আটকে থাকলেও কি ভেবে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। স্নিগ্ধাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উঠে দাড়ালো। রিমোট হাতে নিয়ে টিভি বন্ধ করতেই স্নিগ্ধা মুখ খুললো তারপর শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,” ফাহাদ রেজওয়ানকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে কেনো?”
আদিল ভ্রু কুঁচকে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। ফাহাদকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে এই খবরে স্নিগ্ধা এতো চিন্তিত কেনো? আদিলের সরু কণ্ঠে বললো,” যত কৌশলেই কেউ চুরি করুক না কেনো? তাকে তো একটা না একটা সময় ঠিক কি ধরা পড়তে হয়। ফাহাদের ও সেই সময় হয়ে এসেছে।”
স্নিগ্ধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?”
আদিলের কপালে একটা ভাজ পড়েছে।চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হতেই সে থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো,” আমি বুঝতে পারছি না। যবে থেকে ওই ফাহাদ তোমাকে কিডন্যাপ করেছে তারপর থেকেই ফাহাদকে নিয়ে তোমার একটু বেশি কৌতূহল। তোমার এই অবস্থা যে করেছে তাকে নিয়ে তোমার কিসের এত কনসার্ন?”
বেশ জোর গলায় কথা শেষ করলো আদিল। তার চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ। চোয়াল শক্ত করে সে রাগ সামলাচ্ছে।
স্নিগ্ধা যেনো আদিলের এই আচরণে কিছুটা ক্ষিপ্ত হলো। কঠিন গলায় বললো,” আমার কনসার্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আর আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে লোকটা বিপদে পড়ায় আপনি বেশ খুশিই হয়েছেন।”
আদিল হটাৎ রেগে গিয়ে বললো,” অবশ্যই খুশী হয়েছি। এটা ওর সাথে আরো আগে হওয়া উচিত ছিলো। আমি তো এটাই ভেবে পাই না তুমি কেনো ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলছো? কি বলেছে তোমাকে ও? নিশ্চই বানিয়ে বানিয়ে কথা বলেছে। সেইসব বর্ণনা শুনে তুমি ওকে বিশ্বাস করেছো?” বলতে বলতে হাত দিয়ে কপালের সামনের চুলগুলো পিছনে সরিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাড়ালো আদিল।
স্নিগ্ধার অবাক লাগছে আদিলকে দেখে, অকারনেই লোকটা কিভাবে রেগে যাচ্ছে। স্নিগ্ধা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কেনো বিশ্বাস করবো না? এতদিনে আপনি তো আমাকে কিছুই বলেননি। তাই আমি যা জেনেছি সেসব কি বিশ্বাস করবো না?”
আদিল অবাক হয়ে বললো,” তাই বলে তুমি যার তার কথায় বিশ্বাস করবে?”
স্নিগ্ধা উপহাস করে ঠোটটা একটু প্রসারিত করলো তারপর বললো,” আমি তো জানি আপনি নিজেও দেশে ছিলেন না যখন এই সবটা হয়েছে। আপনি নিজেও কি অন্যের কথা বিশ্বাস করে বসেন আছেন না?”
আদিল স্নিগ্ধার কাছে এগিয়ে এসে বলল,” দিদির ডায়রি পড়ার পরও তুমি ফাহাদকে কি করে বিশ্বাস করছো? কি করে পারছো?”
স্নিগ্ধা আদিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,” শুধু একজনের ডায়রি পরে বিচার করে নিলেন লোকটা কেমন? আপনার বোন মানুষ চিনতে সত্যি এতটা ভুল করতে পারে বলে আপনার বিশ্বাস হয়? বরং আপনি এটা বলছেন না কেনো আপনি আপনার বাবার কথাটা কেই সত্যিই ভেবে বসে আছেন।”
আদিল স্নিগ্ধার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে চেনা এই চোখ হটাৎ অচেনা হয়ে উঠেছে। আদিল নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” কি বলতে চাচ্ছো তুমি? আমি আমার বাবাকে বিশ্বাস করবো না?”
” বিশ্বাস করতে কে বারণ করেছে? তবে অন্ধ বিশ্বাস করারই বা কি প্রয়োজন? ফাহাদকে তো ওনার কোনো কালেই পছন্দ ছিলো না। বিয়ের পর নাকি জেল হাজতে পাঠানোর সকল ব্যাবস্থাও তিনি করেছিলেন ফাহাদের জন্যে। পদে পদে হেনস্তাও করেছিলেন প্রচুর।” বলেই স্নিগ্ধার আদিলের চোখ মুখ দেখলো। কপাল কুঁচকে সে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা আদিলের চেহারা দেখে বললো,” কি ব্যাপার কি ভাবছেন আপনি? এইটাই কি ভাবছেন যে আপনার বোন ডায়রীতে কিছু লেখেনি কেনো? তাই না? আপনি কি খেয়াল করেছেন ডায়রির পাতায় একটা বছর মিসিং। প্রতি সপ্তাহে যে মেয়ে এক পৃষ্ঠা হলেও লিখেছে সে হটাৎ এক বছর কিছুই লিখেনি কেনো?”
আদিল স্নিগ্ধার হাত শক্ত করে ধরে একদম নিজের কাছে টেনে নিয়ে স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,” কি বলতে চাচ্ছো তুমি?”
স্নিগ্ধা এবার আর নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলো না।আদিলের চোখে চোখ রেখে বললো,” সে লিখেছে ঠিকই কিন্তু সেই লেখা কেউ না কেউ তো সরিয়ে দিয়েছে। লেখাগুলো হয়তো আপনার মনে সন্দেহের সুযোগ করে দিতো, সেই কারণেই সরিয়ে দিয়েছে। নয়তো এমন অন্ধ বিশ্বাস পাওয়া যাবে না।”
আদিল স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছে স্নিগ্ধার এই কথাগুলোর পিছনে যথেষ্ট প্রমাণ স্নিগ্ধা পেয়েছে। আদিল চোয়াল শক্ত করে স্নিগ্ধার হাত ছেড়ে দাড়ালো । তপ্ত নিশ্বাস ফেলে এদিক সেদিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,” যে আমার বোনকে ছেড়ে দিয়েছে শুধু ক্ষমতা পাবার আশায়, যার কাছে মানুষ মারাটা একটা পশু মারার সমান তার কথায় এতো বিশ্বাস তোমার?”
” কই আমাকে তো মারেনি! আমাকে মেরে ফেলাটা তো তার কাছে কোনো ব্যাপার ছিলো না। তবে ছেড়ে দিলো কেনো বলুন তো? আর মানুষ রূপের পশুদের যদি মেরেই থাকে তবে তো বেশ করেছে। আর ক্ষমতার কথা বলছেন? ক্ষমতা তো আপনাদেরও কম নেই। তাহলে তো আপনাদের ক্ষমতার দিকেই প্রথম হাত বাড়ানোর কথা তাই না?”, বলেই স্নিগ্ধা ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকালো তারপর বললো,” বাকিটা আপনার বিষয়। আপনি অন্যের কথায় বিশ্বাস করবেন নাকি নিজে যাচাই করে দেখবেন।” বলেই স্নিগ্ধা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আদিল মূর্তির মতন দাড়িয়ে রইলো। এমনটা সে সত্যি ভাবে নি। তার বাবা তাকে মিথ্যে বলবে? আর এত কনফিডেন্স নিয়ে স্নিগ্ধা কথাগুলো বলছে কি করে?
_______________________
হটাৎ এমন করে স্পৃহাকে দেখতে ছেলে পক্ষের লোক আসবে আয়েশা খাতুন বুঝতে পারেন নি। স্পৃহার বাবার বন্ধু আসিফ সাহেবের বড় ছেলে জন্যে স্পৃহাকে তারা চায়। কয়েকমাস ধরেই প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। কোনো জবাব না পেয়ে যে আজ হুট করে চলে আসবেন সেটা তিনি বুঝতে পারেন নি। হুট করে এসে বেশ বিপাকে ফেলেছে তাদের। এতো ঝামেলা একা সামলাতে না পেরে স্নিগ্ধাকে ফোন করে ডাকতেই হলো তার।
সে কারণেই স্নিগ্ধা মায়ের ফোন পেয়ে তৈরি হয়েছে। অভ্রকেও তৈরি করেছে। অভ্র এমনেই এতো কিউট দেখতে তার উপর আবার শার্ট প্যান্ট আর জুতোয় কি যে মিষ্টি লাগছে দেখতে। জুতো পড়ার পর থেকেই বিছানায় উঠে লাফ দিচ্ছে সে। লাফ দিতে দিতে বিছানায় পরে যাচ্ছে আর তখন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
স্নিগ্ধা শাড়ির আঁচলে সেফটিপিন লাগিয়ে নিজের পার্স হাতে নিলো তারপর অভ্রকে কোলে করে বিছানায় থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো,” অনেক লাফালাফি করেছো। এবার চলো আমরা যাই।”
অভ্র চোখ পিট পিট করে বললো,” কোথায় যাবো?”
স্নিগ্ধা মজার ছলে বললো,” তোমার খালামনির বরকে দেখতে।”
কথাটা শুনেই অভ্র একটা লাফ দিলো। তার খুশি আর রাখে কে? স্নিগ্ধা উঠে দাঁড়াতেই জিমকে দেখতে পেয়ে ডাকলো তারপর বললো,” আজ আমাকে একবার বাড়িতে যেতে হবে।”
জিমের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে আছে। স্নিগ্ধার কথা শুনে সে শান্ত স্বরে বলল,” আজ যাওয়াটা কি খুব জরুরী?”
” হ্যা আজই যেতে হবে।”,বলেই স্নিগ্ধা জিমের দিকে তাকালো। কাল রাত থেকে আদিল বাড়ি ফেরেনি। ফোনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই জন্যেই জিমের চোখমুখের এই দশা। স্নিগ্ধার যে চিন্তা কম হচ্ছে সেটা না। তবে সে প্রকাশ করছে না। কাল রাতে আদিল অনেক্ষন রূমে নিজের বাবার সাথে কথা বলেছে। হয়তো সেই কারণেই ……. আর ভাবতে পারছে না সে। তবে স্নিগ্ধার ধারণা আদিল ফাহাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। তার মন বলছে।
জিমের অবস্থা দেখে স্নিগ্ধা বললো,” ফাহাদকে তো পুলিশ ধরেই ফেলেছে তাহলে এখনো কিসের ভয়? নাকি আপনার বসের পারমিশন লাগবে?”
অভ্র ঠোঁট উল্টে বললো,” চলো না যাই, আমাদের যেতে দাও তাহলে তোমাকেও আমি খালামনির বরটা দেখাবো।”
অভ্রর কথায় স্নিগ্ধা হাসলো। কিন্তু জিম ভ্রু কুঁচকে বললো,” কার বর?”
স্নিগ্ধা জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” স্পৃহার কথা বলছে। স্পৃহাকে আজ দেখতে এসেছে। সেইজন্যেই আমরা যাচ্ছি।”
জিম কিছুটা অবাক হলো কিন্তু চেহারায় সেটা বেশি প্রকাশ করলো না। ” ওহ্ ” বলে থেমে গিয়ে বললো,” ঠিক আছে চলুন আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।”
তারপর বাড়ি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মুদি দোকান থেকে খবর তার কানে ভেসে আসে। পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ ফাহাদ রেজওয়ানকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। এইটুকু শুনেই থমকে দাড়িয়েছিলো স্নিগ্ধা। আর বাড়ির ভিতরে পা ফেলে নি সে। জিম অভ্রকে কোলে করে বাড়ির ভিতরে চলে যাওয়ায় পালানোর সুযোগ পেয়েছিল স্নিগ্ধা।কোনো কিছু না ভেবেই রিক্সায় উঠে পড়ল সে। তারপর এখন ঢাকা মেডিকেলে বসে আছে।
[ #চলবে ]
#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৩৪
#নবনী_নীলা
স্নিগ্ধা বেশ কিছুক্ষন বসে থেকে অপেক্ষা করলো। ফাহাদের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাইলো। পুলিশ অফিসার রাজি হলেন না। আজকে কারোর সঙ্গেই দেখা করতে দেওয়া হবে না। ফাহাদের কেবিন মানে নয় নাম্বার বেডকে ঘিরেই সবার সব কৌতূহল। দেখা করতে দেওয়া হবে না জেনেও কেনো জানি স্নিগ্ধা বসে আছে।
এই সবের ঝামেলার মাঝে স্নিগ্ধা একা একজন মেয়ে। তার কথা বা তার এই দেখা করবার ইচ্ছেটুকু কেউ বিশেষ গুরুত্ব দিলো না। খুব জোড় খাটিয়ে সে কিছু বলতেও পারছে না। একপাশে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষন।
স্নিগ্ধা দেখতে পেলো দূর থেকে কে যেনো হেঁটে আসছে এইদিকে। মুখটা স্পষ্ট নয় তবে অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। খুব স্মার্ট কোনো মেয়ে এই দিকে এগিয়ে আসছে সেটা তার পোশাক দেখে ধারণা করে নিয়েছে স্নিগ্ধা। মেয়েটি কেবিনে ঢুকার চেষ্টা করতেই নার্স তাকে থামিয়ে দিলো। পরক্ষনেই মেয়েটি অগ্নী কণ্ঠে নার্সের উপর চেঁচিয়ে উঠলো। এতে পরিবেশ আরো হযবরল হয়ে গেলো। ডাক্তার আর পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন। তর্কাতরকি শুরু হলো। এমন গরমেলে পরিস্থিতির মুখোমুখি এর কখনো হয়নি স্নিগ্ধা। তাও সে চুপ করে এক পাশে দাড়িয়ে রইলো। কিছু কিছু অস্পষ্ট কথা বার্তা ভেসে আসছিলো। এর মাঝেই একটি নাম শুনে বেশ চমকালো স্নিগ্ধা।
সুনেয়রা রেজওয়ান। নামটা শুনা মাত্রই স্নিগ্ধা কৌতূহলী হয়ে তাকালো। এই মেয়েটি কি তাহলে সুনেয়রা! সুনেয়রা রেজওয়ান মানে তো ফাহাদের স্ত্রী! তাহলে কি এই সেই যার সাথে আদিল দেখা করতে গিয়েছিলো। মনে মনে কিছুক্ষণ ভাবলো স্নিগ্ধা।
এইদিকে গন্ডগোল আরো বাড়লো। বোঝাই যাচ্ছে আজ আর কাউকে ফাহাদের সঙ্গে দেখা করতে দিবে না তারা। তাই স্নিগ্ধার এইখানে অপেক্ষা করার সম্পূর্ন বৃথা। সে আর রইলো না। মেডিকেল থেকে বেরিয়ে গেলো। একবার হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো দুপুর ঘনিয়ে এসেছে। তাই তাড়াতাড়ি একটি টেক্সীতে উঠে পড়ল সে।
গাড়ীতে বসে ফোনটা একবার হাতে নিয়েও আবার রেখে দিলো সে। আদিলকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছিলো তার। কিন্তু কেনো জানি সে ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় দিলো না। স্নিগ্ধা জানে তার এই রাগটা সম্পূর্ন অযুক্তিত তবুও তার রাগ লাগছে। একটা মানুষ কেনোই বা এতো নির্বোধ হবে? একটিবার বুঝি ফোন করে জানানো যাচ্ছে না? তার জন্যেও যে কেউ চিন্তা করবে এই কথা তার মনে হলো না? বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে স্নিগ্ধা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। গাড়ি চলছে তার গতিতে।
________________
জিম দূর থেকে ড্রইং রুমে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কারণ ছাড়াই ছেলেটিকে তার ভীষন অসহ্যকর লাগছে। অকারণে কারোর প্রতি তার এতো মেজাজ খারাপ তার এর আগে হয় নি। ছেলেটা দেখতে ভালো। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সকলের সঙ্গে সুন্দর ব্যাবহার করছে কিন্তু তবুও জিমের তাকে পছন্দ হচ্ছে না। বিরক্তি বশত সে বারান্দায় বসে আছে। তাকে ফরিদা ড্রইং রূমে বসতে বলেছিলো সে ইচ্ছে করেই ভিতরে যায় নি। থমথমে মুখ নিয়ে অনেক্ষন হলো বসে আছে।
এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ বেশ ব্যাস্ত। বাতাসে খাবারের সুভাস ভাসছে। রান্না ঘর থেকে মহিলাদের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে।
জিম বিরক্ত হয়ে উঠে দাড়ালো। সেই বিরক্তি ভরা মেজাজ নিয়ে সে ভিতরে এলো। তাকে দেখে ছেলেটি কথা বলার জন্যে সোজন্য দেখলেও জিম সেই সব অগ্রাহ্য করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। কাজটি সে সম্পূর্ন নিজ ইচ্ছেতেই করেছে।
দোতলায় উঠে সে স্পৃহার ঘরের সামনে এসে দাড়ালো। পর্দার কারণে ভিতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। জিম চুপ করে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। সে এখানে কেনো এসেছে? আর স্পৃহার ঘরের সামনেই বা কেনো দাড়িয়ে আছে? সে জানে না। নিজেকে এই প্রশ্ন করে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে গেল সে। জিম মিনিট দশেক রূমের সামনে পায়চারি করলো। হয়তো স্পৃহা বের হয়ে তাকে দেখবে। কিন্তু স্পৃহা বের হলো না। এতে মেজাজ আর মন দুটোই পৃথক আবেগে সোচ্চার হয়ে উঠলো। মনটা একটু খারাপ কিন্তু মেজাজ গরম। অগ্নি মেজাজে রূমের সামনে থেকে চলে যাওয়ার আগেই কে যেনো তার হাত ধরে টেনে রূমের ভিতরে নিয়ে গেলো।
ভিতরে এসে জিম হতবাক হয়ে তাকালো।স্পৃহা তাকে ভিতরে এনে দরজা বন্ধ করতেই বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো সে। চোখ বড় বড় করে বললো,” কি করছো কি? দরজা বন্ধ করলে কেনো?”
স্পৃহা দরজা বন্ধ করে তীক্ষ্ণ চোখে পিছনে তাকালো। তারপর রাগী গলায় বললো,” আমার আপনার সঙ্গে কথা আছে তাই দরজা বন্ধ করেছি।”
জিমের চোখে মুখে এখনো বিষ্ময় নিয়ে বললো,” কথা থাকতেই পারে কিন্তু তার জন্যে দরজা বন্ধ করতে হবে ?”
স্পৃহা এবার ভ্রু কুঁচকে ফেললো তারপর বললো,” আশ্চর্য! দড়জা বন্ধ করেছি তো কি হয়েছে? আপনি এমন একটা ভাব করছেন যেনো আমি আপনার সতীত্ব হরণ করতে আপনাকে রুমে নিয়ে এসেছি।”
স্পৃহার এমন কথায় নিজেকে শান্ত করলো। হটাৎ স্পৃহার এমন কাজে সে বিচলিত হয়ে উঠেছিল। তারপর হালকা গলা সারিয়ে বললো,” শুনলাম তোমার নাকি বিয়ে?”
স্পৃহা চোখ তীক্ষ্ণ করে আরো দুকদম এগিয়ে এসে বলল,” ও আচ্ছা। আপনি জানেন তাহলে? দিন দুনিয়ার খবর তাহলে আছে আপনার কাছে?”
স্পৃহার কথায় কেমন একটা রাগ ফুটে উঠেছে। জিম অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,” হুম্, আছে। তা বর পছন্দ হয়েছে?”
স্পৃহা আরো এগিয়ে এসে বলল,” পছন্দ হবে না কেনো? খুব পছন্দ হয়েছে।”
জিমের কপালে একটা ভাজ পড়লো সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাথা নেড়ে বললো,” হুম্ ভালো।”
স্পৃহা এতোক্ষণ নিজের রাগ দমিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু জিমের এই উত্তরে তার রাগ আরো তুমুল হলো। স্পৃহা চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে এসে জিমের কলার চেপে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো। হটাৎ দুজনেই দুজনের মুখোমুখি। ব্যালেন্স করতে গিয়ে জিম একটু ঝুঁকে দাড়ালো। স্পৃহার চোখে চোখ পড়তেই কেনো জানি হৃদয়ে এক কম্পন শুরু হলো তার। স্পৃহার দৃষ্টি তখন তীক্ষ্ণ। দাতে দাঁত চিপে সে বললো,” হুম্, ভালো। এইসব বলতে এইখানে এসেছেন? কেনো এসেছেন আপনি? আমার বিয়ে যদি আপনি না ভেঙেছেন না? আপনাকে আমি বদনাম করে ছাড়বো বলে রাখলাম।”
প্রথম দুটি বাক্য শুনে মনে একটু বসন্তের বাতাস বসলেও শেষ বাক্যটি গ্রীষ্মের কাঠ ফাটা রোদ্দুরের মতন তির্যক ভাবে তার মাথায় বিধলো। তাকে বদনাম করবে মানে? কি ধরনের কথা এইসব! জিম চোখ বড় বড় করে তাকালো তারপর বললো,” বদনাম করবে মানে কি?”
স্পৃহা একটা ভ্রু তুলে বললো,” বদনাম মানে বুঝতে পারছেন না? এইযে আমি আপনি এক ঘরে দরজা বন্ধ করে আছি। এটাই কি কম না আপনাকে বদনাম করার জন্যে?”
জিম নিজের কলার থেকে স্পৃহার হাত সরানোর চেষ্টা করে বললো,” পাগল হয়ে গেছো তুমি। আবোল তাবোল বকছো।”
” আচ্ছা। তাহলে কি করবো? এই বিয়েটা করে নিবো?”,জিমের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো স্পৃহা।
জিম ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা একটু তাচ্ছিলের সঙ্গে বললো,” করে নাও।”
স্পৃহা চোয়াল শক্ত করে দাতে দাঁত চিপে জিমের কলার আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,” আচ্ছা তাই! আর আপনি! আপনি কি করবেন? আমার বিয়েতে এসে খাসির রেজালা খাবেন? আর আমার বাচ্চা কাচ্চার মামা হবেন?”
জিম একটু হাসলো। মুচকি একটু হাসি, ক্ষুদ্র আয়তন হওয়া সত্বেও সেই হাসি যেনো স্পৃহার বুকে এক ঝড় তুললো। মুহূর্তের জন্যে থমকে তাকালো সে। জিম স্পৃহার কোমরের দুপাশে হাত দিয়ে আগলে ধরতেই। জিমের কলার থেকে স্পৃহার হাতের বাধন সহজ হলো। চেষ্টা করেও জিমের চোখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনতে পারছে না সে। স্পৃহা একটা ঢোক গিলে তাকাতেই জিম বললো,” উহু, মামা হওয়াতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তুমি রাজি থাকলে বাবা হতেই পারি।”
স্পৃহা হতবাক হয়ে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে, চোখ দুটো খুলে আসার উপক্রম হয়েছে তার। স্পৃহা ফট করে জিমের কলার থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বললো,” আ..আপনি এত নিলজ্জ সেটা তো জানা ছিলো না।”
জিম একটা ভ্রূ তুলে বললো,” হুম্, আমি নিলজ্জ্ আর তুমি খুব লজ্জাবতী।”
স্পৃহা কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো,” একদম বেশি কথা বলবেন …. না।” শেষের না টুকু বলার আগেই স্পৃহা, দরজায় টোকার শব্দে কেপে উঠলো। ছিটকে জিমের থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েও সরতে পারলো না সে। জিমের দুই হাতের বাঁধনে সে আবদ্ধ।
স্পৃহা চোখ বড় বড় জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” ছাড়ুন বলছি।” বলতে বলতেই ওপাশ থেকে স্নিগ্ধা ডেকে বললো,” এই দরজা খুল।”
স্পৃহা একটা ঢোক গিলতেই জিম বললো,” আমার নামে নাকি বদনাম ছড়াবে। এখন ভয় পাচ্ছো কেনো? তোমার সঙ্গে বদনাম হতে তো আমার কোনো ভয় নেই।” বলেই জিম ঠোঁট একটু প্রশস্ত করলো। স্পৃহা দাতে দাঁত চিপে বললো,” আপনাকে আমি পরে দেখে নিবো।আপনার এই হাসি আমি ঠিক বের করবো।”
জিম স্পৃহাকে জ্বালাতন করে ভালোই মজা পাচ্ছে।
দরজায় আরো কয়েকবার টোকা পড়লো। এইবার হাক দিলেন আয়েশা খাতুন। গলা উচিয়ে বললেন,” কিরে জলদি দরজা খুল।”
আয়েশা খাতুনের কণ্ঠ শুনে জিম ফট করে হাতের বাঁধন খুলে দূরে সরে এলো। আয়েশা খাতুনকে সে বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছে। জিমের চোখ মুখের অবস্থা নাজেহাল। এমন কিছু সে আশা করেনি সেটা তাকে দেখেই আন্দাজ করা যায়। এমন পরিস্থিতিতেও স্পৃহা ঠোঁট চেপে হাসলো তারপর বললো,” কি ব্যাপার! আপনার না আমার সঙ্গে বদনাম হতে ভয় নেই। তাহলে ঘামছেন কেনো এতো?”
#চলবে